সদগতি॥ প্রেমচন্দ / ননীগোপাল শূর
সদগতি – প্রেমচন্দ
এক
বাড়ির দরজায় ঝাট দিচ্ছে দুখী চামার। ওর বৌ ঝুরিয়া গোবর দিয়ে ঘর নিকোচ্ছে। দু’জনেরই কাজ সারা হলে ঝুরিয়া দুখীকে বলল, এবার তাহলে তুই গিয়ে পণ্ডিতমশাইকে বলে আয়, উনি আবার অন্য কোথাও বেরিয়ে-টেরিয়ে যান।
দুখী–হ্যাঁ যাচ্ছি, কিন্তু ভেবে দেখ তো উনি বসবেন কিসে?
ঝুরিয়া–কোথাও একটা খাঁটিয়া-ফাটিয়া পাবি না? বামুনপাড়া থেকে না-হয় একটা চেয়ে নিয়ে আসিস।
দুখী–তুই মাঝেমাঝে এমন সব কথা বলিস যে, শুনলে পিত্তি জ্বলে যায়। বামুনপাড়ার ওনারা আমাকে খাঁটিয়া দেবে কেন! একটুকুন আগুন পর্যন্ত বাড়ি থেকে দেয় না, খাঁটিয়া দেবে! কুয়োর ধারে গিয়ে এক ঘটি জল চেয়ে পাই না, আর খাঁটিয়া দেবে! এ কি আমাদের খুঁটে, কঞ্চি, ভূষা কিংবা কাঠ যে, যার যেমন খুশি নিয়ে চলে যাবে। নে, আমাদের খাঁটিয়াটাকেই ধুয়েটুয়ে রেখে দে। গরমের দিন, ঠাকুরমশাই আসতে-আসতে শুকিয়ে যাবে।
ঝুরিয়া–আমাদের খাঁটিয়াতে উনি বসবেন না। দেখিসনি কী রকম আচারে-বিচারে থাকেন।
দুখী একটু চিন্তিত হয়ে বলল, তাও তো বটে। তাহলে মহুয়াপাতা পেড়ে এনে একটা আসন বানিয়ে নিলে হয় না। মহুয়া তো বড়-বড় লোকেরা খায়। মহুয়াপাতা পবিত্তর। দে তো লাঠিটা, ক’টা পাতা পেড়ে আনি।
ঝুরিয়া–পাতা দিয়ে আসন আমি বানিয়ে রাখবখন। তুই যা। আর হ্যাঁ, ঠাকুরমশাইয়ের জন্যে তো সিধেও নিতে হবে। আমাদের থালাটাতে সিধে সাজিয়ে রেখে দেব।
দুখী–কখনো অমন সব্বনাশটি করিস না। তাহলে সিধেও যাবে, থালাখানাও ভাঙা পড়বে। একটান মেরে বাবাঠাকুর থালাখানাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। ওনার বড় তাড়াতাড়ি রাগ চেপে যায়, রাগ চাপলে বামুনমাকেও ছেড়ে কথা কন না; ছেলেটাকে তো এই সেদিন এমন ঠ্যাঙানি ঠেঙিয়েছেন যে, বেচারা আজও ভাঙা হাত নিয়ে ঘুরছে। পাতাতে করেই সিধে দিস। হ্যাঁ, দেখিস তুই কিন্তু কিছু ছুঁস না। গোঁড়ের মেয়েকে ডেকে নিয়ে সাহুর দোকান থেকে সব জিনিস নিয়ে আসিস। সিধেতে সব জিনিস যেন ঠিক থাকে। সেখানেক আটা, আধ সের চাল, পোয়াটাক ডাল, আধপো ঘি, নুন-হলুদ না দিস আর পাতার এক কোণে চার আনা পয়সাও রেখে দিস। গোঁড়ের মেয়েকে না-পেলে তুই ভুর্জিনক হাতে-পায়ে ধরে ডেকে নিয়ে যাস। দেখিস তুই কিন্তু কিছু ঘঁস না, তাহলে সব্বনাশ হয়ে যাবে।
সব কথা ভালো করে বুঝিয়ে-পড়িয়ে দুখী লাঠিটা নিয়ে ঘাসের একটা বড়সড় গাঁটরি মাথায় চাপিয়ে পণ্ডিতমশাইকে খোশামুদি করতে চলল। খালি হাতে বাবাঠাকুরের সামনে যায় কোন মুখে। আর নজরানা বলতে ঘাস ছাড়া ওর কাছে আর কিই-বা আছে। ওকে খালি হাতে দেখলে ঠাকুরমশাই তফাৎ থেকেই যে দূর-দূর করে খেদিয়ে দেবেন।
দুই
পণ্ডিত ঘাসীরাম পরম ঈশ্বরভক্ত। ঘুম থেকে উঠেই পূজার্চনা নিয়ে পড়েন। হাতমুখ ধুতে-ধুতে আটটা বাজে। তারপর শুরু হয় পুজো। পুজোর প্রথম কাজ হল ভাঙ ঘোটা। তারপর আধঘণ্টা ধরে বসে চন্দন ঘষেন, আয়নার সামনে বসে একটা কাঠি দিয়ে কপালে তিলক আঁকেন। চন্দনের দুটো রেখার মাঝখানে সিদুরের লাল ফোঁটা কাটেন। একে-একে বুকে, হাতে, গোল-গোল মুদ্রা আঁকেন চন্দনের। এরপর ঠাকুরের বিগ্রহকে স্নান করান, চন্দন দিয়ে সাজান, সামনে ফুল দেন, আরতি করেন, ঘণ্টা বাজান। দশটা নাগাদ উনি পুজো সেরে ওঠেন। ভাঙের শরবত খেয়ে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। ততক্ষণে দু’-চারজন যজমান এসে পড়ে বাড়িতে। ঠাকুরপুজোর ফল হাতে-হাতে পেয়ে যান। এই হল ওঁর পেশা।
আজ ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে এসে উনি দেখেন দুখী চামার এক গাঁটরি ঘাস নিয়ে বসে আছে। দুখী ওকে দেখেই সাষ্টাঙ্গে দণ্ডবৎ করে জোড়হাতে উঠে দাঁড়ায়। বাবাঠাকুরের তেজোময় মূর্তি দেখে দুখীর হৃদয় শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে! আহা কী দিব্য মূর্তি। ছোটখাট গোলগাল চেহারা, মসৃণ ভাল, প্রসন্ন বদন, ব্রহ্মতেজে প্রদীপ্ত নয়ন। সিঁদুরে আর চন্দনরেখায় দেখাচ্ছে যেন দেবতা!
দুখীকে দেখে শ্রীমুখে বলে ওঠেন, আজ কী মনে করে এলি রে দুখীয়া!
দুখী মাথা হেঁট করে বলে, মেয়েটার বিয়ে দিচ্ছি বাবাঠাকুর! পাঁজিপুঁথি দেখে একটা শুভলগ্ন দেখে দিতে হবে যে। কখন দয়া হবে বাবা?
ঘাসী–আজ তো সময় হবে না রে। ঠিক আছে, না-হয় সন্ধে নাগাদ যাব।
দুখী–না না, বাবাঠাকুর, একটু তাড়াতাড়ি চলুন। আমি সব কিছু ঠিকঠাক করে রেখে এসেছি। এই ঘাসটা কোথায় রাখি?
ঘাসী–এই গরুটার সামনে দিয়ে দে ওটা। আর ঝাড়গাছা নিয়ে বাড়ির দরজাটা একটু ঝটপাট দিয়ে পরিষ্কার করে দে তো। বৈঠকখানাটাও আজ ক’দিন ধরে লেপা-পোঁচা হয়নি। ওটাকে একটু গোবর দিয়ে লেপে দে। আমি ততক্ষণে সেবাটেবা সেরে নিই। তারপর একটুখানি বিশ্রাম নিয়ে যাব। হ্যাঁ, এই কাঠটাকেও একটু চিরে দিস তো। আর শোন, খামারে ঝুড়ি চারেক ভূষি পড়ে আছে, ওগুলোকে নিয়ে এসে ভূষি রাখার ঘরটায় রেখে দিস, কেমন।
দুখী সঙ্গে-সঙ্গে হুকুম তামিল করতে শুরু করে দিল। দরজায় ঝাড় দিল, বৈঠকখানাকে নিকিয়ে দিল গোবর দিয়ে। এসব কাজ সারতে-সারতে বেলা বারোটা বেজে গেল। পণ্ডিতমশাই খেতে যান। দুখী সকাল থেকে কিছু খায়নি। জোর খিদে পেয়েছে ওরও; কিন্তু এখানে কে ওকে খেতে বলেন। বাড়ি এখান থেকে মাইলখানেক দূরে। বাড়ি খেতে গেলে পণ্ডিতমশাই যদি রাগ করেন। বেচারা খিদে চেপে কাঠ চিরতে শুরু করল। মোটা মতন একটা গাঁট, এর ওপর এর আগে কত-না শিষ্য তাদের শক্তি পরীক্ষা করছে। দুখীও একই শক্তি আর দৃঢ়তার সঙ্গে এই কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হল। দুখীর কাজ ঘাস কেটে বাজারে নিয়ে গিয়ে বেচা। কাঠ চোরার অভ্যাস আদৌ নেই তার। ঘাস ওর খুরপির সামনে মাথা নোয়ায়। দুখী ঠিকরে যায়। ঘেমে নেমে ওঠে দুখী, হাঁপাতে থাকে, অবসন্ন হয়ে বসে পড়ে, আবার উঠে দাঁড়ায়। হাত ওঠাতে গিয়ে ওঠাতে পারে না। পা দুটো কাঁপে, কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। চোখে আঁধার ঘনিয়ে আসে, মাথা ঝিমঝিম করে! তবুও সে কাজ করে চলে। ভাবে, এক ছিলিম তামাক যদি টানতে পেতাম হয়তো একটু তাগদ পেতাম। কিন্তু কলকে তামাক এখানে পাব কোথায়? বামুনদের পাড়া। বামুনরা তো আর। আমাদের নিচু জাতের মতন তামাক খায় না। হঠাৎ খেয়াল হয় এ-গাঁয়ে তো এক ঘর গোড়ও আছে। ওর কাছে গেলে ঠিকই কল্কে-তামাক পাওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে দুখী ছোটে ওর বাড়ি। যাক্, পরিশ্রম সার্থক হয় সে তামাক দেয়। কিন্তু আগুন পাওয়া গেল না সেখানে। দুখী বলে, আগুনের জন্য ভেব-না ভাই! আমি যাচ্ছি, পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়ি থেকে চেয়ে নেব। ওঁর বাড়িতে তো এই একটু আগেও রান্না হচ্ছিল।
এই বলে জিনিস দুটো নিয়ে দুখী চলে আসে। পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়ির দেউড়িতে দাঁড়িয়ে ডাকে, বাবাঠাকুর, একটুন আগুন যদি পেতাম এক ছিলিম তামাক টেনে নিতাম।
পণ্ডিতমশাই খেতে বসেছিল। বামুনগিন্নী জিজ্ঞেস করেন, আগুন চাইছে কে এটা?
পণ্ডিত–আরে ওই শালা দুখিয়া চামার। ওকে বলেছি কাঠটাকে একটু চিরে দিতে। আগুন তো রয়েছে, দাও-না একটু।
বামুনগিন্নী ভুরু কুঁচকে বলে ওঠেন, পুঁথিপত্তরের ফেরে পড়ে ধরম-করম সব কিছুর তো মাথা খেয়ে বসে আছ। চামার হোক, ধোপা হোক, নাপিত হোক, মাথা উঁচু করে একেবারে ভেতরবাড়িতে চলে আসবে! এ যেন হিন্দুর বাড়ি নয়, একটা সরাইখানা। বলে দাও পোড়ারমুখোকে চলে যেতে, না হলে এই পোড়াকাঠ দিয়ে মুখ পুড়িয়ে দেব। আগুন চাইতে এসেছে!
পণ্ডিতমশাই বুঝিয়ে বলেন, ভেতরে চলে এসেছে তো কী হয়েছে? তোমার তো। কোনো কিছু ছোঁয়নি। মাটি হল পবিত্র। একটুখানি আগুন দিয়ে দিচ্ছ-না কেন? কাজটা। তো আমাদেরই করছে। কোনো মজুর লাগিয়ে এই কাঠ চেলাতে গেলে কম করে চার আনা পয়সা তো নিত।
বামুনগিন্নি মুখঝামটা দিয়ে বলেন, ওটা বাড়িতে ঢুকেছে কেন?
হার মেনে বলেন পণ্ডিতমশাই-শালার কপাল খারাপ, এছাড়া আর কী?
বামুনগিন্নী–বেশ, এবারের মতো আগুন দিয়ে দিচ্ছি; কিন্তু আবার যদি এভাবে কোনো ব্যাটা বাড়িতে ঢোকে তো তার মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব।
সব কথাই কানে আসে দুখীর। মনে-মনে পস্তাচ্ছে–কেন যে শুধু-শুধু এলাম। সত্যি কথাই তো। বামুনপণ্ডিতের বাড়ির ভেতরে চামার ঢোকে কী করে! বড় পবিত্তর এনারা, তাই তো দুনিয়ার সবাই এত খাতির করে, তাই তো এত মান্যিগন্যি। মুচি-চামার তো নয়। এই গাঁয়েই বুড়ো হলাম। আর এ আক্কেলটুকুন হল-না আমার। তাই বামুনগিন্নী আগুন নিয়ে বেরুলে দুখী যেন হাতে স্বর্গ পায়। জোড় হাত করে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বলে, মা-ঠাকরুণ, বড় ভুল হয়ে গেছে গো। বাড়ির ভেতরে চলে এসেছি। চামারের বুদ্ধি তো মা! এতটা মুখ্যসুখ্য যদি নাই হব, তাহলে লাথিঝেটা খাব কেন?
বামুনগিন্নী চিমটেয় ধরে আগুন এনেছেন। হাতপাঁচেক দূরে দাঁড়িয়ে ঘোমটার আড়াল থেকে আগুনটাকে দুখীর দিকে ছুঁড়ে দিলেন। বড় একটা আগুনের টুকরো এসে দুখীর মাথায় পড়ল। তাড়াতাড়ি পিছু হটে সে মাথা ঝাঁকাল। তার মন বলে উঠল, এ হল গে পবিত্তর বামুনের বাড়িকে অপবিত্তর করার সাজা। ভগবান হাতে-হাতে সাজা দিয়ে দিয়েছেন। এজন্যেই তো সারা দুনিয়া বামুনদের এত ভয় করে। অন্যসব লোকের টাকা-পয়সা মার যায়। কই বামুনদের পয়সা মেরে নিক তো কেউ। গুষ্টিসুষ্ঠু সবার সব্বনাশ হয়ে যাবে না, পা পচে-পড়ে খসে পড়বে-না!
বাইরে এসে সে তামাক খায়, তারপর আবার কুড়ল নিয়ে কাজে লেগে পড়ে। খটাখট আওয়াজ আসতে থাকে।
ওর গায়ে আগুন পড়েছে, তাই বামুনঠাকরুনের একটু মায়া হয় দুখীর ওপর। পণ্ডিতমশাই খেয়ে উঠলে বলেন, চামারটাকে একটু কিছু খেতেটেতে দাও, বেচারা সেই কখন থেকে কাজ করছে, খিদে থাকতেই পারে।
পণ্ডিতমশাই এই প্রস্তাবটার বাস্তব দিকটা উপলব্ধি করে জিজ্ঞেস করেন, রুটি আছে?
পণ্ডিতগিন্নী–দু’চারখানা হয়তো বেঁচে যাবে।
পণ্ডিত দু’চারখানা রুটিতে কী হবে? ব্যাটা চামার, কম করে সেরখানেক তো গিলবে।
পণ্ডিতগিন্নী কানে হাত দিয়ে বলেন, ওরে বাপ রে! সেরখানেক! তাহলে থাকগে।
পণ্ডিতমশাই এবার উল্টো চাপ দেন, বলেন–কিছু ভুষি-টুষি থাকলে আটার সঙ্গে মিশিয়ে দু’খানা মোটা চাপাটি সেঁকে দাও না, শালার পেট ভরে যাবে। ওই পাতলা-পাতলা রুটিতে এসব ছোটলোকের পেট ভরে না। এদের তো জোয়ারের মোটা চাপাটি চাই।
পণ্ডিতগিন্নী বলেন, ছাড়ো তো, এই দুপুর-রোদে কে মরতে যাবে ওসব করে।
তিন
দুখী তামাক খেয়ে আবার কুড়ল নেয়। দম নিয়ে হাতে একটু জোর পায়। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে একনাগাড়ে কুড়ল চালিয়ে যায়। তারপর অবসন্ন হয়ে সেখানে মাথাটা চেপে ধরে বসে পড়ে।
এর মধ্যে গোঁড় এসে পড়ে। বলে–কেন জানটা খোয়াচ্ছ বুড়োদাদা। কোপানিতে এই গাঁট ফাটবে না। শুধু-শুধু হয়রান হচ্ছ।
কপালের ঘাম মুছে দুখী বলে–এখনো একগাড়ি ভুষি বয়ে আনতে হবে রে ভাই।
গোঁড়–খেতে-টেতে কিছু দিয়েছে, না শুধু কাজই করিয়ে চলেছে। গিয়ে চেয়েটেয়ে কিছু নিচ্ছ-না কেন?
দুখী–বলছ কী চিখুরী! বামুনের অন্ন কি আমাদের পেটে হজম হবে?
গোঁড়া–হজম ঠিকই হবে, আগে পাও তো। গোঁফে তা দিয়ে তো ঠিকই খেয়ে নিয়ে তোমাকে কাঠ চেরার হুকুম দিয়ে আরাম করে ঘুমুচ্ছে, জমিদারও তো কিছু না-কিছু খেতে দেন। হাকিমও বেগার খাটালে কিছু না-কিছু মজুরি দেন। ইনি ওঁদেরও ছাড়িয়ে গেছেন। নিজেকে ধাম্মিক বলে জাহির করছেন।
দুখী–আস্তে-আস্তে বল্রে ভাই, শুনে-টুনে ফেললে বিপদ হবে। বলে দুখী আবার কুড়ল চালাতে লাগল। দুখীকে দেখে চিখুরীর দয়া হল। এগিয়ে এসে ওর হাত থেকে কুড়লখানাকে কেড়ে নিয়ে একনাগাড়ে আধঘণ্টা খুব জোরে-জোরে কুড়ল চালাল; কিন্তু গাঁটে একটুখানি ফাটও ধরল না। কুড়লটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে বলতে চাইলে–এ ঘাট চেরা তোমার কম্ম না, জান গেলেও পারবে না।
দুখী ভাবে–বাবাঠাকুর এই গাটটা পেলেন কোথায়, যাকে এত কুপিয়েও চেরা যাচ্ছে না। কোথাও একটুখানি চিড় পর্যন্ত খাচ্ছে না। আমি কতক্ষণ ধরে কোপাব এটাকে? ওদিকে বাড়িতে এখনও শতেক কাজ পড়ে রয়েছে। কাজকম্মের বাড়ি, একটা-না-একটা কাজ তো লেগেই আছে। কিন্তু এতে কার কী মাথাব্যথা! যাই ততক্ষণে না-হয় ভুষিগুলোই নিয়ে আসি। বলব, বাবাঠাকুর, আজ তো কাঠ চিরতে পারলাম না, কাল এসে না-হয় চিরে দেব।
ঝুড়ি মাথায় করে দুখী ভুষি বয়ে আনল। বাড়ি থেকে খামার দুফার্লংয়ের কম নয়। খুব চাপাচাপি করে ঝুড়ি যদি ভরে আনতে পারত তাহলে কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেত বটে, কিন্তু মাথায় তুলে দেবে কে ঝুড়ি। পুরোপুরি ঠাসা ঝুড়িটাকে একা মাথায় তুলতে পারে না। তাই অল্প-অল্প করেই আনে। চারটে নাগাদ ভুষি আনা তার শেষ হয়। পণ্ডিতমশাইয়েরও ঘুম ভাঙে। মুখ-হাত ধুয়ে, পান খেয়ে বাইরে আসেন। দেখেন ঝুড়ির ওপর মাথা রেখে দুখী ঘুমুচ্ছে। জোরে হাঁক দেন–ওরে ও দুখিয়া! বলি, ঘুমুচ্ছিস? কাঠ তো এখনো যেমনকার ঠিক তেমনি পড়ে রয়েছে। এতক্ষণ তুই করছিলি কী? একমুঠো ভূযো আনতেই দিন কাবার করে ফেললি। তার ওপর আবার পড়ে-পড়ে ঘুমুচ্ছিস? নে নে, তোল কুড়ল। কাঠটা চিরে দে! তোকে দিয়ে একটুখানি কাঠ চেরানোও যায় না। লগনও তাহলে তেমনি হবে বুঝলি, আমাকে কিন্তু তখন দুষতে পারবি না। সাধে বলে, ছোট জাতের ঘরে খাবার জুটল তো ব্যস ওদের মতিও পালটে গেল।
দুখী আবার কুড়ল হাতে নিল। যেকথা বলবে বলে ভেবে রেখেছিল, সেসব ভুলে গেল। পেট পিঠে লেগে গেছে। সেই সকাল থেকে জলটুকু পর্যন্ত খায়নি। সময়ই পায়নি। উঠে দাঁড়াতেই কষ্ট হচ্ছে। দেহ বসে যাচ্ছে। তবু মনটাকে শক্ত করে উঠে দাঁড়াল সে। পণ্ডিতমশাই শুভ সময়টা ঠিকমতো যদি না-দেখে দেন, তাহলে হয়তো সব্বনাশ হয়ে যাবে। এজন্যেই তো সংসারে তার এত খাতির, এত মান। শুভ মুহূর্তেরই তো সব খেলা। যাকে ইচ্ছে শেষ করে ফেলতে পারলে ইনি। পণ্ডিতমশাই কাঠটার কাছে এসে দাঁড়ান, আর উৎসাহ দিয়ে যান–মার কষে, আবার মার-কষে মার কী রে, মার। না রে জোরে–তোর হাতে তো যেন জোরই নেই–লাগা কষে, দাঁড়িয়ে ভাবছিস কী! হা হা, ব্যস্ এই তো ফাটল বলে! দে দে, ওই ফাটলতাতেই আবার দে।
দুখীর হুঁশ থাকে না! না-জানি কী এক গুপ্তশক্তি ওর বাহু দুটিতে ভর করেছে। ক্লান্তি, অবসাদ, ক্ষুধা সবই যেন উবে যায়। নিজের বাহুবলে নিজেই অবাক। এক-একটি আঘাত পড়ছে যেন বজ্রের মতো। আধঘণ্টা ধরে উন্মাদের মতো সে কুড়ল চালিয়ে যায়। শেষে কাঠখানাও মাঝখান দিয়ে ফেটে যায়। সেই সঙ্গে দুখীর হাত থেকে কুড়লটাও ছিটকে পড়ে। মাথা ঘুরে পড়ে যায় দুখী। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় ক্লান্ত অবসন্ন শরীর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
পণ্ডিতমশাই ডাকেন–নে রে, উঠে দু’চার কোপ আরও দিয়ে দে। পাতলা-পাতলা চ্যালা করে দে। দুখী ওঠে না। পণ্ডিতমশাইও ওকে আর এখন বিরক্ত করা উচিত মনে করেন না। ভেতরে গিয়ে ভাঙের শরবত খান, শৌচকর্ম সারেন, স্নান করেন, তারপর পণ্ডিতমশাইয়ের পোশাকে সেজেগুজে বাইরে আসেন। দেখেন দুখী তখনো একইভাবে পড়ে রয়েছে। পণ্ডিতমশাই জোরে ডাক দেন–অ্যাই দুখী, তুই কি শুয়েই থাকবি রে, চল তোর বাড়িতেই যাচ্ছি। সব জিনিসটিনিস ঠিকঠাক জোগাড় করে রেখেছিস তো? দুঃখী কিন্তু তবু ওঠে না।
এবার পণ্ডিতমশাইয়ের মনে ভয় হয়। কাছে গিয়ে দেখেন, দুখী টানটান হয়ে পড়ে আছে। ভড়কে গিয়ে ভেতরে ছোটেন, গিয়ে বামুনগিন্নীকে বলেন, দুখিয়াটা মনে হচ্ছে মরে গেছে।
পণ্ডিতগিন্নী হকচকিয়ে বলেন–তো! এক্ষুণি তো কাঠ চিরছিল!
পণ্ডিত–হ্যাঁ, কাঠ চিরতে-চিরতে মরে গেছে। সর্বনাশ হয়েছে, এখন কী হবে?
পণ্ডিতগিন্নী ঠাণ্ডা গলায় বলেন–কী আবার হবে, চামারবস্তিতে খবর পাঠিয়ে দাও মড়া তুলে নিয়ে যাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে সারা গায়ে খবর রটে যায়। বামুনদেরই ঘর সব। কেবল এক ঘর গোঁড়। ওদিকের রাস্তা দিয়ে হাঁটা সবাই ছেড়ে দেয়। কুয়োতে যাবার রাস্তা ওদিক দিয়েই, জল আনবে কী করে! চামারের মড়ার পাশ দিয়ে জল আনতে যাবে কে? এক বুড়ি গিয়ে পণ্ডিতমশাইকে বলে, এখনো মড়াটা ফেলাচ্ছ না যে। গায়ে কেউ জলটল খাবে-না নাকি!
এদিকে চিখুরী চামারবস্তিতে গিয়ে সবাইকে সাবধান করে দিয়ে আসে–খবরদার, মড়া আনতে কেউ যাবি না। এক্ষুনি পুলিশ আসবে, তদন্ত হবে। মজা পেয়েছ নাকি যে একটি গরিব বেচারাকে এভাবে পরানে মেরে ফেলবে। পণ্ডিতই হন আর যেই হন, সে তো নিজের কাছে। লাশ যদি তোরা আনিস তবে পুলিশ তোদেরও বেঁধে নিয়ে যাবে।
তার কথার পর-পরই পণ্ডিতমশাই গিয়ে পৌঁছান। কিন্তু চামারবস্তির কোনও লোক লাশ তুলে আনতে রাজি হয় না। শুধু দুখীর বউটা আর মেয়েটা হাহাকার করতে-করতে ছুটে যায়। পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়ির দরজায় গিয়ে ওরা কপাল চাপড়ে-চাপড়ে ডুকরে কাঁদতে থাকে। ওদের সঙ্গে আরও পাঁচ-দশটা চামার মেয়েছেলে–কেউ কাঁদছে, কেউ-বা ওদের সান্ত্বনা দিচ্ছে। চামার বেটাছেলে নেই কেউ। পণ্ডিতমশাই চামারদের ওপরে খুব চোটপাট করেন, বোঝান, কাকুতি-মিনতি করেন, কিন্তু চামারদের সবার মনে পুলিশের ভয় এতটা ছড়িয়ে পড়েছে যে, একজনও রাজি হয় না। শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে উনি ফিরে আসেন।
চার
মাঝরাত পর্যন্ত কান্নাকাটি চলে। ব্রাহ্মণ দেবতাদের পক্ষে ঘুমোনো মুশকিল হয়ে পড়ে। লাশ নিয়ে যেতে কোনও চামারই আসে না। এদিকে বামুনরাই-বা চামারের মড়া ছোঁবে কী করে। এমন কথাও কি কোনো শাস্ত্ৰ-পুরাণে লেখা আছে? কই, দেখিয়ে দিক তো কেউ!
পণ্ডিতগিন্নী গজর-গজর করেন–এই ডাইনিগুলো তো মাথা খেয়ে ফেললে। এগুলোর গলাও ব্যথা করে না!
পণ্ডিতমশাই বলেন–কাঁদুক পেত্নীগুলো, কতক্ষণ কাঁদবে? যদ্দিন বেঁচে ছিল, কেউ একবার পৌঁছেও নি। মরে গেছে, এখন চিল্লাচিল্লি করতে সবক’টা এসে জুটেছে।
পণ্ডিতগিন্নী–চামারের কান্না অলক্ষুণে নাকি গো?
পণ্ডিত–হ্যাঁ, বড্ড অমঙ্গলের।
পণ্ডিতগিন্নী–এখন থেকেই গন্ধ বেরুচ্ছে।
পণ্ডিত–চামার তো। খাদ্যাখাদ্যের কি কোনও বাছবিচার আছে ওগুলোর?
পণ্ডিতগিন্নী–ওগুলোর ঘেন্নাও করে না।
পণ্ডিত–সবকটা ভ্রষ্ট।
.
রাত তো কাটল কোনও মতে, কিন্তু সকালেও কোনও চামার এল না। চামার মেয়েছেলেরাও কেঁদেকেটে চলে গেছে। একটু-একটু করে ছড়াতে শুরু করেছে দুর্গন্ধ। পণ্ডিতমশাই একগাছি দড়ি নিয়ে আসেন। দড়ির ফাঁস বানিয়ে মড়ার পায়ে ছুঁড়ে দেন। তারপর টান মেরে কষে নেন ফাসটা। আবছা-আবছা অন্ধকার। পণ্ডিতমশাই দড়ি ধরে লাশটাকে টানতে শুরু করেন। টানতে-টানতে গাঁয়ের বাইরে টেনে নিয়ে যান। সেখান থেকে ফিরে এসে স্নান করে নেন চটপট, চণ্ডীপাঠ করেন। তারপর সারা বাড়িতে গঙ্গা জল ছিটিয়ে দেন।
ওদিকে দুখীর লাশটাকে শেয়াল, শকুন, কুকুর আর কাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। তার আজীবন ভক্তি, সেবা আর ধর্মনিষ্ঠার পুরস্কার!