সন্ধানে কোনও ভালো ছেলে আছে
বিধু চায়ে চুমুক দিয়ে মুখটা বিকৃত করলেন। উলটো দিকের চেয়ারে বসেছিলেন তারক। বন্ধু তারক মুখোপাধ্যায়। বিধু তারকের বাল্য বন্ধু। কিছুদিন হল দুজনেই চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। বিধুর মুখের দিকে তাকিয়ে বন্ধু তারক বললেন—কী হল হে।
—নো চিনি। আর একটু দুধ হলেও মন্দ হত না। তেতো তেতো লাগছে।
—দুধ একটু নিতে পারো তবে নো মোর চিনি। এ বয়সে চিনি কম না খেলে চিনি হয়ে মরবে।
—কিচ্ছু হবে না, তুমি হেঁকে একটু চিনি দিতে বলো আমি চিনি একটু বেশি খাই।
ঘরের ভেতরে যাওয়ার দরজার দিকে তাকিয়ে তারক চিৎকার ছাড়লেন—একটু চিনি দিয়ে যাও। একটু চিনি।
বিধুর সামনে খবরের কাগজ। তারক কাগজটাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ঘাড় হেঁট করে দেখতে লাগলেন। চোখে চশমা নেই। কম দেখেন। নাকটা প্রায় কাগজে গিয়ে ঠেকেছে। খাড়া নাক। অসম্ভব খাড়া। ভ্রূর মাঝখান থেকে সোজা নেমে গেছে ঠেঁাটের দিকে টিকোল হয়ে। যৌবনে তারকের স্ত্রী মাঝে মধ্যে নাক নেড়ে আদর করে দিতেন। অন্ধকারে বলতেন তুমি করবে কী, নাক নিয়েই তো নাকাল! তোমার নাকের খোঁচা খেতে-খেতে জীবন গেল।
সে বয়েস আর নেই। তবে নাকটা আছে। তারকের স্ত্রী এক চামচে চিনি হাতে মাথা দিয়ে পরদা ঠেলে ঘরে এলেন। পাকা পেয়ারার মতো গায়ের রং। পরনে সাদা তাঁতের শাড়ি। সামনের দিকে গোটাকতক চুল রূপোর সুতোর মতো চিকচিক করছে। শরীরটা একটু ভারী হয়েছে। তারক মাঝে মাঝে মুগ্ধ হয়ে বলেন—আহা মাতৃমূর্তি, সাক্ষাৎ জগজ্জননী। সুধা স্বামীর মুখে হাতে চেপে ধরে ছি ছি করে ওঠেন—বলতে নেই, বলতে নেই, স্ত্রীকে মা বলতে নেই।
তারক হাত-চাপা মুখ দিয়েই শব্দ বের করেন—কিছুই জানো না, স্ত্রী একাধারে সখী, বোন, মা। তোমার মধ্যে মাতৃভাব জ্বলজ্বল করছে। রোজ সকালে চণ্ডীপাঠের ফলে নারীজাতিকে আমি মাতৃভাবে দেখতে শিখছি।
ডান হাতের চামচে, বাঁ হাতটা তলায় ধরা। চিনি পড়লে হাতে পড়বে। সুধা জিগ্যেস করলেন—চিনি কার?
তারক কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললেন—বিধু। বিধুও একই সময়ে তারকের সঙ্গে বলে উঠলেন—আমার চায়ে, আমার চায়ে, আমার চায়ে। ওর তো ভেতরে সুগার, আমাকে বাইরে থেকে নিতে হয় ঠাকরান চিনি হল এনার্জি।
সুধা বিধুর কাপে চিনি গুলতে-গুলতে বললেন—আজ কি যাওয়া হচ্ছে, ঠাকরপো?
অফকোর্স! কথা দেওয়া হয়েছে না গেলে খারাপ হবে না?
তারক খবরের কাগজের ওপর চোখ রেখে বললেন—না:, কমার লক্ষণ দেখছি না।
—কী কমার? বাজারদর? সুধা স্বামীকে প্রশ্ন করলেন।
—ধরেচো ঠিক, তবে তোমার আলু কপি মাছ নয়। সোনা সোনার দর।
—সোনার দর নিয়ে তুমি মাথা ঘামাচ্ছ কেন? সে তো ভাববে মেয়ের বাপ!
—একেই বলে মেয়েদের বুদ্ধি! যত দাম বাড়বে ততই তো তোমার পাওনা কমবে গো!
—তুমি কোনওদিনই লোভী শ্বশুর হতে পারবে না। তোমার উদার স্বভাব। তবে শ্বশুর হতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। তারক ভুরু কুঁচকে স্ত্রীর দিকে তাকালেন— তার মানে? তোমার এরকম সন্দেহের কারণ। হ্যাঁ, ছেলে যদি বিয়ে করতে না চায়, অন্য কথা। আজকালকার ছেলে মেয়ে ধরে, জোর করে তো আর বিয়ে দেওয়া যাবে না।
—না, তা নয়, তবে কোনও মেয়েই কি তোমার শেষ পর্যন্ত পছন্দ হবে?
সুধা চলে যাচ্ছে, তারক হাঁ করে স্ত্রীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন—শুনলে, বিধু?
—শুনলুম ভাই।
—এরা কীভাবে বলো তো? একমাত্র ছেলে। বারবার নয় একবারই পুত্রবধূ আনব। একটু দেখেশুনে আনতে হবে তো?
তা হবে, কিন্তু তুমি যেভাবে দেখেছ, মাইক্রোসকোপ দিয়ে নতুন কোনও ব্যাকটিরিয়া দেখার মতো করে। ওভাবে দেখলে কোনও মেয়েই তোমার পছন্দ হবে না।
—তোমাদের কী জানো বিধু, তাড়াহুড়ো করে যা হোক একটা লাগিয়ে দিতে পারলেই হল। খুব খানিকটা হই, হই, রই রই হল। খেয়ে ফেলে পেট ফুলে দিনকতক পড়ে রইল। এইবার ম্যাও সামলাক যার বিয়ে যে আর তার ফ্যামিলি।
—এই নিয়ে গোটা সতেরো মেয়ে দেখলে। আজকেরটা হলে এইট্টিন কমপ্টি হবে।
—এইট্টিন কেন হ্যান্ড্রেডও হতে পারে। তোমাদের বলেইছি—আমার একটা স্পেসিফিকেশান আছে। ভেরি সিম্পল স্পেসিফিকেশান আছে—শার্প নোজ, ধারালো নাক চাই, এরিয়্যান নোজ, অনার্য নাক চলবে না, গাত্রবর্ণ গৌর হওয়া চাই, মুখটি হবে প্রতিমার মতো, দেখলেই যেন ‘মা আ’ বলে ডেকে উঠতে ইচ্ছে করে, চোখ দুটো হবে টানা টানা, সরল ইনোসেন্ট, অথচ নির্বোধ নয়, বুদ্ধিদীপ্ত, মাইসোর আইজ।
—সেটা আবার কী? মাইসোরের চন্দন আর ধূপ শুনেছি। মাইসোরের চোখটা কী জিনিস!
—মহীশূরের মেয়েদের চোখ দেখেছ, একেবারে খাঁটি পটল চেরা, এগজ্যাকট মা দুগগার মতো। মুখটাই তো শরীরের সব, ফেসই হল মনের মিনার, মুখ দেখলেই মানুষের মন, স্বভাব চেনা যায়। সেই মুখটা একটু পছন্দ করে নিতে হবে না? এ কি ভাই তোমাদের বারোয়ারি পুজো। গোলেতালে যা হোক, মা হোক একটা প্রতিমা এনে প্যান্ডেলে বসিয়ে দিলেই হল? এ হল গিয়ে সারা জীবনের পাটনারশিপ, শুধু তাই নয়, ফিউচার জেনারেশন তৈরি হবে এদের দিয়ে। বাপ মা সুন্দর হলে ছেলেমেয়েরা সুন্দর হবে। তারা সুন্দর হলে তাদের ছেলেমেয়েরা সুন্দর হবে। বাঙালিদের ক্যাডাভ্যারাস চেহারাটা পালটানোর দায়িত্ব কাদের বিধু? নির্বিচারে যার তার সঙ্গে যার তার বিয়ে দিলে ফুটফুটে ছেলেমেয়ে হবে? হবে না। তুমি কি ম্যাচ শব্দটা শোননি? আমাদের ম্যাচ মেকার্স হতে হবে।
—তাই হও ভাই, তবে তুমি যা আরম্ভ করেছ। শেষপর্যন্ত তোমার ছেলের বরাতে মেয়ে জুটলে হয়।
—কিছু ভেবো না, ধৈর্য থাকলে সবই হয়। পেডিগ্রি মিলিয়ে বিয়ে দিতে হবে। অ্যালসেসিয়ানের সঙ্গে তো লেড়ি মেলানো যায় না।
—ঠিক হ্যায়, অ্যালসেসিয়ানের সঙ্গে অ্যালসেসিয়ানই মেলাও। আমি এখন উঠে পড়লুম। বেলা তিনটের সময় রেডি হয়ে থেকো।
বিধু চলে গেলেন। ঠোঁটের কোণে এক মুচকি হাসি। তারকের মা সুন্দরী ছিলেন। তারকের বউটিও সুন্দরী। দেখা যাক তারকের পুত্রবধূ কেমন হয়। সবই ভবিতব্য। কার বরাতে কী জুটবে, বরাতই জানে। মানুষ নিমিত্ত মাত্র।
তারক খেতে বসে স্ত্রীকে বললেন, বুঝলে বিধুটা হল ন্যাজকাটা শেয়াল।
—তার মানে?
—মানে ভেরি সিম্পল। ওর ছেলেটা তো ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে এক বিশালকায়া, হিড়িম্বাসদৃশ্য রমণীকে বিয়ে করে এনেছে, বিধু চাইছে আমার ঘাড়েও ওইরকম একটি চাপাতে।
—তোমার যত তেড়াবেঁকা চিন্তা। বিধু ঠাপুরপো কখনোই তা ভাবছে না। তুমি মানুষকে বড় ছোট করো। বিধু ঠাকুরপোর ছেলের বউ কী এমন খারাপ হয়েছে? মেয়েটি ডকটরেট করেছে। ভালো গান গায়। গড়ন পেটনও ভালো। রংটাই যা একটু চাপা।
—মুখটা?
—এমন কিছু খারাপ নয়। চলনসই। তেমনি ব্যবহারটি ভারী সুন্দর।
—ওজন?
—ওজন মানে? ও তুমি বলছ মোটা? ওকে মোটা বলে না। দোহারা চেহারা।
—বিয়ের জল পড়ে গায়ে আর একটু সারবে, তখন পিপে। পিপা-কৃতি। যাই বলো আমার একটুও পছন্দ হয়নি।
—যার বউ তার যখন পছন্দ হয়েছে তুমিও বা কে আর তোমার বিধু ঠাকুরপোই বা কে? যারা সংসার করবে তাদের মিলটাই বড় কথা।
—আরে ধুর প্রেম করা বিয়ে নাইনটিপারসেন্ট মেলে না। কয়েকটা বছর যেতে দাও প্রেমের ফানুস ফ্যাট করে ফেটে যাবে।
—তুমি অত অমঙ্গল চিন্তা করো কেন? মানুষের ভালোটা ভাবতে পারো না।
—একসপিরিয়েনস! অভিজ্ঞতা! এসব দেখে শেখা। ভালো ভাবব কী করে বলতে পারো!
—কী হল ভাত ফেলে রাখলে?
—আর পারছি না। আজ আবার রেস্ট হবে না, একটু পরেই বেরোতে হবে। দেশের কী অবস্থা! একটা ভালো সর্বাঙ্গ সুন্দর মেয়ে পাওয়া যায় না।
—পাকপাড়ার মেয়েটিকে তুমি নিতে পারতে?
—পাগল হয়েছ। তার চুলের অবস্থা দেখেচ। শ্যাম্পু করে করে ঝুলঝাড়ুর মতো হয়ে গেছে। টাক পড়ল বলে।
—তোমাদের বংশে বড় রূপের বিচার। তোমার মাকে দেখেছি তো। মানুষের চেহারা তুলে বড্ড খোঁচা দিতেন। তুমি তো তাঁরই ছেলে। রূপ রূপ করেই গেলে।
—ও কথা বোলো না। বিচার ছিল বলেই তোমাকে পেয়েছিলুম। আগেকার দিনে জমিদাররা কীরকম ছিলেন জানো, দেখে দেখে সেরা সুন্দরীদের বউ করে আনতেন। জমিদার গিন্নি মন্দিরে গেছেন, কি গঙ্গায় স্নানে গেছেন, ফুটফুটে একটি মেয়ে চোখে পড়ল, অমনি মেয়ের মা, কি দিদিমাকে কথাটা পেড়ে ফেললেন—মেয়েটিকে আমার চাই, মা।
—তাহলে আমিও এইবার গঙ্গার চান ধরি। তারপর মেয়ে ধরতে না পারি কোনও পড়তি জমিদারের চোখে পড়ে যাই। শেষে তাঁর ভাঙা-ভাঙা নাচ-ঘরে। জমিদারদের তো পরস্ত্রীর ওপর লোভ ছিল শুনেছি।
তারক গণ্ডুষ শেষ করে বউয়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন—
—সে ভয়ের বয়েসটা তোমার আমার কাছেই কেটে গেছে। তোমার যৌবনে আমার কম দুশ্চিন্তা ছিল! সবচেয়ে ভয় পেতুম বিধুটাকে। ব্যাটার ডন বৈঠক মারা শরীর ছিল। কেবলই ভাবতুম বুকের ছাতি দেখিয়ে তোমাকে দুর্বল না করে ফেলে। এখন কারুরই আর তেমন ফায়ার নেই। আগুন নিবে ছাই পড়ে গেছে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তারক চুল ঠিক করছেন। এখনি বিধু আসবেন। সকালে সেই রকমই কথা হয়েছে। সামনের দিকের চুলের গোড়ায় মৃদু মৃদু পাকা বেরিয়ে পড়েছে। প্রায় একমাস হয়ে গেল। এইবার একবার কলপ চালাতে হবে। আজকে হলে ভালো হত, সময় পাওয়া গেল না। পাকা চুলে আত্মবিশ্বাস বড় খাটো হয়ে যায়। না:, বয়েসটাকে এখনও বেশ দাবিয়ে রাখা গেছে?
সুধা জলের গেলাস হাতে ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে স্বামীকে তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়া লাগালেন—মেয়েছেলেকেও হার মানালে। নাও নাও খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে বিয়ে তোমার ছেলের নয় নিজের।
তারক আয়না দিয়ে সুধার দিকে তাকিয়ে বললেন—পহেলে দর্শনধারী পিছে গুণ বিচারি। সারা জীবন সেলসে চাকরি করে সার বুঝেছি, চেহারা নিয়ে আগেই কিস্তিমাত, তারপর অন্য কথা।
—তুমি কি মাল বেচতে যাচ্ছ। তুমি তো যাচ্ছ মেয়ে দেখতে।
—যেখানেই যাই আমার তো একটা ইমেজ আছে গো।
—নিশ্চয়ই আছে, তুমি যে আমাদের তারকচন্দ্র। দরজাগোড়ায় দাঁড়িয়ে বিধু উত্তর দিলেন।
—ও এসে গেছ। এ কী হল?
—কী আবার হল?
—তোমার কাপড়ের সঙ্গে যে পাঞ্জাবির রং মিলল না!
—কার মেলে ভাই? তুমি একটা লোক দেখাও যার পাঞ্জাবি আর কাপড় একই রকম সাদা!
—আমাকেই দ্যাখো। তারক কোঁচা ঝাড়তে-ঝাড়তে বন্ধুর সামনে এসে দাঁড়ালেন।
—নাও খুব হয়েছে। এখন চলো দুগগা বলে বেরিয়ে পড়ি।
মেয়ে স্কুলের ছুটি হয়েছে। দুই বন্ধু সেজেগুজে রাস্তার এক পাশ দিয়ে গুটি গুটি বাসস্টপের দিকে এগিয়ে চলেছেন। রাশি রাশি মেয়ে নীল শাড়ি সাদা ব্লাউজ পরে পিলপিল করে দুপাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। হাসি গল্প গায়ে ঢলে ঢলে পড়া। কিচির মিচির, পাল পাল মেয়ে। পেছন দিক থেকে আসা স্রোতে দুই বন্ধু প্রায় ভেসে চলেছে। রাস্তা কিছুটা হালকা হতে তারক বিধুকে আক্ষেপ করে বললেন, দেখেছ বিধু, বাঙালি মেয়েদের কী অবস্থা? একটারও ভালো নাক নেই? মুখের ওপর থ্যাবড়ানো বাড়ির মতো অ্যাতোখানি জায়গা জুড়ে ভোঁতা মেরে পড়ে আছে। কোনটার গণ্ডারের মতো, কোনওটার হিপো-পোটমাসের মতো, কোনওটার শূকরের মতো। একটাও পিচবোটের মতো পাতলা খাড়া নাক চোখে পড়ল না।’ বিধু এতক্ষণ নিজেকে সামলাতেই ব্যস্ত ছিলেন। বন্ধুর মতো অত খুঁটিয়ে দেখার ইচ্ছে বা চেষ্টা কোনওটাই ছিল না। বিধু বললেন,
—তাই নাকি? তা হবে। তবে আমি যখন দেখি মুখটাই দেখি। শুধু নাকটাকে আলাদা করে দেখার অভ্যেস আমার কোনওকালেই ছিল না, আজও নেই। তবে তুমি দেখবে এদের সকলেরই বিয়ে হয়ে যাবে। দেখলে না সাইকেলধারী কত তরুণ এখনই কেমন বঁড়শি ঝুলিয়ে এই মৎস্যরাশির মধ্যে খেলে খেলে চলে গেল।
—তা গেল। বাংলা প্রবাদও আছে সব হাঁড়িরই সরা জোটে। আরে সেটা কি একটা কথা হল! মানুষের ফিচার বলে একটা জিনিস আছে। নাকেতেই মানুষের ইনটেলিজেন্স বোঝা যায়। ধারালো নাক জ্বলজ্বলে চোখ। লম্বা লম্বা হাতের আঙুল। তেলা গা এসব হল লক্ষণ। বুদ্ধিমানের লক্ষণ সুরুচির লক্ষণ, শিল্পী মনের লক্ষণ। ফ্রেনোলজি একটা সাবজেক্ট। এখন তো তোমার অঢেল সময়, একটু স্টাডি করো না।
বিধু আর বকবক করতে রাজি নন। তারকের সঙ্গে চেহারার তর্ক আজ মাসখানেক ধরে লাগাতার চলেছে। আজ আবার কোথা থেকে এক সাবজেক্ট ধরে এনেছে ফ্রেনোলজি। এরপর নিয়ে আসবে আর্কেয়োলজি। তারপর আনবে ফিলোলজি, পেলিয়েন্টোলজি ইন্ডোলজি। ছেলের বিয়ে দিতে গিয়ে সব লজিই আসবে। আসলে তো বাবা সেই একটাই লজি—সেকসোলজি। বিধু চুপ করে আছে দেখে তারক তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডার আও একটু খুলতে চাইলেন। বাসস্টপ এখন মিনিটখানেক পথ।
—বুঝলে বিধু মহিলাদের মধ্যেও অনেক রকম আছে। শুধু লম্বা চুল, সরু গলা আর ম্যামারি গ্যান্ড দিয়েই মহিলা চেনা যায় না। ওর বাইরেও নানা লক্ষণ আছে। তান্ত্রিকরা এসব জানতেন, কে পদ্মিনী, কে শঙ্খিনী, কে হস্তিনী, কে ডাকিনী, কে যোগিনী। মেয়েছেলে নিয়ে কারবার অত সহজ নাকি। জীবনসঙ্গী নির্বাচন করতে হবে অনেক দেখে শুনে। সর্বসুলক্ষণা, লক্ষ্মীমন্ত। তবেই না ধুলা মুঠি সোনামুঠি হবে।
বিধু ঠেলেঠুলে তারককে একটা মিনিবাসে তুললেন। পেছনের আসনে দুজনে পাশাপাশি। বাস হু হু করে ছুটছে। বিধু পাঞ্জাবির পকেটে থেকে নস্যির ডিবে বের করে বেশ জুতসই এক টান নিলেন। তারক বললেন—বিশ্রী।
—বিশ্রী মানে। তোমার গায়ে পড়ল নাকি!
—আর না না, নস্যি না। ও তো তোমার ছাত্রীবন থেকেই চলছে। অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তোমার নস্যি, ইদানীং আমার বয়ের জর্দা। বিশ্রী হল ওইটা।
তারক কোলের ওপর ফোল রাখা হাতের আঙুলটা ছোট্ট করে তুলে সামনের আসনে বসে থাকা এক মহিলাকে দেখালেন। শরীরের ডান পাশটা পেছন দিক থেকে সামান্য চোখে পড়ছে। বিধু তাকিয়ে দেখেও বিশেষ কিছুই ধরতে পারলেন না। ফিসফিস করে জিগ্যেস করলেন,
—কী বিশ্রী?
—আরে কোমরটা দেখেছ? ওই কি একটা কোমরের ছিরি। তিন থাক চর্বি। কোনও কোনও টিকটিকির ন্যাজ ওই রকম হয়। কোমর নয় তো ডেকরেটেড টিকটিকির ন্যাজ। বুঝলে বিধু। বেশিরভাগ বাঙালি মেয়ের এই অবস্থা। ল্যাক অফ একসারসাইজ, ওভার ইটিং নুন স্লিপিং।
ল্যাক অফ একসারসাইজ কথাটা বিধুর ভীষণ পছন্দ হল। এটা তার সাবজেক্ট। বিধু বললেন,
—প্রতিটি বাঙালি মেয়ের যোগাসন করা উচিত। ভুজঙ্গাসন, মৎস্যাসন, অর্ধমৎস্যেন্দ্রাসন, চন্দ্রাসন। দোব না কি একটা ফ্রি প্রেসক্রিপশান ঝেড়ে। এক মাসে ওই ক্যাডাভ্যারাস কোমর হাতের মুঠোয় ডাঁটার মতো ধরা যাবে।
—আসন? আমাদের পাড়ায় তুমি একটা কারখানা খোল না।
—কারখানা?
—হ্যাঁ-হ্যাঁ, কারখানা। মেদ ছাঁটাই। কোল কুঁজোদের সোজা করা। আজকালকার মেয়েদের লক্ষ্য করে দেখেছ? ধনুকের মতো সামনে বাঁকা। না: তাকানো যায় না।
—কী তাকানো যায় না?
—ওই ভদ্রমহিলার দিকে।
—নাই বা তাকালে। বাইরের দিকে চাওনা।
—আরে দূর চোখ চলে যাচ্ছে যে ওই দিকে।
—কিছু না। বুঝলে তারক, একমাস ভুজঙ্গাসনের সঙ্গে অর্ধচন্দ্রাসন পাঞ্চ করে করলে ওই কোমর আবার মেরামত হয়ে ধাতে এসে যাবে।
—কে করাবে ভাই। ওর কত্তাটি তো ওই জিনিসেই রেলিশ করেন।
তারক ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে তাকাবার চেষ্টা করলেন। শহর ছুটছে হু হু করে পেছন দিকে।
সালকের সমরেশবাবুর বাড়িটি বেশ প্রাচীন। ছাদের কার্নিসে বেশ নধর একটি বটগাছ। তারক বললেন,—বেশ বনেদি বাড়ি হে। মনে হয় কালচারাল ফ্যামিলি।’
‘কী করে বুঝলে?’
‘দেখছ না দরজার সামনে কোনও মহিলা দাঁড়িয়ে পাড়ার উঠতি মস্তানদের সঙ্গে হ্যাঁ হ্যাঁ করে গুলতানি করছে না।’
‘জানালার গবাটে ঠ্যাং তুলে কেউ বসে নেই। বারান্দায় ক্যাটকেটে লাল কোনও অন্তর্বাস ঝুলছে না। বাড়িটা কেমন শান্ত। আমার মন বলছে সব ঘোরাঘুরি বোধহয় আজই শেষ হল।’
‘ঈশ্বর করুন যেন তাই হয়।’ বিধু দরজার কড়া নাড়লেন।
তারক বললেন, ‘আহা, অত জোরে নয়, অত জোরে নয়, সংস্কৃতিবান লোকের মতো বেশ মিঠে করে তালে তালে ছাড়ো। আমরা তো গোয়ালা নই, পোয়াদাও নই।’
‘তা নই, তবে ছেলের বাপ তো। ভঙ্গিটা পুরুষালি হলে ক্ষতি কি?’
দরজার সামনে একটি শিশু উদিত হল। সামনের একটা দাঁত ফোকলা। সেই ফাঁক দিয়ে জিভের ডগা উঁকি মারছে।
‘খোকা, সমরেশবাবু আছেন?’
‘নেই। বাবা মিত্তি কিনতে গেছেন।’
তারক বন্ধুকে বললেন, ‘যুক্তাক্ষর উচ্চারণ করতে পারে না। বেশি বয়েসের সন্তান। ভদ্রলোক অবশ্যই কিঞ্চিৎ অসংযমী।’
‘তাতে তোমার কী?’
‘আমার কী? অসংযমী পুরুষের সন্তানও তো অংসযমী হবে। সংযমই তো মানুষের চরিত্রের বাঁধন। না:, সুবিধে হবে না। চলো সরে পড়ি।’
‘সে কী এই তো বললে তোমার মন বলছে।’
‘আমার মন ভুল বলেছে। লেট আস গো ব্যাক।’
‘কী যে বলো, ফিরে যাওয়াটা মোস্ট অভদ্রতা হবে। কাপুরুষের মতো কাজ হবে। বাড়িতে আর কেউ নেই খোকা?’
‘হ্যাঁ শুভা আছে।’
‘শুভা কে?’
‘আমার দিদি।’
বিধু বললেন, ‘মা কোথায়?’
ছেলেটি হাত উলটে বললে, ‘মাম্মি নেই।’
তারক বিধুর হাত ধরে এক টান মারলেন, ‘পালিয়ে চলো। ভালো চাও তো পালিয়ে এসো। সাংঘাতিক বাড়ি। দিদিকে নাম ধরে ডাকছে তার ওপর আবার মাম্মি। গোদের ওপর বিষফোঁড়া। আপস্টার্টের বাড়ি। কালচারে মিলবে না।’
বিধু হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘বড় বাড়াবাড়ি করে ফেলছ, তারক। অভদ্রতার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।’
‘মেয়ে দেখতে হয় তুমি যাও আমি ওর মধ্যে নেই’ তারক চলে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতেই মেয়ের বাবার মুখোমুখি। হৃষ্টপুষ্ট ভদ্রলোক। পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। দু-হাতে বুকের কাছে ধরা গোটা কতক বড় ছোট খাবারের বাক্স। ভদ্রলোক উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘এসে গেছেন। চলুন চলুন ভেতরে চলুন।’
বসার ঘরটি বেশ সাজানো। তারক বিধুর কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, ‘ভীষণ লাউড। উগ্রপন্থী মনে হচ্ছে।’
‘এখন আর কোনও মন্তব্য নয়। ভেতরে গেছেন, এখুনি এসে পড়বেন। তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো।’
অন্দরমহলে খুব একটা উত্তেজনা চলেছে। মেয়ের বাবার উচ্চকণ্ঠই পরদা ফুঁড়ে ঘরে আসছে। ‘আহা আহা ওসব কাপ ডিশ হাটা হাটা। ওই সাদা সেটটা বের কর। উঁহু উঁহু ও শাড়িটা নয় মা, বড্ড ক্যাটকেটে রং। ফিকে নীলটা পর। ও নীল রং সন্ধেবেলা তেমন জমবে না। তাহলে ওই হালকা গোলাপিটা হ্যাঁ হ্যাঁ।
তারক বন্ধুকে ফিসফিস করে বললেন, ‘না হে গলাটা একটু তেরির মতো হলেও রুচিসম্পন্ন ব্যক্তি। মানুষের বাইরেটা দেখে সব সময় বোঝা যায় না।’
বিধু এক টিপ নস্যি নিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘যাক দেরিতে হলেও জীবনের একটা সত্য তুমি আজ বুঝলে।’
তারক কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, বলা হল না। গৃহস্বামী সশব্দে, সবেগে পরদা উড়িয়ে ঘরে ঢুকলেন, ‘অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি, কিছু মনে করবেন না। একলা মানুষ। বড় বিপদে পড়ে গেছি। মেয়েটি কি শাড়ি পরবে তাও আমাকে বলে দিতে হবে।’
বিধু জিগ্যেস করলেন, ‘কেন আপনার স্ত্রী বুঝি এসব ব্যাপারে উদাসীন।’
‘স্ত্রী।’ ভদ্রলোকের মুখে করুণ হাসি। ‘বছর ছয়েক হল আমার স্ত্রী মারা গেছেন। আমাকে মহা ফাঁপরে ফেলে তিনি ফুস করে চলে গেলেন।’
তারক উদ্বিগ্ন মুখে জিগ্যেস করলেন, ‘কী হয়েছিল।’
‘বিশেষ কিছু না, লিভারটা অকেজো হয়ে গিয়েছিল।’
‘হেরিডিটারি নাকি?’
‘না না, চানাচুর, চানাচুর আর চা এই খেয়ে খেয়ে লিভারটাকে শুকিয়ে ফেলেছিল।’
‘আপনার মেয়ের লিভার কেমন?’
‘ও:, ভেরি সাউন্ড। চেহারা দেখলেই বুঝতে পারবেন।’ ভদ্রলোক তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দরজার পরদাটা দু-হাতে ধরে একপাশ করলেন। ট্রে হাতে একটি মেয়ে ঢুকল। ঝলমলে ম্যাকসি পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। তারক শশব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘সামলে মা, সামলে, এখুনি হুমড়ি খেয়ে পড়বে।’
মেয়েটি চোখ বড় বড় করে বললে, ‘ও মা, পড়ে যাব কেন?’
ভদ্রলোক পরদা ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘না না, আজকালকার মেয়েদের ওসব অভ্যাস আছে।’
তারক গম্ভীর মুখে বললেন, ‘তা আছে।’ বিধু তারকের হাতে আস্তে একটা চিমটি কেটে সংকেত করলেন, ‘ব্যস ওই পর্যন্ত আর কোনও মন্তব্য নয়।’
তারক বললেন, ‘মেয়েলি অভ্যাস।’
ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ মেয়েদের অভ্যাস। মেয়েরা হল জলের মতো যে পাত্রে রাখবেন সেই পাত্রের আকৃতি নেবে।’
তারক বললেন, ‘বাঁদরের মতো। অনুকরণ প্রিয়।’
ভদ্রলোক ঢোক গিললেন। পাত্রপক্ষ আর অফিসের বড় কর্তার কথায় প্রতিবাদ করলেই আখেরে পস্তাতে হয়। তারকের মন্তব্যে সায় দিলেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, এপিস হ্যাবিট।’
হাতে হাতে চায়ের কাপ। প্লেটে নোনতা ডাঁই। তারক খালি কাপটা নামাতে নামাতে বললেন, ‘আর দেরি করে লাভ কী? আসল কাজটা এবার সেরে ফেলা যাক।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। চা খাওয়া হয়েছে, এইবার নিয়ে আসি।’ ভদ্রলোক ভেতরে চলে গেলেন। তারক খুঁত খুঁত গলায় বিধুকে বললেন, ‘মা-মরা মেয়েরা বড় অভিমানী হয়। আগে দেখি তারপর ভেবে দেখা যাবে।’
বিধু উত্তরে শব্দ করে একটিপ নস্যি নিয়ে দেওয়াল ক্যালেন্ডারের সিনারির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। ঘরের একপাশে চাদর ঢাকা ডিভান। সেখানে একটা ভেলভেটের আসন পাতা। মেয়েটি প্রায় নি:শব্দে সেই নির্দিষ্ট স্থানে এসে বসল। লজ্জা নেই, জড়তা নেই, চাপা একটা নম্রতার ভাব। হাত তুলে নমস্কার করে দুই দর্শনার্থীর দিকে বেশ একটা ঘরোয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মেয়ের বাবা হই হই করে উঠলেন, ‘হল না মা হল না। প্রথমেই তোমার নম্বর কাটা গেল।’
‘কেন বাবা?’
‘সকাল থেকে, বারবার বলে দিলুম পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে।’
‘ইস ভুল হয়ে গেছে।’ মেয়েটি তাড়াতাড়ি উঠে এল হেঁট হয়ে একেবারে তারকের পায়ের কাছে। তারক খপ করে একটা হাত চেপে ধরলেন। গোল নরম শীতল একটি হাত। আর তখনই তাঁর মনে হল, এ হাত পুত্রবধূর হাত। মনে মনে বললেন, ‘সিলেকটেড’। মুখে বললেন, ‘থাক থাক, মা। তোমাকে অত দীন হতে হবে না। তুমি পারবে।’
মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েছে। দুই বন্ধুর সামনাসামনি। তারকের মন বলছে, হ্যাঁ ঠিক এই রকমটিই চেয়েছিলুম। এমনি চুল এমনি মুখ চোখ এমনি স্বভাব, এমনি লাবণ্য। তারক হাত ছেড়ে দিয়েছেন, ‘যাও মা তোমার জায়গায় গিয়ে বসো।’ মেয়েটি পেছন ফিরে এগিয়ে চলেছে। তারক মনে মনে বললেন, ‘আহা ঠিক এমনি চলন, এমনি গড়ন।’
কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা। কারুর মুখেই কোনও কথা নেই। বিধু তারককে জিগ্যেস করলেন, ‘তোমার কিছু প্রশ্ন আছে?’
‘যৎসামান্য।’
‘তা হলে করে ফ্যালো।’
তারক একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘সিনেমা দেখার নেশা আছে?’
মেয়েটি মৃদু গলায় বললে, ‘নেশা নেই তবে মাঝেমধ্যে যাই।’
‘হিন্দি ভালো লাগে, না বাংলা ভালো লাগে, না ইংরেজি?’
‘হিন্দি আমি সহ্য করতে পারি না, ইংরেজির ডায়ালগ বুঝি না, মাঝেমধ্যে বাংলাতেই যাই।’
‘রেডিওর নেশা কেমন, বিবিধ ভারতী?’
হাসি হাসি মুখ করে মেয়েটি বললে, ‘অল্পস্বল্প। সারা দিন বাড়িতে একা একা থাকি তো।’
‘তা বেশ। কিন্তু ধরো কারুর যদি ক্ল্যাসিকাল গানের টেস্ট থাকে তাহলে কি এইরকম হবে, খেয়াল হচ্ছে তুমি অমনি ঝপ করে ঘুরিয়ে বিবিধতে নিয়ে এলে—সে অমনি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে খেয়াল নিয়ে এল তুমি আবার বিবিধতে নিয়ে গেলে সে আবার খেয়ালে নিয়ে এল—কোর্টে লাখ খানেক ডিভোর্স কেস ঝুলছে তার মধ্যে হাজারখানেক হল এই ক্লাসিকাল আর পপ টেস্টের ক্ল্যাশ!’
‘না না হবে না ভালো ক্ল্যাসিকাল গান আমিও শুনতে ভালোবাসি তবে ওই ক্ল্যাসিকালের নামে হ্যা হ্যা হলে কানে তুলো দিতে ইচ্ছে করে।’
বিধু বললেন, ‘রাইট ইউ আর। অধিকাংশ খেয়ালই অজকাল অশ্রাব্য।’
মেয়ের বাবা বললেন, ‘ও এক সময় নিজেই উচ্চাঙ্গ সংগীতের চর্চা করত। গলাটাও নেহাত খারাপ ছিল না। এখন সব ছেড়েছুড়ে দিয়েছে।’
তারক বললেন, ‘ছাড়লে কেন?’
‘গান শিখতে গেলে চরিত্র ঠিক রাখার অসুবিধে হয়।’
‘অ্যাঁ সে আবার কী কথা।’ তারক চমকে উঠলেন।
মেয়ের বাবা হাসতে-হাসতে বললেন, ‘লাইনটার মধ্যে একটু ইয়ে আছে, ওই সিনেমার হিরোয়িন হওয়ার মতো ব্যাপার।’
‘আই সি, আই সি, লাইনটার মধ্যে লাইসেনসাস লোক ঢুকে পড়েছে আর কি?’
বিধু বললেন, ‘ঠাকুর বলতেন না? বাড়িতে দু-ভাবে ঢোকা যায়, সদর দরজা দিয়ে আবার পায়খানার দরজার দিয়েও ঢোকা যায়।’
তারক বললেন, ‘তোমার রান্নাবান্না আসে, মা? রেওয়াজ আছে?’
‘ওটা আমার ভালোই আসে। মা খুব ভালো রাঁধতেন। আমার ঠাকুমাও ভালো রাঁধতেন। আমি বিশ্বাস করি রান্না একটা আর্ট।’
‘ভেরি গুড। আহা মণিকাঞ্চন যোগ।’ তারক লাফিয়ে উঠলেন, ‘তার মানে তোমার মধ্যে রাঁধিয়ে জিনিস আছে। তোমার নামটি কী মা?’
‘শুভ্রা।’
তারক পকেট থেকে একখণ্ড কাগজ বের করে, বড় অক্ষরে নামটা ইংরেজিতে লিখলেন। ঝটপট করে কতকগুলো সংখ্যা তলায় তলায় বসালেন, এসের তলায় ১. ইউ-এর তলায় ৩. বির তলায় ২, এইচের তলায় ৮, এ-র তলায় ১। ইজ ইকোয়ালটু ১৫। পাঁচ আর একে ছয়। কাগজ খণ্ড থেকে মুখ তুলে বললেন, ‘হবে। সুন্দর হবে। ফাশক্লাস হবে।’
মেয়ের বাবা কৌতূহলী হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কী হিসেব করলেন?’
নিউমারোলজি। আমি যেমন নিউমারোলজি করি, আমার বন্ধুটি করে ফ্রেনোলজি। ও চেহারা দেখে ভাগ্য, স্বভাব, চরিত্র সব বলতে পারে।’
‘আপনি গণনা করে কী পেলেন?’
‘ভালো খুব ভালো? আমার আর একটি প্রশ্ন মা, তুমি রোজ সকালে স্নান করো তো?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, রোজ ভোরে।’
‘সর্দিকাশি কী রকম হয়?’
‘খুব একটা হয় না।’
‘টনসিল আছে?’
‘ছিল যখন গান করতুম, এখন আর নেই।’
বিধু বললেন, ‘ওই মজা, গান ধরলেই টনসিলে পেছনে লাগে, ছাড়লেই টনসিলও গলার পথ ছেড়ে দেয়।’
তারক বললেন, ‘আমার আর কোনও প্রশ্ন নেই। তুমি ভেতরে যেতে পার, মা।’
মেয়েটি চলে যেতেই তারকের খেয়াল হল হাতের লেখাটা তো দেখা হল না। মেয়ের বাবাকে বললেন, ‘আর একটু কষ্ট দোব, দুচার লাইন বাংলা, দুচার লাইন ইংরেজি হাতের লেখা আমাকে এনে দিন। হ্যাঁ আর একটা প্রশ্নের উত্তর চাই, ধর্ম বিশ্বাস করে কি না?’
বেরোতে-বেরোতে বেশ রাত হয়ে গেল। ভরপেট খাওয়া হয়েছে। গাড়ি হাওড়া ব্রিজের ওপর ওঠে পড়েছে। শীতটাও বেশ চেপে এসেছে। বিধু বললেন, ‘তা হলে শীত থাকতে থাকতেই লাগিয়ে দাও।’
‘হ্যাঁ, তাই দোব। শুভস্য শীঘ্রং। ভদ্রলোক তো ছেলে দেখতেই চাইলেন না। শুনলে তো, বললেন, বিশ্বাস করে ঠকা ভালো, অবিশ্বাস করে জেতার চেয়ে।’
‘স্ত্রী নেই, বিশেষ কোনও আত্মীয়স্বজন আছে বলেও মনে হয় না। মেয়ে আর বাপ এই তো সংসার। ছেলে দেখাটা আবার মেয়েদের সাবজেক্ট, বুঝলে তো?’
‘ও সব চলবে না। ছেলে আমি দেখাবোই। দু পক্ষই বাজিয়ে নিক। পরে যেন কোনও কথা না ওঠে।’
‘যাক ভাই, তোমার শেষ পর্যন্ত মেয়ে যে পছন্দ হয়েছে, ও: গুরুর কৃপা।’
‘ঠাকুর বলে গেছেন যার যেখানে কুটো বাঁধা? আমি সব লক্ষণটক্ষণ মিলিয়ে নিয়েছি কম স্টাডি করতে হয়েছে।’
শ্যামাঙ্গী সুকেশী তনু লোমরাজি কান্তা।
সুভুরু-সুশীলা কিম্বা সুগতি সুদন্তা।।
মধ্যক্ষীণা যদি হয় পঙ্কজ নয়নী।
কুলহীনা হইলেও বরেষ্ট-দায়িনী।।
আবার খনাই বলছেন
কুদন্তা অথবা হয় অধিক ব্যাপিকা।
পিঙ্গল লোচনা অঙ্গষষ্ঠী সলোমিকা।।
মধ্যপুষ্ট যদি হয় রাজার বালিকা।
কুলে শ্রেষ্ঠা হইলেও অরিষ্ট-দায়িকা।।
কেবল একটা জিনিস জানতে পারলুম না, অবশ্য পুরুষের জানার কথাও নয় মা বেঁচে থাকলে বলতে পারতেন, সেটা হল আদ্য ঋতুর বার।’
‘সেটা আবার কী?’
‘সেটা আবার কী?’ তারক বিরক্ত হলেন, ‘ঋতু হে ঋতু। ফার্টিলিটি। রবিতে বিধবা হয়, সোমে পতিব্রতা। মঙ্গলেতে বেশ্যা, বুধে সৌভাগ্যসংযুতা।।’
বন্ধুকে আর বেশি ঘাঁটাতে সাহস হল না, বিধু কলকাতার আকাশে তারা দেখতে লাগলেন। হাওড়া পড়ে রইল ব্রিজের ওপারে।
দূর থেকে নিজের বাড়িটা দেখে তারক বড় খুশি হলেন। আলো, পরদা, গ্রিল, লতানো গাছ। মিহি সেতারের শব্দ। এক হাতে বড়বাজারের রাবড়ির হাঁড়ি। তারক বাড়ি ঢুকছেন যুদ্ধ জয় করে। বছরখানেক হল মেয়েই দেখছেন। দেখতে দেখতে আর বাতিল করতে-করতে একসময় প্রায় হতাশই হয়ে পড়েছিলেন, বাংলাদেশে ছেলের বউ পাবেন না বলেই মনে হয়েছিল।
‘নাও, তোমার পুত্রবধুর অনারে মিষ্টি মুখ। সিলেকটেড। ফুল মার্কস। এক আধ অম্বর গ্রেস দেওয়ারও দরকার হল না।’ তারক রাবড়ির হাঁড়িটা হাসি হাসি মুখে স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিলেন, ঢোকার মুখে লতানে গাছের পাতায়, গ্রিলে, আলোয় আলো-আঁধারি হয়ে আছে। সুধা মনে হয় হাঁড়ির মুখের বাঁধনটা তেমন লক্ষ্য করতে পারেননি। তারকও ছেড়ে দিয়েছেন। পায়ের কাছে পড়ে হাঁড়িটা সশব্দে চুরমার হয়ে গেল।
‘এ কী করলে?’ তারক যেন প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছেন। ‘তুমি ধরোনি?’ সুধা বিব্রত, ‘ধরে ছিলুম, কীভাবে যেন ফসকে গেল।’
তারক বললেন, ‘টাকার কথা ভাবছি না। চল্লিশটা টাকা বড় কথা নয়। মনটা কেমন হয়ে গেল। কেমন যেন চমকে উঠলুম। একটা শুভ সংবাদ দিতে গেলুম, কেমন যে সব খাপছাড়া হয়ে গেল।’
‘তুমি আর খুঁত খুঁত করো না। ভেতরে চলে এসো। আজ আবার হাওয়া ছেড়েছে।’
পোষা বেড়ালটা চুকচুক করে রাবড়ি চাটছে। তারক বললেন, ‘সামলাও। কেজি খানেক মালাই খেয়ে কলেরা হয়ে না মরে।’
সুধা বেড়ালটাকে কোলে তুলে নিলেন। কোলের গরমে, ক্ষীরের লোভে বেড়ালটা ফুলে ফুটবল হয়ে রইল।
তারকের মনে হল যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন সে-বাড়ি আর নেই। আবহাওয়াটা কেমন যেন পালটে গেছে। সুধা আলমারির সামনে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা যেন কেমন বদলে গেছে। ছেলের ঘরে সেতার বাজছে। তাও যেন কেমন মিইয়ে মিইয়ে। রাতের দিকে আলোগুলো কাঁপতেই থাকে, রোজই কাঁপে। আজ যেন পক্ষাঘাতের রোগীর মতো বড় বেশি কাঁপছে।
ইজিচেয়ারে বসতে-বসতে তারক সুধাকে বললেন—’অ্যাশট্রেটা এনে আমার সামনে বসো।’
‘মেয়েটি বড় ভালো। দেখে ভীষণ মায়া হল। মেয়ের বাবা হাতে ধরে বললেন, ‘মা-মরা মেয়ে একটু ভালো পরিবারে দিতে চাই। মেয়েটিকে আপনি নিন। রূপ আছে, গুণ আছে, গান জানে, রাঁধতে জানে, স্মার্ট কিন্তু অসভ্য নয়। আমি বাপু নিয়ে ফেলেছি। তুমি হয়তো বলবে, আমরা দেখলাম না তুমি আগেই কথা দিয়ে এলে। আমার টেস্ট তোমরা জানো তাই সাহস করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। পরশু দিন তোমরা গিয়ে দেখে আসবে, আমি বলে এসেছি। আশীর্বাদে আর বিয়ের দিন আমি কালই পাঁজি দেখে পাকা করে আসব, এক মিনিটের ব্যাপার, পুরোহিতমশায়ের বাড়িতে সকালে চা খেয়ে আমি আর বিধু যাব।’
সুধা আঁচল পাকাতে-পাকাতে শুনছিলেন। তারক লক্ষ করছিলেন সুধা অন্যমনস্ক। ‘তোমার কী হয়েছে বল তো। তোমাকে কেমন যেন অন্যমনা উদাস উদাস দেখছি।’
‘তোমাকে একটা কথা বলি, হয়তো খুবই আঘাত পাবে, তবুও বলতে হচ্ছে, তুমি আর অমিতের বিয়ের চেষ্টা কোরো না। ওর বিয়ে হয়ে গেছে।’
‘মানে?’ তারক সোজা হয়ে বসলেন, ‘তুমি বলছ কী, বিয়ে হয়ে গেছে মানে?’
‘হ্যাঁ, রেজিস্ট্রি ম্যারেজ।’
‘সে কী?’ তারক উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ‘সে কী? কবে হল। কে বললে?’
‘আজই হয়েছে। অমিত আজই আমাকে বলেছে। তোমাকে সে আগেই বলতে চেয়েছিল, সাহস পায়নি। তার মতে নিজের বিয়ে নিজের মতে করাই ভালো। সেইটাই নাকি যুগের নিয়ম। তোমার অনুমতি পেলে বউ নিয়ে আসবে ঘরে।’
তারক পায়চারি থামিয়ে বিস্ময় মেশানো গলায় বললেন, ‘এত দূর। বল কী? আমাদের সেই নিরীহ অমিত। হোল ফ্যামিলিকে সে পথে বসিয়ে দিলে। আমাদের প্রেসটিজ ধূলোয়। মেয়েটি কে? হু ইজ সি। কে সে? আমাদের চেয়ে অমিতের ওপর তার হোল্ড বেশি। সহপাঠী? একই অফিসে চাকরি করে? জানো কিছু?’
‘তুমি উত্তেজিত হয়ো না। সে হল আমাদের বিধু ঠাকুরপোর মেয়ে।’
তারক চিৎকার করে উঠলেন, ‘হোয়াট শয়তান। হি ইজ এ সেটান। কেমন মুখ বুজে আমার পিছু পিছু গেল। একবারও বললে না, তারক আমিই তোমার বেয়াই। রাসকেল।’
সুধা বিব্রত। স্বামীকে সামলাবার জন্যে বললেন, ‘অমন করে চেঁচাচ্ছ কেন? চেঁচিয়ে কী হবে?’
চেঁচাবো না। বল কী? আমার কাছা খুলে দিলে। আমার গর্ব চুরমার করে দিলে। সিঁধ কেটে আমার ঘরে ঢুকে এল আমি বাপ হয়ে চুপ করে থাকব? আলবাত চেঁচাব। ডাক অমিতকে। ডাক সেই অকৃতজ্ঞ বিশ্বাসঘাতককে।’
‘কেন চিৎকার করছ? বিধু ঠাকুরপোও জানত না।’
‘বিশ্বাস করি না। ষড়যন্ত্র। ট্রেচারি।’
তারক ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেলেন। ‘অমিত, অমিত, যা শুনছি ঠিক?’
সেতার নামিয়ে অমিত বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। শান্ত গলায় বললে, ‘হ্যাঁ ঠিক।’
‘তুই আমাদের একবারও বললি না কেন? কেন এই বিলিতি বিয়ে।’
‘এখন হিন্দু মতে হতে আপত্তি হবে না।’
‘আই সি। আই সি। এর পেছনে পাকা মাথা আছে। আটঘাঁট বেঁধে কাজ। নাইস। ভেরি নাইস।’
‘এর পেছনে কেউ নেই শুধু আমরাই আছি। আপনি যাঁকে সন্দেহ করছেন তঁার কোনও ভূমিকাই নেই। তিনিও ব্যাপারটা আজই জানবেন।’
তারক দরজার সামনে গুম হয়ে বসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। এই সেই অমিত। সুবোধ, বাধ্য ভালো ছাত্র, বিনয়ী। সেই অমিতের কাছে বাপমার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়াল সামান্য একটা মেয়ে। এইরকমই হয় নাকি? কই তাঁর জীবনে তো এমন ঘটনা ঘটেনি। এত সাহস তো তাঁর ছিল না। অভিভাবকদের তৈরি করে দেওয়া ভাগ্যকেই তো নিজের বলে মেনে নিয়েছেন। তাতে খারাপ তো কিছু হয়নি।
নি:শব্দে তারক সরে এলেন। কোনও বক্তব্য নেই, কোনও মন্তব্য নেই। সংসারের কর্তৃত্ব হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে গেল। পরাজিত। সম্পূর্ণ পরাজিত।
ঘুম আসছে না। ছটফট করছেন বিছানায়। শীত। তবু ঘামছেন। সুধা বললেন, ‘যুগ পালটাচ্ছে। অনেক কিছুই তোমাকে মেনে নিতে হবে। ভবিষৎ ভাবতে গেলে চলবে না। অনিশ্চিতের দিকে এগোতেই হবে। ভালোও হতে পারে, খারাপও হতে পারে। ঘুমোবার চেষ্টা করো।’ মেয়েরা সব জিনিসকেই যেভাবে সহজ করে নিতে পারেন ঠিক সেইভাবেই সুধা নিলেন। খুব একটা ক্ষোভ আছে বলে মনে হল না।
অন্ধকারে চিত হয়ে শুয়ে কপালে একটা হাত রেখে তারক ভাবতেই লাগলেন যে ভাবনার কুল কিনারা নেই। শেষ সিদ্ধান্তে এলেন, গুটোতে হবে, নিজেকে গুটোতে হবে। প্রায় পাকা কথা দিয়ে এসেছেন মা-মরা সরল মেয়েটিকে তিনি নেবেন। এখন কেমন করে দু-লাইনের একটি চিঠিতে একটি পরিবারের হাসি নিশ্চিন্ততা তিনি এক ফুঁয়ে নিবিয়ে দেবেন। সম্ভব? তাহলে তো তিনি মেয়েদেখে বেড়ানো জোচ্চোরে পরিণত হবেন? কী আর করা যায়। ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি একটা জায়গা দিয়ে রাতটা কাটিয়ে দিলেন।
সকাল। সেই ষাট বছরের পুরোনো পৃথিবী। যেমন ছিল তেমনি আছে। রাস্তার উলটোদিকের কৃষ্ণচূড়া গাছটা কেবল মরে এসেছে। একটা ডালই সজীব। গুটি শুটি পাতা ছাড়ছে। পাখি সেই একই গান গাইছে। আকাশ সেই একই রকম নীল। সেই একই রকম পরিবেশের ঘুম ভাঙার শব্দ। সব একই রকম গতানুগতিক। কেবল তারক অন্যরকম। অনেক চেষ্টা করেও সেই হাসিখুশি মনটা আর খুঁজে পেলেন না। মনে হল অভ্যাসেই বেঁচে আছেন।
সুধা লক্ষ্য করলেন চেয়ারে বসে থাকা যে মানুষটিকে তিনি চা দিয়ে এলেন সে এক অন্য মানুষ। তারক দেখলেন, এতদিনে তিনি যেন স্বপ্নে ছিলেন, তা ঘুম ভাঙা চোখে সব কিছুরই যেন বড় চড়া রং, বড় ক্যাটক্যাটে। বাজারের পথে হঠাৎ বিধুর সঙ্গেই প্রথম দেখা। বিধু মুখ নীচু করে পালাতে চাইছিলেন বলেই তারকের ধারণা। তারক গলা চড়িয়ে ডাকলেন, ‘এই যে বেয়াই মশাই।’
বিধু বিব্রত। তারক কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘বন্ধু থেকে বেয়াই। কেমন নতুন নতুন লাগছে তাই না।’
বিধু বললেন, ‘বিশ্বাস করো, আমি কিছুই জানতুম না, ভাই। সত্যি জানতুম না। তুমি ভাববে আমিই আমার মেয়েকে লেলিয়ে দিয়েছি। তা কিন্তু নয়।’
‘জানি জানি। লেলিয়ে দিতে হয় না। ওরা নিজেরাই লেলে যায়। কা তব কান্তা কস্তে পুত্র, সংসারোহমতীব বিচিত্র।’
বিধু তারকের ভাবালু উদাস মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সব কিছুই হল, নিজের মেয়ে, নিজের মুখে বলা ঠিক নয় গুণ আছে, মুখরা নয়, লেখাপড়া জানে কেবল নাকটাই যা ভোঁতা মতো তেমন শার্প নয়, মুখ দেখলে মনে হবে বোকা বোকা কিন্তু বোকা নয়।’
তারক শান্ত গলায় বললেন, ‘ভেবো না, ভেবো না, সব যখন ছাড়তে পেরেছি, নাকটাও ছাড়তে পারব। বুঝলে বেয়াই, সেদিন বাসে জানালার ধারে বসে বসে দেখলুম, স্ট্যান্ডে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন তেরো-চোদ্দো বছরের একটি মেয়ের হাত ধরে। মহিলার নাকটা কপালের কাছ থেকে কে যেন কর্নিক দিয়ে চেঁচে নামিয়ে দিয়েছে। তার ফল কি হয়েছে জানো ওর মেয়ের নাকটা হয়েচে নিখুঁত সুন্দর। আমার বিশ্বাস বাপের নাক যদি খাঁড়ার মতো হয় আর মার নাক যদি হয় চিনেম্যানের মতো কম্বিনেশানের রেজাল্ট একটি বাঁশি।’
তারক হাসতে থাকলেন। বিধুর মনে হল সে হাসি নয়, একটু অস্বাভাবিক। তারক হাসি থামিয়ে নীচু গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘আচ্ছা, তোমার সন্ধানে কোনও ভালো ছেলে আছে।’
‘ছেলে?’
‘হ্যাঁ গো ছেলে। আমার একটি মা-মরা মেয়ে আছে। যদি থাকে আমাকে দু-চার দিনের মধ্যে জানিও। আমি বড় দুশ্চিন্তায় আছি।
বিধুর বিস্মিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে তারক হনহন করে মিলিয়ে গেলেন। ‘আপনার সন্ধানে কোনও ভালো ছেলে আছে, না না মেয়ে নয়, একটি ভালো ছেলে, আমার একটি মেয়ে আছে, মাতৃহীনা, বিষণ্ণ, করুণ। সন্ধানে কোনও ভালো ছেলে আছে।’