তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

সন্দেহ

সন্দেহ

সন্দিগ্ধমনা কিছু মানুষ আছেন। সন্দেহ করাটা তাঁদের বাতিক হয়ে দাঁড়ায়। সহজে কারোকে বিশ্বাস করতে পারেন না। সব ব্যাপারেই তাঁদের সন্দেহ। ‘আচ্ছা, দিন পনের আগে তোমাকে একটা চিঠি পোস্ট করতে দিয়েছিলুম। করেছিলে তো?’

‘কেন বলুন তো?’

‘না, এতদিনে উত্তর এসে যাওয়ার কথা; কিন্তু কোনও সাড়াশব্দই নেই। তাই ভাবলুম, ভুলেটুলে যাওনি তো।’

ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেলুম। চিঠি পোস্ট করলে পোস্টবকস তো কোনও রিসিট দেয় না। তাঁর সন্দেহ নিরসনের কোনও উপায় নেই।

 ছেলে বাজার করে এসেছে। মা জিগ্যেস করছেন, ‘মাংস কত এনেছিস?’

‘কেন যা বলেছিলে। এক কেজি।’

‘এক কেজি বলে তো মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আটশো।’

 লেগে গেল মায়ে ছেলেতে ঝটাপটি। শেষে এমন হল নিয়ে আয় পাল্লা। চাপা বাটখারা। এই সময় আশেপাশে বেশ কিছু অলৌকিক শক্তির অধিকারী চরিত্রও জুটে যান। যাঁরা চোখে দেখে জিনিসের ওজন বলতে পারেন। তাঁরা বলবেন—হ্যাঁ, ঠিকই, এ তোমার এক কেজি হতেই পারে না। সাতশো কি বড় জোড় আটশো। সন্দেহ খুব সংক্রামকও। কারোর মনে একবার জন্মালে সব মনেই জন্মে যায়। হাই তোলার মতো। একজন হাই তুললে, সবাই তুলতে থাকে।

বাজার করা একটা ধন্যবাদহীন যন্ত্রণা। যে করে, তাকে সবাই ভাবে, খুচখাচ মেরেছে। না মারলে বাজার হয়! বাবার ছেলেকে সন্দেহ, স্ত্রীর স্বামীকে সন্দেহ। বাজারকে ঘিরে ক্রেতার সন্দেহ। ক্রেতাকে ঘিরে বাড়ির সন্দেহ। বাটখারা? তার তলা ফাঁপা। ওজনে কম। এক কেজিতে একশো দুশো গ্রাম মারবেই। পাল্লা ঠিক নেই। পাষাণ আছে। মাছের কানকো তুলে দেখ, লাল টুকটুকে; কিন্তু পচা। যত মাছ বেচা মাসি আছে তারা সব ভাগাভাগি করে পান চিবোচ্ছে আর পুচুত করে কানকো তুলে পানের পিক ফেলে লাল টাটকা পুকুর থেকে সদ্য-তোলা রুই মাছ করে ছেড়ে দিচ্ছে। বাজার ছেয়ে গেছে ‘পটল-আর্টিস্টে’। পট-শিল্পীর মতো পটল-শিল্পী। এও একপ্রকার লোক-শিল্প। পটলে সবুজ রং মাখিয়ে, এক নম্বর ফাইন তুলি দিয়ে গাঢ় সবুজে লম্বালম্বি রেখা টানা। বাজার ছেয়ে গেছে কারবাইড কারিগরে। আগে গোপন গুপ্তঘরে জাল টাঁকশালে জাল টাকা তৈরি হত। টাকার দাম কমে যাওয়ায় সে কারবার উঠে গেছে। এখন হয়েছে কাঁচাকে পাকা করার গোপন কারবাইড ঘর। সেখানে আম পাকছে, কলা পাকছে, পেঁপে পাকছে, কাঁঠাল পাকছে। লাল টুকটুকে আম। বিস্বাদ। আঁটি তখনও নরম কুচকুচে। পাকা পেঁপে? ইন্টারভেনাস শ্লোকজ, ইনজেকশান করে যদি একটু মুখে দেওয়া যায়। লিচু? ভেতরে ভীমরুলের মতো ঢ্যাপা আঁটি। গায়ে পার্চমেন্টের মতো, সি-থ্রু শাড়ির মতো, পাতলা এক পরত শাঁস।

মানুষের সন্দেহবাতিক কি সাধে হচ্ছে? যুগটা ক্রমশই জটিল হচ্ছে। এক ফয়েল ওষুধ কিনে ভদ্রলোকের সে কী কসরত। একসপায়ারি ডেটটা দেখে নিতে হবে।

বলা তো যায় না। মহা সন্দেহ। কি দিতে কী দিয়ে দেয়। চকচকে রাংতার গায়ে নীল কালির ছাপ। পড়ে কার সাধ্য। অপটিক্যাল একসপার্ট ছাড়া, প্রতিফলন, প্রতিসরণের অ্যাঙ্গেল ঠিক করে সাধারণ মানুষের পক্ষে পাঠোদ্ধার দু:সাধ্য।

মাংস কিনতে গিয়ে সন্দেহ। কোন পাড়ার কুকুর। খুবই স্বাভাবিক প্রশ্ন, সরষের তেলটা কি তেল? মাখন আর কি ঘি দিয়ে তৈরি হয়?

মানুষের কথাকে সন্দেহ। কারোর কথাই আজকাল আর বিশ্বাস করা যায় না। কথার দাম ক্রমশই কমছে। সব কথাই এখন কথার কথা। প্রথমত, নেতার কথা। পাড়ায় কল নেই। নেতা বললেন, তিন দিনের মধ্যে জলের ফোয়ারা খেলবে, আলোয় রাত ফুটফুট করবে, রাস্তার সব গাড্ডা বুজে গিয়ে মেড ইন জার্মানি হয়ে যাবে। যাও বা শিশুর ছুনুর মতো কলের মুখ দিয়ে সরু সুতোর ধারায় একটু পড়ছিল, তাও বন্ধ হয়ে গেল। দৈত্যের একটি চক্ষুর মতো যাও বা মোড়ের মাথায় একটি আলো জ্বলছিল, তাও নিবে গেল। সব বেকারের চাকরি হবে, কলকারখানা খুলে যাবে, দেশে দুধ আর মধুর স্রোত বইবে। মানুষ মুচকি হাসে। বুড়ো বয়েসে দিদিমার মুখে রূপকথার গল্প শোনা। পক্ষীরাজ। রাজার দুধপুকুর। শিশুর বিশ্বাস হারিয়েছি আমরা। তাই ম্লান হেসে মনে করেইনি—নেতারা অমন বলে থাকেন। কিছু মনে করতে নেই। নেতার কাজ নেতা করেছেন।

সরকারি কর্মচারীর কথা! ‘আপনি কিছু ভাববেন না, তিন দিনের মধ্যে পেনশন পেপার রেডি হয়ে যাবে।’ তিনমাস হয়ে গেল। প্রতিশ্রুতি এমন একটা জিনিস, যা শুধুই শ্রুতি।

সাধারণ মানুষের কথা আজকাল এইভাবে শুরু হয়—’আপনি কিচ্ছু ভাববেন না, আমি দেখছি।’ চাকরি দেখছি, মেয়ের জন্যে পাত্র দেখছি। কাজের লোক দেখছি। ভালো পাড়ায় দুটো ঘর দেখছি। গৃহশিক্ষক দেখছি। কিচ্ছু ভাববেন না। আমি সব দেখছি। আজকাল মানুষ আয়নায় নিজের মুখছাড়া আর কিছুই দেখে না।

আমরা যখন বলি, ‘আরে আসুন আসুন, কতদিন পরে এলেন, কী সৌভাগ্য!’ তখন অভ্যাগত সন্দেহ করেন, ‘ঠিক বলছে তো!’ কারণ দরজা খোলার আগে কে যেন বললে, কানে এল—’কে আবার এখন জ্বালাতে এল।’

 যে মেয়েটি বলেছিল, ‘তোমাকে ছাড়া আমি কি করে বাঁচব!’ সে এখন বহল তবিয়তে অন্যের কণ্ঠলগ্না। আগের চেয়েও বেশ হৃষ্টপুষ্ট। সুতরাং প্রেমিক অথবা প্রেমিকা যখন অমন কথা বলে তখন সন্দেহ হয়। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে—’সত্যি?’

আজকাল শোকের কান্নাকেও সন্দেহ হয়। স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামী চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছেন। একমুখ দাড়ি। বুঝি বা সন্নাসীই হয়ে যান। বছর না ঘুরতেই শালির সঙ্গে সিনেমা দেখছেন। বছর না ঘুরতেই, স্পেস্যালিস্টের চেম্বারে লাইন। হাই প্রেশার, হাইসুগার। প্রভু, বাঁচার পথ বাতলান।

অনেক দেখেই প্রবাদের জন্ম—’অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।’ ‘এম্পটি ভেসল সাউন্ডস মাচ।’ ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ!’ রেভারেন্ড লং সাহেব একটি মজার প্রবাদ উদ্ধার করেছিলেন—’ক্ষীর বরাবর ভ্রষ্টা নারী। পির বরাবর নেড়ে। স্বর্ণক্ষুরে হড়্যে। আর বাড়ির কাছে গেড়্যে। এদের যে বিশ্বাস করে। সে এক ভেড়ের ভেড়্যে। মিথ্যের এই পৃথিবীতে সত্য বেঁচে আছে সন্দেহের প্রশ্ন হয়—ঠিক বলছ তো?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *