সন্তান

সন্তান

যখন বিয়ে হয় তখন জুবেদার বয়স পঁচিশ।

তার বাপ-মায়ের অবশ্য সতেরোতেই তার বিয়ে দিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু উপযুক্ত পাত্র পাওয়া গেল না। কোথাও কথাই এগোত না, আবার কোথাও কথাবার্তা এগোনোর পর গিয়ে কিছু একটা গন্ডগোল হত। এই করে করে জুবেদার পঁচিশ হল। সেই সময় তার বাবার কাছে সম্বন্ধ এল এক বিপত্নীক ব্যবসায়ীর। তার বয়স তখন পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। বেশি বই কম না। বাজারে তার কাপড়ের পাইকারি দোকান ছিল। মাসে প্রায় পাঁচ-ছ’শো টাকা আয়। জুবেদার বাবা রাজি হয়ে গেল।

জুবেদা বাধ্য মেয়ে। সে বাপ-মায়ের সিদ্ধান্ত হাসিমুখে মেনে নিল। যথাসময়ে বিয়ে হয়ে গেল আর সে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল।

তার স্বামীর নাম ইলমুদ্দীন। ভীষণ ভদ্র। জুবেদাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। জুবেদার আরাম-আয়েসে যাতে কোনো খামতি না হয়, সেদিকে তার তীক্ষ্ম নজর ছিল। অন্য কেউ যা পেলে বর্তে যেত, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল জুবেদার কাছে। কাপড়ের তো কথাই নেই! হাজার হাজার টাকার সুতি, সিল্ক, ডাবল হর্স বোস্কী ইত্যাদির থানের পর থান!

প্রত্যেক সপ্তাহেই সে বাপের বাড়ি যেত। একদিন পৌঁছে দেউড়ি দিয়ে ঢুকতেই ভিতরে কান্নার আওয়াজ পেল। ভিতরে ঢুকে জানতে পারল যে হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকে তার বাবা মারা গেছেন।

জুবেদার মা একা হয়ে গেলেন। বাড়িতে একজন চাকর ছাড়া তাঁর আর কেউ রইল না।

কিছুদিন পর জুবেদা স্বামীর কাছে গিয়ে তার বিধবা মাকে নিয়ে আসার অনুমতি চাইল।

ইলমুদ্দীন বলল, ‘আমার অনুমতির কী আছে?…এটা তো তোমারই বাড়ি! তোমার মা তো আমারও মা!…যাও, নিয়ে এস। আমি জিনিসপত্র আনার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’

জুবেদার আর খুশির অন্ত রইল না। সে টাঙ্গায় করে গিয়ে তার মাকে নিয়ে এল। ইলমুদ্দীন আগেই জিনিসপত্র আনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।

ইলমুদ্দীনদের বাড়িটা বেশ বড়। দু’তিনটে ঘর খালিই পড়ে ছিল। ভেবেচিন্তে জুবেদার মায়ের জন্য একটা ঘর ঠিক করা হল।

জুবেদার মা জামাইয়ের ব্যবহারে আপ্লুত হয়ে গেছিলেন। তিনি অনেকবার ভাবলেন কৃতজ্ঞতাস্বরূপ জামাইকে নিজের সব গয়নাগাঁটি দিয়ে দেবেন যাতে তার ব্যবসায় কাজে লাগে। কিন্তু স্বভাবে তিনি ছিলেন ভীষণ কিপ্টে। ফলে সাতপাঁচ ভেবেও শেষ পর্যন্ত অত হাজার টাকার গয়না আর জামাইকে দিয়ে উঠতে পারলেন না।

একদিন তিনি মেয়েকে বললেন, ‘দশমাস হয়ে গেল এখানে এসেছি। এখনো অবধি আমি একটা পয়সাও খরচ করিনি। তোর বাবা আমার জন্য অনেক রেখে গেছেন। প্রায় হাজার দশেক টাকা, তার উপর এত গয়না! কিছু তো আমায় দিতে দে!’

জুবেদা কয়লার উনুনে রুটি সেঁকছিল। সে বলল, ‘মা, তুমি যে কী বলো না!’

‘কী আবার বলছি!…আমি এইসব কিছুই ইলমুদ্দীনকে দিয়ে দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন ঠিক করেছি, তোদের বাচ্চা হলে তাকেই সব দিয়ে যাব।’

জুবেদার মায়ের একটা বিশাল চিন্তা ছিল যে মেয়ের এখনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। বিয়ের প্রায় দু’বছর হতে চলল! কিন্তু বাচ্চা হওয়ার কোনো লক্ষণই নেই।

তিনি জুবেদাকে কত হাকিমের কাছে নিয়ে গেলেন! কত ওষুধ-বিষুধ খাওয়ালেন! কিছুতেই কিছু হল না।

তারপর তিনি গেলেন পীর-ফকির-বাবাদের কাছে। কত তাবিজ- কবচ-টোটকা করানো হল! তাও বৃথা।

শেষে জুবেদা বিরক্ত হয়ে গেল।

একদিন রেগে সে মাকে বলল, ‘ছাড় তো এসব!…বাচ্চা না হলে না হবে!’

বুড়ি মুখ গোমড়া করে উত্তর দিলেন, ‘মা, এসব খুবই জরুরি!…তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি কি একেবারেই গেছে!…একটা বাচ্চা থাকা কতটা দরকার, জানো! এতেই তো জীবনের সার্থকতা!’

জুবেদা চুল্লিতে রুটি সেঁকতে সেঁকতে বলল, ‘আমি কী করব! না হলে আমার কী দোষ!’

‘দোষ কারোরই নয়, মা।…সবই আল্লাহর দয়া!’

জুবেদা আগেই আল্লাহর কাছে অজস্রবার প্রার্থনা করেছিল যাতে তার কোল খালি না থাকে। কিন্তু তাতেও আল্লাহর বিন্দুমাত্র দয়া হয়নি।

মা যখন রোজ বাচ্চার কথা বলতে শুরু করল, জুবেদার ধীরে ধীরে মনে হতে লাগল যে তার জীবন ব্যর্থ।

প্রত্যেক রাতে সে উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করল। কখনো দেখত যে সে একটা ধূ-ধূ মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে, কোলে একটা গোলগাল বাচ্চা; বাচ্চাকে সে এমন জোরে দোলাচ্ছে যে বাচ্চাটা আকাশে উঠে ধীরে ধীরে গায়েব হয়ে যাচ্ছে! আবার কখনো সে দেখত যে সে একটা বিছানায় শুয়ে; গদির জায়গায় অসংখ্য ছোট্ট বাচ্চা তার নীচে হাত পা নাড়ছে!…

এসব দেখতে দেখতে তার মাথাটা খারাপ হয়ে গেল।

একদিন বসে থাকতে থাকতে তার কানে এল একটা বাচ্চার কান্না। সে মাকে জিগ্যেস করল, ‘এটা কার বাচ্চা যে এত কাঁদছে?’

মা ভালো করে শোনার চেষ্টা করলেন। কিছু শুনতে না পেয়ে শেষে বললেন, ‘কই! কোনো বাচ্চা কাঁদছে না তো!’

‘না মা! কাঁদছে! ভীষণ জোরে জোরে!’

‘হয় আমি কানে কালা হয়ে গেছি, নয় তুই কানে বেশি শুনছিস।’

জুবেদা চুপ করে গেল। কিন্তু তার কানে আসা বাচ্চার কান্না আর ছটফটানির আওয়াজ বন্ধ হল না।

ক’দিন পর থেকেই তার মনে হতে লাগল যে তার বুক দুধে ভরে উঠেছে। কিন্তু সে মাকে কিছু বলল না। দুপুরে মা বিশ্রাম নিতে নিজের ঘরে গেলে সে চুপিচুপি নিজের কামিজ তুলে দেখল। সত্যিই তো! স্তন দুটো তো বেশ বড় আর ভরা ভরা লাগছে!

বাচ্চার কান্নার শব্দ সে মাঝে-মাঝেই শুনতে পেত। সে বুঝতে পারত যে এসব তার ভ্রম। আসলে সে শুধুই বাচ্চার কথা ভাবত আর তাই ওসব শুনতে পেত! সন্তানহীনতার কথা মাথায় আসলেই তার মনে হত, তার জীবন শূন্য, অর্থহীন।

বেশিরভাগ সময়ই সে বিষণ্ণ থাকতে লাগল।

মহল্লার বাচ্চারা বাইরে চিৎকার চেঁচামেচি করলে তার অসহ্য লাগত। মনে হত বেরিয়ে ওদের গলা টিপে দেবে!

তার স্বামীর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। সে ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। কাপড়ের দাম তখন রোজ একটু একটু করে বাড়ছে। বিচক্ষণ লোক ছিল বলে সে আগে থেকেই অনেক কাপড় কিনে রেখেছিল। ফলে এই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে তারও আয় বেড়ে গেল।

স্বামীর আয় বাড়তে জুবেদার বিশেষ কোনো আনন্দ হল না। ইলমুদ্দীন বাড়ি এসে তাকে নোটের বান্ডিল ধরালে সে কোলের উপর সেটা ফেলে ঘুমপাড়ানি গান গাইতে শুরু করে দিত। তারপর কোল থেকে তুলে সেগুলোকে কোনো এক কাল্পনিক দোলনায় রেখে দোল দিত।

একদিন ইলমুদ্দীন দেখল, তার দেওয়া নোট দুধের বাটিতে পড়ে। সে অবাক হয়ে গেল। নোটটা ওখানে কী করে গেল! সে জুবেদার কাছে গিয়ে জিগ্যেস করল, ‘দুধের বাটিতে এই নোট কী করে গেল?’

জুবেদা উত্তর দিল, ‘বাচ্চাগুলো খুব দুষ্টু হয়েছে! এটা নিশ্চয়ই ওদেরই কাণ্ড!’

ইলমুদ্দীন হকচকিয়ে গেল, ‘বাচ্চা! বাচ্চা কোথায়?!’

জুবেদা স্বামীর চেয়েও বেশি অবাক হল, ‘বাচ্চা কোথায় মানে!…কী যে বল না তুমি!…আমাদের বাচ্চা নেই এখানে?…এই তো সব স্কুল থেকে ফিরবে। চিন্তা কোরো না, আমি জিগ্যেস করব কে এটা করেছে।’

ইলমুদ্দীন বুঝল যে জুবেদা ঠিক নেই। তার মাথার সমস্যা হয়েছে। সে শাশুড়িকে কিছু বলল না। সে জানত যে শাশুড়ি একজন দুর্বল মানুষ। তার উপর তাঁর বয়স হয়েছে।

জুবেদার এই অসুখ নিয়ে তার কষ্টের শেষ ছিল না। কিন্তু সে বুঝে উঠতে পারল না যে কী করবে।

বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পরামর্শ করতে অনেকেই বলল জুবেদাকে পাগলাগারদে ভর্তি করতে। কিন্তু পাগলাগারদের কথা ভাবলেই ইলমুদ্দীনের শরীর কেঁপে উঠত। সে কিছুতেই জুবেদাকে সেখানে নিয়ে যেতে রাজি হল না।

সে দোকানে যাওয়া বন্ধ করে দিল। সারাদিন সে বাড়িতে থাকত। জুবেদার দেখাশোনা করত। তার ভয় ছিল, জুবেদা কোনো সাংঘাতিক কাণ্ড না করে বসে!

হzলমুদ্দীন বাড়িতে থাকায় জুবেদার বিষণ্ণভাব একটু কমল। কিন্তু তার চিন্তা শুরু হল যে স্বামী দোকানে যায় না কেন? দোকান তাহলে কী করে চলে? যে দোকানের দেখভাল করছে সে টাকা চুরি করে পালালে কী হবে!…

সে একদিন জিগ্যেস করল, ‘তুমি দোকানে যাচ্ছ না কেন?’

ইলমুদ্দীন নরম গলায় বলল, ‘জুবেদা, আমি কাজ করে করে ক্লান্ত!… ক’টাদিন বিশ্রাম নিতে চাই।’

‘দোকান তাহলে কে দেখছে?!’

‘লোক আছে। সব কাজ সেই দেখে।’

‘সৎ?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। ভীষণ সৎ। বহু বছর ধরে আছে আমার সঙ্গে। প্রত্যেকটা পাইপয়সার হিসেব দেয়।…তুমি চিন্তা কেন করছ?’

জুবেদা চিন্তিত মুখে উত্তর দিল, ‘চিন্তা করব না!…বাচ্চাকাচ্চা আছে!… আমার যাই হোক, ওদের কথা তো ভাবতে হবে নাকি!…চাকর সব টাকা মেরে দিলে বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কী হবে!’

‘জুবেদা! আল্লাহ সবার মালিক। কর্মচারি খুবই সৎ, খুবই বিশ্বাসী। তুমি অকারণ চিন্তা কোরো না।’, ইলমুদ্দীনের চোখে জল এসে গেল।

‘আমার আর কীসের চিন্তা! সব মা-ই তো তার বাচ্চাদের জন্য ভাববে, বল! সেইজন্যই আর কি!’

ইলমুদ্দীনের নিজের অবশ্য জুবেদার জন্য চিন্তার অবধি ছিল না।

জুবেদা সারাদিন তার কাল্পনিক বাচ্চাদের জন্য কাপড় সেলাই করত, গরম উলের সোয়েটার বুনত, তাদের মোজা কাচত…। বেশ কয়েকবার সে ইলমুদ্দীনকে বলেকয়ে বিভিন্ন মাপের ছোট্ট ছোট্ট চটি-জুতোও আনিয়েছিল। প্রত্যেকদিন সকালে উঠে সে সেগুলোকে পালিশ করতে বসে যেত।

এই সবকিছু যেন ইলমুদ্দীনকে কুরে কুরে খেত। তার শুধু মনে হত, এ নিশ্চয়ই তারই কোনো পাপের শাস্তি! কিন্তু পাপটা যে কী, সে সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই ছিল না!

একদিন এক বন্ধুর সঙ্গে ইলমুদ্দীনের দেখা হল। বন্ধুর কপালে ভাঁজ! যেন সে কোনো গভীর চিন্তার জালে আটকা পড়েছে!

কারণ জিগ্যেস করায় ইলমুদ্দীন জানতে পারল, বন্ধু যে মেয়েটার সঙ্গে প্রেম করত, সে সন্তানসম্ভবা। গর্ভপাতের সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।

ইলমুদ্দীন বলল, ‘ভাই! গর্ভপাত কেন করাবে?…বাচ্চা হোক না!’

নিজের সন্তানের ব্যাপারে বন্ধুর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। সে বলল, ‘আমি বাচ্চা নিয়ে কী করব?’

‘আমায় দিয়ে দিও।’

বাচ্চা হতে তখনো কিছুটা দেরি ছিল। এই সময়ের মধ্যে ইলমুদ্দীন জুবেদাকে বলে বলে বিশ্বাস করিয়ে ফেলল যে সে মা হতে চলেছে। বাচ্চার জন্মের আর মাসখানেক বাকি।

জুবেদা বারবারই বলতে লাগল, ‘আর চাই না গো!…এতজন তো আছে!’

ইলমুদ্দীন একবারও এ কথার কোনো উত্তর দিল না।

বন্ধুর একটা ছেলে হল। ইলমুদ্দীন তাকে নিয়ে এসে জুবেদার কোলের পাশে শুইয়ে দিল। তারপর জুবেদাকে ঘুম থেকে তুলে বলল, ‘জুবেদা! আর কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে থাকবে!…দেখো তোমার কোলে কে!’

জুবেদা পাশ ফিরে দেখল, একটা ছোট্ট শিশু শুয়ে শুয়ে হাত-পা ছুঁড়ছে।

ইলমুদ্দীন আবার বলল, ‘ছেলে হয়েছে!…আল্লাহর দয়ায় এখন আমাদের পাঁচ সন্তান!’

জুবেদা খুশি হয়ে বলল, ‘এই ছেলেটা কখন হল গো?’

‘সকাল সাতটায়।’

‘আমার কিচ্ছু মনে নেই!…বোধহয় ব্যথার চোটে অজ্ঞান হয়ে ছিলাম!’

ইলমুদ্দীন বলল, ‘হ্যাঁ, সেরকমই কিছু একটা হয়েছিল বোধহয়। যাইহোক, আল্লাহর অসীম করুণা! এখন সব ঠিক হয়ে গেছে।’

পরেরদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই ইলমুদ্দীন চমকে উঠল।…জুবেদা রক্তে ভাসছে! তার হাতে একটা ক্ষুর! সেটা সে নিজের স্তনের উপর চালাচ্ছে!…

সে ধাক্কাটা সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি জুবেদার হাত থেকে ক্ষুরটা কেড়ে নিল, ‘এ কী করছ, জুবেদা!!!’

জুবেদা কোলের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে উচ্চারণ করল, ‘সারারাত ছেলেটা কাঁদল…একফোঁটা দুধও বেরোল না বুক থেকে…চুলোয় যাক এমন…’—সে আর কিছু বলতে পারল না। রক্তে মাখা একটা আঙুল বাচ্চার ঠোঁটের উপর রেখে জুবেদা নিথর দেহে বিছানার উপর ঢলে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *