1 of 2

সওয়াল – অরুণচন্দ্র ভট্টাচার্য

সওয়াল – অরুণচন্দ্র ভট্টাচার্য

পাবলিক প্রসিকিউটার জনার্দন রায় এবার কেসটা সাম আপ করতে থাকেন : মি লর্ড, আসামির কাঠগড়ায় যে-ছোটখাটো মানুষটিকে দেখছেন, তিনি বড় সাধারণ নন। ইনি যখন যেখানে থেকেছেন, সেখানেই একটা অশুভ ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। অবশ্য যথারীতি প্রতিবারই ইনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, অপরাধী হিসেবে ইনি প্রথম স্তরের। কিন্তু অপরাধী যতই উচ্চস্তরের হোক না কেন, কোনও-না-কোনও সময় সে ছোটখাটো ভুলত্রুটি করে ফেলে। সেই ভুলত্রুটির ফাঁক দিয়েই তার অপরাধ ধরা পড়ে যায়। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এবার আমরা অভিযুক্ত অনিলবরণ রায়ের প্রথম জীবন থেকে কার্যকলাপ আলোচনা করে দেখব।

…অনিলবাবু অল্প-বয়েসেই পিতৃমাতৃহারা হন। ওঁকে আশ্রয় দেন পিতৃবন্ধু জগন্নাথ দাস। ইনি যখন বি-এ ক্লাসে পড়তেন—সেসময় হঠাৎ জগন্নাথবাবু রহস্যজনকভাবে মারা যান। ডাক্তারের মতে, উনি হার্টফেল করেন। পুলিশ কিন্তু সন্দেহ করেছিল, তাঁকে স্লো পয়জনিং করা হয়েছে। আমার বিশ্বাস, অভিযুক্ত অনিলবরণ রায়ই নিঃসন্তান আশ্রয়দাতা জগন্নাথ দাসকে স্লো পয়জনিং করে হত্যা করেন। অথচ কোনও অদৃশ্য হাতের ইঙ্গিতে ডেডবডি পোস্টমর্টেম করা হল না।

এমনসময় আসামিপক্ষের উকিল গদাধর পতিতুণ্ডু উঠে দাঁড়ান : মি লর্ড, আমার বন্ধু জনার্দনবাবু কিন্তু লিমিট এক্সিড করে যাচ্ছেন। আদালত কক্ষে অনুমানের স্থান নেই। যে-মৃত্যুর সঙ্গে ওঁর নাম কোনও পক্ষই জড়ায়নি, তার দায়িত্ব ওঁর ওপর চাপিয়ে দিয়ে জনার্দনবাবু কিন্তু ওঁর ওপর খুবই অবিচার করছেন। হি পারহ্যাপস ওয়ান্টস টু ইনফ্লুয়েন্স দ্য জুরি উইথ দিস আননেসেসারি ইনসিনুয়েশন।

জজ ওঁর অবজেকশন অ্যাকসেপ্ট করে বলেন, আপনি অনুমান বাদ দিয়ে ঘটনায় আসুন।

মি লর্ড,—বলে ব্যারিস্টার রায় আবার শুরু করেন,—কিন্তু বাজারে বড়লোক হিসেবে যতই নামডাক থাক, মৃত জগন্নাথ দাসের তেমন কোনও সম্পত্তি ছিল না। কাজেই অনিলবরণ রায়কে অন্য আশ্রয় খুঁজে নিতে হল। এবার উনি আশ্রয় পেলেন ওঁর দূরসম্পর্কের দিদি নীলিমা সেনের কাছে। কিন্তু নীলিমাদেবীর হঠাৎ মস্তিষ্ক-বিকৃতি দেখা দিল। তারপরই উনি রহস্যজনকভাবে হার্টফেল করেন।

ব্যারিস্টার রায় আর কিছু বলার আগেই মিস্টার পতিতুণ্ডু উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, নীলিমাদেবীর মৃত্যুর কারণ ইত্যাদি আমি পুলিশ রিপোর্ট থেকে পড়ে শোনাচ্ছি। নীলিমাদেবী ছিলেন উইক হার্টের মানুষ। উনি যাকে ভালোবাসতেন, তার বিশ্বাসঘাতকতা ওঁর কাছে তীব্রতম বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এতে ওঁর মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং উনি মারা যান।

জনার্দন রায় শ্রাগ করতে-করতে আবার বলতে শুরু করেন, এবারও অভিযুক্ত অনিলবরণ রায়কে সরাসরি জড়ানো যায়নি। তবু এই ঘটনার সময় উনি ওই ফ্যামিলিতে ছিলেন, এটা বোধহয় বলা দরকার।

…তারপর অনিলবাবু টাটা শু কোম্পানির ম্যানেজার চপল চক্রবর্তীর ছেলের প্রাইভেট টিউটর হয়ে এলেন। এখানেও চপলবাবুর স্ত্রী মারা গেলেন। পুলিশ অবশ্য রিপোর্ট দিল, আত্মহত্যার কেস।

মিস্টার পতিতুণ্ডু আবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, মি লর্ড, আমি আর-একবার ইন্টারাপ্ট করছি।—তারপর ব্যারিস্টার রায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার কথা অনুযায়ী কিন্তু চপলবাবুর স্ত্রীর কেসটাকে সুইসাইড বলে মেনে নেওয়ার কথা না। বরং, ওঁকে ঝুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করাই স্বাভাবিক। আপনি-আমি স্বামী হলে কী করতাম, বলুন!

ব্যারিস্টার রায় বলেন, হয়তো পারিবারিক কেলেঙ্কারি—।

পতিতুণ্ডু বলেন, এতে পারিবারিক কেলেঙ্কারি এল কোথায়? তবে চপলবাবু কিছু গোপন করার চেষ্টা অবশ্য করে থাকতে পারেন। কিন্তু, সেটা নিজেকে বাঁচাতে, ওঁকে নয়। এবার আপনি বলুন।—বলতে-বলতে মিস্টার পতিতুণ্ডু আসন গ্রহণ করেন।

ব্যারিস্টার রায় এবার বলতে থাকেন, তারপর উনি এসে উঠলেন ওঁর এক সহকর্মীর ওখানে। ভদ্রলোক পণ্ডিত মানুষ, রাজনীতিতে ঝোঁক। অনিলবাবুর সঙ্গে ওঁর বনল না, অনিলবাবু ওঁর বাসা ছাড়লেন। এরপরই ভদ্রলোক খুন হলেন।

মিস্টার পতিতুণ্ডু বলে ওঠেন, সেটা তো পলিটিক্যাল মার্ডার—প্রমাণ পাওয়া গেছে। অনিলবাবুর সঙ্গে কোনও পলিটিক্যাল পার্টির যোগাযোগ আছে—আমার লার্নেড ফ্রেন্ড কি এমন কথা বলতে পারেন?

ব্যারিস্টার রায় এ-কথার কোনও সরাসরি জবাব না দিয়ে বলতে থাকেন, সবশেষে অভিযুক্ত অনিলবরণ রায় আশ্রয় পেলেন রায়বাহাদুর ক্ষৌণীশ সেনের কাছে। ওঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি হলেন। এত ভালোবাসা, এত বিশ্বাস—কিন্তু এখানেও উনি স্বভূমিকা প্রকাশ করলেন। অবশ্য একেবারে অকারণে না। রায়বাহাদুর অভিযুক্ত শ্রীরায়কে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবেসে ফেলেন। তাই উইল করে ওঁর নিজের সম্পত্তি আসামিকে দিয়ে যান। অথচ রায়বাহাদুরের নিজের ভাই, ভাগ্নে, রয়েছে। শোনা যায়, রায়বাহাদুর এর আগে একবার উইল করে ওঁর সমস্ত সম্পত্তি ভাগ্নে রজত আর ভাই বিকাশকে দেন। অনিলবাবুকে সন্তানতুল্য মনে করার পর উনি সেই উইল নাকচ করে ওঁকেই সব কিছু উইল করে দেন।

…অনিলবাবু এ-কথা জানতে পারেন। আর তখনই ওঁর মনে হয়, উনি হয়তো আবার উইল বদলাতে পারেন। সেই আশঙ্কায় উনি রায়বাহাদুরকে নিষ্ঠুরের মতো হত্যা করেন। এখন আমি বিভিন্ন সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে প্রমাণ করে দেখাচ্ছি যে, অভিযুক্ত মিস্টার রায়ই হত্যাকারী।

…এক নম্বর, প্রসিকিউশন সাক্ষীর কথা থেকে আমরা দেখেছি, উনি রায়বাহাদুরের হত্যার ঠিক পরেই ওঁকে (মিস্টার রায়কে) রায়বাহাদুরের ঘর থেকে বেরুতে দেখেছেন।

…দু-নম্বর, সাক্ষী ফুটপ্রিন্ট এক্সপার্ট মিস্টার চ্যাটার্জি বলেছেন, মৃত রায়বাহাদুরের ঘরে যে-জুতোর ছাপ পাওয়া গেছে, সেই ছাপের সঙ্গে ওঁর পায়ের জুতোর মাপ মিলে গেছে।

…তারপর তিন নম্বর, প্রসিকিউশন উইটনেস মিস্টার কারফরমার বলেছেন, রাত সাড়ে এগারোটার সময় মৃত রায়বাহাদুরের ঘরে অভিযুক্ত অনিলবরণ রায়ের গলা শোনা গেছে। ডাক্তারদের মতে, রায়বাহাদুরকে ঠিক ওই সময় অথবা দু-চারমিনিট আগে-পরে হত্যা করা হয়েছে।

…চতুর্থ নম্বর, সাক্ষী ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট শম্পা সেন বলেছেন, মৃত রায়বাহাদুরের জলের গ্লাসে যে-আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে, সেই আঙুলের ছাপ অভিযুক্ত অনিলবাবুর।

…এখন এইসব সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স থেকে আমরা অনায়াসে এ-সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, অভিযুক্ত শ্রী অনিলবরণ রায়ের বিরুদ্ধে রায়বাহাদুর ক্ষৌণীশ সেনকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।

…এই প্রসঙ্গে আমি অনারেবল জাস্টিসকে বিখ্যাত ক্রিমিনোলজিস্ট মিস্টার পেলের মন্তব্য ভেবে দেখতে বলছি—সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স ক্যান্ট লাই, ডাইরেক্ট এভিডেন্স মে লাই।

জনার্দন রায় শেষ করেন।

এবার অ্যাডভোকেট গদাধর পতিতুণ্ডু আরম্ভ করেন, মি লর্ড, আমার লার্নেড ফ্রেন্ড এতক্ষণ ধরে ধান ভানতে শিবের গীত গাইলেন, এটা আমি প্রমাণ করে দেখাচ্ছি।

…প্রথমত, উনি আমার মক্কেলের অতীত জীবন আলোচনা করতে গিয়ে ওঁর বাস-করা বাড়ির প্রতিটি মৃত্যুর সঙ্গে ওঁকে জড়ালেন। এটা আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ। কিন্তু তাই বলে, ওঁর উদ্দেশ্য কোনওমতেই নির্দোষ না। এইসব আগড়ম-বাগড়ম বলে উনি আপনাদের মন বিষাক্ত করে দিতে চাইলেন।

…তারপর উনি বলেছেন, উনি আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে মৃত ক্ষৌণীশ সেনকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণ করেছেন। আমি ওঁর যুক্তিগুলো একে-একে খণ্ডন করছি। দেখবেন, ওঁর সব যুক্তিই ভিত্তিহীন ও অসার।

…এক নম্বর, উনি বলেছেন, আমার মক্কেলের নামে উইল করার পরেই নাকি রায়বাহাদুর খুন হয়েছেন। ঘটনা কিন্তু তা নয়। এই প্রসঙ্গে আমরা এস্টেট ম্যানেজার রামলোচনবাবুর কথা উল্লেখ করতে পারি।

…রামলোচনবাবু বলেছেন, উইল অবশ্যই রায়বাহাদুর করেছিলেন। কিন্তু ওটা ড্রাফট উইল।

…রামলোচনবাবু আরও বলেছেন, অনিলবাবু এ-উইল করা নিয়ে আপত্তি করেছিলেন।

…আর-একটা কথা, ‘একজিবিট নং ৬’ এই ড্রাফট উইলটাকে কি মি লর্ড ‘উইল’ বলবেন?

…রামলোচনবাবুও উইল বলেননি। কেননা, এতে কোনও সাক্ষীর সিগনেচার নেই। এ-উইলটা ইনভ্যালিড। ক্ষৌণীশবাবু মরার দিন এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল। আমার মক্কেল আইনের ভালো ছাত্র। তিনি এ-কথা ভালো করেই জানেন যে, উইটনেস-এর সিগনেচার না থাকলে উইল ভয়েড হয়ে যায়। ওঁর যদি সম্পত্তি পাওয়ার লোভেই হত্যা করার ইচ্ছে থাকত, তাহলে উইল এক্সিকিউটেড হওয়ার পরই রায়বাহাদুর নিহত হতেন, তার আগে না।

…দু-নম্বর, ফুটপ্রিন্ট এক্সপার্ট বলেছেন, হত্যাকারীর জুতোর ছাপ রায়বাহাদুরের ঘরে পাওয়া গেছে। জুতোর ছাপ, কিন্তু পায়ের ছাপ নয়।

…কেউ যদি অন্য কাউকে কোনও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়াতে চায়, তাহলে, তার জুতো পায়ে দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটানোই তো স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে অন্য কেউ আমার মক্কেলের জুতো পায়ে দিয়ে থাকতে পারে।

…এখন দেখুন, জুতোটা হচ্ছে ‘একজিবিট নং ৮’। ওটার মধ্যে পাওয়া গেছে কিছু তুলোর প্যাড। এখন আমার মক্কেলকে ওই জুতো পরিয়ে দেখা গেছে তুলোর প্যাড থাকলে উনি ওই জুতো পায়ে দিতে পারেন না। তার মানে, ওঁর পায়ের মাপ আর জুতোর মাপ এক। তাহলে এমন কেউ ওই জুতো পায়ে দিয়েছেন, যাঁর পায়ের মাপ জুতোর মাপের চেয়ে ছোট।

…তারপর মিস্টার কারফরমারের কথায় আসি। টেপরেকর্ডারে কেউ যদি কারও গলা ধরে রাখেন, তারপর কেউ যদি সেই টেপরেকর্ডার বাজান—তাহলে কি এটা মনে হবে না, ওই গলা যাঁর—তিনি কথা বলছেন? এখন, এ-বাড়িতে কার টেপরেকর্ডার আছে?

…রামলোচনবাবু একজনের নাম করেছেন। সেই টেপরেকর্ডারে আমার মক্কেলও গলা দিয়েছেন—এটাও আমরা জেনেছি।

…তারপর রায়বাহাদুরের গ্লাসে আমার মক্কেলের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে, তার কারণ গ্লাসটা ওঁরই।

…রায়বাহাদুরের খাস ভৃত্য বনমালী বলেছে, এ-গ্লাস সাহেবের না। আবার যদুনাথ ঠাকুর শনাক্ত করেছে, গ্লাসটা আমার মক্কেলেরই। তাহলে কি আমার মক্কেল নিজের গ্লাসে করে রায়বাহাদুরকে বিষ পৌঁছে দিয়েছে? হত্যাকারী কি এত মূর্খ হয়?

…তাহলে, এটা নিশ্চয়ই অন্য কেউ পৌঁছে দিয়েছে। রায়বাহাদুর আর আমার মক্কেলের গ্লাস দুটো একই ধরনের—হত্যাকারী এর সুযোগ নিয়েছে।

…এখন আসল হত্যাকারী কে—এটা বের করার দায়িত্ব মহামান্য কোর্ট অব জাস্টিসের। এ-ব্যাপারে আমি সামান্য আলোকপাত করছি।

…ড্রাফট উইলটা এক্সিকিউটেড না হলে কার বেশি সুবিধে? নিঃসন্দেহে রায়বাহাদুরের ভাগ্নে রজতবাবুর। কেননা, এই উইল এক্সিকিউটেড হলেই উনি সম্পত্তির মালিকানা হারাবেন। তারপর, ওঁর পায়ের মাপ আমার মক্কেলের পায়ের মাপের চেয়ে সামান্য ছোট। ওঁর টেপরেকর্ডার আছে।

…সবচেয়ে বড় কথা, উনি রায় অ্যান্ড কোং—ড্রাগিস্ট অ্যান্ড কেমিস্টস-এর সঙ্গে যুক্ত। তাই ওঁর পক্ষে পটাসিয়াম সায়ানাইড জোগাড় করা খুবই সহজ। রায়বাহাদুরের হত্যার দু-দিন আগে উনি কিছুটা পটাসিয়াম সায়ানাইড নিয়ে এসেছেন—ওঁর পার্টনার মিস্টার দাস এমন স্টেটমেন্ট দিয়েছেন। কাজেই—।

মিস্টার পতিতুণ্ডু শেষ করেন।

আধঘণ্টা পরে ফোরম্যান অব দ্য জুরির গলা শোনা যায় আমরা ইউন্যানিমাসলি বলছি, দ্য অ্যাকিউজড ইজ নট গিলটি।

সঙ্গে-সঙ্গে জজসাহেবের গলা শোনা যায়, দ্য অ্যাকিউজড ইজ অ্যাকুইটেড।

মাসিক রহস্য পত্রিকা

জানুয়ারি, ১৯৭৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *