সতি-উন-নিসা
এই মুসলমান রমণীর জীবন-চরিতে দিল্লীর বাদশাহদিগের অন্তঃপুরের একটি চিত্র দেখিতে পাওয়া যায়। তাহা ছাড়া সে সময়ের একজন শিক্ষিত পারসীক মহিলার বিবরণ আমরা জানিতে পারি; তৎপর মাতার হৃদয়ের স্নেহ ও শোকের একটি করুণ দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে আসে।
মুসলমান জগতে পারস্যবাসীদের মত বুদ্ধিমান ও সুসভ্য জাতি আর হয় নাই। ইউরোপে যেমন ফরাসীরা শিল্প ও সভ্যতায় সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ, এশিয়া মহাদেশে পারস্য দেশের লোকেরাও তেমনি। ভারতবর্ষের মুসলমান রাজাদিগের অনেক বিখ্যাত ও কার্য্যদক্ষ মন্ত্রী, সেনাপতি ও শাসনকর্তা পারসীক ছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে মহম্মদ গাওয়ান (বাহমাণী সুলতানদিগের মন্ত্রী), মির জুম্লা (আওরঙ্গজীবের প্রধান সহায়), আলি মৰ্দ্দান্ খাঁ (দিল্লীর যমুনা নহরের এঞ্জিনিয়ার) প্রভৃতির নাম অনেকে শুনিয়াছেন।
সতি-উন্-নিসা (অর্থাৎ বর্শার তীক্ষ্ণ ফলার মত রমণীদের শিরস্থানীয়, রমণীশ্রেষ্ঠ,) পারস্যের মাজেন্দ্রান প্রদেশের একজন সম্ভ্রান্ত লোকের কন্যা। তাঁহার পিতৃ ও শ্বশুরকুল বিদ্যা ও সভ্যতার জন্য বিখ্যাত। তাঁহার ভ্রাতা তালবাই আম্লি সে সময়ে পদ্য রচনায় এবং বাক্যবিন্যাসে অদ্বিতীয় ছিলেন, এবং সম্রাট জাহাঙ্গী- রের রাজসভায় ‘কবির রাজা’ এই উপাধি পাইয়াছিলেন। এই পারসীক পরিবারের অনেকেই ভারতে আসিয়া কাজ করিতেন, কেহ কেহ পারস্যেও থাকিতেন। বিধবা হইবার পর সতি-উন্-নিসা দিল্লীর মহারাণী মতাজ মহলের চাকরী করিতে আরম্ভ করিলেন, এবং কার্যদক্ষতা, বাগ্মীতা, চিকিৎসাবিদ্যা ও সদ্ আচরণগুণে শীঘ্রই আর সব চাকরাণীকে ছাড়াইয়া উঠিয়া রাণীর প্রধান কর্মচারীর পদ পাইলেন। তাঁহার উচ্চপদ ও বিশ্বাসের চিহ্নস্বরূপ রাণীর শীলমোহরটি তাঁহার হাতে রাখা হইয়াছিল।
সতি-উন্-নিসার উচ্চারণ বিশুদ্ধ ছিল, তিনি আরবী কোরান এবং ফার্সী পদ্য ও গদ্য বহি ভাল করিয়া পড়িতে পারিতেন। এজন্য তিনি জ্যেষ্ঠ রাজকুমারী জেহানারার শিক্ষয়িত্রী হইলেন এবং অল্পদিনেই তাঁহাকে কোরান পড়িতে এবং ফার্সী লিখিতে শিখাইলেন। যে সকল সচ্চরিত্র স্ত্রীলোকেরা খাওয়া পরার কষ্টে থাকিত অথবা যেসব গরিব কুমারীদের বিবাহের টাকার অভাব হইত, তাহাদের কথা সতি-উন্-নিসা প্রত্যহ রাণীকে বলিতেন। বৈকালে বাদশাহ যখন অন্তঃপুরে আসিতেন, রাণী তাঁহাকে এই সব কথা জানাইতেন; এবং বাদশাহ তাহাদের জন্য দানের হুকুম দিতেন। এরূপে প্রত্যহ অনেক টাকা বিতরণ হইত। কাহাকে জমি দেওয়া হইত, কাহাকে দৈনিক বৃত্তি, কাহাকে এককালীন দান এবং কুমারীদিগকে নগদ টাকা ও অলঙ্কার। এই শুভকার্য্যে সতি-উন্-নিসা মধ্যস্থ ছিলেন এবং সকলের আশীর্ব্বাদ পাইতেন।
রাণী মরিলে পর, যখন তাঁহার দেহ আগ্রায় তাজমহলে গোর দিতে আনা হয়, সতি-উন্-নিসা সঙ্গে সঙ্গে আসিলেন। বাদশাহ শাহজাহান বড়ই ভাল স্বামী ছিলেন; ধনী এবং মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও আর বিবাহ করিলেন না। তারপর যে ৩৫ বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন একেলা প্রেয়সীর স্মৃতি হৃদয়ে রক্ষা করিলেন। কাজেই রাজবাড়ীতে কর্ত্রীর কাজ করিতে রহিলেন শুধু তাঁহার কন্যা জেহানারা; তাঁহাকেই রাজ-পরিবারের বিবাহ প্রভৃতি উৎসবের বন্দোবস্ত করিতে হইত, স্ত্রীলোকদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইতে হইত, এবং অন্যান্য সামাজিকতা রক্ষা করিতে হইত। এই সব কাজে তিনি সতি-উন-নিসার উপর নির্ভর করিতেন। সতি-উন্-নিসা রাজকুমারীরও প্রধান কর্মচারিণী হইলেন এবং তাহার মোহরের ভার পাইলেন। ফলতঃ এই বৃদ্ধ দাসী রাজ-পরিবারের ছেলে মেয়েদের ঠিক মার মত হইলেন।
রাজকুমারদের বিবাহে সতি-উন্-নিসা, চাকরাণীদের সর্দ্দার হইয়া, বরপক্ষের দানগুলি রাজবাড়ী হইতে লইয়া গিয়া কন্যার মার নিকট পৌঁছাইয়া দিতেন এবং মহামূল্য বকশিস পাইতেন। রাণী মমতাজ মহল বাঁচিয়া থাকিতে ভবিষ্যতে ছেলেদের বিবাহের জন্য অনেক লক্ষ টাকার অলঙ্কার, মণি মুক্তা, কাপড় ও আসবাব সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলেন; তারপর জেহানারা নিজেও এজন্য অনেক দেন। বিবাহে এই সব হইতে বাদশাহকে উপঢৌকন, বর-কন্যাকে দান, রাজপরিবারের সকলকে ও সভাসদ এবং ওমরাহদিগকে উপহার বিতরণ হইত।
জ্যেষ্ঠ কুমার দারাশিকোর বিবাহে দান-সামগ্রী ষোল লক্ষ টাকার ছিল-৭ লক্ষ মণি মুক্তার, এক লক্ষ নগদ টাকা, ৪ লক্ষ সোনা রূপার অলঙ্কার এবং অন্যান্য বহুমূল্য দুষ্প্রাপ্য সামগ্রীতে, বাকি হাতী ঘোড়া ইত্যাদিতে
জাহানারার হুকুমে সতি-উন্-নিসা এ সমস্ত দ্রব্য আগ্রা দুর্গের রাজবাড়ীর প্রশস্ত আঙ্গিনায় সাজাইয়া রাখিলেন। রাত্রে চারিদিকে আলো জ্বালান হইল, বোধ হইল যেন মহামূল্য দ্রব্যের এক প্রদর্শনী (exhibition) খোলা হইয়াছে। লোকেরা দেখিয়া চক্ষু সার্থক করিল; স্বয়ং বাদশাহও দেখিতে আসিলেন। এই মত দ্বিতীয় কুমার শূজার বিবাহে দশ লক্ষ টাকা দান সামগ্রী সাজাইয়া দেখান হইল। এই কাজে সতি-উন্-নিসার কার্য্যকুশলতা, কর্তৃত্ব শক্তি এবং কলানৈপুণ্য বেশ দেখা গেল এবং সেই জন্যই কাজও সুচারুরূপে সম্পন্ন হইল।
সতি-উন্-নিসা যে কেবল জাহানারার মন্ত্রী ছিলেন তাহা নহে। বাদশাহের অন্তপুরের তদারকের ভার তাঁহার উপর, এবং বাদশাহের আহারের সময় পরিবেশন করা ও উপস্থিত থাকাও তাঁহার কার্য্য ছিল। ইহা খুব বিশ্বাস এবং স্নেহের চিহ্ন।
তাঁহার নিজের সন্তান ছিল না; তাই তাঁহার মৃত ভাই তালিবার দুই কন্যাকে তিনি পোষ্য লইয়াছিলেন। তাহাদের উপরই নিঃসন্তান বিধবা-হৃদয়ের যত সঞ্চিত স্নেহ ও ভালোবাসা ঢালিয়া দিতেন। বিশেষতঃ ছোট মেয়েটি তাঁহার যেন চোখের মণি ছিল। পারস্য হইতে হাকিম (ডাক্তার) জিয়াউদ্দীন নামক তাঁহার একজন দেবর পুত্রকে আনিয়া, তাহার সহিত এই মেয়েটির বিবাহ দেন, এবং বাদশাহের অনুগ্রহে তাহাকে মুঘল রাজসরকারে একটি চাকরী দিয়া একরকম ঘর-জামাই করিয়া রাখেন। ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ই জানুয়ারী এত ভালবাসার সামগ্রী এই মেয়েটি দীর্ঘ সুতিকা রোগে মারা গেল। মাতার শোক কি দর্শনের উপদেশ শুনে? সতি-উন্-নিসা যদিও জ্ঞানী ও পণ্ডিত ছিলেন, কিন্তু এখন একেবারে ধৈর্য্য হারাইলেন; এগার দিন পর্য্যন্ত নিজের বাড়ীতে (লাহোর দুর্গের বাহিরে) শোকে উন্মাদ হইয়া পড়িয়া রহিলেন।
শাহজাহান বড়ই দয়ালু ছিলেন, স্ত্রী পুত্র চাকরবাকর সকলের প্রতি তাহার আদর যত্নের সীমা ছিল না। বারো দিনের দিন তিনি শোকের কিছু উপশম হইয়াছে ভাবিয়া সতি-উন্-নিসাকে রাজ-প্রাসাদে ডাকিয়া আনিলেন। কন্যা জেহানারাকে সঙ্গে লইয়া তাঁহার নিকট গিয়া দুজনে কত সান্ত্বনা দিলেন, এবং ওখানে থাকিতে বলিলেন।
পরদিন বাদশাহ শিকার করিতে গেলে, সতি-উন্-নিসা কি কাজের জন্য নিজ বাড়ীতে ফিরিলেন। আহারের পর সন্ধ্যার দুই নমাজ্ (প্রার্থনা) করিয়া কোরান পড়িতে লাগিলেন। রাত্রি আটটার সময় হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন “আমার যেন দম বন্ধ হইয়া আসিতেছে।” অসুখ তাড়াতাড়ি বাড়িতে লাগিল। তাঁহার আত্মীয় মসি-উজ্জমান নামক পারসীক ডাক্তারকে তৎক্ষণাৎ ডাকা হইল। তিনি ঘরে ঢুকিতে সতি-উন্-নিসা তাঁহাকে সালাম করিয়া অমনি এক পাশে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেলেন। তখনও নাড়ী ছিল। কিছুক্ষণ মূর্ছাভঙ্গের জন্য ঔষধ দেওয়া হইল, কিন্তু কোন ফল হইল না। পরে নাড়ী থামিল এবং বুঝা গেল যে সব ফুরাইয়াছে। একপক্ষ সময়ের মধ্যেই স্নেহময়ী মাতা কন্যার সঙ্গ লইলেন
পরদিন বাদশাহ এ দুঃসংবাদ পাইয়া কয়েক জন সম্ভ্রান্ত কর্ম্মচারীকে হুকুম দিলেন, যে খুব সম্মানের সঙ্গে মৃতদেহ সৎকার করিতে হইবে; রাজকোষ হইতে দশ হাজার টাকা শ্রাদ্ধের জন্য দেওয়া হইল। এক বৎসর পরে মৃতদেহ লাহোর হইতে উঠাইয়া আগ্রায় আনিয়া তাজমহলের বাহিরের আঙ্গিনায় পশ্চিম দিকে গোর দেওয়া হইল। ত্রিশ হাজার টাকা দিয়া বাদশাহ এক সমাধি-মন্দির করিয়া দিলেন। তাহা এখনও আছে।
এইরূপে এই প্রভুভক্ত পুরাতন ভৃত্য মৃত্যুতেও প্রভু ও প্রভুপত্নী হইতে দূরে রহেন নাই।
[ভারত মহিলা, আষাঢ়, ১৩১৪।
* আবদুল হামিদ লাহোরীর পারসীক ইতিহাস পাদিশাহনামা হইতে প্রবন্ধের ঘটনাগুলি পাওয়া গিয়াছে।