সতে মুচি

সতে মুচি

সতে মুচি জাতে মুচি হলেও জুতো সেলাই সে করে না। পেশা তার ঢোল বাজানো। সেজন্য কেউ কেউ বলে সতে বায়েন। সতে কিন্তু তার নামের শেষে বায়েন বলে না, বলে মুচি, সত্যেশ্বর মুচি। এই সত্যেশ্বর মুচি বা সতে মুচিকে নিয়ে আমাদের গ্রামে ভারী মজার একটি গল্প প্রচলিত আছে।

আমাদের গ্রামের অনতিদূরে রায়না নামে এক বিখ্যাত গ্রাম আছে। একদিন সতে এবং ওর দূরসম্পর্কের এক জ্যাঠামশাই ভূষণ কী এক জরুরি কাজে খুব ভোরে রায়না যাওয়া ঠিক করল। আগের দিন রাত্রে সব ঠিকঠাক করে পরদিন ভোরবেলায় ভূষণ এসে সতেকে ডাকল, “সতে!”

তখন নিশিভোর। আকাশ তখনও অন্ধকার। একটিও কাকপক্ষী ডাকেনি। তেমন সময় ভূষণ ডাকল, “সতে! এই সতে!”

কিন্তু কোথায় সতে! সাড়া নেই শব্দ নেই। অবশেষে অনেক ডাকাডাকির পর সতের বউ দরজা খুলল।

ভূষণ বলল, “কী ব্যাপার? সতেকে ডেকে দাও। সকাল করে না গেলে কোনও কাজই যে হবে না।”

সতের বউ তো আকাশ থেকে পড়ল।

“ওমা! এই তো খানিক আগে আপনি এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন? আবার এখন এসে ডাকাডাকি করছেন, বলি ব্যাপারটা কী?”

ভূষণের তো চক্ষু তখন চড়কগাছ।

“আমি এসে ডেকে নিয়ে গেলাম! আমি তো এই আসছি।”

“না। আপনিই তো ডাকলেন তাকে। সেও অমনই আপনার ডাক শুনে বেরিয়ে গেল।” ভূষণ তখন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, “কী সর্বনাশ!”

“তা হলে কী হবে? একেবারে আপনার মতো গলায় কে তাকে ডাকল তবে?” ভূষণ বলল, “ঠিক বলছ, আমার মতো গলা? না কি অন্য কেউ ডেকেছে?”

“না গো জ্যাঠা, না। অবিকল আপনার মতো গলায় তাকে ডাকল। আমার মন বলছে নিশ্চয়ই কোনও অমঙ্গল হয়েছে তার। আপনি এক্ষুনি খোঁজখবর নিন। আমি মেয়েমানুষ, আমি কোথায় কী করব?”

ভূষণ বলল, “বড় আশ্চর্য ব্যাপার বটে! নিশিভোরে অবিকল আমার মতো গলা করে ডাকল। সেও অমনই বেরিয়ে গেল। এ তো দেখছি অত্যন্ত গোলমেলে ব্যাপার। ঠিক আছে, তুমি কিচ্ছুটি ভেবো না। আমি এখনই ব্যবস্থা করছি।”

সঙ্গে সঙ্গে লোকজন জড়ো করে ফেলল ভূষণ।

দেখতে দেখতে সকালও হয়ে গেল। তারপর শুরু হল খোঁজাখুঁজির পালা। গাঁয়ের সর্বত্র তন্নতন্ন করে খোঁজা হল সতেকে। দু’জন রায়না গেল। দু’জন খণ্ডঘোষে তার শ্বশুরবাড়িতে গেল। দু’জন গেল জাহানাবাদ। কিন্তু কোথায় সতে? শুধু শুধু খোঁজাখুঁজিই সার হল। সতের বউ তখন কান্নাকাটি শুরু করে দিল।

ভূষণ বলল, “কী বিপদ! খুঁজে পাওয়া গেল না বলে হাল ছেড়ে দিলে কী করে হবে? আবার খোঁজো। যেখান থেকে পারো খুঁজে বের করো তাকে।”

আবার শুরু হল খোঁজাখুঁজির পালা। বনজঙ্গল তোলপাড় করা হল। কিন্তু তবুও কোনওখানে সতের এতটুকু চিহ্নও পাওয়া গেল না।

ভূষণ বলল, “পুকুরে জাল ফেলে দেখো। যদি কেউ কোনও অপকর্ম করে ডুবিয়ে রেখে থাকে তাকে!”

জাল নামল পুকুরে। সতে সেখানেও নেই। কাজেই বাধ্য হয়েই হাল ছেড়ে দিতে হল। নিশিভোরে একজন জলজ্যান্ত মানুষ বেমালুম উবে গেল গ্রামের বুক থেকে, এই সংবাদটাই শুধু বাতাসের আগে ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র।

দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন কেটে গেল। একদিন, দু’দিন, তিনদিন। চারদিনের দিন ভূষণ ওর মেয়ের বাড়ি যাচ্ছিল। তখন চৈত্রের শেষ। দুপুরবেলা। খাঁ-খাঁ করছে রোদ্দুর। একটা ছাতি মাথায় খালি পায়ে সতের কথা ভাবতে ভাবতে পথ চলছিল ভূষণ। গাঁয়ের প্রান্তে বাবুরমায়ের খালের ওপারে মালগোড়ে বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে বিরাট এক বটগাছের নীচে গিয়ে ভূষণ বসল। এই পথে কতদিন সতেকে সঙ্গে নিয়ে ভূষণ তার মেয়ের বাড়ি গেছে। এই গাছতলায় কতবার বিশ্রাম করতে বসে দু’জনে কত গল্প করেছে। সেইসব কথা ভাবতে লাগল ভূষণ। ভাবতে ভাবতে সতের জন্য মনটা তার আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল। কী যে হল মানুষটার! বেমালুম উবে গেল। গাঁয়ের লোকে কত কথাই না বলছে এসব ব্যাপার নিয়ে। কেউ বলছে, ওকে ঠিক নিশিতে ডেকেছে। কেউ বলছে, বাঘে খেয়েছে। কেউ বলছে, দেশত্যাগ করেছে। যার যা ইচ্ছে সে তাই বলছে। দুষ্ট লোকেরা বলছে, ওসব ভূষণেরই কারসাজি। সে-ই নিশ্চয়ই কোনও কিছুর লোভে সরিয়েছে সতেকে। শেষের কথাটা শুনলে কেমন যেন ছ্যাঁৎ করে ওঠে বুকের ভেতরটা। কিন্তু মানুষের মুখে তো হাতচাপা দেওয়া যাবে না। কাজেই যে যা বলে তা চোখ কান বুজে শুনে যেতে হয়।

ভূষণ যখন গাছতলায় বসে বসে এইসব ভাবছে সেই সময় হঠাৎ ওর পায়ের ওপর জলের মতো এক ফোঁটা কী যেন পড়ল টস করে। ভূষণ ভাবল এ নিশ্চয়ই কাকপক্ষীদের কাজ। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে আবার যখন আর এক ফোঁটা পড়ল তখন আর সন্দেহভঞ্জন না করে পারল না। ব্যাপারটা কী দেখবার জন্য ওপরদিকে তাকাতেই মাথাটা গেল ঘুরে। যা সে দেখতে পেল তা স্বচক্ষে দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারল না। ভূষণ দেখতে পেল সেই বটগাছের অতি উচ্চে তিনটি মোটা মোটা ডালের ফাঁকে চুপচাপ শুয়ে আছে সতে। আর তারই কাতর দুটি চোখ বেয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ছে সেই জলের ফোঁটা।

সতেকে দেখতে পেয়েই ভূষণ লাফিয়ে উঠল, “সতে! এই সতে!”

কিন্তু কে দেবে সাড়া? সাড়া নেই শব্দ নেই। সতে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে। ভূষণ আবার ডাকল, “সতে রে!”

সতে এবারও সাড়া দিল না।

ভূষণ ফের ডাকল, “এই! এই সতে! ওখানে শুয়ে আছিস কেন? আমি জ্যাঠামশাই। আমাকে চিনতে পারছিস না?”

সতে নিরুত্তর।

ভূষণ বুঝল গতিক সুবিধের নয়। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও ভৌতিক ব্যাপার রয়েছে। নয়তো মাথাখারাপ হয়েছে সতের। কিন্তু ভৌতিক ব্যাপারই যদি হয় তা হলে তো একে এখানে একা ফেলে রেখে কাউকে ডাকতে যাওয়া ঠিক হবে না। ততক্ষণে মাল পাচার হয়ে যাবে। তারপর তন্নতন্ন করে খুঁজে মরে গেলেও আর কোথাও পাওয়া যাবে না তাকে। অথচ ওকে ওখান থেকে নামিয়ে আনাও তার একার কর্ম নয়।

যাই হোক, ভাগ্যক্রমে হঠাৎ সেখান দিয়ে ভূষণেরই এক চেনা লোক যাচ্ছিল। ভূষণ তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে তাকে সব কথা খুলে বলে গাছতলায় নিয়ে এল তাকে। তারপর সতের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ওই। ওই দ্যাখো।”

ওপরদিকে তাকাতেই লোকটির তো চক্ষুস্থির, “আরে! সত্যিই তো। ওই তো আমাদের সতে মুচি।”

“ওকে ওখান থেকে এক্ষুনি নামিয়ে ফেলতে হবে।”

“তা তো হবে। কিন্তু ও এখানে এল কী করে?”

“সেইটেই তো আশ্চর্য!”

“আমার মনে হয়, এ নিশ্চয়ই সেই তেনাদের কাজ। যখন-তখন যাদের নাম করতে নেই। ঠিক আছে। তুমি এক কাজ করো। গাছের ওপর উঠে সতেকে একটু ছুঁয়ে থাকো। আমি ততক্ষণে লোকজন সব ডেকেডুকে আনছি। নাহলে ওকে ওখান থেকে টেনে নামানো তোমার-আমার কর্ম নয়।” এই বলে লোকটি দ্রুতপদে গ্রামের দিকে চলে গেল।

আর ভূষণও তৎক্ষণাৎ গাছে উঠে ছুঁয়ে ফেলল সতেকে।

তারপর লোকজন এলে সবাই মিলে ধরাধরি করে সতেকে নামানো হল। পালকিতে শুইয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হল। রোজা এসে ঝাড়ফুঁক করতে অনেকটা সুস্থ হল বেচারা।

দিনকতক পরে যখন সে একেবারে সুস্থ হয়ে উঠল তখন একদিন সকলের কাছে সব কিছু সবিস্তারে খুলে বলল সে। সতে বলল, সেদিন ভোরবেলায় ভূষণের মতো গলা করে কে যেন তাকে ডাকল। আর সেও অমনই মন্ত্রমুগ্ধের মতো বেরিয়ে এল সেই ডাক শুনে। কিন্তু বাইরে এসে কাউকেই সে দেখতে পেল না। তখন কেমন যেন সর্বশরীর ছমছমিয়ে উঠল তার। এমন সময় হঠাৎ সে বুঝতে পারল তার পায়ের তলা থেকে মাটি ক্রমশ যেন সরে সরে যাচ্ছে এবং অনেক উঁচুতে উঠে যাচ্ছে সে। তখন সে কতবার চেষ্টা করল চিৎকার করে কাউকে ডাকবার। কিন্তু তার গলা দিয়ে তখন এতটুকু শব্দ আর বের হল না। কেমন যেন বোবা হয়ে গেল সে। তারপর বাতাসে ভাসতে ভাসতে খালের ধারে ওই বটগাছের ডালে গিয়ে আটকে গেল। সেই থেকে তিন-চারটে দিন ওইখানেই ওই গাছের ডালেই একভাবে কেটে গেছে তার। ওই গাছের তলা দিয়ে কত লোকজনকে সে যেতে-আসতে দেখেছে। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও গলা দিয়ে এতটুকু শব্দ বের করেও কাউকে সে ডাকতে পারেনি। সারাটা দিন যে কীভাবে কাটত তার, তা একমাত্র সে-ই জানে। সন্ধের পর সে দেখতে পেত কিম্ভূতকিমাকার দুটো মুখ ভাঁটার মতো চোখ বের করে এগিয়ে আসত তার দিকে। আর সারারাত ধরে তারা লকলকে জিভ বের করে অবিরাম তাকে চাটত। চেটে চেটে তার শরীরের সমস্ত রক্ত চুষে খেত তারা। তারপর ভোর হলেই আবার ওকে ফেলে রেখে চলে যেত। সারাদিনে আর আসত না। সেই সন্ধের পরে আবার আসত।

সতের মুখে এই অবিশ্বাস্য কাহিনী শুনে অবাক হয়ে গেল সকলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *