সংস্কৃত-বাংলা এবং প্রাকৃত-বাংলার গতিভঙ্গিতে একটা লয়ের তফাত আছে। তার প্রকৃত কারণ প্রাকৃত-বাংলার দেহতত্ত্বটা হসন্তের ছাঁচে, সংস্কৃত বাংলার হলন্তের। অর্থাৎ, উভয়ের ধ্বনিস্বভাবটা পরস্পরের উলটো। প্রাকৃত-বাংলা স্বরবর্ণের মধ্যস্থতা থেকে মুক্ত হয়ে পদে পদে তার ব্যঞ্জনধ্বনিগুলোকে আঁট করে তোলে। সুতরাং তার ছন্দের বুনানি সমতল নয়, তা তরঙ্গিত। সোজা লাইনের সুতো ধরে বিশেষ কোনো প্রাকৃত-বাংলার ছন্দকে মাপলে হয়তো বিশেষ কোনো সংস্কৃত-বাংলার ছন্দের সঙ্গে সে বহরে সমান হতে পারে, কিন্তু সুতোর মাপকে কি আদর্শ বলে ধরা যায়।
মনে করা যাক, রাজমিস্ত্রি দেয়াল বানাচ্ছে; ওলনদণ্ড ঝুলিয়ে দেখা গেল, সেটা হল বারো ফিট। কিন্তু, মোটের উপর দেয়াল খাড়া দাঁড়িয়ে থাকলেও সেটার উপরিতল যদি ঢেউখেলানো হয়, তবে কারুবিচারে সেই তরঙ্গিত ভঙ্গিটাই বিশেষ আখ্যা পেয়ে থাকে। দৃষ্টান্তের সাহায্য নেওয়া যাক।
"বউ কথা কও, বউ কথা কও' যতই গায় সে পাখি, নিজের কথাই কুঞ্জবনের সব কথা দেয় ঢাকি।
খাড়া সুতোর মাপে দাঁড়ায় এই–
১ ২ ১ ২ ১ ২ ১ ২ বউ ক । থা কও । বউ ক । থা কও ১ ২ ১ ২ ১ ২ য তই । গায় সে । পা খি ১ ২ ১ ২ ১ ২ ১ ২ নি জের । ক থাই । কুন্ জ । ব নের ১ ২ ১ ২ ১ ২ সব ক । থা দেয় । ঢা কি
সেই সুতোর মাপে এর সংস্কৃত সংস্করণকে মাপা যাক–
১ ২ ১ ২ ১ ২ ১ ২ ক থা । ক হ । ক থা । ক হ ১ ২ ১ ২ ১ ২ পা খি । য ত । ডা কে, ১ ২ ১ ২ ১ ২ ১ ২ নি জ । ক থা । কা ন । নে র ১ ২ ১ ২ ১ ২ স ব । ক থা । ঢা কে।
সুতোর মাপে সমান। কিন্তু, কান কি সেই মাপে আঙুল গুনে ছন্দের পরিচয় নেয়। ছন্দ যে ভঙ্গি নিয়ে, বস্তুর পরিমাপ নিয়ে নয়।
তোমার সঙ্গে আমার মিলন বাধল কাছেই এসে। তাকিয়ে ছিলেম আসন মেলে, অনেক দূর যে পেরিয়ে এলে, আঙিনাতে বাড়িয়ে চরণ ফিরলে কঠিন হেসে। তীরের হাওয়ায় তরী উধাও পারের নিরুদ্দেশে।
এরই সংস্কৃত রূপান্তর দেওয়া যাক–
তোমা সনে মোর প্রেম বাধে কাছে এসে। চেয়েছিনু আঁখি মেলে, বহুদূর হতে এলে, আঙিনাতে পা বাড়িয়ে ফিরে গেলে হেসে। তীর-বায়ে তরী গেল ওপারের দেশে।
মাপে মিলল, কিন্তু লয়ে মিলেছে কি। সমুদ্র যখন স্থির থাকে আর সমুদ্র যখন ঢেউ খেলিয়ে ওঠে তখন তার দৈর্ঘ্যপ্রস্থ সমান থাকে, কিন্তু তার ভঙ্গির বৈচিত্র্য ঘটে। এই ভঙ্গি নিয়েই ছন্দ। বিধাতা সেই ভঙ্গির দিকে তাকিয়েই মৃদঙ্গ বাজান, বোল বদলিয়ে দেন, তাই মনের মধ্যে ভিন্ন রকমের আঘাত লাগে।
আমি অন্যত্র বলেছি, প্রাকৃত-বাংলার ছন্দে যতিবিভাগ সকল সময় ঠিক কাটা কাটা সমান ভাগে নয়। পাঠক এক জায়গায় মাত্রা হরণ ক’রে আর-এক জায়গায় ওজন রেখে তা পূরণ করে দিলে নালিশ চলে না। এইজন্যে একই কবিতা পাঠক আপন রুচি-অনুসারে কিছু পরিমাণে ভিন্নরকম করে পড়তে পারেন।
রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপরতন আশা করি। ঘাটে ঘাটে ফিরব না আর ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী।
এই কবিতাটি আমি পড়ি “রূপ’ এবং “ডুব’ এবং “অরূপ’ শব্দের ধ্বনিকে দীর্ঘ করে। অর্থাৎ ঐ উকারগুলোর ওজন হয় দুইমাত্রার কিছু বেশি। তখন তারই পূরণস্বরূপে “ডুব দিয়েছি’র পরে যতিকে থামতে দেওয়া যায় না। অপরপক্ষে “ঘাটে ঘাটে’ শব্দে মাত্রাহ্রাসের ত্রুটি পূরণ করবার বরাত দেওয়া যায় “ফিরব না’ শব্দের উপর; নইলে লিখতে হত “সাতঘাটে আর ফিরব না ভাই’।
সংস্কৃত-বাংলা ও প্রাকৃত-বাংলার ছন্দে লয়ের যে ভেদ কানে লাগে তার কারণ সংস্কৃত-বাংলায় অনেক স্থলেই যে-শব্দের মাপ দুইয়ের তার ওজনও দুইয়ের। যেমন–
১ ২ ১ ২ তো মা স নে।
কিন্তু প্রাকৃত-বাংলায় প্রায়ই সে স্থলে মাপ দুইয়ের হলেও ওজন তিনের। যেমন–
১ ২ ১ ২ তো মার সঙ্ গে।
এতে করে তিন-ঘেঁষা ছন্দের প্রকৃতি বদলে যায়। “রূপসাগরে’ গানটির পরিবর্তে লেখা যেতে পারত–
রূপরসে ডুব দিনু অরূপের আশা করি। ঘাটে ঘাটে ফিরিব না বেয়ে মোর ভাঙা তরী॥
যদি কেউ বলেন, দুটোর একই ছন্দ, তাহলে এইটুকু বলে চুপ করব যে, আমার সঙ্গে মতে মিলল না। কেননা, আমি ছন্দ গুনি নে, আমি ছন্দ শুনি।
শ্রাবণ, ১৩৩৯