সনাতন ধর্ম বনাম হিন্দুধর্ম
পূর্ববর্তী পাঁচটি প্রবন্ধে বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত ও গীতার একটি সাধারণ এপরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। এ পরিচিতি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে বেদের ধর্মটি ‘বহু দেবতাবাদের’ ধর্ম। বেদের শেষের দিকে অর্থাৎ উপনিষদে এসে পাওয়া যাচ্ছে ‘সর্বেশ্বরবাদী’ ধর্ম। এদিকে বৌদ্ধধর্মের সন্ন্যাসবাদের প্রেক্ষাপটে রচিত রামায়ণকে বলা যায় ‘গৃহধর্মের’ গ্রন্থ। আবার মহাভারতে এসে পাওয়া যাচ্ছে রাজ্যের জন্য জ্ঞাতিযুদ্ধের কাহিনী। বলা হয়েছে এটি ধর্মযুদ্ধ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এতে ধর্মের লক্ষণ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। সবশেষে গীতার ধর্মে একজন রক্তমাংসের মানুষকে হাজির করা হয়েছে স্রষ্টার ভূমিকায়। বলা হয়েছে তিনি বিষ্ণুর অবতার অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ স্রষ্টা হিসেবে ধর্মের কথা বলেছেন, কিন্তু কোথায়ও তিনি তাঁর ধর্মের নামোল্লেখ করেন নি। তিনি বর্ণাশ্রমভিত্তিক ধর্ম অর্থাৎ ‘জাতধর্মের’ গুণগান করেছেন এবং বিশ্ববাসীকে সকল ধর্ম পরিত্যাগ করে তাঁর বর্ণাশ্রমধর্মে শরণ নিতে বলেছেন।
বেদ থেকে গীতা এবং ধর্মগ্রন্থ হিসেবে কথিত আরও গোটা কুড়ি ধর্মশাস্ত্র, ১৮টি পুরাণ ও বেশ কিছু উপপুরাণ পাঠ করলে বোঝা যায় এগুলো একই সূত্রে গাঁথা এবং একটি মূল কাঠামোর ওপর রচিত। এসব গ্রন্থে যে ধর্মটি প্রচার করা হয়েছে তা হচ্ছে চারবর্ণ ও চার-আশ্রম ভিত্তিক একটি ধর্ম। একে সাধারণভাবে ‘বর্ণাশ্রম’ ধর্ম বলা হয়। এ ধর্মে ব্রাহ্মণ সর্বশ্রেষ্ঠ। তাকে ঘিরেই ধর্ম এবং ব্রাহ্মণের সকল অধিকার এখানে সুরক্ষিত। বাকিরা বলা যায় ধর্মের নামে ব্রাহ্মণের সেবক, দাস বা ভৃত্য। এই ধর্মকে তাই পণ্ডিতগণ যথার্থভাবেই ব্রাহ্মণ্যধর্ম, বৈদিকধর্ম বা আর্যধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেন। উল্লেখ্য প্রাচীনপন্থীরা এই ব্রাহ্মণ্যধর্মকেই ‘সনাতন ধর্ম’ হিসেবে বর্ণনা করেন। কিন্তু মুষ্কিল হচ্ছে অ-হিন্দুরা হিন্দুদেরকে সনাতনধর্মাবলম্বী বলে জানে না। তারা হিন্দুদেরকে জানে ‘হিন্দু’ হিসেবেই। এখানেই যত গণ্ডগোল!
দৈনন্দিন জীবনে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা হিন্দুদেরকে ‘হিন্দু’ হিসেবে চিহ্নিত বা এক কাতারভুক্ত করলেও তথাকথিত বর্ণ হিন্দুরা ধর্ম পরিচয়ের পরিবর্তে যার যার ‘জাতি’ পরিচয়েই বেশি গর্ববোধ করে। বোঝা যায় তারা হিন্দু পরিচয়ে যতটা না আগ্রহী তার চেয়ে বেশি আগ্রহী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ বা বদ্যি হিসেবে পরিচয় দিতে। যারা তা করে না তারা আবার তাদের ধর্মের পরিচয় দেয় ভিন্ন ভিন্নভাবে। কেউ বলে তার ধর্ম ‘হিন্দুধর্ম’, কেউ বলে ‘সনাতন ধর্ম’। আবার কেউ বলে তার ধর্ম হিন্দু (সনাতন)’ ধর্ম। এটি কি বিভ্রান্তি, না হিন্দুধর্ম সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণার ফল? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া খুবই কঠিন। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় অনেক হিন্দু “হিন্দুধর্ম’ ও ‘সনাতন ধর্ম’কে সমার্থক বলে মনে করে। উপরন্তু পাঠ্য পুস্তকের প্রভাবে সনাতন ধর্ম পরিচয়ের দিকেই শিক্ষিত হিন্দুর ঝোঁক বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। এমতাবস্থায় প্রশ্ন: সত্যি সত্যি কি সনাতন ধর্ম ও হিন্দুধর্ম সমার্থক? এর উত্তর পেতে হলে সনাতন ধর্ম ও হিন্দুধর্ম এই উভয় ধর্ম সম্পর্কেই অস্পষ্ট ধারণা কাটিয়ে ওঠা দরকার। এ উদ্দেশ্যে প্রথমেই আসা যাক ‘সনাতন’ ধর্মের কথায়।
যারা নিজেদেরকে ‘সনাতন’ ধর্মাবলম্বী বলে পরিচয় দেয় তারা এর জন্য একটি যুক্তি দাঁড় করায়। যুক্তিটি বেদভিত্তিক প্রাচীনতার। তাদের মতে বেদ বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থ। যেহেতু বেদ তাদের ধর্মগ্রন্থ তাই হিন্দুর ধর্মও প্রাচীনতম। এই যুক্তিটিকেই আরও একটু সম্প্রসারিত করে বলা হয় হিন্দুধর্মটি সনাতন ধর্ম কারণ এটি আগেও ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এ ধরনের যুক্তির দুটো ভিত্তি : ১. প্রথমটি ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বেদ এবং ২. দ্বিতীয়টি চিরকালীন স্থায়িত্ব। বলা বাহুল্য যুক্তির দুটো ভিত্তিই অত্যন্ত দুর্বল। কেন দুর্বল তার অনেক কারণের মধ্যে দুটো কারণ নিচে দেওয়া হল:
১. ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বেদ : প্রথম কারণ হচ্ছে বেদ প্রাচীনতম গ্রন্থ হতে পারে, হতে পারে প্রাচীনতম ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্য, কিন্তু তা সর্বজনীন ধর্মগ্রন্থ নয়। কারণ বেদের মূল কাঠামো বৈষম্যপন্থী। এর পাতায় পাতায় এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ অর্থাৎ ভূমিপুত্রদের বিনাশ কামনা করা হয়েছে। এতে ভালো কথা যে নেই তা নয়, কিন্তু এসব কথা বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে ভূতের মুখে রাম নাম বলে মনে হয়। শুধু বৈষম্যপন্থী নয় ধর্মীয় বিধান অনুসারে ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য সকলের জন্য বেদ নিষিদ্ধ। এমনকি ব্রাহ্মণ মেয়েদের জন্যও। ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য কোনো হিন্দু বেদ স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারে না। এমতাবস্থায় যে গ্রন্থে সকলের অধিকার নেই সেই গ্রন্থকে সর্বজনীন ধর্মের গ্রন্থ বলা কোনোভাবেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। উপরন্তু কেবল বেদের ধর্মই হিন্দুধর্ম নয়। বেদের ধর্মকে বড়জোর ‘আর্যধর্ম’ বা ‘বৈদিক ধর্ম’ বলা যেতে পারে। এ ধর্ম পূজার কথা বলে না, বলে শুধু যজ্ঞের কথা। আর যজ্ঞের মাধ্যমে আর্য দেবতাদের তুষ্ট করে প্রার্থনা করা হয় ভূমিপুত্রদের (অন-আর্য) বিনাশ ও অমঙ্গল। অপরদিকে হিন্দুধর্মে বেদের জ্ঞানভাগ একটি উপাদান মাত্র, বাকি সব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অন্যান্য প্রাচীন ধর্মমত থেকে নেওয়া। এই বিষয়টির প্রতি লক্ষ রেখেই বোধ হয় স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন : বেদ ভিন্ন আর কোথাও যে সত্য নেই, এ কথা বলবার তোর কি অধিকার? বেদে ঋক শব্দের অর্থ মন্ত্রার্থদ্রষ্টা – পৈতা গলায় ব্রাহ্মণ নয়। যে ধর্ম প্রাণে শক্তি সঞ্চার করে না, তা আমার কাছে ধর্মই নয় তা উপনিষদের, গীতার বা ভাগবতের যারই হোক (ড. হরপদ চট্টোপাধ্যায় : বিবেকানন্দ কথামৃত: বুলবুল প্রকাশন কলকাতা, ১৯৯৪)।
দ্বিতীয়ত বেদ থেকেই হিন্দুধর্মের শুরু নয়। হিন্দুর শুরু সিন্ধু অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতা থেকে। আমরা জানি সিন্ধু সভ্যতা বেদের অনেক পূর্ববর্তী সভ্যতা। এই সভ্যতার নিদর্শন হচ্ছে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা। সিন্ধু সভ্যতা বৈদিক আর্যদের সভ্যতা থেকে অনেক সমৃদ্ধ, প্রাচীনতর ও উন্নত ছিল। বর্তমান হিন্দুধর্মে সিন্ধু ও দ্রাবিড় সভ্যতার উপাদান আর্যদের উপাদানের চেয়ে অনেক বেশি। বস্তুত হিন্দুর বিশ্বাসে সিন্ধু সভ্যতা অনেক বেশি ক্রিয়াশীল। বিপরীতে বলা যায় হিন্দুর বিশ্বাসে আর্যদের বিশ্বাস একটা আবরণ মাত্র। তাই প্রাচীনতম ধর্ম হিসেবে সনাতনত্ব দাবি করতে হলে হিন্দুকে শুরু করতে হয় সিন্ধু সভ্যতা দিয়ে। কিন্তু স্পষ্টতই এটি করা হয় না।
২. চিরকালীন স্থায়িত্বঃ বেদের উপরোক্ত যুক্তি এবং তদভিত্তিক প্রাচীনতার যুক্তি যেহেতু অচল, তাই আলোচনার বাকি থাকে চিরকালীন স্থায়িত্ব বা সনাতনত্বের যুক্তি। অর্থাৎ ধর্মটি আগেও ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে এই যুক্তি। এই যুক্তির বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। ‘সনাতন’ শব্দের অর্থ কি? আভিধানিক (সাহিত্য সংসদ) অর্থে ‘সনাতন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে অনাদি, অনন্ত, চিরস্থায়ী ও শাশ্বত ইত্যাদি। কোনো ধর্মকে অনাদি, অনন্ত, চিরস্থায়ী অথবা শাশ্বত আখ্যা দিতে হলে ধর্মটিকে হতে হয় এমন একটি ধর্ম যা আদি ও অকৃত্রিম অর্থাৎ সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত। বস্তুত হিন্দুদের একাংশ তাদের ধর্মকে এমন একটি অপরিবর্তিত ধর্ম বলেই মনে করে। তাদের ধারণা হিন্দুধর্ম অনাদি ও অনন্তকাল থেকে বিদ্যমান। এই ধর্মের কোনো পরিবর্তন হয় নি। কিন্তু ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এই ধরনের অবস্থান মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য হয় না। বরং উল্টোটিই সত্য।
হিন্দু ক্রম বিকাশমান একটি ধর্ম। সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু হিন্দু দেব-দেবীর বিবর্তন বা ক্রম বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই এ সত্যটি ধরা পড়ে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় বর্তমানের রাম ও কৃষ্ণ বেদের কালের দেবতা নয়। রাম ও কৃষ্ণ বেদের অনেক পরবর্তীকালের অর্থাৎ পৌরাণিক আমলের দেবতা। দুর্গা-কালী দেবীও বেদের কালের দেবী নয় যদিও দেবীপূজার প্রথা প্রচলিত বহু প্রাচীনকাল থেকে। কালের বিবর্তনে আমরা এই দেব-দেবীদের পেয়েছি। বর্তমানে পূজ্য দেব-দেবীর মধ্যে অনেকেই সম্পূর্ণ নতুন। কোনো কোনো দেব-দেবীর বর্তমান রূপ প্রকৃতপক্ষে বিবর্তিত রূপ। এই প্রক্রিয়ায় আবার পুরোনো অনেক দেব-দেবী বিলুপ্ত হয়েছে। অপরদিকে তীর্থ ব্যবস্থাটিও বেদের কালের নয়। এটি এসেছে যজ্ঞের পরিবর্তে। এ রকম অনেক উদাহরণের পরেও হিন্দুদের একাংশ কেন নিজেদেরকে সনাতন ধর্মাবলম্বী বলে পরিচয় দেয়?
শিক্ষিত হিন্দুদের একাংশ কেন নিজেদেরকে সনাতন ধর্মাবলম্বী বলে পরিচয় দেয় এর যথাযথ উত্তর পাওয়া দুঃসাধ্য। তবে কারণ হিসেবে একটি মতের উল্লেখ করা যেতে পারে। রজত রায়ের মতে (‘হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধ : দেশ: সহস্রায়ন সংখ্যা: ১১.১২.৯৯) চতুর্দশ শতাব্দীর পূর্বে হিন্দুদের ধর্মের কোনো নাম ছিল না। তখন ‘হিন্দু’ শব্দটি ছিল জাতিবাচক, ধর্মবাচক নয়। কোনো নাম না পেয়ে হিন্দুরা নিজেদেরকে ‘সনাতন’ ধর্মাবলম্বী বলে পরিচয় দিতে শুরু করে। রজত রায়ের মন্তব্যকে আরও একটু সম্প্রসারিত করা যায়। চতুর্দশ শতাব্দীতে ভারতের শাসক শ্রেণি ছিল মুসলমান। তাদের ধর্ম ইসলাম। মনে হয় প্রতিদ্বন্দ্বী ‘হিন্দুজাতি’ তখন তার ধর্মকে ইসলামের চেয়ে প্রাচীনতর করার প্রয়াসে ‘সনাতন’ শব্দের আশ্রয় নেয়। অনুমান এই সনাতন শব্দটি ‘মনুসংহিতা’ থেকে সংগৃহীত। ‘মনুসংহিতার’ কয়েক জায়গায় সনাতন ধর্মের উল্লেখ আছে। প্রাচীনতা প্রমাণের এই প্রয়াসে হিন্দুধর্মের ক্রমবিকাশের ইতিহাসটি অবশ্য চাপা পড়ে যায়।
ক্রমবিকাশ বা বিবর্তন মানেই পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন। অর্থাৎ প্রাচীনের সাথে নতুনের দ্বন্দ্ব ও মিলনের মাধ্যমে সংশেষণ। এ প্রক্রিয়ায় হিন্দুধর্ম অথবা বিশ্বাস অপরিবর্তনীয় থাকে নি। হিন্দুর এই পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেই অমলেশ ত্রিপাঠি (স্বাধীনতার মুখ : আনন্দ পাবলিশার্স: ১৯৯৮) বলেছেন : সমগ্র হিন্দুধর্মকে ‘সনাতন’ বলা হবে অনৈতিহাসিক! তাঁর মতে হিন্দুধর্ম দীর্ঘকালের, কিন্তু চিরকালের নয়। তিনি প্রফেসর দান্ডেকরের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন : হিন্দুধর্ম আংশিকভাবে সামাজিক, আংশিকভাবে ধর্মীয়, আংশিকভাবে দার্শনিক, আংশিকভাবে অনুষ্ঠানগত এবং আংশিক দৃষ্টিভঙ্গিগত। তিনি রাধাকৃষ্ণণের মত উদ্ধৃত করে আরও বলেছেন : হিন্দুত্ব ‘হেলেনিজমের’ মত সাংস্কৃতিক। বলা বাহুল্য হিন্দুর এই বৈশিষ্ট্যগুলো অনাদি ও অনন্ত কালের বৈশিষ্ট্যের পরিচয় নয়। কারণ হিন্দুর পূর্বতন অনেক আচার-অনুষ্ঠান আজ বিলুপ্ত। এর স্থলে জন্ম নিয়েছে নতুন অনেক ধারণা। যেমন হরি-হর আত্মার ধারণা ও সর্বভূতে আত্মার ধারণা ইত্যাদি।
আরও একটি কারণে সনাতন ধর্মীয় পরিচয় গ্রহণযোগ্য নয়। শাস্ত্রে দেখা যায় সনাতন ধর্মের সাথে সম্পর্ক ‘ব্রাহ্মণ্য’ বা ‘আর্যধর্মের’। ‘ব্রাহ্মণ্যধর্মের’ একটি পরিচয় পাওয়া যায় ‘মনুসংহিতায়’। শুধু ধর্ম নয় এমনও বলা হয় যে, মনু থেকেই না কি মানব! অথচ এই মনু সংহিতার বিধানকে এক কথায় বলা যায় উৎকটভাবে বর্ণবাদী ও চরমভাবে বৈষম্যপূর্ণ। পুরো মনুসংহিতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুকে দেখানো হয়েছে হেয় করে। সেখানে ব্রাহ্মণকে বসানো হয়েছে দেবতার আসনে। এই গ্রন্থেরই কয়েক জায়গায় ‘সনাতন ধর্ম’ শব্দটি পাওয়া যায়। এমতাবস্থায় মনুসংহিতাই যদি সনাতন ধর্মের রূপ হয় তাহলে সনাতনধর্মী বলে পরিচয় দেওয়া হবে হিন্দুর পক্ষে চরম মানহানিকর। কোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হিন্দু ও ভদ্রমহিলার পক্ষে মনুর বর্ণশাসনের বিধান মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। রাষ্ট্রীয় আইনে আজকাল তো এসব বিধান নিষিদ্ধ। অধিকন্তু সনাতনধর্মী বলে পরিচয় দিলে হিন্দুদেরকে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা ও ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়। অথচ এটি সম্ভব নয়। কারণ বর্তমান হিন্দুসভ্যতা, সংস্কৃতি ও হিন্দুধর্মের মূলভিত্তিই সিন্ধু ও দ্রাবিড় সভ্যতা।
ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায় হিন্দুর পরিচিতির সমস্যা দুটো সূত্র থেকে উদ্ভূত। এর একটি হচ্ছে প্রাচীনতার সমস্যা ও অন্যটি হচ্ছে সভ্যতা ও ঐতিহ্যের সমস্যা। বলা বাহুল্য এই দুটোরই নিশ্চিত সমাধান দেয় ‘হিন্দু’ পরিচিতি। প্রশ্নঃ হিন্দু কত প্রাচীন এবং এই শব্দের উৎপত্তি কোত্থেকে? ‘হিন্দু’ শব্দটি কত প্রাচীন সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। কিন্তু যে ‘সিন্ধু’ থেকে ‘হিন্দু’ নামের উৎপত্তি সেই সিন্ধু যে প্রাচীনতম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এটা ঠিক যে, হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ হিসেবে পরিচায়িত প্রাচীন বেদের কোথায়ও ‘হিন্দু’ শব্দের ব্যবহার নেই। বৈদিক দেবতাদের স্তুতি, তাদের কাছ থেকে কাম্য, যাগ-যজ্ঞের বিবরণ সিন্ধু সভ্যতার লোকদের বিনাশ কামনা ও সৃষ্টি তত্ত্ব ইত্যাদি বেদের প্রধান বিষয়বস্তু। কিন্তু এসব আলোচনার কোথায়ও ‘হিন্দু’ শব্দটির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় না।
বেদের পরবর্তীকালে রচিত রামায়ণ, মহাভারত অথবা মহাভারতস্থ গীতাতেও ‘হিন্দু’ শব্দের ব্যবহার নেই। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বার বার ‘জাতধর্মের’ কথা বলেই যুদ্ধবিমুখ অর্জুনকে যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, যুদ্ধ ক্ষত্রিয়ের ধর্ম! যুদ্ধ বিমুখ ক্ষত্রিয় হয় না। শুধু গীতা নয় উল্লেখিত এসব গ্রন্থে যে ধর্মের উল্লেখ আছে তা হচ্ছে ‘জাত’ (কাস্ট) ধর্ম। উল্লেখ আছে শূদ্র, বৈশ্য, ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ এই চারটি জাতির (কাস্ট) কথা। এসব ‘জাতির’ কার কি ধর্ম বা কাজ তার বিস্তারিত উল্লেখ আছে। মানুষের দোষ-গুণ, লোভ-লালসা, শাপ-বর ও গার্হস্থ্য জীবনের বিচিত্র সমস্যা ও করণীয় ইত্যাদির চমৎকার বর্ণনা আছে এসব গ্রন্থে। কিন্তু ‘হিন্দু’ শব্দের অনুপস্থিতি সর্বত্র লক্ষণীয়। এসব গ্রন্থ বাদে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ আছে যাকে হিন্দুর আইনগ্রন্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই আইন গ্রন্থ অর্থাৎ ‘মনুসংহিতা’তেও ‘হিন্দু’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় নি। তা হলে ‘হিন্দু’ শব্দটি কোত্থেকে এল?
দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর গ্রন্থে (বৃহৎ বঙ্গ: দে’জ পাবলিশিং: ১৯৯৩) বলেছেন: সিন্ধুনদ থেকেই ‘হিন্দ্’, ‘হিন্দু’ ও ‘হিন্দুস্থান’ প্রভৃতি শব্দ এসেছে। অন্য পণ্ডিতদের মতেও সিন্ধুনদ থেকেই ‘হিন্দু’ নামের উৎপত্তি। ফারসিতে সিন্ধুর উচ্চারণ ‘হিন্দু’। ফারসি সাহিত্য ও ইতিহাসে তাই সিন্ধুনদের অববাহিকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে ‘হিন্দু’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইংরেজিতে সিন্ধু নদের নাম ‘Indus’। এ কথা সুবিদিত যে, এই ‘Indus’ শব্দটিই পরবর্তীকালে ‘India’ শব্দে রূপান্তরিত হয়। এই সূত্রেই হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলের অধিবাসীদের ফারসি সাহিত্য ও ইতিহাসে ‘হিন্দুস্তানি’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বর্তমান ভারতের হিন্দিভাষী অঞ্চলের লোকেরা ধর্ম-বর্ণ- গোত্র নির্বিশেষে নিজেদেরকে ‘হিন্দুস্থানি’ বলে পরিচয় দেয়। বলা বাহুল্য মুসলমানরাও এর ব্যতিক্রম নয়। যদি ব্যতিক্রম হতো তাহলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা ও বিখ্যাত দার্শনিক-কবি ইকবাল “সারা জাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্ত হামারা” এই বিখ্যাত গান রচনা করতেন না। তবে এই ‘হিন্দুস্থান’ নিশ্চয়ই শুধু ‘হিন্দুধর্মের’ লোকদের স্থান নয়। এই ‘হিন্দুস্থান’ সিন্ধু সভ্যতার অংশীদার সকল মানুষের বসতিস্থান। তাই বোধ হয় ‘জয় হিন্দু’ এত জনপ্ৰিয়!
সিন্ধুনদভিত্তিক এই ‘হিন্দু’ বা ‘ইন্ডিয়া’ নামটি একটি ভৌগোলিক ধারণা। সিন্ধুনদের অববাহিকায় বসবাসকারী জনগণের জীবন-যাপন, চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও অবিশ্বাস ইত্যাদির সমন্বয়ে যে ধারণা ও ঐতিহ্য গড়ে ওঠেছে তাই সিন্ধু সভ্যতা। তাই ‘হিন্দু’ শব্দটি সিন্ধু সভ্যতার পরিচায়ক। সহজ কথায় বলা যায় ‘হিন্দু’ শব্দটি ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও সভ্যতাভিত্তিক একটি ধারণা। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে ‘হিন্দুরা’ যে প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকারী হিসেবে ‘হিন্দু’ নামে আখ্যায়িত হতে পারে এই সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। বহুকাল পরে সিন্ধু সভ্যতার এই মানবগোষ্ঠীকে বিদেশিরা ‘হিন্দু’ নামে আখ্যায়িত করে।
নীরদ সি চৌধুরী তাঁর (হিন্দুইজম : এ রিলিজিয়ন টু লিভ বাই: অক্সফোর্ড: ইন্ডিয়ান পেপার ব্যাকস: ১৯৯৬) গ্রন্থে বিভিন্ন শব্দের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন: হিন্দুরাও নিজেদের পরিচয় দিতে গিয়ে ‘হিন্দু’ শব্দটি ব্যবহার করত না। শব্দটি তাঁর মতে মুসলমান শাসকগণ কর্তৃক ব্যবহৃত হতো। এই সূত্রে হিন্দুরাও ‘হিন্দু’ শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদেরকে পরিচিত করতে থাকে (Even the word Hindu was not used by them to designate themselves except when, under Muslim Rule, they employed this Muslim term for this purpose) |
একই মত পোষণ করেন অন্নদাশঙ্কর রায়। তিনি তাঁর (সংস্কৃতির বিবর্তন: বাণী শিল্প : কলকাতা, ১৯৮৯) গ্রন্থে বলেছেন: ‘হিন্দী’ নামটি ‘হিন্দু’র মতই বাইরে থেকে আমদানি। উভয়ের মূলে আছে ‘হিন্দ’ অর্থাৎ ‘সিন্ধু’ তথা ‘সিন্ধু’। এই মূল থেকেই এসেছে ‘ইন্ড’ তথা ‘ইন্ডিয়া’। এটিও বাইরে থেকে আমদানি। অন্নদাশঙ্কর আরও বলেছেন: (পঞ্চাশ বছর পূর্তির পূর্বে নামক প্রবন্ধ: স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : প্রবন্ধ সংগ্রহ) হিন্দুধর্ম বা ‘হিন্দুইজম’ শব্দটি ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে কেউ ব্যবহার করে নি। জওহর লাল নেহরু (ভারত সন্ধানে : আনন্দ পাবলিশার্স : ১৯৯৫) হিন্দু শব্দ সম্বন্ধে একই মত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন : প্রাচীন সাহিত্যে ‘হিন্দু’ শব্দটি একেবারেই অনুপস্থিত। ভারতীয় পুস্তকের মধ্যে অষ্টম শতাব্দীর একখানি তান্ত্রিক গ্রন্থে এই শব্দের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় বলে তিনি শুনেছেন। সেখানে অবশ্য ‘হিন্দু’ একটি জাতির নাম, ধর্মবাচক নয়।
উপসংহার : ওপরের আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, ‘হিন্দু’ শব্দটি আধুনিক। কিন্তু তার সম্পর্ক প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার সাথে। শুধু নামে নয়, ধর্মবিশ্বাসেও। অবশ্য প্রাথমিক অবস্থায় ‘হিন্দু’ শব্দ দ্বারা কোনো ধর্মের লোককে বোঝাত না। পরবর্তীকালে নানা সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে ‘হিন্দু’, ‘হিন্দুধর্ম’ ও ‘হিন্দু সভ্যতা’ সমার্থক হয়ে ওঠে। এর জন্য হিন্দুকে একটি জটিল বিবর্তন প্রক্রিয়া অতিক্রম করতে হয়েছে। কী সেই বিবর্তন প্রক্রিয়া? আগেই উল্লেখ করা হয়েছে বেদ-পূর্ববর্তীকালে এই অঞ্চলের সভ্যতা ছিল সিন্ধু সভ্যতা। বেদের কালে যে ধর্ম প্রচারিত হয় তা ‘আর্যধর্ম’ বা ‘ব্রাহ্মণ্য ধর্ম’। বেদের পরবর্তীকালে আসে জৈন ও বৌদ্ধধর্ম। এই তিনটি ধারা অর্থাৎ ক. বেদ-পূর্ববর্তী ধর্মবিশ্বাস, খ. ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং গ. জৈন-বৌদ্ধধর্মের সাথে লোকায়ত ধর্ম বিশ্বাসের আপোষ রফা ও সংশ্লেষণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে হিন্দুধর্মের গোড়া পত্তন হয়েছে। তাই হিন্দুধর্ম মানে ব্রাহ্মণ্যধর্ম নয়। বস্তুত এটি বিভিন্ন ধর্মমতের একটি সমন্বিত বা সংশ্লেষিত রূপ। এই প্রেক্ষাপটে হিন্দুধর্মকে ‘সনাতন ধর্ম’ বলা হবে ইতিহাস ও যুক্তি বিরুদ্ধ!