সত্যবতীর বিদায়

সত্যবতীর বিদায়

শীতের এক সুগভীর কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরবেলায় অত্যন্ত ময়লা কাপড় দিয়ে বাঁধা একটা পুঁটুলি হাতে করে এক বৃদ্ধা, রাজকুমার রায়ের প্রকান্ড ফটকওয়ালা বাড়ির ভিতরের উঠোনে গিয়ে দাঁড়াল। প্রথমে ঢুকতে একটু দ্বিধা করেছিল। কারণ এই বাড়িতে সে এই প্রথম পদার্পণ করছে, কিন্তু মুহূর্ত পরেই সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে এক নিঃসঙ্কোচ কলেজ-বালিকার মতোই চাকর-বাকরের ছুটোছুটি আর কোলাহলে কাতর উঠোনের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। বৃদ্ধার চেহারা এমন কদাকার যে হঠাৎ দেখলে ভয় হয়। উঁচু কপাল, তোবড়োনো নাক, মাংসল মুখ অথচ চোখদুটি অত্যন্ত ছোটো এবং গর্তে বসানো। মাথার চুল ছোটো করে ছাঁটা। বয়স পঞ্চাশের বেশি হলেও গায়ের চামড়া এখনও যথেষ্ট ঢিলে হয়ে আসেনি।

বৃদ্ধা কারোর আশায় এদিক-ওদিক চেয়ে শেষে একটা চাকরকে ডেকে বলল, আচ্ছা, এটা আমাদের রাজুর বাড়ি না?

রাজু! রাজু কে! এই বলে চাকরটা আবার নিমেষে কোথায় উধাও হয়ে গেল।

রাজু কে! তবে কি এটা রাজুর বাড়ি নয়? বৃদ্ধা মনে মনে খানিকটা অসহায় বোধ করল। কিন্তু বাইরে সে ভাব সম্পূর্ণ ঢেকে রেখে আর একজনকে ডেকে বলল, আচ্ছা, এটা আমাদের রাজুর বাড়ি নয়?

ঝি মতির মা খনখন করে বলল, রাজু-টাজু কেউ এখানে নেই গো।

কিন্তু এমন সময় ভেতর থেকে মনোরমা বললো, কে রে মতির মা? এই বলে আর মতির মার উত্তরের অপেক্ষা না করে ধীরে ধীরে ভারী শরীরখানা নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। তার চোখে চশমা, হাতে অনেকগুলি চুড়ি, গায়ে আঁটো সাটো সেমিজ, চওড়া নকশি পেড়ে শাড়ি, বুড়িকে দেখে মনোরমা আশ্চর্য হল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ সে বিস্ময়ের ভাব দমন করে ফেললে, বরং চোখের ওপর ভ্রূ কুঁচকে এসেছে।

একগাল হেসে সত্যবতী বলল, বউ, কেমন আছো? আচ্ছা তোমাদের কতকল দেখিনে, তোমাদের কথা ভেবে হয়রান হয়ে গেলুম, ঈশ্বরকে কত বলি, ঠাকুর আমার এমন ছেলে, ছেলের বউ, সব থাকতে আমি ষাটের বুড়ি কেন এত কষ্ট করে মরি? ছেলে তো আমার এমন নয় যে কক্ষনো ডাক-খোঁজ করে না, আমার রাজুর মতো ছেলে কারোর হয়? কক্ষনো হয় না, এই আমি বলে দিচ্ছি। এই তো সেবার এক দুই তিন চার, সত্যবতী হাতের কর গুণে বলল, পাঁচটা টাকার জন্যে দু-অক্ষর লিখে পাঠিয়ে দিলুম, আর অমনি তোমায় কী বলব বউ—আর অমনি যেন হাওয়ার গাড়িতে চড়ে টাকা এসে হাজির! বলতে বলতে সত্যবতীর দম বন্ধ হয়ে এল।

ইতিমধ্যেই প্রায় সারা বাড়িতে সাড়া পড়ে গিয়েছিল; বাড়ির সমস্ত ছেলেমেয়েরা মন্টু-ঘেন্টু-জিতু-বেলা-হেলা ইত্যাদি সবাই এসে বুড়িকে ঘিরে দাঁড়াল। সকলের ছোটো জিতু এই কুৎসিত বুড়িকে আর কখনো দেখেনি, সে মনোরমার আঁচল ধরে নাকি সুরে বলল, কে ঠাকুরমা?

সত্যবতী হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে বলল, আই ভাই আয়, তোদের নাম কী রে ভাই? আরে, আয় না? এই রাজকন্যার মতো সুন্দরী বউকে দেখে পছন্দ হচ্ছে না? সত্যবতী একটু পরিহাস করল। ওদিকে মনোরমার শীতলতাও তার দৃষ্টি এড়ায়নি। সে তাকে খুশি করবার জন্যে বলল, তোমাকে ভারী শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে বউ। কোনো অসুখ করেছে বুঝি?

মনোরমা সংক্ষেপে গম্ভীর স্বরে বলল, না, কোনো অসুখ করেনি।

ওপরে পড়ার ঘরে বসে ইন্দু প্রাণপণে কলেজের পড়া মুখস্থ করছিল। নতুন মানুষের সাড়া পেয়ে বারান্দার ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বলল, মা, কে এসেছে?

মা একবার ওপর দিকে চাইলো মাত্র, কিছু বলল না। সত্যবতী চোখ বড়ো করে বলল, বউ, আমি বলে দিচ্ছি, তোমার কোনো অসুখ করেছে, তুমি না বললে আমি শুনব কেন? দাঁড়াও আমি ওষুধ দিয়ে দেব। সত্যবতী বছর দুই আগে নাকি কালী পেয়েছিল, তাঁর আশীর্বাদে একটা মূল্যবান ওষুধও পেয়েছিল এবং সত্যবতী মনোরমাকে অভয় দিল।

মন্টুরা একেবারে হাঁ করে তার দিকে চেয়েছিল, এমন কদাকার চেহারা তারা ইতিপূর্বে আর কখনো দেখেনি। ছবিতেও এরকম চেহারা খুব কম দেখা যায়। দাঁত যা-ও আছে তাও এমন কালো যে দেখলে ঘেন্না করে। ঠোঁটের কোণ বেয়ে কী যেন পড়ছে।

–কিন্তু ছাইপোড়া কপাল আমার,—সত্যবতী বলা-নেই-কওয়া-নেই হঠাৎ কপালে করাঘাত করে বলল, হা-ঈশ্বর! যার জন্য এতদূর এলাম তাকেই ভুলে গিয়েছি। রাজু কোথায় বউ, আমার রাজু?

মনোরমা বসবার ঘর দেখিয়ে দিল।

সত্যবতী তরতর করে অমনি সেই ঘরের দিকে ছুটল, পুঁটুলিটা কোথাও রাখবার জায়গা এখনো হয়নি, আর রাখবেই বা কোথায়? কোথাও এতটুকু পরিষ্কার জায়গা আছে কি? সেটা কাঁধে করেই সত্যবতী বসবার ঘরে ঢুকল, কিন্তু ছেলের চেহারা দেখে তার চক্ষু স্থির, আহা কী চেহারা কী হয়েছে গো! ননীর শরীর যেন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেই তকতকে সোনার বরণ রংই বা কোথায়, মাথায় সেই গভীর কালো চুলই বা কোথায়? রাজকুমার চেয়ারে বসে অনেক খাতাপত্র দেখছেন, সামনেই দুটি চেয়ারে বসে আরও দুটি লোক। সেই লোকগুলির সামনেই সত্যবতী হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো, চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বললে, রাজু, তোর এ কী চেহার, হয়েছে বাবা? তোর এমন অসুখ আমায় আগে জানাসনি কেন? কেন জানাসনি বল? আমি কি তোর কেউ নই? ঈশ্বরকে কত বলি, হে ঠাকুর সবই তা দিয়েছে, তবে আর একটি মনোবাঞ্ছা যদি পূর্ণ করতে! আজ উনি বেঁচে থাকলে।

ব্যাপারটা প্রথমে রাজকুমার ভালো করে বুঝতেই পারেনি। হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিল। একটু পরে লজ্জায় আর রাগে মাটির সঙ্গে মিশে গেল। সত্যবতীকে দুহাত দিয়ে ধরে সে বলল, আহা, এখানে কেন মা? এখানে কেন মা? এখানে থেকে যাও, অন্যসময় হবে। সে সত্যবতীকে ঘরের বার করে দিল। সত্যবতী তখনো শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, একহাতে পুটুলিটা ধরে আর এক হাতে কাপড়ের আঁচল দিয়ে নাক-চোখ মুছতে লাগল।

দুর্ধর্ষ শক্তিমান কোনো লোককে কাঁদতে দেখলে যেমন হাসি পায়, এই কুৎসিত বুড়িকে শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে মন্টুদের হাসি পেল, তারা খিল খিল করে হাসতে লাগল।

এই দেখে সত্যবতীর রাগের সীমা নেই!

-আহা, হাসছিস কেন? আমরা গরিব বলে মানুষ নই বুঝি?

মনোরমা আর সহ্য করতে পারল না। বলল, দেখতেই তো পাচ্ছেন, কয়েকজন ভদ্রলোক বসে আছেন ওঘরে, তবু ওখানে গিয়ে ওদের সামনে ওরকম করছেন কেন? মনোরমার রাগ হলো, সারা জীবনে যিনি একটি দিনের জন্যও খোঁজ করেন না, তাঁর হঠাৎ এমন উৎসাহ দেখলে সত্যি হাসি পায়।

সত্যবতী রাজকুমারের পিতা নবকুমারের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী, তার বিবাহের ইতিহাস বড়াই বিচিত্র। রাজকুমারের মা মারা যাওয়ার বছর পাঁচেক পরে হঠাৎ একদিন ভয়নাক বাবু সেজে নবকুমার কোথায় উধাও হয়ে গেল, সাত-আটদিন পরে সঙ্গে করে নিয়ে এল এই দুর্ধর্ষ সত্যবতীকে। সত্যবতী তখনও এমনি কালো বটে, কিন্তু কিছুটা মার্জিত, চকচকে, হঠাৎ দেখলে চোখ ঝলসে যায়। তার প্রকান্ড শরীর তখন দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, ধূ-ধূ করে। নবকুমার তখন সেই রসসিক্ত শরীরটাকে পেয়ে চুলে প্রচুর কলপ মেখে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিল।

কিছুকাল পরে আবিষ্কার করা গেল, সত্যবতী কেবল সত্যবাদীই নয়, কিঞ্চিৎ মুখরাও বটে। গ্রামের ভিতর তার শক্ৰসংখ্যা হু-হু করে বেড়ে যেতে লাগল, সত্যবতী নিঃসংশয়ে একটা সিদ্ধান্ত করল যে, সমস্ত পৃথিবী তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারপর অনেকগুলি বছর কেটে গেছে এবং সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে একলা সংগ্রাম করে এতকাল বেঁচে থাকা যথেষ্ট শক্তিমত্তার পরিচয় বটে। নবকুমার এই স্ত্রীলোকটিকে বিয়ে করবার পর থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একদিন ভুলেও ছেলের খোঁজ করেনি—লোকে শুনে অবাক হয়ে যায়, বাস্তবিক মানুষ এমন পাগল হয় কী করে? শত হলেও নিজের ছেলে তো? মনোরমার অভিযোগ এইখানেই, তার জ্ব কুঁচকে এসেছে এই কারণেই। সে তার বড়ো মেয়ে জয়ন্তী এবং পুত্রবধু সুনন্দার কাছেই প্রথম ব্যাপারখানা সবিস্তারে খুলে বলল। শেষে এই বলে উপসংহার করল যে, এমন দরদ দেখলে হাসির বদলে কান্নাই পায়।

কিছুক্ষণ পরে ঘর ঝাঁট দিতে গিয়ে এক নতুন বিভ্রাট এসে হাজির। কেমন একটা পচা গন্ধ পেয়ে সত্যবতী নাকে কাপড় দিল, দূর থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখল, ঘরের অন্ধকার কোণের দিকটিতে একটা চড়াই মরে পড়ে রয়েছে। আ রামো! এমন কান্ড তো জীবনেও দেখিনি। সত্যবতী অমনি দৌড়ে মনোরমার কাছে গেলো, গিয়েই একদমে বললো, বউ, তুমি জেনেশুনে যে এমন একটা কান্ড করবে তা আগে জানিনি।

মনোরমা সেদিনের বাজারের হিসেব লিখছিল। চাকর সামনে দাঁড়িয়ে, চশমাসুন্ধু ভারী মুখখানা তুলে চোখদুটি বরাবর সত্যবতীর চোখের ওপর স্থাপন করে সে বলল, কী হয়েছে?

সত্যবতী হাত-পা চোখ-মুখ সব একসঙ্গে নেড়ে হতাশার সুরে বলল, হবে আর কি! যা হবার তাই হয়েছে। একটা চড়াই মরে পড়ে রয়েছে ঘরে। বউ, তুমি বেছে-বেছে এমন একটা ঘর কেন আমায় দিলে বলো তো? আমার রাজুর তো। ঈশ্বরের ইচ্ছেয় আর ঘরের অভাব নেই।

মনোরমা বিরক্ত হয়ে বলল কে বললে, আমি আপনাকে ওরকম একটা ঘরে ইচ্ছে করে থাকতে দিয়েছি! এই বলে একজন চাকরকে ডেকে চড়াইটা বাইরে ফেলে দিতে নির্দেশ দিল।

তখনও ভালো করে সন্ধ্যা হয়নি। এই সময়টা সমস্ত বাড়িটা ভোরবেলার গোলমালে ভরে যায়। ঝি উনান ধরাতে যায়, ঠাকুর মনোরমার কাছে এ বেলা কী কী রাঁধবে সে বিষয়ে পরামর্শ করতে আসে, আর বৈকালিক চা-পান এখনও যাদের হয়নি তাদের শিশুসুলভ চীকার বাড়ির ওদিকে ধ্বনিত হয়ে ওঠে।

এমন সময় বারান্দার আবছা অন্ধকারে কয়েকটি ছোটো-ছোটো ছেলেমেয়েকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সত্যবতী উৎসাহিত হয়ে ডাকলো, কে রে! বেলা? শোন।

বেলার দল খিলখিল করে হেসে উঠল, একটা দৌড় দিয়ে খানিকটা পালাবার চেষ্টা করে আবার যথাস্থানে ফিরে এল, বুড়ির দিকে পিটপিট করে তাকাতে লাগল।

—শুনে যা বলছি? আহা, ছেলে-বুড়ো সবাই এরকম! শুনে যা? ছোটো ছেলেমেয়ের দল এবার সাহস করে সত্যবতীর ঘরের ভিতর ঢুকল, দম বন্ধ করে বলল, কেন ডাকছ বুড়ি?

বুড়ি! সত্যবতী এক মুহূর্তে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল, তাদের তেড়ে বলল, আমি বুড়ি নাকি? বজ্জাত ছেলে ধরে কান মলে দেব? যার তার সঙ্গে ইয়ার্কি, না?

বোরা আবার দমে গেল, এখন কী করবে ভেবে না পেয়ে এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে অন্ধকারে ঘুরঘুর করতে লাগল। এ দেখে সত্যবতীর মায়া হল। তাদের ডেকে বলল, ফের ওরকম করিসনি বুঝলি? বুঝলি তো? হ্যাঁ, তোর নাম কী রে? কী বললি? হেলা? সত্যবতী হেলা নামের ছোটো মেয়েটিকে কোলের কাছে টেনে বলল, আচ্ছা হেলা, তোরা কখনো ভূত দেখেচিস?

–ভূত, না।

–আমি দেখেছি! সত্যবতী এমনভাবে হাসল যেন কোনো ভূতের মতোই দেখায়, বলল—শোন তাহলে বলি। সেদিন শনিবার পশ্চিমপাড়ার ঘোষবাড়িতে শনিপুজোর নেমন্তন্ন ছিল, তাই সকাল-সকাল যাচ্ছিলুম। মাত্র সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কিন্তু এরই মধ্যে পথে লোকজন নেই। গাঁ-দেশের পথ-ঘাটের কথা তো জানিস, ক-টা লোকই বা হাঁটে। সে রাস্তা দিয়ে যেতে একটা জায়গা ছিল যেখানে গাছপালা ঝোপ-জঙ্গল এত বেশি যে দিনের বেলাতেই অন্ধকার হয়ে আসে। বাঁদিকে একটা তেঁতুলগাছ আছে, কবে কোন ঝড়ে উপড়ে পড়ে রয়েছে। তবু আজও মরেনি, বছর বছর দিব্বি পাতা গজায়, তেঁতুল গজায়। এই তেঁতুলগাছের কাছে গিয়েই গা আমার ছমছম করতে লাগল, আমি জোরে হাঁটতে লাগলুম, কিন্তু ভাই পথ আর ফুরোয় না, যতোই হাঁটি না কেন পেছনদিকে চেয়ে দেখি সেই তেঁতুল গাছ। ভাবতে লাগলুম এবার কী করা যায়? ঠিক এখুনি তো মন্তরটা আওড়ানো আর ঠিক হবে না, একবার হারালে ও মন্তর আর ফিরে পাওয়া যায় না, এমন সময় দেখি আমার পথ আগলে সেই–! সত্যবতী মুখে উচ্চারণ না। করে আকারে ইঙ্গিতে বলল, বুকের ওপর থুথু ফেলল-এই প্রকান্ড…তালগাছের মতো তার দুটি ঠ্যাং, মিশমিশে কালো শরীর, ওপরের দিকে ভয়ে চেয়ে দেখলুম, তার গায়ে নেই আমাদের মতো কোনো মাথা, নেই গলা, কেবল বুকের ওপর বড়ো বড়ো দুটি চোখ, আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে! আমি তো ভয়ে হিমসিম খেয়ে গেলুম, শরীরের ভেতর ঘাম দিয়ে জ্বর এল, হাত-পা ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল, …সত্যবতীর ছাইরঙা দুটি চোখ বড়ো হয়ে এল, সে সকলের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন সেদিনের ভয়ের ছায়াগুলি আজও তার চোখের সম্মুখে ভূতের মতো ঘুরে বেড়োচ্ছে। আর মন্টুরা? তাদের চোখও বিস্ফারিত, তারা ভয়ে এদিক-ওদিক চেয়ে সত্যবতীর হাঁটুর ওপর হাত রেখে বসে রইল। গল্প যখন শেষ হল তখন রাত নটা বাজতে আর বাকি নেই। সত্যবতী অনেক গল্প করল, মুখের জল ফেনা হয়ে গেছে, তার কুঞ্চিত পেটের ঘরখানায় আরও গল্প আনাগোনা করে। সত্যবতী আশ্বাস দিল, সেসব কাহিনি সে আরেক দিন বলবে—আজ আর নয় বাপু, আজ আর নয়!

-ঠাকুরমা ভয় করছে যে।

–ভয় কীসের? ভারী তত ভয়! কয়লার টুকরোর মতো কয়েকটি দাঁত বের করে সত্যবতী হাসে।

মন্টু বয়োজ্যেষ্ঠ। সকলের বড়ো হয়ে পাছে নিজের দুর্বলতা অতর্কিতে প্রকাশ পায় এই ভয়ে সে নিজের চঞ্চল দৃষ্টি যথাসম্ভব গুটিয়ে ওপরে যেতে যেতে বিজ্ঞের মতো বলল,-ভয় কীসের? আমার হাত ধরে চলে আয় হেলা।

বেশি রাত হয়নি। রান্নাঘরে এখনও রান্নার আয়োজন চলছে। বাসন আর খুন্তি নাড়ার টুং-টাং শব্দ, ঝি-চাকরের চেঁচামিচি, ওপরে ইন্দুর পড়া মুখস্থ করা, মনোরমার ছেলের ঘরে প্রথমে যে ছেলেটি রয়েছে তার অবিশ্রান্ত চীৎকার। মেয়েটা বড়ো কাঁদে। মনোরমার বড় ছেলে বাইরে অনেক রাত কাটায়, বড়ো ফ্লাস খেলার বাতিক, বাতিক শুধরে যাবে এই ভেবে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু শোধরাল কই? ওদিকে দোতলার রেলিং বেয়ে কয়েকটা কাপড় ঝুলছে, বেশিরভাগই শাড়ি। আশ্চর্য, এত লোক-লস্কর থাকতেও এমন ব্যাপার! কেবল পড়া মুখস্থ করলে আর গান শিখলেই হবে? সত্যবতী একটা প্রকান্ড হাই তুলল, সঙ্গে সঙ্গে দুটি আঙুল দিয়ে টকটক শব্দ করে তুড়ি দিতে ভুলল না। তার হাই দেওয়ার অর্থ এই নয় যে সে এখনি ঘুমুতে যাবে, এমনি ঘন ঘন হাই তোলা তার একটা অভ্যাস; তাতে সে বেশ আরাম বোধ করে। সত্যবতী উঠে দাঁড়াল, ঘোমটা টেনে বাইরে গিয়ে থপ থপ করে ওপরে উঠতে লাগল, সিঁড়ি এত প্রশস্ত এবং বেশি যে যেন একটা মরুভূমি চিৎ হয়ে শুয়ে আছে—অস্ফুটস্বরে সে বলল, কত সিঁড়ি বাপু, যেন আর ফুরোবে না?

দোতলার পেছনের ছাদে কে এই রাতে ঘুরে বেড়োচ্ছে? কাছে গিয়ে দেখা গেল, জয়ন্তী। মরা ঘাসের মতো শুকনো জয়ন্তী এই রাত্রেও দিব্যি চুল ছেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সত্যবতী আশ্চর্য হয়ে বলল, ওমা গো, এই অমাবস্যার রাত্তিরেও চুল ছেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস? তোদের কান্ড দেখে গা বমি বমি করে, জানিস, রাত্তিরে চুল ছেড়ে ঘুরে বেড়ালে কী হয়?

জয়ন্তী অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে একট মধুর বিষয় ভাবছিল, এমন নির্মম আঘাত পেয়ে তীব্র দৃষ্টিতে তার দিকে চাইল, কিন্তু দেখল, তার দুটি চোখ আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে।

সত্যবতী হতাশ হয়ে বলল, ওমা গো, আমি কোথায় যাব? তার খারাপ লাগল এই ভেবে যে, দিনকালের গতি আগের মতো আর নেই ঠাকুর-দেবতা তো মানবেই না, এমনকী অমাবস্যার রাত্রেও যে চুল ছেড়ে ঘুরে বেড়ানোটা মোটেই ভালো নয়, এ-ও মানবে না। এই তো সেবারও ঘোষবাড়ির পারুল—সে বলবে সেই ঘটনা? আর বললেও তো বিশ্বাস করবে না। সত্যবতী নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে নীচে নেমে এল, তখুনি দরজা দিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু সকালে ঘুমালে যা হয় তার কি, মধ্যরাতে জেগে উঠে সত্যবতী বাইরের বারান্দার কার জুতোর মচমচ আওয়াজ শুনতে পেল, বললে, কে? কে? কিন্তু কোনো উত্তর নেই। জুতোর আওয়াজ সিঁড়িতে উঠে আবার আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। মনোরমার বড়োছেলে প্রিয়কুমার এতক্ষণে বাড়ি ফিরছে।

পরদিন সুদীর্ঘ এক ঘণ্টাকাল পর বারান্দা ধরে নিজের ঘরে যাওয়ার সময় এমন একটা ঘটনা ঘটলো যাতে সত্যবতী একটা তুমুল কান্ড বাধিয়ে তুলল। ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়, ঝি মতির মা-র কাপড়ের আঁচলটা তার সদ্যস্নাত শরীরে হাওয়ার মতো একটু এসেছিল মাত্র, সত্যবতী অমনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, আ-মর মাগী, ছুঁয়ে দিলি যে? কেন ছুঁয়ে দিলি বল? ওমা গো, আমি এইমাত্র চান করে এলাম, আর অমনি ঝি-মাগী আমায় ছুঁয়ে দিল, আবার বলে কি না, আমরা ছোটোলোক নই গো, অদেষ্ট মন্দ বলেই আজ ঝি-গিরি করে খাই! বলে কি না কায়েত, কায়েত না আরও কিছু, ও-কথা বললেই আমি বিশ্বাস করি!

মতির মা বিশেষ শ্রদ্ধা সহকারেই বৃদ্ধির পায়ে ধরে প্রণাম করতে যাচ্ছিল, কিন্তু এমন ঝামটা খেয়ে হতভম্ব হয়ে গেল, এবারের মতো নিজের জাতের উচ্চতা আর বিশেষ প্রমাণ না করেই ধীরে ধীরে সরে পড়ল।

কিন্তু প্রমাণ করতে না দিলেও এমন অবজ্ঞাও আবার সহ্য হয় না। সত্যবতী একে নিতান্ত অবজ্ঞা বলেই ধরে নিল। ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো আরও ঘেউ ঘেউ করতে লাগল।

এমন সময় দোতলার বারান্দা থেকে উঁকি মেরে মনোরমা বলল, আহা অত চেঁচামেচি কেন? বাড়ির মধ্যে একটা অসুখ হলেও এক মিনিট শান্তিতে থাকবার যো নেই? তোমরা সবাই মিলে কি ক্ষেপেছো? ইন্দু ওখানে দাঁড়িয়ে কেবল হাসছিস যে? এলি? রতন, এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছিস? ডাক্তার ডাকতে গেলি?

-ডাক্তার! আবার ডাক্তার ডাকা কেন? কার আবার অসুখ করেছে? সত্যবতী খানিকটা শুনেই স্তব্ধ হয়ে গেল, মনে মনে ভাবল, কার আবার অসুখ হল? মনে হচ্ছে তার রাজুরই কিছু? সত্যবতী অমনি তার বর্তমানের বিষয়টি ভবিষ্যতের জন্য স্থগিত রেখে একটি তেজস্বিনী ঘোড়ার মতোই ছুটতে ছুটতে ওপরে গিয়ে হাজির হল, শুনতে পেল রাজকুমার বলছে :

-আমি আর কী করব বল? এক ছেলে জুয়ো খেলেন, আর এক ছেলে স্বদেশি করেন, আর এক মেয়ে বিয়ে করতে চান না, আর এদিকে তো ভাঁড়ার ঘর শূন্যি, ঋণে গলা পর্যন্ত ডুবে গেছি। লোকে তাদের ছেলেপিলে আশা কেন করে! বুড়ো বয়সে অকর্মণ্য হয়ে গেলে বসে বসে খাবে বলেই তো? আর আমার ঘরে এসব কী?

সত্যবতী বুঝতে পারল, রাজকুমার কিছুক্ষণের জন্য ভারী অস্থির হয়ে পড়েছে। হবেই তো! এতবড়ো একটা সংসার ওই একটা লোকের মাথায়ই তো। সত্যবতী ঘরের ভিতর ঢুকে হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠল, বললো, রাজুরে, তোর এ কী হল বাবা? আমায় আগে বলিসনি কেন? শত হলেও তো আমি তোর মা, মা-র কাছে সব কথা আগে বলতে হয়।

সকলে অবাক। মনোরমা হতবুদ্ধি।

সত্যবতী বিনিয়ে বিনিয়ে বলল, হে মা কালী, ছেলেকে আমার ভালো করে দাও। আমার রাজু ভালো হলে জোড়া পাঁঠা বলি দেব, আমার ছেলেকে ভালো করে দাও! এতদিন ধরে এসেছি, মার সঙ্গে দেখা করবার নামটি নেই, আমার ওপর রাগ করবে না তো কি? মাগো, তোমার কাছে কত অপরাধই না করেছি, তাই বাছার আমার এমন অসুখ করেছে। তোমার দুটি পায়ে ধরি মা, বাছাকে আমার ভালো করে দাও! সত্যবতীর দু-চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল, চোখের জলে বুক ভেসে গেল। কান্নার বেগ খানিকটা কমলে সে সকলকে এই বলে আশ্বাস দিল যে মা কালীর কৃপায় সে তার রাজুর অসুখ একঘণ্টার মধ্যে সারিয়ে দেবে।

সত্যবতীর এই উচ্ছাসে কিছুমাত্র বিস্ময় প্রকাশ না করে সকলে যে যার কাজে মন দিল, মনোরমা তার দিকে একবার তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে তারপর স্বামীর প্রতি মৌখিক পরিচর্যার শর নিক্ষেপ করল।

রাজকুমার ওঠার চেষ্টা করে বলল, আহা, এত গোলমাল কেন? কিছু হয়নি, তোমরা যাও, আমায় একটু একা থাকতে দাও, উঃ! রাজকুমার তার কপালে হাত চেপে চুপ করে বসে রইলেন।

কিন্তু এমন অবজ্ঞা কখনো সহ্য হয়? সত্যবতী ভাবলো, সে যে কালী পেয়েছে, একথা কে না জানে?

বরং একথা শুনে এ বাড়ির লোকগুলি হয় খিলখিল করে হাসবে, নয়তো গম্ভীর হয়ে বসে থাকবে। বিশ্বেস করতে যেন অহংকারে বাধে। অথচ এইজন্যই গ্রামে তার কতো আদর, তাকে নিয়ে কত ডাকাডাকি, কত লোক ডাক্তারকে ফেলে রাজুর মা-র কাছে ছুটে আসে। অথচ এরা বিশ্বেস করে না। কলিকাল না হলে এমন হয়! সত্যবতী মনে মনে দারুণ বিরক্ত হল; এত বিরক্ত হল যে মনে মনে এদের প্রতি ঈশ্বরের অভিশাপ কামনা করতে লাগল। যারা অহংকারে মত্ত হয়ে লোককে এমন অবজ্ঞা করে, তাদের সঙ্গে কথা না বলাই ভালো। সত্যবতী ধীরে ধীরে নীচে নেমে এল। এখনি রান্না করে কিছু খেতে হবে তো! পেট যখন আছে তখন পেটের ভিতর কিছু দিতেই হবে।

বাইরে একটা কাক ডেকে উঠল, কা! কী!

সত্যবতী তাড়া দিয়ে বলল, আ-মর! আবার এখানে এসে পড়ে মরেছিস কেন? যা, এখান থেকে যা। হুশ, হুশ! এদের দেখলে সত্যবতীর বুকের ভিতর কাঁপুনি ধরে যায়।

বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে মন্টু এসে হাজির, সঙ্গে বেলা-হেলা-জিতুরাও। মন্টু বলল, ঠাকুমা, আপনি মিথ্যে কথা বলেছেন। আমাদের স্যার আজ বলেছেন ভূত বলে কিছু নেই।

সত্যবতী অবাক হয়ে গেল। দু-চোখ পাকিয়ে বলল,-ষাঢ় কে শুনি!

—আমাদের ইংরিজি যিনি পড়ান, আমায় খুব ভালোবাসেন। বলেছেন ভূতটুত কিছু নেই?

—হ্যাঁ?

সত্যবতী ঠোঁট উলটিয়ে বলল, …কথায় বলে.., কিন্তু হঠাৎ দারুণ গম্ভীর হয়ে গেল। নিজের দু-চোখে আঙুল দিয়ে বলল, আমি এই স্বচক্ষে দেখেছি। তাহলে বলি শোন।

সবাই তাকে ঘিরে বসে গেল, বেলা ঠাকুরমার বিছানার ওপর হাঁটু গেড়ে বসল। সত্যবতী তার তোবডানো বিকৃত মুখ আরও বিকৃত করে বলল, আমি স্বচক্ষে দেখেছি!…।

দু-বছর আগের কথা বলছি। সেবার একটা পাখি আমার ঘরের উঠোনের সামনে এসে দাঁড়ায়। পাখিটা দেখতে এমন সুন্দর ছিল যে কী বলব, দু-চোখ জুড়িয়ে যায়, মনে হয় আরও দেখি। দেখতে পেলুম, পাখিটা রোজই আমার উঠোনে এসে বসে, দু-হাতে রূপের হাট খুলে এদিক-ওদিক হাঁটে। দেখতে দেখতে ভারী ইচ্ছে হল ওকে একবার ধরি। পাখিকে ইচ্ছে হলেই হাত বাড়িয়ে ধরা যায় না, তবু কেন ইচ্ছে হল ওকে একবার ধরি। অমনি হাত বাড়িয়ে দিলুম, হাত বাড়িয়ে দেখি পাখি তো উড়ে পালিয়ে গেল না, কেবল একটু সরে দাঁড়াল। ভাবলুম এমনটি তো কখনো হয় না। আবার হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলুম, পাখি আবার সরে দাঁড়াল। আবার ধরতে গেলুম, আবার সরে দাঁড়াল! বুঝলি মন্টু, আমি যেন পাগল হয়ে গেলুম, পাগলের মতো ওর পেছনে পেছনে ছুটতে লাগলুম— সত্যবতীর চোখ বড়ো হয়ে গেল, সে তার গলার স্বর কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে বলল, অনেকক্ষণ পর চেয়ে দেখি, আমি একটা বনের মধ্যে এসে পড়েছি, আর আমার সামনে সেই পাখি, বনের মধ্যে একটা জনমানব নেই, ঘর নেই, বাড়ি নেই, আমার হাত-পা অবশ হয়ে এল, আমি কাঁদতে লাগলুম। সত্যবতী সত্যই কেঁদে ফেলল, তার দু-চোখ বেয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল। মন্টুদের অবস্থা এর চেয়েও খারাপ। ভয়ে তাদের দাঁতগুলি যেন লেগে গিয়েছে, চোখ বেরিয়ে এসেছে। সত্যবতী বলল, একটু পরেই চেয়ে দেখি, পাখির জায়গায় পাখি তো নেই, শাদা কাপড় পরে এত বড় ঘোমটা টেনে এক বউ, বউ আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে এল, আমার তখন পেটের নাড়িভুড়ি পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে, আমি তখন বুদ্ধি করে এক দৌড় দিলুম, তারপর অনেকদূর এসে তারপর বাঁচলুম। আবার বলে কি না বিশ্বেস করে না। বিশ্বেস তোর মাষ্টারের ঘাড় করবে। তোদের মাষ্টারের ভারী অহংকার হয়েছে, না রে? সত্যবতী আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছল।

সন্ধ্যার অন্ধকারে কেউ কারোর মুখ দেখতে পাচ্ছিল না, মন্টু তো চোখ বুজেই রইল, একজন যে উঠে সুইচ একটু টিপে দেবে, এমন সাহসও কারোর নেই। মন্টু চোখ বুজেই বললে, আলোটা জ্বালিয়ে দে না বেলি? ইস, কী অন্ধকার! আলোটা জ্বালো না? আমি পারব না বলছি। নিজে যেতে পারো না? হেলার অবস্থা আরও সাংঘাতিক। সে দাঁতমুখ খিচিয়ে অনেক কষ্ট করে যতোই ভূতের চেহারাটা ভুলতে চেষ্টা করছিল ততোই সেই ভূত নামক জীবটি একটা বিরাট আকার ধারণ করে তার চোখ ঘিরে দাঁড়াচ্ছিল। সে অবশেষে কাঁদতে শুরু করে দিল : ঠাকুমা, ও ঠাকুমা!

ঠাকুরমার চোখের জল তখন শুকিয়ে এসেছে।

ব্যাপার আরও অনেকদূর গড়াত যদি না মনোরমা জানতে পারত। হঠাৎ একদিন শেষ রাত্রে মন্টু অনেক অস্পষ্ট কথা বলে বালিশে মুখ ঘষে গোঙাচ্ছে। অনেক কষ্টে সেদিন তাকে সেই গোঙানি থেকে বাঁচানো গেল, তার পরের দিন মন্টুর যা চেহারা হয়ে গেল দেখলে কান্না পায়। আর সর্বদাই কেমন পাকিয়ে পাকিয়ে তাকায়, যেন সর্বদাই ভয়ে হিমসিম খাচ্ছে। সন্ধ্যা হলে অবস্থা আরও জটিল। তখন সকলেই মনোরমার আঁচল ধরে বসে থাকে, কিছুতেই ছাড়বে না।

পরদিন মনোরমা সত্যবতীর ঘরের দিকে ছুটে গেল। সত্যবতী তখন জয়ন্তীর দৈহিক দুর্দশার কথা নিয়ে ঝি মতির মা-র সঙ্গে গভীর আলাপে রত। মনোরমা বলল, আপনি এসব কী শুরু করে দিয়েছেন শুনি? ছেলেপিলে বলে একবার মায়াও হয় ন? আমাদের কি মেরে ফেলবেন?…এতটুকু মান-সম্মান জ্ঞান নেই? গেঁয়ো ভূত।

–ভূত।

সত্যবতী অবাক হয়ে মনোরমার দিকে চাইল, তার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল। যে-কোনো মুখভঙ্গিতেই তাকে এমন বিকৃত দেখায়, যেন মনে হয় সর্বদাই সে রেগে রয়েছেঃ চোট-পড়া কপালের নীচে জলভরা চোখ দুটি বাঘের চোখের মতো জ্বলজ্বল করে। ওপরের পাটির কালো দুটি দাঁত নীচের ভারী ঠোঁটের গায়ে বারে বারে আঘাত খেতে থাকে, যেন একটা কালো চকচকে মেশিন; হাঁসফাঁস করে চলেছে, দম আটকে রেখে মাঝেমাঝে শ্বাস ফেলছে।

তারপরে এক পরিচ্ছন্ন ভেরবেলায়—বাড়ির একটা লোকও তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি, কিন্তু দূরে বড়ো রাস্তায় ট্রাম-বাসের শব্দ প্রবল হয়ে উঠেছে—সত্যবতী তার কালো ইস্পাতের মতো শরীরে একখানা নামাবলি জড়িয়ে মাথায় নববধূর মতো প্রকান্ড ঘোমটা টেনে, নিজের ছোটো পুঁটলিটা কাঁধে স্থাপন করে পথে বেরিয়ে পড়ল। এমন দুঃসাহসিকতার অভিনয় সে তার জীবনে আরও অনেক করেছে, স্বামীর মৃত্যুর পর গ্রামের বিপুল শক্ৰসংখ্যার সঙ্গে একা যখন যুদ্ধ করেছে। তখন আত্মরক্ষার্থে কতো দুঃসাহসিক কাজে তাকে লিপ্ত থাকতে হয়েছে। আজও তার অন্যথা হতে পারে না। রাজপথে পড়ে, সত্যবতী যাকে কাছে পেলে তাকেই জিজ্ঞেস করলো-হ্যাঁ গা, শেয়ালদায় কত নম্বর বাস যায় বলবে?

এমন কোলাহল-ভরা রাজপথে সত্যবতীর কণ্ঠস্বর ভারী ক্ষীণ শোনা গেল। সে বাসের কন্ডাকটরদের জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁগো, তোমাদের বাস শেয়ালদায় যাবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *