সতী শোভনা – পাঁচকড়ি দে

সতী শোভনা – পাঁচকড়ি দে

প্রথম পরিচ্ছেদ

ডাক্তারবাবুর কথা

বেলা দ্বিপ্রহর। আহারাদি শেষে একটু বিশ্রাম করিব মনে করিতেছিলাম বটে, কিন্তু কার্যত ঘটিয়া উঠিল না। বাহির হইতে সংবাদ আসিল, কে একটি ভদ্রলোক বহিবাটিতে আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন—বিশেষ আবশ্যক, এখনই দেখা করিতে হইবে।

আমি বাহিরে আসিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। আগন্তুকের বয়ঃক্রম সপ্তবিংশতি বৎসর; বর্ণ গৌর। মুখমণ্ডল সুন্দর হইলেও এক্ষণে যন্ত্রণাবিবর্ণীকৃত। গঠন ঈষদ্দীর্ঘ। একখানি রেশমী রুমালে দক্ষিণ হস্ত বক্ষের উপর ঝুলাইয়া গলদেশে বাঁধা। আমাকে দেখিয়াই, দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া সেই যুবক ক্ষীণতর স্বরে বলিলেন, ‘মহাশয়ের নাম কি কালীকৃষ্ণবাবু?’

‘হাঁ, আমারই নাম।’

‘ক্ষমা করিবেন, আমি কখন আপনাকে দেখি নাই। লোকের মুখে আপনার অনেক সুখ্যাতি শুনিয়াছি।’

দেখিলাম, তিনি তখন দাঁড়াইয়া কাঁপিতেছেন; পদদ্বয় যেন তাঁর দেহভার আর বহন করিতে পারিতেছে না। নিকটস্থ চেয়ারে তাঁহাকে আমি বসিতে বলিলাম। তিনি ধীরে ধীরে বসিলেন। বসিয়া বলিলেন, ‘আমি বড় কষ্ট ভোগ করিতেছি; এক সপ্তাহের মধ্যে একদিনও ঘুমাইতে পারি নাই; কি জানি, আমার ডান হাতে কি হইয়াছে—কার্‌বাঙ্কল্‌ কি ক্যান্সার কিছুই ঠিক করিতে পারিতেছি না; যন্ত্রণায় প্রাণ বাহির হইয়া যাইতেছে। প্রথম একটু একটু যন্ত্রণা কখন হইত; কখন হইত না; কিন্তু এখন বড় ভয়ানক দাঁড়িয়েছে—এক মুহূর্তের জন্য আমি স্থির হইতে পারিতেছি না। দিন দিন যাতনা বাড়িয়া উঠিতেছে; আর আমি সহ্য করিতে পারি না; কে যেন একখণ্ড জ্বলন্ত অঙ্গার হাতের উপর চাপিয়া ধরিয়াছে—এমনই যন্ত্রণা। আপনি যদি অনুগ্রহ করিয়া কাটিয়া দেন, বড়ই উপকৃত হই; এমন কি আর এক ঘণ্টা যদি এই যন্ত্রণা আমাকে ভোগ করিতে হয়—আমি পাগল হইয়া যাইব।’

আমি তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলাম, প্রথমে অস্ত্র করিবার কোন আবশ্যক নাই, প্রলেপাদির দ্বারা যাহাতে তাঁহার যন্ত্রণা দূর হয় করিব।

যুবক এবার একটু জোরে জোরে বলিলেন, ‘না, না ডাক্তারবাবু, প্রলেপ-প্রয়োগে ইহার কিছু হইবে না; আপনি অস্ত্র করিয়া দিন, নতুবা এ যন্ত্রণা যাইবে না; যেখানে যন্ত্রণা হইতেছে সেখানকার মাংস কাটিয়া তুলিয়া ফেলুন।’

হাতের কোনখানে তেমন যন্ত্রণা হইতেছে আমি দেখিতে চাহিলাম। ধীরে ধীরে তিনি রুমাল হইতে হাত বাহিরে করিলেন; বাহির করিয়া ধীরে ধীরে আমার টেবিলের উপর অতি সন্তর্পণে রাখিলেন। বলিলেন, ‘ডাক্তার মহাশয়, আপনি পরীক্ষা করিয়া যাহাই বুঝুন, আপনি কাটিয়া দিন। আমাকে কতদূর যাতনা ভোগ করিতে হইতেছে কথায় আপনাকে কি করিয়া বুঝাইব?’

আমি তাঁহার হাতখানি ধীরে ধীরে তুলিলাম। যন্ত্রাদির সাহায্যে বিশেষ করিয়া দেখিতে লাগিলাম। কোন রোগের কোন প্রমাণই পাইলাম না। তাঁহার হাতে আর আমার হাতে কোন পার্থক্য নাই—নীরোগ। আর তত গ্রাহ্য না করিয়া আমি তাঁহার হাত ছাড়িয়া দিলাম, সশব্দে তাঁহার সেই হাতখানি টেবিলের উপর পড়িয়া গেল।

যুবক উৎকট যন্ত্রণায় বিকট চিৎকার করিয়া তখন কাঁদিয়া উঠিলেন। বাম হাতে ধীরে ধীরে ডান হাত তুলিলেন। তাঁহার ভাবে বোধ হইল, তিনি বস্তুতই অতিশয় যন্ত্রণা ভোগ করিতেছেন।

আমি বলিলাম, ‘ঠিক কোন স্থানে যন্ত্রণা হইতেছে আমাকে দেখাইয়া দিন।’

‘এইখানে।’ বলিয়া তিনি অঙ্গুলি নির্দেশে করতলের উপরিভাগে—যেখানে দুইটি স্থূল শিরা একত্রে মিশিয়াছে—দেখাইলেন। আমি ধীরে ধীরে সেই স্থান টিপিয়া দেখিতে লাগিলাম, ইহাতে তখন তাঁহার সর্বাঙ্গ কম্পিত হইতেছিল।

আমি বলিলাম, ‘ইহাতেও কি আপনার যন্ত্রণা হইতেছে?’

তিনি কোন উত্তর করিলেন না। দেখিলাম, তাঁহার চক্ষু দুটি অশ্রুজলে ভরিয়া গিয়াছে। ভাবিয়া পাইলাম না কি এমন যন্ত্রণা!

আমি। কি আশ্চর্য! আমি তো কিছুই দেখিতে পাইতেছি না।

তিনি। তবে এ যন্ত্রণা কেন হইতেছে? ইচ্ছা হইতেছে দেয়ালে ঠুকিয়া নিজের মাথা নিজে ভাঙ্গিয়া ফেলি—মরিয়া যাই—যন্ত্রণার অবসান হোক।

আমি magnifying glass দিয়া বিশেষ করিয়া তন্নির্দিষ্ট স্থান পরীক্ষা করিলাম, কিছুই নয়। বলিলাম, ‘কই, কিছুই দেখিতেছি না। আপনার হাতের অন্যান্য স্থান যেমন এটুকুও তেমনি।’

‘আমার বোধ হইতেছে ওখানটা লাল হইয়াছে।’

‘কই?’ যুবক তখন পকেট হইতে একটা wooden pencil বাহির করিয়া ধীরে ধীরে অস্পষ্ট রেখায় হাতের সেইখানে একটি আধুলির মতন গোল করিয়া ক্ষুদ্র চিহ্ন করিলেন।

আমি তাঁহার দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, বোধ হয় একটু না একটু পাগলের ছিট আছে। বলিলাম, ‘আপনি কিছুদিন এখানে অপেক্ষা করুন, আরোগ্য লাভ করিতে পারিবেন।’

যু। থাকিতে পারিব না। এমন মনে করিবেন না যে আমি পাগল। এখানে থাকিলে আপনি এমন কি উপায় স্থির করিয়াছেন যে আমি নিশ্চয় নীরোগ হইব? আর কোন উপায় নাই। যেটুকু আমি পেন্সিল দিয়া দাগ করিয়াছি, আপনি কাটিয়া ফেলুন—এ উৎকট যন্ত্রণা হইতে নিষ্কৃতি পাই।

আমি। আমি পারিব না।

যুবক। কেন?

আমি। অস্ত্র করিবার কিছুই দেখিতেছি না। আপনি যে স্থান দাগ কাটিয়া দেখাইতেছেন ঠিক আমার হাতের ন্যায়—রোগের তো কিছুই দেখিতেছি না।

যু। আপনি কি মনে করিতেছেন আমি পাগল না আপনার সহিত বিদ্রুপ করিতে আসিয়াছি? এই নিন, আপনার পারিশ্রমিক নিন, ‘ওইটুকু বেশ করিয়া কাটিয়া দিন; আমি আপনার সহিত ছেলেমানুষী করিতে আসি নাই।

পকেট হইতে তিনি একখানি একশত টাকার নোট বাহির করিয়া টেবিলের উপর রাখিলেন।

আমি। আমি এখনও বলিতেছি, আমি পারিব না।

যু। কেন পারিবেন না?

আমি। না, ইহা আমার দ্বারা হইবে না। আমার এ কার্যে আমাকে সাধারণের নিকট নিন্দাভোগ করিতে হইবে। সকলেই আপনাকে শুধু পাগল ভাবিবে না, আমাকেও বদ্ধ পাগল বলিয়া জানিবে।

যু। বেশ, না পারেন, আর একটি আমার সামান্য কথা রাখুন, আমি আপনা আপনি ওইটুকু কাটিয়া ফেলিতেছি। বাঁ হাতে যদিও সুবিধা মত কাটিতে পারিব না, তাহাতে ক্ষতি নাই। যাই হোক্, আপনি ঔষধাদি দিয়া বাঁধিয়া দিবেন।

পকেট হইতে তিনি একখানি শাণিত ছুরিকা বাহির করিলেন। আমি অবাক হইয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলাম। পর মুহূর্তে দক্ষিণ হাতের নির্দিষ্ট স্থানে তিনি সেই ছুরি বিদ্ধ করিলেন; অজস্র ধারে রক্ত বাহির হইল। সেই একজ্ঞায়ী যুবককে আমি বলিলাম, ‘যদি একান্তই কাটিতে হইবে—আমি কাটিয়া দিতেছি।’

বাঁ হাতে তাঁহার দক্ষিণ হাত ধরিয়া, তাঁহার হাত হইতে ছুরিখানি লইয়া বলিলাম, ‘মুখ ফিরিয়া দাঁড়ান, রক্ত দেখিয়া অনেকে জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়ে।’

তিনি বলিলেন, ‘কোন আবশ্যক নাই, আমি তো আপন ইচ্ছায় আপনাকে অস্ত্র করিবার নিমিত্ত পীড়াপীড়ি করিতেছি।’

আমি তাঁহার কথামত সেই নির্দিষ্ট অংশের মাংসখণ্ড কাটিয়া তুলিলাম। প্রবল বেগে রক্তস্রোত বহিতে লাগিল। স্থিরদৃষ্টে তিনি সকলই দেখিতেছিলেন। কাটিবার সময় মুখে যন্ত্রণার কোন চিহ্ন দেখা যায় নাই—হাত কাঁপে নাই—নড়ে নাই। যখন মাংসখণ্ড কাটিয়া পৃথক করা হইল, তখন তাঁহার বদনবিবর ও নাসারন্ধ্র দিয়া একটি অতি তৃপ্তির দীর্ঘ নিশ্বাস সশব্দে বহিল। সেই সঙ্গে বলিলেন, ‘আঃ বাঁচিলাম।’

‘এখন আর কোন যন্ত্রণা নাই?’

‘না—কিছু না—সকল যন্ত্রণা গিয়াছে। ওই মাংসখণ্ডের সঙ্গেই সকল যন্ত্রণা উবিয়া গিয়াছে। আঃ বাঁচিলাম, আর এই রক্তপাত কিছুই নহে, আর একদিনের কথা মনে হইলে ইহা তার কাছে অতি সামান্য। যত রক্ত বাহির হইতেছে ততই যেন আমার শরীর সুস্থ হইতেছে; যত বাহির হইতে পারে হোক, লাভ বই ক্ষতি নাই?’

যতক্ষণ রক্ত ছুটিতে লাগিল, ততক্ষণ যুবক আনন্দোৎফুল্ল নয়নে তাহা দেখিতে লাগিলেন। যত শীঘ্র পারিলাম আমি ঔষধাদির দ্বারায় রক্ত বন্ধ করিয়া, ক্ষতস্থান বাঁধিয়া দিলাম।

ইতিমধ্যে তাঁহার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখভাব সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হইল। যেন তিনি নূতন জীবন পাইলেন। তাঁহার সেই অতি ম্লান নয়নদ্বয় আনন্দোপ্তাসিত হইয়াছে। ললাটদেশ আর কুঞ্চিত নহে; যেন তিনি আর তিনি নহেন।

যুবক বলিলেন, ‘মহাশয়, আপনাকে শত শত ধন্যবাদ। আপনার কৃপায় আমি সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করিয়াছি। যৎকিঞ্চিৎ আপনাকে পারিশ্রমিক স্বরূপ দিলাম। কিন্তু আপনি আজ আমার যে উপকার করিলেন তাহার কাছে উহা কিছুই নহে। আপনার ঋণ অপরিশোধ্য; চিরজীবন আপনার নিকট কৃতজ্ঞ রহিলাম।’

আমি তাঁহার প্রদত্ত একশত টাকার নোট গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিলাম। তিনিও কোনমতে তাহা ফিরাইয়া লইতে চাহেন না। শেষে আমাকে তাঁহার সেই পীড়াপীড়িতে বিরক্ত হইতে দেখিয়া বলিলেন, ‘আপনি যদি একান্তই না গ্রহণ করেন, কোন দাতব্য চিকিৎসালয়ে দান করিয়া বাধিত করিবেন।’ বলিয়া চলিয়া গেলেন।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

ডাক্তারবাবুর কথা—ক্রমশ

এক সপ্তাহ কাটিয়া গেল, আর সেই অপরিচিত রোগীটির দেখা পাইলাম না। দ্বিতীয় সপ্তাহ অতিবাহিত হইল তথাপি সংবাদ নাই। তৃতীয় সপ্তাহের শেষে একদিন প্রাতঃকালে আমি আপনার শয়ন-প্রকোষ্ঠে বসিয়া একখানি সংবাদপত্র পাঠ করিতেছি, এমন সময় দ্বারবান আসিয়া সংবাদ দিল, আবার না কি সেই রোগশূন্য রোগী, উন্মত্তপ্রায় যুবক আসিয়াছেন।

তাঁহার কাণ্ডকারখানায় আমার মনে অতিশয় কৌতূহল হইয়াছিল; তখনই বহিবাটিতে গিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। প্রথমবার যেমনভাবে তাঁহাকে দেখিয়াছিলাম, এবারও তাহাই দেখিলাম। সেইরূপে সেই দক্ষিণ হস্ত সেই রেশমী রুমালে গলদেশে বাঁধা রহিয়াছে। সেইরূপ মুখমণ্ডল মলিন, যন্ত্রণাক্লিষ্ট, ম্লান। ললাট কুঞ্চিত, চক্ষু কালিমালেপিত নিষ্প্রভ; তাহার সেইরূপ ভাব দেখিয়া স্তম্ভিত হৃদয়ে আমি জিজ্ঞাসিলাম, ‘আবার কি হইয়াছে?’

যুবক উত্তর করিলেন, ‘ঠিক কাটা হয় নাই।’ স্বর অতি ক্ষীণ—অতি মৃদু, ‘আগেকার চেয়ে এখন যাতনা আরও বাড়িয়াছে, কিছুতেই আর সহ্য হইতেছে না। ইচ্ছা ছিল আর আপনাকে কষ্ট দিব না; মনে করিয়াছিলাম এই যন্ত্রণা হয়তো মাথায় কিংবা বুকে উঠিবে, তাহা হইলে যন্ত্রণাময় জীবনের সঙ্গে এ যন্ত্রণা ঘুচিয়া যাইবে। কই, তাহা হইল না, যেখানকার যন্ত্রণা ঠিক সেইখানে আছে, এক তিল নড়ে নাই। আমার মুখের দিকে ভাল করিয়া চাহিয়া দেখুন, তাহা হইলেই ঠিক বুঝিতে পারিবেন, আমার কত যন্ত্রণা হইতেছে।’

যুবকের বর্ণ গৌর হইলেও কে যেন সত্য সত্যই তাহার সর্বাঙ্গে কালি মাড়িয়া দিয়াছে। ললাট ঘর্মবিন্দুতে পূর্ণ হইয়া গিয়াছে। যন্ত্রণায় মধ্যে মধ্যে তাহার শ্বাস রুদ্ধ হইয়া যাইতেছে। ক্ষতস্থানের বাঁধন অতি সন্তর্পণে খুলিয়া ফেলিলাম। দেখিলাম ক্ষতস্থান নূতন মাংসে প্রায় পূর্ণ হইয়া আসিয়াছে; আশ্চর্যের কিছুই দেখিলাম না। হাত টিপিয়া নাড়ী দেখিলাম, অতি দ্রুত কিন্তু জ্বরের তো কোন প্রমাণই নাই।

আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম, ‘এমন আশ্চর্য ব্যাপার আমি কখন দেখি নাই।’

‘বড়ই আশ্চর্য কাণ্ড—বড় ভয়ানক; যাহাতে আমি এ দারুণ যন্ত্রণা হইতে শীঘ্র নিষ্কৃতি পাই তাহাই করুন, কি হইয়াছে কি না হইয়াছে দেখিবার কোন আবশ্যক নাই। এ ভীষণ যন্ত্রণা হইতে আমাকে নিস্তার করুন। এবারে বেশি গভীর করিয়া কাটিয়া দিন; বোধ করি তাহা হইলেই আমি সুস্থ হইতে পারিব।’

আমি এবার তাহার কথামত পূর্বাপেক্ষা গভীর করিয়া সেই স্থানে কাটিয়া দিলাম। মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, তখন তাঁহার সেই বিবর্ণীকৃত মুখমণ্ডলে আর কোন যন্ত্রণাব্যঞ্জক চিহ্ন নাই। ক্ষতস্থান দিয়া প্রবল বেগে রক্ত ছুটিতেছে; স্থির, সল্পনেত্রে তিনি তাহাই দেখিতেছেন।

তখনই আমি রক্ত বন্ধ করিয়া, ক্ষতস্থান বাঁধিয়া দিলাম। তিনি যাইবার সময় দুই একবার জোরে জোরে আশ্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ‘এখন আর আমার কোন কষ্ট হইতেছে না। বেশ সুস্থ হইয়াছি।’

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

পত্র—প্রথমাংশ

এ কথা আমি সহব্যবসায়ী বন্ধুদিগের দুই-চারিজনকে জানাইলাম। তাঁহারা শুনিয়া চমৎকৃত হইলেন। কি রোগ বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না।

প্রায় মাসাতীতকাল পরে একদিন আমি সেই যুবকের লিখিত একখানি পত্র পাইলাম। পত্রখানি বেশ বড়—অতি ছোট ছোট অক্ষরে ঘেঁষাঘেঁষি লাইনে লেখা। নিম্নে নিজের যে নাম লিখিয়াছেন তাহা যদি তাঁহার স্বাক্ষর হয়, বুঝিলাম, তাহা হইলে তাঁহার হস্তে আর সেরূপ যন্ত্রণা নাই। নতুবা লেখনী ধারণ করা তাঁহার পক্ষে দুঃসাধ্য হইত।

পত্রখানি এইরূপ: —

ডাক্তার মহাশয়!

এতদিনে বুঝিতে পারিয়াছি আপনি কিংবা চিকিৎসাশাস্ত্রে এমন কোন বিধান নাই, যাহা আমার এ যন্ত্রণার কারণ নিরূপণ করিতে পারে। উঃ! এ যন্ত্রণা কি প্রাণান্তক!

আজ আমি আপনার নিকট আমার এ যন্ত্রণার মূল কারণ প্রকাশ করিব। গত সপ্তাহে আবার আমার হাতে ঠিক সেই স্থানে সেইরূপ দারুণ যন্ত্রণা আরম্ভ হয়। সে যন্ত্রণা সহ্য করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল। আপনাকে একখণ্ড পত্র লিখিব মনে মনে স্থির করিলাম, কিন্তু লেখনী চালনা করিবার ক্ষমতা আমার নাই। ভাবিয়া চিন্তিয়া এক উপায় স্থির করিলাম, সেই যন্ত্রণাময় ক্ষতস্থানে আমি একখণ্ড জ্বলন্ত অঙ্গার স্থাপন করিলাম। আপনারা যেরূপ poultice বাঁধেন, সেইরূপে লোহার তার দিয়া সেই জ্বলন্ত অঙ্গারখণ্ড সেই ক্ষতস্থানে চাপিয়া বাঁধিলাম। যতক্ষণ সেই অগ্নি নিভে নাই ততক্ষণ আমি কোন যন্ত্রণা অনুভব করি নাই। তুলনায় সে যন্ত্রণার কাছে, অগ্নিদাহের যন্ত্রণা কিছুই নহে। এরূপ না করিলে কখনই আমি একটি কথাও আপনাকে আজ লিখিয়া জানাইতে পারিতাম না। ছয় মাস পূর্বের কথা বলিতেছি; তখন আমার সুখের সীমা ছিল না। আমার মসিক যে আয় ছিল তাহাতে আমার বেশ সুখ স্বচ্ছন্দে দিনাতিবাহিত হইত।

দুই বৎসর পূর্বে আমি আমাদিগের কোন দরিদ্র প্রতিবাসীর একটি সুন্দরী, সুশীলা কন্যাকে বিবাহ করি; তাহার স্বভাব চরিত্রের কথা ঠিক বর্ণনা করিতে পারিলে উপন্যাসের গাথা স্বরূপ হইয়া পড়ে। তাঁহার নাম শোভনা। আমাকে একদণ্ড ছাড়িয়া সে থাকিতে পারিত না। একদণ্ড যদি আমাকে আমি তাহার চক্ষুর অন্তরালে রাখিতাম, তাহার সেই মুখমণ্ডল মলিন হইয়া যাইত। নয়ন সজল হইত, সাত পাঁচ ভাবিয়া কেমন এক রকম হইয়া পড়িত। যদি কোনদিন বাটি ফিরিতে অনেক রাত হইত, হতভাগিনী আমার জন্য, এই পিশাচের জন্য জাগিয়া বসিয়া থাকিত—ঘুমাইত না—আমার অপেক্ষায় বসিয়া কাঁদিত। এখন বেশ বুঝিতেছি তাহার সেই অগাধ ভালবাসা এ পৃথিবীর ছিল না।

এমন কি আমাকে ছাড়িয়া শোভনা পিতৃগৃহেও যাইতে চাইত না। আমি বরং বিশেষ করিয়া, বলিয়া কহিয়া মধ্যে মধ্যে দেখাশুনা করিয়া আসিতে বলিতাম। কথা ঠেলিতে পারিত না, যাইত; কিন্তু এক বেলার অধিক থাকিতেও পারিত না।

আপনি বলিবেন, কোন স্ত্রী তাহার স্বামীকে যতদূর ভালবাসিতে হয় বাসে না? আমিও তাহা স্বীকার করিয়া লইতেছি; কিন্তু, কোন্ স্বামী এমন ভালবাসা পাইয়া সুখী হয় না। তেমন প্রগাঢ় ভালবাসা কোন্ স্বামীর সহ্য হয় না, তাই সেটুকু সে সাধ করিয়া নিজে নষ্ট করে? আমি, আমি, আমি সেই নরাধম স্বামী। আমিই সেই নরপ্রেত।—হায়, হায়! অমরাবতীতে নন্দন-কাননের পারিজাততলে, রত্নবেদীতে বসিয়া সাধ্বী-সতী ইন্দ্রাণী শচীর স্বহস্তে গাঁথা পারিজাত মালা নির্মাল্য স্বরূপ কি জানি কোন্‌ ভ্রমক্রমে বুঝি এ নরপিশাচের গলায় আসিয়া পড়িয়াছিল। সে অপার্থিব স্বর্গীয় সামগ্রীর আদর আমি কি বুঝিব, তাই অতি শীঘ্র দিব্য গন্ধ পারিজাত সম্ভার শতখণ্ডে ছিঁড়িয়াছি।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

পত্র—মধ্যাংশ

মানুষ কি পাগল! সেই জন্য বুঝি অতি সুখের ভিতর হইতে কোথায় দুঃখ আছে সাধ করিয়া আপনা হইতে তাহাই আগে টানিয়া বাহির করিতে চায়! কি জানি একদিন কোন শয়তানের কি মোহমন্ত্র কুক্ষণে আমার কর্ণে পশিল।

আমার স্ত্রীর আলাহিদা একটি বাক্স ছিল, কখন সে সেই বাক্সের চাবি দিতে ভুলিত না, কি সেই চাবি কখন ভুলিয়া ফেলিয়া রাখিত না; এই দুই বিষয়ে সে সদা সাবধান থাকিত। এত সতর্কতার কারণ কি?

এত সতর্কতার কারণ কি? ইহাই আমার হৃদয়ের মধ্যে সর্বদা তখন আন্দোলিত হইতে লাগিল। এই এক চিন্তায় আমায় যতদূর অস্থির করিয়া তুলিতে হয় তুলিল। আমি পাগলের মত হইয়া পড়িলাম।

মনের ভিতর দারুণ সংশয়, দারুণ দুর্ভাবনা, দারুণ অবিশ্বাস। তাহার সেই অপার্থিব ভালবাসা, সেই অসীম অনুরাগ, সেই স্বর্গীয় পবিত্রতা কিছুরই উপর আর বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। সকলই যেন ভণ্ডামি বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।

সেই সরলতা মাখা দৃষ্টি, সেই মুখমণ্ডলের অকলঙ্ক ভাব, আবেশময় প্রেমালিঙ্গন, সে সকলে যেন কে বিষ মাখাইয়া কি এক বিষের আগুন জ্বালাইয়া দিল।

একদিন শোভনার একটি বাল্যসখী আসিয়া নিমন্ত্রণ করিয়া তাহাকে নিজের বাটিতে লইয়া যাইবার জন্য বড় জেদাজেদি আরম্ভ করিল। এখনও তাহাদের মধ্যে পরস্পরের বড় ভালবাসা ছিল। কিন্তু শোভনা আমাকে ছাড়িয়া তাহার সহিত কিছুতেই যাইতে চাহে না। তখন শোভনার সেই বাল্যসখী আমাকে আসিয়া ধরিয়া বসিল; আমি শোভনাকে তাহার সঙ্গে যাইতে বলিলাম। শোভনা আমার কথা কখন ঠেলিত না—যাইতে চাহিল। শোভনার বাল্যসখী—বাল্যবিধবা।

সেই দিন যাইবার সময় শোভনা যথায় চাবি লুকাইয়া রাখিল আমি দূরে থাকিয়া গোপনে দেখিলাম। সে চলিয়া গেলে আমি সেই চাবি বাহির করিলাম। তাড়াতাড়ি সেই বাক্স খুলিয়া ফেলিলাম, আমার অন্তরাত্মা কাঁপিতে লাগিল। হাত হইতে চাবি ভূতলে পড়িয়া গেল। হৃদয় দৃঢ় করিয়া আমি সকল জিনিস উল্টাইয়া পাল্টাইয়া তন্ন তন্ন করিয়া দেখিতে লাগিলাম। পাছে সে আসিয়া বুঝিতে পারে তাহার অসাক্ষাতে আমি তাহার বাক্স খুলিয়াছিলাম সেইজন্য আবার যথাকার যে সামগ্রী পূর্ববৎ সাজাইয়া রাখিতে লাগিলাম।

এটা ওটা তুলিতে রাখিতে দেখিতে পাইলাম, বাক্সের এক কোণে একতাড়া পত্র রহিয়াছে; তাড়াতাড়ি টানিয়া বাহির করিলাম। বুকের ভিতর তুমুল ঝটিকা বহিতে লাগিল। নিশ্বাস রুদ্ধ হইয়া গেল, রুদ্ধশ্বাসে, কম্পিত করে, সশঙ্ক হৃদয়ে পত্রগুলি খুলিয়া পড়িতে গেলাম; তখন বুকের ভিতর যেন বিদ্যুদগ্নি ঝকিয়া ঝকিয়া মস্তকে প্রবেশ করিল। কি ভয়ানক! এ সকল যে প্রেমপত্র।

পত্রগুলি জরির কাজ করা গোলাপী রঙের একটুকরা ফিতায় বাঁধা ছিল—খুলিলাম। পড়িতে যাই—পারি না, সাহসে কুলায় না। কোথা হইতে কোন পিশাচ যেন তখন হাঁকিয়া হাঁকিয়া আমার কানে কানে বলিয়া দিল, ‘ভীরু। পড়িয়া দেখ—সকলই বুঝিতে পারিবে।’

কেহ তথায় ছিল না; এমন কি ভিত্তি গাত্রে এমন একখানি দর্পণও ছিল না—যাহাতে আমারই নিজের মূর্তি প্রতিবিম্বিত হইয়া সে সময়ে আমাকে একবারের জন্যও লজ্জিত করে—ধিক্কার দেয়। একে একে সকল পত্ৰই আমি পড়িলাম। প্রত্যেকখানিরই নিম্নে আমার একজন বন্ধুর নাম স্বাক্ষর দেখিলাম। পত্রগুলি সাবধানে রাখিবার জন্য প্রত্যেক পত্রেই যথেষ্ট করিয়া সাবধান করা হইয়াছে।

তখন আমার মনের অবস্থা কিরূপ হইয়াছিল, কে জানিবে? সর্বাঙ্গে বিষদাহের যন্ত্রণা হইতে লাগিল। পাঠশেষে পত্রগুলি তেমনি করিয়া আবার বাঁধিয়া ফেলিলাম; যে স্থানে ছিল তেমনি করিয়া আবার রাখিয়া দিলাম। কম্পিত হস্তে বাক্স রুদ্ধ করিলাম।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পত্র—শেষাংশ

শোভনার ফিরিতে সন্ধ্যা হইল।

সর্বাগ্রে শোভনা আমার নিকট ছুটিয়া আসিল; যেন সে আমাকে কতদিন দেখে নাই, তাই আমার মুখপানে কতক্ষণ অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল। আমাকে দেখিয়া সে যেন কত সুখী হইল। আমি তখন আপনার মনোভাব একেবারে গোপন করিয়া অন্যান্য দিবসের ন্যায় কথোপকথন করিতে লাগিলাম। কিন্তু এদিকে প্রাণের ভিতর বিষের হস্কা ছুটিতেছিল; সে তাহা বুঝিতে পারে নাই।

রাত এগারটার পর উভয়ে শয়ন করিলাম। আমার চক্ষে নিদ্ৰা নাই—হৃদয়ে শান্তি নাই; শয্যা কণ্টকাকীর্ণ বোধ হইতে লাগিল। সেই কণ্টক শয্যায়, জ্বালাময় অবস্থায় রাত একটা বাজাইলাম—চক্ষে নিদ্ৰা নাই। নিদ্রা? সে আশা বৃথা!

আর আমি থাকিতে পারিলাম না; যত রাত বাড়িতে লাগিল ততই সে অন্তর্দাহ সেই সঙ্গে আরও বাড়িতে লাগিল—ক্রমে অসহ্য হইয়া উঠিল। যখন রাত দুইটা সেই কণ্টকশয্যা ত্যাজিয়া উঠিলাম। উঠিয়া আগে প্রদীপ জ্বালিলাম। দেখিলাম, শোভনা নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাইতেছে। দুগ্ধশ্বেত উপাধানে তাহার সেই সুন্দর মুখমণ্ডল পরম শোভাময়। শুভ্র মেঘখণ্ডের বুকে যেন কোন দেবীমূর্তি চিত্রিত রহিয়াছে। বুঝিলাম না—বুঝিতে পারিলাম না—চেষ্টাও করিলাম না। প্রকৃতির এমন নির্দোষ সৌন্দর্যরাশির মধ্যে নরকের পাপের ছায়া কোথা হইতে আসিয়া মিশিল! স্থির করিলাম, শোভনাকে সেই রাত্রেই হত্যা করিব; তাহার সেই নিদ্রিত অবস্থায় তাহাকে হত্যা করিবার জন্য শাণিত ছুরিকা বাহির করিলাম। বাহির করিয়া তাহার সেই কমলকোমল কণ্ঠে বসাইতে গেলাম। হাত কাঁপিয়া কাঁপিয়া ছুরিখানা গৃহতলে পড়িয়া গেল। একবার ভাবিলাম, কেমন করিয়া সেই নবনীকোমল কণ্ঠে শাণিত ছুরিকা বিদ্ধ করিব। যাহাকে এতদিন নিজের অপেক্ষা অধিক ভালবাসিয়া আসিয়াছি, যাহার সুখ বিধানের জন্য একদিন প্রাণপণ করিতে পারিয়াছি আজ তাহাকে কেমন করিয়া এ সংসার হইতে বিদায় করিব? তখন আবার সেই পিশাচের মোহমন্ত্রে মোহিত হইলাম—সে যেন আমার চক্ষের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বিদ্রূপের মৃদু হাসি হাসিতে হাসিতে বলিল, ‘কাপুরুষ, সাহস নাই।’ সেই কথা গম্ভীর নাদে তখন হৃদয়ের কন্দরে কন্দরে ছুটিতে লাগিল। আমার বিকৃত মস্তিষ্ক আরও বিকৃত করিয়া তুলিল। তখন অতি সাহসে বুক বাঁধিয়া আবার সেই শোণিত-তৃষ্ণার্ত লৌহময় নির্দয় ছুরি দৃঢ় মুষ্টিতে তুলিয়া লইলাম। দৃঢ় মুষ্টিতে ধরিয়া অকম্পিত করে নিদ্রিতা শোভনার সেই নিদ্রা চিরনিদ্রায় পরিণত করিবার জন্য তাহার বক্ষে আমূল বিদ্ধ করিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই অজস্রধারে রক্ত ছুটিতে লাগিল—স্থির দৃষ্টিতে তাহাই আমি দেখিতে লাগিলাম। দেখিলাম, তখন একবার যন্ত্রণায় শোভনা ছট্‌ফট্‌ করিয়া উঠিল। চক্ষুরুন্মীলন করিয়া স্থির দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ আমার দিকে চাহিয়া রহিল। কিন্তু সে দৃষ্টিতে ক্রোধের কোন চিহ্ন ছিল না। তাহার দৃষ্টিতে কখনও ক্রোধব্যঞ্জক চিহ্ন দেখি নাই— আজিও দেখিতে পাইলাম না। দেখিতে দেখিতে শোভনার প্রাণবায়ু বহির্গত হইয়া গেল। তখন আমার হাতের উপর শোভনার একবিন্দু রক্ত পড়িয়াছিল। কোথায় পড়িয়াছিল তাহা আপনি জানেন। সে রাত্রে আমি সে রক্তবিন্দু দেখিতে পাই নাই, পরদিন দেখিলাম, একবিন্দু রক্ত আমার হাতের উপর শুকাইয়া রহিয়াছে।

যে কৌশলে আমি নিজের অপরাধ গোপন করিয়াছিলাম তাহা আপনাকে জানাইতে চাহি না। আইনের হাত এড়াইলাম বটে, কিন্তু ঈশ্বর যে উপরে রহিয়াছেন সে কথা তখন মনে পড়ে নাই।

ক্রমে শোভনাকে ভুলিতে আরম্ভ করিলাম। তাহার উপর আমার সেই অতি নিষ্ঠুরতার জন্য কখন কখন মন যে অত্যন্ত ব্যাকুল না হইয়াছিল তাহা নহে, কিন্তু সেই আমাকে নিষ্ঠুর করিয়াছিল ভাবিয়া মন স্থির করিতে চেষ্টা করিতাম। প্রাণে এমন একটা দারুণ আঘাত না লাগিলে কেহ কি এমন করিয়া নিজের স্ত্রীর গলায় শাণিত ছুরি বসাইতে পারে?

কয়েক দিবস পরে একদিন অপরাহ্ণে শোভনার সেই বিধবা বাল্যসখী আমার সঙ্গে দেখা করিল। আমাকে শোকার্ত ভাবিয়া কত বকিল, কত বুঝাইল, আমি তাহার সে সকল কথার একটি বর্ণও হৃদয়ঙ্গম করিয়া উঠিতে পারি নাই। কর্ণপাতও করি নাই। সান্ত্বনায় আমার প্রয়োজন? আমি দুঃখিত নহি—শোকার্ত নহি—কাতর নহি।

তাহার পর সে একথা ওকথা অনেক কথার পর আমার হাত ধরিয়া, একটু থতমত খাইয়া, জড়িত স্বরে, কম্পিত কণ্ঠে বলিল; ‘আমি জানি, তুমি কখনই কাহারও কাছে প্রকাশ করিবে না। আমার একটি লুকানো কথা এখন তোমার কাছে না বলিলে নয়, তাহাই বলিতে হইতেছে। তুমি হয়তো আমাকে মনে মনে ঘৃণা করিবে। কি করিব? মানুষের মন বশ মানিবার নহে। কতকগুলি গুপ্তপত্র আমি নিজের কাছে রাখিবার কোন সুবিধা না পাইয়া শোভনার নিকট রাখিয়াছিলাম; সে পত্রগুলি যদি তুমি খুঁজিয়া বাহির করিয়া আমাকে দাও—বড় উপকার করিবে।’

তাহার কথা শুনিয়া তখন আমার আপাদমস্তক কাঁপিতে লাগিল। মস্তকে আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। মনের গতি ঠিক রাখিতে না পারিয়া তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সে সকল প্রেমপত্রে কি লেখা আছে?’

ক্রোধে বিধবার চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল। বলিল, ‘পত্রে কি লেখা আছে কি না তাহা তোমার জানিবার আবশ্যক কি? ছি ছি রমেশ, তোমার অপেক্ষা তোমার স্ত্রীর হৃদয় শতগুণে মহৎ ছিল। যখন তাহাকে আমি পত্রগুলি রাখিতে দিয়াছিলাম, পত্রে কি লেখা আছে কি না, ভুলিয়াও সে একবার সে কথা জিজ্ঞাসা করে নাই। শোভনা দিব্যি করিয়াছিল সে কখনই আমার গচ্ছিত পত্র পাঠ করিবে না। সে যে আমার পত্রের একটি বর্ণও পাঠ করে নাই এ আমি নিশ্চয় বলিতে পারি। তাহাকে আমি ভাল রকম চিনিতাম, শোভনার ন্যায় অমন সরল স্বভাবের স্ত্রীলোক এ জগতে দুর্লভ।

আমি। কিরূপে আমি তোমার পত্রগুলি চিনিয়া বাহির করিব?

সে। জরির কাজ করা গোলাপী রঙের ফিতায় পত্রগুলি একসঙ্গে বাঁধা আছে।

আমি। খুঁজিয়া দেখিতেছি।

কোথায় সে পত্রের তাড়া ছিল আমার নিকট অবিদিত নহে। তথাপি আমি এদিক ওদিক অনর্থক অনুসন্ধান করিয়া যেন সে পত্রগুলির বিষয় কিছুই জানি না এইরূপ ভান করিয়া কতক্ষণ পরে পত্রগুলি বাহির করিয়া তাহার হস্তে দিয়া বলিলাম, ‘এই পত্রগুলি কি তোমার?’

‘হাঁ—হাঁ—এই বটে; যেমন আমি পত্রগুলি বাঁধিয়া শোভনার হাতে দিয়াছিলাম ঠিক তেমনিই আছে।’

আমি আর তাহার দিকে মুখ তুলিয়া চাহিতে পারিলাম না; পাছে সে আমার মুখ চোখের ভাব দেখিয়া বুঝিতে পারে আমি সেই সকল পত্র খুলিয়া পাঠ করিয়াছিলাম। আর আমি সেখানে দাঁড়াইতে পারিলাম না, মাথা যেন কেমন ভারী হইয়া উঠিল—ঘুরিতে লাগিল। শয্যায় গিয়া শয়ন করিলাম। আপনার হাতে মাথার চুল ছিঁড়িতে লাগিলাম, বক্ষে কাঘাত করিয়া প্রাণের ভিতর যে হাহাকার পড়িয়া গিয়াছিল, তাহা দমন করিতে চেষ্টা করিতে লাগিলাম। তখন বিধবা চলিয়া গিয়াছে।

সেই থেকে এই যন্ত্রণার আরম্ভ। যদিও তখন সেই রক্তবিন্দু শুকাইয়া উঠিয়া গিয়াছিল—বাহিরের যন্ত্রণার কোন চিহ্ন প্রকাশ পায় নাই। তথাপি সেই রক্তবিন্দু যেখানে লাগিয়াছিল সেখানে ভীষণ যন্ত্রণা হইতে লাগিল। বোধ হইল কে যেন গলিত সীসক ঢালিয়া দিয়াছে। প্রতি দণ্ডে যন্ত্রণা ভীষণ হইতে ভীষণতর হইতে লাগিল। সহস্র চেষ্টায় ঘুমাইতে পারিতাম না। তেমন দারুণ যন্ত্রণা বুঝি পৃথিবীতে আর নাই। এ যন্ত্রণার কথা আমি কাহারও নিকট প্রকাশ করিতে ভরসা করিতাম না—কে বিশ্বাস করিবে? আমি কিরূপ যন্ত্রণা ভোগ করিতেছিলাম আপনি তাহা অবগত আছেন। দুইবার সে প্রাণান্তক যন্ত্রণা হইতে আমাকে নিস্তার করিয়াছেন। কিন্তু যতই সেই ক্ষতস্থান শুকাইয়া আসে ততই যন্ত্রণার বৃদ্ধি হইতে থাকে। দারুণ যাতনায় এখন আমাকে বড়ই অস্থির করিয়া তুলিয়াছে। সহ্য করিবার ক্ষমতাও আর নাই—বোধ হইতেছে এক দণ্ডের মধ্যেই আমাকে ইহলোক ত্যাগ করিতে হইবে। এই আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইতেছে বুঝিয়া মনে মনে আমি সুখী। আশা আছে হইলোকে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইয়া গেলে পরলোকে শোভনা আমাকে মার্জনা করিলেও করিতে পারে। আপনি আমার যে উপকার করিয়াছেন তজ্জন্য আপনাকে সহস্র ধন্যবাদ দিতেছি। কৃতজ্ঞের নমস্কার জানিবেন। ইতি—

শ্রীরমেশচন্দ্র বসু

দুই তিন দিন পরে কয়েকখানি সংবাদপত্রে দেখিলাম যে রমেশচন্দ্র বসু নামক এক ব্যক্তি নিজের মাথা দেয়ালে বারম্বার আঘাত করিয়া আত্মহত্যা করিয়াছেন। তন্মধ্যে কেহ কেহ লিখিয়াছেন, পত্নীশোকই রমেশ বসুর আত্মহত্যার একমাত্র কারণ। যাঁহারা একটু সন্ধান রাখিয়াছিলেন, তাঁহারা, দুরারোগ্য ক্ষতরোগের যন্ত্রণাই আত্মহত্যার একমাত্র কারণ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। যাঁহারা তাঁহাকে বিশেষরূপে চিনিতেন তাঁহারা প্রকৃত সংবাদই লিখিয়াছিলেন যে, তিনি পাগল হইয়া গিয়াছিলেন, দুরারোগ্য ক্ষতরোগ সেই ক্ষিপ্তাবস্থার একমাত্র খেয়াল ব্যতীত আর কিছুই নহে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *