সত্য-ক্রেতা-দ্বাপর
সুইটজারল্যান্ডের রামগাড়ল হার পডি নাকি একদা একটা দাঁড়কাক পুষেছিল।
বন্ধু শুধাল, এ কী ব্যাপার! কাগ আবার কেউ পোষে নাকি? বৈজ্ঞানিকসুলভ অর্ধমুদ্রিতনয়নে পডি বলল, ওই যে লোকে বলে দাঁড়কাক একশো বছর বাঁচে, সেটা ঠিক কি না আমি হাতে-নাতে নিজে দেখে নিতে চাই।
মুচকি হাসন, আপত্তি নেই। কিন্তু আমি নিজেই পলডির মতোই বটি।
চিন্তা করুন তো এই যে ইহুদি জাত বিস্তর ঘোরাঘুরি করে, হাজার দুই বছর ধরে এ-জাত, ও-জাত, সে-জাতের কাছে মার খেতে খেতে গোলামি করে করে প্রথম আপন রাজ্য গড়ে তোলার সুযোগ পেল খ্রিস্টজন্মের হাজারখানেক বছর পূর্বে, রাজা সুলেমানের আমলে। কিন্তু হায়, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তার সেই গরি খানখান হয়ে যেতে লাগল। কিন্তু তিনি ইহুদিদের সদাপ্রভু য়াহভের জন্য যে বিরাট মন্দির গড়েছিলেন তার স্মৃতি ইহুদিরা আজও প্রতি শনির স্যাবাৎ পরবে স্মরণ করে।(১)
তার পর খেল মার ফের ঝাড়া একটি হাজার বছর ধরে। আর বাবিলনের রাজা তো একবার প্রায় গোটা গোষ্ঠীটাকে ধরে নিয়ে গোলাম বানিয়ে রেখে দিলেন আপন দেশে। দু পুরুষ সেখানে কাটিয়ে কোনওগতিকে প্রাণ নিয়ে তারা ফিরল ফের প্যালেস্টাইনে।
সুলেমানের হাজার বছর পর ফের তারা পেল আরেকটা চান। প্রভু যিশুর জন্মের কয়েক বছর পূর্বে, রাজা হেরডের আমলে (এরই পুত্রের সামনে বিচারের জন্যে প্রভু যিশুকে পাঠানো হয়, আবার জেরুস্লম তথা ইহুদি জাতের মুখে হাসি ফুটল। ধনদৌলত তো বাড়লই, তদুপরি সুসভ্য বাবিলনে তারা যেসব জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হয় তারই কাঠামোতে ফেলে আপন প্রাচীন শাস্ত্রাদির নতুন নতুন টীকাটিপ্পনী রচনা করল। হেরড আবার নতুন করে আত্মভের মন্দির গড়লেন।
কিন্তু এবারে যে দুর্দৈব এল, তার সঙ্গে পূর্বকার কোনও অভিজ্ঞতারই তুলনা হয় না।
খ্রিস্টজন্মের ৭০ বছর পর রোমানরা জেরুস্লম আক্রমণ করে শহর এবং দুর্গ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে য়াহভের মন্দির পুড়িয়ে ছাই করে দিল; এক ইহুদি ঐতিহাসিকের ভাষায় : Amid circumstances of unparalelled horror, Jerusalem fell. The temple was burnt and the Jewish State was no more.
এই কি শেষ? হ্যাঁ, কিন্তু ইহুদি রাষ্ট্র লোপ পাওয়া সত্ত্বেও ইহুদিরা জেরুস্লম নগরে বসবাস করতে লাগল। ওদিকে তাদের ওপর রোম সম্রাটের কুশাসন ক্রমে ক্রমে এমনই বেড়ে যেতে লাগল যে, শেষটায় ১৩২ খ্রিস্টাব্দে তারা রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল– অবশ্য স্মরণ রাখা কর্তব্য, ইহুদিদের অনেকেই এরকম বছরের পর বছর ধরে বিদ্রোহী মনোভাব পোষণ করতে মানা করেছিলেন। আমরা জানি স্বয়ং খ্রিস্ট রোমানদের বিপক্ষে বিদ্রোহ ঘোষণা করার পক্ষপাতী ছিলেন না।
এবারে রোমানরা যা করল তার সঙ্গে ৭০ খ্রিস্টাব্দের মন্দির পোড়ানোরও তুলনা হয় না। হারিয়ানের আদেশে সমস্ত শহর পুড়িয়ে খাক করে দিয়ে তার উপর হাল চালানো হল। খুব সম্ভব হারিয়ানের উদ্দেশ্য ছিল, রাজা দায়ূদের গোর, সুলেমানের মন্দির এমনই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, যাতে করে পরবর্তী যুগে ইহুদিরা সেগুলো খুঁজে বের করে সমাধিসৌধ এবং নতুন মন্দির গড়ে তাদেরই চতুর্দিকে নবীন বিদ্রোহ, নবীন রাষ্ট্রের সূত্রপাত না করে।
এবং তার চেয়েও মারাত্মক হুকুম জারি হল : ইহুদি মাত্রেরই হারিয়ান নির্মিত নবীন জেরুসলমে প্রবেশ নিষেধ। অর্থাৎ রোমান, খ্রিস্টান, আরব, গ্রিক ও অন্যান্য নানা সম্প্রদায় নানা সেমিতি তথা মিশরীয়রা সেখানে স্বচ্ছন্দে বসবাস করতে পারবে কিন্তু য়াহভের উপাসকরা সেখানে প্রবেশাধিকারও পাবে না।
এর পরই ইহুদিরা ব্যাপকভাবে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ল।
আজ ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ। জেরুসলমের উপর হারিয়ান হাল চালান ১৩২ খ্রিস্টাব্দে, হেরডের মন্দির ধ্বংস হয় ৭০ খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ আজ ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে বিজয়ী বীররূপে যে ইহুদিরা জেরুসূলমে প্রবেশ করল সেটা যথাক্রমে আঠারো বা উনিশশো বছর পর। কিন্তু এই তৃতীয় পর্যায়ের কথা পরে হবে।
প্রথম পর্যায়ে রাজা সুলেমান যে ইহুদি-প্রাণাভিরাম মন্দির নির্মাণ করেছিলেন সেটা সম্ভব হয়েছিল প্রতিবেশী ফিনিশীয় রাজা টায়ার (বর্তমান লেবানন অঞ্চল) অধিপতি রাজা হিরমের সাহায্যে। বস্তুত রাজা সুলেমান স্বাধীন হলেও তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হিরমকে তিনি অনেক প্রকারে সেবা করে সে সাহায্য পান। এচ. জি. ওয়েলস তো তার ইতিহাসে তাচ্ছিল্যভরে বলছেন, There is much in all this (অর্থাৎ সুলেমানের সেবা) to remind the reader of the relations of some Central African chief to a European trading concern.
অর্থাৎ অর্ধ বর্বর নিগ্রো চিফ যেরকম শক্তিশালী ইয়োরোপীয়কে কাঁচামাল সস্তা লেবার যুগিয়ে সভ্য জগতের এটা-সেটা পায়, সুলেমানের বেলাও তাই। এবং তার পরই বলছেন, এবং বাইবেল পড়লেই দেখা যায়, সুলেমানের রাজ্য was a pawn between (হিরমের) Phoenicia and Egypt. এবং বাইবেলেই আছে সুলেমান তার রাজ্যের উত্তরার্ধ হিরমকে দিয়ে দেন বা দিতে বাধ্য হন।(২)
পূর্বেই বলেছি, এর হাজার বছর পর দ্বিতীয় চা পান রাজা হেরড দ্য গ্রেট।
ইনি আবার সংস্কার করে গড়ে তুললেন নব জেরুস্লম। সুদৃঢ় নগরপ্রাচীর, বিরাট রাজপ্রাসাদ, নানা অট্টালিকা এবং সবচেয়ে বড় কথা– সুলেমানের মন্দির নব মহিমামণ্ডিত করে গড়ে তুললেন। এছাড়া প্যালেস্টাইনের সর্বত্র প্রাচীন নগরী সংস্কার ও বহু নতুন নগর স্থাপন করলেন। বস্তুত ইহুদিদের এ যুগকে দ্বিতীয় সত্যযুগ বলা যেতে পারে।
কিন্তু রাজা হেরড ছিলেন সুলেমানের চেয়ে পরমুখাপেক্ষী। তিনি ছিলেন রোম সম্রাটের অধীনে পরাধীন রাজা। মিশররানি ক্লেওপাতরা-বল্লভ-রোমশাসক অ্যানটনির কৃপায় তিনি রাজা উপাধি পান ও তাকে রোম সাম্রাজ্যের ক্লান্ট প্রিন্স হিসেবে প্যালেস্টাইন শাসন করতে হত। অ্যানটনির আত্মহত্যার পর তিনি পান রোম রাষ্ট্রপ্রধান কার্যত সিজার) অক্টাভিয়ানের পৃষ্ঠপোষকতা।
অতএব দেখা যাচ্ছে, প্রথম দফায় সুলেমান তাঁর গ্লরি গড়লেন ফিনিশীয় রাজা হিরমের সহায়তায়; তার এক হাজার বছর পর দ্বিতীয় দফেতে রাজা হেরড ইহুদিকুলের গৌরব বৈভব পূর্ণ করে তুললেন রোম-শাসকের সাহায্যে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, সেটাও বিনষ্ট হল ৭০ বছরের ভিতর ও তার পর কেটে গেল আরও দু হাজার বছর। এবারে তৃতীয় দফাতে, ১৯৬৭-এর জুন মাসে ইহুদি প্রবেশ করল বিজয়ী বীরের বেশে প্রাচীন জেরুসলমফ নগরে। পুরোভাগে জঙ্গিলাট দায়ান। বিশ্ব ইহুদি উচ্চকণ্ঠে জয়ধ্বনি করে উঠল, ইনিই মাশিয়হ। –মিসায়া (Meesiah), খ্রিস্টানের যিশু (খ্রিস্ট শব্দের অর্থেও মিসায়া) মুলমানের মসীহ = মাহুদি, হিন্দুর কল্কি।
এবারে তৃতীয় দফাতে এ-মাশিয়হ এ-কল্কির পিছনে কে?
আনকল স্যাম– জনসন!
***
কিন্তু এবারেও যদি ইহুদিরা ফেল মারে তবে আগের এক হাজার, তার পর দু হাজার সেই হিসেবে ফোর্থ চান্স পাবে চার হাজার বছর পরে।
লেখনারম্ভের পডি হয়তো-বা দেড়শো বছর পরমায়ু পেয়ে দাঁড়কাক একশো বছর বাঁচে কি না পরখ করে যেতে পারবে, কিন্তু ইওরস অবিডিয়াটলি এ অধম তো চার হাজার বছর বাঁচবে না! আল্লাকে অসংখ্য ধন্যবান। আমেন।
————
১. তিন হাজার বছর ধরে ইহুদিরা এই মন্দিরের গুণকীর্তন করে করে তার পরিধি ও ঐশ্বর্য এমনই বাড়িয়েছে যে, বাস্তবের সঙ্গে আজ আর তার কোনও মিলই নেই। বাইবেল অনুযায়ীই দেখা যাচ্ছে, মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ২০০ ফুট, প্রস্থ ৭০-এর একটু বেশি (বাইবেল, কিংজ ১; অধ্যায়)! এ যেন সেই লোক মরে লক্ষ লক্ষ কাতারে কাতার! শুনিয়া দেখিনু শেষে আড়াই হাজার ॥
২. বাইবেল, কিংজ ১: ২১। উত্তর গ্যালিলির এই অঞ্চলেই ইজরায়েল-সিরিয়ার হালে সংঘর্ষ হয়। অনুর্বর প্রস্তরময় এই ভূমি কিন্তু বড় ঐতিহাসিক মূল্য ধরে। গ্যালিলি হ্রদের এই উত্তর তীরে যিশু তার প্রথম ও প্রধান প্রচারকার্য আরম্ভ করে টিলার উপরে বসে সারমন অব দ্য মাউনট (ধন্য যাহারা আত্মাতে দীন-হীন, কারণ স্বর্গরাজ্য তাহাদেরই) উপদেশ দেন। এখানেই তিনি সাতখানি রুটি ও ছোট্ট কয়েকটি মাছ দিয়ে চার হাজার লোককে খাওয়ান। এরই কাছে মগদলা গ্রাম, যেখান থেকে নর্তকী, পরে তাপসি মেরি মগডলিন (অস্ফরডের মডলিন কলেজ। maudlin tears; কেনৃবৃরিজের মডলিন বানানে পিছনে e অক্ষর আছে) যিশুর কাছে আসেন…পাঠক যদি অপরাধ না নেন তবে বলি, এখানেই আমি সর্বপ্রথম গ্যালিলির হ্রদের মাছ খাই। তার অপূর্ব স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে এ অঞ্চল সম্বন্ধে সবিস্তর লেখার বাসনা আছে।