সঙ্গীত ও অধ্যাত্মসাধনা
মানস প্রয়োজনে ও জৈবধর্মের তাকিদে সঙ্গীত মানবসমাজে স্বতোউদ্ভূত। সে কারণেই কৌম সমাজে art আর ritual অভিন্ন। আদি সমাজে গান কর্মেরই অঙ্গ ছিল–মুখে গান, হাতে কাজ। গানের ছাদে হাত চলে, তাই আজো ছাদ নির্মাণে গান অপরিহার্য। এভাবে জীবনকে কলার অনুগত করে কিংবা কলাকে জীবনানুগ করে সাধনার শুরু হয়েছে কবে থেকে তা কেউ বলতে পারে না। তবে জানা অতীতের গোড়ার দিকের কুয়াশার প্রলেপেও যা ঢাকা পড়েনি তা হচ্ছে : কলাশিল্পের ও অধ্যাত্মজীবনবোধের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। তাই চিত্রকলা ভাস্কর্য নৃত্য ও গীতি এমনকি স্থাপত্যও একই উৎসের ইঙ্গিত দেয়। সঙ্গীতের সঙ্গে জীবনের এমনি গভীর যোগ রয়েছে বলেই ইসলামের সুকঠোর নির্দেশও আরবেরা বেশি দিন মেনে চলতে পারেনি। ইসলামের উন্মেষের মাত্র কয়েক বছর পরেই উমাইয়াদের আমল থেকেই সঙ্গীতচর্চা প্রশ্রয় পেতে থাকে।
আরবদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ কেবল গতানুগতিক চর্চায় নিঃশেষ হয়নি, বরং ইরানী, নবেতিক, সিন্ধি, গ্রীক প্রভৃতি সঙ্গীত পদ্ধতির অনুশীলনে ঋদ্ধ ও উন্নত করার প্রয়াসেও অভিব্যক্ত হয়েছে। তফাতের মধ্যে এই : মুখ্যত মানসপ্রবণতাবশে এবং কিছুটা শাস্ত্রীয় প্রভাবে তা কেবল সৌন্দর্যানুশীলন ও আনন্দের উপকরণ রূপেই গৃহীত হয়েছে। আব্বাসীয় পতনযুগে মুসলিম-সঙ্গীতে আবার ধর্মীয় আবেগ যুক্ত হয়েছে। আসলে ইরানী প্রভাবে সূফীমতের প্রসারেই সঙ্গীত হয়ে উঠল বোধন-গীতি, সাধনসঙ্গীত ও ভজন। কেননা আরবে সঙ্গীতচর্চা ইসলামোেত্তর যুগে অবাধ ছিল না, তার উপর সৌন্দর্যপিপাসা আনন্দ-অন্বেষা ও স্বপ্নালুতাই ছিল তাদের সাঙ্গীতিক প্রয়াসের মূলে।
এদের লক্ষ্য কখনো সঙ্গীতে অধ্যাত্ম আবেগ সৃষ্টির দিকে ছিল না। সমস্ত আরব ইতিহাস, তাহার ভাষা ও সামাজিক জীবন সংক্ষেপে যে একটি কথায় বলা চলে, তাহা হইল কল্পনাবিলাস ও খেয়াল। তাহাদের সাহিত্য, বিজ্ঞান ও ললিত কলায় এই কল্পনার যথেষ্ট নির্দশন বিদ্যমান। ইহাদের স্থাপত্য শিল্পের দিকে লক্ষ্য করিলে দেখা যাইবে যে, সুদৃঢ় ইমারত অপেক্ষা ইহা জটিল রূপকল্প এবং আলঙ্কারিক নকশামাত্র। ইহাদের চিত্রকলা বর্ণসমাবেশের প্রকাশ এবং ইহা সুসম্বন্ধতাহীন সুর সৃষ্ট এমন এক কাল্পনিক নকশা যাহাকে কোনো সংজ্ঞায় বাঁধিয়া দেওয়া যায় না। সঙ্গীত সম্বন্ধেও ঐ একই কথা : শোভা-সৌন্দর্য, সুবৈচিত্র্য এবং অলঙ্করণই হইল ইহার মৌলিক উপাদান। Encyclopaedia of Islam গ্রন্থে সংকলিত মুসলিম স্থাপত্যাদি সম্বন্ধে লিখিত প্রবন্ধে Berchem ( বাৰ্চেম) এই দিকটারই বারবার উল্লেখ করিয়াছেন–সেখানে তিনি বলিয়াছেন আরবি য় শিল্পকলা প্রকৃতি নহে, প্রকৃতির স্বপ্ন। … সঙ্গীতের ক্ষেত্রে মুসলিমগণ শিল্পের জন্যই শিল্প হিসাবে আনন্দ ও সৌন্দর্যভোগের উপায় স্বরূপ ও বিচিত্র অভিজ্ঞতায় উদ্বেল ইন্দ্রিয়ানুভূতির অবলম্বনরূপে সঙ্গীতের চর্চা করিয়াছিলেন এবং সেইজন্যই ইহার সমগ্রতা, ঔজ্জ্বল্য, ভব্যতা ও শালীনতা লইয়া ইহা বিশিষ্ট।
অতএব আর্য বলেই হোক কিংবা ভারতিক প্রভাবেই হোক অথবা জোরাস্ট্রীয় মতবাদের সংস্কার বশেই হোক, ইরানে মরমীয়াবাদের পরিণতি কালে সঙ্গীত ও নর্তন সাধন-ভজনের উপায়রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। ইরানি মরমীয়াবাদ তথা সুফীমত কোনো ঋজু ও অবিমিশ্র দর্শন-উদ্ভূত নয়; এটি গ্রীক বৌদ্ধ খ্রীস্টান ইহুদী মানী ও বেদান্তদর্শনের মিশ্রণে এক জটিল ও বহুধা বিভক্ত মতবাদ। ইসলামের মতো বৌদ্ধধর্মেও নাচ-গান বাজনা নিষিদ্ধ ছিল বটে কিন্তু বৌদ্ধেরাও একই অনিবার্য কারণে তা মেনে চলেনি। ট্রানসকসিয়ানার বৌদ্ধরাই পরবর্তীকালের তুর্কী, পাঠান ও মুঘল মুসলমান। কাজেই তাদের রক্তেও বৌদ্ধগুরুবাদ ও যোগতান্ত্রিক সংস্কার সুপ্ত ছিল। এদিকে ভারতে কালক্রমে অনার্য যোগ-সাংখ্য-তন্ত্র ও আর্য কর্মবাদ আর জ্ঞানবাদের সংমিশ্রণে যে সর্বেশ্বরবাদমূলক বৈদান্তিক ব্রহ্মবাদ প্রশ্রয় পেল, তারই পরিণতিকালে ভারতে মুসলিম অনুপ্রবেশ ঘটে।
যদিও শঙ্কর-দর্শনের প্রভাবেই বৌদ্ধ-উচ্ছেদে ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রতিষ্ঠা পায়, তবু শঙ্করের জ্ঞানবাদ তথা মায়াবাদ লোকের জীবনচর্যায় ফলত ধর্মাচরণে বিশেষ গৃহীত হয়নি। কাজেই যোগতান্ত্রিক সাধনাই মরমীয়াবাদের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে শাস্ত্রীয় ধর্মও নানা মিশ্র মতে জটিল এবং আনুষ্ঠানিক আড়ম্বরে বিপুল হয়ে উঠে। বেদান্ত দর্শনের প্রচ্ছায় গড়া এই আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রতীকি কল্পনায় প্রকৃতির স্থান ছিল মুখ্য আর অলৌকিকতার প্রভাব ছিল অসামান্য। এজন্যেই ভারতীয় কলাশিল্প ধর্মসম্পৃক্ত; ইহা ধর্মের এবং ব্যাপকতর অবস্থায় সমগ্রজীবনের অনুগত। ভারতীয়দিগের নিকট কলাশিল্প সৌন্দর্যানুশীলন অপেক্ষা জীবনকে তাহার সামগ্রিক পূর্ণতায় এবং তাহার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধীয় যাবতীয় রহস্যে উপলব্ধি করার মধ্যেই সমধিক নিহিত। অতলস্পর্শী ব্ৰহ্মতত্ত্বের রূপায়ণ হইল ভারতীয় ললিতকলার জাগ্রত লক্ষ্য। ৫
ইসলাম ও সঙ্গীত *[* এই অংশটুকুর উপকরণ ডক্টর মাখন লাল রায় চৌধুরীর Music in islam: JASBLetters & science 1957 থেকেই বিশেষভাবে সংগৃহীত।]
ইসলাম-পূর্বযুগে অন্য মানুষের মতো আরবেরাও ছিল সঙ্গীতপ্রিয়। আরবি ভাষায় গিনা, মুসিকী ( গ্রীক) এবং সামা ( সিরীয়)–এই তিনটে শব্দ সঙ্গীতবাচক। আরবে পেশাদার গায়িকারা কইনাৎ ( Qainat) কিংবা কিয়ান ( Qiyan) নামে অভিহিত হত। দেশী গায়িকা ছাড়াও আবিসিনিয়া থেকে অনেক গাইয়ে-মেয়ে আসত। এরা সমাজ-জীবনের অঙ্গ ছিল। ইসলাম পূর্বযুগের সঙ্গীতযন্ত্রের মধ্যে আমরা মিযহার (Lute), মিযাফা ( Psalter), কুসাবা (Flute), মিযমার ( Reed pipe) এবং ডাফ (Tambourine), সুর, নাকাড়া, তবলা (অতবল) সঞ্জ, জলাজিল প্রভৃতির নাম পাই। মক্কার উকায-এ যে-বার্ষিক মেলা হত তাতে গোটা আরবের গোত্রগুলো জড়ো হত নিজেদের শৈল্পিক উৎকর্ষ দেখাবার জন্যে। মুয়াল্লাকাগুলো এখানেই গীত বা আবৃত্ত হত। তখনকার আরবে জাদুকর এবং গণকরাও তাদের পেশা চালাত গানের মাধ্যমেই। হজ উদযাপনের সময়ও গান চলত, তার রেশ রয়েছে তাহলিল ও তালবিয়ায়। আশরিক সবির কয়মা নুঘীর–এই আয়াত এখনো সুর করেই পড়া হয় মীনায় ইফাদা করবার সময়। আযানও ইসলাম-পূর্বযুগের প্রথার অনুসরণ। নারী-পর্দাপ্রথা চালু মা-থাকায় রসুলের আমলেও নারীরা উৎসবে-পার্বণে-যুদ্ধে গানে-বাজনায় অংশগ্রহণ করত। ওহুদের যুদ্ধেও নাকি রণগীতি গেয়েছিল নারীরাই।
দেবতা ও উপদেবতার অনুগ্রহ লাভের জন্যেও গায়িকার গানই কার্যকর বলে মনে করা হত। এজন্যে তাদের অপর নাম ছিল দজিনা (Dajina) বা মদজিনা (Madjina)। তাই ইসলাম পূর্বযুগের আরবে নারীর প্রভাব সম্বন্ধে : R.A. Nicholson বলেছেন : Wise women inspired the poets to sing and warriors to fight…. কাফেলায় কিংবা সরাইখানাতেও গায়িকা পোষা হত। আবুল ফারাজ ইসফাহানীর কিতাবুল আগানি ইবন, আবদুরব্বিহির (মৃত্যু : ৯৪০ খ্রী.) ইকদুল ফরিদ, ভৌগোলিক আল মাসুদীর কিতাবুৎ তানবিহ ওয়াল ইশরাক প্রভৃতি পুরোনো গ্রন্থে এবং কোরআনে-হাদিসে নানা প্রসঙ্গে কয়েকজন প্রখ্যাত গায়কের নাম আমরা জানতে পাই। নজর বিন হাবিস, মালিক বিন যোবায়ের, হরায়রা, খুলায়দা, বিলাল হাবসী, শিরিন, সারা, কুরায়ানা, কুরিল্লা, আমর, হামজা প্রভৃতি।
আমরা ইসলাম-পূর্বযুগের আরবে উৎসবে-পার্বণে-হজে, অনাবৃষ্টি-অজন্মায়-দুর্ভিক্ষে, দেবতার আবাহনে, যুদ্ধে, জাদুতে ও ভাগ্যগণনায় গানের প্রয়োগ দেখেছি। তাছাড়া প্রাত্যহিক জীবনে। আনন্দের উপকরণ হিসেবে গুঁড়িখানায়, সরাইতে ও কাফেলায় পেশাদার গায়িকা পোষার রীতিও ছিল অবাধ। এসব গায়িকার সবাই আরব ছিল না; আবিসিনিয়া, গ্রীস ও ইরান থেকেও আসত। এমনকি রসুলের আমলের যুদ্ধে ড্রামবাদক ছিলেন একজন ভারতীয়, তার নাম বাবা Sawandik।
এতে বোঝা যায় আরবেরা সঙ্গীতপ্রিয় জাতি। কাজেই ইসলামোত্তর যুগে সঙ্গীত-বিমুখ হওয়া তাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য কৃচ্ছু সাধনার মতোই দুষ্কর ঠেকেছিল। ফলে প্রবৃত্তির প্রতিকূল সংগ্রামে তারাও বেশিদিন আত্মরক্ষা করতে পারেনি। অবশ্যম্ভাবীরূপে শুরু হল খোঁজাখুঁজি ও ব্যাখ্যা-নিরীক্ষা কোরআন-হাদিসের সমর্থন লাভের আশায়। এবং অভীষ্ট ফল লাভে দেরি হল না।
কোরআন থেকেই সঙ্গীতে আনা আয়াতের অনুমোদন বা অনুমোদনের আভাস ইঙ্গিত বের করা হল :
ক. নিশ্চয়ই গাধার ডাকই সবচেয়ে ঘৃণ্য স্বর।
খ. তিনি ইচ্ছেমতো তাঁর সৃষ্টিতে বৃদ্ধি করেন সুন্দর স্বর।
গ. এবং কোরআন আকর্ষণীয় করে পড়ো।
এমনি আরে অনেক আয়াত থেকে পরোক্ষ ইঙ্গিত২৪ সংগ্রহ করে সঙ্গীতের সমর্থনে ভাষ্য তৈরি হয়েছে। আবার একই পদ্ধতিতে সঙ্গীতবিরোধী তথ্যও উদ্ধার করেছে সঙ্গীতবিমুখ গোঁড়ারা।
হাদিস থেকেও পক্ষে-বিপক্ষে প্রমাণ সংগৃহীত হয়েছে প্রচুর। এতে কেবল বিতর্ক বিস্তৃত ও জটিলই হয়েছে; সবার পক্ষে গ্রহণীয় কোনো মীমাংসা মেলেনি।
হাদিসে সঙ্গীতের সমর্থন
ক. যারা দাউদের সুকণ্ঠ শুনতে ইচ্ছে করে, তারা আবু মুসা আল আশারীর কণ্ঠ শুনুক।
খ. রসুল স্বয়ং শ্লোক বা পদবন্ধ রচনা করে গীতিসুরে আবৃত্তি করেছেন :
১। ইন আন্তা ইল্লা অসবুউ দুমিতি
ওয়া ফি সবিলিল্লাহি মা লকিতি।
(হে রক্তপূর্ণ আঙুল, তুমি আল্লাহর রাস্তায় গিয়েছ)।
২। আতাইকুম আতাইকুম ..
ফাহাইয়ানা ওয়া হাইয়াকুম।
(আমি তোমাদের কাছে এসেছি, এসেছি, আল্লাহ আমাকে এবং তোমাদেরকে দীর্ঘজীবী করুন)
রসুলের ওফাতে শোকাভিভূতা কন্যা ফাতেমাও পদ রচনা করে বিলাপ করেছিলেন:
৩। সব্বত আলাইয়া মসাইবু লউ ইন্নাহা–
সব্বত অলালাইয়ামি শররফা লাইয়াহিয়া।
আমার উপর বিপদপাত হয়েছে। যদি তা দিবালোকের উপর পড়ত, তা হলে তা রাত্রি হয়ে যেত।
গ, হযরত আয়েশা বলেছেন : রসুলের উপস্থিতিতে তার সাহাবীরা পরস্পরকে কবিতা আবৃত্তি করে শুনাতেন। রসুল মৃদু হাসতেন।
ঘ. আমর বিন আশশারীয়া বলেছেন : আমিরসুলের সামনে উমাইয়া বিন আবিল সাতের শতেক শ্লোক ((verse) সবই আবৃত্তি করে শুনিয়েছি। রসুল বলছিলেন, আবৃত্তি করতে থাকো এবং মন্তব্য করেছিলেন উমাইয়া তাঁর কবিতার ভাবে প্রায় মুসলিম হয়ে গেছে।
ঙ. আয়েশা রসুলের আর এক উক্তি উল্লেখ করেছেন : তোমাদের সন্তানদের কবিতা শেখাও, এতে তাদের জবান মিষ্টি হবে।
চ. তিরমিজীতে বর্ণিত আছে : রসুল এক যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে এলে এক মহিলা ডফ (ডাফ) বাজিয়ে গান গেয়ে তাঁকে সম্বর্ধনা করতে চাইলে তিনি অনুমতি দেন।
ছ, তবরানি (Tabarani) তাঁর মজমি কবির-এ বর্ণনা করেছেন : একদিন রসুল নিজেই আয়েশায় কাছে এক গায়িকা এনে হাজির করেন এবং আয়েশার অভিপ্রায়-ক্রমে সে গান গাইল, রসুল শুনে (মুগ্ধ হয়ে) মন্তব্য করলেন : নিশ্চয়ই শয়তান (মিষ্টিস্বরের অধিকারী) তার নাসারন্ধ্র দিয়ে যাওয়া-আসা করছে। কি নফখাশ শয়তানু মেন খারাইয়া।
জ, আয়েশা এক ঈদের দিনে এক আনসার মেয়ের গান শুনছিলেন, রসুল তখন বিছানায় শায়িত ছিলেন। আবু বকর এসে গান-বাজনা হচ্ছে দেখে আয়েশাকে তিরস্কার করে বললেন : শয়তানের যন্ত্র বাজুছে রসুলের ঘরে! রসুল বললেন : তাকে করতে (শুনতে) দাও আবুবকর, আজ ঈদের দিন। [ আবু বকর: মিযমারুশ শয়তানি ফি বায়ত-ই-রসুলিল্লাহ্। রসুল : দাহুন্না ইয়া আবুবকর, ফা ইন্নাহা আইয়ামু ঈদ।]
ঝ, আয়েশা একবার এক এতিম মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, বিয়ের উপহার সামগ্রীর সঙ্গে গায়কও পাঠানো হয়েছিল, রসুলের সম্মতিক্রমে এবং রসুল নিজেও এ উপলক্ষে একটি গান রচনা করেছিলেন :
আনা নবীউ লা কঝিব।
আনা ইব্ন আবদ-ইল মুত্তালিব।
ঞ. একবার রসুলের উপস্থিতিতে আয়েশাকে কয়েকটি গায়িকা ডফ বাজিয়ে গীত শুনাচ্ছিল, উমর এসে বললেন, সঙ্গীত হচ্ছে শয়তানের বিদ্যা,অতএব হারাম। রসুল ভিন্নমত প্রকাশ করলেন। তারপর থেকে উমরও সঙ্গীত উপভোগ করতেন।
ট. আব্বাস ইবন মালিক বলেছেন : রসুল হুদা (কাফেলা চলাকালীন গান-উটগীতি) শুনতেন। এবং আয়েশা স্বয়ং মেয়েদের জন্যে এবং আনাসের ভাই বারা-ইন মালিক পুরুষদের জন্যে হুদা গাইতেন।
ঠ. রসুল আবিসিনিয়াবাসীদের বলেছিলেন : আরফাঁদ গোত্রের সন্তানেরা, তোমাদের অনুষ্ঠান (গান-বাজনার Performance Acrobatic) চালিয়ে যাও। (দুনাকুম ইয়া বনি আরফাদা ববাজি-মাশুগুল বাঁশি।]
ড. আবিসিনীয়গণের (জঙ্গীদের) ক্রীড়া ছিলো নাচ-গান। (বাজি-ই-জঙ্গীয়ান–রক্স ওয়া সুরূদ বুদা।
ঢ, আল্লাহ্ মিষ্টি কণ্ঠস্বর বঞ্চিত কোনো নবী পাঠাননি। মা বাসাল্লাহু নবীয়ান ইল্লা হসন আসসও।
ণ. মিষ্টিস্বরে কোরআনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত কর। [জাইয়িনুল কোরআন বি অসওয়াতিকুম।]।
ত, আল্লাহ্ নবীদের মিষ্টিসুর যেভাবে অনুমোদন করেছেন, এমনটি আর কিছুই করেননি। (মা আজান আল্লাহুতায়ালা লিশায়িন কমা আজানা আন নবীয়িতন হন অসসওত।]
খলিফাদের মধ্যে হযরত আবুবকর সঙ্গীত নিষিদ্ধ মনে করতেন। হযরত উমরও সঙ্গীতবিরোধী ছিলেন, তবে শেষের দিকে তিনি আর তেমন রুষ্ট হতেন না।
হযরত উসমান গান শুনতেন। নিজে গাওয়া গর্হিত মনে করতেন। তাঁর প্রিয় গায়কের নাম ছিলো আবু সাজ্জাদ। হযরত আলি নিজে কবি ছিলেন এবং ললিত কলার সমাদর করতেন। কিন্তু তিনি পেশাদার গায়িকাদের ঘৃণা করতেন।
মোটামুটিভাবে বলতে গেলে খলিফারাও সঙ্গীত বৈধ বলে মনে করতেন না। আরবদের বিশ্বাস শয়তান বড় শিল্পী। ভারতে যেমন সঙ্গীতাদি শিবপ্ৰােক্ত বলে ধারণা, তেমনি শিল্প শয়তান উদ্ভাবিত বলেই আরবদের বিশ্বাস। রসুলের উক্তিতেও এই শয়তানের কথা আছে।
বিশেষ করে ইসলাম-পূর্ব আরবে মদ, নারী ও সঙ্গীত নিয়েই জনগণ মত্ত থাকত, ইসলামের সংগ্রাম ছিল এসব অনাচারের বিরুদ্ধে। কাজেই যৌন-আবেদনমূলক সঙ্গীত ও পেশাদার গায়িকার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে উপায় ছিল না। তাই কোরআনে, হাদিসে ও ফেকায় সঙ্গীতের প্রতি বিরূপতা প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি কবি ও গায়কের সততায় ও সত্যবাদিতায় অবিশ্বাস করার স্পষ্ট নির্দেশও রয়েছে :
ক. বিপথগামীরাই কবির অনুসরণ করে। [ আশু-অরাউ ইবাত্তাবি-উঁহুমুল গাউন।]
খ. [ওয়া মিনান্নাস-ই-মাই ইয়াতারি লাহওয়াল হদিসি লি য়ুদিল্লা আন সবিলিল্লাহ্।]
গ. রসুল বলেছেন : [ ইহজারুল গিনা ফাইন্নাহু মিন ফি, লি ইব্লিস ওয়া হুয়া শিরকুন ইনদাল্লাহি তায়ালাওয়ালা তাগান্নি ইল্লি শয়তান।] : সঙ্গীত থেকে আত্মরক্ষা কর।
এটি ইব্লিসের লক্ষণ; এটি শিরক। শয়তান ছাড়া কেউ গান গায় না।
ঘ. গায়ক ও শ্রোতা আল্লাহর অভিশপ্ত। (লা আনল্লাহ্ অল মুগান্নিআতা ওয়াল মুগান্না লাহু।
ঙ. রসুল গান করা ও শোনা নিষিদ্ধ করেছেন। [ আনিল গিনা-ই-ওয়াল ইসতিমা-ই আনিল গিনা।]
সব প্রতিরোধ ব্যর্থ করে দিয়ে আরব-মনের সাঙ্গীতিক প্রস্রবণ ক্ষীণধারায় ৬৬১ খ্রীস্টাব্দ অবধি বইতে থাকে। তারপর খলিফা মুয়াইয়া (মাবিয়া) যখন শাসনাধিকার পেলেন, তখন থেকে আরব সমাজে সাঙ্গীতিক প্রবণতা বাড়তে থাকে। কেননা, মুয়াইয়া নিজে সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন এবং স্বয়ং গায়িকা পুষতেন। তবু সাহাবী ও ইমামদের মধ্যে সঙ্গীত ব্যাপারে কখনো মতদ্বৈধতা ঘোচেনি। স্থান, কাল, প্রয়োজন ও প্রবণতা অনুযায়ী কেউ বলেছেন যায়েজ, কেউ করেছেন নিষেধ।
ইমাম আবু হানিফা যন্ত্রসহযোগে সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা গান শুনতেন। ইমাম মালিকও গান উপভোগ করেছেন। ইমাম শাফী তাঁর কিতাবুল উলুম-এ সঙ্গীতকে সমর্থন করেছেন। গাজ্জালী তাঁর কিমিয়া-ই-সাদৎ-এ কিতাবুল উলুম সম্বন্ধে মন্তব্যসূত্রে বলেছেন যে শাফী সঙ্গীতের পক্ষপাতী ছিলেন। ইউনুস-বিন-আবদুল আলা একবার সঙ্গীত সম্বন্ধে ইমাম শাফীকে প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তরে শাফী বলেন : হেজাজে আমি কাউকে সঙ্গীতবিরোধী দেখিনি।
ইমাম আহমদ-বিন হাম্বলের দুই পুত্রের উক্তিতে প্রকাশ, তিনি সঙ্গীত উপভোগ করতেন। নির্দোষ ও মহম্ভবের গানের প্রতি তিনি বিরূপ ছিলেন না। মোল্লা আলি কার হানাফী বলেন : চার ইমাম ও মুজতাহিদগণ সঙ্গীত উপভোগ করতেন।
আসলে কোনো ইমামই সঙ্গীতকে যায়েজ বলেননি। বিশেষ অবস্থায় শর্তসাপেক্ষে কখনো কখনো তাদের সঙ্গীত শুনতে বা অনুমোদন করতে দেখা গেছে মাত্র। কিন্তু তাঁরা স্পষ্ট মত দিয়েছেন সঙ্গীতের বিরুদ্ধে। সঙ্গীত হৃদয়ে মন্দভাব জাগিয়ে তোলে, এ-ই হচ্ছে সাধারণ ধারণা। অতএব সঙ্গীত ফাসেকী। যারা চরিত্র ও সাধনা বলে বলীয়ান; কেবল তাদের পক্ষেই সঙ্গীতচর্চা বৈধ হতে পারে। রসুল বলেছেন : সঙ্গীত হৃদয়ে উত্তেজনা আনে, যেমন জল (জলের স্পর্শে মাটির বুকে) ঘাস জন্মায়। এই মত সাধারণভাবে খলিফা, সাহাবী, তাবিন ও ইমাম সবাই পোষণ করতেন। কাজেই গীত গওনে-শ্রবণে অধিকারী ভেদ আছে। সুকণ্ঠ গায়ক যে সুরের জাদুকর এবং মহম্ভাবের সঞ্চারক, সে তত্ত্ব দাউদ নবীর কাহিনীর মধ্যে রয়েছে। তখন গান ফাসেকী নয় সাদেকী। অবশ্য Fakihani (ফাঁকিহানী] বলেন, আমি কোরআনে, হাদিসে কিংবা রসুলের জীবনে প্রত্যক্ষভাবে তথা স্পষ্টভাবে সঙ্গীতবিরোধী কিছু পাইনি।
গায়িকার প্রতি রসুল, খলিফা, সাহাবী, তাবিন, ইমাম প্রভৃতি সবাই ছিলেন বিরূপ। শিয়ারাও সঙ্গীতবিরোধী।
দেশকালের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক মৌলানা উপরোক্ত পরোক্ষ উক্তির ও তথ্যের প্রমাণে সঙ্গীত যায়েজ বলে ফতোয়া দিয়েছেন। ইমাম জাফর সাদিক, শেখ আবু এজিদ বিস্তামী, শেখ ইবনুল আরাবী, নুর কুতব-ই-আলম পাণ্ডুবী, শাহ ওয়ালী উল্লাহ, শাহ রফিউদ্দিন, ইব্রাহিম সাদ জহিরী, শেখ আবু তালিব মক্কী, আবদুল হক দেহলবী, মৌলনা মুহম্মদ শাহ্ আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ প্রাচীন ও নবীন অনেক সাধক ও আল্লামা সঙ্গীতকে বৈধ বলেছেন।
নক্শবন্দিয়া ছাড়া আর সব মতের সূফীরাই সঙ্গীতকে সাধনার মাধ্যম করে নিয়েছেন।
বলেছি, শেখ আহমদ মুজাদ্দাদী নকশবন্দী ছাড়া অন্যান্য প্রধান সূফীদের সবাই সাধনায় সঙ্গীতের গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। অবশ্য কাদিরিয়া ও শাত্তারিয়া সম্প্রদায় সঙ্গীতচর্চায় শর্তারোপ করেছে। আবু নসর সারাজ, ইমাম গাজ্জালী, শেখ আলি বিন উসমান হুজুইরী(কাশফ উল-মাহজুব লেখক, এটি ফারসি ভাষায় সূফীতত্ত্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ), ফরিদউদ্দীন আত্তার, শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী, খওয়াজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া, জালালউদ্দিন রুমী প্রমুখ সঙ্গীতকে সাধনার অবলম্বন করেছিলেন।
.
০২.
সুফীরা প্রেমধর্মে বিশ্বাসী। কিতাব-উল-লুম্মায় আবু নসর সারাজ এবং এহিয়া-উল-উলুম ও কিমিয়া-ই সাদত গ্রন্থদ্বয়ে ইমাম গাজ্জালী সঙ্গীতের তাত্ত্বিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। আচারবাদীদের কাছে যা গর্হিত, মরমীয়াদের কাছে তা-ই কাম্য। এখানেই যাহের ও বাতেনের পার্থক্য। অতএব তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় সঙ্গীতে মানব-মনের একটি মহত্তর প্রকাশ স্বীকৃত হয়।
গাজ্জালীর মতে (কিমিয়া) সঙ্গীত হচ্ছে পাষাণে নিহিত সুপ্ত আগুনের মতো। ঘর্ষণে শিলা থেকে যেমন আগুন বের হয়, এবং তা গোটা অরণ্য দগ্ধ করে, তেমনি সঙ্গীতের স্পর্শে আত্মার আগুন জ্বলে উঠে। সোনা যেমন আগুনে পুড়ে বিশুদ্ধ ও রূপবান হয়, তেমনি হৃদয়কে সঙ্গীতের আগুন মুকুরে পরিণত করে, যার মধ্যে প্রতিবিম্বিত হয় জগতের সৌন্দর্য। এ সৌন্দর্যের রূপভেদে তাত্ত্বিক নাম: জমাল, হুসন ও তনাসুব। সঙ্গীত সৌন্দর্যকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নেয়। তার মতে নিঃসঙ্গতায় মানুষ বাঁচাতে পারে না। সে সঙ্গীত খোঁজে। যাকে ভালোবাসে তাকেই সে পেতে চায় সঙ্গীরূপে। কাজেই প্রেম বা মহব্বত করার জন্যে আল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছুই নেই। যাকে পেলে আর কিছুই পাবার থাকে না, একের মধ্যে সবকিছুই মেলে, সব অভাব মেটে; তার সঙ্গেই তো প্রেম করা, তাঁকেই সাথী হিসেবে পাওয়ার কামনা করা উচিত। বিশেষ করে, আল্লাহও মানুষের প্রেমকামী :
ক. আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, তারা আল্লাহকে ভালোবাসবে।
খ, আল্লাহপ্রেম, পিতামাতা, সন্তান ও ভ্রাতৃপ্রেমের চেয়ে বেশি।
গ, রসুলও বলেন : যে তার আর সব সম্পদের চেয়ে বেশি করে আল্লাহ ও রসুলকে ভালোবাসতে না পারে, সে ধার্মিক নয়। শরীয়তপন্থীদের মতো সূফীরাও সঙ্গীতে অধিকারী-ভেদ মানে। ৫৬ক তাই আবু নসর সারাজ যোগ্যতানুসারে শ্রোতারা তিন শ্রেণীতে ভাগ করেছন :
ক. মুবদী ও মুরীদ (Beginners and disciples) খ. মুতওয়াসসিত্ ও সিদ্দিকী (Advanced and Purists). গ. আরেফিন (Mystics).
জুনাইদ বাগদাদীও স্থান (Makan), কাল (Zaman) ও পাত্র বা সঙ্গকে (Akhwan) সঙ্গীত শ্রবণের ঔচিত্য ও অনৌচিত্য বিচারে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। হুজুইরীরও এই মত। তিনিও আমাদের জন্যে নয়,অধ্যাত্মচিন্তা উদ্রেক করার উদ্দেশ্যে গীত বা শ্রুত সঙ্গীতই বৈধ বা বাঞ্ছনীয় বলেছেন।
যদিও হযরত আয়েশা প্রমুখের দোহাই ও নজির দিয়ে সঙ্গীতকে বৈধ করে নেবার প্রয়াস ইসলামের উন্মেষ-যুগ থেকেই শুরু হয়েছে, তবু বৈধ বলার চেয়ে অবৈধ বলার পক্ষে তথ্য, প্রমাণ ও যুক্তি যে বেশি, তা কেউ সহজে অস্বীকার করে না। আয়েশা-সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় : ঈদের দিনে, বিবাহোৎসবে এবং অন্যদিনে নির্দোষ সঙ্গীত গীত ও শ্রুত হতে পারে। আর অধ্যাত্মসাধনার বাহন হিসেবে সঙ্গীতের উপযোগে আন্তরিক বিশ্বাস রেখে কেউ যদি সঙ্গীতচর্চা করে কিংবা সঙ্গীতকে চর্যা হিসেবে গ্রহণ করে তাহলে তার পক্ষে সঙ্গীত অবৈধ হতে পারে না। এমনি সব বিশ্লেষণ ও বিবেচনার ভিত্তিতে মুসলিম সমাজে সঙ্গীত বৈধ হয়েছে।
অবশ্য পাপ বলে জেনেও যেমন মানুষ লোভের বশে আর দশটা অপকর্ম করে, মুসলমানেরাও তেমনি মানুষ হিসেবে ফাসেকী জেনেও সঙ্গীতকে পরিহার করতে পারেনি। শোনা যায়, বাদশাহ কুতবউদ্দিন আইবেক সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন; ফলে তাঁর আমলে রাজ্যের জনগণও সঙ্গীতানুরাগী হয়ে উঠে। ইলতুতমিসের সময় গোঁড়া মুসলিমরা রাজকীয় হুকুমে সঙ্গীত নিষিদ্ধ করে দেয়ার জন্যে ইলতুতমিসকে অনুরোধ করে। ইলতুতমিস কুতুবউদ্দীনের প্রতি শ্রদ্ধাবশে নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করাই স্থির করলেন। ফলে মুসলিম শাসনের গোড়া থেকেই ভারতে সঙ্গীত মুসলিম-সমাজে প্রশ্রয়। পায়।
পাক-ভারতে চিশতিয়ারাই মনেপ্রাণে সঙ্গীতকে সাধন-ভজন ও বোধনের মাধ্যম করেছিলেন। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (১১৪২-১২৩৮) সুলতান মুহম্মদ ঘোরীর বাহিনীর সঙ্গে তিনি ১১৯২ সনে ভারতে আসেন এবং হিন্দুতীর্থ পুষ্করের কাছে আজমীরে খানকা তৈরী করেন।
.
০৩.
ভারতের এক বৃহত্তর অঞ্চলে বিশেষ করে উত্তরভারতে এই চিশতিয়ারাই ইসলাম প্রচার করে। ইসলামের আনোদানকারী বলে তাঁদের প্রধানরা চেরাগী বলে অভিহিত হন। এঁদের মধ্যে কুতুবউদ্দিন দেহলবী, ফরিদুদ্দীন শকরগঞ্জী, জালালুদ্দীন পানিপথী, নিযামুদ্দীন আউলিয়া বলখী (প্রকৃত নাম মুহম্মদ বিন আহমদ বিন দাখিয়াল অল বোখারী), মুহম্মদ সাদিক গুনগুবী ও শেখ সলিম ফতেপুরীর মাহাত্ম্য আজো অম্লান। আমীর খুসরুও বুজুর্গ বলে খ্যাত। এরা সবাই সঙ্গীতকে সাধনার অবলম্বন করেছিলেন। এবং এঁরা হিন্দুদেরও শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন। পঞ্চপঞ্জ চিশতিয়া গ্রন্থে সঙ্গীতানুরাগ ও সঙ্গীত সম্বন্ধে এঁদের ধারণার আলোচনা রয়েছে। শিহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দী বলতেন–যারা সঙ্গীতের বিরোধিতা করে তারা রসুলের ও সাহাবীদের জীবন ও আচার সম্বন্ধে অজ্ঞ। তিনি তাঁর সন্তানকে সঙ্গীতচর্চায় উৎসাহিত করতেন।
য়া বুনাইয়া লা তকিজ-ই সামা
ফা ইন্নাহা লাহ্ওয়া ওয়ালা ইব।
(বৎস, সঙ্গীত পরিহার করো না, বহু মহাপুরুষ তা চর্চা করেছেন
সূফীদের মতে সঙ্গীত অধ্যাত্মসাধনায় সিদ্ধি ত্বরান্বিত করে। ইবনুল ফরিদ বলেন : সঙ্গীতের মূর্ঘনার মধ্যে আমি আমার দয়িতকে (আল্লাহকে) সমগ্র সত্তা দিয়ে দেখি।
আবুল কাসিম অল বঘবী (Baghwi) বলেন : সঙ্গীত আত্মার (spirit) খাদ্য। আত্মা যখন খাদ্য পায়, তখন দেহের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে সুস্থ হয়।
জালালুদ্দিন রুমীও বলেন, আগার আজ বুর্জি মানা-ই বুয়াদ সাইর-ই-উ ফিরিশতাহ্ ফিরু মানাদ আজ তায়র-ই-উ।
(If the musician soars up to pinnacle of ecstasy, the angel cannot follow in pursuit of him,)
চিশতিয়া সোহরওয়ার্দিয়া, কলন্দরিয়া, মারিয়া, কাদিরিয়া এবং মখদুমিয়া সূফীদের দান বাঙলাদেশে ইসলাম বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ। আশরাফ জাহাগীর তার একটি চিঠিতে সগর্বে লিখেছেন :
In the blessed land of Bangal, there is hardly a village or town where a muslim Sufi is not to be found and the innumerable graves of the muslim mystics which dot the country are a silent testimony to their self-denying devotion to their ideal.
জালালউদ্দিন তাবরেজী সম্বন্ধে Siyar-ul-Arifin (p ১৭১) গ্রন্থে আছে?
Shaikhul Mashaikh Jalaluddin Tabrezi went to Bengal. All the people of that (place) turned towards him and became his disciples. The Shaikh established a khanqah there and started a free Kitchen…etc.
চিশতি সূফীদের মধ্যে সিরাজুদ্দিন উসমান ওফেঁ আখি সিরাজ তাঁর সাগরেদ আলাউল হক, আলাউল-পুত্র নূর-কুতুব-ই-আলম, তাঁর শিষ্য শেখ হেসামুদ্দিন মানিকপুরী (কারা মানিকপুরের) বাঙলাদেশে প্রতিষ্ঠাবান ছিলেন। নূর-কুতুব-ই-আলমের ওয়াহাদাৎ-উল ওজুদ বিষয়ক পত্রের আলোকে চৈতন্যদেব প্রবতিত নব-বৈষ্ণব ধর্মের বিশ্লেষণ করলে এতে সূফী প্রভাবের আভাস পাওয়া যাবে।
শরীয়তী ইসলাম আর পাক-ভারতে সূফী দরবেশ প্রচারিত মুসলমান ধর্ম এক নয়। কাজেই সূফী-দীক্ষিত মুসলমানেরা পাক-ভারতে অবাধে সঙ্গীতচর্চার সুযোগ পায়। বিশেষ করে চিশতিয়া খান্দানে তো সঙ্গীতের মাধ্যমেই সাধন-ভজন শুরু হয়। পরে কলন্দরিয়া প্রভৃতি প্রায় সব মরমীয়া সম্প্রদায়েই সামা, হাল্কা ও দারা সাধনার মাধ্যম হিসেবে গৃহীত হয়। সিন্ধুর লতীফ শাহ, পাঞ্জাবের বুলে শাহ, আজমীরের খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি, দিল্লীর নিযামউদ্দিন আউলিয়া, আমীর খুসরু এবং সুফী শেখ বাহাউদ্দিন, শের মোহাম্মদ ও মিয়া দলু, সাচল, বেদিল, রোহল, কুতব, য়্যারী, দরিয়া থেকে বাঙলার লালনশাহ ও আহমদুল্লাহ শাহ প্রভৃতি সবাই সঙ্গীতকে সাধনার উপায় রূপে গ্রহণ করেছেন। তাদের দরগায় আজো সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়। কাজেই পাক-ভারতে মুসলমানদের সঙ্গীতচর্চা কলা-বিলাস মাত্র নয়, জীবনচর্যার তথা ধর্মাচরণের বাহন। এভাবে সঙ্গীত সমাজে নতুন মহিমায় ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হল। কেবল তা-ই নয়, কবীর, দাদু, রজব প্রমুখ দেশী মরমীয়ারাও সঙ্গীতকেই প্রচারের ও ভজনের বাহন করেছেন। আদি সূফী দরবেশদের মধ্যে কেবল খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি, কিংবা বাহাউদ্দীন জাকারিয়া কোরায়শী মুলতানীই যে সঙ্গীতবিদ ও সঙ্গীত সাধক ছিলেন, তা নয়, আরো অনেক অখ্যাত দরবেশ ও তাঁদের শিষ্য-প্রশিষ্য সঙ্গীতানুশীলন জনপ্রিয় করে তোলেন। হযরত বাহাউদ্দিন জাকারিয়া রাগ-রাগিণীরও স্রষ্টা।
কবীর যেমন সূফী ও ভারতিক মরমীয়া ধারার সমন্বয় সাধক ৬৬; তেমনি আমীর খুসরুই মুসলিম (আরব্য-পারসিক তুর্কী) ও ভারতিক সঙ্গীতের মিশ্ৰধারার আদি প্রবর্তক। ৬৭ এখন থেকেই শুরু হল পাক-ভারতে সঙ্গীতের সোনার যুগ।
আগেই বলেছি, ইসলামের উদ্ভবের মাত্র কয়েক বছর পরেই উম্মাইয়াদের আমলে মুসলমানদের মধ্যে সঙ্গীতচর্চা শুরু হয়। অবশ্য ইসলামেও স্বর-মাধুর্যে মর্যাদা আরোপিত হয়েছে। নামাজে শিরিন-সুরে কেরাত পড়ার সামর্থ্য ইমামের অন্যতম যোগ্যতা বলে স্বীকৃত। কিন্তু তবু গোড়া শরীয়তী কোনোকালেই সঙ্গীতকে সুনজরে দেখেনি। তা সত্ত্বেও এর সর্বগ্রাসী মায়াবী প্রভাব থেকে দূরে থাকা সম্ভব হয়নি অনেকের পক্ষেই। তাই গোঁড়া মুসলিম সুলতান সিকান্দার লোদী কিংবা নিষ্ঠাবান গোড়া শরীয়তপন্থী ম্রাট আওরঙজীবও প্রথম জীবনে সঙ্গীতবিমুখ হতে পারেননি। পরে ১৬৮৮ খ্রীষ্টাব্দে শাফী মজাহাবী হয়ে আওরঙজীব সঙ্গীতবিরোধী হলেন।
.
০৪.
বাঙালি মুসলমানেরাও যে সঙ্গীতকে অপার্থিব উল্কণ্ঠার তথা অধ্যাত্ম জিজ্ঞাসার নিবৃত্তির ও সাধনার বাহন করেছিলেন, তা চিশতিয়া, কাদিরিয়া, কলন্দরিয়া প্রভাবের প্রমাণ ছাড়াও, আঠারো শতকের কবি আলি রজাব জবানীতে পাচ্ছি :
আলি হোন্তে সে সকল সন্ন্যাসী ফকিরে
শিখিল সকল যন্ত্র রহিল সংসারে।
ভাবের বিরহ সব শান্ত হৈতে মন
রাগতাল কৈল প্রভু সংসারে সৃজন।
সর্বদুঃখ দূর হয় গীত যন্ত্র রাএ।
গীত যন্ত্র শুনি মহামুনি ভ্রম যাএ।
গীত যন্ত্র মহামন্ত্র বৈরাগীর কাম।
রাগযন্ত্র মহামন্ত্র প্রভুর নিজ নাম।
জীববন্ত যথ আছে ভুবন ভিতর
সর্বঘটে যন্ত্র বাজে গীতের সুস্বর।
ঘটে গুপ্ত যন্ত্র গীত যোগিগণে বুঝে।
তেকারণে সর্বজীবে সে সবারে পূজে।
গীতযন্ত্র সুস্বর বাজায় যে সকলে
মহারসে ভুলি প্রভু থাকে তা মেলে।
শুদ্ধভাবে ডুবি নৃত্য করে যেই জনে
গীতরসে মজি প্রভু থাকে তার সনে।
অপর একজন কবিও বলেন :
কহে হীন দানিশ কাজী ভাবি চাহ সার
রাগযন্ত্র নাদ সব ঘটে আপনার।
অষ্টাঙ্গ তন্ন মধ্যে আছএ যে মিলি।
তনান্তরে মন-বেশি করে নানা কেলি।
মোকামে মোকামে তার আছে যে স্থিতি
ছয় ঋত তার সঙ্গে চলে প্রতিনিত।…
রাগঋত অন্ত যদি পারে চিনিবার
জীবন মরণ ভেদ পারে কহিবার।
কিবা রঙ্গ কিবা রাগ কিবা তার রূপ
ধ্যানেত বসিয়া দেখ ঘটে সর্বরূপ।
বাঙালি মুসলিম সমাজে সঙ্গীতচর্চা যে সূফী প্রভাবেরই ফল, আমাদের সে অনুমান উক্ত চরণ কয়টির দ্বারা প্রমাণসিদ্ধ হল। কবি সৈয়দ সুলতান, আলাউল প্রভৃতিও সূফী সাধক ও পীর। তাদের সঙ্গীতপ্রীতি সাধনার অনুগত। আর তত্ত্ব-সঙ্গীত রচনার প্রেরণাও তাঁরা সাধন-সূত্রেই পেয়েছেন। আগেই বলেছি, বাঙালি মুসলিম মরমীয়ারা যে-সাধন পন্থা গ্রহণ করেছেন, তা মূলত ইসলামী নয়। ভারতিক সূফীমতবাদও একান্তভাবে আরব-ইরানি নয়। এর অবয়বে যেমন ভারতিক প্রভাব পড়েছে, বাঙালি মরমীয়াদের দর্শনে, ধর্মে ও আচারে প্রচুর দেশজ তথা ভারতিক উপাদান রয়েছে। কাজেই এদেশে হিন্দু-মুসলমান চিরকাল হাতে হাত মিলিয়ে ও মনে মন মিশিয়ে অধ্যাত্ম সাধনা করেছে। এভাবেই বাঙালি দেশে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সাধনায় মরমীয়াদের উপমতগুলো সৃষ্টি হয়েছে।
বলেছি, মুসলিম অধিকারের পূর্বে ও পরে ভারতে যারা ইসলাম প্রচার করেছিলেন, তাঁরা সবাই সূফী ছিলেন। এই মরমীয়াদের অনেকেরই সঙ্গে শরীয়তের বাহ্যানুষ্ঠানের বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। অথচ সাধারণের পক্ষে ধর্ম আচারিক ও আনুষ্ঠানিক না হলে ধর্মাচরণ দুঃসাধ্য হয়ে উঠে। ফলে মুসলমানেরা তাদের চারপাশেই অবলম্বন খুঁজেছে। এভাবেই তাদের তত্ত্ব-দর্শনে পীরপূজা ও দেহচর্যা মুখ্য হয়ে উঠেছে। তাদের তত্ত্ব প্রকাশের মাধ্যম হয়েছে ভারতিক রূপকল্প।৬৯ আরাধ্যের প্রতীক হলেন রাম ও রাধাকৃষ্ণ, এমনকি কালীও।
.
০৫.
মরমীয়াদের মতে, সৃষ্টি হচ্ছে স্রষ্টার আনন্দ সহচর। কাজেই মানুষের সঙ্গে আল্লাহর বান্দা-মনিব সম্পর্ক হতে পারে না; হতে পারে না পিতা-পুত্রের কিংবা ভক্ত-ভগবানের সম্বন্ধ। মানুষের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক হচ্ছে বন্ধুত্বের, প্রণয়ের। যেখানে প্রণয় আছে, সেখানে গতিবিধি অবাধ হওয়াই স্বাভাবিক। কাজেই নামাজ-রোজার বা এই প্রকার আনুগত্যের প্রশ্নই অবান্তর। ফলে শরীয়ত সেখানে নিরর্থক। অনুরাগে প্রণয়ের উন্মেষ, বিরহবোধে উপলব্ধি এবং মিলনে সার্থকতা। প্রেমের ধর্ম হচ্ছে প্রেমিক প্রেমাস্পদ পরস্পর পরস্পরকে আত্মস্থ করতে আকুল হবে, পরস্পরের মধ্যে আত্মবিলোপে কৃতার্থ হবে। এই প্রেম জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার প্রেম। জীবাত্মা হচ্ছে পরমাত্মার খণ্ডিতাংশ। স্বরূপত খণ্ডের অখণ্ডে বিলীন হওয়ার আকুলতার নামই প্রেম।
গরজ খণ্ডের তথা জীবাত্মার, তাই সে প্রেমিক, তাই সে রাধা। পরমাত্মারও গরজ আছে। যেমন সমুদ্রও বারিবিন্দুর সমষ্টি মাত্র। বারিবিন্দুর উপরই তার অস্তিত্ব। কিন্তু কোনো বিশেষ বিন্দুর জন্যে তার বিশেষ আকুলতা নেই। এজন্যেই জীবাত্মা সদা উদ্বিগ্ন, পাছে সে বাদ পড়ে। তাই রাধা বলে : এই ভয় উঠে মনে, এই ভয় উঠে; না জানি কানুর প্রেম তিলে জনি টুটে। প্রেমের পরিণতি একাত্মতায়, যখন বলা চলে আনল হক কিংবা সোহম। এ অবস্থাটা সূফীর ভাষায় ফানাফিল্লাহ অথবা বাকাবিল্লাহ আর বৈষ্ণবের কথায় যুগল রূপ বা অভেদ রূপ। এ দুটোতে সূক্ষ্ম দার্শনিক তাৎপর্যের প্রভেদ আছে। তবে অবস্থা ও অভিপ্রায় মূলত একই।
কুন ফায়াকুন দ্বৈতবাদের পরিচায়ক। আর একোহম বহুস্যাম অদ্বৈতবাদ নির্দেশক। সূফীরা মুসলমান, তাই দ্বৈতবাদী; কিন্তু অদ্বৈত সত্তার অভিলাষী। বৈষ্ণবগণ ব্রহ্মবাদের প্রচ্ছায় গড়া, তবু তাদের সাধনা চলে দ্বৈতবোধে এবং পরিণামে অদ্বৈত সত্তার প্রয়াস। সূফী ও বৈষ্ণব উভয়েই পরমের কাঙাল। মানবাত্মার সুপ্ত বিরহবোধের উদ্বোধনই সূফী–বৈষ্ণবের প্রধান কাজ। কেননা, রুমীর ভাষায় :
দানা ছুঁ অন্দর জমিন পেনহা শওয়াদ
বাদ আজো সারে সবজি বস্তা শওয়াদ।
জীবাত্মা তখন বাঁশীর মতো বলে: বসোনো আজনায়ে ফুঁ হেকায়েত নি কুনদ…।
জ্ঞানদাসও বলেন : অন্তরে অন্তর কাঁদে কিবা করে প্রাণ অথবা পরাণ পিরীতি লাগি স্থির নাহি বাধে।
রবীন্দ্রনাথ তাই বলেন :
বিরহানলে জ্বালোরে তারে জ্বালো
রয়েছে দীপ না আছে শিখা
এই কি ভালে ছিল রে লিখা
ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো।
এজন্যে সূফীগানে ও বৈষ্ণবপদে আমরা মিলনপিপাসু বিরহী আত্মার করুণ কান্না শুনতে পাই। সূফীগজল ও বৈষ্ণবপদ মানবাত্মার চিরন্তন Tragedy-এর সুর ও বাণী বহন করেছে। তার বেদনার অন্ত নেই। কেননা, সর্বক্ষণ চিত্তকাড়া কালার বাঁশি লাগিছে অন্তরে, সে কারণেই চিরকাল কাদিছে রাধা হৃদয়-কুটিরে।
এই প্রেমধর্মের আর একটি দিক হচ্ছে আত্মতত্ত্ব। কেননা, আত্মা এই প্রেমের এক পক্ষ তথা প্রেমিক। আর আত্মা পরমাত্মার অংশ তো বটেই। তাই সক্রেটিসের Knoweth thyself, উপনিষদের আত্মানাং বিদ্ধি, হাদিস বলে অভিহিত ইসলামের মান আরাফা নাফসাহু ফাঁকাদ আরাফা রাব্বাহু কিংবা উপনিষদের তং বেদ্য পুরুষৎ বেদমা বো মৃত্যু পরিব্যথাঃ-এই আত্মতত্ত্বের ভিত্তি ও লক্ষ্য দুই-ই। মুসলিম মরমীয়া কবিদের রাধা-কৃষ্ণ প্রতীক গ্রহণের কয়েকটি কারণ অনুমান করেছেন অধ্যাপক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য। ৭০ তার মধ্যে তিনটে প্রধান- ক, দেশজ মুসলমান পূর্বসংস্কার বশে চৈতন্যের প্রেম-ধর্ম প্রচারকালে রাধাকৃষ্ণ লীলারসে মুগ্ধ হয়ে নিজেরাও পদ রচনা করেছেন। খ. রেওয়াজের প্রভাবে রাধাকৃষ্ণের রূপকে পদ রচিত হয়েছে বটে, তবে কৃষ্ণ অনেক মুসলমান কবির কাছে অপৌরুষেয়। এবং কানু ছাড়া গীত নেই যুগের নৈর্ব্যক্তিক নাগর কানাইরূপে লৌকিক প্রেমের নায়ক হয়েছেন। গ. আর সুফী মতের মুসলমানরা ভাব-সাদৃশ্য বশে জীবাত্মা-পরামত্মসূচক জনপ্রিয় দেশী রূপক হিসেবে রাধাকৃষ্ণের শরণ নিয়েছেন।
সৈয়দ সুলতান প্রভৃতি মুসলিম কবিরা শেষোক্ত কারণেই রাধা-কৃষ্ণ রূপকে পদ রচনা করেছেন। সূফী হলেও একেশ্বরবাদী মুসলমানের মনে রাধা-কৃষ্ণের রাস, মৈথুন প্রভৃতির কল্পনা প্রশ্রয় পাওয়ার কথা নয়। তাই তারা রূপ, অনুরাগ, বংশী, অভিসার, মিলন বিরহ প্রভৃতিকে জীবাত্মা-পরমাত্মার সম্পর্কসূচক ও ব্যঞ্জক বলে গ্রহণ করতে পারলেও বস্ত্র হরণ, দান, সম্ভোগ, খণ্ডিতা, বিপ্রলব্ধা প্রভৃতির সঙ্গে তাদের অধ্যাত্মতত্ত্বের মিল খুঁজে পাননি। সেজন্যে মুসলমানের লেখায় ওসব শ্রেণীর পদ সাধারণত পাওয়া যায় না। তাদের রচনায় অনুরাগ ও বিরহবোধ এবং জীবন-জিজ্ঞাসাই বিশেষরূপে প্রকট।
সৃষ্টিলীলা দেখে স্রষ্টার কথা মনে পড়ে–এটিই রূপ; সৃষ্টিবৈচিত্র্য দেখে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক বোধ জন্মে–এটিই অনুরাগ এবং তাঁর প্রতি কর্তব্যবুদ্ধি জাগে–এটিই বংশী আর সাধনার আদি স্তরে পাওয়া না-পাওয়ার সংশয়বোধ থাকে–তারই প্রতীক নৌকা। এর পরে ভাবপ্রবণ মনে আত্মসমর্পণব্যঞ্জক সাধনার আকাক্ষা উপ্ত হয়–এটিই অভিসার। এর পরে সাধনায় এগিয়ে গেলে অধ্যাত্ম স্বস্তি আসে–তা-ই মিলন। মিলনে আত্মসমর্পণের আকুলতা প্রশমিত হয়–তা-ই ফানাফিল্লাহ। এরও পরে চরম আকাক্ষা–একাত্ম হওয়ার বাঞ্ছ, যার নাম বাকাবিল্লাহ-এই বিরহ। মৃত্যুর আগে সাধারণের পরম মিলন নেই, সেজন্যেই বাকাবিল্লাহ সূচক পদের অভাব। কেউ কেউ সে দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ করেন। তারাই বাকাবিল্লাহ হন–আর বলেন আনল হক, বা। সোহম–যেমন মনসুর, বায়যিদ ও আদহাম বলেছেন। এজন্যেই মুসলিম রচিত পদ রাগানুগ নয়। শশিভূষণ দাশগুপ্তও তাই বলেন :
এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যাইত পারে যে, বাঙ্গালার মুসলমান কবিগণ রাধা-কৃষ্ণকে লইয়া যে কবিতা রচনা করিয়াছেন তাহা কোনো বিধিবদ্ধ বৈষ্ণবধর্মের আওতায় রচিত নহে। … বৈষ্ণবমতে রাধাকৃষ্ণের যত লীলা তাহার ভিতর মানুষের কোনো স্থান নেই। … শ্রীকৃষ্ণের সহিত মিলন বাসনাও বৈষ্ণব সিদ্ধান্ত-বিরুদ্ধ। … কিন্তু অন্যরূপ পরিণতির সম্ভাবনা দেখা দিল মুসলমান কবিগণের ভিতরে, কারণ তাহারা চৈতন্য প্রবর্তিত একটি সাধারণ প্রেমধর্মের প্রভাব সামাজিক উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করিলেন; একটা সাহিত্যিক বিষয়বস্তু এবং প্রকাশভঙ্গিও উত্তরাধিকার সূত্রেই পাইলেন, কিন্তু পাইলেন না রাধাকৃষ্ণ লীলা সম্বন্ধে কোনো স্থিরবদ্ধ ভাবদৃষ্টি। সুতরাং বাঙ্গালার জনসমাজে যে সাধারণ ভক্তিধর্ম ও যোগধর্ম প্রচলিত ছিল, এই সকল কবিগণ রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে সেই সকলের সঙ্গেই যুক্ত করিয়া লইলেন। বাঙ্গালা দেশের প্রেমপন্থী মুসলমান সাধকগণ অল্পবিস্তর সকলেই সুফীপন্থী সূফীমতে প্রেমই হইল। ভগবানের পরম স্বরূপ প্রেমের দ্বারাই আবার এই জগৎ সৃষ্টি। নিজের অনন্ত প্রেম আস্বাদনের জন্যই এক পরম স্বরূপের, বহুরূপে লীলা, ইহাই হইল সৃষ্টির তাৎপর্য। জীব হইল এই এক-এর সৃষ্টিলীলার প্রধান শরিক-লীলা দাসর। .. সূফী প্রেমধর্ম এবং বাঙ্গালার প্রেমধর্ম জনগণের মধ্যে যে একটি জনপ্রিয় সহজ সমন্বয় লাভ করিয়াছে, বাঙ্গালাদেশের মুসলমান কবিগণ সেই সমন্বয়জাত প্রেমধর্মের আদর্শের সহিত রাধাকৃষ্ণকে অনেক স্থলে মিলাইয়া লইয়াছেন। ফলে রাধার যে পূর্বরাগ অনুরাগ বিরহের আর্তি, তাহা কবিগণের জ্ঞাতে অজ্ঞাতে পরম দয়িতের জন্য নিখিল প্রেমসাধকগণের পূর্বরাগ বিরহের আর্তিতেই পরিণতি লাভ করিয়াছে এবং সেই আর্তির ক্ষেত্রে কবি নিজেকে শুধু দর্শক বা আস্বাদক রূপে খানিকটা দূরে সরাইয়া লন নাই, নিখিল আর্তির সহিত নিজের চিত্তের আর্তিকেও বিলাইয়া দিয়াছেন। ইহারই ফলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব কবিগণের ভাবদৃষ্টি হইতে বঙ্গীয় মুসলমান কবিগণের ভাবদৃষ্টি অনেক স্থানে পৃথক হইয়া পড়িয়াছে। আমরা মুসলমান কবিগণের রচিত রাধা-কৃষ্ণ লীলা সম্বন্ধীয় পদগুলির ভণিতা লক্ষ্য করিলেই এই কবিগণের মূল ভাবদৃষ্টির ও ইঙ্গিত পাইব।
উত্তরভারতীয় সাধক কবিগণও রাম বা রাধাকৃষ্ণকে এমনি ভাবদৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন এবং নতুন তাৎপর্যে গ্রহণ করেছেন। দাদু, দরিয়া, রজব, শেখ কাইম, এয়ারী, মইজুদ্দীন, আফসোস প্রমুখ কবির পদাবলী এ সাক্ষ্যই বহন করে।
বাঙলাদেশে রাধাকৃষ্ণ জীবাত্মা পরমাত্মার প্রতীক যেমন হয়েছেন, তেমনি দেহ ও আত্মা–ভক্ত ও ভগবানের রূপক হিসেবেও তাদের পাই। মুসলমানদের মধ্যে বিশেষ করে বাউল সাধনায় দেহতাত্ত্বিক তাৎপর্যেও রাধাকৃষ্ণ চিহ্নিত। অবশ্য দেহতত্ত্বের প্রতীকী প্রকাশে রাধা-কৃষ্ণ তন-মনের প্রতিনিধিত্বে সীমিত থাকেননি, তন-মনের অস্থির ও বিভ্রান্তিকর রূপকল্প হয়েছেন। একে তো সাধারণ শ্রেণীর মুসলমানেরা ধর্মান্তরিত ভারতীয়দের বংশধর, তাদের রক্তের সংস্কারে ভারতিক প্রভাব বিদ্যমান, তার উপর ইসলামের একটি বিশিষ্ট শাখা সূফীমতবাদ ভারতে প্রাধান্য লাভ করে। সুতরাং মুসলমানদের মন, ইন্দ্রিয়, আত্মা ও ধর্মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভারতিক ভক্তিবাদ তাদের সহজেই প্রভাবিত করতে পেরেছিল। তাই বাঙালি কবি শাহনূরের কথায় মুসলমানদের রাধা-কৃষ্ণ প্রতীক গ্রহণের সঙ্গত কারণ খুঁজে পাই :
সৈয়দ শাহনুরে কয় রাধাকানু চিন হয়।
রাধাকান্ত আপনার তনে রে।
আরো স্পষ্ট হয় যখন শুনিঃ
তন রাধা মন কানু শাহনুরে বলে।
অথবা,
সৈয়দ শাহনুরে কয় ভব কূলে আসি।
রাধার মন্দিরে কানু আছিলা পরবাসী।
অথবা, উসমানের কথায় :
রাধা-কানু এক ঘরে কেহ নহে ভিন।
রাধার নামে বাদাম দিয়া চালায় রাত্রিদিন।
কানুরাধা এক ঘরে সদায় করে বাস
চলিয়া যাইবা নিঠুর রাধা কানু হইবা নাশ।
সৈয়দ মর্তুজাও বলেন :
আনন্দমোহন মওলা খেলা ধামালী
আপে মন আপে তন আপে মন হরি।
আপে কানু আপে রাধা আপে সে মুরারি
সৈয়দ মর্তুজা কহে, সখি, মওলা গোপতের চিন
পুরান পিরীতি খানি ভাবিলে নবীন।
এর সঙ্গে স্মর্তব্য :
রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি
অন্যান্যে বিলাসয় রসাস্বাদন করি।
বিকৃত বৈষ্ণব সাধক বাঙলার বাউল ও অন্যান্য উপসম্প্রদায়ের অনেকগুলোই রাধাকৃষ্ণের রূপকে দেহতত্ত্ব তথা জীবাত্মা ও পরমাত্মার রহস্যভেদে প্রয়াসী।
প্রবন্ধটি অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফের। তাঁর নামটি প্রবন্ধটির শিরোনামের পরে উল্লেখ করা উচিত ছিল। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা। তাই প্রতিটির কথার শেষে উৎস দেওয়া উচিত ছিল।