সখের ডিটেকটিভ – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
শীতকাল। রাত্রি ৮টা ২২ মিনিটে ডায়মন্ডহারবার হইতে আগত কলিকাতাগামী প্যাসেঞ্জার গাড়িখানি সংগ্রামপুর স্টেশনে আসিয়া দাঁড়াইল। অল্প কয়েকজন আরোহী ওঠা-নামা করিতেই ছাড়িবার ঘণ্টা পড়িল।
ঠিক এই সময়ে ব্যাগহস্তে একজন মধ্যবয়স্ক স্থূলকায় ভদ্রলোক দৌড়িয়া প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করিলেন। কিন্তু তাঁহার উদ্যম বৃথা হইল। পোঁ করিয়া বাঁশি বাজাইয়া, ইঞ্জিন মহাশয় বাবুটিকে উপহাসচ্ছলেই যেন ‘ধেৎ’ ‘ধেৎ’ করিতে করিতে ছুটিতে আরম্ভ করিল। বাবুটি হতাশ হইয়া চলন্ত ট্রেনখানির প্রতি চাহিয়া রহিলেন—আর হাঁপাইতে লাগিলেন।
গাড়ি বাহির হইয়া গেলে বাবুটি ধীরপদে আবার ফটকের দিকে অগ্রসর হইলেন। সেখানে গোল লণ্ঠন হাতে ছোট স্টেশন মাস্টারবাবু দাঁড়াইয়া আগন্তুক আরোহীগণের নিকট টিকিট লইতেছিলেন। বাবুটি পাশে দাঁড়াইয়া রহিলেন। শেষ ব্যক্তি ফটক পার হইয়া গেলে ছোটবাবুকে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মশায়, আবার কটায় ট্রেন?’
ছোটবাবু বাতির আলোকে টিকিটগুলি দেখিতে দেখিতে বলিলেন, ‘কোথাকার ট্রেন?’
‘কলকাতায় ফেরবার।’
‘আবার সেই রাত্রি ১টা ১৮ মিনিটে।’
বাবুটি আপন মনে হিসাব করিতে লাগিলেন, ‘একটা আঠারো। আমাদের হল, আঠারো প্লাস চব্বিশ—একটা বেয়াল্লিশ মিনিট—পৌনে দুটোয় ধর। তাই তো!’
ইত্যবসরে ছোটবাবু সেখান হইতে অদৃশ্য হইয়াছিলেন। একজন খালাসী চাকাওয়ালা মই ঘড়ঘড় করিয়া টানিতে টানিতে প্ল্যাটফর্মের আলোকগুলি নিবাইয়া দিতেছিল। বাবুটি ধীরে ধীরে ফটকের বাহির হইয়া সিঁড়ি বাহিয়া নিম্নে গিয়া দাঁড়াইলেন। সম্মুখে চাহিয়া দেখিলেন, নিকটে একটি হালুইকরের দোকানে মিটিমিটি করিয়া আলোক জ্বলিতেছে। তাহার পর যতদূর দৃষ্টি চলে, কেবল অন্ধকার। নিকটতম গ্রামও এখান হইতে অন্তত এক ক্রোশ দূরে অবস্থিত। রাস্তাটির দু ধারে কেবল গাছ ও জঙ্গল। সেই জঙ্গলে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকিতেছে; মাঝে মাঝে শৃগালের হুকাহুয়া রবও শুনা যাইতেছে।
সেখানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া বাবুটি অনুভব করিলেন, কিঞ্চিৎ আহার্য সামগ্রী অভ্যন্তরভাগে প্রেরণ না করিলে সমস্ত রাত্রি কাটিবে না। যদিও, যাহাদের বাড়িতে গিয়াছিলেন, সেখানে সান্ধ্য জলযোগটা একটু গুরুতরগোছই হইয়াছিল, এবং তাহাদের আয়োজনে বিলম্বের জন্য গাড়িটি ফেল হইয়া এই বিপত্তি উপস্থিত, তথাপি সারারাত্রির উপযুক্ত বোঝাই তো লওয়া হয় নাই। হালুইকরের দোকানটি আছে তাই রঙ্গা, নচেৎ অর্ধাশনে রাত্রি কাটাইতে হইত। ভাবিতে ভাবিতে বাবুটি হালুইকরের দোকানের সম্মুখে গিয়া দণ্ডায়মান হইলেন।
বৃদ্ধ হালুইকর চশমা চোখে দিয়া রামায়ণ ‘পড়িতেছিল, বলিল, ‘আস্তাজ্ঞে হোক, আসুন।’ দোকানের ভিতর দেয়াল ঘেঁসিয়া একটি সরু বেঞ্চি ছিল, তাহার উপর বাবুটি উপবেশন করিয়া বলিলেন, ‘কি কি আছে?’
হালুইকর বলিল, ‘আজ্ঞে বাবুর কি চাই বলুন। রসগোল্লা আছে, পান্তুয়া আছে, মিহিদানা আছে, কচুরি আছে, সিঙ্গাড়া আছে—তাজা, আজই ভেজেছি।’
ইচ্ছামত দ্রব্যাদি ক্রয় করিয়া বাবুটি আহারে প্রবৃত্ত হইলেন।
এই সুযোগে ইঁহার পরিচয়টি দেওয়া আমাদের কতর্ব্য হইতেছে। সুখের বিষয়, তজ্জন্য আমাদিগকে বিশেষ শ্ৰম স্বীকার করিতে হইবে না, নামটি প্রকাশ করিলেই যথেষ্ট হইবে। কারণ, বিজ্ঞাপন অনুসারে ‘বঙ্গসাহিত্যে ইঁহার নূতন পরিচয় দেওয়া সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন।’
আপনারা নিশ্চয়ই ইঁহার লেখনী প্রসূত কোন না কোন ডিটেকটিভ উপন্যাস পাঠ করিয়াছেন। স্বয়ং না পড়িয়া থাকেন, বাড়ির মেয়েদের জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিবেন।
ইঁহার নাম শ্রীযুক্ত গোবর্ধন দত্ত। কলিকাতায় বাস করেন। এই স্টেশন হইতে দু ক্রোশ দূরে কোন গ্রামের একজন ভদ্রলোকের কন্যার সহিত ইঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রের বিবাহের সম্বন্ধ হইতেছে। আজ বেলা তিনটার গাড়িতে ইনি কলিকাতা হইতে আসিয়া পৌঁছিয়াছিলেন। মেয়ে দেখিয়া আটটা চব্বিশের গাড়িতে যদি রওনা হইতে পারিতেন, তবে রাত্রি পৌনে দশটায় কলিকাতায় পৌঁছিয়া, গরম গরম লুচি, ঘন বুটের ডাল, সদ্য ভর্জিত রোহিত মৎস্য, হংস-ডিম্বের কালিয়া প্রভৃতি ভক্ষণান্তে নিরাপদে লেপ মুড়ি দিয়া শয়ন করিতেন, কিন্তু বিধিলিপি কে খণ্ডাইতে পারে?
বাসী কচুরি, ভিতরে আঁটিওয়ালা রসগোল্লা প্রভৃতি যথাসাধ্য ভক্ষণ করিয়া গোবর্ধনবাবু হাত মুখ ধুইয়া ফেলিলেন। হালুইকরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তোমার দোকান কতক্ষণ খোলা থাকে?’
হালুইকর বলিল, ‘রাত্তির নটা, বড়জোর সাড়ে নটা।’
‘তার পর?’
‘তার পর দোকান বন্ধ করে গিয়ে আহার করি। আহারাদি করে শয়ন করি।’
গোবর্ধনবাবু ব্যাগটি হাতে করিয়া উঠিলেন। হালুইকর বলিল, ‘বাবু তা হলে ইস্টিশানে চললেন?’
‘করি কি?’ বলিয়া গোবর্ধনবাবু ধীরে ধীরে আবার স্টেশনে গিয়া উঠিলেন।
সংগ্রামপুর ছোট স্টেশন। তার আপিস, টিকিট আপিস প্রভৃতি সমস্ত একই কামরায় অবস্থিত। ওয়েটিং রুম পর্যন্ত নাই।
গোবর্ধনবাবু প্লাটফর্মে পৌঁছিয়া দেখিলেন, সেই আপিসকামরা তালাবন্ধ। বাহিরে কম্বল গায়ে দিয়া একজন খালাসী বসিয়া ঝিমাইতেছে। একটিমাত্র লণ্ঠন জ্বলিতেছে, তাহারও আলোক অত্যন্ত কমাইয়া দেওয়া।
গোবর্ধনবাবু খালাসীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বাবু কোথা রে?’
‘খেতে গেছেন, বাসায়।’
‘কখন আসবেন?’
‘এই এলেন বলে।’
একখানি বেঞ্চি ছিল, গোবর্ধনবাবু তাহারই উপর উপবেশন করিলেন। ব্যাগটি খুলিয়া পানের ডিবা বাহির করিলেন, সিগারেট ও দিয়াশলাই বাহির করিলেন। জুতা খুলিয়া রাখিয়া, পা দুটি বেঞ্চির উপর তুলিয়া গাত্রবস্ত্রখানি বেশ করিয়া ঢাকা দিয়া বসিয়া,তাম্বুল-চর্বণও ধূমপানে প্রবৃত্ত হইলেন।
চারিদিকে খোলা মাঠ, হু হু করিয়া হাওয়া আসিতেছে। কিছুক্ষণ পরেই গোবর্ধনবাবুর শীতবোধ হইতে লাগিল। কোথায় বাড়িতে এতক্ষণ চারিদিকে দুয়ার-জানালা বন্ধ করিয়া লেপ মুড়ি দিয়া শয়ন, আর কোথায় এই তেপান্তরের মাঠে এই কষ্টভোগ! যদি না মেয়ে দেখিতে আসিতেন, তাহা হইলে তো এই কর্মভোগ হইত না! মেয়ের বাপেরা জলযোগের অনাবশ্যক আড়ম্বর করিয়া গাড়ি ফেল করিয়া দিয়াছে বলিয়া তাহাদের উপর রাগ হইল; বিধবা ভ্রাতৃজায়ার উপর রাগ হইল—ছেলের বিবাহের জন্য এত তাড়াতাড়িই কেন তাহার? গোবর্ধনবাবু বলিয়াছিলেন, এ বছরটা যাক, আসছে বছর তখন দেখা যাবে—সে কথা তিনি কোনমতেই শুনিলেন না! বধূ আসিয়া কি চতুর্ভুজ করিয়া দিবে? বাল্যবিবাহের উপরও তাঁহার রাগ হইতে লাগিল।
শীতে কাঁপিতে কাঁপিতে প্রতিজ্ঞা করিলেন, এবার বাল্যবিবাহকে আচ্ছা করিয়া গালি দিয়া একখানি নূতন ধরনের উপন্যাস তিনি লিখিবেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে সিঁড়িতে জুতার শব্দ উঠিল। প্ল্যাটফর্মের উপর খানিকটা আলো আসিয়া পড়িল। বাতি হাতে করিয়া ছোটবাবু অসিলেন; আপিসকামরা খুলিয়া প্রবেশ করিয়া দরজাটি ভেজাইয়া দিলেন।
আরো কিয়ৎক্ষণ শীতভোগ করিবার পর গোবর্ধনবাবু ধৈর্য হারাইলেন। উঠিয়া গিয়া দরজাটি ফাঁক করিয়া বলিলেন, ‘স্টেশনমাস্টারবাবু, পৌনে দুটোর গাড়ির তো এখনও অনেক দেরি, বাইরে বড্ড শীত, ভিতরে এসে কি বসতে পারি?’ বাবুটি স্টেশনমাস্টার নহেন, ‘ছোটবাবু’ মাত্র, তাহা গোবর্ধনবাবু জানিতেন, কিঞ্চিৎ খোসামোদ করার অভিপ্রায়েই ওরূপ সম্ভাষণ করিলেন।
ছোটবাবু বলিলেন, ‘আসুন।’
প্রবেশ করিয়া গোবর্ধনবাবু একখানি পিঠভাঙা চেয়ারে বসিলেন। এইবার ভাল করিয়া দেখিলেন, ছোটবাবুর বয়স ৪০ বৎসরের উপরে উঠিয়াছে। সাদা জিনের প্যান্টালুনের উপর কালো মোটা গরম কোট পরিয়া রহিয়াছেন। মোটা মোটা গোল গোল বোতামগুলাতেও কি সব ইংরেজী অক্ষর লেখা। টেলিগ্রাফের কলের কাছে বসিয়া খুটখাট করিয়া কাজ করিতেছেন।
গোবর্ধনবাবু যেখানে বসিয়াছিলেন, তাহার কাছে লম্বা গোছের একটি টেবিল, তাহার উপর ঘসা কাচের একটি সরু উচ্চ লণ্ঠন রক্ষিত, লাইন ক্লিয়ার বই ও অন্যান্য খাতাপত্র যথা তথা ছড়ান; একটি টিনের গঁদদানি, অপর একটি টিনের আধারে তেলকালির প্যাড এবং সেই স্টেশনের একটি মোহর ছাপ, সীসার কাগজ চাপা, একগাছা রুল—এই সব দ্রব্য রহিয়াছে।
ছোটবাবু তারের কাজ শেষ করিয়া আগন্তুকের প্রতি চাহিয়া একটি হাই তুলিলেন। দাঁড়াইয়া উঠিয়া হাত দুটি পিঠের দিকে করিয়া গা ভাঙিলেন। তাহার পর একটি দেরাজ ধরিয়া খর্খর্ করিয়া টানিয়া, তাহার মধ্য হইতে একখানি বই বাহির করিয়া, আলোকের নিকট সরিয়া আসিয়া পডিতে বসিলেন। গোবর্ধবাবু গলাটি বাড়াইয়া দেখিলেন, বইখানি তাঁহারই প্রণীত ‘ভীষণ রক্তারক্তি’ নামক উপন্যাস।
গোবর্ধনবাবু নূতন লেখক নহেন; যাহাদের বই বৎসরের পর বৎসর সিন্দুক বা আলমারিতে কীটভোগ হইয়া বিরাজ করে, সে শ্রেণীর গ্রন্থকার নহেন; তথাপি এই দূর পল্লীতে একজনকে নিজ পুস্তকপাঠে নিবিষ্টচিত্ত দেখিয়া তাঁহার মনটা উল্লসিয়া উঠিল। তাঁহার শীত কোথায় চলিয়া গেল।
ছোটবাবু একমনে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাইয়া পড়িয়া যাইতে লাগিলেন। গোবর্ধনবাবু একদৃষ্টে তাঁহার মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন। আত্মপ্রসাদে তাঁহার মন ভরিয়া উঠিতে লাগিল। মনে মনে বলিলেন, ‘বিজ্ঞাপনে যে লিখি—‘একবার পড়িতে বসিলে আহার নিদ্রা ত্যাগ’—সেটা কি নিতান্ত মিছে কথা লিখি?’
কিছুক্ষণ এইরূপে কাটিলে, এই ভক্ত পাঠকটির নিকট আত্মপরিচয় দিবার জন্য গোবর্ধনবাবুর প্রাণটা ছটফট করিতে লাগিল। ভাবিলেন, পুরাতন একখানি মলিদা গায়ে দিয়া কাদামাখা জুতা পায়ে দিয়া নিরীহ ভাল মানুষটির মত বসিয়া রহিয়াছি—আমি যে কে, জানিতে পারিলে বাবুটির কি বিস্ময়ের অবধি থাকিবে! ইহার পর চিরদিন উনি লোকের কাছে বলিয়া বেড়াইবেন না কি—‘একবার বিখ্যাত ডিটেক্টিভ ঔপন্যাসিক গোবর্ধনবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। লোকটি এমন সাদাসিধে যে দেখলে গোবর্ধনবাবু বলে মনেই হয় না। অতি মহাত্মা লোক!’—না হয় আমিই উঁহার নামটি প্রথমে জিজ্ঞাসা করি। তাহা হইলে নিশ্চয়ই আমার নামও উনি জিজ্ঞাসা করিবেন।
গলা বাড়াইয়া গোবর্ধনবাবু দেখিলেন, ছোটবাবু তখন ত্ৰয়োবিংশ পরিচ্ছেদ পড়িতেছেন। যেখানে প্রসিদ্ধ গুণ্ডা মির্জা বেগ পঞ্চদশবর্ষীয়া সুন্দরী নায়িকা বকুলমালাকে তাহার পিতৃগৃহ হইতে গভীর রাত্রিতে ডাকাতি করিয়া লইয়া যাইতেছে। এই পরিচ্ছেদটি বিশেষভাবে চমকপ্রদ; সুতরাং রসভঙ্গ করিতে ইচ্ছা হইল না।
পরিচ্ছেদটি শেষ হওয়ামাত্র গোবর্ধনবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মহাশয়ের নাম জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি?’
বাবুটি পুস্তক হইতে মুখ না তুলিয়াই উত্তর করিলেন, ‘শ্ৰীবীরেন্দ্রনাথ দাস ঘোষ।’ বলিয়া চতুর্বিংশতি পরিচ্ছেদে মনোনিবেশ করিলেন।
গোবর্ধনবাবু সহজে ছাড়িবার পাত্র নহেন। তিনি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনার নিবাস’?
বাবুটি পূর্ববৎ কহিলেন, ‘হুগলীর কাছে।’
‘কোন গ্রামে?’
‘শঙ্করপুর।’ বলিয়া তিনি চতুর্বিংশতি পরিচ্ছেদের দ্বিতীয় পৃষ্ঠা উন্মোচন করিলেন।
গোবর্ধনবাবু মনে মনে বলিলেন, ‘কোথাকার অভদ্র লোক!’—প্রকাশ্যে বলিলেন, ‘আপনার নামধাম জিজ্ঞাসা করছি বলে বিরক্ত হচ্ছেন না তো মশায়? আজকাল ইংরেজী ফ্যাশান অনুসারে এগুলো বেয়াদপি বলে গণ্য, তা জানি। কিন্তু আমরা মশায় সেকেলে লোক—অত মেনে চলতে পারিনে। কিছু মনে করবেন না।’
বাবুটি তাঁহার পানে একটি নজর মাত্র চাহিয়া, একটু মৃদু হাস্য করিয়া বলিলেন, ‘না।’
গোবর্ধনবাবু তখন আত্ম-পরিচয়দান সম্বন্ধে হতাশ হইয়া কড়িকাঠ গণিবার অভিপ্রায়ে ঊর্ধ্বদিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। দেখিলেন, কড়িকাঠ নাই, ঢেউখেলান লোহার ছাদ মাত্র।
ছোটবাবু যখন বইখানি শেষ করিলেন, তখন রাত্রি প্রায় বারোটা। বই বন্ধ করিয়া, দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া প্রায় এক মিনিটকাল তিনি সম্মুখস্থ দেওয়ালের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন। তাহার পর গোবর্ধনবাবুর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘সেই অবধি বসে রয়েছেন?’
‘আজ্ঞে, কি করি বলুন!’
‘ভারি কষ্ট হল তো আপনার। পান খাবেন?’ বলিয়া পকেট হইতে পানের ডিবা বাহির করিয়া আগন্তুকের নিকটে ধরিলেন। পান লইয়া গোবর্ধনবাবু ভাবিলেন, ‘হায়, এ ব্যক্তি জানিতেও পারিতেছে না, যাহাকে পান দিতেছে, সে লোকটা কে এবং কত বড়!’
ছোটবাবু বলিলেন, ‘মশায় মাপ করবেন। আপনি প্রায় তিন ঘণ্টা এখানে বসে আছেন, আপনাকে কোনও খাতির করিনি। ওই বইখানা নিয়ে এমনি ইয়ে হয়ে পড়েছিলাম—একেবারে বাহ্যজ্ঞানশূন্য। কোথা থেকে আসছেন? মশায়ের নামটি কি?’
গোবর্ধনবাবু বলিলেন, ‘কলকাতা থেকে এসেছিলাম। আমার ভাইপোর জন্যে কাছেই একটি গ্রামে মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম; আমার নাম শ্রীগোবর্ধন দত্ত।’
নামটি শুনিবামাত্র ছোটবাবু পূর্বপঠিত বইখানির সদরপৃষ্ঠাটি খুলিয়া আলোকের নিকট ধরিলেন। বই নামাইয়া গোবর্ধনবাবুর পানে চাহিলেন। আবার বইখানির সদরপৃষ্ঠাটি দেখিতে লাগিলেন।
তাঁহার অবস্থা দেখিয়া গোবর্ধনবাবু হাসিয়া বলিলেন, ‘কি ভাবছেন?’
বাবুটি সঙ্কোচের সহিত বলিলেন,‘মশায়—আপনিই কি—এই বই লিখেছেন?’
গোবর্ধনবাবু ন্যাকা সাজিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি বই ওখানা?’
‘ভীষণ রক্তারক্তি।’
‘ওঃ হ্যাঁ—আমারই একখানা বই বটে।’
ছোটবাবু বলিলেন, ‘অ্যাঁ—আপনি! আপনিই গোবর্ধনবাবু? মশায় আপনার সঙ্গে যেরকম ব্যবহার আমি করেছি, ভারি অন্যায় হয়ে গেছে। ছি ছি।’
গোবর্ধনবাবু বলিলেন, ‘না না, কিছুই অন্যায় তো আপনি করেননি। কি অন্যায় করেছেন?’
‘অন্যায় করিনি? আপনি এখানে তিন তিন ঘণ্টা কাল ঠায় বসে আছেন, আপনাকে জিজ্ঞাসাও করিনি—মশায় আপনি কে, কোনো কষ্ট হচ্ছে কি না—বই নিয়ে এমনই মেতেছিলাম। অন্যায়। করিনি!’
‘কিছু না, কিছু না। বরং আমার বই নিয়ে আপনি মেতে উঠেছিলেন, সেটা তো আমার পক্ষে কমপ্লিমেন্ট। আমার আর কোন বই আপনি পড়েছেন ?’
‘আজ্ঞে আর কিছু পড়িনি, তবে পাঁজিতে আপনার অনেক বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখেছি বটে। এবার আনাতে হবে এক একখানা করে। আজই কি এই বইখানা পড়া হত? বইখানি একজন প্যাসেঞ্জার ফেলে গেছে। পাঁচটার গাড়িতে এসেছিল কলকাতা থেকে—মস্ত এক দল। বাইরে প্ল্যাটফর্মে ওই যে বেঞ্চখানা রয়েছে—তারই ওপর জনকতক বসেছিল। তারা চলে গেলে দেখি, বইখানি বেঞ্চির নিচে পড়ে রয়েছে । এনে পড়তে আরম্ভ করলাম। বাপ! আরম্ভ করলে কি আর ছাড়বার যো-টি আছে? আচ্ছা, মশায়, ও সব ঘটনা কি সত্যি, না আপনি মাথা থেকে বের করেছেন?’
আসল কথাটা বলিতে গেলে বলিতে হয়, ‘ইংরেজী নভেল হইতে না বলিয়া গ্রহণ,’ তাই গোবর্ধনবাবু ইতস্তত করিয়া বলিলেন, ‘মাথা থেকে বের করেছি।’
‘আপনার খুব মাথা কিন্তু! কি অসাধারণ কৌশল! আপনি যদি পুলিশ লাইনে ঢুকতেন তো খুব ভাল ডিটেকটিভ হতে পারতেন। হ্যাঁ—ভাল কথা মনে পড়ে গেল। আপনি এসেছেন, ভালই হয়েছে, আপনাকে জিজ্ঞাসা করি। দেখুন, এই বইখানার ভিতর একখানা চিঠি ছিল। আশ্চর্য চিঠি । আমি তো মশায় পড়ে কিছুই বুঝতে পারলাম না। আপনি দেখুন দেখি।’
বলিয়া দেরাজ খুলিয়া একখানি পত্র বাহির করিয়া তিনি গোবর্ধনের হাতে দিলেন।
ব্যাগ হইতে চমশা বাহির করিয়া, চোখে দিয়া, আলোর কাছে ধরিয়া গোবর্ধনবাবু পত্রখানি পাঠ করিলেন—
‘ভাই কুঞ্জ,
মঙ্গলবার রাত্রে শত্রুদুর্গ আক্রমণ মনে আছে তো? তুমি সদলবলে ওই দিন বৈকাল পাঁচটার গাড়িতে আসিয়া পৌঁছিবে, অন্যথা না হয়। সকলে এখানে সমবেত হইয়া সন্ধ্যার পরে মার্চ করিতে হইবে। রাত্রি দশটায় যুদ্ধারস্তু। কার্য সমাধা করিয়া ভোর তিনটার গাড়িতে তোমরা ফিরিয়া যাইতে পারিবে। ইতি—
তোমাদের
নিতাই।’
পত্রখানি পড়িয়াই গোবর্ধনবাবুর মনে হইল, ইহা স্বদেশী ডাকাতি ভিন্ন আর কিছুই নহে। জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তারা একদল এসেছিল বললেন না ?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘ক’জন?’
‘জন কুড়ি হবে।’
‘বয়স কত সব?’ চেহারা কি রকম?’
‘বয়স—পনেরো যোল থেকে ঊনিশ কুড়ির মধ্যে। চেহারাগুলো ষণ্ডা যণ্ডা—খুব হাসি, স্ফুর্তি, গোলমাল করতে করতে গেল।’
‘ভদ্রলোকের ছেলে সব?’
‘হ্যাঁ। বেশ ফিটফাট কাপড়-চোপড়, কারো কারো চোখে সোনার চশমা।’
‘কোন ক্লাসের টিকিট নিয়ে এসেছিল?’
‘ইন্টারমিডিয়েট।’
‘সিঙ্গেল না রিটার্ন?’
‘রিটার্ন।’
‘তাদের টিকিটগুলো বের করুন।’
ছোটবাবু একটা দেরাজ টানিয়া একগাদা টিকিট হইতে লাল রঙের আধখানা টিকিটগুলি বাছিয়া গোবর্ধনবাবুর সম্মুখে ফেলিতে লাগিলেন। গোবর্ধনবাবু গণিয়া দেখিলেন, সর্বশুদ্ধ ঊনিশখানা আছে। প্রত্যেকখানিই কলিকাতা হইতে, নম্বরগুলি পরপর। পকেট-বুক বাহির করিয়া টিকিটের নম্বর ও ছাপগুলির বিবরণ গোবর্ধনবাবু নোট করিয়া লইয়া গম্ভীরভাবে বলিলেন, ‘স্বদেশী ডাকাতি।’
ছোটবাবু বলিলেন, ‘স্বদেশী ডাকাতি। অ্যাঁ? স্বদেশী ডাকাতি!’
‘পরিষ্কার স্বদেশী ডাকাতি। আপনার কাছে ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাস আছে?’
‘না। কেন বলুন দেখি?’
চিঠিখানির একস্থানে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া গোবর্ধনবাবু বলিলেন, ‘এই দেখুন, খামের উপর যে মোহর পড়ে, তারই সাদা দাগ এ চিঠিতে রয়েছে। একটা ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাস পেলে ছাপটা পড়তাম।’
ছোটবাবু চমশা চোখে দিয়া দাগটা পড়িতে চেষ্টা করিলেন। শেষে বলিলেন, ‘কিছু পড়া গেল না।’
গোবর্ধনবাবু সেই ঘসা কাচের লণ্ঠনটির দ্বার খুলিয়া ভিতরে কি যেন অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। শেষে একটুকরা কাগজ লইয়া লণ্ঠনের একটা স্থানে ঘসিতে লাগিলেন। কাগজটুকু ভুষা-কালি মাখা হইয়া গেল। বাহির করিয়া তাহার উপর জোর দুই তিনটা ফুঁ দিয়া গোবর্ধনবাবু সেখানি চিঠির সেই সাদা ছাপ-পড়া অংশে লঘু হস্তে বুলাইতে লাগিলেন। ছোটবাবু অবাক হইয়া ইহার কার্যপরম্পরা দেখিতেছিলেন।
ছাপটি পরীক্ষা করিয়া গোবর্ধনবাবু গম্ভীরভাবে বলিলেন, ‘আজই বেলা ৯টার ডেলিভারিতে বহুবাজার পোস্টাপিস থেকে এ চিঠি বিলি হয়েছে।’ বলিয়া চিঠিখানি ছোটবাবুর হস্তে দিলেন। ছোটবাবু সেখানি আলোকে ধরিয়া দেখিলেন, কালো জমির উপর সাদা অক্ষরে OW AAR, তাহার নিম্নে 9এ, তাহার নিম্নে 5 J y ফুটিয়া উঠিয়াছে। চিঠিখানি গোবর্ধনবাবুর হস্তে প্রত্যর্পণ করিয়া রুদ্ধস্বরে বলিলেন, ‘ধন্য আপনার বুদ্ধি! নইলে আর অমন সব নভেল আপনার মাথা থেকে বেরোয়!’
গোবর্ধনবাবু বলিতে লাগিলেন, ‘এই ডাকাতদের মধ্যে অন্তত একজন—যার নাম কুঞ্জ—বহুবাজার অঞ্চলে থাকে। নিতাই বলে দলের একজন পূর্বেই এসেছিল—যা কিছু দেখবার শোনবার খবর নেবার সমস্ত ঠিকঠাক করে এই চিঠি লিখেছে। এই অঞ্চলের কোনও ধনী লোকের বাড়ি আজ রাত্রি দশটার সময় তারা ডাকাতি করেছে—ভোর তিনটের গাড়িতে তারা ফিরে যাবে।’
এমন সময় কলিকাতা হইতে ট্রেন আসিয়া পৌঁছিল। ছোটবাবু লণ্ঠন হাতে সেখানি ‘পাস’ করিতে ছুটিলেন।
গোবর্ধনবাবু একাকী বসিয়া মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, ‘এ ডাকাতগণকে যে কোনও উপায়ে হউক ধরিতে হইতেছে। ধরিতে পারিলে গভর্নমেন্টের কাছে যথেষ্ট সুনাম হইবে, চাই কি একটা রায় বাহাদুর খেতাবও মিলিতে পারে।’—অনেক দিন হইতেই রায় বাহাদূর হইবার জন্য গোবর্ধনবাবুর আকাঙ্ক্ষা। নভেল লিখিয়া অর্থোপার্জন যথেষ্টই করিয়াছেন, কিন্তু সাহিত্যক্ষেত্রে তেমন মান-সম্ভ্রম হইল কই? ইঁহার পুস্তকসংখ্যার তুলনায় অর্ধেকের অর্ধেক যাঁহারা লেখেন নাই, যাঁহাদের বই আলমারিজাত হইয়া থাকে, বৎসরে ২৫ খানির বেশি বিক্রয় হয় না, তাঁহাদের কত মান, কত সম্ভ্রম, মাসিকপত্রে ছবি বাহির হইতেছে, কত সভার সভাপতি হইয়া তাঁহারা কত বক্তৃতা করিতেছেন, কিন্তু গোবর্ধনবাবুকে কেহ তো ডাকিয়াও জিজ্ঞাসা করে না!—তিনি ইহার একমাত্র কারণ নির্দেশ করেন—ওই সকল লোক কেবলমাত্র গ্রন্থকার নহেন, সাহিত্যক্ষেত্রে গ্রন্থকার এবং অপর কোনও ক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ। তাই অনেকদিন হইতেই তাঁহার মনে হইতেছে কোনো একটা সুযোগে রায় বাহাদুর বা অন্তত রায়সাহেবও তিনি হইতে পারেন, তাহা হইলে বোধ হয় তাঁহার এই ‘কেবলমাত্র গ্রন্থকার’ অপবাদটি ঘুচিয়া যায়—সমাজে নিজ প্রাপ্য সম্মান তিনি আদায় করিয়া লইতে পারেন। তাঁহার মনে হইল, বোধ হয় এই সুযোগেই তাহা হইবে; নহিলে ভগবান তাঁহারই একখানা গ্রন্থের মধ্যে করিয়া মূলসূত্রস্বরূপ ওই চিঠিখানা পাঠাইয়া দিবেন কেন?
ট্রেন চলিয়া গিয়াছিল। ছোটবাবু যাত্রীদের টিকিট কালেক্ট করিয়া অফিসে ফিরিয়া আসিলেন। পকেট হইতে ডিবা বাহির করিয়া পান খাইলেন, গোবর্ধনবাবুকেও দিলেন। নিকটস্থ চেয়ারখানিতে বসিয়া বলিলেন, ‘তাই তো মশায়—কার সর্বনাশ হল কে জানে!’
গোবর্ধনবাবু বলিলেন, ‘দেখুন, আজ এ ডাকাতদের ধরতে হবে।’
ছোটবাবু বলিলেন, ‘কে ধরবে?’
‘আপনি ও আমি।’
‘আমি? সর্বনাশ! তাদের কাছে রিভলভার আছে, মাথার খুলি উড়িয়ে দেবে না!’
গোবর্ধনবাবু হাসিয়া বলিলেন, ‘না, এখন আর তাদের কাছে রিভলভার নেই। সে সব কোথাও লুকিয়ে রেখে তারা আসবে।’
‘তাহলেও ধরা কি সোজা কথা মশায়? তারা উনিশ-কুড়িজন লোক—’
‘জাপটে ধরতে গেলে কি আর হবে? কৌশলে ধরতে হবে।’
‘তারপর?’
‘তারপর সকলের শ্রীঘর।’
‘তারপর?’
‘তারপর আবার কি?’
‘ওদের দলের অন্যান্য লোক যারা আছে, তারা যে আপনাকে আমাকে কুকুরমারা করে মারবে!’
একথা শুনিয়া গোবর্ধনবাবুর মনে একটু ভীতির সঞ্চার হইল। তিনি কয়েক মুহূর্ত নীরবে চিন্তা করিলেন। কিন্তু রায়বাহাদুরির প্রলোভনই অবশেষে জয়লাভ করিল। বলিলেন, ‘আপনি কি বলছেন মশায়? আমরা কি মগের মুল্লুকে বাস করছি যে আমাদের কুকুরমারা করবে? এ কার্য করে যদি আমরা সফল হই, আমাদের যাতে কোন অনিষ্ট না হয়, সে বন্দোবস্ত গভর্নমেন্ট করবেন। তার জন্যে যদি লাখ টাকা খরচ হয়, তাতেও তাঁরা পেছপাও হবেন না, আপনি চিন্তা করবেন না। আসুন, এ কার্যে আমায় সহায়তা করুন। দেখুন দেখি, এই স্বদেশী ডাকাতেরা দেশের কি মহা অনিষ্ট করছে। নিরীহ লোকদের সর্বনাশ করছে—এই কি ধর্ম, এই কি স্বদেশপ্রেম! প্রত্যেক রাজভক্ত প্রজারই কর্তব্য, তাহাদের কার্যে বাধা দেওয়া, তাদের সমুচিত প্রতিফল দেওয়া।’
ছোটবাবু গালে হাত দিয়া বসিয়া রহিলেন, কোনও উত্তর করিলেন না। কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করিয়া গোবর্ধনবাবু বলিলেন, ‘কি বলেন? আমায় সাহায্য করবেন?’
হাত দুটি জোড় করিয়া ছোটবাবু বলিলেন, ‘গোবর্ধনবাবু, আমায় মাপ করতে হচ্ছে। আমি ছাপোষা মানুষ, অনেকগুলি কাচ্চা-বাচ্ছা, আমি ও কাজটি পারব না। আমায় বাঁচান।’
‘আমি বাঁচাব কি? আপনি যদি আমায় সাহায্য না করেন, আমি নিজেই অবশ্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে দেখব। কিন্তু এ স্থান আমার অপরিচিত, আমি একা কি করতে পারব? আমায় সাহায্য না করলেই কি আপনি বাঁচবেন মনে করেছেন? গভর্নমেন্ট যখন শুনবেন যে, আপনি আমায় সাহায্য করতে অস্বীকার করাতেই ডাকাতগুলো ধরা পড়ল না, তখন গভর্নমেন্ট কি ভাববে, বলুন দেখি? ভাববে, আপনিও ষড়যন্ত্রকারীদের দলের লোক, তাই সাহায্য করেননি। উল্টে বোধ হয় আপনারই জেল হয়ে যাবে।’ এই কথা বলিয়া গোবর্ধনবাবু মনোযোগের সহিত ছোটবাবুর মুখপানে চাহিয়া তাঁহার মনের ভাব নির্ণয়ে সচেষ্ট হইলেন।
ছোটবাবু হঠাৎ উঠিয়া গোবর্ধনবাবুর পদযুগল ধারণ করিলেন। বলিলেন, ‘আপনি বড়লোক, মহাত্মা লোক, নভেলিস্ট—এ গরীবকে দয়া করুন। আমায় এর মধ্যে জড়াবেন না, দোহাই আপনার। যদি কিছুর জন্যে আপনার সাহায্য দরকার হয়, তা বরং আমায় অনুমতি করুন। গোপনে যা পারি, তাতে প্রস্তুত আছি, প্রকাশ্যে কিছুই পারব না।’
‘উঠুন—উঠুন!’—বলিয়া গোবর্ধনবাবু ছোটবাবুকে হাত ধরিয়া উঠাইলেন। বলিলেন, ‘আচ্ছা, আপনার যদি এতই ভয়, তাহলে কাজ নেই। আমি একাই যা হয় করব। যা বলি তা শুনুন।’
গোবর্ধনবাবু ভাবিতেছিলেন, সাহায্য যদি এ করে, তবে কার্য সফল হইলে গৌরবের ভাগটা না-ই লইল। বলিলেন, ‘দেখুন, কাছাকাছি এমন কোনো বাড়ি আছে, যার মধ্যে তাদের পুরে আটক করতে পারি ?’
ছোটবাবু বলিলেন, ‘আছে—আছে—খুব ভাল জায়গাই আছে।’
‘কোথায় ?’
‘বাইরে চলুন, দেখাই।’
কিছু পূর্বে চন্দ্রোদয় হইয়াছিল। গোবর্ধনবাবুকে প্ল্যাটফর্মের প্রান্তদেশে লইয়া গিয়া ছোটবাবু বলিলেন, ওই যে মস্ত বাড়িটা দেখছেন, ওটা ধানের আড়ত করবার জন্যে রেলি ব্রাদারেরা এই নূতন তৈরি করেছে । মস্ত একখানা গুদামঘর আছে ওর মধ্যে, প্রায় ৪০ ফুট লম্বা ২৫ ফুট চৌড়া। খালি আছে, এখনও ওদের আড়ত খোলেনি। যদি কোনো কৌশলে সেই দলকে ওই ঘরখানার মধ্যে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালাবন্ধ করতে পারেন, তাহা হইলেই কাজ হাঁসিল। পুলিশ আসা পর্যন্ত ওইখানে ওরা আটক থাকবে এখন।’
গোবর্ধনবাবু বলিলেন, ‘অনুগ্রহ করে আপনার লণ্ঠনটা নিয়ে আসুন, ঘরখানি দেখি ।’
ছোটবাবু লণ্ঠন আনিতে চলিয়া গেলেন, গোবর্ধনবাবু সেই অন্ধকারে দাঁড়াইয়া কৌশল চিন্তায় ব্যাপৃত হইলেন।
ছোটবাবু লণ্ঠন লইয়া আসিলে উভয়ে গিয়া ঘরখানি দেখিলেন। একটিমাত্র দরজা। উপরে, ছাদের প্রায় কাছে, এদিকে দুটি ওদিকে দুটি বায়ু-চলাচলের জন্য জানালা কাটা রহিয়াছে, তাহাতে এখনও শার্সি বসান হয় নাই। গোবর্ধনবাবু দেখিলেন, সেগুলি মেঝে হইতে প্রায় ২০ ফুট উচ্চে—সুতরাং ওখান দিয়া পলায়নের সম্ভাবনা নাই। বলিলেন, ‘এই ঠিক হবে।’
ঘরের বাহিরে আসিয়া গোবর্ধনবাবু দরজাটি পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। পুরু শালকাঠের ফ্রেমে আড়ভাবে সেই কাঠের ছোট ছোট তক্তা বসানো, আগাগোড়া রিভেট করা । উপরে একটি, নিম্নে একটি মোটা শিকলও আছে। খুব মজবুত, সহজে ভাঙিয়া বাহির হইতে পারিবে না। ছোটবাবু বলিলেন, ‘রেলের ভাল তালা আছে, আপনাকে দিই চলুন।’
‘চলুন। আরও সব সরঞ্জাম দরকার। চলুন, আপিসে বসে তার পরামর্শ করি গে।’
ফিরিবার পথে ছোটবাবু মিনতিপূর্ণ স্বরে বলিলেন, ‘কিন্তু আমি যে আপনাকে কোনো বিষয়ে সাহায্য করছি, তা যেন ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ না হয়, দোহাই আপনার।’
‘না, তা হবে না।’
আপিসে ফিরিয়া ঘণ্টাখানেক ধরিয়া পরামর্শ চলিল। ইতিমধ্যে পৌনে দুটার গাড়ি আসিয়া চলিয়া গেল।
কলিকাতা-নিবাসী সেই নিরীহ যুবকেরা আসিয়াছিল—তাহাদের বন্ধু নিতাইয়ের বিবাহে বরযাত্রী হইয়া । নিতাই ছেলেটি অনেক দিন হইতে কিঞ্চিৎ মিলিটারি ভাবাপন্ন ; রঙ্গ করিয়া যখন নিজ বিবাহকে ‘যুদ্ধারম্ভ’ এবং শ্বশুরবাড়িকে ‘শত্রুদুর্গ’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছিল, তখন স্বপ্নেও জানিত না, তদ্দ্বারা বন্ধুগণকে সে কি বিপজ্জালে জড়াইতেছে!
যে গ্রামে বিবাহ হইল, তাহা স্টেশন হইতে দু ক্রোশ দূরে অবস্থিত । বিবাহ ও আহারাদির পরে বরের নিকট বিদায় গ্রহণ করিল। তাহাদের জন্য গো-যান প্রস্তুত ছিল, কিন্তু সেগুলি তাচ্ছিল্যভরে প্রত্যাখ্যান করিয়া যুবকেরা পদব্রজেই স্টেশন অভিমুখে অগ্রসর হইল। বরাবর সরকারী রাস্তা, পথ ভুল হইবার আশঙ্কা ছিল না। জ্যোৎস্নালোকে গান গাহিতে গাহিতে, অতি আনন্দেই তাহারা পথ অতিক্রম করিতে লাগিল।
রাত্রি যখন দুটা, তখন স্টেশনের আলোক তাহাদের দৃষ্টিগোচর হইল। একজন বলিলেন, ‘এস ভাই, বঙ্গ আমার জননী আমার গাইতে গাইতে যাই।’—বঙ্গ আমার জননী আমার—গাহিতে গাহিতে, তালে তালে পা ফেলিয়া, দশ মিনিটের মধ্যে তাহারা স্টেশনে পৌঁছিল।
প্ল্যাটফর্মে পৌঁছিয়া দেখিল, এক ভদ্রলোক মাথায় পাগড়ি বাঁধিয়া মলিদা গায়ে দিয়া প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়াইয়া আছেন। একজন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘ট্রেনের আর দেরি কত মশাই ?’
বাবুটি বলিলেন, ‘আপনারাই কি আজ বিকেল পাঁচটার গাড়িতে এসেছিলেন ?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘আপনাদের দলের কেউ কলকাতা থেকে ছাড়বার সময় গাড়ি মিস্ করেছিল ?’
‘তা তো জানিনে ; তবে আরও তিনজনের আসবার কথা ছিল বটে, তারা আসেনি, হয়তো সময়মত স্টেশনে এসে জুটতে পারেনি; কেন মশায়?’
বাবুটি বলিলেন, ‘তবে ঠিক হয়েছে। আপনাদেরই লোক । তিনজন নয়, দুজন লোক সন্ধ্যা সাতটার গাড়িতে এসে পৌঁছেছিলেন। তার মধ্যে একজনের ভয়ানক জ্বর।’
‘কোথায় ? কোথায় তারা ? ’
‘ওই রেলি ব্রাদারের আড়তে তাঁরা আছেন। যিনি সুস্থ, তিনি আমাদের এসে বললেন, মশাই, এই তো বিপদ, একটু আশ্রয় দিতে পারেন ? কোথায় আশ্রয় দিই, ওই রেলি ব্রাদারের আড়ত দেখিয়ে দিলাম। বাসা থেকে তাক্তাপোশ, লেপ, বিছানা সব পাঠিয়ে দিলাম। দু তিনবার গিয়ে দেখেও এসেছি—খুব জ্বর, ১০৫-এর কম তো হবে না। আর, কি পিপাসা !—দশ মিনিট অন্তর খালি বলে জল দাও। সুস্থ লোকটির কাছেই শুনলাম আপনারা রাত্রি তিনটের গাড়িতে কলকাতা ফিরবেন।’
যুবকেরা পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিল, ‘ওহে, বোধ হয় শান্তি আর শৈলেন । শান্তিরই বোধ হয় জ্বর হয়েছে—তার তো ম্যালেরিয়া লেগেই আছে কি না।’
পাগড়ি-বাঁধা বাবুটি বলিলেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ—শান্তিবাবুরই জ্বর হয়েছে। নামটি ভুলে গিয়েছিলাম। চলুন, দেখবেন।’ বলিয়া তিনি অগ্রসর হইলেন। বলা বাহুল্য, ইনি আমাদের গোবর্ধনবাবু ভিন্ন আর কেহ নহেন।
যুবকেরা পশ্চাদ্বর্তী হইল। তাহারা বলাবলি করিতে লাগিল, ‘জ্বর যদি একটু কম থাকে, গাড়িতে নিয়ে যাবার মত অবস্থা থাকে, তবে নিয়েই যাব ; নইলে আমাদের সকলকেই এখানে থাকতে হবে।’
রেলি ব্রাদারের আড়তে পৌঁছিয়া বাবুটি বলিলেন, ‘ওই ঘরে আছে, চলুন।’—দ্বারের ফাঁক দিয়া একটু একটু আলো আসিতেছিল।
দ্বার ঠেলিয়া মাথাটি ভিতরে প্রবেশ করাইয়া বাবুটি বলিলেন, ‘ঘুমুচ্ছে বোধ হয়। ফিবার মিক্সচারটায় কিছু উপকার হয়ে থাকবে। দুজনেই ঘুমুচ্ছে। পা টিপে টিপে আপনারা যান।’
যুবকগণ দেখিল, সেই লম্বা ঘরের প্রান্তভাগে পালঙ্ক পাতা রহিয়াছে। পার্শ্বে একটি টেবিলের উপর গোটা দুই ঔষধের শিশিও দেখা গেল। দেওয়ালে একটা ল্যাম্প মিটি মিটি করিয়া জ্বলিতেছে। যুবকগণ জুতার গোড়ালি শূন্যে তুলিয়া নিঃশব্দে প্রবেশ করিতে লাগিল।
সকলে প্রায় একসঙ্গেই শয্যার নিকটে পৌঁছিল। একজন লেপের প্রান্তটি আস্তে আস্তে উঠাইতে লাগিল। ক্রমে অনেকখানি উঠাইয়া ফেলিয়া বলিল, ‘কই? ’
দুই তিনজনে লেপটা টানিয়া বলিল, ‘গেল কোথা? ’
অপর সকলে বলিল, ‘সে বাবুটি কই ? তিনি গেলেন কোথা ? ’
কেহ কেহ বলিল, ‘দেখ তো, দেখ তো, বাইরে বোধ হয় আছেন।’
তিন চারিজনে দ্বারের কাছে গিয়া দ্বার টানিল, তাহা বাহির হইতে বন্ধ । চিৎকার করিয়া তাহারা বলিল, ‘ওহে, বন্ধ যে! ’
বাকি সকলে তখন দ্বারের নিকটে গেল। সকলেই দ্বার ধরিয়া টানাটানি করিতে লাগিল, দ্বার এক চুলও নড়িল না।
সকলেরই মনে একটু ভয় হইল। কেহ কেহ বলিল, ‘ওহে কুঞ্জ—এ কি ব্যাপার ? ’
কুঞ্জ বলিল, ‘কিছুই বুঝতে পারছিনে। আমাদের এরকম করে বন্ধ করলে কেন ? লোকটার উদ্দেশ্য কি ?’
অভয় বলিল, ‘একবার ডেকে দেখা যাক।’ বলিয়া সে দরজার কাছে মুখ রাখিয়া চিৎকার করিতে লাগিল, ‘ও মশাই! ও পাগড়ি মাথায় বাবুটি, বলি শুনছেন ? দোরটা বন্ধ করে দিলেন কেন ? খুলে দিন, খুলে দিন।’
একে একে দুইয়ে দুইয়ে তখন তাহারা ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি করিতে লাগিল। কিন্তু কোনই ফল হইল না। কেহ কেহ তখন হতাশ হইয়া মেঝের উপর বসিয়া পড়িয়াছে।
অবনী বলিল, ‘ওহে, গতিক ভাল নয়। এর মধ্যে বন্ধ থাকলে প্রাণে মারা যাবে যে। এ মজবুত কবাট ভাঙা যাবে না । ওই ল্যাম্পটা নিয়ে এস। ওর তেলটা কটের গায়ে মাখিয়ে আগুন ধরিয়ে দাও। কবাট পুড়িয়ে ফেল।’
কুঞ্জ বলিল, ‘সর্বনাশ !—তাহলে ধোঁয়ায় শেষকালে দমবন্ধ হয়ে মারা যাব যে ! জানলা নেই—শুধু ছাদের কাছে ছোট ছোট ওই দুটি ভেন্টিলেটার, তাও কাচবন্ধ বলে বোধ হচ্ছে। অন্য উপায় চিন্তা কর।’
শ্যামাপদ বলিল, ‘সে বোধ হয় পালিয়েছে। চেঁচামেচি করি, এস, কারু না কারু সাড়া পাব।’
কেশব বলিল, ‘এই শীতের ভোরে কে আছে এখানে যে আমাদের সাড়া পেয়ে এসে আমাদের উদ্ধার করবে ? ’
সকলে তখন মাথায় হাত দিয়া বসিয়া চিন্তা করিতে লাগিল।
অর্ধ ঘণ্টা পরে বাহির হইতে ভস্ ভস্ করিয়া একটা শব্দ আসিল। অভয় বলিল, ‘ওই আমাদের ট্রেন বেরিয়ে গেল।’
জল্পনায় কল্পনায় আরও ঘণ্টাখানেক কাটিল । কেন যে লোকটা এরূপ ব্যবহার করিয়া গেল, তাহাই নির্ণয় করিতে চেষ্টা করিতে লাগিল। ভাবিয়া চিন্তিয়া সকলে কোনও কূল কিনারা পাইল না। অবশেষে স্থির করিল লোকটা বোধ হয় পাগল হইবে।
কুঞ্জ ঘরের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল, খাটখানি ধরিয়া নাড়াচাড়া করিতেছিল। কিছুক্ষণ পরে সে সকলকে ডাকিয়া বলিল, ‘দেখ, উপরে যে ওই ভেন্টিলেটর রয়েছে, ওতে শার্সি-টার্সি বোধ হয় নেই। আমি অনেকক্ষণ থেকে চেয়ে চেয়ে দেখছি। ওই দিয়ে ছাড়া বেরুবার আর কোন উপায় নেই কিন্তু।’
অভয় কহিল, ‘ও তো বিষম উঁচু, ওখানে পৌঁছান যায় কেমন করে ? ’
কুঞ্জ বলিল, ‘এ নেওয়ারের খাটখানা ভাঙা যাক। খাটের কাঠ চারখানা টেবিলের পায়া চারটে নেওয়ার দিয়ে খুব কষে বাঁধা যাক এস। একটা মইয়ের মত হবে। দেওয়ালের গায়ে সেইটে দাঁড় করালে জানলার ও ফুটো অবধি পৌঁছানো যাবে বোধ হয়।’
তিন চারিজন দেখিয়া অনুমান করিয়া বলিল, ‘বোধ হয়।’
কুঞ্জ বলিল, ‘তিনকড়ি, তুই সাইজে সব চেয়ে ছোট আছিস। পারবি উঠতে ? ’
তিনকড়ি বলিল, ‘খুব পারব। কিন্তু তার পর ? ওদিকে নামব কি করে ? ’
‘এই মই, জানলা গলিয়ে ওদিকে ফেলে, ধরে নামতে পারবিনে ? ’
‘ওদিকে আবার জমি অবধি পেলে তো ! ওদিকে যদি বেশি নিচু হয় ? ’
কুঞ্জ বলিল, ‘আগে উঠে তো দেখ।’
তখন সেই ল্যাম্পের আলোকের সাহায্যে সকলে মিলিয়া খাটের নেওয়ার খুলিতে আরম্ভ করিল। খোলা শেষ হইলে অনেকে মিলিয়া খাটের পায়া হইতে পাট্রিগুলা বিচ্যুত করিয়া ফেলিল। টেবিলও এইরূপে ভাঙা হইল। খাটের পাট্রি এবং টেবিলের পায়া নেওয়ার দিয়া বাঁধিতে বাঁধিতে বাহিরে কাক ডাকিয়া উঠিল, গবাক্ষপথে ভোরের আলো প্রবেশ করিল।
সকলে ধরাধরি করিয়া তখন সেই মইকে দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করাইয়া দিল। ইহা গবাক্ষ ছাড়াইয়াও প্রায় একহাত ঊর্ধ্বে উঠিয়াছে—দেখিয়া সকলের মনে আশার সঞ্চার হইল।
তিনকড়ি বলিল, ‘যদি বেরুতে পারি বেরিয়ে আমি কি করব ? স্টেশনে যাব ? ’
কুঞ্জ বলিল, ‘না, না, স্টেশনে গিয়ে কি হবে ? তারাই তো আমাদের শত্রু । প্রথমে দরজায় গিয়ে দেখবি। যদি শুধু শিকল বন্ধ থাকে, শিকল খুলে দিবি। যদি দেখিস তালা বন্ধ, থানায় গিয়ে দারোগাকে সব বলবি। কাছে কোথাও নিশ্চয়ই থানা আছে—দারোগা এসে আমাদের উদ্ধার করবে।’
সকলে মিলিয়া সেই মইটা ধরিয়া রহিল। তিনকড়ি অতি কষ্টে বাঁধনের গাঁটে পা দিয়া, উপরে উঠিতে লাগিল। ক্রমে গবাক্ষের নিকটে পৌঁছিয়া তথায় সে বসিল ।
নিম্ন হইতে জিজ্ঞাসা হইল, ‘তিনকড়ে, কি দেখছিস ? ’
‘মাঠ। মাঠে একটা শেয়াল চরছে।’
‘মানুষ-টানুষ কাউকে দেখছিস ? ’
‘কাউকে নয়।’
‘কতখানি নিচে জমি ? এ কাঠ পৌঁছবে ? ’
‘না। অনেক নিচু । এক কাজ কর না।’
‘কি ? ’
‘নেয়ার খোল। টুকরোগুলো মুখে মুখে করে গেরো বাঁধ। দু-খাই করে পাকিয়ে দড়ার মত কর। একটা মুখ আমায় দাও। সেটা আমি নিচে নামিয়ে দিই। আর একটা মুখ তোমরা সকলে মিলে ধরে থাক। আমি ওদিকে নেমে পড়ব এখন।’
সকলে বলিল, ‘বেশ বুদ্ধি করেছ—বাঃ ! ’
তখন সেই আঠারো জোড়া হাত নেওয়ার খুলিতে, বাঁধিতে এবং পাকাইতে লাগিয়া গেল। কুড়ি মিনিটের মধ্যে সমস্ত প্রস্তুত।
নিম্ন হইতে সকলে বলিয়া দিল, ‘আগে গিয়ে দেখ দরজায় খালি শিকল বন্ধ আছে না তালা দেওয়া আছে। যদি তালা দেখিস, নিচে থেকে আমাদের বলবি, যত শীঘ্র পারিস থানায় যাবি—গিয়ে দারোগাকে সব কথা বলে এখানে নিয়ে আসবি।’
‘আচ্ছা, আমি নামলাম।’ বলিয়া দড়ি ধরিয়া জানালার ভিতর দিয়া তিনকড়ি নিজেকে গলাইয়া দিল ।
প্রাণভয়ে ছোটবাবু অর্ধঘণ্টা পূর্বেই চুপি চুপি আসিয়া নিজের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়া তালা এবং শিকল খুলিয়া দিয়া গিয়াছিলেন। যুবকেরা কেহই তখন দরজার কাছে ছিল না, কোনও শব্দই পায় নাই। ছোটবাবু ভাবিয়াছিলেন, অনতিবিলম্বেই ইহারা জানিতে পারিবে । দ্বার খোলা পাইয়া পলায়ন করিবে, তাহা হইলে ভবিষ্যতে আর ‘কুকুরমারা’ হইবার আশঙ্কা থাকিবে না।
দরজা খুলিয়া দিয়া ছোটবাবু আবার আপিসে ফিরিয়া গেলেন। দেখিলেন গোবর্ধনবাবু সেই লম্বা টেবিলখানার উপর খানকতক ক্লিয়ার বই মাথায় দিয়া ঘুমাইতেছেন। ছোটবাবু ডুপ্লিকেট চাবিটা লুকাইয়া রাখিয়া আপনার কাজ করিতে লাগিলেন।
অনেকক্ষণ পরে গোবর্ধনবাবু একটু নড়িয়া চড়িয়া উঠিলেন। মলিদা হইতে মুখ বাহির করিয়া বলিলেন, ‘ভোর হয়েছে যে। থানায় লোক পাঠালেন ? ’
ছোটবাবু বলিলেন, ‘না, এক ব্যাটা খালাসীকেও দেখতে পাচ্ছিনে।’
‘আমি নিজেই যাব না কি ? থানা কত দূর এখান থেকে ? ’
‘এক মাইল হবে।’
‘আচ্ছা মশাই, এক কাজ করি না কেন ?—থানায় খবর না পাঠিয়ে, বরং কলকাতায় একখানা টেলিগ্রাম করে দিই, পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেলের নামে । মিলিটারি পুলিশ নিয়ে, একবারে বন্দুক-টন্দুক নিয়ে তারা আসুক। এ সব স্থানীয় পুলিশকে বিশ্বাস নেই মশায়। আমি যে এত কষ্ট করে ধরলাম, দারোগা নিজে নাম নেবার জন্যে শেষে হয়তো আমায় আমলই দেবে না। টেলিগ্রাম করে দিই, কি বলেন ?’
‘সে মন্দ নয়। বেশ তো, আপনি বসে টেলিগ্রাম লিখুন, আমি ততক্ষণ বাসায় গিয়ে আপনার চায়ের যোগাড় করে আসি।’
‘আঃ, এমন সময় এক পেয়ালা গরম চা পেলে তো বেড়ে হয় মশায় ! একে এই শীত, তাতে সমস্ত রাত্রি জাগরণ।’
ছোটবাবু বাসায় গেলেন। গোবর্ধনবাবু কাগজ-কলম লইয়া টেলিগ্রাম লিখিতে বসিলেন। অনেক কাটকুট করিয়া শেষে মুসাবিদাটা এই প্রকার দাঁড়াইল—
‘আমি কার্যবশত এ অঞ্চলে আসিয়া অদূরে কোনও গ্রামে একটি ভীষণ স্বদেশী ডাকাতি হইয়াছে জানিতে পারিয়া, অনেক কষ্টে এবং কৌশলে উনিশজন ডাকাইতকে ধৃত করিয়া একটা ঘরে তালা বন্ধ করিয়া রাখিয়াছি। মিলিটারি পুলিশ লইয়া শীঘ্র আসুন।
গোবর্ধন দত্ত’
মুসাবিদাটি দুই তিনবার পড়িয়া, গোবর্ধনবাবু অবশেষে নিজ স্বাক্ষরের নিম্নে লিখিয়া দিলেন, ‘বেঙ্গলি নভেলিস্ট—বাঙ্গালা ঔপন্যাসিক। দুইটি উদ্দেশ্য ছিল—ইন্সপেক্টর জেনারেল সাহেব মনে না করেন যে, কোন দায়িত্বজ্ঞানহীন লোক এই টেলিগ্রাম পাঠাইতেছে। দ্বিতীয়ত, কে ধরাইয়া দিল, সে সম্বন্ধে ভবিষ্যতে কোনও গোলযোগ না হয়।
এই সময় বাহিরে গোবর্ধনবাবু অনেক লোকের কোলাহল ও জুতার আওয়াজ শুনিয়া, টেলিগ্রামখানি হাতে করিয়া কৌতূহলবশত বাহিরে গেলেন।
যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার প্রাণ উড়িয়া গেল ।
সেই তাহারা—সেই দল—কাঁধে তাহাদের খাটভাঙা টেবিলভাঙা। বড় বড় কাঠ। একজন উঠিল—‘ওই রে, পাগড়ি মাথায় ওই শালা।’
গোবর্ধনবাবু বুঝিলেন, তাঁহার আসন্নকাল উপস্থিত। কিন্তু প্রাণ বড় ধন। সেটা বাঁচাইবার জন্য একবার চেষ্টা করিয়া দেখিতে হয়।
সুতরাং তিনি ছুটিলেন। ‘ডাকাইত’গণও, ‘ধর শালাকে ধর’ বলিয়া তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিতে লাগিল। গোবর্ধনবাবু কিয়দ্দূর ছুটিয়া, প্ল্যাটফর্মের তারের বেড়া টপকাইয়া, মাঠ দিয়া, জঙ্গল দিয়া প্রাণপণে ছুটিলেন। গাছের কাঁটায় তাঁর কাপড় ছিঁড়িল, গা ক্ষতবিক্ষত হইয়া গেল, তথাপি তিনি ছুটিলেন। এক পাটি জুতা খুলিয়া পথে পড়িয়া রহিল, একপায়ে জুতাসুদ্ধ তিনি ছুটিলেন। ক্রমে দ্বিতীয় জুতাপাটিটিও খুলিয়া পড়িল, তথাপি ছুটিলেন। পায়ে কাঁটা ফুটিতে লাগিল, পাথরকুচি বিঁধিতে লাগিল—ক্রমে তাঁহার গতি মন্দ হইয়া আসিল। অবশেষে হাঁপাইতে হাঁপাইতে এক স্থানে বসিয়া পড়িলেন। চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন, ঘন জঙ্গল। কান পতিয়া রহিলেন, ডাকাইতগণ তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়া আসিতেছে কি না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিলেন কিন্তু কাহারও কোন সাড়াশব্দ পাইলেন না।
মনে মনে তখন গোবর্ধনবাবু ভাবিলেন স্টেশনে উহারা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিবে না ; কারণ, নিজেদের প্রাণের ভয় তো আছে। তাই ঘণ্টা দুই সেখানে বসিয়া থাকিয়া তিনি ধীরে ধীরে বাহির হইলেন। পা কাটিয়া ব্যথা হইয়াছে, খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে চলিতে লাগিলেন।
পথ ভুলিয়া, ঘুরিয়া ফিরিয়া বেলা ৯টার সময় স্টেশনে উপস্থিত হইলেন।
ডাকাইতগণ কাহাকেও কোথাও দেখিতে পাইলেন না। অনুসন্ধানে জানিলেন, ছোটবাবু বাসায় গিয়াছেন। বাসায় গিয়া ছোটবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন।
ছোটবাবু হাসিয়া বলিলেন, ‘কি, কোথায় ছিলেন এতক্ষণ ? ডাকাতরা আপনাকে খুঁজছিল যে।’
গোবর্ধনবাবু নিম্নস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কোথায় গেল তারা ? ’
‘তারা এতক্ষণে কলকাতা পৌঁছে গেছে।’
ছোটবাবু তারপর ডাকাইতগণের মুখে যাহা শুনিয়াছিলেন, তাহা বর্ণনা করিলেন।
গোবর্ধনবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কিন্তু কি প্রকারে মুক্ত হল তারা ?’
ছোটবাবু এইবার কল্পনার সাহায্য গ্রহণ করিয়া বলিলেন, ‘সে মশায় আশ্চর্য কৌশল। সাতটার ট্রেনে তারা চলে গেলে, আড়তে গিয়ে দেখলাম কি না। বাইরে তালা যেমন বন্ধ ছিল, তেমনি রয়েছে। খাট ভেঙে, নেয়ার খুলে তারই মই তৈরি করেছে, করে সেই জানালার ফুটোয় উঠে, একে একে টুপটুপ করে লাফিয়ে পড়েছে। উঃ—কি কৌশল, কি সাহস !’
গোবর্ধনবাবু কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, ‘দেখুন, তারা ডাকাতই বটে, বিয়ের বরযাত্র নয় । বরযাত্র এসেছিল, এটা আপনাকে মিথ্যে করে বলে গেছে।—যা হোক্, আমার নামটাম তাদের কাছে বলেননি তো ? ’
‘আরে রাম ! আমাকে অনেকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলে বটে, কিন্তু আমি বললাম, ‘মশায়, কত লোক আসছে, কত লোক যাচ্ছে, কত লোকের খবর রাখব বলুন। তবে হ্যাঁ, মলিদাচাদর গায়ে, মাথায় পাগড়ি জড়ানো একটা লোককে প্ল্যাটফর্মে রাত্রে দেখেছিলাম বটে। ওই যা বলছেন আপনারা—বোধ হয় পাগলটাগল হবে।’
গোবর্ধনবাবু একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ‘নামটি আমার বলেননি যে এইটি ভারি উপকার করেছেন। ফের যদি তারা কি তাদের দলের লোক, এসে আমার সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে, দোহাই আপনার, বলবেন না।’ বলিয়া গোবর্ধনবাবু ছোটবাবুর হাত দুখানি চাপিয়া ধরিলেন।
ছোটবাবু বলিলেন, ‘ক্ষেপেছেন, সে কি আমি বলি ? জিভ কেটে ফেললেও না।’
ছোটবাবুর বাসাতেই স্নানাহার করিয়া, দ্বিপ্রহরের গাড়িতে গোবর্ধনবাবু কলিকাতা রওনা হইলেন।
পরদিন ডাকেই ছোটবাবু একটি বৃহৎ বুক-প্যাকেট পাইলেন—গোবর্ধনবাবু তাঁহাকে নিজ গ্রন্থাবলী সম্পূর্ণ একসেট উপহার পাঠাইয়াছেন। প্রত্যেক পুস্তকে উপহারের কথা লিখিয়া স্বাক্ষর করিয়াছেন, ‘আপনার চিরকৃতজ্ঞ গোবর্ধন।’