সকাল

সকাল

ভোর পাঁচটায় অ্যালার্ম সেট। আগেকার কালের ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজত খ্যাড় খ্যাড় করে। এক-একটা ঘড়ি আবার নিজের বুকের শব্দে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠত ব্যাঙের মতো। কর্তার ঘুম এতেও না ভাঙলে মাথার কাছের ছোট্ট টেবিল থেকে স্খলিত হয়ে ঘাড়ে এসে পড়ত। গড়িয়ে বালিশে। কানের কাছে। বেজেই যাচ্ছে, বেজেই যাচ্ছে। ঘুম জড়ানো গলায় বললে, ‘সকাল থেকেই শুরু করলে? থামবে, না বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দোব।’ শেষে খেয়াল হল, এ তো বউ নয়, ঘড়ি।

একালের ঘড়ির অ্যালার্মে নানারকম স্তোত্র সুরে বাজে। আমার ঘড়িতে গায়ত্রী মন্ত্র। যেই ‘ওঁ’ শুনলুম, সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে অ্যালার্ম বন্ধ করে পাশ ফিরে ঘুম। সেই সাতটা। এই ঘুমটা খুব সুইট।

সকালের চা রাইট টাইমের প্ল্যাটফর্মে ঢোকে। দু-চার মিনিট লেট ধর্তব্য নয়। এরপর কাগজ। এক নজরে যতটা পারা যায়। একটা রেল চিৎপটাং। ছটা খুন। তিনটে ধর্ষণ। পথ দুর্ঘটনা। ছজন ফৌত। বর্ডারে উট। দুপক্ষে বুলেট বিনিময়। যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা। এদিকে-ওদিকে। আমেরিকার বল, ইরাকের ব্যাট। আউটও নেই, রানও নেই। গোটাকতক সুন্দরী ভীষণ জ্বালাচ্ছে। কখনও চুল, কখনও হিরের গয়না, কখনও মোবাইল ফোন। মোবিলেও আছে, মোটর সাইকেলেও হাজির। টিভির পরদায়, কাগজের পাতায় স্বল্পবাস ষোড়শী আর বাজারে গিয়ে মাছ দেখা প্রায় একই রকম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোমরে দুলবে কোল্ড ড্রিংকস, বক্ষচূড়ায় হিরে। খোলা চুলে শ্যাম্পু-ঝিলিক, পেট ভরবে কীসে?

কেন আলু? ট্রিমেন্ডাস ফলন। আলু খাও আলু।

বাজার-দর্শন আর নরক দর্শন প্রায় এক। পেছনে মানুষের গুঁতো, বুকে দামের খোঁচা। পরিচিতজন বললে, ‘আবার পড়ল।’

‘কে পড়ল? কোথা থেকে পড়ল?’

‘কাগজ পড়ো না? সুদ, সুদ। আরও এক পার্সেন্ট ধপাস।’

আগে এইরকম বলত, ‘রুগির অবস্থা খুব খারাপ। যমে-মানুষে টানাটানি চলেছে।’ ব্যাংকের সুদের অবস্থাও তাই। কী টানাটানিরে ভাই! যাক গে। এখন ষাট টাকায় গোটা বাজারটা কিনতে হবে। কীভাবে? কিছু কিনব চোখ দিয়ে। কীরকম? আহা! গায়ে গতরে মাছটা কেমন শুয়ে আছে দেখো। যেন সুন্দরী কমলা। থাকো, তুমি তোমায় জায়গায় থাকো। আমার টাকা আমার জায়গায় থাকুক। সজনে ডাঁটার আবেদন, নিমপাতার নিবেদন, কচি আমের হাতছানি, মোচার মুচকি হাসি উপেক্ষা করো। কয়েক কেজি আলু, গোটাকতক প্রসন্ন ডিম নিয়ে নিরাপদ প্রত্যাবর্তন।

যা-আ!

কী ভুললে?

 ছেলের স্কুলের টিফিন। আর হাঁটুর বাতের মলম। স্ত্রীর বয়েস বাড়ছে। মুখের বাত হাঁটুতে নেমে বসে আছে মৌনী হয়ে।

টিফিন? বিশাল প্রবলেম।

 কেন? রুটি কুমড়োর তরকারি?

মাথা খারাপ? বাংলা মিডিয়ামেই অচল। ছেলের আমার ইংলিশ মিডিয়াম। যখন সেজেগুজে, টাই-ফাই পরে বেরোয় মনে হয় সায়েব বাচ্চা। বাপের নাম ভোলানাথ নয়, ম্যাকিন্টস বার্ন। মায়ের নাম মনোরমা নয়, জুলিয়ান ডে।

সুপ্রিয়! বল তো ভাই, আজ কী টিফিন দেওয়া যায়?

 কেন। একটা কেক। এক প্যাকেট চিপস। আর বাবুল গাম। ওই শেষেরটাই ঘণ্টা তিনেক টেনে দেবে। দেখেননি, বড় বড় ক্রিকেটাররা, কেবল চিবোচ্ছে। চিবিয়ে চিবিয়ে চার পাঁচ ঘণ্টা চালিয়ে দিচ্ছে। কেকের সঙ্গে একটা কলা, সিঙ্গাপুরি।

ধুস? সিঙ্গাপুরিতে শুধু জল।

শুধু জল নয়, সঙ্গে কলও আছে। সঙ্গে সাত-আটটা আঙুর ঢুকিয়ে দেবেন, একটা আপেল। যা পড়াশোনার চাপ, তেড়ে খাওয়াতে হবে।

ভীষণ মোটা আর বেঁটে হয়ে যাচ্ছে। থ্যাসকা মতো।

হবেই তো। চাপে। জীবনের কী চাপ! এক চুল এদিকওদিক হলেই আউট। গন ফট। আত্মহত্যার কি হিড়িক রে ভাই! একটি রেল, পাতাল রেল, দড়ি, জলে ডোবা, ছাত থেকে ঝাঁপ। যে যখনই সময় পাচ্ছে আত্মহত্যা করছে। এই তো কদিন আগে আমাদের এক বন্ধু। একসঙ্গে বসে চা খাচ্ছিলুম। হঠাৎ বললে, বোস, একটু হালকা হয়ে আসি। আর এল না। খোঁজ খোঁজ। ঝুলছে। ভালোবাসা যেন একটা ব্যামো।

 কেলেঙ্কারি ব্যাপার! আর সেই রকম কিছু মেয়েও বেরিয়েছে বটে মার্কেটে! ভালো ভালো ছেলে ধরছে আর নারকোলের ছোবড়া ছাড়াবার মতো করে সব ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে খোল, জল, শাঁস আলাদা করে ছেড়ে দিচ্ছে। সব শিকারি। প্রেমের এ-কে ফর্টিসেভন। মোড়ের মাথার সেলুনের ছেলেটি ভীষণ ভালো। বললে, ‘আসুন স্যাট করে নামিয়ে দি একটানে।’ মন্দ প্রস্তাব নয়। আজ একটু বেশি দেরি করে ফেলেছি। লটবহর বের করে বাড়িতে বসতে গেলে বহুত সময় লেগে যাবে।

 সেলুন সেরে কিছু দূর এগোতেই রমেশ বাবু। ‘তোমরা একটা প্রতিবাদ করবে কি না?’

‘কীসের প্রতিবাদ?’

খুব রেগে গেলেন, ‘সব জানো, জেনে শুনে ন্যাকামি! বাড়িওয়ালার ছেলে আমার মেজ মেয়েটকে ধরেছে।’

‘আজ্ঞে, বাঘে ধরলে গুলি করে নামানো যায়, একটা ছেলে ধরলে কী করা যাবে কাকাবাবু?’

এর মধ্যে শুধু ধরা নেই, ধরাধরি আছে।’

‘তার মানে? হোয়াট ডু ইউ মিন?’

‘আই মিন ম্যারেজ। শুনুন, আপনি ভীষণ বোকা।’

‘বোকা?’

‘ইয়েস বোকা। ভালো করে শুনুন। আপনার বাড়িওয়ালার সবেধন নীলমণি একটি। সেটিকে যদি খেলিয়ে জামাই করে ডাঙায় তুলতে পারেন বাড়িটা আপনার মেয়ের হবে। এখন দেখতে হবে মাছটা ফসকে না যায়!’

‘হুঁ, বলেছ ভালো। যাতে ফসকে না যায় তার প্রিকশান?’

‘কড়া নজর রাখুন, আর একটা মেয়ে না ঘোঁত করে ঢুকে পড়ে। মেয়েরা একটা চিল।’

‘সেটা কী করে সম্ভব?’

‘গোয়ান্দাগিরি। চিৎপুর থেকে দড়ি, পরচুল কিনে ফেলুন। ছদ্মবেশী। দেখবেন, বেশ মজা লাগবে। আর বুঝতে পারবেন, ছেলে, মেয়ে বাপের সম্পত্তি নয়। সব শ্বশুরের সম্পত্তি।’

‘অতএব, বাপ না হয়ে শ্বশুর হওয়ার চেষ্টা করুন।’

ভদ্রলোক ঘাবড়ে গেলেন। দাঁড়িয়ে রইলেন। হাতে বাজারের ব্যাগ। পাশ দিয়ে অটো চলে যাচ্ছে নানা ছন্দে। একগুঁয়ে মোটর সাইকেল। বাড়িতে ঢোকবার মুখে আর একবার, যা:। যা: চা। চা কেনা হয়নি। দুটো জিনিস—চাবি আর চা। ভুল হবেই হবে।

বাজার করার পুরস্কার অথবা পারিশ্রমিক এক কাপ চা। গৃহিনীর অবস্থা আমার চেয়েও খারাপ। গ্যাসের দুটো বার্নারই জ্বলছে। একটায় ডাল, একটায় তরকারি। পায়ের কাছে আদুরে বেড়ালের মিউ, মিউ। ‘দাঁড়াও না পুসি। এই তো দুধ খেলি। আগে অফিসটাকে অফিসে পাঠাই। স্কুলটাকে স্কুলে। সব সময় খেলে চলে? খাওয়ায় একটু রেস্ট দিতে হয়।’

পুসি বুঝদারের মতো হালকা একটা ‘মিউ’ ছাড়ল।

পরক্ষণেই ছেলেকে, ‘চুলে ভরতি জল। ভালো করে মোছ।’

আর ঠিক তখনই ভীষণ উত্তেজিত অবস্থায় প্রবেশ করলেন আমাদের পাড়ার রমলা মাসি। প্রবীণা। তিন-চার বছর হল স্বামী মারা গেছেন। ছেলে প্রেম করে বিয়ে করেছে।

‘বউমা। কিছু করবে কি করবে না?’

বউমার নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। ‘কী করব মাসিমা?’

‘আজ সকালে আমাকে ঝুল ঝাড়ু দেখিয়েছে। শুধু দেখায়নি, নেচে নেচে গেয়েছে—মার ঝাড়ু মার ঝাড়ু মেরে ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর।’

‘বাড়িটা তো আপনার নামে, দুটোকে এইবার আপনিই বিদায় করে দিন।’

‘বউমা দুটোতেই পার্টি করে।’

‘আপনি বিরোধী পার্টি করুন। যা হওয়ার পার্টিতে-পার্টিতে হোক।’

রমলা মাসি কাঁদছেন, ‘বউমা দশমাস দশদিন এই ছেলেকে আমি গর্ভে ধারণ করেছি। বুকের দুধ খাইয়েছি।’

চোখ মুছে বললেন, ‘তোমাদের রাঁধুনির দরকার নেই? আমাকে রাখো না বউমা।’

মেঝেতে বসে পড়লেন অসহায় মহিলা। স্বামী ছিলেন নামকরা শিক্ষক। কত ছেলেকে মানুষ করলেন, নিজেরটি হয়ে গেল অমানুষ।

এইবার দৌড়। চলো কর্মস্থলে। যাওয়ার পথ মসৃণ নয়। জায়গায়-জায়গায় যানজট। পথ অবরোধ। বাজার রাস্তা খেয়ে বসে আছে। গরু ছাগলও আহারের সন্ধানে বেরোয়। মানুষের মতো এমন দৌড়য় না।

বাসে পাশে যিনি বসে আছেন, বহুক্ষণ ধরে উশখুশ করছেন। একবার এ পকেটে হাত, একবার ও পকেটে, ‘যা:’।

‘কী হল?’

‘মানি ব্যাগ। গন। গো, ওয়েন্ট, গন।’

ভদ্রলোক কেমন-কেমন চোখে তাকালেন আমার দিকে। কী রে বাবা! আমাকেই পকেটমার ভাবছেন না তো।

ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলুম, ‘কত ছিল?’

গম্ভীর গলায় বললেন, ‘খুললেই দেখতে পাবেন।’

‘মানে? আমি পকেটমার? বসে বসে পকেট মারা যায়?’

এপাশে, ওপাশে আমার বন্ধু-বান্ধব। দীর্ঘদিনের সহযাত্রী। তারা জিগ্যেস করল, ‘কী হয়েছে রে?’

ভদ্রলোক ঝাঁ করে উঠে, গুঁতোতে গুঁতোতে নেমে গেলেন। পর মুহূর্তেই আমার বলার পালা, ‘যা:!’

‘কী হল রে?’

‘গো, ওয়েন্ট, গন। আমার ব্যাগ গন।’

‘লিখে রাখো, পকেট শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নয়, বসে বসেও মারা যায়। নার্সিংহোমে আমার বউয়ের বালিশের তলা সাফ করে দিয়েছিল।’

‘পাশ থেকে বাচ্চা সাফ করে দিচ্ছে। দশমাস গর্ভধারণের ফল ফক্কা। শূন্য হাতে সগর্বে প্রত্যাবর্তন। মা হয়েছে। ছেলে কই?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *