সন্দেশ

সন্দেশ

রান্নাঘরে চোখে জল কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। পেঁয়াজ কাটবার সময় এ কাণ্ড হামেশাই ঘটে। ডালে ফোড়ন দেওয়ার সময়টাও মাঝেমধ্যে বিপজ্জনক হয়ে যায়। কিন্তু চা বানাবার সময় চোখে জল আসবার কোনও কারণ নেই।

গায়ত্রীদেবী চা করছেন। তাঁর দু’চোখেই জল! চা বানানোর ফাঁকে ফাঁকে তিনি শাড়ির আঁচল দিয়ে সেই জল মুছে নিচ্ছেন।

তিন বছর হল, ব্রজেশ্বরবাবু চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। চাকরি শেষ করবার সঙ্গে সঙ্গে ব্রজেশ্বরবাবু চায়ে চিনি খাওয়ার পাটও শেষ করেছেন। শুধু দিনের দ্বিতীয় কাপে এক চামচ খান। এই চা গায়ত্রীদেবী নিজে বানান। আজও বানালেন। তারপর বেতের ট্রে-তে কাপ সাজিয়ে তিনতলার বারান্দায় এলেন।

এই বারান্দাটা চমৎকার। বারান্দার তিনটে দিকই খোলা। সল্টলেকের এদিকটায় উঁচু বাড়ি কম। তাই হঠাৎ দেখলে মনে হবে, বারান্দাটা যেন কোনও বাড়ির বারান্দা নয়, আকাশের বারান্দা। ব্রজেশ্বরবাবু এর নাম রেখেছেন আকাশ-বারান্দা। সকালের কিছু সময় তিনি আকাশ-বারান্দায় কাটান।

স্বামীর পাশে বসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে গায়ত্রীদেবী দু’বার চোখের জল মুছলেন এবং তিনবার ফোঁপানির মতো শব্দ করলেন। কোনও লাভ হল না। ব্রজেশ্বরবাবু কান্নার কিছুই দেখতে বা শুনতে পেলেন না। কারণ, তিনি চোখ বুজে আছেন। কানে ওয়াকম্যান। উঁচু পদে সরকারি চাকরির সুবাদে তাঁকে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরতে হয়েছে। সেই সময় একটা উদ্ভট শখ মাথায় চাপল। শখ না বলে একে পাগলামি বলা উচিত। ছুটিছাটা আর ফাঁক পেলেই তিনি টেপরেকর্ডার নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। জঙ্গল, নদী, পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে পাখির ডাক ধরে রাখতেন। কম করে খানকুড়ি ক্যাসেট এই মুহূর্তে তাঁর সংগ্রহে রয়েছে। সেসব ক্যাসেটে নম্বর দেওয়া। ইচ্ছে হলে, পছন্দমত নম্বরের ক্যাসেট বের করে শোনেন। বাকি জীবনটা মূলত তিনি পাখির ডাকের মধ্যেই থাকতে চান। একসময় তাঁর একটা পাখির ডাকের সংগ্রহশালা করবার স্বপ্ন ছিল। বিশ্বে প্রায় সবকিছুর সংগ্রহশালা আছে। পাখির ডাকের কেন যে নেই!

আজ ব্রজেশ্বরবাবু যে ক্যাসেটটা শুনছেন তার নম্বর ‘সাতের ঘ’। এতে রয়েছে কান্‌হা জঙ্গলের পাখির ডাক। পাখির স্থানীয় নাম গুড্ডুর। ডাক, লম্বা লম্বা টানা শিসের মতো। ব্রজেশ্বরবাবুর খুব ভাল লাগছে। তার মনে হচ্ছে, সত্যি সত্যি কান্‌হা জঙ্গলের মধ্যে বসে আছেন। মোটা একটা শিরীষ গাছের গায়ে হেলান দিয়ে ছোট ছোট চুমুক দিয়ে গরম চা খাচ্ছেন।

ক্যাসেট শেষ হলে কান থেকে ওয়াকম্যান সরালেন ব্রজেশ্বর। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ গলায় বললেন, ‘অপূর্ব! তুমি একবার শুনবে গায়ত্রী?’

গায়ত্রীদেবীর মাথায় আগুন ধরে গেল। শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘হ্যাঁ, শুনব। তুমি যখন বলছ অবশ্যই শুনব। বাড়িতে এরকম একটা বিপদ ঘটেছে আর আমি পাখির ডাক শুনব না? তুমি বললে পাখির মতো ডাকতে ডাকতে বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিতেও পারব।’

ব্রজেশ্বরবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার গায়ত্রী, বিপদের কী হয়েছে?’

গায়ত্রীদেবী আর পারলেন না। ঝাঁঝিয়ে উঠলেন। বললেন, ‘বিপদের কী হয়েছে! আজ সকাল থেকে কৌশিক কী বলতে শুরু করেছে জানো?’

ব্রজেশ্বরবাবু বললেন, ‘কই, না তো, জানি না তো কিছু!’

গায়ত্রীদেবী বললেন, ‘তা জানবে কেন? ছেলের কথা জানবে কেন তুমি, তুমি জানবে পাখির কথা। কৌশিক বলছে, সে আর চাকরিবাকরি কিছু করবে না। সে নাকি সন্দেশ বানানোর কারখানা দেবে!’

ব্রজেশ্বর অবাক গলায় বললেন, ‘সন্দেশ! কেন সন্দেশ বানাবে কেন?’

গায়ত্রীদেবী হিমশীতল গলায় বললেন, ‘মনে হয়, তোমার পাখিগুলোকে খাওয়াবে। সন্দেশ রসগোল্লা খেয়ে তারা মনের আনন্দে তোমার কানের পাশে বসে গান গাইবে। ওর অবশ্য কোনও দোষ নেই। পাগল বাবার ছেলে পাগল ছাড়া আর কী হবে।’ এই পর্যন্ত বলে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে গায়ত্রীদেবী উঠে পড়লেন।

উঠে পড়লেন ব্রজেশ্বরও। বিড়বিড় করে বললেন, ‘ইন্টারেস্টিং!’ তিনি ছেলের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।

টেবিলে বসে কৌশিক মন দিয়ে কিছু লিখছে। টেবিলের ওপর কম্পিউটার। সেখানে ‘স্ক্রিন সেভার’ হিসেবে ভেসে ভেসে উঠছে কয়েকটা লাইন— আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি, সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে…।

কৌশিক আট মাস হল জেনেটিক বায়োলজি নিয়ে খুব শক্ত ধরনের একটা পড়াশুনো সহজ ভাবে শেষ করে বিদেশ থেকে ফিরেছে। তারপর কম করে সতেরোটি ফার্ম থেকে সে চাকরির প্রস্তাব পায়। তার মধ্যে পাঁচটা মাল্টিন্যাশনাল। একটিতে সে কাজ শুরু করে। কিন্তু দু’মাস কাটতে না কাটতে সেই লোভনীয় চাকরি সে ছেড়ে দিয়েছে। ছেড়ে দিয়ে গত পনেরো দিন হল বাড়িতে। দরজা আটকে কম্পিউটারে কীসব খুটখাট করেছে আর লাইব্রেরি থেকে মোটা মোটা পুরনো বই এনে রাত জেগে পড়েছে। শেষপর্যন্ত আজ সকালে মায়ের কাছে সে ঘোষণা করে, বাঙালি চাকরিতে নয়, বেঁচে আছে স্বপ্নে। সেও স্বপ্ন দেখেছে। অতএব, আর চাকরি নয়। যে-কোনও মায়ের কাছেই এই ঘোষণা বড় ধাক্কার মতো। সেই ধাক্কার জোরেই গায়ত্রীদেবীর এত কান্নাকাটি। কিন্তু কৌশিকের স্বপ্নটা কী?

ব্রজেশ্বরবাবু ঘরে ঢুকলেন। কৌশিকের পিঠে হাত রাখলেন। হাসিমুখে বললেন, ‘সুপ্রভাত।’

কৌশিক হেসে বলল, ‘সুপ্রভাত, এসো বাবা। বসো।’

ব্রজেশ্বর বসলেন। বললেন, ‘কী করছিস?’

কৌশিক বলল, ‘একটা প্রজেক্ট তৈরি করছি। এটা আমার ড্রিম প্রজেক্ট বাবা। আমার স্বপ্নের প্রকল্প। তুমি এই কাগজটা একবার দেখবে?’

ব্রজেশ্বর ছেলের উৎসাহ দেখে খুবই খুশি হলেন। না, ছেলেটা মানুষ হয়েছে। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করেন, পাগলামিতে যার উৎসাহ নেই সে কখনও পুরো মানুষ হতে পারে না। অর্ধেক বা সিকি হয়ে আটকে যায়। তিনি কাগজটা নিলেন। ওপরে বড় বড় করে লেখা— বাংলার হারিয়ে যাওয়া সন্দেশ। তলায় লেখা— গুডমর্নিং সন্দেশ, লর্ড রিপন সন্দেশ, পরিওয়ালা ছাঁচ সন্দেশ, বাঘ সন্দেশ, মুন্ডি সন্দেশ, আপেল সন্দেশ, মনোরঞ্জন সন্দেশ, অবাক সন্দেশ, গোলাপফুল সন্দেশ, জামরুল সন্দেশ, নয়নতারা সন্দেশ…।

ব্রজেশ্বরবাবু বললেন, ‘অপূর্ব! তুই তো বিস্তর খাটাখাটনি করেছিস দেখছি।’

কৌশিক গদগদ মুখে বলল, ‘বুঝলে বাবা, ঠিক করেছি, বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এইসব সন্দেশ আমি আবার নতুন করে বানাব। বানিয়ে বিদেশে এক্সপোর্ট করব।’

ব্রজেশ্বর বললেন, ‘বিদেশে সন্দেশ কে খাবে?’

কৌশিক জোর গলায় বলল, ‘সবাই খাবে। পেলেই খাবে। দুর্দান্ত প্যাকেটে পাঠাব। আমার সব ভাবা হয়ে গেছে। আর দ্যাখো বাবা, এটা তো শুধু ব্যাবসার বিষয় নয়, এর মধ্যে আমাদের বাংলার রসনা-সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে। তাকে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়াটাও হবে একটা বড় কাজ। হবে না?’

ব্রজেশ্বরবাবু বললেন, ‘অবশ্যই হবে। আলবাত হবে।’

কৌশিক উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল। পায়চারি করতে করতে বলতে লাগল, ‘চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, সেন্ট পিটসবাগ, নিউ ইয়র্ক, ওসাকা, গুয়েতামালা, প্যারিসের মিষ্টির আউটলেটগুলোর সামনে লম্বা লম্বা লাইন। কোথাও বৈকুণ্ঠভোগ বিক্রি হচ্ছে হুড়মুড় করে। কোথাও বাবর শা ফুরিয়ে যাওয়ার মুখে। কোথাও এলাচ বরফির স্টক শেয। ইন্টারনেটে একটা দোকান থেকে আর একটা দোকানে সিউড়ির মোরব্বা, গুপ্তিপাড়ার কাঁচাগোল্লা, রানাঘাটের পান্তুয়া চেয়ে মেসেজ যাচ্ছে। কলকাতায় আমাকে ই-মেলে জানানো হচ্ছে। ওফ!’

ব্রজেশ্বরবাবু মুগ্ধ গলায় বললেন, ‘তুই যা বলছিস সে তো অনেক টাকার ব্যাপার রে? অত টাকা পাবি কোথা থেকে?’

কৌশিক হেসে ফেলল। যেন গোটা ব্যাপারটার মধ্যে টাকাটাই সবথেকে তুচ্ছ অংশ। বলল, ‘মূল টাকাটা আসবে ডিস্ট্রিবিউটারদের কাছ থেকে। আপাতত হাজার তিরিশ-চল্লিশ টাকার ব্যবস্থা করতে হবে। স্যাম্পেল বানাতে হবে। স্যাম্পেল পাঠালে তবে অর্ডার। তা ছাড়া এসব মিষ্টির কারিগর তো আর চট বলতে পাব না। খোঁজাখুঁজির ব্যাপার আছে। অর্ডার হলে ব্যাঙ্কে যাব, সরকারের কাছে যাব। কিছু একটা হয়ে যাবে।’

ব্রজেশ্বরবাবু ফিসফিস করে বললেন, ‘না হবে না। তবে সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, স্বপ্ন। দ্য ড্রিম। তুমি নেমে পড়ো। আমি তোমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক লিখে দিচ্ছি। মাকে এখনই বলার দরকার নেই।’

কৌশিকের ইচ্ছে করছে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ নাচে।

জায়গা জোগাড় হল। ভবানীপুরের কাছে একফালি গ্যারেজ ঘর। দশহাজার টাকার বায়না। গ্যারেজের ওপর সাইনবোর্ড লাগানো হল—‘মিসিং সুইটস—অফিস কাম ওয়ার্কশপ।’ তারপর শুরু হল সবথেকে কঠিন কাজ। হারিয়ে যাওয়া সন্দেশের রেসিপি এবং কারিগরের সন্ধান। নামকরা মিষ্টির দোকানগুলোতে ঘুরে ময়রার দেখা পাওয়া গেল, কিন্তু সব শুনে তারা ঘাবড়ে গেল। যার নাম শোনেনি সে জিনিস তারা বানাবে কী করে? শেষপর্যন্ত খবর পাওয়া গেল, বর্ধমানে নাকি একজন আছে। লোকটার পূর্বপুরুষদের কেউ একজন বর্ধমানের রাজার প্রাইভেট ময়রা ছিল। কৌশিক ছুটল। লোকটা কৌশিককে একটা হলদেটে মার্কা সার্টিফিকেট দেখাল। রাজারা কাগজে লিখে সার্টিফিকেট দিতেন এমন কোনও কথা কৌশিকের জানা নেই। কিন্তু উপায় কী? রাজি হল কৌশিক।

কিছুদিনের মধ্যে রাজবাড়ির ময়রা বর্ধমানের গ্রাম থেকে ভাগনে, শালা, ভগ্নিপতি এবং তাদের মোট চারটি ছেলেমেয়ে নিয়ে এসে ভবানীপুরের গ্যারেজে বাসা বাঁধল। তারা একমাসের অগ্রিম বেতন তো বটেই, সেই সঙ্গে উনুন, কড়াই, হাতা কেনার টাকাও চেয়ে নিল। সেখানে গুছিয়ে বসতে-না-বসতেই দিন তিনেকের মাথায় মোটরবাইক চালিয়ে দুটি ছেলে এসে হাজির। তাদের একজনের হাতে মোবাইল। একজনের কানে দুল। একগাল হেসে কৌশিককে বলল, ‘দাদাভাই, এসে গেছি। দুটো ঠান্ডা বলুন। শুনলাম দাদাভাই বাংলার মিষ্টি ফিস্টি নিয়ে কী একটা কল ফেঁদেছেন। বেশ করেছেন দাদাভাই, ভাল করেছেন। তাই তো কবি বলেছেন, বাংলার মাটি, বাংলার জাল। কিন্তু দাদাভাই, শুধু বাংলার সন্দেশ রসগোল্লার জন্য ভাবলে কি চলবে? পাড়ার বাংলার ভাইদের জন্যও যে একটু ভাবতে হবে। হাজার পাঁচেক রেডি রাখবেন দাদাভাই। কাল এসে নিয়ে যাব। কই ঠান্ডা কোথায়?’

কৌশিক ব্যাঙ্কে গেল। ম্যানেজার চোখ সরু করে বললেন, ‘দুঃখিত, সন্দেশের জন্য লোন সিস্টেম এখনও চালু করতে পারিনি। তবে আশা করি, যেভাবে এগোচ্ছি, তাতে কিছুদিনের মধ্যে সন্দেশ, নাড়ু, তালের বড়ার জন্য ঋণদান প্রকল্প আমরা চালু করতে পারব। আপনি বরং কুটির শিল্প দপ্তরে যান।’

কুটির শিল্প দপ্তরের কর্মীরা কচুরিপানার চেয়ার সংক্রান্ত একটা ফাইল নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলেন। তার ফাঁকেই সব শুনে বললেন, ‘এক্সপোর্ট ফেক্সপোর্টের ঝামেলা আছে। এল সি খুলতে হবে। আপনি মাঝারি শিল্প দপ্তরে গিয়ে একবার দেখতে পারেন।’

মাঝারি শিল্প দপ্তর অফিসের কর্মীরা এতক্ষণ গোমড়া মুখে কাজ করছিলেন। কৌশিকের প্রজেক্ট পৌঁছোতে টেবিলে টেবিলে হাসির তুফান উঠল। অফিসার ভদ্রলোক হাসিহাসি মুখে বললেন, ‘মিস্টার ঘোষ, আপনি কি আপনার প্রোডাক্টের দু’-একটা স্যাম্পেল এনেছেন? এই ধরুন দুটো গোলাপফুল সন্দেশ বা খানচারেক লর্ড রিপন? আনবেন, তারপর আমরা আপনার প্রজেক্টের ভায়াবিলিটি ভেবে দেখব। আর একটা কাজ করতে পারেন। আপনি কয়েকটা প্লাস্টিকের সন্দেশ তৈরি করে দেখতে পারেন৷ তা হলে প্রজেক্টটা আমরা হলদিয়া পেট্রোকেমিকালের ডাউনস্ট্রিমের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারি। হা হা।’

রাতে আকাশ-বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে কৌশিক। ব্রজেশ্বর পাশে এসে দাঁড়ালেন। পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘কী রে, মন খারাপ?’ কৌশিক ম্লান হেসে বলল, ‘না বাবা, মন খারাপ নয়। ক্লান্ত লাগছে।’ ব্রজেশ্বর হেসে বললেন, ‘ক্লান্ত তো লাগবেই। সব পথেরই শর্ট কাট আছে, শুধু স্বপ্নের পথে কোনও শর্ট কাট নেই।’ তুই বরং একটা কাজ কর। আমার উনিশ নম্বর ক্যাসেটটা নিয়ে একটু শোন। ওটায় কিছু মাইগ্রেটারি পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ পাবি। ক্লান্তি ঝেড়ে উড়ে যাওয়ার আওয়াজ। ইট মে হেলপ ইউ। শুনবি?’ কৌশিক বলল, হ্যাঁ, শুনব। তুমি ক্যাসেটটা দাও।’

কৌশিক ভেবেছিল, এতদিনে ওয়ার্কশপে কাজ শুরু হয়ে গেছে। স্যাম্পেল তৈরি হবে। পরশু ছানা, ক্ষীর, এলাচ কেনবার টাকা দিয়ে এসেছে। বর্ধমানের ময়রা টাকা হাতে নিয়ে সেদিনও বলল, সে পারবে। এটাই আশার কথা। সবথেকে বড় আশার কথা। প্রোডাক্ট ঠিকমতো হলে বাকিটা ঠিক হয়ে যায়।

কিন্তু একী! দুপুরে কৌশিক ‘মিসিং সুইটস’ গ্যারেজে ঢুকে একেবারে থ! উনুনটুনুন কিছুই কেনা হয়নি। রাজবাড়ির ময়রা দলবল নিয়ে শতরঞ্চি পেতে মন দিয়ে তাস খেলছে। গেটের মুখে নানা রঙের পতাকা, ফেস্টুন। ঘরের দেয়ালে আলতায় লেখা পোস্টার—‘মিসিং সুইটস এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন লড়ছে লড়বে।’

হতভম্ব ভাব কাটার পর, কৌশিক চিৎকার করে বলল, ‘কী হচ্ছে এসব? কাজ না করে আপনারা তাস খেলছেন?’

ময়রাবাবু প্রথমে তাসের চাল ফেলল। তারপর বলল, ‘চেঁচাবেন না স্যার। আগে পাওনা গন্ডার কথা পাকা হবে। পুজো বোনাসের কী হল তার কাগজপত্র দেখাবেন। রাজা বাদশার সন্দেশ বানিয়ে বিদেশে পাচার করবেন আর আমরা গরিব গুব্বো মানুষ কি না খেয়ে মরব স্যার? এখন আসুন দেখি, খেলার সময় বিরক্ত করবেন না।’

গাড়ি ঘুরিয়ে থানায় গেল কৌশিক। সেকেন্ড অফিসার বলল, ‘খেপেছেন মশাই? স্টাইকারদের গায়ে হাত? লোকাল নেতাটেতা ধরে মিটিয়ে নিন।’

লোকাল নেতার কোনও নাম নেই, শুধু পদবি আছে। জোয়ারদার। খুবই বিনয়ী ধরনের মানুষ। চা খাওয়ালেন। বললেন, ‘আপনার প্রজেক্ট শুনতে উদ্ভট কিন্তু ইন্টারেস্টিং। বড় কথা হল, শুধু ব্যাবসা নয়, আপনি দেশের জন্য ভেবেছেন। দিস ইজ গুড। ভেরি গুড। আমরাও দেশের জন্য ভাবি, কিন্তু পাবলিক বিশ্বাস করে না। আপনি চিন্তা করবেন না, এসব বর্ধমান ফর্ধমানের লোক আমি তুড়ি মেরে হাটিয়ে দিচ্ছি। আমার খানদশেক ছেলেকে নিয়ে নিন।’

কৌশিক আমতা আমতা করে বলল, ‘আপনার ছেলেরা কি সন্দেশ বানাতে পারবে?’ জোয়ারদার হো হো শব্দে হেসে উঠল, ‘সন্দেশ বানাবে! ওরা সন্দেশ বানাবে কেন? পার্টির কত কাজ জানেন আপনি? পাবলিককে সার্ভিসেস দিতে দিতে জান কয়লা হয়ে যায়। ছানা পাকানোর জন্য আপনি অন্য লোক খুঁজে নেবেন। আমার ছেলেরা মাসে একবার গিয়ে মাইনে তুলে আনবে। কোনও সাতপাঁচে থাকবে না— এটা গ্যারান্টি। আপনি সন্দেশ বানাবেন না, গাঁজা গাছ লাগাবেন, নো মাথা ব্যথা।’

কৌশিক চাকরি নিয়েছে। কোম্পানি বিদেশি নয়, দেশি। পদ বড় হলে কী হবে, মাইনে তেমন বেশি নয়।

গায়ত্রীদেবী রান্নাঘরে। তাঁর চোখে আজও জল। তবে এই জল চোখের নয়, শুকনো লঙ্কার ঝাঁঝের জল। আজ তিনি শুধু চা নয়, খুব আনন্দের সঙ্গে রান্নাও করছেন। ছেলে আজ থেকে নতুন অফিসে যাচ্ছে।

আঁচলে হাত মুছে, চা নিয়ে আকাশ বারান্দায় উঠে এলেন গায়ত্রীদেবী। ব্রজেশ্বরবাবুর চোখ বোজা, কানে ওয়াকম্যান। ক্যাসেটের নম্বর পাঁচের চ। পাখিদের নাম, দোয়েল এবং ফিঙে। ক্যাসেট শেষ হলে তিনি চোখ খুললেন। একটু হাসলেন। বললেন, ‘বুঝলে গায়ত্রী। বাংলার দোয়েল আর ফিঙের মতো চমৎকার ডাক পৃথিবীর আর কোনও পাখিরই নেই।’

গায়ত্রীদেবীর মুখ হাসিহাসি। স্বামীর দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, ‘পাগল কোথাকারে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *