সকলই তার ইচ্ছা

সকলই তার ইচ্ছা

আপনি কিন্তু আমার জন্মদিনে আসবেন।

নিশ্চয়। কবে তােমার জন্মদিন?

এই তাে দোসরা আগস্ট। ওই দিন আপনি গরদের পাঞ্জাবি পরে আসবেন। আপনার পাশে দাঁড়িয়ে আমি একখানা ছবি তুলব। গরদের পাঞ্জাবি পরলে আপনাকে একদম রাজার মতাে দেখাবে।

কী পাগলের মতাে বলছ রাখী। আমি এখন রাজা সাজব কী! আমি তােমার চেয়ে কত বড়াে তা তুমি জানাে। তােমার বাবা আমার কাছে পড়েছে। আমার মাথা তাে প্রায় সাদা।

কত বড়াে? আপনি কি আমার বয়স জানেন?

তুমি সবে কলেজে ঢুকেছ রাখী। এইমাত্র টিউটোরিয়াল থেকে পড়ে ফিরলে। কুড়িও হয়নি তােমার।

আবদার। আমার আসল বয়স বের করার ফন্দি?–বলে রাখী টেবিল। ল্যাম্পটা জ্বেলে দিয়ে তার আলােছায়ার ভেতর দাঁড়াল। এখন সন্ধেবেলা।

আমি জানতে চেয়েছি নাকি? শুনুন না। আপনি কি ফিরােজা বেগম শােনেন ? ফিরােজার গলায় কী যেন আছে। শুনলে অনেক কিছু মনে পড়ে যায়। কেন? ফিরােজা দরকার তােমার ?

ওঁর একটাও ক্যাসেট নেই আমার। যা শুনেছি রেডিও থেকে।

তােমার জন্মদিনে নিয়ে আসব।

আপনার জন্যে একটা ডিম ভেজে আনি।—বলে রাখী উঠে দাঁড়াল। অলক তালুকদার ধুতির কেঁচাটি কোলে তুলে নিয়ে সােফায় ডানদিকে হেলে বসলেন। চল্লিশ বছর আগে তিনি পুরােদস্তুর যুবক ছিলেন। তাঁর বাঁদিকে রাখীর বাবা বসে। পরিতােষ সরকার। তার সামনে টেবিলে বাড়ির নকশা। নকশার চার কোণে চারটি পেপারওয়েট। বাড়ি উঠবে। পরিতােষ নকশার একটা খসড়া দিয়েছেন, কনসালট্যান্ট হিসেবে অলক তালুকদার তাই নিয়ে কথা বলতে এসেছেন। তিনি বড়াে বড়াে বাড়ির চারপাশ কীভাবে সাজানাে হবে—তারই এক্সপার্ট। সে ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ছাত্রজীবনে পরিতােষ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অলকের কাছে পড়েছেন। অলক পাঁচ ছ-বছর হল কলেজ থেকে রিটায়ার হয়ে কনসালটেন্সি করছেন।

রাখী। এই বয়সে কেউ ডিম খায় না। তােমার মা তাে চা দিলেন। উহু। আমি টিউটোরিয়ালে ছিলাম। মা নিশ্চয় শুধু চা দিয়েছেন আপনাকে। তা কি হয়? আমি মাখন দিয়ে ডিম ভেজে এনে দিচ্ছি। দেখবেন—খেতে খুব ভালাে লাগবে।

পরিতােষ তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। যাকে বলে প্রশ্রয়ের হাসি। মুখে বললেন, স্যার! ও যদি কারও কথা শােনে! বলতে বলতে পরিতােষ খসড়া নকশাটি গুটিয়ে নিয়ে ভেতরের ঘরে গেলেন। সফল সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। নতুন বাড়ি। বিরাট লিভিংরুম। সেই আন্দাজে সাজানাে। পরিতােষের একটিই ইস্যু—সে এই রাখী। পরিতােষ নিজেই ওর পড়া দেখে দেন। এইমাত্র রাখী ফিজিক্স টিউটোরিয়াল থেকে পড়ে ফিরেছে। ফিরেই বলেছিল, ফিজিক্স না বড়াে বাজে জিনিস। আমি প্রবলেমগুলাে সব পারব। কিন্তু পড়ে কী লাভ বলুন তাে? কত সুন্দর সুন্দর জিনিস আছে জীবনে—সেসব কখনও পড়াবে না।

লিভিংরুমের গায়েই সাজানাে কিচেন। সেখানে কাজের মেয়েটি দাঁড়িয়ে কী রাঁধছিল। তাকে সরিয়ে রাখী ডিম ভাজতে লাগল। সালােয়ার কামিজ। লম্বা বেণী। বছর ষােলাে সতেরাে হবে। সতেরােই হবে। তাই মনে হল অলক তালুকদারের। মুখখানি ভরাট। বড়াে বড়াে চোখ। শ্যামলা রঙ।

লম্বা একটি ডিমভাজা এনে অলকের সামনে ধরল। গরম। একটু পরে কেটে কেটে খাবেন।। তুমি খাবে না। আমি এখন খাই না। সকালে গান গাইতে গাইতে ভাজি। তারপর খাই। তুমি গান গাও?—বলে অলকের মনে হল—ভারী খেয়ালি তাে মেয়েটা। ওমা! তাও জানেন না। আমি জানব কী করে? তাও তাে ঠিক। একটা গান কর না— এখানে আমি গান করি না। আমার ঘরে আমি গাই।

কোন ঘরটা তােমার? তাও দেখেননি? বাঃ। আমি দেখব কী করে।

ওই কোণের ঘরটা। তাই বলে এখন ওখানে আপনাকে নিয়ে যাব না। আমার ওপর আপনার ধারণা খারাপ হয়ে যাবে। এমন নােংরা হয়ে আছে না—এবার খান। ঠান্ডা হয়ে এসেছে।

 ঠিক এই সময় একতলার সিঁড়ি বেয়ে একটি ছেলে উঠে এল। মাথা ভর্তি কেঁকড়া চুল। চশমার পেছনে বড়াে বড়াে চোখ। ট্রাউজারের ভেতর সাদা হাফশার্ট গোঁজা। কোমরে বেল্ট। ঘিয়ে রঙের প্যান্টের পায়ার নীচে কালাে নর্থ স্টারের ডগা। পিঠে ব্যাগ ভর্তি বই। ডান হাতে যেন কী একটা।

এ কী? এ কী ? সিধে দোতলায়? ছেলেটি থতমত খেয়ে বলল, এটা ফেলে এসেছ ক্লাসে।

বাঁ হাত দিয়ে রাখী ছেলেটির হাত থেকে জিনিসটা তুলে নিয়ে বলল, হা। তাই তাে। আমার মাথার ব্রোচ। ক্লাসে খুলে রেখেছিলাম। ভুলে ফেলে এসেছিলাম—বলতে বলতে ব্রোচটি নিজের বেণীর গােড়ায় বসিয়ে নিয়ে ঘরের মাঝখানটায় ফিরে এল।

অলক তালুকদার দেখলেন, ছেলেটি দোরগােড়ায় তখনও দাঁড়িয়ে। রাখী তার সঙ্গে আর একটিও কথা বলল না। যেন ওখানে দাঁড়িয়ে নেই ছেলেটি। তিনি বেশ অস্বস্তিতেই পড়লেন। নিজে বসে আছেন সােফায়। পরিতােষ নকশাটি ঘরে রাখতে গিয়ে আর ফিরছে না। পরিতােষের বউ অন্য কোনও ঘরে। রাখী লিভিংরুমের বাহার—টেবিল ল্যাম্পটার কাছাকাছি ফিরে আসায় আলােছায়ার ভেতর তাকে আর টিউটোরিয়াল ফেরত স্টুডেন্ট মনে হচ্ছে না। আচমকাই যেন পুরােদস্তুর একটি মেয়ে হয়ে উঠেছে। অথচ অলক তাে জানেন—তিনি নিজে এখন পঁয়ষট্টি।।

লিভিংরুমের মাঝামাঝি দাঁড়ানাে রাখী বলল, একজনের যদি কাউকে ভালাে লাগে—

অলক মনে মনে বললেন, কী সর্বনাশ। পরিতােষ এসে পড়লে কী ভাববে? আমি তাে নিজের থেকে রাখীকে কিছু বলিনি। কেন যে শুধু শুধু মানুষের বয়স বেড়ে যায়। একদম শুধু শুধু।

ধরুন একজনের যদি কাউকে মনে ধরে যায়—

অলক তালুকদার বহু বহুকাল এমন কথাবার্তার মুখােমুখি হননি। এই ধারার কথা ভুলে গেছেন। রাখী নিজের কথার ভেতর জড়িয়ে আছে। যেন বা জলে নিজেরই ছায়ার মুখােমুখি। এতটাই মজে আছে।

কাউকে ভালাে লেগে গেলে সে কথা কি সে বলতে পারে ? পারে না। কিছুতেই পারে না।

দোসরা আগস্ট বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। গরদ নেই অলক তালুকদারের, খুঁজে পেতে ঘিয়ে রঙের একটা তসর পাওয়া গেল। অনেকদিন আগে দরজি পাঞ্জাবি বানাতে গিয়ে সেলাই কলের তেল ঢেলে ফেলেছিল। তার দাগ ওঠেনি।

তাই গায়ে দিয়ে অলক তালুকদার ফিরােজা বেগমের ক্যাসেট হাতে নিয়ে হাজির হলেন। ছেলে বলতে মেয়ে বলতে ওই একাই রাখী। পরিতােষ আর তার বউয়ের জীবনে এই দিনটি দিনের মতাে দিন। ফুল, গান, খাবার, আলাে—কোনও কিছুরই অভাব নেই। রাখী আজ একটা লাল ডুরে পরেছে।

 লিভিংরুম উপচে রাখীর বন্ধু, বন্ধুনী। অলক যেতেই তার হাত থেকে ফিরােজা বেগমের ক্যাসেটটি প্রায় কেড়ে নিল রাখী। তারপর একটা চলন্ত ক্যাসেটকে বের করে দিয়ে ফিরােজাকে প্লেয়ারে ভরে দিল। দিয়ে একঘর মানুষের ভেতর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে ফেলল রাখী।

সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর তিনটি মেয়ে দুটি ছেলে চোখ বুজে ফিরােজার গলার সঙ্গে দুলতে লাগল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। নজরুলের লেখা গান।

সেদিন যদি জানিতাম এই পথেরই বাঁকে তােমার সঙ্গে দেখা হবে হবেই দেখা চোখ বুজে দুলতে থাকা ছেলে তিনটির ভেতর সেই ছেলেটিও আছে। যে সেদিন সন্ধ্যাবেলা রাখীকে তার ফেলে আসা ব্রোচটা দিতে এসেছিল। অলক তালুকদার পরিষ্কার বুঝতে পারছেন—এ ঘরে তিনিই একমাত্র বিনা টিকিটের প্যাসেঞ্জার।

ছখানি গানের শেষে ক্যাসেট ঘুরল। তুমুল হাসি। এই শােন রাখী সেদিন—। এরকম জাতের অনেক রকম কথা। কথা না বলে বরং বলা ভালাে-কাকলী। সেই সঙ্গে বাতাস সুগন্ধীতে ম ম। তার ভেতর ক্যাটারারের লােক চিকেন বাটার রােল—পনির ক্যাপসিকাম—নানান খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। মেয়ােনেজ।

সবাই খাচ্ছে। হাসছে। কারও শাড়ির আঁচলের জরি ঝিকমিক করে উঠল। তাদের হাসিতে আলাে ঠিকরে পড়ছে। গলার স্বর টাটকাদানাদার। অলক দেখলেন, মেয়েরা-ছেলেরা—সবাই এই পৃথিবীর নতুন মানুষ। তার ভেতর পরিতােষ—তার বউ কিছু পুরনাে। তিনি নিজে একেবারেই সাবেক কোচা লুটোনাে ধুতি। তার ওপর বেশি ঝুলের তসর। ছেলেগুলাের কোমরের বেল্টে এনামেল করা বগলসগুলাে ওদের চোখের মতােই চকচকে। নিজের মাথা তিনি দূরে উল্টোদিকের দেওয়াল আয়নায় দেখতে পেলেন। অল্প অল্প কালাের ভেতর এবড়াে-খেবড়াে সাদা। বড়াে রেলইয়ার্ডের শেষ দিকে একসময়কার ওয়াগন মাটিতে গেঁথে গিয়ে কাত হয়ে থাকে।

গান থামতেই রাখী এগিয়ে এসে দুহাতে অলকের দুখানি হাত ধরল। ধরে অলককে টানতে টানতে ঘরের মাঝখানে নিয়ে এসে রাখী নিজেই ফিরােজার ঢঙে গেয়ে উঠল—লম্বা টানে—সেদিন যদি জানিতাম—

সারাটা লিভিংরুমে তাজা গলার হাসিতে ভেসে গেল। অলককে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে। দূরে সােফায় হাসি হাসি মুখে রাখীর মা-বাবা বসে। অলক বুঝতে পারছেন না কী করবেন। গাইবেন? কিন্তু গাইতে তিনি জানেন না। স্রেফ, গুনগুন করতে পারেন। হাসবেন? বেশ কিছুকাল হল হাসলে তাকে খুব একটা ভালাে দেখায় না। কিন্তু গম্ভীর হয়ে তাে থাকা যায় না। হাসি হাসি মুখে তিনি তাকালেন।

রাখী ঘােষণার গলায় বলে উঠল, এবার আমরা ছবি তুলব।

রাখী নিজে অলক তালুকদারের বাঁ পাশে ছবির জন্য পােজ দিয়ে দাঁড়ালে বাকিরা তার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। রাখী বলে উঠল, উঁহু। আমি একা ওঁর সঙ্গে ছবি তুলব। তােমরা সবাই সরে যাও। এই ঊর্মি? তাের ক্যামেরা? অমনি ঊর্মি তার ফ্ল্যাশগান নিয়ে তৈরি। বাকিরা সবাই সরে দাঁড়াল। অলক তালুকদার বুঝতে পারছেন না—কী করবেন? সরে দাঁড়াবেন? নতুনদের বাদ দিয়ে তার মতাে একজন সাবেককে নিয়ে ? এ হয় না। কিংবা, রাখীর আরও গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন ?

উর্মি মেয়েটি ফোকাস ঠিক করে ফেলেছে। এইবার শাটার টিপবে। সেদিন রাখীর ব্রোচ ফিরিয়ে দিতে আসা সেই ছেলেটিকে দেখতে পাচ্ছেন অলক তালুকদার। হাসি হাসি মুখ। কিন্তু চোখ ছােটো হয়ে এসেছে। ছেলেটি যেন তাকে পেনসিলের শিসের ডগায় বসিয়ে মন দিয়ে দেখছে। নিজেকে অলকের এত ছােটো লাগল।

তখনই দপ করে সারা এলাকার আলাে নিভে গেল। পরিতােষের গলা শুনতে পেলেন অলক।

কেউ নড়বে না। অনেক প্লেট, কাচের গ্লাস রয়েছে। স্যার-নড়বেন না। আমি এখুনি ইনভার্টার চালু করে দিচ্ছি।

কিন্তু এতজনের ভিড়ের ভেতর দিয়ে পরিতােষ ইনভার্টারের কাছে পৌছবে কী করে? অলক বুঝতে পারছেন না। অন্ধকার বলে নানারকমের সুগন্ধীতে বাতাস ভার। কয়েক পলকে আলাে না থাকার অন্ধকার চোখে সয়ে গেল। অনেকগুলাে নতুন শরীর। লিভিংরুমটা এখন বনবিভাগের কচি শালবাগান। অলক তালুকদার একটু একটু করে আন্দাজে ডানদিকে সরে যেতে লাগলেন। ইনভার্টারে আলাে ফুটল। মাথার ওপর পাখা ঘুরতে শুরু করল। ফের হাসি। টাটকা ভরাট সব গলা। তীক্ষ। ও কী? আপনি অত দূরে থাকলে ছবি আসবে কী করে? উর্মির এই সরল কথায় সবাই দমকা হাসি হেসে উঠল। সেই ছেলেটিই এগিয়ে এসে অলককে ধরে রাখীর ঠিক গা-ঘেঁষে ফের দাঁড় করিয়ে দিল। দিয়ে বলল, স্মাইল, প্লিজ।

 অলক তালুকদার বুঝতে পারছেন, তিনি এমনিতেই গাইতে পারেন না। তড়বড় করে তাজা তাজা কথাও বলতে পারেন না। আর এখন ইনভার্টারের আলােয় তেমন করে হাসিও আসছে না তার মুখে। রাখীর পাশে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন—একেবারে গরুচোর।

অলক তালুকদার ডানদিকে সরে গিয়ে বলে উঠলেন, না না। তােমরা সবাই মিলে ছবি তােল। আমি কেন?

দূর থেকে পরিতােষ সরকার গলা তুলে বললেন, দাঁড়ান না স্যার। ওরা যখন বলছে।

না না। তা হয় নাকি!

সেই ছেলেটি এগিয়ে এসে ফের অলকের হাত ধরল, খুব হয়। আসুন তো—

চমকে উঠলেন অলক তালুকদার। নতুন বয়সের উদার বীর। এখন হয়তাে এরকমই হয়। তিনি দেখলেন, একটু দূরে রাজরানির পােজে কথাটি না বলে রাখী দাঁড়িয়ে। জন্মদিনে খুব সেজেছে। চুপ করে থেকে সে এখন নিজেই আগাগােড়া একটি আদেশ। অলক রাখীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। উর্মি তার ক্যামেরার শাটার টিপতে রেডি হল।

সেই ছেলেটি বলে উঠল, মুখটা তুলুন। মুখটা কিছুতেই তুলতে পারছেন অলক। তিনি বুঝতে পারছেন, রাখীর ইচ্ছাই ছেলেটির ইচ্ছা। ও তাে ফাকা ক্লাসঘরে কুড়িয়ে পেয়ে ব্রোচটা ফেরত দিতে এসেছিল রাখীকে।

ফ্ল্যাশগান দপ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে হাততালিতে কচি শালবাগান ভরে গেল। রাখীর হাসি হাসি মুখ ছেলেটির মুখে আদেশ হয়ে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে একটা বােতলের ছিপি খুলল শব্দ করে। তারপর অলকের দিকে ঐ ভরে এগিয়ে ধরল, কোল্ড ড্রিঙ্কস?

আমি এখন খাব না। ইনভার্টার আলাে দেয় ব্যাটারি থেকে। উর্মির ক্যামেরার ফ্ল্যাশগানও ব্যাটারি থেকেই আলাে দিল। সেই আলাে এইমাত্র পলকে অলকের মুখে আঁপিয়ে পড়েই ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু তাতে তার চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। তিনি সােফায় গিয়ে বসতেও পারছেন না—আবার লিভিংরুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতেও তাঁর খুব অস্বস্তি লাগছে। তাঁর সামনে সেই ছেলেটি ছিপি খােলা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বােতল হাতে দাঁড়িয়ে। বােতলের ভেতর থেকে একটি লিকলিকে স্ট্রর মাথা বেরিয়ে। কেমন বেখাপ্পা। অনেকটা অলকেরই মতাে। একতলা থেকে বােগেনভেলিয়া লতিয়ে দোতলার জানলায় উঠে এসেছে। তার ফিকে গােলাপি ফুলসুদ্ধ কয়েকটি সবুজ পাতায় একটুখানি লতা রাখী ছিড়ে আনল। খােলা জানলার বাইরে সারা পাড়া অন্ধকার। সেই অন্ধকারের ভেতর থেকেই রাখী যেন ফুলগুলাে তুলে আনল। এসে সবার সামনে অলকের দিকে এগিয়ে ধরল।

সে ফুল নিতে অলক তালুকদারের হাত উঠল না। সে ফের টের পেল—কোল্ড ড্রিঙ্কসের বােতল হাতে ছেলেটি তাকে আবার পেনসিলের সরু শিষের ওপর বসিয়ে মন দিয়ে দেখছে। চোখ ছােটো করে। বােতলে রক্ত হাতে এইভাবে লােকে অপারেশন থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে।

হাত না এগিয়ে আসায় রাখী ফুল সমেত লতানাে বােগেনভেলিয়ার উঁটি অলকের তসরের পাঞ্জাবির বুক পকেটে ভরে দিল। সবার সামনে। লজ্জা লজ্জা চোখে।

ফের হাততালি। হাসি। কথা নয়। কাকলী।

এসব কি রাখীকে এনকোর দিতে? না আমাকে ঠাট্টা করে? এইসব ভাবনায় ডুবে যেতে যেতে আঁতকে উঠলেন অলক তালুকদার।

রাখী এবার বড়াে একখানি ক্যাডবেরির অনেকখানি ভেঙে তাঁর সামনে এগিয়ে ধরেছে। একেবারে খােলাখুলি। তাঁকে এভাবে রাখীর সবার থেকে আলাদা করে নিয়ে ফুল দেওয়া—তারপর ক্যাডবেরি ভেঙে এগিয়ে দেওয়ায় অলক তালুকদার একদম জবুথবু হয়ে পড়লেন। একদম একটি কচি শালবাগানের ভেতর তিনি চোখ তুলে তাকাতে পারছেন না। মাথা নিচু করে হাত এগিয়ে দিলেন।

উঁহু। হাঁ করুন। আমি খাইয়ে দেব।

পয়ষট্টি বছর বয়সে কী না করা যায়! অলক কোনওরকমে মুখ খুললেন। তাতে রাখী ক্যাডবেরি ঠেসে দিল। কোনওরকমে মুখের ভেতরে নিয়ে নিলেন। অলক।

উর্মি আর তার সঙ্গীসাথীরা বলে উঠল, চল রাখী ছাদে যাই। বড় গরম লাগছে—

অলকও দেখলেন ক্লান্ত ইনভার্টার মাথার ওপরের পাখা আর ঘােরাতে পারছে না।

ছাদে ওঠার সিঁড়ি অন্ধকার। রাখীর গলা পাওয়া গেল। পরিষ্কার ঝঙ্কার তােলা গলা। টর্চটা ধর সমীর

ছেলেটির নাম কি তাহলে সমীর? বুঝতে পারলেন না অলক। ফের রাখীর গলা। একটা ফোল্ডিং চেয়ার আনিস কিন্তু

পেছন পেছন টর্চের ফোকাসের ভেতর দিয়ে অলক তালুকদার। অনেকের সঙ্গে। দোতলা থেকে টর্চের আলাে। সেই সঙ্গে একটি ফোল্ডিং চেয়ার টেনে তােলার আওয়াজ। সিড়ির ধাপের সঙ্গে চেয়ারের পায়ার ঘসটানি। তাহলে সেই ছেলেটির এক হাতে টর্চ। আরেক হাতে ফোল্ডিং চেয়ার। কোল্ড ড্রিঙ্কসের বােতলটা রাখল কোথায় ? এ ভারি অন্যায় রাখীর।

বাঃ! খােলা ছাদ ভর্তি ঠান্ডা বাতাস। সারা এলাকা অন্ধকার। দূরে কোথায় জেনারেটর চলছে। মাথার ওপর ঘষা কাচের ভঙ্গিতে আবছা মতাে চাঁদ।

আমি একা চেয়ারে বসব নাকি? ছিঃ।

 দু-হাতে রাখী অলকের দুখানি হাত ধরল। হ্যা। আপনিই শুধু বসবেন। আমরা সবাই আজ দাঁড়িয়ে থাকব।

বলে রাখী তাকে বসিয়ে দিল। এবার অলক দেখলেন, তিনি ভুল ভাবেননি। সেই ছেলেটির হাতেই টর্চ। টর্চের গা চাঁদের আলােয় ঝিকমিক করছে। ওরই নাম তাহলে সমীর।

উহু রাখী। আজ তােমার জন্মদিন। তুমি চেয়ারে বস। বলে অলক উঠে দাঁড়ালেন।

রাখী শুনল না। তাঁকে জোর করে ধরে বসিয়ে দিল। তিনি বসে পড়ে সমীরের মুখ দেখার চেষ্টা করলেন। দেখতে পেলেন না।

পনেরাে ষােলােজনের দলটা নানান ভাগে ভাগ হয়ে ছাদের রেলিংয়ের এক এক জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। বাড়ির গা ধরে সুপুরি গাছ ঠেলে উঠেছে। আলাে আসার নাম নেই। পরিতােষ বা তার বউ—কেউই তাে ছাদে এল না। অলক বুঝতেই পারছেন, সবে তরুণী হয়ে ওঠার স্বাধীনতায়—জন্মদিনের সাজে, সুগন্ধীতে, আনন্দে রাখী ডগমগ হয়ে আছে এখন। ঠিক এই সময় ছাদের আবছা মতাে কোণ থেকে খুব চেনা একটি গান গেয়ে উঠল রাখী। খুবই চেনা অলকের।

তুমি যে আমার ওগাে তুমি যে আমার শুধু একবার বল তুমি যে আমার বেশ থেমে থেমে গাইছে রাখী। থেমে থেমে। জায়গা মতাে গলা নরম করে। যেমন করে কোন সিনেমায় গেয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। সন্ধ্যা মুখােপাধ্যায়ের গলায়।

এসব ছবি হঠাৎ হঠাৎ দুপুরবেলা এসে পড়ে টিভি-তে। সমীর এগিয়ে এসে বলল, আসুন না। ওই কোণে গিয়ে দাঁড়াই।

তুমি গেলে যাও। সমীর বলল, আসুন না। গান শুনবেন রাখীর। এখান থেকেই শুনতে পাচ্ছি। কাছে গিয়ে শুনতে হলে তুমিই শােন গিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *