সংস্কৃতি প্রসঙ্গে
স্বাধীনতার পর আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের গতি-প্রকৃতি আর তার রূপরেখা সম্বন্ধে দেশের বুদ্ধিজীবীদের মনে স্বভাবতই নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। স্বাধীনতার পূর্বে অর্থাৎ ১৯৭১-এর মার্চের আগে সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে আমাদের যা অবস্থা ছিল স্বাধীনতার পর তার তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে কি না, যে পরিবর্তনকে নিঃসন্দেহে চিহ্নিত করা যায় অগ্রগতি বলে–এটি আমাদের সামনে এক বড় জিজ্ঞাসা।
স্বাধীনতার মুক্ত হাওয়া আর পরিবেশ ছাড়া সংস্কৃতি চর্চা কখনো সার্থক হতে পারে না–এ এক সর্ববাদী আর সর্ব-স্বীকৃত সত্য। তাই দেখা যায়, যিনি একদিকে ক্ষমতার জোরে গোপন আদেশ জারি করে সংস্কৃতিসেবীদের স্বাধীনতা হরণ করেছেন, তিনিও অন্যদিকে সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য স্বাধীনতা যে অপরিহার্য তা প্রকাশ্যে অস্বীকার করার সাহস পাচ্ছে না। ফলে অহরহ মাঠে-ময়দানে সর্বত্র সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার কথা তিনিও ঘোষণা করে থাকেন। এখন আমাদের জিজ্ঞাসা–১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশের সংস্কৃতিসেবীদের স্বাধীনতার দিগন্ত আগের তুলনায় সম্প্রসারিত হয়েছে, হয়েছে অধিকতর সংকুচিত? সম্প্রসারিত হয়েছে বলতে পারলে সবচাইতে বেশি খুশি হতাম আমি নিজে। আপনারা জানেন, দীর্ঘকাল ধরে আমি এ স্বাধীনতার সপক্ষে লিখে এসেছি।
আমি একদা লিখেছিলাম–‘পোষা বাঘ যেমন খাঁটি বাঘ নয়, তেমনি পোষা শিল্পীও খাঁটি শিল্পী নয়।’ ব্যাঘ্রত্ব-বঞ্চিত, ব্যাঘ্রত্ব-বিসর্জিত বাঘকে দিয়ে যেমন সার্কাসের খেলা দেখানো যায় শুধু, তেমনি স্বাধীনতা বিসর্জিত বা ক্ষমতার কাছে বিক্রীত পোষা শিল্পীদের দিয়েও স্রেফ শিল্পের এক রকম সার্কাসি ভূমিকা পালনই শুধু সম্ভব। অমন শিল্পীর অপমৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না।
স্বাধীনতা খণ্ডিত বা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এতকাল আমরা স্বাধীনতা অর্থে স্রেফ রাজনৈতিক স্বাধীনতাই বুঝে এসেছি–সে সঙ্গে মাঝে মাঝে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথাও বলেছি বটে, কিন্তু সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার কথা কখনো উচ্চারণ করি নি, তার জন্য কোন আন্দোলনও ছিল না, হয়তো আমরা উপলব্ধি করতেই চাই নি এর গুরুত্ব। একটা জাতির পরিচয় তার সংস্কৃতিতে। কথাটা এভাবেও বলা যায়, একটা জাতিকে জাতি করে তোলে তার সংস্কৃতি–সংস্কৃতিতেই তার পরিচয়, তার যা কিছু স্বাতন্ত্র্য আর বৈশিষ্ট্য। রাজনৈতিক স্বাধীনতা বাইরের খোলস, সে স্বাধীনতা যদি মন-মানস আর প্রাণে সঞ্চারিত না হয় তাহলে তা কখনো হতে পারে না দৃঢ়-মূল, সামগ্রিক আর জাতীয় দেহের সর্বস্তরে সম্প্রসারিত। দেহের চামড়ার মতো বাইরের খোলসেরও যে প্রয়োজন। নেই তা নয়, তবে জীবন আর জীবনের সজীবতা, বিকাশ আর সমৃদ্ধি নির্ভর করে প্রাণের ওপর। মাতৃদুগ্ধের মতো এ প্রাণরসের সঞ্জীবনী সুধা পান করেই জাতি মহৎ জাতি হয়ে ওঠে। এ প্রাণরসের আধার, ভাণ্ডার আর প্রস্রবণ সংস্কৃতিসাধনা। সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত, নাটক, নৃত্য ইত্যাদি কলাবিদ্যারই যৌথ নাম সংস্কৃতি। এ সবের যথাযথ সাধনা আর বিকাশে জাতির সাংস্কৃতিক জীবন হয়ে ওঠে সমৃদ্ধ।
তবে সবকিছুর পেছনে একটা আদি আছে, রয়েছে মূল বা গোড়া–-সংস্কৃতি চর্চারও আদি বা মূল গোড়া শিক্ষা। সে শিক্ষার ক্ষেত্রে এখন যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে তা দেখে আমরা রীতিমতো আতঙ্কিত। এর ফলে শুধু সাহিত্য, শিল্প ও ললিতকলা নয়, জীবনের মূল্যবোধই ধুলায় মিশে যাচ্ছে। সব শিল্পীকেই যথার্থভাবে শিক্ষিত হতে হয়–শিক্ষিত হওয়া মানে দক্ষতা অর্জনের সাথে সাথে মনেপ্রাণে রুচিশীল আর চরিত্রবান হয়ে ওঠা। ইংরেজি ক্যাকটার’ শব্দের অর্থেই আমি এখানে চরিত্র কথাটার ব্যবহার করছি। শিল্পীকে চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হয়। শিল্প-দক্ষতার মতো চরিত্র আর ব্যক্তিত্বও জন্মলব্ধ নয়–সাধনালব্ধ। সাধনায় যাদের অনীহা রয়েছে, তেমন সাধনা-বিমুখদের কোনো রকম শিল্পের আঙিনায় অনধিকার প্রবেশ না করাই বাঞ্ছনীয়।
উদীচীর তরুণ শিল্পীগোষ্ঠী বোধ করি প্রধানত সংগীতেরই সাধনা করে থাকে। সংগীতকে বলা যায় ললিতকলার সর্বোত্তম অঙ্গ। এ কারণে বৈদিক যুগে সংগীতকে বলা হতো ‘দেবজনবিদ্যা’। এর থেকে বোঝা যায় যে, প্রাচীনকালেও ললিতকলা তথা সংগীতকে কতখানি উর্ধ্বে স্থান দেয়া হতো। সংগীত ছিল তখন সর্বসময়ের সাধনার বিদ্যা। এ সাধনাকে যারা গ্রহণ করতেন, তারা সারা জীবনের জন্যই তাকে বরণ করতেন। এখনকার মতো তখন সংগীত স্রেফ বিয়ে কিংবা বেতার-টেলিভিশনে নির্বাচিত কিংবা স্থান পাওয়া পাসপোর্ট হিসেবে গণ্য হতো না। অর্থমোহ সব রকম ললিতকলার পরম শত্রু–এখন বেতার-টেলিভিশন তরুণ শিল্পীদের সামনে একটা মোহজাল যে সৃষ্টি করেছে তাতে সন্দেহ নেই। এর ফলে তরুণ সঙ্গীত শিক্ষার্থীদের অনেকের একমাত্র মোক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে কোনো রকমে বেতার-টেলিভিশনে স্থান পাওয়া, বেতার-টেলিভিশন-শিল্পী হিসাবে পরিচিত হওয়া। এ মোক্ষলাভের পর সাধনা কিংবা অগ্রগতির আর কোনো তাগিদই বোধ করে না। এদেশের শিল্পীরা। এভাবে শিল্পী নিজেই ডেকে আনে নিজের অপমৃত্যু।
আগের দিনেও শিল্পীদের জীবিকার সমস্যা যে ছিল না তা নয়। তখন রাজা বাদশাহ, ভূস্বামী-নবাব-আমিরেরা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এখন সমাজ বিবর্তনের ফলে সে সামন্ত শ্রেণী নিশ্চিহ্ন। তাই শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব এসে পড়েছে এখন রাষ্ট্র আর সমাজের ওপর। সমাজ আর রাষ্ট্র সে দায়িত্ব যথার্থভাবে পালন করছে না বলেই বেতার-টেলিভিশনের দ্বারস্থ হতে শিল্পীরা এক রকম বাধ্য হচ্ছেন অনেক সময় আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে। কারণ, জীবনের জীবিকার চেয়ে বড় দাবি আর নেই। ললিতকলা আজ এক মহাসংকটের সম্মুখীন। যুগ আজ শুধু গতিশীল নয় বরং বলা যায় ধাবমান, তার অপরিহার্য অনুষঙ্গ যন্ত্র আর যান্ত্রিকতা; তার দাবি তাৎক্ষণিকের, সে চায় অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গে সাপ্লাই। অথচ সবরকম ললিতকলা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার, কঠোর শ্রমসাপেক্ষ আর আজীবনের সাধনার বস্তু। নগদ বিদায় যেখানে সেখানে সবকিছু সস্তা আর নিম্নমানের না হয়ে যায় না। শিল্পীর জৈবিক প্রয়োজন আর শিল্পের মান রক্ষা–এ দুয়ের সমস্যা আজ এক কঠিন সমস্যা। এ দুয়ের সমন্বয়ের অভাবে এখন কেউই পুরোপুরি সংগীতজ্ঞ বা সংগীতশিল্পী হতে পারছে না আমাদের দেশে। শিল্পীরা। এখন জীবনের এক ভগ্নাংশই শুধু সংগীতে কিংবা অন্যান্য কলাশিল্পে নিয়োগ করতে পারেন, নিয়োগ করে থাকেন। এ অবস্থায় উন্নতমানের সংগীত আর সংগীতশিল্পী আশা। করা যায় না। এখন আমাদের দেশে সংগীতের যে এক নিদারুণ অধোগতি দেখা যাচ্ছে। তার কারণ বোধকরি এখানেই নিহিত। বলা বাহুল্য, শিল্প জীবনের সবটুকুই দাবি করে। সে দাবি আমাদের শিল্পীরা পূরণ করতে পারছেন না। যতদিন তা করা সম্ভব হবে না ততদিন শিল্প সাধনায় আমাদের আশানুরূপ অগ্রগতিও আশা করা যায় না। এ প্রসঙ্গে আরো একটি মৌল বিষয়ের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। মান যাই হোক আমাদের সংগীতশিল্পীর অভাব নেই, তরুণদের অনেকে সংগীত শিখছেন, সংগীতশিল্পী হতে আগ্রহী। এ সবই আশার লক্ষণ। কিন্তু সংগীত রচয়িতা বা কম্পোজার কই? নতুন নতুন সুরসমৃদ্ধ সংগীতও দেখা যাচ্ছে না, শোনা যাচ্ছে না কোথাও। আর কতকাল আমরা চর্বিতচর্বণ করতে থাকবো? পুরোনোকে ভাঙিয়ে আর কতকাল চলবো আমরা? আমাদের সংগীত-সম্পদ কি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল কিম্বা দ্বিজেন্দ্র-অতুলপ্রসাদে সীমিত হয়ে থাকবে? আমাদের সমস্ত সংগীত-প্রতিম কি নজরুলে এসেই হয়ে থাকবে স্তব্ধ? সংগীতে আমাদের সৃজনশীলতা কি একেবারে বন্ধ্যা হয়ে পড়েছে? সৃজনশীলতার প্রাচুর্য ছাড়া ললিতকলার কোনো শাখাই সামনে এগুতে পারে না। তখন ঘুরে ঘুরে একই বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়াই হবে আমাদের ভাগ্য। এখন তো তাই করছি আমরা। ইদানীং একটি ‘বিচিত্রা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে অন্যটিতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ সেখানেও একই সংগীত কিংবা একই ধরনের নৃত্যের যে পুনরাবৃত্তি ঘটবে, পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকে তা সহজেই অনুমান করে নেয়া যায়। আমাদের পূর্বসূরী বড় কবিরা প্রায় সকলেই প্রচুর সংগীতও রচনা করেছেন। এ যুগের কবিদের মধ্যে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সংগীত রচয়িতা বা কম্পোজারকে দেখা যাচ্ছে না। ফলে দিনে দিনে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়ে। চলেছে আমাদের সংগীত জগতে।
অন্য সবকিছুর মতো সৃজনশীলতা ছাড়া ললিতকলায়ও সমৃদ্ধি আসতে পারে না। এমন কি নৃত্যেও ইতোপূর্বে যারা নাম করেছেন–তারা তা করেছেন সৃজনশীলতার পথেই। মরহুম বুলবুল চৌধুরী ইতিহাস-পুরাণ এমন কি চলতি ঘটনা-প্রবাহ থেকেও উপাদান নিয়ে নতুন নতুন নৃত্য পরিকল্পনা করে নৃত্যশিল্পে প্রচুর বৈচিত্র্য এনে তাকে সৃমদ্ধ করে তুলেছিলেন। তারপরে নৃত্যের নতুন পরিকল্পনায় কেউ হাত দিয়েছেন কি না আমার জানা নেই। উদয়শংকরও যে বিশ্বজোড়া নাম করেছিলেন সেও সৃজনশীলতার পথেই। রামায়ণ কাহিনীকে তিনি নতুন করে সৃজন করেছিলেন তার নৃত্য পরিকল্পনার নতুন আঙ্গিকে। তাতেই চমকে উঠেছিল দর্শক। অপুর সংসার বা কাবুলীওয়ালা এত ভালো চলচ্চিত্র হতে পারলো কী করে? সত্যজিৎ রায়ের প্রতিভা তার একমাত্র কারণ। নয়। বড় কারণ পেছনে ছিল বিভূতিভূষণের সার্থক উপন্যাস পথের পাঁচালি আর রবীন্দ্রনাথের ‘অসামান্য গল্প’। বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য সৃজনশীল সাহিত্যিকের গল্প-কাহিনী নিয়েই যে পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র শিল্প একদিন সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। অন্যান্য দেশের দিকে তাকালেও আমরা এ একই দৃশ্য দেখতে পাবো। আমাদের এখানে যে চলচ্চিত্র শিল্প তেমন সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারছে না। তার একটা বড় কারণ সার্থক গল্প-উপন্যাসের অভাব। বক্স বা অর্থ সাফল্যের দিকে নজর রেখে চলচ্চিত্রের উপযোগী গল্প যে বানানো যায় না তা নয়; কিন্তু তা কখনো শিল্পোত্তীর্ণ হতে পারে না। আমি বলতে চাচ্ছি–সব রকম শিল্পকর্মের পেছনে সৃজনশীলতা অত্যাবশ্যক। এ ছাড়া কোনো রকম শিল্প-সাধনাই বেশি দূর অগ্রসর হতে পারে না। শিল্পীরা কণ্ঠ কি যন্ত্রসঙ্গীতের সাধনা করবেন–কিন্তু তার জন্য নতুন কথা চাই, নতুন সুর আর বক্তব্য চাই। শিল্পীরাও যুগের সন্তান–সবরকম শিল্প ও যুগ-চেতনার বাহন। যুগের চাহিদা আর প্রয়োজন, জিজ্ঞাসা আর সমস্যার প্রতি তাঁরা উদাসীন থাকতে পারেন না। নতুন সৃজনশীল প্রতিভার প্রয়োজন এ কারণেও অপরিহার্য। আমাদের সব কথা আর আবেগ-অনুভূতিকে রবীন্দ্রনাথ কি নজরুল প্রকাশ করে নিঃশেষ করে গেছেন, এমনি দাবি ঐ দুই মহাপ্রতিভার প্রতিও কিছুমাত্র শ্রদ্ধার পরিচায়ক নয়। আমাদের নিজেদের পক্ষে তা হীনম্মন্যতার চরম। এমন ধারণা দেশের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর–এও এক অচলায়তনে আটকে থাকা। সংস্কৃতির এক সহজাত ধর্ম অচলায়তনকে ভাঙা, ডিঙিয়ে যাওয়া, কোথাও আটকে না থাকা; আটকে না পড়া। তাই আমরা নতুন শিল্পী যেমন চাই, তেমনি চাই নতুন সংগীত রচিয়তাও।
রাজনৈতিক অর্থে আমরা এখন পুরোপুরি স্বাধীন। কিন্তু এ স্বাধীনতা তেমন কোন জোয়ারের প্লাবন আনে নি আমাদের ভাবজীবনে, আমাদের কল্পনায়, আমাদের সংস্কৃতি সাধনায়। কোনো জাতির জীবনে যখন জোয়ার আসে তখন তা সব দিকেই আসে। এ জোয়ার যদি ভাবজগতে কোন প্লাবন না ঘটায় তা হলে তা নবজাগরণ তথা রেনেসাস হয়ে দেখা দেয় না। রাজনৈতিক জাগরণের সঙ্গে মানস-জাগরণ তথা মননশীলতার ক্ষেত্রে নব নব দিগন্তের উন্মোচন না ঘটলে তা কখনো ফলপ্রসূ হয় না। এ কারণে আমাদের রাজনৈতিক জাগরণ বারে বারে ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েছে। এবারও বিরাট এক রাজনৈতিক জাগরণ আর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের উত্তরণ ঘটেছে। এ সঙ্গে সাংস্কৃতিক জাগরণ যদি হাতে হাত না মেলায় তা হলে এ স্বাধীনতাও অচিরে অর্থহীন হয়ে পড়বে। মানুষ শুধু রুটি খেয়ে বাঁচে না–কথাটা পুরোনো হলেও সত্য। সংস্কৃতি হচ্ছে মনের খোরাক–এ খোরাকের সাহায্যে মন মানসের বিকাশ আর সম্প্রসারণ ঘটে। সাহিত্য, শিল্প, নৃত্য, অভিনয়, চিত্র আর সংগীত সবই সংস্কৃতির বুনিয়াদ। এসবের প্রভাবে ব্যক্তির শুধু নয়, সমগ্র জাতির মন আর চরিত্র সংহত আর পরিণত হয়, হয়ে ওঠে রুচিশীল আর সুস্থ। রাজনীতি যেখানে মানুষকে করে ক্ষমতা-সচেতন, সংস্কৃতিচর্চা সেখানে মানুষকে করে মনুষ্যত্ব-সচেতন। তাই জাতীয় জীবনের এক অপরিহার্য অঙ্গ সংস্কৃতিচর্চা।
সংস্কৃতিতে গণজীবনের প্রতিফলন শুধু ঘটে না, গণমানসের অভীপ্সা, এষণা, আশা আকাক্ষা আর স্বপ্ন-কল্পনার প্রতিফলনও ঘটে তাতে। অর্থাৎ যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা সংস্কৃতিচর্চা নয়, যা হওয়া উচিত সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমকে হতে হবে তারও ইঙ্গিতবহ আর পথিকৃৎ। তাই বুর্জোয়া সমাজের সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতিচর্চার রয়েছে বিরাট ব্যবধান। সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি শুধু গণমুখী নয়, জীবনমুখীও। অর্থাৎ সর্বস্তরের জীবনের সঙ্গেই তার সম্পর্ক–তাতে ঘটে সব মানুষের জীবনের অভিব্যক্তি, তাতে রূপলাভ করে সর্বস্তরের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্ন-কল্পনা। এ কারণে মানুষের জীবিকার সঙ্গে, তার প্রতিদিনের জীবন-সংগ্রামের সঙ্গেও রয়েছে তার সম্পর্ক। এ সবকে বাদ দিয়ে ওদের জীবনে সংস্কৃতিচর্চা স্রেফ বিলাস। এমনধারা বিলাসের স্থান নেই সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে। যেহেতু আমাদের আদর্শ সমাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্রে উত্তরণ, এখন আমাদের সংস্কৃতিচর্চার পরিধিকেও সেভাবে সম্প্রসারিত আর রূপায়িত করে তুলতে হবে। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীরও লক্ষ্য তাই হোক। জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতির আয়ু প্রায় নিঃশেষিত। জনজীবন আর জনমানস যে সংস্কৃতিতে দক্ষতার সাথে, শিল্পসম্মতরূপে প্রতিফলিত সে সংস্কৃতিতেই ওরা পেয়ে থাকে একই সঙ্গে মনের খোরাক আর প্রচুর অনাবিল আনন্দ। এখন থেকে আমাদের সংস্কৃতিচর্চার লক্ষ্য তাই হোক।
[‘সংস্কৃতি প্রসঙ্গে’ বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সম্মেলেনে প্রদত্ত ভাষণ। প্রথম প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭২-এ। পরে তা শুভবুদ্ধি গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়।]