1 of 3

সন্ত্রাস

দশজন ইসলামী সন্ত্রাসীসহ মোট আঠাশজনের মৃত্যু হলো করাচী বিমানবন্দরে। দশজন সন্ত্রাসীর শরীরে আত্মঘাতী বোমা বাঁধা ছিল। সঙ্গে খেজুর, গুড়, মটর, বাদাম এসবও ছিল, গ্রেনেডও ছিল, পেট্রোল বোমাও ছিল। বিমানবন্দর বেশ কিছুদিন দখলে রেখে সন্ত্রাস চালানোর ইচ্ছে-টিচ্ছে ছিল বোধহয়। বিপদ দেখলে পেটে বাঁধা আত্মঘাতী বোমার বোতাম টিপবে, মুহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। কিন্তু খেজুর খাওয়ার সময় ওরা আর পায়নি। তার আগেই জীবন দিতে হলো।

তেহেরিক-ই-তালিবান নামের গোষ্ঠী সগৌরবে ঘোষণা করেছে যে, তারাই বিমানবন্দরে আক্রমণ করেছে। এই আক্রমণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা বলেছে, তেহেরিক-ই-তালিবান নামের গোষ্ঠীর আমির হেকিমুল্লাহ মাসুদকে আমেরিকা দ্রোন হামলায় মেরেছে, তার প্রতিবাদে আর ওয়াজিরিস্তানে কোনও রকম পুলিশি হামলা চলবে না- এই হুমকি দিতে।

এই আক্রমণে আঠাশজনের প্রাণ চলে গেলো, তাতে অবশ্য কারও কোনও অনুশোচনা নেই। মানুষের জীবনের চেয়ে ধর্ম বিশ্বাস ওদের কাছে অনেক বড়। ওদের কাছে মানুষের জীবনের গুরুত্ব নেই, গুরুত্ব আছে অলৌকিকের। অনেকে বলে, মৃত্যুর আগে কী হবে তা নিয়ে ওরা ভাবে না, ভাবে মৃত্যুর পর কী হবে তা নিয়ে।

আমি ঠিক বুঝি না, যে জীবনটাকে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, সেই জীবনটাকে কী কারণে এত সহজে ছাই করে দিতে চায়। ধর্ম তো জগতে আরও আছে, প্রলোভন তো আরও অনেক ধর্মেও আছে, অন্যায় অবিচার অত্যাচারের উপদেশ তো অন্য ধর্মও দিয়েছে, কিন্তু একটি ধর্মে বিশ্বাসীরাই কেন সারা পৃথিবীতে সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে। এর কারণ কি নিতান্তই নিবুর্দ্ধিতা, অজ্ঞতা, অশিক্ষা নয়? একটি ধর্মগোষ্ঠীই এখন তাণ্ডব করে চলেছে, মানুষ হত্যা করে চলেছে। অন্যান্য ধর্মগোষ্ঠী কখনও যে সন্ত্রাস করেনি, তা নয়, করেছে। কিন্তু পুরোটা না হলেও এখন অনেকটাই বন্ধ করেছে সন্ত্রাস। আত্মঘাতী বোমা বনার মতো ভয়ঙ্কর আবেগ অন্তত অন্যান্য ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে নেই।

আজ গোটা বিশ্বে ইসলামী সন্ত্রাস সবচেয়ে বেশি যাদের ভোগাচ্ছে, তারা মুসলমান। ইসলামী সন্ত্রাসীদের কারণে সবচেয়ে বেশি যারা মরছে, তারা মুসলমান। আর এদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কম যারা প্রতিবাদ করছে, তারাও কিন্তু ওই মুসলমানই। এর চেয়ে বড় দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে!

পাকিস্তানকে নিয়ে আমার যে ভয়, সেটা হলো কবে না আবার কোন সন্ত্রাসী পারমাণবিক বোমার নাগাল পেয়ে যায়। নিরাপত্তা রক্ষীর ছদ্মবেশে সন্ত্রাসীরা যদি বিমানবন্দরে একবার ঢুকতে পারে, নিরাপত্তা রক্ষীর ছদ্মবেশে তারা কেন পারমাণবিক বোমা রাখার ঘরে ঢুকতে পারবে না! পারমাণবিক বিজ্ঞানীর ছদ্মবেশও ওরা নিতে পারে। ওদের মতো ঘৃণায় টগবগ করা ভয়ঙ্কর লোকগুলো কবে যে টিপে বসে পারমাণবিক মারণাস্ত্রের ট্রিগার। কবে যে পৃথিবীর সবকিছুকে পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে ফেলে!

উত্তর কোরিয়ায় একটা পাগল স্বৈরাচারী বসে আছে। পাকিস্তানের ক্ষমতাবানদের মধ্যে থিকথিক করছে মৌলবাদী আর সন্ত্রাসী। ওই দুই দেশেই রয়েছে পারমাণবিক বোমা। এ খবর অনেকেই জানে যে পাকিস্তানের দুই পরমাণু বিজ্ঞানী, যারা পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা বানিয়েছেন, তালিবানদের খুব ঘনিষ্ঠ লোক। তারা তালিবান আমলে আফগানিস্তানে ঘন ঘন গেছেন, ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গেও দেখা করেছেন। আল কায়দাকে পারমাণবিক, রাসায়নিক আর বায়োলজিক্যাল অস্ত্র বানিয়ে দেওয়ার চুক্তিও করে ফেলেছিলেন। মনে আছে পারমাণবিক বিজ্ঞানী সুলতান বশির উদ্দিন মাহমুদ আর চৌধুরী আবদুর মাজেদের কথা? ওরা ‘উম্মাহ তামির-এ-নাউ’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছিলেন, বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা শুধু পাকিস্তানের নয়, এ বোমা পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম উম্মাহর’। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বশির উদ্দিন মাহমুদ এত বেশি জড়িয়ে ছিলেন যে আমেরিকার চাপে পাকিস্তান সরকার তাকে ‘পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশন’ থেকে বের করে দিতে বাধ্য হয়। মাহমুদ এখন কোরআন এবং বিজ্ঞানের মধ্যে মিল বের করছেন ঘরে বসে, আর একের পর এক এই বিষয়ে বই লিখে যাচ্ছেন। বিজ্ঞান শিখলে ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার থেকে মুক্ত হওয়া যায়, এ কথা আমরা বিজ্ঞানমনস্ক মুক্তচিন্তকরা সেই কতকাল থেকে বলছি। যখন দেখি উঁচু মাপের বিজ্ঞানীরাই ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কারের কাদায় ডুবে আছে, তখন বড় হতাশ হই। অবশ্য সব বিজ্ঞানী তো নয়, যত বিজ্ঞানী আছে জগত জুড়ে, তার বেশির ভাগই ধর্মমুক্ত। সব গোষ্ঠীতেই তো ব্যতিক্রম আছে। বিজ্ঞানীদের মধ্যেও আছে।

সারা পৃথিবীর মানুষ ধিক্কার দিচ্ছে মুসলিম সন্ত্রাসীদের। অনেক সময় দেখা যায়, দোষটা সন্ত্রাসীদের ওপর থেকে সরে গিয়ে পুরো মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর পড়ছে। নিরীহ মুসলমানরাও, যারা সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত নয়, তাদেরও মানুষ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে, ঘৃণার চোখে দেখছে। মুসলিম সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাস দেখতে দেখতে মানুষ এখন ক্লান্ত। কদিন পর পরই সন্ত্রাসের খবর আসে, মানুষের মৃত্যুর খবর আসে, ভয়ে মানুষ তটস্থ, মানুষের ক্রোধও ক্রমশ বাড়ছে। এই সন্ত্রাসীদের পক্ষে কথা বলার লোকের অভাব নেই। বিশেষ করে বামপন্থীদের বেশির ভাগই সন্ত্রাসীদের পক্ষে সওয়াল করেন। তাদের বক্তব্য, ‘পাশ্চাত্যের দেশগুলো মুসলমান বিরোধী, মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, নির্বিচারে মুসলমান মারছে, ইজরাইলের অত্যাচারেও মুসলমানরা অতিষ্ঠ। সুতরাং মুসলমানদের অধিকার আছে তাদের যা খুশি করার, শরিয়া আইন বলবৎ করার, নিজেদের ইসলামী ঐতিহ্য, সংস্কার ইত্যাদি টিকিয়ে রাখার, প্রয়োজনে সন্ত্রাসী হওয়ার, প্রয়োজনে জোর জবরদস্তি করে মেয়েদের বোরখা পরাবার, মেয়েদের পাথর ছুড়ে মারার।’ নিজেদের বেলায় কড়ায় গণ্ডায় আধুনিকতা চাই, আর মুসলমানদের বেলায় মধ্যযুগ হলেই চলবে। এই তাদের বক্তব্য। বামপন্থীদের শঠতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই।

মুসলমান দেশগুলোতে তো বটেই, মুসলমান মৌলবাদীরা এখন ইউরোপেও অশান্তি করছে। রাতে রাতে লন্ডনের মুসলমান এলাকায় মৌলবাদীরা টহল দিচ্ছে। পথচারীদের আক্রমণ করছে, হুমকি দিচ্ছে। মেয়েদের পোশাক পছন্দ না হলে রীতিমত পথ আটকে অপমান করছে, বলে দিচ্ছে, এ পোশাক পরে মুসলমান এলাকায় হাঁটা চলবে না। মদের বোতল নিয়ে বা মদ খেয়ে এই রাস্তায় হাঁটা চলবে না, শাসাচ্ছে পথচারীদের। সমকামীদের এই এলাকায় ঢোকা চলবে না, কারণ এ এলাকা মুসলমান এলাকা। লন্ডনের রাস্তা দখল করে নিতে চাইছে মুসলিম মৌলবাদীরা। তারা ঠিক করে দিতে চাইছে, মানুষ কী পোশাক পরবে, কী খাবে বা পান করবে, কোন রাস্তায় হাঁটবে, কার সঙ্গে শোবে না শোবে। মুসলমান এলাকা যেন মুসলমানের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। পৃথিবীর মানুষ এইসব ভিডিও দেখছে ইউটিউবে। ছিঃ ছিঃ করছে। আর ওদের ঘৃণাটা রাগটা গিয়ে পড়ছে পাশের বাড়ির নিরীহ মুসলমানের ওপর অথবা মুসলমান দোকানীর ওপর বা অফিসের মুসলমান কর্মচারীর ওপর।

শুধু রাস্তা দখল নয়, কিছুদিন আগে ধরা পড়েছে মুসলমান মৌলবাদীদের ট্রজান হর্স ষড়যন্ত্র, বার্মিংহামের ইস্কুলগুলো দখল করে নেওয়ার ষড়যন্ত্র। সেকুলার ইস্কুলগুলোকে মাদ্রাসা বানিয়ে ফেলার ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্র ধরা পড়ার পর লোকে নিন্দা করছে মৌলবাদীদের। এই রাগ গিয়ে পড়ছে মুসলমান গোষ্ঠীটার ওপর, নিরীহ মুসলমানরাও শিকার হচ্ছে লোকের সন্দেহের, অনাস্থার। এগারোই সেপ্টেম্বরে মুসলিম সন্ত্রাসীদের আমেরিকা হামলার পর কিছু লোক এতই মুসলমানবিদ্বেষী হয়ে উঠেছিল যে, কিছু শিখকে মুসলমান ভেবে গুলি করে মেরেছে। এই মৌলবাদী আর সন্ত্রাসী গোটা মুসলমান সম্প্রদায়ের যত ক্ষতি করছে, তত ক্ষতি আর কেউ করছে না। একসময় ইসলামকে যারা শান্তির ধর্ম বলে মনে করতো, তারা এখন আর মনে করছে না এটি শান্তির ধর্ম। প্রচুর মুসলমানও দিন দিন নাস্তিক হচ্ছে। সংখ্যাটা বাড়ছে। বেশ কয়েকদিন ফেসবুকের কিছু পোস্ট পড়লাম, যে কথা আমি সেই আশির দশকে বলে মৌলবাদীদের রোষানলে পড়েছিলাম, দেশান্তরী হতে হলো যে কারণে, সেইসব সাহসী কথা সগৌরবে বলছে আজকের প্রচুর তরুণ। আমার চেয়েও আরও জোরেশোরে বলছে। সব দোষ কিন্তু মৌলবাদীদের। তারাই ইসলামের সুনাম নষ্ট করছে। মৌলবাদীরা যদি তাদের ঘৃণ্য কীর্তিকলাপ বন্ধ না করে, তাহলে নাস্তিকের সংখ্যা আরও বাড়বে, সাধারণ মুসলমানরা উঠতে বসতে লোকের কাছে আরও অপদস্থ হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *