সন্দেশ – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী

সন্দেশ – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী

যেন সাপ দেখে সে ভয় পেল, ভূত দেখে আঁতকে উঠল। চৌকাঠের ওপারে পা বাড়িয়েছিল, পাটা সরিয়ে আনল। তারপর শরীরে ক্ষিপ্র মোচড় দিয়ে স্বল্পপরিসর করিডর ও সিঁড়ি ক’খানা পার হয়ে সে নেমে এল নীচে ফুটপাথে। কিন্তু ফুটপাথে নেমেই কি সে দাঁড়াতে পারল স্থির হয়ে। ভূত ও সাপ তাকে ধাওয়া করেছে, যে কোনও দিকে পালাতে হবে এই স্থির প্রতিজ্ঞা নিয়ে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। পার হল বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রিট, এল চঞ্চল জনমুখর কলেজ স্ট্রিট এবং তাই ধরে ছুটতে ছুটতে এক জায়গায় এসে সে হঠাৎ থামল। আর যাওয়া যায় না। কেননা ঠিক সেই মুহূর্তে হ্যারিসন রোডের ট্রাফিক চলেছে।

আর সেই মুহূর্তে, যেন অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে জীবনে এই প্রথম পাশের পানের দোকান থেকে হাত বাড়িয়ে একটা সিগারেট কিনে নীলাদ্রি সিগারেট ধরালে। সিগারেটে টান দিয়ে সে খুকখুক কাশল, ভীত বিব্রত চোখে এদিক-ওদিক তাকাল দু’বার, তারপর, তারপর যেন পৃথিবীতে আর কিছুতেই ভয় নেই কাউকে ভয় করে না চোখেমুখের এমনি দৃপ্ত কঠিন ভঙ্গি করে পর পর জোরে চার পাঁচটা টান দিয়ে হাত থেকে এক সময় সিগারেটটা ফেলে দিলে। ততক্ষণে হ্যারিসন রোড পরিষ্কার হয়ে গিয়ে কলেজ স্ট্রিটের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। কিন্তু নীলাদ্রি ঠিক করতে পারছে না কোথায় যাবে কোন দিকে যাবে। একবার ভাবল হাওড়ার পোল দেখে না সে কতদিন, সেদিকে যাবে, শেয়ালদার স্টেশন-প্ল্যাটফরম রিফিউজিতে ভরে গেছে একবার গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে আসবে কি? না কি কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে সোজা সে উত্তর দিকে চলে যাবে। কিন্তু তারপর কোথায় যাবে কার কাছে। কর্নওয়ালিস স্ট্রিটেরও শেষ আছে। মোটের ওপর যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে এক পা নড়ল নীলাদ্রি। বরং ঘাড় ফিরিয়ে যে-রাস্তা ধরে এসেছিল সেই রাস্তাটা বার বার দেখতে লাগল। না, আর ভয় নেই ভয় নেই। আবার এক সময় শরীরের তীব্র ক্ষিপ্র মোচড় দিয়ে সেই পথ ধরেই সে এগিয়ে চলল। যাবার সময় পুঞ্জ পুঞ্জ বিদ্বেষ ও ঘৃণা সামনের রেস্তোরাঁর দরজা ও সিঁড়ির উদ্দেশে ঢেলে রেখে সে গোলদিঘির বেড়ার ধারে চলে এল। রাগে দুঃখে উত্তেজনায় থর থর কাঁপছিল নীলাদ্রি। একটা জায়গায় সে স্থির হয়ে কতক্ষণ বসতে চায়।

বেলা দুপুর। তা হলেও শেষ-কার্তিকের হেলে-পড়া সূর্য ইতিমধ্যে পার্কের চার পাঁচটা বেঞ্চে ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছে। গেট পার হয়ে সে আস্তে আস্তে পার্কে ঢুকল। কোনার দিকের একটা বেঞ্চে রুমাল বিছিয়ে বসল ও। নীলাদ্রির কান্না পেল হাসি পেল। কতকালের পরিচিত এই কলেজ-স্কোয়ার। কত লোককে এই দুপুরে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেছে সে। দেখে কেবলই তার মনে হত এরা বেকার, টি-বি রোগীর দল। কিন্তু একদিন একবারও কি তার মনে হয়নি কোনও ব্যর্থ প্রেমিক তার ব্যর্থতা তার নিঃসঙ্গতা ভুলতে অথবা নিবিড়ভাবে তাকে উপলব্ধি করতে ঠিক এখানে চলে আসতে পারে! নীলাদ্রি দুই হাতে মুখ ঢাকল। তারপর একসময় যখন হাত সরিয়ে নেয় দেখা গেল তার চোখ দু’টো বাষ্পচ্ছন্ন। স্থির অপলকদৃষ্টিতে কতক্ষণ সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে অদূরে ডাইভিং-বোর্ডের পাটাতনের ওপর বসে এক সারি দাঁড় কাক গা ঝাড়ছে, কখনওঅলস মন্থর গলায় শব্দ করে উঠছে। দিঘির নিষ্কম্প স্থির জলে তাদের ছায়া পড়েছে। মাথার ওপর ধূসর নীলাভ আকাশে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘের টুকরো ইতস্ততঃ ছড়িয়ে। জলের ওপারে ট্রাম বাস মানুষের অস্পষ্ট চলমান মিছিল। কান পাতলে তাদের শব্দ শোনা যায়। কিন্তু নীলাদ্রি আর একটা শব্দ শুনতে বুঝি কান খাড়া করে ধরে। সেই শব্দ এখান অবধি এসে পৌঁছয় না সে জানে যদিও। বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রিট ও হিন্দু স্কুলের অট্টালিকা-শ্রেণী শোভনার হাসির শব্দ আড়াল করে রেখেছে।

নীলাদ্রির পক্ষে এটা কল্যাণকর, সন্দেহ কী। কিন্তু সেই মুহূর্তে নীলাদ্রির মনে হল রেস্তোরাঁর উত্তর কোণের প্রায়ন্ধকার টেবিলে পশুপতির পাশে নিরিবিলি বসে কফির পেয়ালার চুমুক দিতে দিতে শোভনা সেন কি হাসছিল। নীলাদ্রিকে কি ওরা দেখতে পেয়েছিল? সেই সুযোগ নীলাদ্রি দেয়নি বটে। চৌকাঠের এপারে দাঁড়িয়ে দু’জনকে। সে আগে দেখে ফেলেছিল বলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাল। আ, শোভনা, শোভা,— দেহে মনে আবার একটা উদ্ধত উত্তেজনা অনুভব করল নীলাদ্রি। কিন্তু অনুভব করতে করতেও যেন কম্বল দিয়ে আগুন চাপা দেওয়ার মতো সেই উত্তেজনা অস্থিরতা সে তার শরীরের মধ্যে রক্তের মধ্যে চেপে রাখল। তারপর স্থির বিষণ্ণ ম্রিয়মাণ চোখে পেঁজা তুলোর মতো মেঘের টুকরো ও দাঁড়কাক-অধ্যুষিত ডাইভিং বোর্ডটা দেখতে লাগল। না এটা সেই যুগ নয়। নীলাদ্রি ইচ্ছা করলেই এই মুহূর্তে ছুটে গিয়ে রেস্তোরাঁর বিবরে ঢুকে বাঘের মতো শোভনার গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সুন্দর মুখ আর অনাবৃত সাদা সুঠাম বাহু দুটো দাঁত ও নখের আঁচড়ে ক্ষতাক্ত করে দিতে পারে না। তা ছাড়া বাঘের মতো এত বড় দাঁত ধারালো নখ তার নেই। আবার ইচ্ছা করলেও বিষ খেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে কি চলন্ত ট্রেনের তলায় লাফিয়ে পড়ে নীলাদ্রি আত্মহত্যা করতে পারে না। নীলাদ্রি পারে শুধু বিস্মিত বিমূঢ় হয়ে ভাবতে, ভাবতে আর শোভনা সেনের মতো নির্লজ্জ নিষ্ঠুর বোকা ব্যর্থ মেয়েদের ঘৃণা করতে করুণা করতে।

ব্যর্থ ব্যর্থ। নীলাদ্রি না। ব্যর্থ হয়েছে ওই মেয়ে শোভনা যার নাম। কী দাম রইল এতদিনের প্রেমের! প্রেমের অভিনয়? নির্ধূম দীপ-শিখা হয়ে তোমার ভালবাসা। জ্বলবে, কেবল একটি হৃদয়ের জন্যে চিরজীবন জ্বালিয়ে রাখবে, চলার-বলার ভাবে ভঙ্গিতে ঠারে-ঠমকে বড় যে দিনের পর দিন বিজ্ঞাপিত করছিলে এই কি সেই?— চিৎকার করে এখান থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হচ্ছিল নীলাদ্রির। একদিন, একটা দুপুর। নীলাদ্রি কলেজে গেল না, চোখের আড়াল হল, আর সেই ফাঁকে— যেন এমন একটা দুর্লভ সুন্দর দিনের জন্যে শোভনা সেন কতকাল প্রতীক্ষা করছিল। ধনী রূপবান ও বলতে গেলে তাদের ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে চরিত্রহীন লোফারের সঙ্গে রূপসী, বলতে গেলে ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে বিদূষী, মেয়েটি কার্তিকের শীত পড়ি-পড়ি দুপুরে পর পর কয়েক বাটি কফি ও প্লেট ভরতি কাজুবাদাম কেক কটলেট ডিম ও ফুলুরি খাওয়ার লোভ-সংবরণ করতে পারলে না। হয়তো আর দশটি মেয়েকে চাখতে চাখতে এই দুর্লভ দিনের কোনও বিরল মুহূর্তে গাড়ি-চড়ে-আসা। পশুপতি তালুকদার একবার মাত্র ঘাড় নেড়ে বলেছিল, এসো। শোভনা ঠিক চলে এল। যেন প্রস্তুত হয়ে ছিল। পা বাড়িয়ে ছিল। পাখা পোড়াবার প্রহর গুনছিল। নীলাদ্রির চোখে জল এল। ধূর্ত অবিশ্বাসিনী। চিৎকার করে নীলাদ্রির বলতে ইচ্ছে হল মেয়েদের এক লহমার জন্যে বিশ্বাস করে না এমন পুরুষের সংখ্যা সারা পৃথিবীতে। কেন এখনও সংখ্যায় অনেক বেশি নিজের স্বভাব দিয়ে শোভনা তা উপলব্ধি করুক। একবার নিজেকে দিয়ে সে তা বিচার করুক। ধরা যাক কেবল নিমন্ত্রণ রক্ষার খাতিরেই সৌজন্যবশত পশুপতির সঙ্গে ক্লাস পালিয়ে ও চলে এসেছে। যদি-তা-ই। হত তা-ই করত শোভনা। কিন্তু তা না। চৌকাঠের এপার থেকে একজন দেখে টের পেয়েছে কেবলমাত্র দুটো কফির পেয়ালা না, অনেক ডিশ কাঁটা-চামচ জলের গ্লাস বাটি মশলাদানির পাহাড় জমে উঠেছে সামনে টেবিলে। কেবল একটা ক্লাস ফাঁকি দেওয়া নয় একটা আস্ত দুপুর, পুরো একটা দিন ওরা দু’জন ওখানে বসে। নীলাদ্রি আজ কলেজে আসবে না জেনে ক্লাসে না ঢুকে সেই বেলা দশটা থেকে দুজন এসে ওখানে বসে গল্প করছে খাচ্ছে। আরও কতদিন এভাবে লুকিয়ে পশুপতির সঙ্গে বসে শোভনা খেয়েছে নীলাদ্রি মনে মনে এখন তা বেশ হিসাব করতে পারল। আ বিচ— হোর। দাঁতে দাঁতে ঘষে প্রায় শব্দ করে নীলাদ্রি বলে উঠত। সামনে আগন্তুক দেখে নিবৃত্ত হল।

মহিলার সঙ্গে একটা কুলি। কুলির মাথায় ছোট একটা কাঠের বাক্স, রেডিয়ো, নীলাদ্রি পরে বুঝতে পারল।

‘আমি এখানে একটু বসতে পারি, বাবা, বেঞ্চের ওধারে?’

‘নিশ্চয় নিশ্চয়।’ চমকে মহিলার মুখের দিকে তাকাল নীলাদ্রি। ‘আমি উঠে যাচ্ছি, আপনি বসুন।’

‘না না, উঠবে কেন। তুমিও বসো।’ হাতের থলেটা ঘাসের উপর নামিয়ে রেখে মহিলা বেঞ্চের এক পাশে বসেন। নীলাদ্রি উঠল না। মহিলা রূপবতী। প্রায় তার মা’র বয়সী অনুমান করে নীলাদ্রি মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারলে না, মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।

‘এটা গোলদিঘি, বাবা?

‘হ্যাঁ।’ নীলাদ্রি চোখ তুলল। ‘আপনি এখানে,—কলকাতায় নূতন এসেছেন কি? ’

হঠাৎ এ-প্রশ্নের উত্তর দেন না তিনি। স্থির নিবিষ্ট চোখে একটু সময় দিঘির দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসেন। তারপর আস্তে আস্তে বলেন, ‘না, আমি চিরকাল কলকাতায় কাটিয়েছি, বাবা। বড় তো একটা বেরোই না এখানকার বউ-ছুঁড়িদের মতন রাস্তায়-ঘাটে। গোলদিঘি লালদিঘির গোলমাল আমার আজও কাটল না।’ মহিলা অল্প শব্দ করে হাসলেন। নীলাদ্রিও হাসল।

‘আমার ছেলেমেয়েদের চেয়ে তুমি বয়সে বড় হবে না। রুবি তোমার চেয়ে বছর খানেকের ছোট হতে পারে। ওই রুবি আমায় রাস্তায়-ঘাটে বার করতে আরম্ভ করেছে।’

কে রুবি কী বৃত্তান্ত প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হল নীলাদ্রির।

মহিলা বললেন, ‘তুমি কোন কলেজে পড় বাবা?’

‘স্কটিশ।’ নীলাদ্রি কৌতূহলী চোখে তাঁর মুখের দিকে তাকাল।

‘রুবির বেথুন।’ এবার ওর সেকেন্ড ইয়ার। আমার দ্বিতীয় মেয়ে।’

নীলাদ্রি জলের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

‘রুবিকে নিয়ে কি আমি কম যন্ত্রণা পোহাচ্ছি বাবা।’ মহিলাও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‘এই দুপুর রোদে ওর জন্যে আমাকে রেডিয়ো কিনতে বেরোতে হয়েছে। কী করব। না কিনলে ওর কাঁদাকাটি থামছে না।’

‘কী ব্যাপার, হঠাৎ রেডিয়োর জন্যে রুবির এত—’ মুখে না চোখের ভাষা দিয়ে নীলাদ্রি যেন প্রশ্ন করল। নীলাদ্রির চোখে চোখ রেখে তিনি বললেন, ‘তোমরা এখন বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে আমায় বেশি জ্বালাতন করছ।’

চোখ সরিয়ে নীলাদ্রি আবার একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

মহিলা বললেন, ‘কতদিন বারণ করেছি হেমন্তর সঙ্গে মিশবে না। হোক বাবা বড়লোক। ও বখাটে ছেলে। দু-দু’বার আই-এ ফেল করল। ওর সঙ্গে মাখামাখি আমি চাই না। মন্দ ছেলের সঙ্গে প্রেম আমি খতম করবই।’

নীলাদ্রি আকাশের দিকে তাকায়।

‘হেমন্তর সঙ্গে মিশলে ও উচ্ছন্নে যাবে! লেখাপড়া এখানেই শেষ! সারাটা ভবিষ্যৎ ওর অন্ধকারাচ্ছন্ন এত বড় মেয়ে কি তা বোঝে না।’ মহিলা আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মোছেন। বাষ্পচ্ছন্ন কণ্ঠস্বর। ‘ফি বছর গ্রীষ্মের ছুটি হতে আলমোড়ায় ওর মাসিমার কাছে চলে যায়। এবার কিছুতেই গেল না। কত করে বললাম এই গরমে কলকাতায় থেকে কি হবে। একটু বাইরে বেড়িয়ে এলে শরীর মন দুই ভাল থাকে।’

‘গেল না কেন?’ যেন অনিচ্ছাকৃত একটা প্রশ্ন নীলাদ্রির মুখ দিয়ে বেরল।

‘ওই যে বললাম, হেমন্ত। সারাটা ছুটি ওর সঙ্গে থেকে পার্কে-ময়দানে বেড়িয়েছে, রেস্টুরেন্টে খেয়েছে আর সিনেমা দেখেছে। হেমন্তর তো পয়সার অভাব নেই। প্রথমটায় কি আমি টের পেয়েছিলাম। আমি জানি অমুক ছাত্রীর বাড়ি বেড়াতে গেছে অমুক ছাত্রীর সঙ্গে বায়োস্কোপে গেল। তলে তলে যে হেমন্তর সঙ্গে—’ একটু থেমে মহিলা বললেন, ‘পরে হঠাৎ একদিন দিবাকর এসে আমাকে সব বলে গেল।’

কে দিবাকর নীলাদ্রি প্রশ্ন করতে পারলে না। তার বুকের মধ্যে কাঁটাটা বড় যন্ত্রণা দিচ্ছিল।

‘সেদিন সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরতে খুব গালমন্দ করলাম ভয় দেখালাম। কাঁদল। রাত্রে কিছু খেলে না। পরদিনও নাওয়া-খাওয়া একরকম বন্ধ। বিকেলে কাছে ডেকে আদর করে যখন চুল বেঁধে দিচ্ছি বলল, আমি হেমন্তর সঙ্গে আর মিশব না মা। রেডিয়ো নেই আমাদের, একটা রেডিয়ো কিনে দাও। এবার থেকে সারাক্ষণ বাড়িতে থাকব।’

নীলাদ্রি চমকে মহিলার মুখের দিকে তাকাল। তিনি অল্প অল্প হাসছেন। ‘মেয়ের কথা শুনে হাসিও পেল দুঃখও হ’ল। মনে মনে বললাম, মন্দ কি যদি একটা রেডিয়ো পেলে হেমন্তকে, হেমন্তর প্রেম ভুলতে পার। না হয় তাই কিনে দেওয়া যাবে।’ হাস্যবিচ্ছুরিত চোখে তিনি এবার নীলাদ্রির চোখের দিকে তাকান। ‘আজকালকার ছেলেমেয়েদের প্রেমে পড়তে বেশি দেরিও লাগে না আবার ভুলতেও এক মিনিট। ওই রুবিকে দিয়েই বুঝলাম। কী বল, তুমি বড্ড চুপ করে আছ বাবা।’

নীলাদ্রি ততক্ষণে নুয়ে হাত বাড়িয়ে একটা ঘাস ছিঁড়ে নিয়ে নখ দিয়ে সেটা কুটি কুটি করছে। নীলাদ্রির কান্না পাচ্ছিল এই ভেবে শোভনা সেনের মা কি বেঁচে নেই। আ, যদি বেঁচে থাকেন আর কোনও দিন টের পান কলেজ পালিয়ে মেয়ে একটা লোফারের সঙ্গে বসে রেস্তোরাঁর অন্ধকারে প্রহর কাটাচ্ছে।

‘সেই কখন বেরিয়েছি।’ মহিলা বললেন, ‘তা বাবা, টাকার তেমন জোর নেই। কর্তা বেঁচে থাকলে যা হোক তবু একটা কথা ছিল, ওঁর রেখে যাওয়া সামান্য ক’টা টাকা ভেঙে যাচ্ছি। তার ওপর ছেলেমেয়েদের জন্যে বাড়তি এটা ওটা কিনতে গেলে প্রাণ যেন বেরিয়ে যায়। ঘুরে ফিরে দু’তিনটে দোকান যাচাই করে শেষ পর্যন্ত ওই মাঝারি দামের একটা রেডিয়ো কিনলাম। অবশ্য রুবির ওটা অপছন্দ হবে না। কী বল?

‘হ্যাঁ, হবে, কেন হবে না।’ নীলাদ্রি আড় চোখে ঘাসের ওপর নামিয়ে রাখা যন্ত্রটার দিকে একবার তাকাল। হাঁটুর ওপর দুই হাত রেখে কুলিটা পাশে বসে ঝিমোচ্ছে। ব্যাগ থেকে রুমাল বার করে মহিলা মুখ মোছেন। ‘হাতের সব ক’টা টাকা খরচ হয়ে গেল। যাবার সময় ট্যাক্সি নিয়েছিলাম। ফেরবার সময় আর ইচ্ছা হল না। কম পয়সায় একটা রিক্সা ডেকে নিলাম। আর কী, কলেজ স্ট্রিট এসে গেছি তাই রিক্সাও ছেড়ে দিলাম। এখান থেকে বাদুড়বাগান আর কতটুকুন রাস্তা। সনাতন সঙ্গে আছে ভয় নেই। হেঁটেই এইবার বাড়ি পৌঁছে যাব।’ মহিলা মাটিতে উপবিষ্ট লোকটিকে ডাকলেন, ‘সনাতন, ওঠ্‌, গোলদীঘি দেখবি বলে এখানে এসে তুই ঘুমোচ্ছিস যে। রুবি শুনলে হেসে কুটি কুটি হবে।’ কথা শেষ করে মহিলা নীলাদ্রির দিকে চোখ ফেরান। কুলি না, তাঁর চাকর, নীলাদ্রি এবার বুঝতে পারল।

‘তুমি কোথায় থাক বাবা? ’

‘টালিগঞ্জ।’ নীলাদ্রি সোজা হয়ে বসল।

‘অনেক দূর এখান থেকে।’ মহিলা হাতের রুমাল ব্যাগে পুরলেন। ‘কইরে সনাতন, ওঠ্‌ এবার, ক’টা বাজে এখন?’

‘আড়াইটে তিনটে হবে।’ নীলাদ্রি আন্দাজে বলল।

‘রুবির এইবেলা কলেজ ছুটি হবে। আজ শুক্কুর বার তিনটে মোটে ক্লাস ওর। তুমি কলেজ যাওনি বুঝি। ছুটি? কীসের?’

‘না এমনি, শরীরটা তেমন ভাল না।’ নীলাদ্রি ম্লান হাসল। তিনি উঠলেন। সনাতন ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে, তার মাথায় রুবির নতুন কেনা রেডিয়ো। পাতার ফাঁক দিয়ে ঠিকরে-পড়া চিকরি-কাটা রোদের ঝালর লেগে মসৃণ কালো বার্নিশ করা বাক্সটা ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। একটু সময় সেদিকে তাকিয়ে থেকে নীলাদ্রি একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। গেট পার হয়ে তারা পার্ক থেকে বেরিয়ে যায়। অদূরে ডাইভিং-বোর্ডের গায়ে আর এক ঝাঁক কাক এসে উড়ে বসে সবটা সাদা অংশ ঢেকে ফেলেছে।

১৩.১২.১৯৫৩

লেখক পরিচিতি

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী: ২০ আগস্ট ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লায় মাতুলালয়ে জন্ম। ১৯৩০ সালে বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। ১৯৩৬-এ পরিচয় পত্রিকায় ‘নদী ও নারী’ গল্পটি প্রকাশিত হলে আলোড়ন ওঠে। ‘বারো ঘর এক উঠোন’ সফলতম উপন্যাস। এ ছাড়া কয়েকটি গ্রন্থ; মীরার দুপুর, প্রেমের চেয়ে বড়, এই তার পুরস্কার। ১৯৬৫ সালে আনন্দ পুরস্কার। মৃত্যু: ১ অগস্ট ১৯৮৩।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *