সত্যি-ভূত মিথ্যে-ভূত
অবিনাশ সামন্ত যেদিন ভূত হল, সেদিনই তার থাকার জায়গা হল দেউলপোতা গ্রামের নাগেশ্বর ফুলগাছের মগডালে। আঙুল তুলে তার জায়গাটা ঠিক করে দিল মোড়ল-ভূত। ভূত হওয়ার পর-পরই অবিনাশের মনে হয়েছিল, এবার সে কোথায় থাকবে? তারপর নিজের কাছ থেকেই উত্তরটা পেয়েছিল, মানুষ জন্মালে যেমন পৃথিবীতে তার জায়গা হয়ে যায়, মানুষ মারা গেলেও তেমনি তক্ষুনি তার জায়গা হয়ে যায় ভূত-রাজ্যে।
তাই মারা যাওয়ার পর চার-পাঁচটা দিন অবিনাশ বসে থাকল নিশ্চিন্ত মনে তাদের বাড়ির কানাচের নিম গাছটার মাথায়। ইচ্ছে করলে সে সোজা চলে যেতে পারত ভূত-রাজ্যে। গিয়ে মোড়ল-ভূতকে আঙুল তুলে বলতে পারত, ‘ভূত-রাজ্যে থাকার অধিকার আমার হকের, মোড়লমশাই। এখনই আমি দেউলপোতার নাগেশ্বর ফুলগাছের মগডালে থাকতে চাই!’ কিন্তু সে থেকে গেল শুধুমাত্র একটাই কারণে। মৃত্যুর পর তার জন্যে বাড়ির কে কেমনভাবে কাঁদে, তা দেখার জন্যে।
দিন ছয়েক কাটার পর, যেমন করে ফুলে মধু সঞ্চার হয়, যেমন করে ধানের ভিতর ক্ষীর জমতে শুরু করে, অমন করে তার মনের মধ্যে ব্যথার সঞ্চার হতে শুরু করল। সে দেখল তার স্ত্রী কান্নার কথা ভুলে পাড়াময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে, কেমন করে শ্রাদ্ধ-শান্তিটা ভালোভাবে সম্পন্ন করা যায়। বড়োছেলে আত্মীয়-কুটুম্বের বাড়িতে অবিনাশের মৃত্যুসংবাদ আর শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে রোজদিনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সকাল সকাল। রেস্টুরেন্টে চিলি চিকেন-বিরিয়ানি সাঁটিয়ে বাড়ি ফিরে দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলছে, ‘মা, মনটা ভালো লাগছে না গো। আজ আর কিছু খাব না।’
ছোটোছেলে ব্যাঙ্কের হিসেবপত্র নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কোথায় বাবার টাকা কার নামে আছে, সব খতিয়ে দেখছে অফিস কামাই করে। বাবা কবে মারা গিয়েছে, মনে করে ঠিকমতো বলতেই পারছে না। পুরুতমশাই এসেছিলেন কাল সকালে শ্রাদ্ধের ফর্দ দিতে। ছোটোছেলে খানিকটা বিরক্তি দেখিয়ে বলল, ‘এখন তিন দিনও হয়নি, ফর্দ নিয়ে আজই চলে এসেছেন? বাবার শ্রাদ্ধ কি পালিয়ে যাচ্ছে নাকি পুরুতমশাই?’
পুরুতমশাই বললেন, ‘তোমার বাবা চলে গেলেন কবে বলো তো?’
ছোটোছেলে বলল, ‘কেন, এই তো পরশু দিন, মানে শুক্কুরবার।’
পুরুতমশাই হেসে বললেন, ‘না না, তোমার বাবা চলে গেলেন বুধবার, শুক্লা নবমীর দিন। তুমি ভুল করছ!’
ছোটোছেলে নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল, ‘ও, হ্যাঁ হ্যাঁ! তা ফর্দটা দিয়ে যান। দাদা আর মা-র সঙ্গে আলোচনা করে রাখব।’
এই সব কান্ড দেখে-শুনে সঙ্গে সঙ্গে নিম গাছের ডালে বসে নিজের ভুলটাও বুঝতে পারল অবিনাশ। সে নেই বলে কারও কোনো কষ্টই নেই, একথা মেনে নিতে পারছিল না বটে। তবে, শেষে ভাবল, মিথ্যে নিম গাছে বসে থেকে কী লাভ? অমনি সটান ভূত-রাজ্যের দিকে উড়াল দিল অবিনাশ।
অবিনাশ এমনিই খুব সাদাসিধে মানুষ ছিল। কারও সাতে-পাঁচে থাকত না। পোস্ট অফিসে পিয়োনের কাজ করত। তবে কেউ বলতে পারবে না, অবিনাশ কারও চিঠি তার বাড়িতে পৌঁছে না দিয়ে ছিঁড়ে সোনাচরের খালের জলে ভাসিয়ে দিয়েছে। আজকাল পোস্ট অফিসে চিঠিপত্র আসাও খুব কমে গিয়েছিল। শত শত কুরিয়ার সার্ভিস চালু হয়ে গেছে চারদিকে। এখন কেউ আর পোস্ট অফিসকে আগের মতো ভরসা করছে না। তবে অবিনাশ সম্পর্কে কেউ বলতে পারবে না, সে কারও দু-পয়সা মেরেছে বা কাউকে কটু কথা বলেছে। বছর তিনেক হল রিটায়ার করেছিল অবিনাশ।
ভূত-রাজ্যে ঢোকার মুখে একটা খ্যাংরা কাঠির মতো চেহারার ভূত এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কোত্থেকে আসা হচ্ছে শুনি? হুট বলতে যে ভূত-রাজ্যে ঢুকে পড়ছ? মানুষদের মতো এখানকার কোনো নীতি-নিয়ম নেই নাকি?’
অবিনাশ বলল, ‘না মানে, মরে গেছি বলেই তো ভূত হয়েছি। আর ভূত হয়েছি বলেই না এখানে আসা। না হলে থাকব কোথায় শুনি? আমার বাড়িতে তো আর এখন থাকার জায়গা হবে না। দ্যাখো না গিয়ে, সেখানে কী কান্ড শুরু হয়েছে!’
‘কোথায় থাকবে এ নিয়ে বিস্তর বাগবিতন্ডা আছে। থাকতে চাইলে যে এখানে থাকতে পারবে, তারও যেমন কোনো মানে নেই, তেমনই চলে যেতে চাইলেই যে এখান থেকে চলে যেতে পারবে, তারই বা উপায় কী?’ বলে খ্যাংরাকাঠি ভূতটা খি খি করে হাসল।
অমন হাসি দেখে অবিনাশের গা-পিত্তি জ্বলে গেল। অবিনাশ বেশ ক্ষুব্ধ গলায় বলল, ‘ভূত হয়ে তবে এ রাজ্যে এসেছি। এ তো আর মাগনা নয়? তার আবার অত কথা কী হে?’
‘তুমি আমাকে ‘হে’ সম্বোধন করে কথা বলছ, তোমার আস্পদ্দা দেখে ভিরমি খাওয়ার জোগাড় আমার। যে আমার কথায় মোড়লমশাই অনেক ভেবে উত্তর দেন, তাকে তুমি অমন করে কথা বলছ? তুমি তো এর আগে কখনো ভূত হওনি? এই প্রথম ভূত হয়েছ?’ খ্যাংরাকাঠি ভূত জিজ্ঞেস করল।
অবিনাশ তার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘প্রথম ভূত মানে? কেউ আবার দু-বার ভূত হয় নাকি? মানুষ মারা গেলে ভূত হয়, তাই তো শুনে এসেছি এতদিন। এখন শুনছি তোমার মুখে অন্য কথা। তুমি তো বেশ প্যাঁচালো কথা বলো দেখছি?’
‘মরে গিয়েছ মানেই যে ভূত হবে, এমন কথা মনেও ভেব না। ভূত হতে গেলে অনেক ট্রেনিং-ফ্রেনিং নিতে হয়, অনেক হাতেকলমে পরীক্ষা দিতে হয়, চাকরির ইন্টারভিউয়ের মতো। তারপর চাকরির মতো এখানেও প্রবেশন পিরিয়ড আছে। সেটা পেরোলে পাকা চাকরির মতো তখন একটুখানি জায়গা হবে এ রাজ্যে। তারও পরে প্রভিডেন্ট ফাণ্ড, গ্র্যাচুইটির মতো অনেক রকমফের ব্যাপার আছে।’ বলে খ্যাংরাকাঠি-ভূত চোখ পিটপিট করে তাকাল অবিনাশের দিকে।
সূর্যটা ডুবে যাওয়ার আগে একবার যেন তাকাল অবিনাশের দিকে। ব্যাপারটা চোখ এড়াল না অবিনাশের। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিয়ে গলা নীচু করে খ্যাংরাকাঠি ভূতের কাছে জানতে চাইল, ‘আমি এবার কোথায় যাব, আজ্ঞা করো। সারারাত এখানে তিনঠেঙে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকব নাকি? পা ব্যথা করবে না? আমার আবার কোমরে বড্ড ব্যথা হয়! শরীর টনটন করতে থাকে। তখন একদম ঘুম আসে না। তার উপর বড্ড ভয় করে রাত বাড়লে। যখন ঝিঁঝি পোকা ডাকতে শুরু করে ঝোপের ওদিকে, জোনাকি জ্বলতে-নিভতে গিয়ে একসময় থম মেরে যায়, সন্ধ্যের অন্ধকার রাতের দিকে গড়াতে গিয়ে যখন আনচান করতে থাকে, উলুক-ঝুলুক করতে থাকে সন্ধ্যেতারার আলো, তখন আমার গা ছমছম করতে শুরু করে। আগে এমন করত না। রিটায়ার হওয়ার পর থেকে এমনটা শুরু হয়েছিল। তাই তুমি যা ব্যবস্থা করার আগেভাগেই করে দাও ভাই।’
‘সে না হয় একটা ব্যবস্থা করছি। মোড়ল যখন বলেই দিয়েছেন, তোমার থাকার জায়গা আপাতত হয়েছে দেউলপোতার নাগেশ্বর ফুলগাছের মগডালে, তখন তার অন্যথা তো হতে পারে না? সোজা চলে যাও সেখানে। তার আগে তোমাকে আজকের হোমটাস্কটা দিয়ে দিই।’ বলে খ্যাংরাকাঠি-ভূত তার কাঁধের ছেঁড়া ঝোলার ভিতর থেকে কালো রঙের খুব ছেঁড়াখোঁড়া খাতাটা বের করে নিবিষ্ট মনে কী যেন দেখতে লাগল।
হোমটাস্কের কথা শুনে অবিনাশের হাঁ চট করে বন্ধ হতে চাইল না। ভূতেদের হোমটাস্ক করতে হয়, এমন কথা জীবনে শোনেনি অবিনাশ। রিটায়ার করার পর অবসর সময়ে বই পড়বে বলে ভেবে পাশের গড়খন্ডের গ্রামীণ লাইব্রেরির মেম্বারশিপ নিয়েছিল অবিনাশ। দুটো ভূতের গল্পের বই ইসু করে এনেছিল। শেষ করতে সময় লেগে গেল প্রায় পাঁচ মাস। তা সেসব গল্পে কোথাও ভূতেদের হোমটাস্কের কথা লেখা নেই। ভূত সম্পর্কে এর বেশি পড়াশোনা নেই অবিনাশের। মুখের হাঁ বন্ধ হতে সময় লেগে গেল মিনিট পাঁচেক। তারপর অবিনাশ বলল, ‘সেটা কী জিনিস, দয়া করে একবার বুঝিয়ে দাও দিকি।’
অনেকটা অবিনাশের গায়ের কাছে সরে এল খ্যাংরাকাঠি-ভূত। ওর গা থেকে একটা বিটকেল গন্ধ বেরোচ্ছে। নাকে বাঁ-হাত চাপা দিয়ে কী যেন বলতে গেল অবিনাশ। ওকে থামিয়ে দিয়ে খ্যাংরাকাঠি-ভূত বলল, ‘অমন গন্ধটন্ধ তোমারও গা থেকে দখিনা বাতাসের মতো ভেসে আসবে। আর ক-দিন যেতে দাও! তা যা বলছিলাম, তোমার আজকের লেসান হল, ভূতকে মানুষ কী কী কারণে ভয় পায়, সে নিয়ে একটা ছোটোখাটো রচনা লিখে ফেলতে হবে আজকের রাতের মধ্যে। যত বেশি পয়েন্টস দিতে পারবে, ততই ভালো। সেদিকে খেয়াল রেখো।’
এই অদ্ভুত রচনা সম্পর্কে আরও দু-একটা কথা জানার জন্যে অবিনাশের পেটের মধ্যে গুড়গুড় করে উঠল। যেমন, লিখবে যে, কাগজ-কলম কোথায়? না হলে লিখবে কী করে? অন্ধকার ঘন হয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে বাঁশগাছের পাতায়। সেদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে খ্যাংরাকাঠি-ভূতকে কিছু বলতে গিয়ে অবিনাশ দেখল, তার সামনে খাঁ খাঁ করছে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। তার মানে অন্ধকারে উধাও হয়ে গিয়েছে খ্যাংরাকাঠি-ভূত।
এবার কী করবে, চোখ বন্ধ করে খানিক ভাবল অবিনাশ। তারপর শাঁ করে উড়ে চলে গেল নাগেশ্বর ফুলগাছের মগডালে। সেখানে গিয়ে অবিনাশ অনেকটা ভরসা খুঁজে পেল যেন। কেননা, এখানে আগে থেকেই অনেক ট্রেনি-ভূতের বাস। তাদের মুখ থেকেই শুনল, এখানে কারও কোনো কাজটাজ নেই। থাকেও না কখনো। সারাদিন ধরে শুধু এ-ওর পিছনে ক্যাচোর-ম্যাচোর করে বেড়াও। মুখ ফসকে হোমটাস্কের কথাটা বলতে গিয়েও ফের কথাটা মুখের ভিতর সুড়ুত করে চালান করে দিল অবিনাশ। না, হোমটাস্কের ব্যাপারটা এখন সাতকান না করাই ভালো।
প্রথম দিন সকলের সঙ্গে ভাব-পরিচয় করে ওঠা গেল না। সেই যে বাড়ির পাশের নিমগাছ থেকে উড়ে আসার পর থেকে তার মনটা জল ভরতি কলসির মতো ভারী হয়ে আছে। নাড়া পেলেই সেও সব দুঃখের কথা বলবে বলে গুব গুব করে উথলে উঠছে। সেসব কথার দু-চারটে মনে করার চেষ্টা করল অবিনাশ।
এত সরু একটা মগডালে মোড়ল-ভূত তার থাকার জায়গা ঠিক করে দিয়েছে যে, প্রথমে তার বেশ ভয় ভয় করছিল। কিন্তু সেই সরু ডালের গায়ে নরুনের মতো কিছু দিয়ে কী সব দাগ কাটা। কে একজন বলে উঠল, ‘ওইটা তোমার জায়গা। তুমি ফের অন্যের জায়গায় দখল বসিয়ো না যেন!’
অবিনাশ মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছে, এখন থেকে সব কথা জেনে-বুঝে যাচাই করে নেবে। যে ভূতটা ওই কথাটা বলল, অবিনাশ তার মুখটা ভালো করে দেখতে পেল না। তবু শূন্যের উদ্দেশে বলল, ‘এটাই যে আমার জায়গা তারই বা প্রমাণ কী?’
আকাশের মেঘটা যেই চাঁদের উপর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল, অমনি আবছা আলোয় এখন একটু স্পষ্ট হল ভূতটা। বেঁটে বলে বেঁটে, যেন সার্কাস দলের ক্লাউন। চোখ দুটো ছেলেবেলার পূজামন্ডপে দেখা ডাকিনিদের চোখের মতো। দাঁতগুলো অসম্ভব বড়ো আর হলদে রঙের। হাত-পায়ের নখের যা ছিরি, মনে হয় না কস্মিনকালে নেলকাটার পড়েছে। সে বলল, ‘ওই দ্যাখো না, সরু ডালের গায়ে তোমার নাম লেখা আছে।’
অবিনাশ ব্যঙ্গের হাসি হাসল। বলল, ‘এই যদি লেখা হয় তা হলেই হল আর কী! বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, উর্দু, ফারসি, তেলুগু, কন্নড়, এমনকী, চর্যাপদের ভাষাও কিছু কিঞ্চিৎ চিনি। কিন্তু এমন অক্ষর কখনো দেখিনি ভাই! এ অক্ষরের নাম কী?’
‘তুমি তো সবে এলে, এখনই টালটুল মেরে সব জেনে ফ্যালো না হে! এই অক্ষরের নাম হল, ভূতাক্ষর। ভূত-রাজ্যে এটাই হল লেখ্যভাষা। এ তোমাকেও শিখতে হবে।’
তখনই মনে হল অবিনাশের, লেখ্যভাষা কথাটার মানে কী? কথাটা কখনো শোনেনি অবিনাশ। এই কি তবে এখানকার লেখার ভাষা? খ্যাংরাকাঠি-ভূত যে তাকে রচনা লিখতে বলেছে, তা হলে সে কি এই ভূতাক্ষর হরফে লিখতে হবে নাকি? এ তো মহাফ্যাসাদে পড়া গেল! এ অক্ষর তো তার মোটেও চেনা নয়!
সরু ডালে কোন আকাশপার থেকে একঝলক ফুরফুরে বাতাস ধেয়ে এসে দোলা দিতে লাগল অবিনাশকে। ছেলেবেলায় মা গাছের ডালে ছেঁড়া শাড়ির দোলনা বেঁধে অবিনাশকে শুইয়ে দিয়ে সংসারের কাজ করত। তখন যেমন করে দোলা লাগত, এখনও তেমন করেই যেন দোলা লাগল, আর অমনি চোখের পাতা হুট করেই বুজে এল তার।
কিন্তু আরও অনেক বড়ো ফ্যাসাদ যে তখনও তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে, সেকথা টের পেল অবিনাশ তারও দু-তিনদিন পরে।
২
সেই খ্যাংরাকাঠি-ভূতকে দেখা গেল সেদিন নাগেশ্বর ফুলগাছের নীচে, গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে। কারণ কী? অমন দাপুটে ভূতের এমন হল কেন? একটু পরেই একান-ওকান হতে-হতে উড়ে এল কথাটা। মোড়ল-ভূত নাকি খ্যাংরাকাঠি-ভূতের উপর বেজায় খেপে গেছেন। নবাগত ভূতেদের যেসব ট্রেনিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকে, সে নাকি তার এক কণাও করেনি। একথা শুনে মনে মনে অবিনাশ ভাবল, সেও তো কিছু হোমটাস্ক পেয়েছিল ভূত-রাজ্যে আসার দিনই। কই, সেও তো ভুলে মেরে দিয়েছে! সকলে এমন করছে বলেই না ও বেচারা বকুনি খেয়ে মরছে। অবিনাশের কেমন যেন মায়া হল খ্যাংরাকাঠি-ভূতের ওপর।
সড়াৎ করে নাগেশ্বর ফুলগাছের মগডাল থেকে একেবারে নীচে নেমে এল অবিনাশ। থসরমসর শব্দ হতে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকিয়ে ফের মাথা নীচু করেই বসে রইল খ্যাংরাকাঠি-ভূত। তার প্রতি মায়াটা যেন এখন কাঁচা দুধ উনুনে পাক করলে যেমন করে ঘন হয়ে আসে, অমন করে ঘি হয়ে আসছে। অবিনাশ বলল, ‘বলো তো ভাই, আমি তোমার জন্যে কী করতে পারি? তুমি প্রথম দিন আমাকে যে রচনা লিখতে দিয়েছিলে, আমি সে-রচনাটা লিখে দিলেই কি মোড়ল-ভূতের কাছ থেকে তোমার বকুনির কিছুটা কমতি হয়?’
এবার মুখ তুলে একবার অবিনাশকে দেখল খ্যাংরাকাঠি-ভূত। মনভার করা গলায় বলল, ‘আমার উপর অর্ডার হয়েছে, এখানে আজ থেকেই প্রাইমারি স্কুল খুলতে হবে। স্কুলের নাম হবে ‘ভূতাক্ষরী প্রাইমারি স্কুল’। আজ থেকেই জোর কদমে পঠনপাঠন শুরু করে দিতে হবে ট্রেনি-ভূতদের নিয়ে। কিন্তু এ গাছের ট্রেনিভূতগুলো এতই অবাধ্য যে, কেউই একদিনের জন্যে একটাও হোমটাস্ক জমা দেয়নি আমাকে। তুমিই বলো, আমি কেমন করে মোড়লের কাছে মুখ দেখাই?’
ঘাড় নাড়ল অবিনাশ, ‘এক-শো ভাগেরও বেশি সঠিক কথা খ্যাংরাভাই! তুমি আমাকে পরিষ্কার করে বলো তো, এই যে প্রাইমারি স্কুলটার কথা বললে, এটা ঠিক কেমন স্কুল?’
খ্যাংরাকাঠি-ভূত বলল, ‘এই যে এত ভূত দেখছ, এসব হল গিয়ে সব মিথ্যে-ভূত। সত্যি-ভূত গোটা ভূত-রাজ্যে খুঁজলে ক-টাই বা পাবে?’
‘তুমি এ কী কথা শোনালে গো? ভূতের আবার সত্যি-মিথ্যে আছে নাকি? কীরকম, আমাকে একটু বুঝিয়ে বলো না?’ অবিনাশের কথায় জেদ ঝরে পড়ল।
‘গোটা ভূত-রাজ্যে তুমি যদি ঠিকমতো গুনেগেঁথে দ্যাখো, তা হলে আমাকে আর মোড়ল-ভূতকে ধরে সত্যি-ভূতের সংখ্যাটা বড়োজোর সতেরো কি তেইশে গিয়ে দাঁড়াবে। আর যত লাখ লাখ ভূত, সবই মিথ্যে-ভূত।’
খ্যাংরাকাঠি-ভূতকে কথা শেষ করতে দিল না অবিনাশ, ‘মিথ্যে-ভূতকে সত্যি-ভূত করতে কতক্ষণ লাগে হিসেব করে বলো তো ভাই! তার আগে বলো, আমি কি সত্যি-ভূত না মিথ্যে-ভূত?’
‘তুমি শিক্ষানবিশ তো! তুমি মিথ্যে-ভূত।’ খ্যাংরাকাঠি-ভূত মুখটা তুলে অবিনাশকে বলল।
‘ভূতই যদি হলাম, তা হলে খামোকা মিথ্যে-ভূত হতে যাব কেন? আমি কী করে সত্যি-ভূত হব, শিখিয়ে দাও না! আমার যে এখনই সত্যি-ভূত হতে মনটা আঁকুপাঁকু করছে ভাই!’
খ্যাংরাকাঠি-ভূত তার কুড়ি হাত খানিক লম্বা পা দুটো সোজাসাপটা ভাবে মেলে দিল সামনে। তারপর বলল, ‘যারা মানুষকে ভয় দেখাতে পারে এবং ভয় দেখিয়ে আদাড়ে-বাদাড়ে, নিশিবিলের জঙ্গলে ঘুরিয়ে মারতে পারে, অন্ধকারে ধরে পটাস করে ঘাড় মটকে দিতেও পারে, লম্বা তলতা বাঁশগাছের টঙে তুলে অমাবস্যা রাতে শাঁ করে আছাড় দিতে পিছপা হয় না, অবিকল মানুষের গলা নকল করে কথা বলতে বলতে আলেয়ার প্যাঁচে ফেলে মানুষকে মারতে পারে, তারাই সত্যি-ভূত।’
অবিনাশ ঘাড় নেড়ে বলল, ‘সে তো খুব ভয়ের কথা হল গো! আমার দ্বারা কি অমন ভূত হওয়া কখনো সম্ভব? আমি তো এমনিতে নির্বিরোধী মানুষ ছিলাম গো!’
‘ভয়ের কথাই তো হবে। ভূতকে যদি মানুষ ভয়ই না পায়, তা হলে ভূত-রাজ্যের কোনো গরিমা থাকে কি? তা হলে মানুষ আর ভূত তো এক হয়ে গেল!’
খ্যাংরাকাঠি-ভূতের কথায় সায় দিল অবিনাশ। জানতে চাইল, ‘এর কি কোনো প্রকারভেদ হয় না? মানে আর একটু সোজাসাপটা ভয় দেখানোর কিছু? সব দেশেই তো যেমন কঠিন-কঠিন নিয়ম হয়, আবার তেমনি সোজাসাপটা নিয়মও তো হয়? তা হলে আমি না হয় তেমন ভূত হওয়ার চেষ্টা করে দেখি পারি কি না।’
‘আছে। ছোটো ছেলে-মেয়েদের ভয় দেখানোর একটা চ্যাপটার আছে সিলেবাসে। সেসবই বা ক-জনা পারে?’
‘কীরকম? বলো না দেখি, শুনতে কেমন লাগে।’ অবিনাশ ঘাড় নেড়ে বলল কথাটা।
খ্যাংরাকাঠি-ভূত বলল, ‘এই যেমন ধরো, যে ছেলে অঙ্কে খুব ভয় পায়, তার খাতার অঙ্কের হোমওয়ার্ক-গুলো রাতে গিয়ে করে দিয়ে আসতে হবে। সে স্কুলে গিয়ে দেখবে, তার সব অঙ্কই করা হয়ে আছে। তখন সে ভূতকে বিশ্বাস করতে শুরু করবে। ভূতকে তার মনে হবেও মাইডিয়ার। সেই সুযোগে একদিন…’ এই পর্যন্ত বলে সে হাত দুটো এমন করে ঘুরিয়ে দেখাল যে, তার মানে ঘাড় মটকানোও হতে পারে, আবার শূন্যে তুলে আছাড় মারাও হতে পারে।
অবিনাশ অরাজি গলায় বলল, ‘না না, ও আমি পারব না! আমার ছোটোদের প্রতি ভালোবাসার কথা আমার পাড়ায় গল্পকথা হয়ে ছড়িয়ে আছে! যাও না, গিয়ে শুনে এসোখন। সেই আমি কিনা…ও আমি পারব না ভাই। বরং আমার নাম কেটে দাও, আমি সোজা অন্য কোথাও চলে যাই। ওই জন্যেই কেউ তোমার হোমটাস্ক করে দেয় না। তুমি মাথা খাটিয়ে জলের মতো সরল হোমটাস্ক বানাও না কেন?’
‘ছোটোদের সাঁতার শেখানোর নাম করে জলে ডুবিয়ে…? সাইকেল চড়ার সময় প্যাডেলে পা ঢুকিয়ে…? বন্ধুর বেশে ভুলিয়ে-ভালিয়ে…? ছেলেধরার ঝোলায় ভরে… এসবই তো এক্কেবারে সোজা টাস্ক?’
অবিনাশ দু-দিকে মাথা নেড়ে বলল, ‘এসব তুমি যা বলছ, এ তো বেশ কঠিন কাজ। এ আমি পারব না। এর চেয়ে আর একটু সহজ কাজ কিছু থাকলে বেছেবুছে দাও না কেন! সে আমি অবসর পেলে তোমার গা-হাত-পা টিপে দেবখন না হয়! আমি তো আবার একটুখানিক দুবলা আছি গো, সে তো তুমি দেখতেই পাচ্ছ?’
খ্যাংরাকাঠি-ভূত হাসতে হাসতে উলটে পড়ে যাবে যেন। তারপর তার হাসি থামতে বলল, ‘তুমি কখনো মরার আগে জেলটেল খাটোনি?’
অবিনাশ অবাক গলায় বলল, ‘ও মা! জেল খাটতে যাব কেন? সেসব তো যারা খারাপ কাজ করে, তাদের পানিশমেন্ট দেওয়া হয়। আমি ভাই কখনো অমন কাজ করিনি। কেউ বলতে পারবে না! যাও না, আমার গাঁয়ে গিয়ে খবর করে এসো না কেন!’
‘তোমার গাঁয়ে গিয়ে খবর করার মতো আমার হাতে অত সময় নেই। তোমাকে একটা হোমটাস্ক দিয়ে রাখি। কাল সকালে কোরো। আমি সন্ধ্যেবেলা এসে জেনে নেব। চলো, নাগেশ্বরের মগডালে তোমার বাসায় যাই।’
সরু ডালে ঝুলতে ঝুলতে খ্যাংরাকাঠি-ভূত বলল, ‘কাল তুমি তোমার গ্রামের দিকে চলে যেয়ো। সেখানে কাউকে ভয় দেখিয়ে ফিরে এসে আমাকে রিপোর্ট কোরো। তোমার ভয় দেখানোর রকম দেখে ঠিক হবে তোমার ভূত-জীবনের গ্রেডেশান, কেমন?’
বলেই খ্যাংরাকাঠি-ভূত আবার কাউকে হোমটাস্ক দিতে চলে গেল। কোন দিকে গেল, সে আর অবিনাশ চোখ চেয়ে দেখতে পেল না। শুধু পাতায় পাতায় খসর-মসর করে শব্দ হল, এই যা!
৩
সকালে উঠে অবিনাশ ভাবল, আজকের হোমটাস্কটা মন দিয়ে করতে হবে। যাই, আমার গ্রামের দিকেই যাই। কিন্তু ফের মনে হল, বাড়ির লোকজনকে দেখলে ফের যদি মন খারাপ হতে শুরু করে? একথা মনে হতেই উড়ে যেতে যেতে অবিনাশ ধাঁ করে বেঁকে গেল মেজোপিসির বাড়ি কামিনীপুরের দিকে। ভাবল, পিসি তো নেই, গিয়ে দেখি, পিসতুতো ভাইয়েরা আমার খবরটা পেয়েছে কি না।
অবিনাশ যায়, যায়, যায়। সে কি আর চাট্টিখানি দূর! পিসির বাড়ি যেতে হলে পেরোতে হবে একটা মস্ত গগনখাকির মাঠ। অবিনাশ বেঁচে থাকতে বার তিনেক এই মাঠটা পেরিয়েছে। দু-বার বাবার সঙ্গে পিসির বাড়ি গিয়েছিল। আর-একবার ক্লাস টেন-এর ফাইনাল পরীক্ষার পর একা বেড়াতে গিয়েছিল পিসির বাড়ি।
মাঠটায় কী নেই। মাঠটার মাঝখান দিয়ে ওপারে গেলে তবে পিসির বাড়ি। নয়তো ঘুরপথে হাজার একটা গ্রাম পেরিয়ে হাঁটাপথে গেলে সে প্রায় একদিনের পথ। খুব স্পষ্ট মনে আছে অবিনাশের, গোটা পথটা একটা সরু পায়েচলা পথ। মাঠে ঢুকে পড়লেই প্রথমে পড়বে বেশ অনেকটা জুড়ে কালকাসুন্দের ঝোপ। এমন ঘন ঝোপ যে দিনের বেলায়ও সেখানে ঝিঁঝি ডাকে। বর্ষা হোক বা না হোক, কটর কটর করে ব্যাং ডাকতে শুরু করে হঠাৎ হঠাৎ।
সেটা পেরোলে অকলঙ্ক মহাশ্মশান। সেখানে অবিনাশ একলা পিসির বাড়ি যাওয়ার সময় মানুষের অনেক-গুলো মাথার খুলিকে ঝড়ে গড়াগড়ি খেতে দেখেছে। ঝড় উঠলে মানুষের অন্তিম যাত্রার ধুলো উড়ে এসে দু-চোখ অন্ধ করে দেয়।
তারপর সরু আলপথ গিয়ে পড়বে শ্মশানমারির খালে। তার উপর একটা নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো আছে। সাতজন্মে সারানো হয়নি। তার উপর দিয়ে সার্কাসের ট্রাপিজের খেলার মতো করে পেরোতে হবে।
সেটা পেরোলে ধু-ধু মাঠ। মনে হবে এ মাঠের আদি আছে কিন্তু অন্ত নেই। চলতে চলতে তারপর পড়বে ফাঁসি-খাওয়া খিরীষ গাছ। গাছটা যেমনি বড়ো, তেমনি তার ঝাঁকড়া ডালপালা। বিকেল থেকেই রাত্রি হয়ে গেছে ভেবে প্যাঁচারা ডাকতে শুরু করে দেয়। গাছের নীচটা দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকে। রোদ পড়ে না বলে খুব ভেজা ভেজা আর স্যাঁতসেঁতে। এই গাছে কতজন যে ফাঁসি দিয়ে মারা গেছে তার হিসেব কামিনীপুরের বুড়ো মানুষরা বলতে পারে না। যারা মারা গেছে, তারা নাকি ওই গাছেই ভূত হয়ে থেকে গেছে।
তবে এই গাছটা সম্পর্কে একটা কথা শুনেছে অবিনাশ। এই গাছে নাকি মনে আনন্দ হলে মানুষ ফাঁসি নিতে আসে। কথাটা শুনে খুব অবাক হয়েছিল অবিনাশ। মনের আনন্দে কেউ মরতে আসে বলে সে কখনো শোনেনি। পিসি ওকে গল্পটা বলেছিল। প্রথম যে মরতে এসেছিল, সে এসেছিল মনের দুঃখে। তারপর থেকে যার মনে আনন্দ দেখে সে, হিংসায় তাকেই নিশিডাকের মতো করে রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে টেনে আনে। অবিনাশ একবার মনে মনে হাসল, ভালোই হবে, ভূতের সঙ্গে ভূতের দেখা হয়ে যাবে!
ওই গাছটা পেরোলে পড়বে ভূতক্রান্তির বিল। মস্ত বড়ো এই বিলেরও অনেক গল্প আছে। একবার নাকি কামিনীপুরের জমিদার অনন্তমাধব দন্ডপাটের আজব ইচ্ছে হয়েছিল, একটানা ঘোড়া ছুটিয়ে এই বিলটা একপাক ঘুরে আসবেন। লোকে বলে বিলটা এক পাক ঘুরতে গিয়ে নাকি তাঁর ঘোড়াটা ছাতি ফেটে মারা গিয়েছিল, বিলটা এত বড়ো! এই বিলটা পেরোলে তবে পড়বে কামিনীপুর।
অবিনাশ তো এখন ভূত, সে ইচ্ছে করলে পাঁইপাঁই করে উড়েও যেতে পারত। কিন্তু তার ইচ্ছে হল, সে ছায়াময় হয়ে হাঁটতে হাঁটতে সব দেখতে দেখতে যাবে। কিন্তু গিয়ে যা দেখল, তাতে অবিনাশ অবাক না হয়ে পারল না। গগনখাকির মাঠটা চিরে একটা এবড়ো-খেবড়ো মোরাম রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে কামিনীপুর। পালা করে দু-খানা ভ্যানরিকশাও চলে এখন। তবে প্যাসেঞ্জার ভরতি না হলে ভ্যানওলা ভ্যান ছাড়ে না। অপেক্ষা করতে হয় দু-একঘণ্টাও।
অবিনাশ ফুরফুরে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে যখন কামিনীপুরে গিয়ে পৌঁছোল, তখন বেলা পড়ে এসেছে। ভ্যানস্ট্যাণ্ডে একটা ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে লোক ভরে নিয়ে। আর দু-জন লোক হলেই ভ্যান ছেড়ে দেবে।
একটা হরতুকি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখছিল অবিনাশ। হঠাৎ দেখল, পিসতুতো ভাই অকুলেন্দু এদিকেই আসছে। অমনি মানুষ হয়ে এগিয়ে গেল অবিনাশ অকুলেন্দুর দিকে। অবিনাশকে দেখে চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল অকুলেন্দুর। সে যে দুটো খবর শুনে মামাতো দাদার বাড়ি যাচ্ছে, তা হলে কি খবর দুটো ঠিক নয়?
সে যে কথাটা শুনেছে আজ দুপুর বেলা মহিম দাসের মুখ থেকে, সেই কথাটা মনে মনে একবার ঝালিয়ে নিল। মহিম দুপুর বেলা অকুলেন্দুর বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। ডেকে বলল, ‘হ্যাঁ রে অকুল, শুনলাম তোর মামাতো দাদা অবিনাশ মারা গেছে নাকি আজ ক-দিন আগে। শুনিসনি? আজ সকালে তোর মামার শোকে মামাতো বউদিরও নাকি যাই-যাই অবস্থা।’
অকুলেন্দু বলল, ‘না তো? দাদার ছেলেরা এখন আর একটা খবর দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করে না। তা হলে ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ি, একবার গিয়ে দেখে আসি।’
বলে ভাত দুটো খেয়েই অকুলেন্দু বেরিয়ে পড়েছে মামাতো দাদা অবিনাশের বাড়ি যাবে বলে। কিন্তু এ কী? ভ্যানস্ট্যাণ্ডে সেই অবিনাশদাই তো দাঁড়িয়ে আছে? তা হলে মহিম যে বলে গেল অবিনাশদা ক-দিন আগে মারা গেছে?
আমতা আমতা করে অকুলেন্দু অবিনাশকে বলল, ‘দাদা, একটা খবর শুনে তোমার বাড়ি যাব বলে বেরিয়েছি। এখন দেখছি খবরটা পুরো উড়ো খবর!’
‘কী খবর শুনলি আবার?’
‘দুপুরবেলা মহিম দাস বলল, তোমার নাকি খুব শরীর খারাপ হয়েছিল ক-দিন আগে?’
‘শোন, লোকে নানা উড়ো খবর ছড়িয়ে বেড়ায়। সব খবরে অমন কান দিস না। তুই হয়তো কবে শুনলি, তোর অবিনাশদা মারা গেছে! তা বলে কি সত্যি আমি মারা গেছি? তা হলে তোর সামনে দাঁড়িয়ে আছি কেমন করে? খবর ওরকম উড়ে উড়ে বেড়ায় রে!’
‘মহিমই তো বলল, আজ সকাল থেকে নাকি বউদিরও খুব শরীর খারাপ? তাই তোমার বাড়ি যাব বলে বেরিয়েছি।’ অকুলেন্দু অবিনাশের মারা যাওয়ার যে খবরটা শুনেছিল, সেটা চেপে গেল। একজন মানুষকে সামনেই জলজ্যান্ত দেখছে, তার মারা যাওয়ার খবরটি কি বলা যায়, না বলা উচিত?
অবিনাশ হেসে বলল, ‘দুর! তোর বউদির সব ওষুধের ব্যবস্থা করেই তবে না বাড়ি থেকে বেরিয়েছি! দেখবি, দেবেন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন আমার পকেটেই আছে? আজ তো আমি এখন যাচ্ছি হরিহরপাড়া। ওখানে আমার এক পুরোনো কলিগের বাড়ি। ক-বছর হল রিটায়ার করেছি। তাই ভাবলাম, যাই, দেবেন কেমন আছে ছেলেপুলে নিয়ে, একবার দেখে আসি!’
অকুলেন্দু বলল, ‘তুমি হরিহরপাড়া যাও। আমি যখন বেরিয়েই পড়েছি তোমার বাড়ি যাব বলে, তখন একবার ঘুরেই আসি। বউদিকেও দেখে আসি!’
অবিনাশ অমনি হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘আজ এই অবেলায় তোকে আর যেতে হবে না অকুল। এক্ষুনি ঝড়-বৃষ্টি নামতে পারে। ভ্যানে গেলেও এতখানি পথ, কম সময় তো লাগবে না! তোর আজ আমার বাড়ি গিয়ে আর কাজ নেই। কাল বরং আমি সকালে হরিপরপাড়া থেকে ফিরে তোকে নিয়েই বাড়ি ফিরব। একসঙ্গে দু-জনে গল্প করতে করতে চলে যাব।’
অকুলেন্দু অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ি ফিরে গেল, ‘অবিনাশদা, কাল সকাল-সকাল তা হলে আমার বাড়ি চলে এসো। একসঙ্গে দু-ভাই দু-মুঠো ডাল-ভাত খেয়েই বেরিয়ে পড়বখন।’
বলতে বলতে শুরু হয়ে গেল মেঘের গর্জন। আকাশ ঝলকে উঠতে লাগল ঘনঘন বিদ্যুতের আলোর ঝলকানিতে।
পরদিন সকালে খবর এল কামিনীপুরে, যে ভ্যানরিকশাটায় অকুলেন্দু যাবে বলে বেরিয়েছিল, সেই ভ্যানরিকশায় কাল রাতে বাজ পড়ে আটজন লোকই মারা গেছে। শুনে অকুলেন্দু মনে মনে বলল, ‘ভাগ্যিস, কাল যেতে দেয়নি অবিনাশদা। তা না হলে…।’
কিন্তু এত বেলা হয়ে গেল এখনও তো অবিনাশদা এল না? পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরেছে অকুলেন্দু। কতদিন পরে মামাতো দাদা আসছে! অপেক্ষা করতে করতে দুপুর হয়ে গেল। অকুলেন্দু ভাবল, অনেকদিন পরে দাদা তার পুরোনো কলিগের বাড়ি গেছে, হয়তো ছাড়েনি। দাদা তার মতো করেই আসুক। আমার মনটা যখন টানছে, তখন আমি দুপুর দুপুর বরং অবিনাশদার বাড়ি চলে যাই। অনেকদিন যাওয়া হয়নি। বউদিকেও দেখে আসা যাবে। বলেই ভ্যানরিকশা ধরে ঘণ্টা দুই পরে যখন অকুলেন্দু অবিনাশের বাড়িতে এসে পৌঁছোল, তখন মামাতো বউদি হাউমাউ করে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিল। সব শুনল অকুলেন্দু। দিন সাতেক হল অবিনাশদা মারা গেছেন।
অকুলেন্দু বলল, ‘তোমরা কী বলছ? কাল অবিনাশদার সঙ্গে আমার কামিনীপুরে দেখা। আমি তোমাদের বাড়ি আসব, আমাকে কিছুতেই আসতে দিল না। বলল, ‘আজ আর তোকে যেতে হবে না অকুল। কাল দু-জনে একসঙ্গে গল্প করতে করতে যাব। আমি বরং আমার পুরোনো কলিগ দেবেনের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি!’ আজ শুনলাম সেই ভ্যানরিকশাটার আটজন প্যাসেঞ্জারই বাজ পড়ে মারা গেছে। অবিনাশদা মরে গিয়েও আমাকে কাল অমন করে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল?’
সকলে অকুলেন্দুর মুখ থেকে এই কথা শুনে নির্বাক হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্যে।
কিন্তু ওদিকে অবিনাশের ভূত-জীবনে ঘনিয়ে এল ঘোর বিপদ।
৪
সন্ধ্যে তখন অন্ধকারের ঘোমটায় সবে মুখ ঢাকছে, অমন সময় অবিনাশ নাগেশ্বর ফুলগাছের মগডালে এসে পৌঁছোল। তক্ষুনি কোথা থেকে শাঁ শাঁ করে চলে এল খ্যাংরাকাঠি-ভূত। এসেই বলা নেই কওয়া নেই ঝপাং করে অবিনাশের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে লাগল জোরে জোরে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রলয় ঝড়ের বেগে নড়ে উঠল নাগেশ্বর ফুলগাছটা।
খ্যাংরাকাঠি-ভূত চেঁচাতে-চেঁচাতে বলল, ‘একটা লোক ভূত হতে যাচ্ছিল, তোমার আক্কেল হল না? তুমি তাকে বাঁচিয়ে দিলে? ওই ভ্যানরিকশার ন-জনই তো ভূত হয়ে যেত কাল রাতে? আমাদের ভূত-রাজ্যে আরও একজন ভূত বাড়ত। তা না করে তুমি ভূত-সমাজের ক্ষতি করেছ। তোমার গোটা ভূত-জীবনের জন্যে তোমাকে কঠিন শাস্তির বিধান হল।’
অবিনাশ কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘খ্যাংরাকাঠি-ভূত ভাই, তুমি আমাকে কী কঠিন শাস্তি দিচ্ছ? আমি সত্যি-ভূত হতে পারব তো?’
খ্যাংরাকাঠি-ভূত রেগেমেগে বলল, ‘তুমি মিথ্যে-ভূত! আর সত্যি-ভূত তুমি কোনো দিনই হতে পারবে না। তোমাকে সারাজীবন মিথ্যে-ভূত হয়েই থাকতে হবে ভূত-রাজ্যে।’
সেই থেকে আজও অবিনাশ মিথ্যে-ভূত হয়েই আছে ভূত-রাজ্যে। আমরা আমাদের চারপাশে ক্ষতি করে না এমন যে ভূতকে এখনও দেখতে পাই, সে আসলে অবিনাশেরই ভূত!