সন্দেহের এক কণা

সন্দেহের এক কণা

স্পেসপোর্টে ‘ফ্যালকন-১’ নেমে পড়তেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন জন্মভূমি। আমার ঘর-বাড়ি। কেমন আছে রুনু আর টুনু? কেমন আছে সুমিতা?

মহাকাশযান থেকে নেমে ম্যাগনেটিক অটো ট্র্যাকে সবে পা রেখেছি, সঙ্গে-সঙ্গে ইউনিফর্ম পরা দশাসই চেহারার দুজন লোক কোথা থেকে এসে হাজির হয়ে গেল আমার দু-পাশে। ওদের পোশাকে সিকিওরিটি ডিভিশনের প্রতীক-চিহ্ন আঁকা। কোমরের কাছে উঁকি মারছে জেনারেটর গান। চোখে কালো চশমা। মাথায় মেটাল হেলমেট।

আমাদের জুতোর নীচে স্টিলের পাত লাগানো। ফলে চলমান ম্যাগনেটিক ট্র্যাকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেই হল। দ্রুতগতির অটো ট্র্যাক আমাদের নিয়ে ছুটতে থাকে।

ওদের একজন জিগ্যেস করল, ‘আপনি সান্যাল?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, চাঁদের এক সাঙ্ঘাতিক দুর্ঘটনা থেকে কোনওরকমে বেঁচে ফিরে এসেছি।’

দ্বিতীয়জন আমার বাহু চেপে ধরল শক্ত হাতে : ‘সেটা অপারেশান ডিভিশন যাচাই করে দেখবে।’

তার মানে? আমি বেঁচে ফিরেছি কি না সেটা যাচাই করে দেখবে অপারেশান ডিভিশন? আমি, ইন্দ্রজিৎ সান্যাল, গোটা মানুষটা জলজ্যান্ত বেঁচে ফিরে এলাম এটাই কি যথেষ্ট নয়? চাঁদের ওই সাঙ্ঘাতিক দুর্ঘটনায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে আমাদের ল্যাবরেটরি। শুধু ফ্যালকন-১ বেঁচে গিয়েছিল। ওটা আমি রেখেছিলাম ল্যাবরেটরি থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরের একটা খাদের মধ্যে। সেখান থেকে পাথর বেয়ে ঠে হেঁটে পেরিয়েছি পনেরো কিলোমিটার পথ। চাঁদে বুকে এটুকু পথ কোনও ব্যাপারই নয়। কারণ মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর ছ’ভাগের একভাগ মতো হওয়ায় চলাফেরায় কষ্ট অনেক কম, তবে অভ্যেসের দরকার। আমি আগে আরও চারবার বিভিন্ন অভিযানে চাঁদে গিয়েছিলাম। চাঁদ আমার মোটামুটি সয়ে গেছে।

অদ্ভুত দক্ষতায় লোক দুটো অটো ট্র্যাকের পথ পালটাচ্ছিল। ট্র্যাকের অসংখ্য কাটাকুটির মধ্যেও সিকিওরিটি বিল্ডিংয়ের পথ চিনে নিতে বিন্দুমাত্রও অসুবিধে হচ্ছিল না ওদের। আমি একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। ইতস্তত করে বললাম, ‘আগে বাড়িতে একবার দেখা করে গেলে হত না? আমার ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, ছ’মাস ওদের দেখিনি।’

লক্ষ করলাম, আমার এই কথায় একজন আর একজনের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে অভদ্রভাবে হাসল, তারপর বলল, ‘ওসব পরে হবে, মিস্টার সান্যাল।’

অন্য সময় হলে এই অভদ্র উত্তরের উপযুক্ত জবাব দিতাম। কিন্তু এখন সবকিছুই কেমন অস্বাভাবিক গোলমেলে লাগছে। তবে সিকিওরিটি ডিভিশনে আমার ছোটবেলার বন্ধু রাকেশ ব্যানার্জি রয়েছে। ওর সঙ্গে দেখা করলেই মনে হয় সব মিটে যাবে। ওদের বললাম, ‘আমি রাকেশ, রাকেশ ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা করতে চাই।’

এবারে দ্বিতীয়জনের বিদ্রূপ-মাখানো হাসির পালা। বলল, ওঁর কাছেই আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি। সেরকমই নির্দেশ আছে আমাদের ওপরে।’

এবারে ভয় পেলাম। তা হলে কি সুমিতা বা রুনু-টুনুর কিছু হয়েছে! যেছ’মাস আমি ছিলাম না তার মধ্যে…ওঃ, ভগবান! আমি আর ভাবতে পারছি না! চারপাশে অটো ট্র্যাকে অনেক লোকজন চলাফেরা করছে। কোনও শব্দ নেই। সকলেই স্থির হয়ে ট্র্যাকে দাঁড়িয়ে।

চারপাশের বাতাস বিশুদ্ধ! কারণ অক্সিজেন-নাইট্রোজেন সবই নিখুঁত শতকরা হিসেবে মিশিয়ে এই বাতাসকে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের উপযোগী করে তোলা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মনে হল, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। অটো ট্র্যাকের মানুষগুলো সব ঝাপসা হয়ে আসছে। আর আমার কানে চাঁদের বিস্ফোরণের শব্দ আঘাত করছে বারবার।

তারই মধ্যে টের পেলাম প্রথম লোকটিও আমার হাত চেপে ধরল। ওদের হাতে বন্দি হয়ে আমি এগিয়ে চলেছি। বন্দি ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায় একে!

ঘরের ভেতরটা ঠান্ডা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। লুকোনো আলোয় আলোকিত। জানি, সাধারণ দৃশ্য-আলো ছাড়াও এ-ঘরে অবলোহিত আলোর ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে এক্স-রে ছবি তোলার আধুনিক আয়োজন। ঘরে আসবাবপত্র বলতে চারটে এয়ার কুশন, বাতাসে ভাসমান গদিওয়ালা চেয়ার। আর তার পাশে পলিমারের সাতকোণা টেবিলে হোস্ট কম্পিউটারের টার্মিনাল।

‘জেনারেটর গানটা বের করে টেবিলে রাখুন, মিস্টার সান্যাল।’ আমার জেনারেটর গানটা বাইরে থেকে দেখতে পাওয়ার কথা নয়। যেদুজন গার্ড আমাকে এখানে পৌঁছে দিয়েছে ওরাও পায়নি। কিন্তু এখন আদেশ শুনে বুঝলাম, অপরেশান ডিভিশনের চোখকে ফাঁকি দিতে পারিনি। ফাঁকি দেওয়া

রাকেশ কম্পিউটার টার্মিনালে বসে কি-বোর্ডের বোতাম টেপাটেপি করছিল। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে অপরিচিতের চোখে তাকাল। কিছু বলল না।

আমাকে জেনারেটর গান বের করে দেওয়ার নির্দেশ, অথবা আদেশ, যিনি দিয়েছিলেন এবারে তাঁকে দেখলাম। শক্ত চোয়াল, কপালে ভাঁজ, ফ্রেঞ্চকাট কাঁচাপাকা দাড়ি, মুখটা লম্বা ধরনের, রোগাটে দীর্ঘকায় চেহারা, আর শুধু চোখের নজর দিয়েই বোধহয় মানুষ খুন করতে পারেন।

‘রাকেশ, আমি ফিরে এসেছি!’ আমি জেনারেটর গানটা টেবিলে রেখে রাকেশের দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম, ‘তোদের ভালোবাসার টানেই বোধহয় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে পেরেছি— ‘

রাকেশ এক ঝটকায় কি-বোর্ড ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মুখের রেখাগুলো বীভৎস হয়ে গেল। ওর হাতে কখন যেন একটা জেনারেটর গান গজিয়ে উঠেছে। ওর কথার প্রতিটি শব্দ যেন ভয়ঙ্কর বজ্রপাতের মতো শোনাল, ‘মিস্টার দাসানি, এই রোবটটাকে জিগ্যেস করুন ইন্দ্রজিৎ সান্যালের ডেডবডিটা ও চাঁদের কোথায় লুকিয়ে এসেছে!’

আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এসব কী শুনছি আমি? কোনওরকমে বললাম, ‘রাকেশ, তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? এই দ্যাখ, আমি, তোর ছোটবেলার বন্ধু— ইন্দ্ৰজিৎ—।’ –

ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আমার পিঠে টোকা মারলেন। বললেন, ‘ব্যানার্জি ভুল বলেছে। রোবট নয়, অ্যান্ড্রয়েড—যাদের চেহারাটা হুবহু মানুষের মতো কিন্তু ব্যাটারি ছাড়া চলতে পারে না।’ হাসলেন দাসানি : ‘যাই হোক, মাথাগরম করে লাভ নেই, ব্যানার্জি। আমি এখনও কাজ শুরু করিনি। আগে শুরু করি, তারপর দেখবেন ওসব শেখানো বুলি কোথায় যায়। তবে আপাতত এই মেশিনটাকে আমরা ইন্দ্ৰজিৎ সান্যাল বলেই ডাকব। তাতে জেরার সুবিধে হবে। আপনি বসুন, মিস্টার সান্যাল। আমার জেরা বহুক্ষণ ধরে চলে, অ্যান্ড্রয়েডদেরও পা ব্যথা হয়ে যায়।’ দাসানির হাতে একটা খুদে রিমোট কন্ট্রোল ইউনিট ছিল। সেটার কী একটা বোতাম টিপতেই ঘরের একমাত্র দরজায় নেমে এল স্বচ্ছ প্লাস্টিকের দেওয়াল। দরজা বন্ধ। ঘরে শুধু আমরা তিনজন।

রাকেশ চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, ‘সান্যাল, তুমি বোধহয় জানো না, নরেন্দ্র এসপাইয়োনেজ ইউনিটের রোবোসাইকোলজিস্ট। শত্রুপক্ষের রোবটরা আজ পর্যন্ত ওঁকে ফাঁকি দিতে পারেনি।’

আমি চেয়ারে বসে পড়েছিলাম। ক্লান্ত গলায় বললাম, ‘আজ ছ’মাস পর আমি দেশে ফিরে এলাম…সুমিতা, রুনু-টুনু…কতদিন ওদের দেখিনি।’ একটু থেমে রাকেশকে লক্ষ্য করে অনুরোধ করলাম, ‘বাড়িতে একটা ফোন করতে দিবি?’

রাকেশ দাস একবার দাসানির দিকে তাকাল। তারপর ঘরের সাদা দেওয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বিদ্রূপের হাসি হেসে আমার বাড়ির ভিডিয়োফোন নম্বরটা উচ্চারণ করল। রাকেশ নম্বরটা জানে। ও আমার বাড়িতে গেছে বহুবার। সুমিতাকে বউদি বলে ডাকে, আর রুনু-টুনুর কাছে কাকু।

রিমোট কন্ট্রোল ইউনিটটা পকেটে রেখে দিয়ে নরেন্দ্র দাসানি চুপচাপ আমাকে লক্ষ করছিলেন। তাঁর নজরে সন্দেহ। আর ভাবখানা এই, কতক্ষণ তুমি আমার চোখে ধুলো দেবে, বাছাধন!

রাকেশ নম্বরটা উচ্চারণ করার সঙ্গে-সঙ্গে ঘরের একটা সাদা দেওয়াল জুড়ে ভেসে উঠল সুমিতার মুখ। রাকেশ বলল, ‘বউদি, আমরা যা সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই। ইন্দ্রজিতের বদলে এই রোবটটা ফিরে এসেছে চাঁদ থেকে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে—।’

রাকেশ একপাশে সরে গিয়ে ইশারায় আমাকে দেওয়ালের কাছে ডাকল। আমি ঘুমিয়ে-চলা মানুষের মতো চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেলাম সুমিতার কাছে। সুমিতা আমাকে দেখছে। ভুরু কুঁচকে গেছে, চোখ সন্দেহে কুটিল। ওর প্রশ্ন ছুটে এল বুলেটের মতো।

‘কোন তারিখে আমাদের বিয়ে হয়েছিল?’

আমার কান্না পেয়ে গেল। রাকেশ আর দাসানি সফল হয়েছে। সুমিতার মনেও সন্দেহের বিষ ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে ওরা। কিন্তু রুনু-টুনু? সুমিতা কঠিন গলায় প্রশ্নটা আবার করল।

আমি মাথা নীচু করে উত্তর দিলাম। দেওয়ালের ছবির দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করছিল না।

সুমিতা আরও কয়েকটা প্রশ্ন করল। আমি জবাব দিলাম। রাকেশ ও দাসানি বাজপাখির নজরে খুঁটিয়ে দেখছে আমার প্রত্যেকটা প্রতিক্রিয়া। একবার মাথা তুলে দেখলাম, সুমিতার মুখের ভাব এতটুকু পালটায়নি।

এরপরই দেওয়ালে ফুটে উঠল রুনুর ছবি। আমার দশ বছরের ফুটফুটে মেয়ে রুনু। সবাই বলে আমার মতো নাকি দেখতে।

‘রুনু, কেমন আছিস?

রুনু হাসিমুখে সবসময় যেমন ঠাট্টা করে ঠিক সেভাবেই বলল, ‘বাপি, বলো তো আমার জন্মদিন কবে?’

‘রুনু—’ যন্ত্রণায় মোচড় খেয়ে শব্দটা আমার বুক ঠেলে বেরিয়ে এল। দুহাতে মুখ ঢাকলাম আমি। গলার কাছটা ব্যথা করছে।

হঠাৎই শুনতে পেলাম কেউ আমাকে ডাকছে, ‘বাপিসোনা!’

আমি দেওয়ালের দিকে তাকালাম। টুনু। আমার পাঁচ বছরের ছেলে। একমাথা কোঁকড়া চুল। চোখ দুটো সবসময় কথা বলে। ও আমাকে নিশ্চয়ই ভুল বুঝবে না।

‘টুনু—’’ আমি চিৎকার করে ডেকে উঠলাম।

‘বাপিসোনা, বলো তো, আমার ভালো নাম কী? ওটা ছাড়া আর-একটা কোন নামে তুমি আমাকে ডাকো?’

আমি বসে পড়লাম মেঝেতে। আর পারলাম না। এতক্ষণের চেপে রাখা কান্না বুক ঠেলে বেরিয়ে এল। দু-হাতে মুখ ঢেকে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম।

আর তখনই শক্ত কঠিন একটা স্পর্শ টের পেলাম ঘাড়ে। জেনারেটর গানের নল। আর একইসঙ্গে দাসানির আদেশ, ‘জবাব দিন, সান্যাল। যদি প্রমাণ করতে চান আপনি সত্যিই ইন্দ্রজিৎ সান্যাল—মানুষ!’

আমি কাঁদতে-কাঁদতেই টুনুর প্রশ্নের জবাব দিলাম।

একটু পরেই শুনতে পেলাম রাকেশের গলা, ‘ওরা ট্রেনিংয়ে কোনও ভুল রাখেনি। ইন্দ্রজিৎ সান্যালের যাবতীয় তথ্য গুঁজে দিয়েছে এর পজিট্রনিক ব্রেনে।’ দাসানি এক হ্যাঁচকায় আমাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। ধাক্কা মেরে বসিয়ে দিলেন চেয়ারে। দেখলাম, দেওয়ালটা আবার আগের মতো ছবিহীন সাদা হয়ে গেছে।

রাকেশ অধৈর্য হয়ে বলল, ‘দাসানি, ছুরি দিয়ে ওর হাত-পা চিরে দেখুন রক্ত পড়ে কি না।’

নরেন্দ্র দাসানি আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। ইশারায় শান্ত হতে বললেন রাকেশকে। তারপর আমাকে বললেন, ‘ইন্দ্রজিৎ, এখানে আসাটা আপনার সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে। যাই হোক, আপনার মুখে চাঁদের গল্পটা একবার শোনা যাক। যদিও রেডিও মেসেজ আমরা ঠিকমতোই পেয়েছি।’

রাকেশ এগিয়ে এসে জেনারেটর গানটা ঠেকিয়ে ধরল আমার কপালে। এটা থেকে তিনরকম লেভেলে ফায়ার করা যায়, লো-লেভেল, হাই-লেভেল আর আলট্রা-হাই-লেভেল। দেখলাম সিলেক্টর সুইচটা এখন আলট্রা-হাই-লেভেলে।

দাসানি কিছু করে ওঠার আগেই রাকেশ বাঁ-হাতে কোথা থেকে একটা ছুরি বের করে ক্ষিপ্রগতিতে বাতাস কেটে চালিয়ে দিল আমার গালে। পাকা হাত। গাল চিরে গেল শুধু। দাসানি চিৎকার করে উঠলেন, ‘ব্যানার্জি কী হচ্ছে! আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন?’

আমিও যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠেছিলাম। ডানগাল বেয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে। সত্যিকারের রক্ত। পকেট থেকে রুমাল বের করে চেপে ধরলাম গালে। রাকেশ রক্ত দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বোধহয় বুঝল আমি রোবট নই, মানুষ। ওর চোখে আবার আমার ‘বন্ধু’ রাকেশের দৃষ্টি ফিরে আসছিল। কিন্তু দাসানির কথায় আমার রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল। রাকেশের দৃষ্টিও হয়ে গেল উদভ্রান্ত পাগলের মতো।

নরেন্দ্র দাসানি বললেন, ‘কী তখন থেকে ছেলেমানুষি করছেন, ব্যানার্জি! আপনাকে তো সেই গোড়া থেকেই বলছি, এটা অ্যান্ড্রয়েড—রোবট নয়। অ্যান্ড্রয়েডদের রক্ত-মাংস থাকে—মানুষেরই মতো। শুধু ব্রেন আর হার্ট, ওই দুটোই যন্ত্র—চলে ব্যাটারিতে। কিন্তু এক্স-রে কিংবা মেটাল ডিটেক্টরে ধরা পড়ে না। আপনি যান তো, চেয়ারে গিয়ে চুপ করে বসুন।’

কিন্তু রাকেশ চেয়ারে গিয়ে বসল না। ছুরি ফেলে দিয়ে একহাতে আমার জামা খামচে ধরে ঝাঁকাতে লাগল আর বলতে লাগল, ‘বল, ইন্দ্রজিৎকে তুই খুন করে কোথায় পুঁতে রেখেছিস—বল…।’

দাসানি এবার জোর করেই সরিয়ে দিলেন রাকেশকে। ঠেলে দিলেন একটা চেয়ারের দিকে। রাকেশ বসে পড়ল। মাথা ঝুঁকিয়ে বড়-বড় শ্বাস নিয়ে হাঁফাতে লাগল ।

আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। পৃথিবী এখন আর আমার ঘরবাড়ি নয়, কিচ্ছু নয়। এখানে আমার আপনজন বলতে আর কেউ নেই। দাসানি আবার ফিরে এলেন আমার কাছে। কাঁধে হাত রেখে বললেন,

‘ইন্দ্রজিৎ, এবারে চাঁদের গল্পটা আপনি বলতে পারেন।’

আমি ধীরে-ধীরে সব বললাম।

তিন বছর আগে আন্তর্জাতিক খনন সংস্থা চাঁদের ‘টেরা’ অঞ্চলে একটা আধুনিক খনন কেন্দ্র গঠনের উদ্যোগ নেয়। সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় এই কেন্দ্র তৈরি করা হয় দু-বছরের চেষ্টায়। এর কাজ হল চাঁদের মাটি ও পাথর থেকে দুষ্প্রাপ্য খনিজ নিষ্কাশন করা। লুনার হাইল্যান্ডস-এ অবস্থিত এই কেন্দ্রটি চাঁদের ওপিঠে। অর্থাৎ, চাঁদের যে-দিকটা সবসময় পৃথিবীর কাছ থেকে আড়ালে থাকে, সেই দিকে। নিউক্লীয় শক্তিচালিত এই কেন্দ্রের তদারকির জন্যে পালা করে বিশেষজ্ঞ পাঠানো হয়। কিন্তু সমস্যা বাধে টাইটান উপগ্রহের বিদ্রোহী সভ্যতাকে নিয়ে।

প্রায় চারশো বছর আগে যন্ত্রসভ্যতায় বিশ্বাসী কয়েক হাজার পৃথিবীবাসী শনির টাইটান উপগ্রহে গিয়ে উপনিবেশ গড়ে তোলে। টাইটানের নাইট্রোজেন আর মিথেন ঘেরা আবহাওয়ায় আশ্চর্য দক্ষতায় তারা তৈরি করে নিরাপদ আবরণে ঢাকা শহর। তারপর বছরের পর বছর ধরে তারা প্রযুক্তিকে উন্নত করেছে। আর একইসঙ্গে পৃথিবীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। শোনা যায়, ওদের বহু গুপ্তচর ছড়িয়ে আছে পৃথিবীতে। চাঁদে আমাদের নতুন পরিকল্পনার কথা যথাসম্ভব গোপন রাখা হয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওরা বোধহয় খবর পেয়ে যায়। তারপর ওদের গুপ্তচরের অন্তর্ঘাতমূলক ষড়যন্ত্রে—অন্তত আমার তাই অনুমান—চাঁদের খনন কেন্দ্রটি সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আমি কোনওরকমে প্রাণে বেঁচে ফিরে আসি।

এখন বুঝতে পারছি, টাইটানের অ্যান্ড্রয়েড গুপ্তচর সন্দেহ করে সিকিওরিটি ডিভিশনের গার্ড পাঠানো হয় আমাকে উপযুক্ত অভ্যর্থনা করার জন্য। আর এখন আমার দেশপ্রেমের ‘পুরস্কার’ দেওয়ার জন্যে অপারেশান ডিভিশন উন্মুখ। একেই বলে অদৃষ্ট!

নরেন্দ্র দাসানি ধৈর্য ধরে সব শুনলেন। মাঝে-মাঝে ওঁর কপালে ভাঁজ পড়ছিল। ওঁকে আমি আগে কখনও এখানে দেখিনি। একটা বিশাল বাড়িকে দুভাগে ভাগ করে তৈরি হয়েছে দুটো ডিভিশন : সেন্ট্রাল সিকিওরিটি ডিভিশন ও সেন্ট্রাল অপারেশান ডিভিশন। দাসানি কোনটায় চাকরি করেন কে জানে! একটা বাতাস-চেয়ার টেনে নিয়ে দাসানি বসলেন আমার মুখোমুখি। তারপর একটার পর একটা প্রশ্ন করতে শুরু করলেন।

‘স্কটল্যান্ডের ফোর্থ ব্রিজের ওপরে আমাকে একটা সনেট লিখে দিন তো…।’ ‘ও আমার দ্বারা হবে না। কবিতা আমি একদম লিখতে পারি না।’ ‘৩৪৯৫৭-এর সঙ্গে ৭০৭৬৪ যোগ দিলে কত হয়?’

তিরিশ সেকেন্ড মতো চুপ করে থেকে বললাম, ‘১০৫৬২১। ‘আপনি দাবা খেলেন?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’

‘ধরুন দাবা খেলায়·ľ

রাকেশ জেনারেটর গান টেবিলে রেখে কম্পিউটার কি-বোর্ডের দিকে তাকিয়ে ঝিম মেরে বসে ছিল, হঠাৎই খেপে উঠে চিৎকার করে বলল, ‘দাসানি, আপনারা কি টুরিং টেস্ট নিয়ে খেলা করছেন?’

কোনও যন্ত্র ভাবতে পারে কি না, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রে ‘নকলনবিশি’ নামে একটা খেলার পরিকল্পনা করেছিলেন এক প্রাচীন বিজ্ঞানী। নাম অ্যালান ম্যাথিসন টুরিং—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক। ওঁর সেই খেলাকে পরে অন্য বিজ্ঞানীরা ‘টুরিং টেস্ট’ নাম দেন। এখন, টুরিং মারা যাওয়ার প্রায় ছ’শো বছর পরে, নরেন্দ্র দাসানি আমাকে টুরিং টেস্টের প্রশ্নগুলোই করছিলেন, আর আমিও হুবহু সেই উত্তরগুলো দিচ্ছিলাম। সেইজন্যে যোগ অঙ্কের উত্তরটাও ভুল দিয়েছি।

দাসানি থেমে গেলেন। ভুরু কুঁচকে রাকেশের দিকে তাকালেন। একটু ভেবে বললেন, ‘দেখুন তো, পোস্টমর্টেম টিম চাঁদে রওনা হয়েছে কি না। আমার মনে হচ্ছে ওরা এই অ্যান্ড্রয়েডটার নকল ব্রেনে আসল ইন্দ্রজিতের সমস্ত স্মৃতির হুবহু ছাপ তুলে দিয়েছে…পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মেমোরি ম্যাপ। টুরিং টেস্ট দিয়ে একে ধরা যাবে না।’

দাসানি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। পরনের মেটালফাইবারের পোশাকের কোনও একটা পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছোট্ট চেহারার একটা ডিজিটাল যন্ত্র বের করলেন। বললেন, ‘এই স্ক্যানারটা এক্স-রে আর আলট্রাসনিক স্ক্যান দুটোই করতে পারে—।’

রাকেশ কম্পিউটারের কি-বোর্ডে বোতাম টিপছিল। দাসানির দিকে চোখ তুলে বলল, ‘ফ্যালকন-১ তল্লাশির কাজ শেষ করে পোস্টমর্টেম টিম লুনার হাইল্যান্ডস-এ পৌঁছে গেছে। ফ্যালকন-১-এ কিছু পাওয়া যায়নি। ওদের রেডিও মেসেজ আসছে কন্ট্রোল রুমে। আপনি জলদি একে স্ক্যান করে দেখুন, কোনও অস্বাভাবিক মেটাল পার্টসের ছবি পাওয়া যায় কি না।’

দাসানি বোধহয় ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। কলার ধরে এক ঝটকায় দাঁড় করিয়ে দিলেন আমাকে। ওঁর শক্তি আমাকে অবাক করে দিল। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘ধরা তোমাকে দিতেই হবে। শুধু উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা। প্রতিদিন আমি হাফডজন অ্যান্ড্রয়েড দিয়ে ব্রেকফাস্ট খাই—

তারপর ডিজিটাল স্ক্যানার দিয়ে স্ক্যানিংয়ের কাজ শুরু করলেন। যন্ত্রে কিছুই ধরা পড়ল না। আমি জানতাম পড়বে না। কিন্তু সন্দেহের বিষ ওদের পাগল করে দিয়েছে। সুমিতা, রুনু, টুনু— ওরাও বাদ যায়নি। বিশ্বাসের ভিত এত সহজে টলে যায় জানতাম না।

শীতাতপনিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও দাসানির কপালে ঘামের ফোঁটা দেখা দিল। যন্ত্রটা পকেটে রেখে আপনমনেই বিড়বিড় করে তিনি বললেন, ‘যে করে হোক আমাকে প্রমাণ করতেই হবে। এর আগে ডেল্টা থ্রি-র দুর্ঘটনার কথা আমরা কেউ ভুলে যাইনি। টাইটান থেকে এক অ্যান্ড্রয়েড স্পাই এসেছিল আমাদের ডেল্টা থ্রি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে। ওর শরীরের ভেতরে লুকোনো ছিল একটা এইচ বোমা। বিশেষ একটা কোড ওয়ার্ড যদি অ্যান্ড্রয়েডটা উচ্চারণ করে তাহলে সঙ্গে -সঙ্গে বোমাটা এক্সপ্লোড করবে। এসব তথ্য আমরা জানতে পেরেছিলাম টাইটানের আর এক মানুষ-গুপ্তচরকে সাইকোপ্রোব করে। তারপর অতিকষ্টে আমরা অ্যান্ড্রয়েডটাকে ধ্বংস করেছিলাম। পাওয়ার প্ল্যান্টটা অল্পের জন্যে বেঁচে গিয়েছিল…’ হঠাৎই গলার স্বর চড়িয়ে আমাকে লক্ষ করে দাসানি বললেন, ‘আপনার কোড ওয়ার্ডটা কী, মিস্টার সান্যাল?’

আমারও ধৈর্য ক্রমশ কমে আসছিল। তাই চেঁচিয়ে জবাব দিলাম, ‘গণ্ডমূর্খ!’ দাসানি বিরাশি সিক্কার এক থাপ্পড় কষিয়ে দিলেন আমার গালে। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। ঠোঁট কেটে গিয়ে রক্তের স্বাদ পেলাম জিভে।

রাকেশ বলল, ‘একে ইন্দ্রজিতের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান, দেখবেন ধরা পড়ে গেছে। সুমিতা বউদি, রুনু, কিংবা টুনু—কেউ না কেউ ঠিক ধরে ফেলবে একে। তারপর শুরু হবে আমাদের খেলা—।’

থাপ্পড় কষানোর পরমুহূর্ত থেকে দাসানি আমাকে খুঁটিয়ে লক্ষ করছিলেন। সম্ভবত প্রতিক্রিয়া দেখছিলেন। রোবট আর মানুষের প্রতিক্রিয়ায় নিশ্চয়ই তফাত থাকবে। ওঁর গুণী চোখ নিশ্চয়ই সেটা বুঝতেও পারবে। আমি আশা-ভরা চোখ নিয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ডানগালটা অসহ্য জ্বালা করছিল।

দাসানি রাকেশকে লক্ষ করে বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, ব্যানার্জি, ইন্দ্রজিতের বাড়িতেই নিয়ে যাই একে

সেই মুহূর্তে দাসানির গলা টিপে ধরতে ইচ্ছে করছিল আমার।

নরেন্দ্র দাসানি বিদ্রূপের স্বরে বলতে লাগলেন, ‘আসলে এই যন্ত্রটার কোনও দোষ নেই। ইন্দ্রজিতের মেমোরি ম্যাপ করে দেওয়ায় ওর এখন বিশ্বাস যে, ও-ই আসল ইন্দ্রজিৎ সান্যাল। ফলে ওর অভিনয়ে কোনও ফাঁক থাকবে না। ও জানে যে, ও-ই আসল লোক। কিন্তু আমিও এত সহজে ছাড়ছি না।’

দাসানি আমাকে ইশারা করলেন। আমি ওঁকে অনুসরণ করলাম। রাকেশকে একপলক দেখলাম। ও তখনও কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত।

দাসানি রিমোট কন্ট্রোল ইউনিটটা বের করে বোতাম টিপলেন। প্লাস্টিকের দেওয়াল সরে গেল। আমরা বেরিয়ে এলাম ঘর ছেড়ে। সুমিতা, রুনু, টুনুকে সামনাসামনি দেখতে পাব ভেবে ততটা আর মনখারাপ হচ্ছিল না।

অটো টানেল ধরে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত গাড়ি ছুটে চলেছে। গাড়িতে উঠেই দাসানি আমার বাড়ির স্থানাঙ্ক জানিয়ে দিয়েছেন কম্পিউটারকে। সঙ্গে-সঙ্গে সবচেয়ে সুবিধেজনক পথের ছবি ফুটে উঠেছে কম্পিউটারের পরদায় এবং গাড়িটাও সেই অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছুটতে শুরু করেছে।

শহর ছাড়িয়ে ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে এলাম। সূর্য সবে ডুবে গেছে পশ্চিমে। আকাশে এলোমেলো লাল-হলুদ রং। হঠাৎই ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল গাড়ি। দাসানি পকেট হাতড়াতে-হাতড়াতে বললেন, ‘তোমাকে এই শেষ সুযোগ দিচ্ছি—’ তারপর একটা জেনারেটর গান বের করে হুমকি দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘এখনও বলো, কে তুমি?’

লক্ষ করেছিলাম, ওঁর জেনারেটর গানের সেফটি লক খোলা নেই। সুতরাং চোখের পলকে জোরালো এক ঘুসি বসিয়ে দিলাম দাসানির মুখে। আবার আরএকটা——এবারে রগের ওপরে। অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। দাসানির চোখ ঘোলাটে হয়ে গেল, কাত হয়ে পড়ে গেলে,’ সিটের ওপরে। ওঁর হাত থেকে খসে পড়া জেনারেটর গানটা তুলে নিলাম হাতে। দাসানিকে ঠেলে ফেলে দিলাম গাড়ির বাইরে। তারপর আবার গাড়ি চালিয়ে দিলাম।

আমার বাড়ির সামনে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা ছিল। সেখানে বাগান করেছিলাম। ফুলগাছ লাগিয়েছিলাম নিজের হাতে। এখন শীতের শেষে গোধূলিতে ফুলের গন্ধ পেলাম। দেখলাম, বাড়ির চারটে জানলায় আলো দেখা যাচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে বন্দুক ফেলে দিলাম। পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেলাম ফুলগাছগুলোর কাছে। বুকভরে ঘ্রাণ নিলাম। আঃ। ঠোঁটের কোণে জ্বালাটা আবার টের পেলাম। একটা ছোট্ট গোলাপ ছিঁড়ে নিলাম গাছ থেকে। ছোট্ট সুন্দর ফুলটা ওর রূপে আর ঘ্রাণে আমাকে যেন পোষ মানিয়ে নিল। ফুলটা আমাকে সন্দেহ করে না।

ফুলটা পকেটে রেখে বাড়ির দরজার দিকে এগোলাম। ছ’মাস চাঁদের মাধ্যাকর্ষণে কাটিয়ে এখন যে সামান্য অসুবিধে হচ্ছে না তা নয়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা যান্ত্রিক স্বর আমাকে পাসওয়ার্ড জিগ্যেস করল। একমাত্র বাড়ির বাসিন্দারা ছাড়া পাসওয়ার্ড কেউ জানে না। জানানো হয় না। তবে খুব অন্তরঙ্গ পারিবারিক বন্ধু হলে অন্য কথা। যেমন রাকেশ আমাদের দরজা খোলার পাসওয়ার্ড জানে। আমি, সুমিতা আর রুনু জানি। টুনুকে এখনও শেখানো হয়নি।

আমি পাসওয়ার্ড বলতেই দরজা খুলে গেল এবং ভেতরে কোথাও একটা ঘন্টি বেজে উঠল।

সামনেই আলোয়-ভেসে-যাওয়া বসবার ঘর। আর-একটু দূরে দু-পাশে দাঁড়িয়ে রুনু আর টুনু।

‘রুনু-টুনু—।’

রুনু কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। টুনু একটু যেন হাসতে চেষ্টা করল। তারপর হঠাৎই কেঁদে চিৎকার করে উঠল, ‘তুমি এক্ষুনি চলে যাও এখান থেকে!’

কোথা থেকে যেন আচমকা হাজির হল সুমিতা। ঠিক ওদের দুজনের মাঝে। আমি সুমিতার নাম ধরে ডেকে উঠলাম। আর ঠিক তখনই সুমিতা ওর হাতেধরা জেনারেটর গান থেকে ফায়ার করল। আমি চৌকাঠের ওপর বসে-পড়লাম ঝরা ফুলের মতো।

সুমিতা তখন আতঙ্কে পাগলের মতো চিৎকার করছে। বলছে, রাকেশ আমাকে ঠিক সময়েই খবর দিয়েছিল। বলেছিল, “নরেন্দ্র দাসানি রোবটটাকে সঙ্গে করে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, এটা দাসানিকে শেষ করে তোমাদের বাড়িতে গিয়ে না হাজির হয়। যদি সেরকম কিছু হয় তাহলে তুমি তৈরি থেকো, বউদি। আমি হাতের কাজ শেষ করেই যাচ্ছি।” রাকেশের কথাই শেষপর্যন্ত অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল। আমার স্বামীকে শেষ করে তুমি আমাদের সবাইকে শেষ করতে এসেছ!’

সুমিতা কোন লেভেলের ফায়ার করেছে জানি না, কিন্তু ওর কথাগুলো আমি যেন বহুদূর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম। রুনু, টুনু অবাক চোখে আমাকে দেখছিল।

সত্যিই তো, আগে কখনও কোনও রোবটকে মরতে দেখেনি ওরা।

ঠিক সেই সময়ে শুনতে পেলাম ভারী বুটের শব্দ। কারা যেন দৌড়ে আসছে অন্ধকার বাগানের পাশ দিয়ে। পায়ের শব্দ কাছে এল। রাকেশ আর দাসানি। সুমিতার হাবভাব আর জেনারেটর গান দেখেই ব্যাপারটা ওরা বোধহয় বুঝতে পারল।

দাসানি ঝুঁকে পড়ে আমার পোশাক তল্লাশ করতে লাগলেন। কিছু কাগজপত্র পেলেন। তারপরেই পেলেন গোলাপটা। লক্ষ করলাম, ওই ছোট্ট তাজা ফুলটা পাথরের মতো মানুষটাকে বদলে দিল। ওঁর চোখ ছোট হল, কপালে ভাঁজ পড়ল। হাঁটু গেড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন আমার মুখের ওপরে। বিড়বিড় করে বললেন, ‘অ্যান্ড্রয়েড কখনও নিজের খেয়ালে গাছ থেকে ফুল ছেঁড়ে না—কখনও না। অ্যান্ড্রয়েডদের সব কাজের পিছনেই একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে—কোনও না কোনও কারণ।

উত্তেজিতভাবে রাকেশের দিকে তাকিয়ে দাসানি বললেন, ‘ব্যানার্জি, আমাদের বোধহয় ভুল হয়েছে!’

রাকেশ তখন ছোট্ট একটা ডিজিটাল ট্রান্সিভারে কার সঙ্গে যেন বেতারযোগাযোগে কথা বলছিল। খট করে যন্ত্রটার সুইচ অফ করল ও। দেখলাম, ওর চোখ চিকচিক করছে। ধরা গলায় থেমে-থেমে ও বলল, ‘চাঁদে ওরা টাইটানের অ্যান্ড্রয়েড-স্পাইয়ের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছে। ওরা যে ইন্দ্রজিৎ সান্যালের নকল করে অ্যান্ড্রয়েড গুপ্তচর পাঠাচ্ছে সেই খবরটা ঠিকই ছিল….কিন্তু মনে হয়, ডিজাইনে কোনওরকম গোলমাল থাকায় ঠিক সময়ের আগেই বিস্ফোরণ ঘটে যায়। তারপর…।’

রাকেশ আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে, চিৎকার করে কেঁদে উঠল। বলল, ‘ইন্দ্ৰ…ইন্দ্ৰ…সত্যিই তুই ফিরে এসেছিলি…!’

আমার মুখে ওর হাতের ছোঁয়া টের পেলাম। ঠিক তখনই সুমিতা-রুনু

টুনু একসঙ্গে কেঁদে উঠল। চোখে জল ওদের সন্দেহ ধুয়ে-মুছে দিয়েছে।

প্রিয়জনেরা যদি চোখের জলে বিদায় জানায় তাহলে মরতে কারও খারাপ লাগে না। আমারও লাগবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *