সত্যি ভূতের গল্প – বিমল কর

সত্যি ভূতের গল্প – বিমল কর

সারদাচরণ বকসির নাম তোমরা নিশ্চয় শোনোনি৷ আমরা ছেলেবেলায় শুনেছিলাম৷ তখন সারদাচরণকে বলা হত গোয়েন্দা সারদা৷ উনি লহরী সিরিজের ছ’আনা দামের বইগুলোতে হামেশাই দেখা দিতেন৷ ‘মারাকানার গুপ্তধন’, ‘তিন প্রহরে ঘণ্টা বাজে’, ‘পরশুরামের পিস্তল’—এ সব ছিল তাঁর বিখ্যাত বই৷ তবে সারদাচরণের আসল খ্যাতি ছিল ভূতের গল্প লেখায়৷ প্রায় প্রত্যেকটি কাগজেই তাঁর ভূতের গল্প বেরুত৷ দারুণ গল্প৷ অমন গল্প কেউ আর লিখতে পারত না৷ এক-একটা গল্প পড়ার পর দিন-দুই গা ছমছম করত৷

সারদাচরণ যে কবে লেখাটেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন তা জানতাম না৷ আর মানুষের ছেলেবেলা তো বরাবর থাকে না, আমরাও বড়সড় হয়ে চাকরি-বাকরি করতে লাগলাম৷

ঘটনাচক্রে সারদাচরণের সঙ্গে আমার আলাপ হল সেদিন৷ ঝাড়গ্রামে গিয়েছিলাম একটা কাজে৷ সারদাচরণের বাড়ির এক পাশেই আমায় থাকতে হয়েছিল৷ সেই সূত্রেই আলাপ, তারপর কথায়-কথায় ধরা পড়ে গেলেন এই সারদাচরণই সেই গোয়েন্দা সারদাচরণ৷ বৃদ্ধ মানুষটি এত চমৎকার, আর গল্প-গুজবে এমন পাকা যে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম৷

বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল৷ কার্তিক মাসের ঠাণ্ডা পড়েছে সামান্য৷ সন্ধে হয়ে গিয়েছিল৷

কথায়-কথায় আমি বললাম, ‘‘আপনি ভূতের গল্প লেখা কবে ছাড়লেন?’’

‘‘অনেক কাল আগে৷’’

‘‘ছাড়লেন কেন? দারুণ লাগত আপনার ভূতের গল্প৷ দু’-একটার কথা এখনো মনে আছে৷’’

সারদাচরণ হাসলেন৷ বললেন, ‘‘কেন ছাড়লাম জানো? একবার এক অদ্ভুত কাণ্ড হল৷ সেই থেকে ছেড়ে দিলাম৷’’

‘‘কী কাণ্ড?’’

‘‘শুনতে চাও?’’

‘‘বাঃ, শুনব না কেন? আপনি বললেই শুনব৷’’

সারদাচরণ একটু চুপ করে রইলেন৷ তারপর শুরু হল তাঁর গল্প :

সেটা নাইনটিন ফরটি-টুয়ের গোড়া হবে৷ তখন সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের পিক পিরিয়ড৷ কলকাতা থেকে লোকজন সব পালিয়ে গিয়েছে বোমার ভয়ে৷ খাঁ-খাঁ করছে শহর৷ ব্ল্যাক-আউটের চোটে কলকাতা সন্ধে হতে না হতেই অন্ধকার৷ ঠুঙি-পরানো গ্যাসের আলো জ্বলে রাস্তায়—তাও সিকি মাইল অন্তর৷ আমি কিন্তু কলকাতা ছেড়ে পালাইনি৷ কেমন করে পালাব বলো? পেট চালাতে হবে তো! পল হ্যামলিন কোম্পানিতে চাকরি করি, তারা খুব কড়া ধাতের৷ থাকতাম শীলবাবুর হোটেলে৷ মির্জাপুর স্ট্রিটে৷ চাকরি করি, লহরীর ছ’আনা সিরিজের বই লিখি, আর বাচ্চাদের কাগজে গল্প৷ ভূতের গল্পই বেশি৷ বড়দের কাগজেও লিখেছি দু-চারটে৷

একদিন হোটেল থেকে বেরিয়ে খানিকটা পায়চারি করে কলেজ স্কোয়ারে গিয়ে বসলাম৷ একটু-একটু চাঁদের আলো, শীত পালাই-পালাই করছে, বেশ লাগছিল৷ আমার বরাবরই চুরুট খাবার অভ্যেস৷ নতুন একটা চুরুট ধরিয়েছি, এমন সময় কে যেন এসে পাশে বসল৷

কলকাতায় তখন সন্ধের পর লোকজন বড় একটা বেরুত না৷ কোথায় বা যাবে অন্ধকারে! পাড়ার মধ্যেই সিনেমা-থিয়েটারে যেত, বা বন্ধু-বান্ধবের কাছে৷ কলেজ স্কোয়ার একেবারেই ফাঁকা৷ দু-চারজন আমারই মতন আছে হয়তো, চোখে পড়ে না৷

পাশে এসে যে লোকটি বসল তাকে আমি নজর করলাম৷ লিকলিক করছে রোগা, গায়ের রং কালোই মনে হল৷ লম্বা ধরনের একটা জামা পরেছে৷ সেটা কোট না আলখাল্লা বুঝতে পারছিলাম না৷

একটু আলাপ জমাবার চেষ্টা করলাম৷ লোকটা জবাবই দেয় না কথার, শুধু হ্যাঁ আর না৷ মনে হল লোকটা ভীষণ বিরক্ত হয়ে রয়েছে৷

আমারও কেমন জেদ ধরে গেল৷ লোকটাকে কথা না বলিয়ে ছাড়ব না৷ তাকে নানারকম প্রশ্ন করতে লাগলাম, আজে-বাজে যা মুখে এল, লোকটারও সেই একই রকম জবাব, হ্যাঁ আর না৷

আমি যখন হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিচ্ছি তখন লোকটা আমায় চমকে দিয়ে একটা কথা বলল৷ কী বলল জান?

বলল, আমাকে সে জানে৷ আমার নাম সারদাচরণ বকসি৷ আমি শীলবাবুর হোটেলে থাকি৷

শুনে আমি অবাক৷ লোকটা কি গোয়েন্দা নাকি?

তারপরই লোকটা বলল, আপনি মশাই যা জানেন না তা লেখেন কেন? ফাজলামি পেয়েছেন?

আমি একেবারে বেইজ্জত৷ বলে কী লোকটা! চটেমটে বললুম, ‘আমি কী লিখি বলুন তো?’

‘যত্ত ছাঁই-পাঁশ৷’

শুনলে কথা! রাগে গা জ্বলে উঠল৷ মনে হল, এক চড়ে লোকটার বদন বিগড়ে দিই৷ একেবারে অসভ্য৷ কোনোরকমে রাগ চেপে বললাম, ‘মশাইয়ের কি ছাই তোলার অভ্যেস আছে?’

‘আমার কী আছে আপনার জেনে দরকার নেই৷…বেশ তো করে খাচ্ছিলেন তিন রাতে তিন খুন, মৃত্যুফাঁদ লিখে—গল্পের গরু তরতর করে গাছে উঠছিল তা মরতে আমাদের দিকে হাত বাড়ালেন কেন?’

রাগে পিত্তি জ্বলছিল৷ আমার আবার বদ-অভ্যেস ছিল৷ রাগের মাথায় তিন পয়েন্ট পাঁচ পয়েন্টও চালিয়ে দিতাম—মানে ঘুঁষি৷ কিন্তু রাগ হলেও লোকটার কথাবার্তা শুনে একটু ঘাবড়েও যাচ্ছিলাম৷ বললাম, ‘আপনাদের দিকে হাত বাড়ালাম মানে?’

‘একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা সাজছেন যে! বলি এই সেদিন রংবাহার কাগজে কী লিখেছেন ওটা? ভূত বলে তার জাত নেই—যা খুশি করলেই হল? কোথায় আপনি দেখেছেন ভূতে রিকশা টানছে? ছি ছি, বলিহারি আপনার আক্কেল মশাই, রাত একটায়—অমন শীতের দিনে আপনি ভূতকে দিয়ে নিমতলা স্ট্রিট থেকে বেলগেছে পর্যন্ত রিকশা টানালেন! আপনি নিজে পারবেন টানতে? দেড়-দু মাইল রাস্তা…ছি ছি ছি…!’

আমি একেবারে থ’ হয়ে গেলাম লোকটার কথা শুনে৷ কথাটা তো মিথ্যে বলেনি৷ একেবারে হালে রংবাহার পত্রিকায় আমার একটা ভূতের গল্প বেরিয়েছে তাতে বাস্তবিক এক ভূতুড়ে রিকশা আর রিকশাঅলার কথা রয়েছে৷

রাগ একটু কমল৷ বললাম, ‘কেন, ভূতে রিকশা টানতে পারে না?’

‘না৷ কভি নেহি…আপনি মশাই বড় বেএক্কেলে৷ নিজে ফুসফুস করে চুরুট ফুঁকছেন—কই আমাকে তো ভদ্রতা করে একটা দিচ্ছেন না? একটা চুরুট ছাড়ুন!’

এবার আমার হাসি পেল৷ আচ্ছা মজার লোক তো৷

একটা চুরুট তাকে দিলাম৷ দেশলাইও৷

লোকটা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে চুরুটটা ধরিয়ে নিল৷

আমি বললাম, ‘আপনি আমার গপ্প-টপ্প পড়েন?’

‘বাধ্য হয়ে৷’

‘কেন, বাধ্য হয়ে কেন?’

‘ওটা আমার চাকরি৷’

আপনি কি রংবাহাদুর কাগজে, কাজ করেন? রণদাবাবুর…

‘না না, রণদার-টনদার কিছু নয়৷ ওই রণদাবাবুকেও একদিন শিক্ষা দিতে হবে৷ বাপের পয়সায় কাগজ করে গাধাটা সম্পাদক হয়েছে৷ ওর বাবা গঙ্গাবাবু প্রায়ই দুঃখ করে বলেন, ছেলেটার কপালে অশেষ দুর্গতি লেখা আছে৷’

বলে কী লোকটা? রণদাবাবুর বাবা মারা গিয়েছেন বছর কয়েক, তাঁর সঙ্গে এই লোকটার দেখা হবার কথা নয়৷ ডাহা মিথ্যে বলছে৷ বললাম, ‘রণদাবাবুর বাবা তো স্বর্গে!’

‘আমি কি মর্ত্যে থাকার কথা বলছি! মায়ের কাছে মামারবাড়ির গল্প!’

লোকটার কথাবার্তা থেকে মনে হচ্ছিল, ও যেন আমাকে ধমকাবার জন্যেই এসেছে৷ বলতে যাচ্ছিলাম, রণদাবাবুর বাবার সঙ্গে আপনার কি কোনো টেলিফোন কানেকশান আছে?—আমাকে কথা বলতে না দিয়ে লোকটা বলল, ‘ক’দিন আগে বেণুবীণা কাগজে আপনি কী অখাদ্য লেখাই লিখেছেন! ছ্যা ছ্যা! রেল স্টেশনের ওয়েটিংরুমে ভূত ঢুকিয়েছেন! তাও আবার গোসলখানায়! কেন মশাই, ভূত কি রেলের জমাদার না ঝাড়ুদার? আপনার মতো নিরেট মাথা আর দেখিনি!’

আমি হাঁ করে লোকটাকে দেখতে লাগলাম৷ অন্ধকারে যেটুকু ঝাপসা জ্যোৎস্না ফুটেছে তাতে তাকে অস্পষ্টই দেখাচ্ছিল৷ লোকটা দেখি টপাটপ গল্প বলে দিচ্ছে৷ হঠাৎ আমার মনে হল, রংবাহার আর বেণুবীণা—কাগজ দুটো আলাদা হলেও ছাপা হয় একই প্রেসে৷ লোকটা নিশ্চয় ছাপাখানার লোক! ছাপাখানায় কাজ করে!

‘আপনি কি প্রেসে কাজ করেন? কম্পোজিটার?’ আমি বললাম৷

‘কম্পোজিটার! কেন?’

‘না, বলছিলাম—মানে ছাপাখানার কম্পোজিটার হলে তাকে সবই পড়তে হয়৷ আপনি পটাপট এত গল্পের কথা বলে যাচ্ছেন—!’

‘চ্যাঙড়ামি করছেন!’ লোকটা খেঁকিয়ে উঠল৷ ‘কম্পোজিটার! আপনার সব ক’টা ভূতের গল্পের ভূতদের কথা আমি বলে দিতে পারি৷ বলব?’ বলে লোকটা চুরুটে গোটা-পাঁচেক টান মারল৷ কাশল খকখক করে৷ তারপর বলল, ‘আপনার একটা ভূত ট্রাফিক পুলিশের কাজ করেছে লোয়ার সারকুলার রোডে, তার জন্য দুটো বাস মুখোমুখি ধাক্কা লাগিয়েছে৷ এ-রকম হয় না৷ ভূতরা মানুষের মতন অত বাজে ট্রাফিক পুলিশ হয় না৷ আপনি আর-একটা যা কাণ্ড করেছেন, লাশকাটা ঘরে একটা ভূতকে দিয়ে অনবরত হা-হা-হি-হি করে হাসিয়েছেন৷ ভূতরা আপনাদের মতন হ্যা-হ্যা করে হাসে না, তারা দাঁত বার করে হাসতে শেখেনি৷ লাশকাটা ঘর দেখেছেন কখনো জন্মে? তার গন্ধ শুঁকেছেন? গল্পটা পড়ে আপনাকেই কাটতে ইচ্ছে করছিল৷ আপনি অদ্ভুত লোক মশাই, ছাই ফেলতে ভাঙা কুলোর মতন—যত রাজ্যের বাজে নোংরা কুচ্ছিত কাজ ভূতদের দিয়ে করিয়েছেন৷ যেমন মানুষরা কত ভালো, তারা সব ভালো ভালো কাজ করে৷ বোলপুরের সেই গল্পটায় একটা বুড়ো ভূতকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে আপনি তেলেভাজা খাইয়েছেন, আর নিজেরা খেয়েছেন ওমলেট৷ তার রেজাল্ট কেমন হয়েছিল মনে আছে তো? কলেরা হতে হতে বেঁচে গিয়েছেন!…আপনি খুবই বাজে লোক৷ ভূতকে দিয়ে সংস্কৃত বলিয়েছেন৷ পৃথিবীতে কোনো ভূতই দু-তিনটে ভাষা বলতে পারে না৷ সংস্কৃত পারে না, পুস্তু পারে না, জার্মান পারে না৷ কেন পারে না জানেন না, আপনাকে জ্ঞান দেওয়া বৃথা৷ আপনি গবেট টাইপের৷ যাকগে, দুটো কথা বলতে এসেছি, বলে চলে যাই৷ দেরি হয়ে যাচ্ছে৷’

আমি চুপ৷ মুখে কথা আসছিল না৷

লোকটা বলল, ‘শুনুন৷ যা বলছি তার অন্যথা করবেন না৷ খুন, পিস্তল, গুমখুন—এ-সব নিয়ে যত খুশি লিখুন, কেউ কিছু বলতে আসছে না৷ কিন্তু ভূত নিয়ে নয়৷ আপনারা বাঙালি লেখকরা ভূত নিয়ে ভেলকির গল্প ফাঁদছেন, না-হয় হাসি-মসকরা করছেন৷ সাহেবরা এমন নোংরা কাজ করে না৷ তাদের ভূতরা ভদ্রলোক৷ দু’চারটে হাই ক্লাসের ভূতের গল্প মেরে লিখলেও তো পারেন! যত্ত সব! আচ্ছা চলি, অনেক দূর যেতে হবে৷ তবে যা বললাম মনে রাখবেন৷ আর ভূতের গল্প লিখবেন না৷ লিখলে এমন শিক্ষা পাবেন যে নবাবের মতন পার্কে বসে বসে চুরুট ফুঁকতে হবে না!’

লোকটা উঠে দাঁড়াল৷

তাড়াতাড়ি বললাম, ‘আপনার পরিচয় স্যার?’

‘পরিচয়? আমার পরিচয়, আমি ভূতদের রিপ্রেজেনটেটিভ৷ দূত বলতে পারেন৷ ওখানকার সেনসার অফিসের একজন জুনিয়র অফিসার৷ সদ্য গিয়েছি৷ আরে মশাই, গত বছর মিলিটারিতে চাকরি পেয়েছিলাম৷ ফোর্ট উইলিয়ামে আমার পোস্টিং ছিল৷ মিলিটারি সেনসার অফিসে৷ এক হুদো আর্মি অফিসার আমায় তার ট্রাকে চাপা দিয়ে দিল৷ সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চত্ব৷ সাইডে যেতেই ওরা আমাকে ওদের সেনসার অফিসে কাজে বসিয়ে দিল৷ যাকগে, চলি৷ আপনি ভূতদের মান-সম্মান ইজ্জত তো নষ্ট করেছেনই, তার ওপর বাচ্চা-কাচ্চচারাও যে ভূতকে শ্রদ্ধার চোখে দেখবে—তারও বারোটা বাজিয়েছেন৷ আমায় বলা হয়েছিল—আপনাকে ওয়ার্নিং দিয়ে দিতে৷ সাবধান করে দিলাম আপনাকে৷ আচ্ছা চলি৷’

লোকটা চলে গেল৷

আমি হাঁ করে বসে থাকলাম৷

সারদাচরণ তাঁর গল্প শেষ করলেন৷

আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘‘লোকটা কে?’’

‘‘জানি না বাপু৷ তবে ভূতের গল্প আর লিখিনি৷’’

‘‘ভয়ে?’’

‘‘না না, ভয়ে নয়৷ মনে হল, আমি ভূতের গল্প লিখলে লোকটার অন্ন মারা যাবে৷’’ সারদাচরণ হেসে উঠলেন৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *