সনাতনের সংসার-ত্যাগ – খগেন্দ্রনাথ মিত্র

সনাতনের সংসার-ত্যাগ – খগেন্দ্রনাথ মিত্র

শহরের উপকন্ঠে বিস্তৃত প্রাসাদোপম অট্টালিকা৷ বহুদূর পর্যন্ত নারিকেল সুপারির সারি চলিয়া গিয়াছে৷ নিম্নে লহরী তুলিয়া গঙ্গা নাচিয়া নাচিয়া চলিয়াছে৷ নারিকেলকুঞ্জে মর্মরধ্বনি ও গঙ্গার মৃদু কুলু কুলু ধ্বনি ব্যতীত আর কোনো শব্দ নাই৷ সনাতন এই প্রাসাদের কক্ষে ভাগবত-পাঠ শুনিতেছেন নিবিষ্ট মনে৷ সন্ধ্যার আসন্ন আঁধারের পূর্বেই কক্ষ আলোকিত হইয়াছে-কিন্তু সে আলোকও ক্ষীণ; মাত্র পাঠকের ভাগবত-পাঠ বাধা পাইতেছে না৷ এমন সময়ে সোপানে পদশব্দ হইল:

একজন ভৃত্য ছুটিয়া আসিয়া বলিল, ‘স্বয়ং বাদশা৷’

‘অ্যাঁ-বাদশা হোসেন শা আসছেন?’

সনাতন চিত্রার্পিতের ন্যায় চাহিয়া রহিলেন৷ পাঠ তখনও চলিতেছে-উদ্ধার-সংবাদ৷ ব্রজগোপীরা উদ্ধবকে দেখিয়া বলিতেছেন:

‘আমরা কাঙালিনি, তুমি রাজবেশ পরিয়া আমাদের নিকট আসিয়াছ, নিশ্চয়ই তোমার কোনো উদ্দেশ্য আছে, বলো তোমার কী উপকার আমরা করিতে পারি?’

হোসেন শা শুনিলেন এবং সনাতনের দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিলেন৷ পরে কথককে ইঙ্গিতে থামাইয়া দিয়া বলিলেন, ‘শোনো, সাকর মল্লিক, তোমার কী হয়েছে, আমায় বলো৷ অসুখের অছিলা করে রাজকার্য থেকে বিদায় নিয়েছ, অথচ আমার প্রেরিত বৈদ্য বলেছে, তুমি বেশ ভালোই আছ৷ কী ব্যাপার?’

সনাতন এবারে স্বপ্নোত্থিতের মতো গাত্রোত্থান করিয়া যথাযোগ্যভাবে নৃপতিকে অভিবাদন করিলেন৷ বলিলেন, ‘আমায় ক্ষমা করুন, রাজন৷ বিষয়কর্মে আর মন দিতে পারি না৷ আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি-নিজের সঙ্গে রীতিমতো সংগ্রাম করেছি-কিন্তু আমি সে সংগ্রামে পরাজিত, ক্ষতবিক্ষত, লাঞ্ছিত৷ আমায় আপনি বিদায় দিন এবং যোগ্য লোককে আমার কর্মে বাহাল করুন৷’

‘তা হয় না বন্ধু৷ তোমার মতো বিশ্বস্ত, পণ্ডিত, সুদক্ষ কর্মচারী মুখের কথায় মেলে না৷ আমার এই সোনার রাজ্যে তোমরাই এমন সৌষ্ঠব এনে দিয়েছ, সে কথা আমি জানি আর খোদা জানেন৷ আমার দবির খাস চলে গেল আমায় দাগা দিয়ে৷ তুমি যেয়ো না, মন্ত্রী!’

সনাতন চুপ করিয়া রহিলেন৷ কথক ও অন্য শ্রোতারা ধীরে ধীরে উঠিয়া গিয়াছিলেন৷ হোসেন শা একজনমাত্র পার্শ্ব রক্ষী লইয়া আসিয়াছেন, সেও বাহিরে অপেক্ষা করিতেছে৷ স্তিমিত আলোকে নবাব দেখিলেন সনাতনের দৃষ্টি অন্ধকারের ফ্রেমে আঁটা অস্পষ্ট আলোকের মধ্য দিয়া বহু দূর প্রসারিত হইয়াছে৷ সনাতনের মন যেন সংসার ছাড়িয়া, বহুমান্য অতিথির সম্পর্ক ছাড়িয়া অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছে৷ কোনো সুদূর হইতে যেন তাঁহার কন্ঠস্বর ভাসিয়া আসিল৷

‘ওই-ওই-ওই শুনুন, আমায় ডাকে৷ ওই গৌরবর্ণ বালক তাহার ব্যাকুল দৃষ্টি আমার এই কুৎসিত মুখের উপর স্থাপন করে আমায় ডাকে৷’

বাদশা দেখিলেন, তাঁহার মন্ত্রী বাতিকগ্রস্ত৷ তিনি খুশি করিবার অভিপ্রায়ে সনাতনের হাত দু-টি ধরিয়া বলিলেন, ‘আমিও যাব৷ আমায় নেবে না, বন্ধু?’

সনাতন আবার বাস্তবে ফিরিয়া আসিলেন, বলিলেন, ‘তুমি যাবে রাজাধিরাজ? পারবে না৷ সে সর্বস্বত্যাগী সন্ন্যাসীর কাছে তুমি যেতে পারবে? কাঁচা কাঞ্চন জিনিয়া বর্ণ, ভুবনভুলানো রূপ, তরুণ বয়স-কিন্তু সন্ন্যাসী৷ সর্বস্বত্যাগ না করলে তার কাছে যে যাওয়া যায় না, রাজন৷’

‘আমি যাব৷ দক্ষিণ দেশে যাবার জন্যে যে সমর-সজ্জার আয়োজন করা হয়েছে, তা তো বাতিল করা যাবে না৷ আমি ফিরে আসি; এসেই তোমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়া যাবে; কেমন?’

প্রতিশ্রুতিরূপ বন্ধনের মধ্যে ধরা দিবার মতো মনের অবস্থা সনাতনের নয়৷ তিনি অন্যমনস্কভাবে চিন্তা করিতে লাগিলেন৷ বাদশাহ বিদায় লইয়া রাজভবনে প্রত্যাগমন করিলেন৷ সনাতন দেখিলেন, তিনি তাঁহার নিজের বাসভবনে বন্দি৷ অসংখ্য অস্ত্রধারী সৈনিক বাড়িটি ঘিরিয়া ফেলিয়াছে৷

কিন্তু মন যাহার বাহিরে ছুটিয়াছে, তাহাকে কি নিগড়ে বাঁধিয়া রাখা যায়? সৈন্যদলের মধ্যে প্রধান রক্ষককে তিনি চিনিতেন; একসময়ে তাহাকে তিনিই বাহাল করিয়াছিলেন৷ আজ তাহার নিকটে মুক্তির জন্য সনাতন কাতরভাবে প্রার্থনা করিলেন৷ কিন্তু তাহার মন ওই পাষাণকারারই মতো পাষাণ দিয়া গড়া৷

সনাতন জানিতেন, যখন করুণায় মন গলে না, তখন টাকায় মন টলে৷ তখন তাঁহার যথাসর্বস্ব সেই রক্ষীকে সমর্পণ করিয়া সনাতন তাঁহার মুক্তি প্রার্থনা করিলেন৷ রক্ষী সেই হইতে কিছু শিথিলভাবে তাহার কর্তব্য সম্পাদন করিতে লাগিল৷

এই অবসরে কারাকক্ষের উচ্চ প্রাচীর লঙ্ঘন করিয়া সনাতন গঙ্গাবক্ষে ঝাঁপ দিলেন৷ সঙ্গে চলিল তাঁহার পুরাতন বিশ্বাসী অনুচর ঈশান৷ রক্ষীর দল নিশীথে আমোদ-আহ্লাদে রত, এমন সময়ে দুইজন বন্দি গঙ্গায় স্রোতের টানে বহুদূর ভাসিয়া গেলেন৷ সংসারের বিষম কারাগার হইতে মুক্ত জীবন স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করিল৷

সনাতন শুনিয়াছিলেন, চৈতন্যচন্দ্র বনপথে শ্রীবৃন্দাবন গিয়াছেন৷ সুতরাং সেই পথ অনুসরণ করিয়া ছুটিতে হইবে৷ দীনহীন কাঙালের বেশে সনাতন বনজঙ্গলের মধ্য দিয়া পশ্চিম দেশাভিমুখে চলিলেন৷ শ্রীরূপের পত্রী পাইয়া তাঁহার একমাত্র চিন্তা হইল কীরূপে প্রভুর দর্শন পাইব৷ কোনো দিন নির্ঝরের নির্মল জলে তৃষ্ণা দূর করেন, কোনো দিন তাহাও জোটে না৷ স্বাধীন বঙ্গের প্রখ্যাত ভূপতি হোসেন শাহের মন্ত্রী আজ পথের ভিখারি-ভিখারিরও অধম৷ গাছতলায় সনাতন যখন চক্ষু নিমীলিত করেন, তখন প্রভূভক্ত ঈশান বিনিদ্রভাবে কাছে বসিয়া থাকে৷ কিছুক্ষণ বাদে সনাতন উঠিয়া বসেন, বলেন, ‘ঈশান, ঘুমোও নাই? একটু ঘুমোও, আমি জেগে আছি৷’ ঈশানের চক্ষে জল আসে৷ হায় অদৃষ্ট৷ দুগ্ধফেননিভ শয্যায় যাঁহার নিদ্রা হইত না, আজ তিনি কঠোর কর্কশ বৃক্ষতলেও একটু বিশ্রাম লাভ করিতে পারেন না৷ ঈশান শুধু অনুগত ভৃত্য নয়, শিক্ষিত দরদি সঙ্গী৷

পথ চলিতে চলিতে উভয়ে এক পর্বতমালার সন্নিকটে আসিয়া পড়িলেন৷ সন্ধ্যা সমাগত৷ পর্বত পার হইবার উপায় নাই৷ জঙ্গলে ঢাকা পর্বতের মধ্য দিয়া একটি মাত্র সরু পথ, তাহা এক ঘাটোয়াল রক্ষা করিতেছে৷ সে পার করিয়া না দিলে উপায় নাই৷

অনন্যোপায় হইয়া তাঁহারা ঘাটোয়ালের শরণাপন্ন হইলেন৷ ঘাটোয়াল বলিল ‘রাত্রি-প্রভাতে এ পাহাড় পার করিয়া দেওয়া হইবে, আপাতত এ রাত্রিটা আমার বাড়িতেই থাকিতে হইবে৷’

সনাতনের জীর্ণ বেশ, শীর্ণ দেহ, মলিন বদন, ঈশানেরও ততোধিক৷ চিরদিন সুখবিলাসে অতিবাহিত করিয়া এ দারুণ ক্লেশ সহিবে কেন?

কিন্তু ঘাটোয়াল বড়োই যত্ন করিতে লাগিল৷ সে তো জানে না তাঁহারা কে? তথাপি এত যত্ন কেন? তাঁহাদিগকে ভালো একটি ঘরে শয্যা-আদি দিয়া রাখিবার এত আয়োজন কীসের জন্য? সনাতন চিন্তা করিতে লাগিলেন৷ ইষ্টনাম জপ করেন, আর মাঝে মাঝে সংশয়ের কণ্টক মনে বিদ্ধ হইতে থাকে৷ ঈশান তখন নিদ্রাগত৷ হঠাৎ তাহাকে ঈষৎ ধাক্কা দিয়া জাগাইলেন৷

‘ঈশান, এই ঘাটোয়াল এমনভাবে আমাদের এত খাতির-যত্ন করছে কেন, বলতে পারো?’

‘লোকটি বোধ হয় ভালো৷’ ঈশান উত্তর করিল৷

সনাতন ভাবিতে লাগিলেন৷ শেষে বলিলেন, ‘দেখো, এরা অতিরিক্ত খাতির-যত্ন করে অর্থ বিত্ত যাদের আছে, শুধু তাদের৷ আমাদের তো কিছুই নেই৷’

ঈশানের চক্ষু বিস্ফারিত হইল; চুপিচুপি বলিল, ‘প্রভু, আমার কাছে কিছু আছে৷’

সনাতন বিস্মিত হইলেন৷ তখন ঈশানের নিকট হইতে সাতটি স্বর্ণমুদ্রা লইয়া তিনি ঘাটোয়ালের সন্ধানে চলিলেন৷ ঘাটোয়াল কপট নিদ্রায় ছিল৷

‘কী মনে করে, ঠাকুর? এত রাত্রে?’

‘বাবা, আমরা ফকির মানুষ, তীর্থযাত্রায় চলেছি৷ সঙ্গে কিছু অর্থও এনেছি সেইজন্যে৷ কিন্তু টাকা সঙ্গে থাকলেই বিপদ৷ তুমি যদি দয়া করে এই বিপদ থেকে আমাদের বাঁচাও৷’

‘কীরকম?’ ঘাটোয়াল আগ্রহান্বিত হইয়া উঠিল৷

সনাতন বলিলেন, ‘আমি তোমার অতিথি৷ তুমি আমাদের যথেষ্ট সেবা করেছ৷ তার বিনিময়ে আমাদের এই অর্থ তুমি গ্রহণ করো৷’ এই বলিয়া সনাতন তাহার সম্মুখে সাতটি মোহর রক্ষা করিলেন৷

ঘাটোয়াল উচ্চ হাস্য করিয়া উঠিল, বলিল, ‘ফকির সাহের, তোমাদের কাছে যে টাকাকড়ি আছে, তা আমার জানতে বাকি নেই৷ আমি এই কাজ করতে করতে পেকে গেলাম, আমি আর বুঝিনে? যাক, বড়ো বিপদ এড়ালে ঠাকুর! আজ এই কয়টি মোহরের জন্যে তোমাদের প্রাণ যেত৷ কাল প্রভাত আর তোমাদের দেখতে হত না৷’

সনাতন শিহরিয়া উঠিলেন৷

রাত্রি প্রভাত হইতে না হইতে সনাতন পাতড়া পাহাড় পার হইবার জন্য প্রস্তুত হইলেন৷ ঈশানকে বলিলেন, ‘ঈশান, বন্ধু, আর নয়৷ একাই ভালো, তুমি ফিরে যাও৷ ওই যে একটি মোহর রইল, তোমার যাবার খরচ ওতেই চলে যাবে; তুমি বনপথে যেয়ো না, সোজা পথে যাত্রীদের সঙ্গে মিশে চলে যাও, ভাই৷ আমার ভাগ্য নিয়ে আমি প্রাণের ঠাকুরের সন্ধানে চলি৷’

ঈশান অনেক কাকুতিমিনতি করিল৷ কিন্তু সনাতন অটল৷ ঈশান বুঝিল যে, ধর্মের পথ আর সঞ্চয়ের পথ এক নয়৷

জীর্ণ চীরধারী নিশব্দে পথচারী সনাতন বৃন্দাবনের পথ ধরিয়াছেন৷ মাঝে মাঝে যাত্রীর সঙ্গে দেখা হয়; জিজ্ঞাসা করেন, ‘হ্যাঁগো, তোমরা কি দেখেছ? গৌরবর্ণ এক সন্ন্যাসী? সে মুখে হরি বলে আর ঢলে ঢলে পড়ে৷ দেখনি, না? দেখলে ভুলতে পারে এমন মানুষ নেই৷’

সনাতনের বিশ্বাস সেই গৌরবর্ণ নবীন সন্ন্যাসী যেখানে যাইবেন সেখানে স্থাবর-জঙ্গম সবার মধ্যে সাড়া পড়িয়া যাইবে৷ নরনারী সব মাতিয়া উঠিবে, তুমুল কোলাহল না হইয়া যায় না৷ কিন্তু কই, কিছু তো শোনা যায় না৷ জয়ধ্বনি ওই শোনা যায়-ওই ওই! কান পাতিয়া শোনেন, কিন্তু এ তো জয়ধ্বনি নয়, হাটের কোলাহল৷

শ্রান্তক্লান্ত কলেবর; অনভ্যস্ত পদচারণায় ধুলায় রক্তের চিহ্ন মুদ্রিত হইতেছে৷ ক্ষুধাতৃষ্ণায় উদাসীন সনাতন চলিতেছেন৷ কখনো মনে মনে, কখনো বা উচ্চৈঃস্বরে ভগবানের নাম করিতেছেন৷ আনন্দে হৃদয় ভরিয়া যাইতেছে৷ আবার পরক্ষণেই সন্দেহে আকুল হইতেছেন, প্রভু কি কৃপা করিবেন? দর্শনের মুহূর্ত পর্যন্ত শরীর থাকিবে তো?

দীর্ঘদিনের পথক্লেশে রৌদ্রবৃষ্টি-ঝঞ্ঝার দুঃসহ প্রকোপে সনাতনের উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ কালি-ঢালা হইয়া গিয়াছে৷ দীর্ঘ শ্মশ্রু সমস্ত মুখখানি ব্যাপিয়াছে৷ একখানি কম্বল কাঁধের উপর ফেলিয়া জীর্ণ বসনে নগ্নপদে তিনি একাকী তৃণগুল্ম-কঙ্করময় পথে অনির্দিষ্ট যাত্রায় চলিয়াছেন৷ তাঁহার বয়স বেশি হয় নাই, কিন্তু উপবাসে, চিন্তায়, পরিশ্রমে তাঁহাকে বৃদ্ধ করিয়া ফেলিয়াছে৷ শ্রান্ত পদযুগলকে অসম্ভব ক্ষিপ্রগতিতে চালনা করিয়া যষ্টির সাহায্যে তিনি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করিতেছেন আর ভাবিতেছেন, প্রভু আমাকে পাগল করেছেন৷ তাঁর সেই আয়ত চক্ষু দু-টি কেবলই আমাকে ডাকছে; বলছে যেন, ‘আর কতদিন আমায় ভুলে থাকবে? আমি যে তোমারই পথ চেয়ে রয়েছি৷’

প্রভু আমার পথ চেয়ে রয়েছেন? আমায় চিনতে পারবেন তো? আমার মতো তাঁর কত আছে৷ কিন্তু আমার কেবলই তিনি-আমার কেবলই তিনি৷

বারাণসীর পথে সনাতন শুনিলেন, প্রভু এই পথে গিয়াছেন৷ দেখিলেন, সমস্ত চিহ্নই বর্তমান৷ পথের দু-ধারে কুসুমগুচ্ছ ম্লান হইয়া পড়িয়া আছে৷ বৃক্ষশাখার শুষ্ক ফুলের মালা দুলিতেছে৷ গৃহে গৃহে পল্লবসারি, মঙ্গলঘটে মঞ্জুরি৷ এই তো, এই তো, সেই প্রাণারাম, নয়নাভিরামের আগমনী৷ আর কী? আর কী? আমার জন্মজন্মান্তরের সুকৃতি সার্থক করিয়া, প্রভু, এইবার দর্শন দাও৷

প্রকাণ্ড শহর বারাণসী৷ কালভৈরবের গঞ্জ হইয়া শহরে ঢুকিতে হয়৷ সনাতন শুনিলেন, প্রভু তপনমিশ্রের বাড়িতে অবস্থান করিতেছেন-নিকটেই৷ কিন্তু পদ আর উঠে না৷ সনাতন সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত, সংসারাভিজ্ঞ, অভিজাতকুলপ্রদীপ৷ কিন্তু তাঁহার মনে হইল, ‘আমি নীচ, অসৎসংসর্গ দুষ্ট, বিষয়বিষে জর্জর৷ আমার কর্তব্য নয়, সেই সুকুমার সর্বত্যাগী, শুচি, উচ্চ ব্রাহ্মণকুলপাবন সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করি৷ না, আমার অঙ্গের দূষিত বায়ু তাঁহার গায়ে লাগিতে দিব না৷ তার চেয়ে আমার প্রাণত্যাগ করা ভালো৷ যদি পরজন্ম থাকে প্রভুর পাদপদ্ম লাভ করিব৷’

‘ফকির’-

সনাতন চমকিয়া উঠিলেন৷ তাঁহার স্বপ্ন যেন হঠাৎ ভাঙিয়া গেল৷ ‘আমায় বলছেন!’

‘হ্যাঁ, বাবা ফকির, তোমাকে প্রভু ডাকছেন৷ ভিতরে এসো৷’

সনাতন কাঁদিয়া উঠিলেন৷

‘বাবা, তুমি ভুল করনি তো? আমায় প্রভু ডাকবেন কেন? আমি যে বড়ো পাপী, অপবিত্র, পতিত৷ প্রভুর নিকট যাবার যোগ্যতা নেই তো আমার! ঠিক বলছ, আমায় ডাকছেন? আর কাউকে নয়?’

‘না, ফকির, তোমাকেই ডাকছেন, এসো বন্ধু৷’

সনাতন চোখের জলে ভাসিতে ভাসিতে উঠিয়া গেলেন৷

‘কই, কই আমার প্রভু? আমি তো চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিনে৷’

‘এই যে আমি! সনাতন, তুমি আমারই বক্ষে আছ৷ নয়ন মেলে দেখো বন্ধু৷ তোমারই জন্যে আমি এখানে আজ কতদিন অপেক্ষা করে বসে আছি৷ তুমি এসেছ? তুমি এসেছ, সনাতন?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *