সতীশবাবু
হেডস্যর সতীশবাবু আমাদের অঙ্কের ক্লাস নিতেন। বিশাল লম্বাচওড়া চেহারা, তেমনি জোরালো গলা, আর তীক্ষ্ন ও তীব্র চোখ। ভয়ে গোটা স্কুল সিঁটিয়ে থাকত। সতীশবাবু মানেই সকলের থরহরিকম্প। মারধর কদাচিত্ করতেন, অন্তত আমি বছর দুইয়ের মধ্যে তাঁকে মারধর করতে দেখিনি। তার দরকারও হত না। স্কুলের শুরুতে এক বার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে খোলা বারান্দার কোণে দাঁড়াতেন, তাতেই গোটা স্কুল একদম চুপ মেরে যেত। ও রকম প্রবল ব্যক্তিত্ব সত্ত্বেও তাঁকে নীরস মানুষ বলার উপায় নেই। গল্প করতে বড়ই ভালবাসতেন।
তিনি নিতেন জ্যামিতির ক্লাস। ক্লাসে এসেই হয়তো ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে একটা সাদা বৃত্ত এঁকে ক্লাসের দিকে তাকাতেন। অর্থাত্, কেমন হল? বাস্তবিক তাঁর বৃত্ত আঁকা ছিল প্রায় নিখুঁত, কম্পাস ছাড়াও যে অমন বৃত্ত আঁকা যায় তা ভাবতে পারতাম না। সতীশবাবুর দুর্বলতার কথা আমাদের ভালই জানা ছিল। আমাদের মধ্যে কেউ এক জন হঠাত্ বলে উঠতাম, ওঃ স্যর, দারুণ! সতীশবাবু ভ্রু তুলে বলতেন, কে কী বললি রে? দাঁড়া! মন্তব্যকারী তখন মুখে মুগ্ধতা ফুটিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলত, বৃত্তটার কথা বলছি স্যর! একদম নিখুঁত।
সতীশবাবুর তোম্বা মুখে হাসির ঝিলিক দেখা যেত। এই পুজোয় তিনি সর্বদাই তুষ্ট হতেন। আর সেই যে গল্প শুরু করে দিতেন তার তোড়ে সে দিনের মতো জ্যামিতি ভেসে যেত। গল্প মানে কোচবিহারের নানা অতীত ঘটনার স্মৃতিচারণ, যার মধ্যে তাঁর ও আরও নানা জনের নানা কৃতিত্বের কথা থাকত। কে ভাল সাইকেল চালাত, কে ক্রিকেটে নাম করেছিল, কে ছিল ফুটবলের দিকপাল, এই সব।
তার মানে এ নয় যে তাঁর সব ক্লাসই ছিল ফাঁকির ক্লাস। যখন জ্যামিতি পড়াতেন, তা-ও ছিল এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। এত ভাল বুঝিয়ে দিতেন, বই পড়ার দরকারই হত না।
আমার প্রতি তাঁর একটু স্নেহ হয়েছিল, ক্রিকেটের মাঠে। গেম স্যর অরুণ লাহিড়ি এক জন সত্যিকারের উঁচু জাতের প্রশিক্ষক ছিলেন। বিকেলের দিকে, ক্লাস শেষ হওয়ার পর, তিনি আমাদের মতো কয়েক জনকে বেছে নিয়ে প্র্যাকটিস করাতেন স্কুলের ভিতরকার মাঠে। তাঁর কাছে সত্যিই কিছু শিখেছিলাম। আর ওই প্র্যাকটিসের সময় মাঝে মাঝে হেডস্যর সতীশবাবুও নেমে পড়তেন ব্যাট করতে। হ্যাঁ, তিনি শুধু ব্যাটই করতেন। গেম স্যর বল করতেন, আমরা ফিল্ডিং করতাম। বলতে নেই, সতীশবাবুর মারের যা জোর ছিল তা ভয়াবহ। ধুতির ওপর প্যাড পরে খেলতেন, অমিতবিক্রমে। ক্যাচ তুললেও মারের জোর ছিল বলে ক্যাচ ধরা ছিল শক্ত, দু-চার বার আমিই যা শুধু তাঁর শক্ত ক্যাচ ধরে ফেলতাম, আর তিনি মাঠ কাঁপিয়ে বলে উঠতেন, সাবাস! পিঠ চাপড়ে বলতেন, সাহস আছে তোর।
স্কুলের মধ্যেই এক ধারে স্কুলের হস্টেল। আমরা জনা পনেরো-কুড়ি ছাত্র হস্টেলে থাকতাম। এর মধ্যে ফেল করা কিছু সিনিয়র ছাত্রও ছিল। তাদের মধ্যেই কিছু গন্ডগোল হয়ে থাকবে। সতীশবাবু ভয়ংকর চটে গিয়ে এক সন্ধেবেলা আমাদের সবাইকে মাঠের মধ্যে লাইন আপ করিয়ে রেখে রোষকষায়িত লোচনে তাকিয়ে দাবড়াচ্ছিলেন। তার মধ্যে হস্টেল বন্ধ করে দেওয়া এবং সবাইকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও ছিল। হঠাত্ একটা বাক্য বলেছিলেন, যার মধ্যে ‘একস্ট্রাভ্যাগান্ট’ কথাটাও ছিল। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, বল তো একস্ট্রাভ্যাগান্ট কথাটার মানে কী? কেউ বলতে পারেনি। শুধু আমি ভয়ে ভয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে উঠেছিলাম, অমিতব্যয়ী। আশ্চর্য মানুষ! একটা ইংরিজি শব্দের অর্থ বলতে পারায় বেজায় খুশি হয়ে তিনি প্রসন্নমুখে সবাইকে সেবারকার মতো ক্ষমা করে দিলেন।
কক্ষনও ইংরিজিতে সই করতেন না। অফিসের কাজে কী করতেন জানি না, কিন্তু আমাদের ছুটির দরখাস্তে সর্বদাই বাংলায় লিখতেন, স চ ভৌ। সতীশ চন্দ্র ভৌমিক।
ওই মোটাসোটা থলথলে শরীর নিয়ে এক বার তাঁকে স্কুলেরই একটা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে মালকোঁচা মেরে ফুটবলও খেলতে দেখেছিলাম। অবাক কাণ্ড, ওই শরীরেও পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে তিনি এত জোরে দৌড়ে বল কভার করছিলেন যা অবিশ্বাস্য। বোধহয় ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকদের ম্যাচ ছিল সেটা। খেলার শেষে আমরা যখন তাঁর খেলার ভূয়সী প্রশংসা করছিলাম, তখন শিশুর মতো কী দেমাকের হাসি! হাসতে হাসতেই বললেন, খেলায় কত বার পায়ে পা লাগিয়েছিস, পেন্নাম করলি না যে বড়! অমনি আমরা ঢিব ঢিব করে প্রণাম করে ফেললাম।
আমরা পাশ করে চলে এলাম। তারও কয়েক বছর পর শোনা গিয়েছিল, স্কুলের ম্যানেজমেন্ট থেকে সতীশবাবুর বিরুদ্ধে কী সব অভিযোগ উঠেছে, তহবিল তছরুপ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি। তিনি সাসপেন্ড হয়ে আছেন।
অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। কিন্তু আমরা দূর থেকে আর কীই বা করতে পারি। শেষে শোনা গেল তাঁর চাকরি গেছে। শুনে বড্ড দুঃখ পেয়েছিলাম। ও রকম এক জন মানুষ যে কোনও স্কুলেরই সম্পদ। যাই হোক, সতীশবাবু স্কুলের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটা মামলা দায়ের করেন। আর তাঁকে সসম্মানে হেডমাস্টারের চাকরিতে বহাল করে চা-বাগানের একটা স্কুল। সতীশবাবু সেখানেই তাঁর বাকি কর্মজীবন কাটিয়ে দেন।
মামলার কী ফল হয়েছিল, আমি আজও জানি না। আমার মনে হয়, ও রকম এক জন মানুষকে হেনস্তা করার সুযোগ হীনতর মানুষেরা সহজে ছাড়ে না। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে আমাকে অনেক স্কুলে পড়তে হয়েছে। নিজেও বেশ কয়েক বছর শিক্ষকতা করেছি। কিন্তু ও রকম হেডস্যর আর দ্বিতীয় দেখিনি।