সত্যিকারের বাঘ

সত্যিকারের বাঘ

পুপলুর বয়স তিন বছর এক মাস, কিন্তু সে রাস্তায় অন্যান্য ছোট ছেলেমেয়ে দেখলেই বলে, ওই যে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা খেলা করছে৷ পুপলু এক থেকে দশের বেশি গুনতে পারে না কিন্তু সে হাজারিবাগে গিয়ে এক হাজারটা বাঘ দেখতে চায়৷

পুপলু আগে ছবিতে পাহাড় দেখেছিল৷ এবার সে সত্যিকারের পাহাড় দেখল৷ মায়ের কোলে না উঠেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল ক্যানারি হিলের চুড়োয়৷ তখন থেকে তার ধারণা হল, সব পাহাড়েই সিঁড়ি থাকে৷ পুপলুর মা এ বিষয়ে আপত্তি করলেই সে রেগে যায়, ভীষণ চ্যাঁচামেচি করে নালিশ জানায় বাবার কাছে৷ একদিন সে হিমালয় পাহাড়েও সিঁড়ি দিয়ে উঠবে৷

পুপলু ছবিতে শুয়োর দেখেছিল, এবার দেখল সত্যিকারের শুয়োর৷ গরু-ছাগলের মতন রাস্তায় তারা ঘুরে বেড়ায়৷ শুয়োরেরা খুব ভিতু—এমনকি পুপলুর মতন ছোট বাচ্চা তাড়া করলেও তারা পালায়৷

পুপলুদের বাড়ির বাগানে একটা ছাগল বাঁধা থাকে৷ পুপলু সেটার পেটে সুড়সুড়ি দিয়ে সুকুমার রায়ের ছড়ায় জিজ্ঞেস করে, ‘ওরে ছাগল, বল তো আগে, সুড়সুড়িটা কেমন লাগে?’ ছাগলটা বিরক্ত হয়, শেষ পর্যন্ত ভ্যাঁচ শব্দ করে হেঁচে দেয়৷ পুপলু খুব খুশি, সুড়সুড়ি দিলে ছাগলদের হাসি পায় না, হাঁচি পায়৷

কিন্তু এক হাজারটা দূরের কথা, একটা বাঘও তার দেখা হল না৷ যখন তার ক্ষিদে পায় কিংবা মা যখন পুপলুকে তেল মাখিয়ে চান করাতে যান তখন সে বাঘ দেখার বায়না তুলে কান্নাকাটি করে৷ তার মা-বাবা তাকে মিছিমিছি বাঘ দেখাবার কথা বললেও সে ভোলে না৷

তবে সে একদিন সত্যি সত্যি বাঘ দেখে ফেলল৷ বনের মধ্যে নয়, রাস্তায় নয়, বাজারে জুতোর দোকানে৷ জুতোর দোকানে ঢুকেই পুপলু ভয়ে বাবা-মায়ের হাত চেপে ধরেছে৷ চোখ দুটো গোল গোল৷ দোকানের ঠিক মাঝখানে একটা চিতা বাঘ৷ জীবন্ত নয় অবশ্য তবে একটা গোটা বাঘকেই সাজিয়ে রাখা হয়েছে৷ তার চোখ, চামড়া, লেজ সবই অবিকল৷

পুপলুর ভয় কাটতে একটুক্ষণ সময় লাগল৷ তারপর ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, বাবা, ওটা সত্যিকারের বাঘ? তার বাবা বললেন, হ্যাঁ, সত্যিকারের! দেখছ না, তোমার দিকে কেমন তাকিয়ে আছে! ওর গায়ে হাত দাও, কিচ্ছু বলবে না, ও খুব ভালো বাঘ৷ পুপলু আস্তে আস্তে একটু হাত ছুঁইয়েই সরিয়ে নিল৷

তারপর থেকে পুপলুর কী উৎসাহ! মালির ছেলে, রিকশাওয়ালা, পিওন— সববাইকে ডেকে বলে, জানো, আমি সত্যিকারের বাঘ দেখেছি৷

ক’দিন পরে পুপলুর মাসিমারা বেড়াতে এল৷ পুপলুর মাসতুতো দিদি মুনুয়ার বয়স নয় বছর৷ সে ইংরেজি ইস্কুলে পড়ে, কত কি জানে! আর সবার কাছে সে ছোট্ট মেয়ে, কিন্তু পুপলুর তো দিদি! পুপলুকে সে কত কিছু শেখায়, কুয়োর কাছে যেতে বারণ করে, ব্যাডমিন্টনের ব্যাট কি করে ধরতে হয়, তাই দেখিয়ে দেয়!

পুপলু তাকে মাথা নেড়েচেড়ে বলল, তুমি তো বাঘ দ্যাখোনি৷ আমি বাঘ দেখেছি৷

মনুয়া বিশ্বাস করতে চায় না, জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

জুতোর দোকানে৷ সত্যিকারের—এই অ্যাত্ত বড়৷

জুতোর দোকানে বাঘ শুনে মুনুয়া তো হেসেই বঁচে না৷ তার কথা অবিশ্বাস করায় পুপলু খুব রেগে যায়৷ সে বাবাকে-মাকে সাক্ষী মানতে চায়৷

তারপর আর একদিন ওদের জুতোর দোকানে নিয়ে যেতেই হয়৷ মুনুয়াও বাঘ দেখে প্রথমটা একটু থমকে যায়৷ কিন্তু ভয় পায় না৷ আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে বলল, এ-মা, এ-তো সত্যিকারের বাঘ নয়! মরা বাঘ—

পুপলু প্রবল বিশ্বাসের সঙ্গে বলে, হ্যাঁ, সত্যিকারের৷

মুনুয়া খুব হাসতে থাকে৷ পুপলুর অভিমান হয়৷ চোখ দুটো ফুলো ফুলো হয়ে ওঠে, ঠোঁট কাঁপে৷

তখন সে বড়দের দলে পাবার জন্য তার মাসিকে জিজ্ঞেস করল, বড়-মা, এটা সত্যিকারের বাঘ নয়? ওই যে সত্যি চোখ, সত্যি সত্যি ল্যাজ—

মাসি বললেন, হ্যাঁ, সত্যিকারের!

তবে যে মুনুদিদি বলল, মরা?

পুপলু মরে যাওয়ার মানে জানে না৷ সে জেনেছে, পাখিদের মরে যাওয়া মানে স্বর্গে যাওয়া৷ পিঁপড়েরাও জুতোর তলায় চাপা পড়লে স্বর্গে যায়৷ এই বাঘটা তো স্বর্গে যায়নি, এখানেই আছে৷

পুপলুকে মরে যাওয়ার মানে কেউ বোঝাতে চায় না৷ যতদিন ও কথাটার মানে সে নিজে থেকে বুঝতে না পারে, ভালোই তো৷ সবাই বলল, না না, মরা নয়, সত্যিকারের বাঘ, ওই তো, তোমার দিকেই তাকিয়ে আছে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *