সদ্‌গতি

সদগতি

পরপর দুইরাত ঘুমের মধ্যে আব্বাকে দেখে কেঁদে উঠলাম।

প্রথম স্বপ্নটা ছিল আমার খুব পরিচিত—এই স্বপ্নটা কিশোরবয়সে বা এমনকি বিশ পেরোনো সময়টাতেও অনেকবার দেখেছি। প্রতিবারই দেখতে গিয়ে নতুন করে বুকে ব্যথা লাগে; সেই কষ্টটাও বুঝি পরিচিত। দেখলাম, আব্বা আমাকে না নিয়ে বাজারে চলে গেছে। একটু আগেই বুয়া থলি বের করছিল, আম্মা বাজারের ফর্দ লিখছিল, আমি তাড়াতাড়ি করে হাফহাতা শার্টের বোতাম লাগাচ্ছিলাম। বাইরে রোদ চড়ছিল। আর দেরি হলে মাছ পাওয়া যাবে না, কেউ বলছিল। দেরি করা যাবে না। দেরি করলে যদি আব্বা আমার কথা ভুলে যায়! বুক ধুকপুক। ডানপায়ের চপ্পল বামপায়ে আর বামপায়েরটা ডানপায়ে। আমার ভ্রুক্ষেপ নাই। ভোঁ-দৌড়। যদি আব্বা আমাকে না নিয়েই চলে যায়! দৌড়ে দরজার কাছ পর্যন্ত গেলাম। তারপর কেউ নাই, কিচ্ছু নাই। এমনকি কেউ বলল না পর্যন্ত যে, আব্বা আমাকে রেখেই চলে গেছে। বাসার বন্ধ সদর দরজার সামনে একটা ছোটো মানুষ হয়ে নিজেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, স্বপ্নের মধ্যেই আমার বুকের ভিতর থেকে কান্না উথলে উঠল।

তারপর দ্বিতীয় রাত। দ্বিতীয় রাতের আমি স্বপ্নের মধ্যে অনেক বড়ো হয়ে গেছি; আব্বা বুড়া হয়ে গেছে। আব্বার মনে বুঝি মৃত্যুভয় ঢুকেছে। হুজুর দিয়ে কোরআন খতম দেওয়ানোর প্ল্যান করেছে আব্বা। আমাদের কলোনি বাসার ড্রয়িংরুমে ময়লাটে শাদা পাজামা আর তার চেয়ে খানিকটা ফরসা পাঞ্জাবি-পরা শীর্ণকায় এক হুজুরকে দেখলাম সোফায় বসে সেন্টার টেবিলের উপর ধীরে-সুস্থে গেলাফ খুলতে। হুজুরের সামনে চা, মিষ্টি আর পিরিচ দিয়ে ঢেকে রাখা পানির গেলাস। মুন্নিকে দেখলাম কৌতূহলী চোখ করে ড্রয়িংরুমের আশপাশে ঘুরঘুর করতে। আশ্চর্য! আমি বড়ো আর আব্বা বুড়া হয়ে গেছে, কিন্তু মুন্নি বড়ো হয় নাই। সাইজে বড়ো একটা ঢলঢলে সবুজ ফ্রক পরে মুন্নি দেখি ড্রয়িংরুমের পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, প্রায় ঝুলছে। আমাকে বলল, ভাইয়া, ওই হুজুরটা ক্যান আসছে? আব্বা কি মরে গেছে? মুন্নির কথা শুনে আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রুমে ঢুকলাম আর ওই নিমীলিত নয়নে কোরআন শরিফ পাঠরত হুজুর ভদ্রলোকের উপর খেঁকিয়ে উঠলাম। উনাকে বললাম, এখানে কী চাই? বললাম, আর আসতে হবে না। স্বপ্নের মধ্যে শুনলাম কোথায় যেন সন্তর্পণে টিপটিপ করে পানি পড়ছে। মনে হলো গেস্টরুমের শাদা চাদর-ঢাকা জাজিমের উপর বসে আব্বা টিভি দেখছে; টিভি দেখতে-দেখতে ঝিমাচ্ছে। আমরা হইহই করে প্যাসেজ পেরিয়ে আব্বার মৃত্যুসংবাদ নিয়ে গেস্টরুমের দরজা পর্যন্ত দৌড়ে গেলাম, তারপর আব্বাকে দেখে থেমে গেলাম। আব্বা ডান চোখ কচলে নিয়ে আমাদের একটু দেখে নিল বিরক্তি নয়, একটা হাসিই বুঝি দেখলাম আব্বার মুখে। বলল, কী রে? তোরা ঘুমাস না? তারপর আবার টিভিতে মন দিলো। ওখানে একঘেয়ে সুরে কিছু একটা বাজছিল। পুরানো ছবির গান বুঝি। মালা সিনহা? হবেও বা।

পরপর দুই রাত এরকম।

তৃতীয় দিন আব্বার মৃত্যুসংবাদ পেলাম।

তখন বেকারিতে সন্ধ্যার শিফট মাত্র শুরু হচ্ছিল। বেকিং সেকশনের পাঞ্জাবি ছেলেগুলি কাজ শেষ করে নাই তখনও। এইটা আমার সেকেন্ড জব ছিল- অফিসের কাজ শেষ করে সপ্তাহে তিনদিন এইখানে কামলা দিতাম। সেইদিন জগৎ আর আমানদীপ কাজ থুয়ে গ্যাজাচ্ছিল; দুইজনে মিলে বুঝি কেটারিং সার্ভিস খুলবে। কত প্ল্যান-প্রোগ্রাম! আমার খুব বিরক্ত লাগছিল; প্রতি শুক্রবার রাতে ওদের ঢিলামি আমাকে ভোগায়। ওদের কাজ শেষ না হলে আমার কাজ শুরু হয় না। আহারে, ভাগ্যিস তখন হাত খালি ছিল। নইলে মুন্নিটা আমাকে ফোনে পেতই না রাত এগারোটা পঞ্চান্ন অর্থাৎ মিডনাইট ব্রেকের আগে আগে। পাবে কীভাবে? ব্রেকটাইম ছাড়া ফ্লোরে ফোন ব্যবহার করা নিষেধ। ম্যানেজার সন্দীপ কুমারের কড়া বারণ।

মুন্নি নিষ্কম্প গলায় বলল, আব্বা স্কয়ার হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে। দুপুরে মুন্নিরা আব্বা-আম্মাকে নিয়ে সাইয়্যেদেনা কমিউনিটি সেন্টারে যাচ্ছিল, ওখানে মুন্নির চাচাতো ননদের এনগেজমেন্ট ছিল বুঝি। ড্রাইভ করছিল মুন্নির বর আলতাফ ভাই। গাড়িতেই আব্বার অ্যাটাকটা হয়। ফেরার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি আর মিশু যেন খারাপ খবরের জন্য রেডি থাকি। “আর ভাইয়া, দোয়া পইড়ো। হ্যাঁ?”

আমি সব শুনলাম। ফোন হাতে নিয়ে বেকারির পিছের গাড়িবারান্দার বাউন্ডারি দেয়ালটা ঘেঁষে বসে পড়লাম। দেয়ালের সীমানা উপচে একটা ফুলের গাছ প্রায় আমার ব্রহ্মতালু পর্যন্ত নেমে এলো। আমাকে বেকারিতে নামিয়ে দিতে এসে মিশু একদিন বলেছিল, এটা নাকি মাদাগাস্কার জ্যাসমিন। সেই দিনটা মনে আছে আমাদের। অফিসের কাজটা পাওয়ার আগে বেকারির কাজটা জুটেছিল আমার, সে আরও তিন বছর আগের কথা। আমি আর মিশু আমাদের জীবন-জীবিকার কাছে ততদিনে প্রায় পরাস্ত। যত যাই হোক, অড জব করব না—সেই পণ ভেঙে কল-সেন্টারের কর্মচারী, ইলেকট্রনিকস দোকানের সেলস্ম্যান, ক্যাফের ওয়েটার, এমনকি হোটেলের ক্লিনার হওয়ার জন্য পর্যন্ত সিভি দাখিল করা শুরু করেছিলাম। মিশু তখন সপ্তাহে মাত্র বিশ ঘণ্টা কাজ করতে পারতো। অ্যাকাউন্টিংয়ে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী আমার বউ, শপিং মলের হেয়ার ড্রায়ার সেকশনে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে থাকত আর সম্ভাব্য খদ্দের পাকড়াও করে হাসিমুখে বলত, “দিস মাদারস ডে, হাউ অ্যাবাউট আ সুপারসনিক ড্রায়ার ফর ইওর ওয়াইফ?”

তো তিন বছর আগে বেকারির চাকরির সেই প্রথম দিনে মিশু শখের পোষা প্রাণীদের মতন ফুর্তিতে বাগবাগ হয়ে নিজে ড্রাইভ করে আমাকে ঠিক এই জ্যাসমিন গাছটার পাশে নামিয়ে দিয়েছিল। গাছটা তখন ফুলে ভরতি। এত সুন্দর! আহা, নলের মুখে পাঁচটা পাপড়ি। শাদা ধবধবে। গন্ধে আমার মাথা ধরে যাচ্ছিল আর শ্বাসনালি প্রায় বুজে আসছিল। অ্যাজমা আমার পুরানো ব্যারাম। মিশু সেদিকে খেয়াল না করেই বকবক করে যাচ্ছিল। কোনকালে পাড়ার বানিংসে টবের গাছ পাওয়া যাচ্ছিল বুঝি দশ ডলারে তিনটা করে, সেখানে গিয়ে সে অস্ট্রেলীয় দ্বীপের আদিম গুল্মলতা থেকে শুরু করে গাছের বেয়ে ওঠার সহায়ক নকল বাঁশের ধাড়া পর্যন্ত দেখে এসেছে। আমি বলেছিলাম, “মিশু, গাড়িটা আরেকটু সামনে নিয়ে রাখলে হয় না? আমার তো অ্যাজমার টান উঠতেছে।” মিশু অপরাধী চেহারা করেছিল বটে, পরক্ষণেই ঝিলিমিলি হেসে বলেছিল, “অ্যাজমার অ্যাকটিং করতেছ না তো?” মিশুকে আগে বহুবার এই গল্প বলেছি, “একবার অ্যাজমার টান উঠেছিল, যখন আমি অনেক ছোটো। বছর পাঁচেক হবে তখন আমার বয়স। দিলীপ কাকা – আব্বার বন্ধু, পরে বিজনেস পার্টনার, উনার ফ্যামিলিসহ আমাদের বাসায় এসেছিলেন আর ততক্ষণে চলেও যাচ্ছিলেন। উনার ছেলে রঙ্কুর সাথে উঠানের শুকনা ঘাসের উপর বেশ হুটাপাটি হয়েছিল সেদিন। তখনও মুন্নির জন্ম হয় নাই। আমার প্রায় একলা জীবনে একটা বিকালের জন্য রঙ্কুর আসা যেন সারা মাসের দুরন্তপনা উশুল করার অজুহাত ছিল। মেহমান বিদায় নিচ্ছিল যখন, তখন হঠাৎ আমাকে হাঁপানিতে পেয়ে বসে। সে-ই প্রথম। আব্বা খেয়ালও করে নাই। আম্মা ভেবেছিল, আমি বুঝি মিথ্যামিথ্যি অভিনয় করছি; ভেবেছিল, মুখ হাঁ করে মাটিতে লেপটে বসে পড়ে আদতে আমি রঙ্কুর অ্যাটেনশন চাইছি। আহারে! আজকে যখন আব্বার হার্ট আজন্মের মতো অকেজো হয়ে যাওয়ার সংকেত দিলো, ধীর লয়ে ধুক ধুক করল, আব্বা কীভাবে তড়পাল? কেউ কি বুঝল আব্বার কষ্ট, নাকি ভাবল যে, আব্বা বুঝি আলতাফ ভাইয়ের আলগোছে বলা কোনো হাসির কথায় রিঅ্যাক্ট করে রুগির মতো মিথ্যামিথ্যি, অ্যাবসার্ড, হাস্যকর মুখভঙ্গি করছে? পান-চিনির দাওয়াত খেতে যাচ্ছিল আমার যে সুবেশ, সুসজ্জিত পরিবার, যে পরিবারের ছবির মতো সুন্দর একটা জুম্মাবারের শরিক—আব্বা কিম্বা আমি–আর কখনো হব না, সেই পরিবার কি আজকের দিনটার কথা কোনোদিন ভুলতে পারবে? আমি যে কখনোই আব্বার হার্টের সমস্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর রাখি নাই, এমনকি ভালো বউমার মতন মিশুও যে কখনো আব্বার ওষুধ গুনে-গেঁথে-গুছিয়ে দেওয়ার রীতিবদ্ধ নাটক করে নাই, কিম্বা অধিকার নিয়ে বলে নাই, “আব্বা, রেড মিট খাওয়া কিন্তু আপনার নিষেধ।” এইসব অপরাধ, এইসব দগদগে, অনপনেয় দাগ আমরা কি কখনো মুছতে পারব?

সন্দীপকে বলে আজ কাজের সময় ফোনটা চালু রাখলাম। ঘণ্টা-দুয়েক পর মুন্নি আবার ফোন করল। সব শেষ? আমি কাঁদতে পারলাম না। ফোন কানে লাগিয়ে আবার বেকারির গাড়িবারান্দা পর্যন্ত গেলাম। “আম্মা… আম্মারে ফোনটা দে, প্লিজ।” মাদাগাস্কার জ্যাসমিন গাছটাতে আজকে কোনো ফুল—এমনকি কুঁড়িও—নাই। এমনই নিরুপদ্রবভাবে আমার আব্বা আমাকে ছেড়ে গেলেন। “মুন্নি, তোর ভাবিকে তুইই ফোন দে। আমি এখন পারতেছি না রে।” আরও অর্ধেক শিফট বাকি।

জানি, অন্য কেউ হলে এই অবস্থায় আর কাজ করতো না। বাড়ি চলে যেত। অনির্দিষ্টকাল ছুটিতে থাকত। আমি বেকারির কাউকে কিছু তো বললামই না, এমনকি মিশুকেও কয়েকটা টেক্সট মেসেজের বেশি কিছু করতে পারলাম না। মিশু অস্থির হয়ে বারকতক ফোন করল। আমি ধরলাম না। পরের রোববার সবুজদের বাসায় যাওয়ার প্ল্যান ছিল আমার আর মিশুর। সবুজের মেয়েটার জন্মদিন। সবুজকে লিখলাম যে, আমাদের যাওয়া হবে না। আমার খুলির ভিতর মগজটা বুঝি ঠান্ডা হয়ে চুপসে গেছিল। অস্বাভাবিক শান্তভাবে আমি বেকিং ফ্লোর পরিষ্কার করলাম। ভূতগ্রস্তের মতো একা- একা চব্বিশ-পঁচিশটা ধাতব বেকিং র‍্যাক সরালাম, সবকয়টার উপর স্পিনাচ আর চিজ রোল থরে থরে ফুলে-ফেঁপে আছে- প্যাকিং ফ্লোরের ছেলেরা বাকিটা দেখবে। মেঝে ভ্যাকুয়াম করার পর ক্লিনিং লিকুইড দিয়ে ঘষে ঘষে বেঞ্চের তলা মুছলাম। কাজ করতে-করতে হাত দিয়ে নিজের গাল-কপাল ছুঁয়ে দেখলাম—দরদর করে ঘামছি; কাঁদছি না। ম্যানেজার সন্দীপ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। কাঁধে হাত রাখল আমার। “ইওর ওয়াইফ কল্ড। প্লিজ, গো হোম। সো স্যরি ফর ইওর লস।”

ভাগ্যিস আমাদের গাড়িটা আমার সাথে ছিল, নইলে মিশু হয়তো আমাকে খুঁজতে নিজেই ড্রাইভ করে চলে আসত। সেটা মোটেও ভালো হতো না। গাড়িটা বের করলাম; ড্রাইভ করে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গেলাম। মেলবোর্নে শুক্রবার রাতের রাস্তা কেন সোমবার রাতের মতো সুনসান? এমন তো দেখি নাই কখনো! টার্মিনালের কাছে গাড়ি পার্ক করে ঢুকলাম ইন্টারন্যাশনাল লাউঞ্জে। বসে থাকলাম সারি-সারি চেক-ইন কাউন্টারের সামনের বেঞ্চিগুলির একটাতে; এইখানে দিন-রাত, গ্রীষ্ম-বর্ষা সকলই সমান শীত। জ্যাকেটটা গাড়িতে রেখে এসেছি। চারিদিকে নম্বর লেখা সাইনবোর্ড আর ডিজিটাল স্ক্রিন। লম্বা করিডোরের উপর দিয়ে শত-শত চাকাওয়ালা ব্যাগ যাচ্ছে, ব্যাগসহ ট্রলি যাচ্ছে, মানুষও যেন পা নাই, আছে ঢাকা। এমিরেটসের টিপটপ এয়ারহোস্টেস মেয়েগুলিকে দেখে কেউ কেউ সসম্মানে লাইন ছেড়ে দাঁড়াল। একটা ধাতব শৈত্য অনুভব করলাম। জ্যাকেটটা মিস করছিলাম।

চাইলে ম্যাকডনাল্ডস থেকে চিপ্‌স কিনে খেতে পারতাম— খিদা না থাকলেও পেট খালি, কিম্বা পাশের আইরিশ পাব থেকে এক বোতল বিয়ার। অতটুকুই। মাটির উপরে দেগে রাখা হলুদ লাইন পার হওয়া যাবে না। আব্বাকে মাটি দেওয়ার আগে দেখা হবে না।

*

এয়ারপোর্টের বেঞ্চে বসে থাকার কথায় মনে পড়ল – আব্বা মরার সাতদিনের মাথায় অফিস-আওয়ারে আমাকে মুনি পন্ডস জংশনের লোহার বেঞ্চে বসে থাকতে দেখে মিশু। আমি দুই হাতের তিনটা-তিনটা ছয়টা আঙুল দিয়ে একমনে সিগারেট রোল করছিলাম – রেডিমেড সিগারেটের উপর ট্যাক্স বাড়ার পর থেকে ওটা বাদ দিয়েছি, খোলা তামাকপাতা আর ফিল্টার কিনে হাতে পাকিয়ে খাই, আর মিশু ফিরছিল সুপারমার্কেট থেকে মাংশ কিনে।

লোহার বেঞ্চটা বহমান ট্রামলাইনের দিকে মুখ করা। এইদিকটায় লোকে বসে না, তা না, তবে প্রতি দশ মিনিট অন্তর ট্রাম এসে যখন উপবিষ্ট জনতাকে প্রায় সেঁচে উঠিয়ে নিয়ে যায়, তখন কয়েক মিনিটের জন্য বেঞ্চগুলি নির্জন পড়ে থাকে। দিনের এই সময়টা এমনিতেও খুব ব্যস্ত নয়; বড়োজোর স্কুলগামী বাচ্চাসহ গৃহিণী কিম্বা বেকার অভিবাসী কিম্বা নির্বিষ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সময় এইটা। চাকরিটা যাওয়ায় পর এত লোকের চোখ বাঁচিয়ে চলা শিখেছি, এত ক্যাজুয়াল সতর্কতা কায়েম করেছি—নাটক-সিনেমাতেও তো কম দেখি নাই জনারণ্যে লুকিয়ে পড়া সদ্য-বেকার পুরুষলোকের ধরা খাওয়ার গল্প, কিন্তু মিশুর কাছে ধরা খেয়ে যাব, আশা করি নাই। এই পথ দিয়ে মিশু আসা-যাওয়া করতে পারে, তাও আবার বাজারের ব্যাগ নিয়ে পায়ে হেঁটে এবং পথে আমাকে দেখে ফেলতেও পারে—এই সম্ভাবনা থিওরেটিক্যালি নাকচ না করা গেলেও বাস্তবে দেখা হয়ে গেলে কী হবে, এইসবের অগ্রপশ্চাৎ আমি খুব একটা ভাবি নাই।

ভাবলে কোনো একটা নিরাপদ জায়গাতেই বসতাম। এত বড়ো শহরে এত অল্পসংখ্যক পরিচিত মানুষের চোখ এড়িয়ে দিন পার করে দেওয়া আর এমন কী কঠিন কাজ! এই রকমের কয়েক হাজার স্পট আমি চিনি তো। যে-কোনো অচেনা সাবার্বের লাইব্রেরি, ট্রেন স্টেশনের প্লাটফর্ম—শহর ছাড়িয়ে পুবদিকের লাইনে যেদিকে বাঙালি কম থাকে, এমনকি কয়েকশ শিশুবান্ধব পার্কের যে-কোনো একটা। একবার তো সেমেটারিতেও গিয়ে বসেছিলাম, অগুনতি অচেনা লোকের কবরের দিকে মুখ করে। চাইলে সিটিতে গিয়েও অনায়াসে বসে থাকা যেত, অফিসপাড়ার ভিতর বড়ো-বড়ো বিল্ডিংগুলির নিচতলায় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রিসেপশন এরিয়ার মধ্যে এন্তার জায়গা আছে; জুতমতো একটা কোনা খুঁজে নিয়ে ভুসভুসে গভীর একটা সোফার উপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে মোবাইল ফোনেই দিব্যি সময় পার করে দেওয়া যেত। আসলেই… সিটিই সবচেয়ে ভালো আর নৈর্ব্যক্তিক বিকল্প হতে পারতো। তা না করে কোন দুঃখে আমি মুনি পন্ডস জংশনে বসলাম!

মিশুর বামহাতে লম্বালম্বি ভাঁজ করে রাখা ওভারকোট। ডানহাতে সবুজ ব্যাগে বাজারসদাই, ভিতর থেকে ধনেপাতা আর পেঁয়াজকলির ডাঁটি বের হয়ে আছে। পুরানো ব্রণ, গত কয়েক রাতের কম ঘুম আর আব্বা মারা যাওয়া-পরবর্তী একটা অনির্দিষ্ট অপরাধবোধ প্রায় স্থায়ী দাগ রেখে গেছে ওর মেকআপবিহীন মুখে-গালে- চোখে। তেলা চুল তালু আর কপালের সাথে লেপটে আছে। জানি, নিজের যত্ন নেওয়ার সময়ও পায় না মিশু। গত কয়েকমাসে স্পষ্টতই ওর ওজন বেড়েছে; ও তো আগে এমন ঘাড়ে-গর্দানে ছিল না। মাথা-মুখ-গলা—শুধু এতটুকু পর্যন্ত দৃশ্যমান থাকলে ওকে যদিও তন্বী বলে ভুল হতে পারে।

একপাশে ওভারকোট আর একপাশে বাজারের ব্যাগ থুয়ে মিশু আমার পাশে বসল। আমার ঝুরা তামাকের ছোট্ট পুঁটলিটা লোহার বেঞ্চের ফাঁক গলে মাটিতে গড়াতে লাগল আর বাতাসের ধাক্কায় প্রায় উড়ে যেতে লাগল মিশু যেদিক থেকে হেঁটে এসেছিল, সেইদিক বরাবর।

“মাহফুজ, চলো বাসায় যাই।”

“বাসায় গিয়ে কী হবে?”

“তোমার ঘুমানো দরকার। সকাল থেকে কিছু খাইছো?”

“আমি কিছু বললাম না।”

“আসলেই আজকে অফিস বাদ দিছো? ছুটি নিছো?”

“না, ছুটি নেই নাই।”

“কালকে রাতে আম্মা আর মুন্নির সাথে আরেকটুক্ষণ কথা বলতা না হয়। ঢাকা যেতে যখন পারতেছি না… আচ্ছা, এখন ফোন লাগায়া দিব?”

এক সপ্তাহে চল্লিশতমবারের মতো এই কথাটা বলল মিশু, যেন আম্মার সাথে, মুন্নির সাথে কথা বললে আমি ভুলে যেতে পারব যে, মরা বাপের মুখ দেখাটাও আমার কপালে জোটে নাই। শেষ দম বের হওয়ার আগে আব্বার হাতটা একটু না ধরতে পারার, নিজের হাতে আব্বাকে মাটি না দিতে পারার অনুশোচনা যেন ঢাকায় ফোন লাগালেই হোয়াটসঅ্যাপ কলের অন্তঃস্থিত ইথারতরঙ্গময় চিকন নালায় হাপিস হয়ে যাবে। এতই সহজ সেটা, যেন আমি সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলছি আর ঘাম-ক্লেদ- জীবাণু সব জলের সাথে মিশে গিয়ে বাথরুমের পাইপ গলে নেমে যাচ্ছে। তোমার- আমার দুইজনের মাথাপিছু দুইশ-দুইশ চারশ–মাত্র দুইশ-দুইশ চারশ ডলার বাঁচানোর জন্য, মিশু, আমরা বছরখানেক আগে আমাদের ভিসাটা রিনিউ না করানোর মতো চূড়ান্ত অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম; বলো, তখনই কি আমরা স্বীকার করে নিই নাই যে, রাজার মতো আত্মার দরজা-জানালা-ফটক খুলে বাঁচার দিন আমাদের শেষ? আমার মরা বাপের আত্মার হায় তার মৃত্যুর বহু আগেই ছেলের গায়ে লাগে নাই কি? এই যে আমরা ঢাকা যেতে পারলাম না, কারণ একবার অস্ট্রেলিয়ার বর্ডার পার হয়ে গেলে আর কখনো আমরা বৈধ পথে এই সোনায় মোড়ানো শ্মশানদেশে ফেরত আসতে পারব না—এই অন্যায়ের জন্য আমার কাছে মাফ চাইবে কে? হোম অ্যাফেয়ার্স অধিদপ্তর? নাকি তুমি চাইবে? হাহ…

এইসব মিশুকে আর বললাম না, যদিও এই বক্তব্যের নানান ভার্শন নানান কায়দায় মিশুকে গত এক সপ্তাহে ঘ্যানঘ্যান করে শোনানো শেষ হয়েছে। মিশুর সহ্যেরও তো একটা সীমা আছে। আব্বার কাছে আমি নয় একটা বাচ্চা ছেলেই ছিলাম আজীবন, মিশুর কাছে তো আমি তা নই। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের আত্মবিশ্বাস নিয়ে, সাংসারিক কর্তৃপক্ষ সেজে, যে পাঁচ পয়সা বাঁচানোর সিদ্ধান্ত আমি হরদম নিয়ে থাকি, যেই কারণে স্যালভেশন আর্মির সেকেন্ডহ্যান্ড শীতবস্ত্রের দোকান থেকে বেছে বেছে কম ছেঁড়া- ফাটা, কম সুতার বুজকুড়ি ওঠা ওভারকোট কিনতে বাধ্য হয় মিশু, ত্বকে সয়ে যায় দেখে দামি ফেইসওয়াশের বদলে শস্তা ড্রাগস্টোর ব্র্যান্ডের টিউব ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়, সারা দিন বাইরে খাটুনির পরে মশলা পিষতে আর পেঁয়াজ কাটতে নামে, দোকানের বা টেক-অ্যাওয়ে খাবারের কিম্বা অবকাশযাপনের কিম্বা বিদেশভ্রমণের লোভ রেখে-ঢেকে চলে, জুলাইয়ের শূলবিঁধানো শীতেও ইলেকট্রিক বিল বাঁচাতে হিটার না ছেড়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে— সেইসবের দায়িত্ব আমার না তো কার?

যথারীতি আমার চোখ বিতৃষ্ণ। পারলে নিজের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতাম।

জোরে বাতাস দিলো। ট্রামলাইনের উপর দিয়ে শুকনা পাতা কেউ যেন তীব্র বেগে ঝাঁটা দিয়ে হেঁচড়ে নিয়ে গেল। আমি মিশুর বারণ উপেক্ষা করে লাইটার দিয়ে একটু আগেই পাকানো সিগারেটটা ধরাতে চেষ্টা করলাম। বারকয়েক চেষ্টা করতে হলো—হাতের পাতা দিয়ে আগুন ঢাকছিলাম, তবু বারবার বাতাস এসে নিভিয়ে দিচ্ছিল। আমার জুলফির পাশে বাড়তে থাকা চুল আমার ডাগ কানের কানের পিছনে গুঁজে দিলো মিশু, ও এখনো সহ্যের সীমারেখার ভিতরে বসবাস করতে চায়। আমি কখনোই আত্মহত্যার কথা চিন্তা করি নাই। মিশু করতো, যখন ওর বয়স কম ছিল। ওর বামবাহুর ট্রাইসেপ বরাবর অনেকগুলি কাটা দাগ ছিল। কিশোরীবয়সে বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করে ব্লেড দিয়ে খানবিশেক পোঁচ দিয়ে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করেছিল নাকি। এই রকম কোনো অপকর্মের রেকর্ড আমার নাই। চাচাতো বড়ো ভাইয়ের বায়োলজি প্র্যাকটিকালের ডাইসেকশন সেটের ভিতর থেকে কাটারির মতো দেখতে কী যেন একটা বের করে খেলতে গিয়ে একবার হাত কেটে ফেলেছিলাম, তারপর আব্বার এক চড় খেয়ে বাকি জীবনে আর সজ্ঞানে নিজের শরীরের উপর কোনো ক্ষতি করার চিন্তা মাথায় আনি নাই। কিন্তু ওই মুহূর্তে মিশুর চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, আমাকে বুঝি আত্মহত্যার হাত থেকে একচুলের জন্য বাঁচিয়েছে ও। ঠান্ডা হাত দিয়ে আমার হাত ধরছিল, কেমন যেন খাবলে খাবলে থাবা প্রসারিত করে, যেন নিশ্চিত মৃত্যুর নদীর ভিতর থেকে আমার দেহ টেনে-হিঁচড়ে তুলে এনেছে আর ডরাচ্ছে, পাছে আমি আবার পাড় ভেঙে পিছলে না যাই!

“শুনো, মিশু, আমি ঠিক আছি। থেরাপি সেশন মিস করি নাই। দুই সপ্তাহ আগপর্যন্ত প্রত্যেকদিন অফিসেও গেছিলাম।”

“তুমি তো বলছো, তুমি এই কয়দিন রোজই অফিসে গেছ। আজকে সকালেও বলছো, অফিস যাইতেছ।”

ঘণ্টি বাজিয়ে আমাদের প্রায় গা-ঘেঁষে ঊনষাট নম্বর ট্রাম এসে থামল। দুপুর বারোটা কি একটা মতন বাজে তখন। যথারীতি ট্রামে বেশি লোক ছিল না। চার-পাঁচজন নেমে গেল। আশি পেরোনো এক বয়স্ক স্থূলাঙ্গী মহিলা গোলাপি ফ্রিল-দেওয়া ফুল-ফুল জামা আর মেরুনরঙা জাম্পার পরে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে অবিশ্বাস্য ধীরে হেঁটে গেল আমাদের সামনে দিয়ে। সম্ভবত গ্রিক কি ইতালিয়ান হবে। আমাকে ওই জায়গায় সিগারেট খেতে দেখে, মহিলা কপাল কুঁচকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে আমাদের দুইজনের দিকে তাকাল। কোথাও তো লেখা নাই—–নো স্মোকিং। আমাদের দেখতে নিশ্চয়ই বিবর্ণ, দীপ্তিহীন, লাগাতার মার খেয়ে পরাজিত এক যুগলের মতো লাগছিল—আমাদের মতো ত্রিশোর্ধ্ব, সংসারী, নয়া-প্রবাসীদের দেখলেই চেনা যায়; আমাদের বাকি সব প্রবৃত্তি ধুয়ে-মুছে গিয়ে হরে- দরে-গাণিতিক গড়ে একটা জিনিস দাঁড়িয়েছে, সেইটাই আমাদের স্পিরিট। নির্জীব, দুর্বল, স্টেরাইল। এইসব ভেবে একটু জেদ হলো। মহিলার দৃষ্টির জবাবে আমিও একটা প্রতিরোধী পূর্ণদৃষ্টি দিলাম। মহিলা বুঝল কি না, কে জানে। মহিলার পিছে হাঁটছিল সদ্য ট্রাম থেকে নামা বাকি সওয়ারিরা। হাঁটার পথটা অপরিসর, তার উপর আবার বেঞ্চিপাতা। মহিলার কারণে দেরি হয়ে যাচ্ছিল বাকিদের, তবুও ওরা ধৈর্য ধরে মাটির দিকে চোখ রেখে আস্তে-আস্তে সারবেঁধে হাঁটছিল। ওরা কেউ আমাদের দেখল না। সেই মানুষগুলির মধ্যে একটা সবুজ রঙের পানির বোতল হাতে একটা বাচ্চাও ছিল, সকলের মধ্যে সে-ই দেখলাম একমাত্র অস্থির, বামহাতে মায়ের হাত ধরে রেখে ডানহাতে বোতলটা সে সজোরে ঝাঁকাচ্ছিল, কিন্তু বাচ্চাটারও মুখের ভাব খুব সিরিয়াস, এমনকি হয়তো গভীর কোনো চিন্তায় নিবিষ্ট। মিশুর কোমল, সস্নেহ দৃষ্টি বাচ্চাটার উপর নিবদ্ধ — মিশুরও বাচ্চা চাই। রাস্তার উলটাদিকে তারকাঁটার বেড়া বসানো। কালো হুডি পরা একটা কম বয়সি ছেলে মাত্রই এসে থামা ট্রামটা ধরার জন্য তারকাঁটার বেড়ার অপরপাশের ফুটপাথ থেকে পড়ি-মরি করে দৌড় লাগাল—একপর্যায়ে হাতের মোবাইল ফোনটাকে অনায়াসে মুখে কামড়ে ধরে দুইহাতে ভর দিয়ে তারকাঁটার বেড়া ডিঙিয়ে ওইপাশের ট্রামলাইন পার হয়ে আলোর বেগে ছেলেটা এইপাশের ট্রামের সামনে এসে পড়ল। কিন্তু ওর কপাল মন্দ। ট্রামের স্বয়ংক্রিয় দরজা ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। ছেলেটার রাগী, হতাশ চোখের সামনে দিয়ে ট্রামটা আবার ঘণ্টি বাজিয়ে টান দিয়ে চলে গেল। হুডি পরা ছেলেটা গমনোদ্যত ট্রামটার গায়ে জোরে এক থাবড়া দিলো। বলল, ফাক। বুড়িটা তখনও আস্তে-ধীরে হেঁটে যাচ্ছে লাঠিতে ভর দিয়ে; ছেলেটার দিকে একবার পিছন ফিরে তাকাল বুড়ি। তারপর লাঠিটা মাটি থেকে তিরিশ ডিগ্রি উঁচিয়ে কী যেন একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর নিজে একাই বিড়বিড় করতে করতে পথচারী পারাপারের সিগন্যালে গিয়ে দাঁড়াল।

“মিশু, গতমাসের লাস্ট সোমবার ওরা আমাকে ফায়ার করছে। আমার চাকরিটা আর নাই।”

মিশু বিষাদিত চোখ বড়ো করে একবার আমার দিকে, আরেকবার ওর ব্যাগে ঠাসা বাজারসদাইয়ের দিকে, তাকাল। ওর একটা আস্থার জায়গা যেন বহুদিন ধরেই অল্প-অল্প করে খসছিল, ওই মুহূর্তে যেন শেষমেশ ভেঙেই গেল, যেন বোকার মতোই বিশ্বাস করেছিল ও আমার উপর আর বিদেশ-বিভুঁইয়ে আমার টাকা-বিয়ানোর কি টাকা-বাঁচানোর ক্ষমতার উপর। আশ্চর্য, মিশু তবু কাঁদল না। আমি কেঁদে ফেললাম। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এই আমি তখন জাতের চাকরি হারিয়ে ভরসায় আছি যে, বেকারির গ্রেইভইয়ার্ড শিফটের কামলা খাটার কাজটা ওরা আমাকে সপ্তাহে ছয়দিন করতে দেবে। মিশু কী করে আশা করে যে, এই মুখ নিয়ে আমি আম্মা আর মুন্নির সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা বলব?

রাস্তার উলটাদিকের বিখ্যাত হোয়াইট সেডার গাছটা পাতা ঝরে প্রায় ন্যাড়া হয়ে গেছে, ডালে-ডালে তার কয়েকশ পাখির বাস। আরেক দফা বাতাস দিলো; তাতে পাখিদের সমবেত আত্মা চিৎকার করে উঠল। বছরের এই সময়টা ঘণ্টায় সত্তর কিলোমিটার বেগে বাতাস বয়। ডালগুলি ভয়ংকরভাবে নড়ে উঠছিল, শীতের হাওয়ায় যেন পাখিগুলি গাছের পাতার মতো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়বে। পাখিদের আর্তনাদে মনে হচ্ছিল, কান পাতা যাবে না। এতে আমার কান্না আপনিতেই থেমে গেল। মিশু অনিচ্ছায় আমার হাত ছেড়ে দিয়ে দুইহাতে নিজের চুল সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

*

জ্যানেট স্মিথ নামের কটা লাল লিপস্টিক-লাগানো মহিলাটা কোনোমতেই ফোন ছাড়ছিল না। ফোনের অপরপ্রান্তের মানুষটা সম্ভবত মহিলার কথা ভালো শুনতে পাচ্ছিল না, কিম্বা এমনিতেই কানে কম শোনে— হয়তো বয়স্ক কেউই হবে। বারবার একটা ফোন নম্বর আবৃত্তি করছিল জ্যানেট; সামনে দাঁড়িয়ে শুনতে-শুনতে আমারই প্রায় মুখস্থ হয়ে গেল। জ্যানেটের বুকের কাছে চেলসি লার্নিং সেন্টারের আইডি কার্ড, গলা থেকে একটা লাল রঙের ফিতায় ঝুলছে সেটা। ওর পোশাক সম্পূর্ণটা দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু উপরের অংশটা টকটকা লাল, নির্দ্বিধ। লার্নিং সেন্টারের অভ্যর্থনা লাউঞ্জে নয়া অভিবাসীসুলভ কিন্তু-কিন্তু দেহভঙ্গিসমেত কুঁজা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। জ্যানেট মাত্র ওর ডেস্কের ওইপ্রান্ত থেকে আমাকে মনোযোগ দেওয়া শুরু করেছিল। ওর সাথে বাক্যবিনিময় শুরু হয়েছে কি হয় নাই, এমন সময় ওর ফোনটা বেজে উঠেছিল। ও বুঝি আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, আমি ওইখানকার কোনো স্টাফের কাছে এসেছি কি না। তখনই ফোন বাজল আর আমাকে আধা সুরাহা হওয়া সমস্যার মুখে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো অনির্দিষ্ট সময়; এইসব অপেক্ষা দারুণ অস্বস্তির। অনেকে এই রকম মুহূর্তে ইতস্তত করতে থাকে আর দুটো হাত কোথায় রাখবে বুঝে পায় না; আমার উলটা মনে হতে থাকে, আমি এখনই চাপড়া-বাঁধা ধুলার মতো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ব আর বাতাস এসে আমার ভস্মাবশেষ উড়িয়ে নিয়ে যাবে। জ্যানেট স্মিথ দেখলাম ধৈর্য ধরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার ফোনের অপরপ্রান্তের সেই মানুষটাকে বলে যাচ্ছে, “তোমার সোফা আর চেয়ারের ফুল সেট আজকেই পৌঁছে যাবে। তুমিই কিন্তু নীল রঙের আপহোলস্ট্রি চেয়েছিলে! হ্যাঁ। নীল। নীল। নীল তো খুবই সুন্দর রং। ব্লু ইজ গুড। ব্লু ইজ রিয়েলি গুড।” আশ্চর্য! আপাদমস্তক লালে আবৃত একজন মানুষ—লাল লিপস্টিক, লাল জামা, লাল রিবনে সজ্জিত হয়ে সমানে নীলের স্তুতি করে যাচ্ছে। জ্যানেটের গলা চড়ছিল। আমার অস্থির লাগতে থাকল।

আজকে আমাদের মাসিক অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার সাপোর্ট গ্রুপের প্রথম অধিবেশন আমি এদের কাউকেই চিনি না। অনলাইনে রেজিস্টার করে চলে এসেছি। প্রতিমাসেই নাকি চেলসি লার্নিং সেন্টারের একটা রুম বিনামূল্যে ভাড়া করে দুই ঘণ্টার সেশন চলে। ক্রনিক উদ্বিগ্নতা কিম্বা বিষণ্নতায় ভোগা একদল মানুষ— তাদের মধ্যে একজন থাকে সঞ্চালক, গোল হয়ে বসে থাকে আর বসে মন খুলে নিজেদের কথা বলে। শুধু কথা বলতে চাওয়া ছাড়া আর কোনো উচ্চাশা কিম্বা আবেদন নিয়ে এরা আসে না। এরা বেশিরভাগই আশেপাশের সাবার্বের মানুষ— চেলসি, ফ্র্যাংকস্টন বা বনবীচে এদের বাড়ি। যদিও এদের মধ্যে শাদা মানুষের সংখ্যাই বেশি (জনসংখ্যার বিচারে তেমনই হওয়ার কথা), এদের মধ্যে এছাড়াও রয়েছে একাধিক মিল—এরা প্রত্যেকেই মনোজাগতিক সংকটের কাছে হেরে গেছে। কারও চাকরি চলে গেছে, কেউ বৃদ্ধ বা অশক্ত, কারও বা ড্রাগ অ্যাবিউজের রেকর্ড আছে, কেউ বহিরঙ্গে খুব ফিটফাট, কিন্তু আদতে সমাজবিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ—– মোটকথা সিস্টেমের মোটা জালির ফাঁক গলে এরা প্রত্যেকেই ঝরে পড়েছে। এদের সাথে নিজেকে আবিষ্কার করার লজ্জা কাটাতে আমার অনেক সময় লেগে যাবে, আমি জানতাম। টেম্পটেশন বেকারির ড্রাইভার মঞ্জিত ব্রার আমাকে বলছিল এদের কথা। টেম্পটেশন হচ্ছে সেই বেকারি, যাদের ফ্যাক্টরিতে আমি শ্রমিকের কাজ করি, কিন্তু ঢাকায় কেউ আমার এই কাজের কথা জানে না। অফিসের চাকরিটা যাওয়ার পর সপ্তাহে ছয়দিন কাজ করার আবেদন মেনে নিয়েছে সন্দীপ। এটাই এখন আমার মূল কাজ।

রিসেপশন ডেস্কে জ্যানেট স্মিথ মহিলাটার সামনে যখন আমি দাঁড়িয়েছিলাম, তখন দেখলাম পুরু মেকআপ করা এবং গালের হনু প্রায় অস্বাভাবিক রকমের স্পষ্ট করে তোলা মুখটা হাসিহাসি করে একটা মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটা আমার সামনে এসে খুব সুর করে জিজ্ঞেস করল, আমার কাছে কনফার্মেশন ইমেইল আছে কি না। মেয়েটার বয়স ত্রিশের কিছু কম, চোখের উপরের পাতায় ঘন করে আলগা পাপড়ি বসানো; দেখে মনে হচ্ছিল, চোখ মেলে তাকাতেও বুঝি ওর শারীরিক পরিশ্রম হচ্ছে। ওর ঠোঁটে হাসিটা একটা অনতিক্রম্য রেখার মতো জেগে ছিল, শুধু ওই পর্যন্ত গিয়েই থেমে যেতে হবে, এর বেশি যাওয়া যাবে না। প্রেমে পড়া বা প্রেমভাব প্রকাশ করা তো দূরের কথা।

আমাকে ও বলল, ওর পিছে-পিছে যেতে। আমি হাঁটা শুরু করলাম। পুরু কার্পেটে মোড়ানো মেঝে—আমি চেষ্টা করলাম মিশুর উপদেশমতো পা হেঁচড়ে না হাঁটতে, এতে নাকি জুতার সোল দ্রুত ক্ষয়ে যায়। প্যাসেজে লেমনগ্রাসের গন্ধ। এয়ার ফ্রেশনার। মেয়েটা হাঁটতে-হাঁটতে পিছন না ফিরেই দস্তুরমাফিক জানতে চাইলো, লার্নিং সেন্টার খুঁজে পেতে আমার কোনো অসুবিধা হয়েছে কি? বলল, আমি নিশ্চয়ই আশেপাশের কোনো এলাকাতেই থাকি। আমি ওকে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম, না, তবে আমার অফিস খুব কাছে। খুব চিকন একটা করিডোর পার হয়ে একটা দরজার দিকে হেঁটে যাচ্ছিল মেয়েটা, যদিও ও সামনে থাকায় দরজাটা তখন দেখতে পাচ্ছিলাম না। ছোটোবেলায় আমি টিভি দেখতে বসলে মুন্নি টিভির ঠিক সামনে এসে পুরো পর্দা আড়াল করে, হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকত। কী দেখছি, তা দেখতে না-পেলে আমার উদ্বেগ হয়। আমার হাত ঘামতে লাগল।

দরজা খুলে ধরে মেয়েটা আমাকে যে রুমে নিয়ে গেল, সেখানে ঢুকে আমি দেখলাম, সবাই কথা থামিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। ওদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল যে, তখনও ওরা মূলত শ্রোতার ভূমিকায়, হয়তো ওদের মধ্যে যে সঞ্চালক, শুধু সে-ই বলছিল, কিন্তু শাদা ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে গোল হয়ে বসে থাকা সকলকে দেখে আমি টের পেলাম, ওদের মধ্যে একটা পুরাতন বোঝাপড়া আছে। ওদের নীরব পারস্পরিক আদবের মধ্যে তেমন একটা ব্যাপারই ছিল। হয়তো বেশিক্ষণ আগে না, মাত্র মিনিট পাঁচেক আগেই ওরা একে-অন্যের সাথে পরিচিত হয়েছে। একে- একে বলেছে নিজেদের নাম-ধাম, পেশা, বাড়িতে কুকুর পালে কি না, কিম্বা শেষ কবে বেড়াতে গিয়েছিল বালি বা প্যাসিফিক আইল্যান্ডস। রিসেপশন ডেস্কের সামনে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকার জন্য সেশনের শুরুর দিককার কিছুটা অংশ আমার মিস হয়ে গেছে, বুঝলাম।

সঞ্চালক মহিলাটা সকলকে বলল, “এইবার আমরা জোড়সংখ্যক মানুষ হয়েছি। চমৎকার!” তারপর আমার দিকে চেয়ে বলল, “আমি কাইলি”, তারপর পাশে বসে থাকা বয়স্ক মহিলার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করল। বয়স্ক মহিলাটা হাসল — মুখে একটা দাঁতও নাই আর মাড়িগুলি কালচে আর কী অদ্ভুতভাবে হাতে গার্ডেনিং গ্লাভস পরা, যেন মাত্রই সেন্টারের পিছের বাগানে আলু তুলছিল— তারপর নরম গলায় আমাকে তার নাম বলল। তারপর একে-একে বাকিরাও। প্রত্যেকের মুখের দিকে একবার করে তাকিয়ে নিয়ে আমি দুই কদম পিছিয়ে গেলাম, তারপর নিজের নাম বললাম। ছোট্ট করে নিজের অনুভূতিও বললাম— এইখানে এসে খুব ভালো লাগছে, হ্যান-ত্যান। পাবলিক স্পিকিংয়ের যেসব টিপ্‌স আমরা শুনে থাকি, যেমন—উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে থেকে শুধু একজনকে বেছে নিয়ে তার চোখে চোখ রেখে সকলের উদ্দেশ্যে কথা বলা; সেসব মনে পড়ল। আমার চোখ গেল তামজিদ ছেলেটার দিকে। ওর চেহারা ভারতীয় উপমহাদেশীয়, কিম্বা সেই দলে আমি ছাড়া বাদামি চামড়া একমাত্র ওর দেখেই কি না কে জানে? আমার ওকে পূর্বপরিচিত, প্রায় আত্মীয় বলে মনে হচ্ছিল। আরও একটা কারণ হতে পারে যে, এই গ্রুপে যেহেতু অনেকেরই সোশ্যাল অ্যাংজাইটির সমস্যা আছে, বাকিরা হয়তো তাই চোখ লুকিয়ে রাখছিল আমার থেকে। সঞ্চালক কাইলি মহিলাটা ঘরের কোনা থেকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এসে ওদের বৃত্তের পরিধিটা একটু বড়ো করে দিয়ে হাততালি দেওয়ার মতো করে হাতের ধুলা ঝেড়ে আমাকে বলল, “বসে পড়ো।”

ছয়টা শাদা চেয়ার আর মাঝের একটা গোল টেবিল আর ঘরের পশ্চিমকোণে একটা চাকাওয়ালা কাঠের দেরাজ, তাও অন্য দিকে মুখ করে রাখা। দেরাজটায় চৌকো-চৌকো কাঠের ইন-লে করা ডিজাইন, দেখে মনে হচ্ছিল একটা রুবিক্স কিউব আমাদের অধিবেশনে যোগ দিয়েছে আর রাগ করে দূরে গিয়ে পাছা ঘুরিয়ে বসেছে। একটা দেয়ালে টানা নোটিশ বোর্ড আর তাতে জরুরিই হবে এমন কিছু কাগজ সাঁটানো। আরেকপাশে কাচের দেয়াল; এন্তার আলো আসছে। ঘরটায় আর কোনো আসবাব নাই।

এবারে কাইলি একতাড়া কাগজ নিয়ে বসল। আমাদেরকে বুঝিয়ে বলা হলো সেশনের মুখ্য উদ্দেশ্য। আমরা কথা বলব—প্রথমে অল্প কথায় বুঝিয়ে বলব, আমরা এখানে কেন এসেছি, কী কারণে বা কোন ঘটনা ঘটার পর আমাদের মনে হয়েছে, এখানে আসা দরকার। তারপর আমরা জোড়ায় জোড়ায় কথা বলব। একজন সাথি বেছে নিয়ে পালাক্রমে বলব আমাদের উদ্বেগ, ভয়, আশঙ্কা, ট্রমা (যদি থাকে) – ইত্যাদির কথা। সাথিকে প্রশ্ন করব, সাথিকে জাজ করব না, সাথির প্রয়োজনে তার হাত ধরব বা সমমর্মিতা দেখাব, সাথির জন্য কথা বলা সহজ করে দেবো। সেই সাথে এটাও মনে রাখব যে, সাথি কিছু বলতে না চাইলে তার ইচ্ছাকে সম্মান করতে হবে। অবশ্য এই সেশন তো কোনোভাবেই ওষুধ, কাউন্সেলিং বা ডাক্তারি সেবার বিকল্প নয়। আমরা কি বুঝতে পারছি? আমাদের কি কোনো প্রশ্ন আছে? না থাকলে প্রথমে এই কাগজে সই করতে হবে—আমরা প্রত্যয়ন করছি যে, সর্বাবস্থায় এই সেশনের সমস্ত কথোপকথন গোপন রাখব, কোনোভাবেই এই চার দেয়ালের বাইরে যেতে দেবো না।

*

“আমার আর আমার আগের স্বামীর একটা ফার্মহাউজ ছিল। তিনটা ঘোড়া ছিল আমাদের। জেমা নামের ঘোড়াটা ছিল সবচেয়ে সুন্দর আর আমার সবচেয়ে আদরের। ডিভোর্সের পর ফার্মহাউজটা আমার নামেই লিখে দেয় মর্গ্যান। আমি কি আর জানতাম, জেমা আমাকে দুই চোখে সহ্য করতে পারতো না? এই যে দেখ, একদিন দানা খাওয়াতে গিয়ে আচমকা লাথি খেয়েছি আমি, চোয়াল ভেঙেছে আর দাঁতগুলিও”, বলতে-বলতে ঠোঁট প্রসারিত করে দেখাল দাঁতবিহীন মহিলাটা—এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, ও বুঝি হাসছে। এরপর থেকে পশুপাখি তো বটেই, এমন কি অবোলা শিশু দেখলেও মহিলা ভয়ে আর উৎকণ্ঠায় কাছে যেতে পারে না। হার্লে কুইনের মতো ফ্যাকাশে সোনালি চুল আধা-গোলাপি করে দুই কানের উপর চূড়া করে দুই লম্বা ঝুঁটিতে বেঁধে রাখা মেয়েটা বলল, “ইউনিকর্ন যেমন আমার খুব ভালো লাগে—ঘোড়া যদিও পোষা প্রাণী হিসাবে কেমন হয়, আমি জানি না; আমার আদরের পোষা জন্তু যদি এমন করতো, আমিও তোমার মতোই…।” দাঁতবিহীন বয়স্ক মহিলাটা মাথা সামান্য নিচু করে ডানহাতের গ্লাভসে মোড়ানো তর্জনী দিয়ে বামহাতের গ্লাভসে-মোড়ানো তালু চুলকাতে লাগল আর সম্মতি জানিয়ে অল্প-অল্প মাথা নাড়ল। প্রৌঢ় লোকটা, যার বগলের নিচ থেকে বাদামি রঙের ছাতার ডাঁটি বের হয়ে আছে, প্রথমে কিছুই বলতে পারছিল না। আমরা শান্ত আর সংযতভাবে চুপ করে থাকায় ও হয়তো মনে জোর পেল। বলল, কর্মমুখী কলেজের ফাইল-ক্লার্ক ছিল সে। কিন্তু আজকাল তো সবই ডিজিটাইজ হয়ে গেছে, ফাইলপত্র ইনডেক্স করতে বা ম্যানেজ করতে একজন ফুলটাইম কর্মচারী রাখা তো যে-কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য আলগা খরচেরও ব্যাপার। এই বয়সে কেউ আর নতুন করে কী শিখবে? বাধ্যতামূলক অবসরে গিয়ে লোকটা একাধারে ডিপ্রেশন আর অ্যাংজাইটি বাঁধিয়ে বসেছে। তার ছেলে নাকি তাকে বলেছে, একা-একা না থাকতে; বলেছে, ছেলে, ছেলের বউ, নাতির সাথে এসে উঠতে। এতে ওদের বাচ্চার ডে-কেয়ারের খরচও বেঁচে যায়। “কিন্তু পরের গলগ্রহ হয়ে থাকব, আমি তেমন ছেলে নই”— গোঁজ হয়ে অভিমানী গলায় বলল প্রৌঢ় লোকটা। ষাটের কাছাকাছি বয়সের একজন লোকের নিজেকে “তেমন ছেলে নই” বলে ডাকার মধ্যে কৌতুককর একটা অসহায়ত্ব ছিল বলে আমার মনে হলো। দুই ঝুঁটির হার্লে কুইন মেয়েটা বলল, “ফ্যামিলি কিন্তু ডিপ্রেশন কাটাতে মারাত্মক হেল্প করে। আমার যেমন ফুল ফ্যামিলি থাকে লন্ডনে, এইখানে তাই সুযোগ পেলেই ইয়োগা রিট্রিটে চলে যাই। সুন্দর একটা সময় কাটে, মনে হয়, নিজের পরিবার যেন এরা। যদিও আমার বান্ধবীরা বলতে চায়, আমার দুইদিন পরপর ইয়োগা আর মেডিটেশনে যাওয়ার বাতিক আছে। আমি তো গতবছর সাইকায়াট্রিস্টই বদলেছি চারটা…।”

এরপর আমার পালা। আমি আমার বক্তব্য মাথায় গুছিয়ে রেখেছিলাম। বললাম, আমাকে আমার অফিস থেকে অন্যায়ভাবে ছাঁটাই করা হয়েছে। বললাম, আমার বস জানত যে, অস্ট্রেলিয়ার শ্রম আইনে কারও চাকরির বয়স যদি ছয় মাসের কম হয়, তাহলে কর্তৃপক্ষ তাকে এক মুহূর্তেই চাকরিচ্যুত করতে পারে। বললাম, আমাকে মিটিং রুমে ডেকে নিয়ে এমন হড়বড় করে জবাব দিয়ে দেওয়া হলো যে, আমি তাজ্জব বনে গেছিলাম। বললাম, আমার বসের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, তক্ষুনি—ওই মুহূর্তেই আমার চাকরি খেয়ে না দিলে বিরাট অনর্থ ঘটে যাবে আর দুইটা মিনিট সময় বেশি নিয়ে নিলে ঘড়িতে ঢং করে বেজে উঠবে ‘ছয় মাস’ আর আমি গটগট করে হেঁটে গিয়ে শ্রম-অধিকার দফতরে গিয়ে ধরনা দেবো আর আমার অফিসের নামে কিম্বা আমার জালিম বসের নামে মামলা ঠুকব।

আমি বুঝি সময় একটু বেশিই নিয়ে ফেলেছিলাম। তামজিদ নামের ছেলেটার দিকে সকলের চোখ ঘুরে গেল দেখে, আমি থেমে গেলাম। আমার আরও কিছু বলার ছিল: আমার আব্বার কথা, আমার আব্বার চলে যাওয়ার কথা, অভিবাসনের প্রশাসনিক জটিলতায় আমার আব্বাকে আমার শেষবারের মতো দেখতে না পাওয়ার কথা, মিশুর কথা, আমাদের দুইজনের আমতা-আমতা করে ইংরেজি বলার কথা, অভ্যাগত গরিব আত্মীয়র মতো পাবলিক ট্রান্সপোর্টের কোনা ঘেঁষে বসে থাকার কথা। সেইসব কিছুই বলতে পারলাম না। তামজিদ ছেলেটা বলতে শুরু করল। ওর বয়স আমার কাছাকাছিই হবে—প্রথাসিদ্ধ রকমের সুন্দর না, কিন্তু ঘোর তামাটে রঙের মধ্যে এমন একটা সহজ পালিশ ছিল যে, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না পালিশটাই ওর সহজাত, নাকি ওর চেহারার খর বিষয়টাই জন্মগত। আল্লাহর দেওয়া স্বাভাবিক সৌন্দর্য মানুষের হাতে অবহেলা পেতে-পেতে যে অবস্থায় দাঁড়ায়, তেমন একটা অসম্পূর্ণ শ্ৰী দেখলাম আমি ওর মুখে। এই রকম মুখ আমি চিনতে পারি, কিন্তু তবু কেন মনে হচ্ছে, চিনতে পারিও না? ও বলল, ও পাকিস্তানি, কিন্তু সেই সাউথ এশিয়ানই তো। ও বলল, ও এখানে মূলত এসেছে, কারণ ওর বাচ্চার অটিজম আছে। নতুন পরিবেশে গেলে কিম্বা নতুন মানুষের সাথে দেখা হলে ওর বাচ্চাটা গুটিয়ে যায়, ভয় পায়, কাঁপতে থাকে–শিশুদের সামাজিক উৎকণ্ঠা নিয়ে তাই ও জানা-শোনা বাড়াতে চাইছে। “আমি যেহেতু একজন আদর্শ বাবা পাই নাই, আমি আমার ছেলেকে বেস্ট প্যারেন্টহুড দিতে চাই।” সঞ্চালক কাইলি নড়েচড়ে বসল, বুঝি চোখ সরু করে তামজিদকে দেখল। আমার মনে হলো, আমার মতো সে-ও বোঝার চেষ্টা করছে যে, সত্যিই তামজিদের মতলবটা কী। তামজিদ বুঝি সেটা টের পেয়েই তাড়াহুড়া করে বলে ফেলল ওর রক্ষণশীল পাকিস্তানি পরিবারের কথা—ওর জাঁদরেল বাবা আর সংগ্রামী মা ওকে যে শৈশব-কৈশোর দিয়েছে, তাতে মানসিক সমস্যা দূরের কথা, মানসিক দুর্বলতারও কোনো জায়গা নাই। ওর জন্ম লাহোরে। স্কুল ফাইনালের পর ডি-ব্লক মডেল টাউনে রাত-বিরাতে বাইক চালিয়ে বন্ধুদের সাথে কাবাব খেতে গেছিল বলে নাকি ওর বাবা ওর বড়ো ভাইয়ের বাইক জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। এগারোতে পা দিতে না দিতেই ওকে আর ওর ভাইকে নিয়ে ওর বাবা-মা মেলবোর্ন চলে আসেন। তারপর মামাদের মোটর পার্টসের দোকানে ওর ভাই কাজ শুরু করে ওদের কাজিনদের সাথে। নতুন শহরে এসে তামজিদ ডিপ্রেশনের কবলে পড়ে। পড়ালেখাও অস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। যদিও মেলবোর্নে ওর কোরআনের ইলম তৈরির তালিম চলত দস্তুরমতো। বাড়িতে হুজুর আসত। হুজুর বললেন, ডিপ্রেশন হচ্ছে শয়তানের কুমন্ত্রণা। এর কারণে মানুষ পেরেশান হয়ে পড়ে। শয়তান কানের কাছে ফিসফিস করে মানুষকে জীবনের অর্থ ভুলিয়ে দেয়। বিশেষত, যে ব্যক্তি দ্বিনের পথে চলার ইচ্ছা করে, তার মনেই এই জাতীয় কুচিন্তা বেশি আসে। তামজিদের কথা শুনে আমি সজোরে মাথা নাড়লাম। মানসিক বৈকল্যকে আরবিতে একটা নাম দিয়ে ছোটো করে রাখা হয়েছে, যাতে এই প্রসঙ্গ নিয়ে মাথা না ঘামাতে হয়। ডিপ্রেশন বা অ্যাংজাইটি হয় তো হোক, ওইদিকে মনোযোগ দিলে তো ঈমান নড়বড়ে হয়ে যাবে। কাইলি আর হার্লে কুইন মেয়েটা খুব মন দিয়ে শুনছিল। ওদের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন বহুভাষী সাংবাদিকের মতো গলা করে তামজিদ বলল, আরবিতে ডিপ্রেশনকে বলে ওয়াসওয়াসা।

ওর উচ্চারণে ওয়াসওয়াসা শব্দটা শুনে আমি ওর দিকে পুরা চোখ মেলে তাকালাম। এক ঝলকে চিনলাম আমি ওকে। ওর নাম কামরুল। ওর জন্ম সরাইলে, মানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, লাহোরে নয় মোটেও। ওর মা লালমোতি। ওর মায়ের ইনকাম দিয়ে ওর বাবা নেশা করতো, তাই ওকে নিয়ে ওর মা চলে এসেছিল আমাদের বাসায়। তিরাশি সনে। আমরা বলতাম আশ্রিত, আসলে ছিল কাজের লোক।

এক মুহূর্তের ভিতর এইসব মনে পড়ে গেল আমার—মুহূর্তটাই কি প্রলম্বিত হয়ে ছিল, নাকি আমিই কোনো উঁচু জায়গার থেকে কারও ধাক্কা খেয়ে ধুপ করে পড়ে যাওয়ার বদলে বাতাসের ভিতর ধীরে, অতি ধীরে ভাসতে ভাসতে বিবর্ণ মাটিতে ল্যান্ড করলাম, জানেন আমার আল্লাহ। আমার মুখভরতি দাড়ি, তাই বুঝি আমাকে চিনতে পারে নাই কামরুল! তামজিদ নাম করে নিল ও?

*

পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের খেলা। সবুজ ফোন করে বলল, একটু পরই ও রওনা দিচ্ছে।

“বাদ দে, দোস্তো। ইচ্ছা করতেছে না। আমারে আমার মতো থাকতে দে না তোরা!”

“বহুত থাকছস তোর মতো। আজকে আমি আসুমই। চব্বিশ ঘণ্টা একলা একলা নিজের মাথায় নিজে হাগোস। তোর খাসলত জানি আমি।”

“তুই শিওর, আসবি? কালকে না আবার তোর অফিস? দেরি হয়ে যায় যদি?”

“আরে রাখ! দরকার হইলে, তোর বাসা থেকে অফিস যাব। প্রবলেম কী? আর তোর কী? তোর তো আর অফিস নাই কালকে। “

মিশু ঠিকই সবুজকে বলে দিয়েছে আমার চাকরি খোয়ানোর কথা। তাতে অবশ্য তেমন সমস্যা নাই। সবুজ তো আমার সবচেয়ে পুরানো বন্ধু। সবুজ এলে বরং ভালোই হয়। কিছু টাকা ধার চাইব; সবুজ যখন এই দেশে নতুন এসেছিল, তখন হাজার দুয়েক ডলার আমিও তো ধার দিয়েছিলাম। দেই নাই? আমার ফ্যামিলি বলতে তো এখন সবুজরাই। মিশুকে যদিও বলা যাবে না ধারকর্ডের কথা।

“আচ্ছা, শুন। তোর কামরুলরে মনে আছে?”

“কোন কামরুল? ইগলু কম্পানির সেল্স ম্যানেজার ছিল যে?”

“আরে না। ধুরো। আমাদের বাসায় থাকত যে। আমাদের বুয়ার ছেলে। মনে নাই? তুই তো ওর হেভি ফ্যান ছিলি।”

“ওহ। তোদের কলোনি বাসার কামরুল! ওদেরকে না খেদায়া দিছিলি? ওরে পাইলি কই?”

“অ্যাংজাইটি সাপোর্ট গ্রুপের মিটিংয়ে গেছিলাম একটা। আরে, আগে শুন! শালা তো আমারে চিনে নাই। আমি তো ঠিকই চিনছি। চাপাবাজি করতেছিল।”

“কী বলছে?”

“বলছে, ওর জন্ম লাহোরে। বলছে, ওর আরবির হুজুর ওরে ওয়াসওয়াসা শিখাইছে। বলছে, একদিন বিকালে হুজুরের নির্দেশে অজিফা শরিফ আনতে ওর আব্বা-আম্মার রুমে গেছিল। গিয়া নাকি দেখছে, ওর আব্বা ওদের বাসার আশ্রিত মহিলার সাথে ইয়ে করতেছে। তাই দেইখা ওই মহিলার ছেলেরে ও নাকি দিছে বেদম মাইর। এইসব নানান হাবিজাবি চাপাবাজি। আবার নিজের নাম কইল তামজিদ।”

“কস কী? কী সাংঘাতিক! এইসব কাহিনি আসলেই তোদের বাসায় হইছিল নাকি?”

“সবুজ, তোর কি মাথা খারাপ?”

“স্যরি। এই রকম প্রশ্ন আমি তোরে ক্যামনে করলাম? রিয়েলি স্যরি, দোস্তো। বাট তুই শিওর এইটা ওই কামরুলই?”

“তুই ফেসবুক বা লিংকডইনে সার্চ দিয়া দ্যাখ না। তামজিদ মালিক মেলবোর্ন। এই কীওয়ার্ড দিয়া দ্যাখ। পরিষ্কার এইটা কামরুল।”

“আচ্ছা। দেখুম। আগে রেডি হই। কোক আনুম? স্ন্যাক্স আছে কিছু বাসায়? মিশুরে রাতে রান্না করতে মানা কর। আমি আইসা উবার-ইটসে খানা অর্ডার দিমু।’

আমি বুঝলাম না, লার্নিং সেন্টারে কামরুলের সাথে দেখা হওয়ার ঘটনাটা সবুজকে বলে আমি ভালো করলাম কি না। থাকত আমার মনের পুরানো ক্ষত মনেই! আর এর সবটা তো আমার মনের সম্পত্তিও না, অনেকখানিই তো আমার পরিবারের সম্মান আর আমার আব্বা-আম্মার অতীতের সাথে জড়িত। এই কি যথেষ্ট ছিল না যে, আমার নামের উপর বেরহম ছেলের কলঙ্ক লাগল? ঢাকার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব—এমনকি আম্মা কিম্বা মুন্নিও কি কখনো আব্বা চলে যাওয়ার পর আমার বিদেশের পাসপোর্ট আঁকড়ে পড়ে থাকার গুনাহ মাফ করতে পারবে? তার উপর চাকরি চলে যাওয়া, আমার দীর্ঘমেয়াদি মনের অসুখ—সবকিছুর ঊর্ধ্বে কামরুলের সাথে এতদিন পর ওইভাবে দেখা হয়ে যাওয়া–নাহ, এইসবের কোনোটাই সবুজকে হড়হড় করে সবকিছু বলে দেওয়ার অজুহাত হতে পারে না। ঢাকায় ওদের প্রত্যেকটা সকাল না জানি কেমন যন্ত্রণার! আহা, আম্মা কত চেষ্টাই না করতো আব্বাকে সুপথে আনার, কিন্তু আব্বার মতি ফিরল না; “তোমরা হজ্বে গেলে যাও, মিয়া! আমার এখনো বয়স হয় নাই”, বলেছিল আমার সত্তরোর্ধ্ব আব্বা—এখন কবরের আজাব কি আব্বার একার? মুন্নি গতকালও ফোনে কেমন কান্নাকাটি করল। ওকে যথারীতি মামারা আব্বার কবরের কাছে ঘেঁষতে দেয় নাই। আর এইসবের মধ্যে আমার এইসব ধ্বজভঙ্গ টাইপ আচরণ, সবুজরা আমাকে আজীবন ডেকেছে মাইগ্গা, আব্বার ছেলে যে এমন তুলতুলু স্বভাবের হতে পারে, আব্বা কি তা ভেবেছিল?

মিশু সকাল-সকাল বক্স-প্লিট স্কার্ট আর উঁচু হিলজুতা পরে কাজে গেছে। ওর ম্যানেজার হারামজাদি নাকি বলেছে, ওর মতো পাঁচফুটি মেয়ের হাইহিল না পরে সেসে কাজ করতে আসাই উচিত না। প্রেজেন্স যদি না থাকে, কী দেখে ক্রেতারা মজবে? তাই তো, কী দেখে মজবে বলো, মিশু? শুধু আমাদের বাঙাল-টানের খুঁতিয়াল ইংরেজি কথায়? শাদা মাগি। সবুজ এদেরকে দেখেই বলে, “শুয়ে শুয়ে বড়ো হইছে।” মিশু অনেক শক্ত ধাতের মেয়ে। ম্যানেজারের প্রায় রেসিস্ট কথাবার্তা আর অসংবেদনশীল হাসি-তামাশা ও গায়েই মাখে না। আমি একদিন ক্ষেপে গিয়ে ওকে কিছু বলেছিলাম বুঝি, ওর ম্যানেজারকে মাগি ডেকে, ও অন্যদিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলেছিল যে, সুপারমার্কেটে এক কেজির প্যাকেট-প্যাকেট ফ্রোজেন সবজি পাওয়া যায়। আমরা আর ফ্রেশ মটরশুঁটি, ফ্রেশ কাঁচামরিচ কিনব না, হ্যাঁ? ফ্রেশটার দাম বেশি।

আমাদের কলোনি-বাসার শেষ দিনে কামরুলকেও আমি বলেছিলাম, “তোর আম্মা একটা মাগি।” এটাও মনে পড়ল। আচ্ছা, আমি কি সন্নিধান ছাড়া স্মৃতিকে আর কোনোভাবে প্রসেস করতে পারি না, ইংরেজিতে যে প্রক্রিয়াকে বলে অ্যাসোশিয়েটিভ মেমরি? আমার সাইকায়াট্রিস্ট ঠিকই বলে। একজন বুদ্ধিমান প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের কি এর চেয়ে উচ্চতর বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা থাকা উচিত না? যেমন, কেন আমার তামজিদকে দেখে মনে পড়তেই হলো ছোটো কামরুলকে আর ছোটো আমি-কে, চল্লিশের আব্বাকে, তিরিশের আম্মাকে, পায়ে-পায়ে ঘোরা মুন্নিকে, অসংখ্য আশ্রিতধন্য আমাদের কলোনি-বাসাকে, যে বাসায় উনুন নিভত না, যে বাসার সদর দরজা দিয়ে ঢুকে উবু হয়ে জুতা খুলতে গেলেই ভাত সিদ্ধ হওয়ার গন্ধ নাকে লাগত? কেন আমি জীবনের টাইমলাইনের ঘটনাগুলির ভিতর সুইচ অন-অফ করতে পারি না? আমি কি হাবা এতই?

শেষ বয়সে আব্বা অযথা অনেক প্রশ্ন করতো—বুয়া, ড্রাইভার, মিশু, এমনকি মাঝেমাঝে আমরাও খুব বিরক্ত হতাম। যে ডাক্তার ধৈর্য ধরে আব্বার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিত, আব্বা তাকেই বলত ভালো ডাক্তার, যোগ্যতার ধার ধারত না। কিন্তু কম বয়সে এই আব্বাই ছিল নিষ্প্রশ্ন একজন পুরুষ, নিজের শক্তি এবং নিজের খেয়ালখুশির ব্যাপারে শতভাগ নিঃসন্দেহ। নতুন বাই চাপলে আব্বাকে থামিয়ে রাখা তো যেতই না, বাকি সবার সেটার অংশভাক হতে হতো—সেটা এক পুকুরভরতি পাঙাশ মাছ তুলে আনার খেয়ালই হোক আর নতুন কোনো ব্যবসার আইডিয়াই হোক। একবার চাকরি ছেড়ে আব্বা চিংড়ির ঘেরে টাকা লাগাল। ঘরবাড়ি ফেলে আব্বা তখন সাতক্ষীরা গিয়ে থাকত, বাসায় এসে সংগ্রামী জীবনের গল্প করতো: নৌডাকাতির গল্প, ঘের নিয়ে পলিটিক্যাল রেষারেষির গল্প, ডালের সাথে বাগারের কালিজিরা মনে করে পোকা খেয়ে ফেলার গল্প ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই ব্যবসায় ধরা খেলো আব্বা। এমন আরও গোটা দুয়েক ব্যবসায়। তাতে আব্বা খুব বদলায় নাই। মামারা আর কাজিনরা বলতো, আব্বা মানুষটা নাকি লার্জার দ্যান লাইফ। আম্মার কারণেই হয়তো আব্বা এমন একটা চরিত্রে মফ করে যেতে পেরেছিল। তাই বলে আব্বা স্বেচ্ছাচারী ছিল না মোটেই। আব্বার মধ্যে একটা বিশেষ রকমের দায়িত্বহীন লজ্জা দেখেছি বহুবার, অনভ্যস্ত চোখে যেটা নির্লজ্জতার কাছাকাছি, কিন্তু নির্লজ্জতার মতো লাগামছাড়া নয়।

আমাদের পাড়ার রিক্রিয়েশন ক্লাবে বন্ধুদের সঙ্গে আব্বা প্রায়ই হাউজি খেলতে যেত আর বাড়ির ভিতর ঢুকত মধ্যরাতের আগে আগেই, যেমন করে ফাঁকিবাজ, ব্যাকবেঞ্চার ছাত্ররা চুপচাপ পিছনের দরজা দিয়ে ক্লাসরুমে ঢোকে। গেস্টরুমটা ছিল আব্বার ডেরা। হাউজির রাতগুলিতে বাড়ি ফিরে খেয়ে-দেয়ে আব্বা গেস্টরুমে নিরুত্তাপ বসে থাকত রাত দুইটা পর্যন্ত। তার আগে প্যান্ট বদলে লুঙ্গি পরতো, দাঁতে লুঙ্গি চেপে ধরে খসখস শব্দে তার ভিতর দিয়ে সারা দিনের প্যান্টটা গলিয়ে বের করে চেয়ারের হাতলে রাখত। প্যান্টের ন্যাতানো শরীরে কালো বেল্টটা শক্ত হয়ে জেগে থাকত। আম্মার শাসনের বাড়িটা, আর আব্বার উপস্থিতিতে আম্মার শাসনের বাড়িটা—দুইটা আলাদা দেশের মতো ছিল। এমন না যে, আব্বা-আম্মার ভিতর কোনো টান ছিল না, কিন্তু টান ছাড়াও তাদের মধ্যে কলহহীন অবহেলার একটা সিন্থেটিক বোঝাপড়া ছিল। জয়াপ্রদাকে আব্বার ভালো লাগত। আর সুপ্রিয়া দেবীকে, সুচিত্রাকে নয়। সেইসব দিনে গেস্টরুমে পাতা জাজিমের কোণে বুড়া লাউয়ের মতো দেয়ালে হেলান দিয়ে পড়ে আব্বা চুপচাপ ভিসিআরে হিন্দি ভিডিও ক্যাসেট চালিয়ে ছবি দেখত চব্বিশ ইঞ্চি টিভিতে ভলিউম মিউটে দিয়ে আর একপর্যায়ে নাক ডাকতে থাকত। দুই- দুইটা একশ ওয়াটের বাতি পুরা গেস্টরুমকে জাগিয়ে রাখত। আম্মা অতক্ষণ জেগে থাকত না। আব্বার সাথে গেস্টরুমে জেগে থাকত কামরুল। রাত জেগে আব্বার পাকা চুল বেছে দিত আর গুনগুন করে গান করতো, “ওই আমি শিকারে যামু, বন্দুক লইয়া রেডি হইলাম আমি আর মামু!” যেদিন যেদিন আব্বার গা ব্যথা করতো- আব্বার পিঠের উপর, ঊরুর উপর চর্বিতে পা গেঁথে টলোমলো হাঁটত কামরুল। ওর তো আর আমাদের মতো পরদিন স্কুল নাই।

“খলিফা হারুনুর রশিদকে কে না চেনে?” কামরুল বলেছিল আমাকে। সরাইলের কামরুল, যে আমাকে লুকিয়ে লাটিমখেলা শিখিয়েছিল—কেমন বোলতার মতন বোঁওওও করে ঘুরত ওর দামড়া লাটিমগুলি! আম্মার হাতে বেদম পিটনা খেয়েছিলাম রাস্তায়-রাস্তায় লাটিমখেলার দায়ে। কামরুল আমার অনেক সুশীল কাজেরও সাথি ছিল বটে; একবার রঙিন কাগজ কেটে আর শোলা চেঁছে আমরা একসাথে একমানুষসমান হরফে লিখেছিলাম—আজ পলাশ ফোটার দিন, সেইদিন রাজহংসীর মতো দেখতে বড়ো মেয়েরা এসেছিল ছাদে আর মাঠে-শাদা শাড়ি, কালো পাড়। এরপর একদিন কামরুল এসে প্রস্তাব দিলো যে, আমরা জশনে জলুছে ঈদ-এ-মিলাদুন্নবি-ও লিখতে পারি কি না; সেটা কেন যেন আর লেখা হয় নাই। কামরুলরা ওর বাবার ঘর-সংসার থুয়ে চলে আসার পর আম্মা আমাকে আর মুন্নিকে শিখিয়ে দিয়েছিল, কেউ যদি জানতে চায়, “ও কে?”, আমরা যেন বলি, “ও আমাদের একটা ভাই।” আমার যখন চোখ উঠত, কামরুলেরও উঠত; কামরুলের মাথায় উকুন হলে, আমারও হতো। এরকম সমস্ত খুচরা বিপর্যয় আর উৎপাতের বন্ধনে আমরা কেমন বাঁধা ছিলাম। বাসার ফুটফরমাশ খাটার কাজ কামরুলই করতো; বিকালে খেলাটেলার পর সন্ধ্যায় ও আমার সাথেই পড়তে বসতো–আমি বসতাম টেবিলে, আর ও মাটিতে আর ওর বইপুস্তক রেক্সিনঢাকা সোফার উপর। ও ছাত্র খুবই দুর্বল ছিল, চঞ্চলও – আম্মার চড়-চাপড় থামত না। যদিও ওইসব পড়াশোনা কামরুলের কোনো কাজে লাগবে বলে কেউ মনে করতো না। মেজো ফুপার গাড়ি-সারাইয়ের দোকানে ওকে নিয়ে নেওয়া হবে আরেকটু চৌকশ হলেই। আমার জন্য এটা ছিল একটা ঈর্ষার প্রস্তাবনা— যেন কোনোদিনও আমাকে দিয়ে হবে না, যদি না কোনো জীবনে আমি কামরুল হয়ে জন্মাই; তাই এই জীবনে হচ্ছে না। হচ্ছে না পিরিচে একটুও না চলকে চা নিয়ে দোকানে-দোকানে ছোটাছুটি, হচ্ছে না গাড়ির তলা থেকে কালো তেলা শরীর নিয়ে স্লাইড করে বেরিয়ে আসা, হচ্ছে না দোকানের সামনে মেলা করে রাখা সার সার টায়ারের উপর পা ফেলে ফেলে বাউন্স করতে-করতে হেঁটে যাওয়া। এখন ভাবলে, আমি ভিতরে কুঁকড়ে যাই— -এইসব রোমান্টিকতায় আমার আজও আপত্তি নাই, কিন্তু মনের কোথায় যেন ওই বয়সেই জন্ম নেওয়া একটা পৌনঃপুনিক নিষ্ঠুরতা টের পাই। অথচ কামরুলকে তো আমি আগলেই রাখতাম; এক বিকালে আজিমপুরের কানাগলির ভিতর খেলতে গিয়ে উপরতলার কোন বারান্দা গলে যেন মাদুরে পেঁচানো এক গৃহকর্মীর থেঁতলানো নিথর শরীর পড়েছিল আমাদের জটলার উপরে; আমি তো কামরুলের হাত ধরে টান মেরে ওকে সরিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। বি-১৫ বাসার কাজের মেয়ে রেহানার হাতে-মুখে-গায়ে যে সর্বদা খুন্তির খোঁচা আর ছ্যাঁকার দাগ থাকত, সেইসব কি কামরুল দেখত না? কিন্তু আমি তো কামরুলকে ভাই ডাকতাম।

মনে পড়ে, পুকুরে গোসল দিয়ে ওঠার পর শীর্ণ পিঠের দুই ডানা বাগিয়ে গুণের মতো টান-টান করে গামছা টেনে ধরে কামরুলের পিঠ মোছার দৃশ্য। (সেইবার ঢাকায় পানির খুব অভাব হয়েছিল, আমরা সবাই কলোনির পুকুরে গোসল করতাম।) আরও মনে পড়ে, কোনো এক দুপুরে ছিঁচকে চোরের চুরি করা শায়া আর পুরানো চপ্পল নিয়ে ওর আহাজারি। রান্নাঘরের পিছনে চিলতে বারান্দায় শুত কামরুল। কলা ঝুলত ওর মাথার উপর কাপড় শুকানোর দড়িতে। বারান্দার গ্রিল ঘেঁষে একটা বালতিতে সজনেগাছ লাগিয়েছিল কামরুল। প্রথম যেবার ওই গাছ শাদা ফুলে নুয়ে গেল, কামরুল মুখ কালো করে বলেছিল, “ধুর! সবগুলা ব্যাটাফুল।” মঙ্গলবারদিন হুজুর এলে কামরুল শান্ত হয়ে বসতো। আমার আর মুন্নির মনে হতো যে, হুজুর কামরুলকে একটু পক্ষপাতও দেখাতেন, যদিও সিপারা-আমপারায় ভুল করলে আমরা খেতাম মৃদু ধমক আর কামরুল খেতো রীতিমতো গালি। সেটাও পক্ষপাত না তো কী? আর কীসব অদ্ভুত কথা বলত কামরুল! বলত, ওদের সরাইলের হুজুর নাকি কোষ্ঠী দেখত, উনার নাকি ছদ্মনাম ছিল জ্যোতিষ তারাপতি। হুজুর যেদিন শেখালেন ওয়াসওয়াসা কী বস্তু, কামরুলের হাসি দেখে কে! “ভাইয়া, বুঝলা? পানির সাপ্লাই দেয় হইল ওয়াসা আর যখন শয়তান ভেজাল করে, তখন সাপ্লাই বন্ধ হইয়া যায়। ওইটা হইল ওয়াসওয়াসা।” আমিও হেসেছিলাম নিশ্চয়ই। আমাদের হুজুর শুনলে নিশ্চয়ই খুব রুষ্ট হতেন। উনি রাশভারী মানুষ ছিলেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলতেন না। হুজুরের সান্নিধ্যে মুন্নিও দেখতাম কথা কম বলতো, কেমন একটা তাপসী রাবেয়া বসরি টাইপের সাধ্বীভাব ভর করতো মুন্নির উপর। ছোটো খালার ওড়না দিয়ে চুল-কাঁধ-মায়-কপাল ঢেকে কানের পিছন দিকে গুঁজে দুলে-দুলে আরবি পড়ত মুন্নি। আর আমার ছিল বেয়াদব চুল, মাঝখানে সিঁথি করা। আমার আগে আমপারা খতম দেওয়া শেষ মুন্নির। আমাদের নীল আলমারির সবচেয়ে উপরের তাকে রেহেলের উপরে গেলাফ দিয়ে বেঁধে রাখা থাকত কোরআন শরিফ; মুন্নির সে কী আয়োজনের পাঠ! খুলে চুমু খায়, উঠিয়ে রাখতে গিয়ে চুমু খায়। হুজুরের তাঁব থেকে মুন্নির মুক্তি ঘটে গেল — একদম গ্র্যাজুয়েশন, মুন্নি শুরু করল গানের স্কুলে যাওয়া, কিন্তু আমার আর কামরুলের মুক্তি ঘটল না।

এরকমই এক দিনে, হুজুরের তালিমেরই এক বিকালে, এক মহা অনর্থ ঘটেছিল। আজকে এই ভিনদেশে বসে যে এই পাকিস্তানির ভেক-ধরা তামজিদকে চিনতে হলো আমার, সেইদিনের সেই ঘটনাটা না ঘটলে এইদিন কি দেখতে হতো? কামরুল হারামজাদা আর কিছু পারে নাই, পেরেছে তামজিদ হয়ে অন্ধকারের ভিতর থেকে ভুস করে ভেসে উঠতে আর উঠে জানান দিতে যে, আমার গল্প সে শুধু ছিনতাই করেই থামে নাই, চোরবাজারে সেটার বেচা-বিক্রি সেরে ঘাম মুছতে মুছতে ঘরেও ফিরেছে।

সবুজের অনুমান বেঠিক নয়; সেইদিন আমি ঢুকেছিলাম বটে আব্বা-আম্মার রুমে। অজিফা শরিফ খুঁজতেই কি? স্কুলের ইসলামিয়াত বইও হতে পারে। হুজুর আর কামরুল তখন ড্রয়িংরুমে বসা। তামজিদের চাপাবাজির মধ্যে এইটুকু অংশই শুধু সত্য।

আম্মা সেইদিন কলেজের নবীনবরণে। বাইরে খাঁ-খাঁ রোদ। জানালার বাইরে আমগাছটায় ঝেঁপে বউল এসেছে। আব্বা তার ছয় ফুটের শরীর নিয়ে বিছানা দখল করে নাক ডাকছে। খাটের পায়ের কাছে শিয়ালরঙা কম্বল পেতে লালমোতি কাপড় ইস্ত্রি করছে। একটা স্বাভাবিক, নিরীহ, গার্হস্থ্যভাবাপন্ন দুপুর। খালি পায়ে হেঁটে অর্ধেকটুকু ঘর পার হলাম। দেখলাম লালমোতি মেঝের উপর হাঁটুতে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে চেয়ারের উপর আব্বার ছেড়ে রাখা প্যান্টের পকেট ঘাঁটছে। এই কাজ আমি অনেক করতাম, আম্মা খুব অপছন্দ করতো; আব্বার পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে হাতিয়ে উলটে-পালটে নোটগুলি পরিপাটি করে গুছিয়ে, সিকি-আধুলি গুনে-গেঁথে, আম্মার পাসপোর্ট সাইজের ছবি প্লাস্টিকের খোপ থেকে বের করে তারপর আবার যেই কে সেই রেখে দিতাম। কেমন বনরুইয়ের মতন শরীর ছিল পেটমোটা চামড়ার মানিব্যাগটার। লালমোতিকে দেখলাম ব্যাগের ভিতর থেকে থাবা দিয়ে একতাড়া নোট বের করে বুকের ভিতর লুকিয়ে ফেলতে। অতটুকুই। এর চেয়ে আর বেশি কিছু না। লাল আমাকে কোলে-পিঠে করে কি মানুষ করে নাই? করেছে তো। আমাদের আপন মানুষ সে; আমারও তো ন্যায়-অন্যায় বাছার চোখ হয় নাই তখন। কিন্তু ভুল-শুদ্ধ বোঝার বুদ্ধি নিশ্চয়ই হয়েছিল। নইলে আমি কেন ওইখানে কিছুই বললাম না? কেন চুপচাপ আব্বার মাথার কাছের বেঁটে বেডসাইড টেবিল থেকে অজিফা শরিফ তুলে নিয়ে নিঃশব্দে ড্রয়িংরুমে ফিরে গেলাম? কেন হুজুর যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ ঘাড়গোঁজ হয়ে রইলাম? কেন কামরুলের সাথে আর একটা কথাও বললাম না? হুজুর চলে যাওয়ার পর সিঁড়িঘর পার হয়ে দেয়ালের ধারে পায়খানার পাইপের জোড়া ঘেঁষে যেখানে বটের কি অশ্বত্থের চারা উঠেছে, সেখানে জামাল চাচার মধ্যস্থতায় কামরুলের সাথে রক্তারক্তি রণে ভঙ্গ দিয়ে ঘরে ফিরে এসে কেন আম্মার বারংবার প্রশ্নের জবাবেও মুখ খুললাম না? “মামি, ভাইয়া বলছে, আম্মা একটা মাগি”, কামরুলের নালিশের পরেও কেন কারণ দর্শালাম না? আম্মা যখন আমার দুই কাঁধ খামচে ঝাঁকি দিয়ে বলে যাচ্ছিল, “বল, বল”, তখনও কেন চুপ করে রইলাম? দরজায় খিল দিয়ে আব্বা- আম্মার যখন বিশ্রী ঝগড়া হলো, তখনও কেন একা-একা বারান্দায় বসে রইলাম? কেন ভাবলাম, “বেশ হয়েছে!” কেন দুইবেলা লালমোতির থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকলাম? যখন ছেনালির কলঙ্ক ঘাড়ে দিয়ে ওদের বিদায় করে দেওয়া হলো, তখন কেন মুন্নির বান্ধবীদের সাথে মনোযোগ দিয়ে পুতুল খেলছিলাম আমি?

সবুজ ওর হাতভরতি পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। খাবার আনাতেও হবে না, ওর বউ তাসমিনা বাক্সভরে খিচুড়ি আর মুরগিভুনা পাঠিয়েছে। দুই লিটারের কোকের বোতল আমার হাতে দিয়ে সবুজ বলল, “এইটা ফ্রিজে রাখ। তুই তো হুজুর মানুষ, নাইলে বিয়ার আনতাম।”

“আনতি। তুই আর মিশু খাইতি!”

“আরে না। কালকে অফিস আছে না? আজকে হালাল উপায়ে পাইক্কাদের হারাব। টিভি অন কর।”

“টি-টোয়েন্টি নিয়া তোর এত মাতামাতি!”—বলতে-বলতে টিভি ছাড়লাম। বাইরে রোদ নরম হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা সাতটা মতন বাজে, গ্রীষ্মকালে সূর্য ডুবতে- ডুবতে রাত আটটা পার হয়ে যায়। একটু পরেই মিশু চলে আসবে। একবেলা একটা দুঃসহ দিন নিজের সাথে কাটানোর শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পেলাম বুঝি। ভাগ্যিস সবুজ জোরাজুরি করে নিজে থেকেই চলে এসেছে!

“যত যাই কস, সৌম্য পোলাটা কিন্তু জোস!”

“বুঝলাম, কিন্তু পাকিস্তানি লেগ-স্পিনারগুলির বোলিং দেখছস? কঠিন হবে।”

“একটু তো কঠিনই হবে। পাকিস্তান তো আর জিম্বাবুয়ে না!”

“যাই হোক। না জিতলেই কী? আমরা যে ওই মরার দেশে খেলতে গেছি, এইটাই অনেক।”

“হ। মুশফিক তো তবু যায় নাই।”

আমার মনে পড়ল, আব্বা ক্রিকেট নিয়ে কেমন উন্নাসিক ছিল; টেস্ট থেকে ওয়ান ডে-তে নামতেই নিজের রুচির সাথে কত না জানি আপস করতে হয়েছে! পাকিস্তানের খেলা খুব পছন্দ করতো আব্বা। আবদুল কাদির, জহির আব্বাস থেকে পরে ওয়াসিম আকরাম আর ইমরান খান।

দুইশ পঁচিশ-তিরিশ মতো রান করে ফেলবে মনে হইতেছে বাংলাদেশ, এই রকম ভবিষ্যদ্বাণী করে সবুজ বাথরুমে গেল।

এক ওভার পরেই ইনিংস ব্রেক। মিশু টেক্সট করেছে যে, ও আর পাঁচ মিনিট দূরে। খিচুড়ির বাক্সটা মাইক্রোওয়েভে বসালাম। তাসমিনার খিচুড়ি মিশুর খুব পছন্দ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *