গত সোমবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তুরস্ক আর জার্মানির আংকারা আর বার্লিন শহরে ঘটে গেল আবারও নৃশংস হত্যাকাণ্ড। আংকারায় এক পুলিশ অফিসার গুলি করে মেরে ফেলেছে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে, বার্লিনের রাস্তায় ক্রিসমাসের বাজার ভর্তি মানুষের ওপর এক লোক চলন্ত ট্রাক তুলে দিয়ে ১২ জনকে পিষে মেরেছে, আর ৪৮ জনকে আহত করেছে। ওদিকে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে এক লোক একটি মসজিদে আচমকা ঢুকে কয়েকজন মুসলমানের দিকে গুলি ছুড়েছে।
জুরিখের মসজিদে যে লোকটি গুলি ছুড়েছে, তার সঙ্গে, বলা হচ্ছে, কোনো ইসলামি সন্ত্রাসী দলের যোগ ছিল না। মসজিদ থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে নিজেকেই সে শেষ অবধি হত্যা করেছে। কেন সে মানুষ মারতে চেয়েছিল, কেন সে আত্মহত্যা করেছে, তা এখনো কেউ স্পষ্ট করে জানে না।
বার্লিনে এক পাকিস্তানি শরণার্থীকে ট্রাক ড্রাইভার বলে ভাবা হচ্ছিল। পরে দেখা গেল, সন্ত্রাসী সে নয়, আসল সন্ত্রাসী পালিয়ে গেছে। এখনো আমরা জানি না বার্লিনের সন্ত্রাসীটি কোনো ইসলামি সন্ত্রাসী কি না। আইসিস বলেছে, সন্ত্রাসীটি তাদের দ্বারা প্রভাবিত। জার্মানির কেউ কেউ বলছে ফ্রান্সের নিস থেকে ট্রাক-হামলা শিখে জিহাদিরাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বার্লিনে, আবার কেউ কেউ কিছু একটা সন্ত্রাস ঘটামাত্রই কে করেছে তার কোনো প্রমাণ পাওয়ার আগেই মুসলিম শরণার্থীদের দিকে সন্দেহের আঙ্গুল না তুলতে অনুরোধ করছে।
আংকারায় যে পুলিশটি রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করেছে, জিহাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করার উদ্দেশ্য নিয়েই সে হত্যাটি করেছে। আল-কায়দার বই পড়ে পড়েই জিহাদে হাতেখড়ি তার। জীবনকে বড় তুচ্ছ মনে করে জিহাদিরা। মৃত্যুর ভয় টয় সব উবে যায়। ২২ বছর বয়সী মেলভুত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেই কারলভকে নিজের পকেট থেকে অস্ত্র বের করে খুন করেছে, খুন করার পর একটি আঙ্গুল শূন্যে তুলে বলেছে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘মনে রেখো আলেপ্পো, মনে রেখো সিরিয়া’। অর্থাৎ আলেপ্পোতে মুসলমানদের মেরে যে অন্যায় করেছে রাশিয়া, তার শাস্তি আজ তাকে পেতে হলো। আল-কায়দা মেলভুতকে হত্যার বদলে হত্যা করতে শিখিয়েছে।
‘আল্লাহু আকবর’— এই দুটো শব্দ আমি ছোটবেলায় শুনতাম আমার নানার মুখে। নানা খুব ভোর বেলায় উঠে সশব্দে নামাজ পড়তেন। তাঁর উচ্চারণের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতো পবিত্রতা, সততা, সম্ভ্রম, সমর্পণ। এই ‘আল্লাহু আকবর’ এখন শুনি সন্ত্রাসীদের মুখে। মানুষকে জবাই করতে করতে, খুন করতে করতে, চিৎকার করে তারা বলতে থাকে, আল্লাহু আকবর। গা কেঁপে ওঠে আমার। সব ধর্মেই তো হিংসে দ্বেষ, খুনোখুনির কথা আছে, তাই বলে এই একবিংশ শতাব্দীতে এক জিহাদি ছাড়া কোনো ঈশ্বরের নামে কেউ মানুষ খুন করে? আল্লাহু আকবর— আমার ছোটবেলায় ঘুম ঘুম চোখে শোনা মধুর শব্দদ্বয় কবে যে হাইজ্যাকড হয়ে গেছে।
ওদিকে জর্দানেও কিছু নিরাপত্তা পুলিশকে মেরে ফেলা হয়েছে। আইসিসের সেনারা কাজটা করে বেশ বুক ফুলিয়েই ঘোষণা করেছে যে এ কাজ তাদেরই। জর্দানের সরকার ইরাক আর সিরিয়ার মুসলমানদের ওপর বোমা মারছে, তাই প্রতিবাদ। ডোনাল্ড ট্রাম্পও ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট পেয়ে তাঁর মতো করে প্রতিবাদ করেছেন সন্ত্রাসী হামলার। ভয় হয় প্রতিবাদ আবার বুশের মতো না হয়ে যায়, এদেশ ওদেশ থেকে দুর্নীতিবাজ একনায়ক সরকার হঠাতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে না আবার খুন করে ফেলেন। কেন মুসলমানদের খুন করা হলো এই রাগে, দুঃখে বা এই ছুতোয় আবার কট্টরগুলো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বানিয়ে না ফেলে।
সবচেয়ে যেটা খারাপ লাগে, তা হলো, জিহাদিদের সন্ত্রাসী কাণ্ডকারখানা দেখে দেখে সারা পৃথিবীর সাধারণ মানুষের মধ্যে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা বাড়ছে। যে মুসলমান সন্ত্রাসের সাতে নেই, পাঁচে নেই। তাকে কেন ভুগতে হবে! পৃথিবীর বেশির ভাগ মুসলমান সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত নয়, তবে কেন বেশির ভাগ মুসলমানকে মানুষ আজ অবিশ্বাস করছে? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই ভালো। আমাকে কালই একজন বললো, ‘কে জিহাদি, কে জিহাদি নয়, তা বাইরে থেকে বোঝা যায় না, তাই সব মুসলমানকেই প্রত্যাখ্যান করি। ’ মুসলমানদের মধ্যেও অনেকে নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকছে, চারদিকের জিহাদি কাণ্ডকারখানা দেখে তারাও অপ্রস্তুত, তারাও লজ্জিত।
দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সন্ত্রাস করছে, পারমাণবিক শক্তি বোমা ফেলছে, নিরীহ মুসলমান মারা পড়ছে, ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর বুলডোজার চালাচ্ছে ইসরাইল, কাশ্মিরে মুসলমানদের নির্বিচারে খুন করছে ভারতীয় সেনা— এসব কারণে মুসলমানরা নাকি জিহাদি দলে নাম লেখাচ্ছে। কিন্তু জিহাদিরা কি মুসলিম সমাজের কোনো উন্নতি করতে পারে? ক্ষতি ছাড়া এ পর্যন্ত লাভ কি তারা করেছে কারোর? মুসলমানদের সবচেয়ে যেটা প্রয়োজনীয় কাজ, যেটা করলে বা গড়লে মুসলমানদের উন্নতি হবে, সেটা আর যা কিছুই হোক, জিহাদ নয়। সেটা শিক্ষা এবং সচেতনতা। সেটা সমানাধিকারের আর সমতার সমাজ। সেটা ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞানমনস্কতা। কিন্তু ক’জন জানে বা মানে সে কথা?
আমরা আইসিসকে তো দেখলাম, বিশাল পরাশক্তির বিরুদ্ধে কিছু ছুরি আর বন্দুক নিয়ে নেমে গেছে মাঠে, বছর ভর মুসলমানদেরই গলা কেটেছে, মেয়েদের ধরে বেঁধে যৌনদাসি বানিয়েছে— এই সমাজ কি কোনো কাঙ্ক্ষিত সমাজ?
ইহুদিরাও অত্যাচারিত হয়েছিল, কিন্তু ওরা অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে দলে দলে মানুষের গলা কাটতে নেমে যায়নি। ওরা নিজেদের শিক্ষিত করেছে, সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবেছে, অর্থনৈতিক শুধু নয়, নৈতিক উন্নতির কথা ভেবেছে, বিজ্ঞানের কথা ভেবেছে, আজ পৃথিবীর বড় বড় শিক্ষাবিদ, বড় বড় চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, পদার্থবিদ ইহুদি সম্প্রদায়ের লোক। বছর বছর নোবেল পাচ্ছে। মানুষ খুন করে, রক্তপাত ঘটিয়ে স্বর্গে যাওয়া যাবে বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বিপ্লব করা যাবে— এসব মনে হয় না কোনো বুদ্ধিমানের কাজ। বুদ্ধি এত লোপ পাওয়া কি ভালো? অনেকে বলছে, মুসলমানরা হয় বোকা, নয় বর্বর। যারা বোকা নয় বা বর্বর নয়— তাদেরও শুনতে হচ্ছে এই অপবাদ।
সন্ত্রাস কোনো সমাধান নয়। কোনো সম্প্রদায়ের জন্য নয়। আজকের মুসলিম সন্ত্রাসীদের জিজ্ঞেস করো, সকলেই বলবে, আমেরিকার সন্ত্রাস তাদের পছন্দ নয়, আমেরিকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই তারা আজ সন্ত্রাসী হয়েছে। আমার প্রশ্ন, ‘তুমি যদি বন্দুকের বিরুদ্ধে, তবে তুমি নিজেই কেন বন্দুক হাতে নিচ্ছ? তুমি যদি খুনের বিরুদ্ধে, তবে তুমি খুন করো কেন?’ আসলে সন্ত্রাসীরা কিছু একটা ছুঁতো খোঁজে সন্ত্রাস করার জন্য, সন্ত্রাস তাদের ভালো লাগে, ভালো লাগে বলেই শত্রুদের সন্ত্রাস দেখে তাদেরও সন্ত্রাসী হতে ইচ্ছে করে, শত্রুরা তো অনেক ভালো কিছু করে, সেসবের প্রতি কেন আকৃষ্ট হয় না তারা? কেন তারা যুক্তিবাদী হওয়ার জন্য, বিজ্ঞানী বা নভোচারী বা আরো হাজারো ভালো কিছু হওয়ার জন্য স্বপ্ন দেখে না?
মুসলমানরা যদি নিজেদের ভালো চায়, নিজেদের সভ্য এবং শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, তবে নিজেদের সংবিধান থেকে, নিজেদের আইন থেকে, শিক্ষা এবং সংস্কার থেকে ধর্মটাকে তুলে নিয়ে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের গণ্ডিতে রেখে দেবে। ব্যক্তিগত বিশ্বাসের গণ্ডি থেকে একে বের করলেই বিপদ বাধে। ইতিহাস বলে বিপদ বাধে। আমরাও সচক্ষে দেখছি বিপদ বাধে। ধর্মের নামে বা ঈশ্বরের নামে খুনোখুনি করে বর্বর লোকেরা। সভ্য দেশগুলোয়, যে দেশগুলোয় মানবাধিকার, সমানাধিকার, নারীর অধিকার, সমতা আর শান্তি সবচেয়ে বেশি, সেখানে ধর্মকে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের গণ্ডির মধ্যে রাখা হয়, রাষ্ট্রের কোনো কাজকর্মে নাক গলাতে দেওয়া হয় না। পৃথিবীতে নানা মতের, নানা ধর্মের, নানা ভাষার, নানা সংস্কৃতির, নানা লিঙ্গের, নানা রঙের মানুষকে একসঙ্গে সুখে-শান্তিতে বাস করতে হলে এ ছাড়া উপায় নেই।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৬