সত্যি নয়

সত্যি নয়

গল্পটা গুপির কাছে শোনাঃ

দলের মধ্যে মেলা লোক ছিল– মেজোমামা, ভজাদা, জগদীশবাবু, গুপির সেজদা, গুপি আর শিকারিরা দু-জন। সারাদিন বনেজঙ্গলে পাখিটাখি আর মেলা খরগোশ তাড়িয়ে বেড়িয়ে সন্ধ্যের আগে সকলে বেজায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। জমিদারবাবুর ঘোড়াগাড়ি এসে বাজপড়া বট গাছের তলায় অপেক্ষা করে থাকবে, ওঁরা জন্তুজানোয়ার মেরে ক্লান্ত হয়ে গাড়ি চেপে জমিদারবাড়ি যাবেন। সেখানে স্নানটান করে রাতে খুব ভোজ হবে। কিন্তু কী মুশকিল, আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করবার পরও যখন গাড়ি এল না, শিকারিরা দু-জন খোঁজ করবার জন্য এগিয়ে গেল। এরা সব গাছতলায় পা মেলে যে-যার পড়ে রইল।

আরও মিনিট কুড়ি গেল, দিব্যি চারদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে, তখন জগদীশবাবু লাফিয়ে উঠে পড়লেন। ওই তোরা, এ জঙ্গলে নিশ্চয়ই বাঘ আছে। খিদের সকলের পেট জ্বলে যাচ্ছে, তার উপর দারুণ পায়ে ব্যথা, কিন্তু ওকথা শুনেই সবাই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। বেশ তারার আলো হয়েছে। তার মধ্যে মনে হল যেন ডান দিকে খানিকটা এগিয়ে গেলে জঙ্গলটা পাতলা হয়ে এসেছে, সেখানে যেন আলো বেশি। সেদিকে খানিকটা যেতেই সবাই অবাক হয়ে দেখল সামনেই বিশাল একটা পোড়ো বাড়ি।

মেজোমামা তো মহা খুশি। বাঃ, খাসা হল, এবার শুকনো কাঠকুটো জ্বেলে দুপুরের খাবার জন্য যে বড়ো হাঁড়িটা আনা হয়েছিল তাতে করে খরগোশের মাংস রাঁধা যাবে। নিদেন একটু বিশ্রাম তো করা যাবে। সবাই খুশি হয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।

গেটটা কবে থেকে ভেঙে ঝুলে রয়েছে, একটু একটু বাতাস দিচ্ছে, তাতে কাচ কোচ শব্দ করছে। বিশ্রী লাগে। পথে সব আগাছা জন্মে গেছে, বাগানটা তো একেবারে সুন্দরবন। প্রকাণ্ড বাড়ি, প্রকাণ্ড বারান্দা। বারান্দার উপর উঠে জগদীশবাবু শ্বেত পাথরের মেজের উপর বেশ করে। পা ঘষে কাদামাটি পরিষ্কার করে ফেললেন। গুপির সেজদা একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে বললে, জায়গাটাকে সেরকম ভালো মনে হচ্ছে না। সেজদার যেমন কথা, ঘোর জঙ্গলের পোডড়া বাড়ি আবার এর থেকে কত ভালো হতে পারে। গুপি আবার বললে, এ বাড়িটার বিষয় আমাদের চাকর হরি একটা অদ্ভুত গল্প বলছিল। এদিকে কেউ আসে না।

একেবারে ভাঙা বাড়ি কিন্তু নয়। দরজাগুলো সব বন্ধ রয়েছে, কেউ বাস করাও একেবারে অসম্ভব নয়। তখন সকলে মিলে মহা হাঁকডাক লাগিয়ে দিলেন। কোনো সাড়াশব্দ নেই। সকলের যে ঠিক ভয় করছিল তা নয়, কিন্তু কীরকম যেন অস্বস্তি লাগছিল, তাই সব এক জায়গায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেজোমামা বললেন, যা, যা, যেসব বীরপুরুষ, নে চল, দরজা ঠেলে খোল, রাঁধাবাড়ার আয়োজন করা যাক।

ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল, খালি খালি সব বিশাল বিশাল ঘর, ধুলোতে ঝুলেতে ভরা। সেকালের পুরোনো চকমেলানো বাড়ি, মাঝখানে বিরাট এক উঠোন তার মধ্যে আবার একটা লেবু গাছ একটা পেয়ারা গাছ। সবটাই অবিশ্যি আবছায়া আবছায়া। উঠোনের পাশেই রান্নাঘর, সেখানে উনুন তো পাওয়া গেলই, এক বোঁচকা শুকনো খরখরে কাঠও পাওয়া গেল। মেজোমামা দেখতে দেখতে জায়গাটা খানিকটা ঝাড়পোঁছ করে নিয়ে রাঁধাবাড়ার ব্যবস্থা করতে লাগলেন। তখনও একটু একটু আলো ছিল, কিন্তু ঘরের ভিতর বেশ অন্ধকার। তবে ওঁদের সকলের সঙ্গেই পকেটলণ্ঠন ছিল। এখন একটু জল চাই।

আর সকলে কেউ-বা উঠোনের ধারে জুতো খুলে পা মেলে দেয়াল ঠেসান দিয়ে বসে পড়েছে, আবার কাউকে যেমন গুপিকে, গুপির সেজদাকে খরগোশ কাটবার জন্য লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারাও বলছে, জল না হলে পারবে না।

অগত্যা মেজোমামা টিফিন ক্যারিয়ারের বড়ো ডিবেটা আর একগাছি সরু দড়ি নিয়ে জলের চেষ্টায় গেলেন।

রান্নাঘরের ওপাশে সবজিবাগান ছিল, তার কোনায় একটা কুয়ো দেখা গেল। মেজোমামা খানিকটা এগিয়ে গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। আঃ, বাঁচা গেল, এখানে তাহলে তোকজন আছে। যা একটা থমথমে ভাব, আর গুপিটা যা বাজে বকে যে আর একটু হলে ভয়ই ধরে যেত! এই তো এখানে মানুষ রয়েছে। একটা ছোকরা চাকর ধরনের লোক কুয়োর আশেপাশে কী যেন আঁতিপাঁতি করে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

মেজোমামার হাতে আলো দেখে সে ভারি খুশি হয়ে উঠল, যাক আলোটি এনে বড়োই উবগার করলেন বাবু, আমাদের বাবুর মাদুলিটা কোথাও পাচ্ছি না। বাবু আর আমাকে আস্ত রাখবেন না।

মেজোমামার মনটা খুব ভালো তিনিও মাদুলি খুঁজতে লেগে গেলেন, হারে কীরকম মাদুলি রে? এখানে আবার তোর বাবুও বাস করেন নাকি? আমরা তো মনে করেছিলাম বুঝি পোড়ো বাড়ি। চাকরটা বললে, আরে ছছ, ছছ! পয়সার অভাবেই পোড়ো বাড়ি। ওই মাদুলিটা আমার বাবুকে একজন সন্ন্যাসী দিয়েছিল। ঔষধ হাতে বাঁধা থাকলে যে ঘোড়াতেই বাজি ধরেন সেটাই জিতে যেত। এমনি করে দেখতে দেখতে কেঁপে উঠলেন, টাকার গাদার উপর বসে থাকলেন। দেখি, পাটা সরান এখানটায় একটু খুঁজি। হ্যাঁ তারপর একদিন আমাকে বললেন–বড্ড জং ধরে গেছে রে, ওটাকে মেজে আন। মাজলামও। তারপর যে বিড়ি ধরাবার সময় কোথায় রাখলাম আর খুঁজে পাচ্ছি না। সেই নাগাড়ে খুঁজেই বেড়াচ্ছি, এদিকে বাবুর সর্বনাশ হয়ে গেল। যে ঘোড়াতেই বাজি ধরেন সেই হয় মুচ্ছো যায়, নয় বসে পড়ে, নয় খানিকটা গিয়ে আবার ফিরে আসে। এমনি করে বাড়ি গেছে, বাগান গেছে, টাকাপয়সা গয়নাগাটি, হাতিঘোড়া সব গেছে। এখন দু-জনে দিনরাত সেই মাদুলিই খুঁজে বেড়াই। উপর থেকে ভাঙা হেঁড়ে গলায় শোনা গেল,

পেলি রে? না সার। বলি খুঁজছিস তো নাকি খালি গল্পই কচ্ছিস? বলতে বলতে একজন ফর্সা মোটা আধবুড়ো লোক দোতলার বারান্দার ধারে এসে দাঁড়ালেন, দেখ দেখ, ভালো করে দেখ, যাবে কোথায়? ঠিক সেই সময় মেজোমামা একটু ঠেস দিয়ে পা-টা আরাম করবার জন্য হাত বাড়িয়ে যেইনা পাশের বারান্দার থামটাকে ধরেছেন অমনি তার ছোট্ট কার্নিস থেকে টুপ করে পুরোনো লাল সুতোয় বাঁধা একটা মাদুলি মাটিতে পড়ে গেল। সুতোটা আলগা হয়ে গেল, মাদুলিটা গড়িয়ে চাকরটার পায়ের কাছে থামল। চাকরটার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসবার জোগাড়, দেন কত্তা দুটো পায়ের ধুলো দেন বাঁচালেন আমাদের। উপর থেকে তার বাবুও দুড়দাড় করে পুরোনো শ্বেতপাথর-বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে ছুটতে ছুটতে নেমে এলেন।পেইছি! আর আমাদের ঠেকায় কে? বড়ো উপকার করলেন ব্রাদার, আসুন একটু কোলাকুলি করি, বলে দুই হাত বাড়িয়ে মেজোমামাকে জড়িয়ে ধরেন আর কী, এমন সময় ও মেজোমামা, ও নেপেনবাবু, কোথায় গেলেন, আর জল দরকার নেই, শিকারিরা ঘোড়াগাড়ি নিয়ে এসে হাজির হয়েছে। বলে দলে দলে সব এসে উপস্থিত। মেজোমামা চমকে দেখেন চাকরটা, তার বাবু আর মাদুলি কিছুই কোথাও নেই। খালি পায়ের কাছে লাল সুতোটা পড়ে রয়েছে।

আস্তে আস্তে সেটা কুড়িয়ে বললেন, চ, খিদেও পেয়েছে ভীষণ?

পথে যেতে শিকারিরা বললে, সাহস তো আপনাদের কম নয়, ওটা ভূতের বাড়ি, তা জানতেন না? বহুকাল আগে এক জমিদার ছিলেন, রেস খেলে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছিলেন, তার বাড়ি। কেউ ওখানে যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *