সংস্কৃতি-কথা

সংস্কৃতি-কথা

ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম। কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা–সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি। সাধারণ লোকেরা ধর্মের মারফতেই তা পেয়ে থাকে। তাই তাদের ধর্ম থেকে বঞ্চিত করা আর কালচার থেকে বঞ্চিত করা এক কথা।

ধর্ম মানে জীবনের নিয়ন্ত্রণ। মার্জিত আলোকপ্রাপ্তরা কালচারের মারফতেই নিজেদের নিয়ন্ত্রিত করে। বাইরের আদেশ নয়, ভেতরের সূক্ষ্মচেতনাই তাদের চালক, তাই তাদের জন্য ধর্মের ততটা দরকার হয় না। বরং তাদের উপর ধর্ম তথা বাইরের নীতি চাপাতে গেলে ক্ষতি হয়। কেননা তাতে তাদের সূক্ষ্ম চেতনাটি নষ্ট হয়ে যায়, আর সূক্ষ্ম চেতনার অপর নাম আত্মা।

সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কালচারের উদ্দেশ্য নয়–উপায়। উদ্দেশ্য, নিজের ভেতরে একটা ঈশ্বর বা আল্লা সৃষ্টি করা। যে তা করতে পেরেছে সেই কালচার্ড অভিধা পেতে পারে, অপরে নয়। বাইরের ধর্মকে যারা গ্রহণ করে তারা অশ্লিাকে জীবনপ্রেরণা রূপে পায় না, ঠোঁটের বুলি রূপে পায়। তাই শর উক্তি : Beware of the man whose God is in the skies আল্লা যার আকাশে তার সম্বন্ধে সাবধান। কেননা, তার দ্বারা যে কোনো অন্যায় ও নিষ্ঠুর কাজ হতে পারে। আল্লাকে সে স্মরণ করে ইহলোকে মৃসে জীবন যাপন করবার জন্য আর পরকালে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্য, অথবা স্বর্গে একটা প্রথম শ্রেণীর সিট রিজার্ভ করার আগ্রহে–অন্য কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে নয়। ইহকালে ও পরকালে সর্বত্রই একটা ইতর লোভ।

অপরদিকে কালচার্ড লোকেরা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে অন্যায় আর নিষ্ঠুরতাকে অন্যায় নিষ্ঠুরতাকে তো বটেই, ন্যায় নিষ্ঠুরতাকেও। মানুষকে ন্যায়সঙ্গতভাবে শাস্তি দিতেও তাদের বুক কাঁপে। নিষ্ঠুর হয়ো না–এই তাদের ভেতরের দেবতার হুকুম আর সে হুকুম তারা তামিল না করে পারে না, কেননা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই একটা ব্যক্তিগত জীবন-দর্শন বা স্বধর্ম সৃষ্টি করা কালচারের উদ্দেশ্য। যেখানে তা নেই সেখানে আর যাই থাক কালচার নেই। কালচার একটা ব্যক্তিগত ধর্ম। ব্যক্তির ভেতরের ‘আমি’কে সুন্দর করে তোলাই তার কাজ।

কালচার সমাজতান্ত্রিক নয়, ব্যক্তিতান্ত্রিক। নিজেকে বাঁচ:ৎ, নিজেকে মহান করো, সুন্দর করো, বিচিত্র করো–এই কালচারের আদেশ। এবং এই আদেশের সফলতার দিকে নজর রেখেই তা সমাজতন্ত্রের সমর্থক। সমাজতন্ত্র তার কাছে লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ। কালচার ব্যক্তিতান্ত্রিক একথা বললে এ বোঝায় না যে, কালচার্ড মানুষ সমাজের ধার ধারে না, সে দলছাড়া, গোত্রছাড়া জীব। তা নয়, সমাজের ধার সে খুবই ধারে। নইলে প্রাণ পাবে কোত্থেকে? ব্যক্তি তো নদী, সমাজ সমুদ্র। সমুদ্রের সঙ্গে যোগ-যুক্ত না হলে সে বাঁচবে কী উপায়ে? সুতরাং নিজের স্বার্থের দিকে নজর রেখেই কালচার্ড মানুষ সমাজের কথা ভাবে, এমনকি দরকার হলে সমাজের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত থাকে। সংস্কৃতিবান মানুষ ব্যক্তিতান্ত্রিক এই অর্থে যে, সমাজ বা অর্থনীতির কথা ভেবে সে নিজের অসৌন্দর্যকে ক্ষমা করে না। এই সমাজে, এই অর্থনীতির অধীনে এরচেয়ে বেশি সুন্দর হওয়া যায় না, এ-কথা বলে নিজেকে কি অপরকে সান্ত্বনা দিতে সে লজ্জাবোধ করে। সে চায় নিজের সৌন্দর্যবোধের সম্পূর্ণ উন্মোচন, নিজের প্রতিভার সম্পূর্ণ বিকাশ। নিজের কাছ থেকে ষোলো আনা আদায় করে না নিতে পারলে সে খুশি হয় না। এইজন্য শুধু সমাজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রকাশ করা তার মনঃপূত নয়। কেননা তাতে জীবনের গভীরতর স্তরের ধ্যানকল্পনার সম্পূর্ণ প্রকাশ ব্যাহত হয়, এবং নিভৃতবাসী অন্তরপুরুষের সাক্ষাৎকার সম্ভব হয় না। জীবনের শ্রেষ্ঠ ও বহুভঙ্গিম প্রকাশ নিজের দিকে তাকিয়েই হয়, সমাজের দিকে তাকিয়ে নয়। অত্যধিক সমাজচেতনা মানুষকে একপেশে ও প্রমাণ-সাইজ করে রাখে–মানুষের চূড়ান্ত বৃদ্ধিতে অন্তরায় ঘটায়। সমাজের আদেশ : দশের মধ্যে এক হও, এগারো হয়ো না। এগারোদের সে সহ্য করে না–যদিও গৌরবের জন্য মাঝে মাঝে মাথায় করে নাচে। কাঁচারের আদেশ : দশের মধ্যে এগারো হও, দশের মধ্যে থেকেই নিজেকে নিজের মতো করে, দ্বাঙ্গসুন্দর করে ফুটিয়ে তোলে। তাতেই হবে তোমার দ্বারা সমাজের শ্রেষ্ঠ সেবা, যদিও সমাজের বিরক্তিভাজন হওয়াই হবে তোমার ভাগ্য।

সমাজ সাধারণভাবে মানুষকে সৃষ্টি করে, মানুষ আবার নিজেকে গড়ে তোলে শিক্ষাদীক্ষা ও সৌন্দর্যসাধনার সহায়তায়। এই-যে নিজেকে বিশেষভাবে গড়ে তোলা এরই নাম কাঁচার। তাই কালচার্ড মানুষ স্বতন্ত্রসত্তা, আলাদা মানুষ। নিজের চিন্তা, নিজের ভাবনা, নিজের কল্পনার বিকাশ না হলে কাস্টার্ড হওয়া যায় না। চিন্তা বা বিবাসের ব্যাপারে সমতা স্থাপন করে মানুষের স্বাতন্ত্র্য লুপ্ত করতে চায় বলে ধর্ম অনেক সময়ে কাঁচারের পরিপন্থী। মতবাদীও এ দোষে দোষী, তাই মবাদী ও ধার্মিকের মধ্যে একটা সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। উভয়েই সরকারি গলায় কথা বলে, ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যের উপরে স্টিমরোলার চালাতে ভালোবাসে।

ধর্মের মতো মতবাদও মনের জগতে লেফট-রাইট করতে শেখায়। ধার্মিকের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে ভয় আর পুরস্কারের লোভ। সংস্কৃতিবান মানুষের জীবনে ওসবের বালাই নেই। তারা সবকিছু করে ভালোবাসার তাগিদে। সত্যকে ভালোবাসা, সৌন্দর্যকে ভালোবাসা, ভালোবাসাকে ভালোবাসা, বিনা লাভের আশায় ভালোবাসা, নিজের ক্ষতি স্বীকার করে ভালোবাসা–এরই নাম সংস্কৃতি। তাই ধার্মিকের পুরস্কারটি যেখানে বহুদূরে থাকে, সংস্কৃতিবান মানুষ সেখানে তার পুরস্কারটি পায় হাতে হাতে, কেননা কাজটি তার ভালোবাসার অভিব্যক্তি বলে তার আনন্দ, আর আনন্দই তার পুরস্কার। সে তার নিজের স্বৰ্গটি নিজেই সৃষ্টি করে নেয়। বাইরের স্বর্গের জন্য তাকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হয় না। তার উক্তি :

তুমি তো গড়েছ শুধু এ মাটির ধরণী তোমার
মিলাইয়া আলোক আঁধার।
শূন্য হাতে সেথা মোরে রেখে
হাসিছ আপনি সেই শূন্যের আড়ালে গুপ্ত থেকে।
 দিয়েছ আমার পরে ভার
তোমার স্বর্গটি রচিবার।

পরম বেদনায়, অসংখ্য দুঃখের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে সে অন্তরে যে গোলাপ ফুটিয়ে তোলে তাই তার স্বর্গ। সেই সৃষ্টি করা এবং তা অপরের সঙ্গে ভাগ করে ভোগ করা, এ-ই কালচার্ড জীবনের উদ্দেশ্য। এই কথা যখন অন্তরে জাগে তখন বাইরেও তার প্রভাব উপলব্ধ হয়। তখন স্বতঃই বলতে ইচ্ছে হয় :

স্বর্গ আমার জন্ম নিল মাটির মায়ের কোলে
বাতাসে সেই খবর ছোট আনন্দ কল্লোলে।

 ধর্ম চায় মানুষকে পাপ থেকে, পতন থেকে রক্ষা করতে, মানুষকে বিকশিত করতে নয়। জীবনের গোলাপ ফোটানোর দিকে তার নজর নেই, চক্ষুটিকে নিষ্কণ্টক রাখাই তার উদ্দেশ্য। অপরপক্ষে কালচারের উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনের বিকাশ, পতন পাপ থেকে রক্ষা নয়। গোলাপের সঙ্গে যদি দু-একটা কাটা এসেই যায় তো আসুক না, তাতে ক্ষতি নেই, দেখতে হবে শুধু ফুল ফুটল কি-না–এই কাচ্চারের অভিমত। মনুষ্যত্বের বিকাশই সবচেয়ে বড় কথা, চলার পথে যে স্থলন-পতন তা থেকে রক্ষা পাওয়াটাই বড় কথা নয়। বরং বড় জীবনের তাগিদে এসে এই স্থলপতনের মর্যাদাও বেড়ে যায় অনেকখানি।

বিকাশকে বড় করে দেখে না বলে ধর্ম সাধারণত ইন্দ্রিয় সাধনার পরিপন্থী। অথচ ইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপ জেলে জীবনসাধনারই অপর নাম কালচার। মন ও আত্মার সঙ্গে যোগযুক্ত করে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বকের জন্মদানই কাঁচারের উদ্দেশ্য। অবশ্য এই ইন্দ্রিয়নিচয়ের সবকটিই যে সমতুল্য তা নয়। ইন্দ্রিয়গুলির মধ্যে চক্ষু আর কানই সেরা। তাই তাদের স্থান সকলের আগে দেওয়া হয়েছে। চোখের মানে ছবির সাধনা, কানের সাধনা গানের। (সাহিত্যের মধ্যে চোখ ও কান উভয়েরই কাজ রয়েছে, কেননা তা ছন্দ ও ছবি উভয়ের মিলন। চোখ ও কানের পরেই নাসিকার স্থান নিশ্বাস গ্রহণের সহায়তায় বাঁচবার সুযোগ দেয় বলে নয়, সুগন্ধ উপলব্দি দ্বারা আত্মাকে প্রফুল্ল রাখবার সুযোগ দেয় বলে। চোখ ও কান ‘আত্মার জিহ্বা, এদের মারফতেই সে তার খাদ্য চয়ন করে। অথচ ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, কোনো কোনো ধর্ম এই চোখ ও কানের সাধনারই পরিপন্থী, সেখানে তার পতনের ফাঁদ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। তাই আমরা চোখ থাকতেও কানা, কান থাকতেও কালা। সুর বা ছবির সূক্ষ্মতা আমাদের প্রাণে দাগ কাটে না। চোখ ও কানের প্রতি বেখেয়াল থাকা যে আত্মার প্রতিই বেখেয়াল থাকা, সংস্কৃতিবানরা তা বুঝলেও ধার্মিকের মাথায় তা সহজে ঢোকে না। তাই তারা শুধু ঈশ্বরের নাম নেয়, ঐশ্বর্য উপলব্ধি করে না। *[*ঈশ্বরকে চাওয়া মানে ঐশ্বর্যকে চাওয়া। রামকৃষ্ণ বলতেন : ঈশ্বর বেটাকে কে মানত যদি তার ঐশ্বর্য না থাকত? এই উক্তির তাৎপর্য উপলব্ধি-যোগ্য। বিভিন্ন ধর্মের আশ্রয়ে তাঁর যে সাধনা তা চিত্ত সমৃদ্ধিরই সাধনা। পথের বৈচিত্রের স্বাদ তিনি পেতে চেয়েছিলেন নইলে পথ যে আসলে এক, তা কি তিনি জানতেন না?

ইন্দ্রিয়ের সাধনা বলে কালচারের কেন্দ্র নারী। নারীর চোখ-মুখ, স্নেহ প্রীতি, শ্রী ও স্ত্রী নিয়েই কালচারের বাহন শিল্প-সাহিত্যের কারবার। ইন্দ্রিয়গ্রামের জাগরণ ও নিয়ন্ত্রণের মূলেও নারী। ‘বোধকলি’ তার প্রসাদেই ফোটে, জীবনের শক্তি, সাহস ও সাধনার প্রেরণা নারী থেকেই। আসে। তাই কবির মুখে শুনতে পাওয়া যায় : “আমি হব না তাপস, হব না, হব না, যদি না পাই তপস্বিনী”। জীবনে তপস্যা করতে চায় বলে নারী-সঙ্গ কালচার্ড মানুষের এত কাম্য। বৈরাগীরা নারীকে পর করে সংস্কৃতিকেও পর করে। তাই তাদের জীবনে বৃদ্ধি নেই, তারা নিঃস্ব নব-নব বুদ্ধি ও প্রীতির স্বাদ থেকে বঞ্চিত। কি মানসিক, কি সাংসারিক সর্বপ্রকার সমৃদ্ধির গোড়ায় নারী। যাত্রাপথে নারীর জয়ধ্বনি পুরুষের জীবন-পথের শ্রেষ্ঠ পাথেয়। যে জাতি নারীকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা রাখতে চায় সে জাতি জীবনে মৃত্যুর আরাধনা করে– ইতিহাসের খাতায় সে মরা-জাতির পৃষ্ঠায় নাম লেখায়। তার জীবনে আত্মনির্যাতন আছে, আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই। আর আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই বলে সংস্কৃতিও নেই। কেননা সংস্কৃতি মানেই আত্মনিয়ন্ত্রণ নিজের আইনে নিজেকে বাধা।

ধর্মের মধ্যে বৈরাগ্যের বীজ উপ্ত রয়েছে। কোনো কোনো ধর্ম নারীকে দেখেছে বিষের নজরে, আর কোনো কোনো ধর্ম ততটা না গেলেও সঙ্গীত-নৃত্যের মারফতে নারীকে ঘিরে যে ইন্দ্রজাল সৃষ্টি তাতে জানিয়েছে ঘোর আপত্তি। সঙ্গীত নৃত্য ইত্যাদি তার কাছে কামেরই আয়োজন, কামের উন্নয়ন নয়। ফলে সূক্ষ্ম উপভোগের সহায় না হয়ে নারী স্কুল ভোগের বস্তু হয়েই রইল, নব নব উন্মেষশালিনী বুদ্ধির প্রেরক ও উচ্চতর জীবনের সহায় হতে আর পারল না। যৌন ব্যাপারে বিশেষ ও কড়া শাসনের ফলে মানুষ তাতেই আকৃষ্ট হয়ে রইল–যৌন সম্ভোগকে অতিক্রম করে যে প্রেম ও আনন্দ তা অনুভব করতে পারলে না বলে। নিষিদ্ধ বস্তু সাধারণত ভীতি ও অতিরিক্ত আকর্ষণ–এই দুই মনোবৃত্তির সংঘর্ষ বাধিয়ে জীবনে বিকৃতি ঘটায়। এখানেও তাই হল যৌন ব্যাপারে মন্দ, এ-কথা না বলে যদি বলা হত : প্রেম ভালো, আনন্দ ভালো, প্রেমের জন্য প্রতীক্ষা ভালো, আনন্দের জন্য প্রতীক্ষা ভালো, তা হলে পৃথিবীর চেহারা হয়তো এত কদর্য হত না। প্রেমের দ্বারা কাম নিয়ন্ত্রিত হত বলে ব্যভিচার ও বিরোধ উভয়ের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষ সহজ ও সুন্দর হতে পারত।

কিন্তু তা না বলে নীতিবিদরা মানুষকে সংযম শিক্ষা করতে বললেন, অথচ কোন্ বড় জিনিসের দিকে তাকিয়ে তা করতে হবে তা বাতলালেন না। কেবল স্বর্গের দিকে ইঙ্গিত করলেন। আর স্বর্গের যে-চিত্রটি আঁকা হল তাতে, এখানে যা ভয়ঙ্কর বলে সাব্যস্ত, সেই ইন্দ্রিয়-বিলাসেরই জয়-জয়কার ঘোষিত হল। তাই ইন্দ্রিয়ভীতি সত্ত্বেও মানুষ ইন্দ্রিয়তার দিকে ঝুঁকলে মুক্তির নিশ্বাস ফেলবার মতো বড়কিছুর আশ্রয় খুঁজে পেলে না। নীতিবিদদের জানা উচিত ছিল, সংযম বলে কোনো স্বাস্থ্যপ্রদায়ী বস্তু নেই, আছে বড় জিনিসের জন্য প্রতীক্ষা আর সেই বড় জিনিস হচ্ছে প্রেম। যে প্রেমে পড়েছে, অথবা প্রেমের মূল্য উপলব্ধি করেছে সে-ই প্রতীক্ষা করতে শিখেছে, অর্থাৎ সেই সহজে সংযমী হতে শিখেছে, অপরের পক্ষে সংযম মানে পীড়ন আর পীড়ন নিষ্ঠুরতার জনয়িত্রী। যে বিনা কারণে নিজেকে দুঃখ দেয়, অপরকে দুঃখ দিতে তার তিলমাত্রও বাধে না। Sadism এর গোড়ায় আত্মপীড়ন, এ-কথা মনে রাখা চাই।

নিষ্ঠুরতা থেকে মুক্তি পাওয়ার অন্যতম উপায় যৌনতৃপ্তি। যৌনতৃপ্তির উপায় কামকে প্রেমের সঙ্গে যুক্ত করা। শুধু কামে তৃপ্তি নেই, তা পরিণামে ক্লান্তি ও অবসাদ নিয়ে আসে। প্রেমের সঙ্গে যুক্ত হয়েই কাম স্নিগ্ধ ও তৃপ্তিকর হয়ে ওঠে। অথচ সমাজ বিয়ের মারফতে কামের দ্বারটি খোলা রাখলেও (বিয়ে মানে : Sex made-easy), প্রেমের দ্বারটি বন্ধ করে দিয়েছে।

বিবাহিত নর-নারীর প্রেমহীন স্কুল যৌনসম্ভোগে সমাজের আপত্তি নেই, কিন্তু অবিবাহিত প্রেমিক-প্রেমিকা যদি একটু হাতে হাত রাখে, অথবা ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকায় তবেই যত আপত্তি। প্রীতিকে বড় করে না-দেখে নীতিকে বড় করে দেখার এই স্কুল পরিণতি। বলা হবে সমাজকে রক্ষা করতে হলে এই স্থূলতার প্রয়োজন আছে, অতএব তা দোষাবহ নয়। উত্তরে বলব : হ্যাঁ, সমাজের কাজ তো ঐ পর্যন্তই, নিজের কাঠামোটুকু টিকিয়ে রাখাই তার কাজ, তার বেশি কিছু নয়। ব্যক্তির বিকাশের কথা সে যতটুকু ভাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি ভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখার কথা, আর সমাজকে টিকিয়ে রাখা মানে সমাজের মোড়লদের টিকিয়ে রাখা–তাদের স্বার্থকে অক্ষত রাখা। মানুষ গোল্লায় যাক, তবু মোড়লদের জবরদস্তি বজায় থাক, তাই তো সমাজের কাম্য। সমাজ মানুষের বৃদ্ধি চায় না, চায় একটা ছাঁচের মধ্যে ফেলে তাকে কোনোপ্রকারে টিকিয়ে রাখতে–তার চূড়ান্ত বৃদ্ধিতে বাধা দিতে।

তাই ব্যক্তির আত্মপ্রকাশের ভার নিয়েছে কালচার। যৌনব্যভিচারের দ্বারা লোকটি নিজেকে ও সমাজকে গোল্লায় পাঠাচ্ছে কি না সেদিকে তার নজর নেই। শকুনের মতো সে মরা গরুর সন্ধানে থাকে না, বুলবুলের মতো তার দৃষ্টি থাকে গোলাপকুঞ্জের দিকে। লোকটির মনে সৌন্দর্য ও প্রেমের পরিচয় পাওয়া যায় কি না, তার বুকে মানুষ ও মনুষ্যত্বের জন্য সজীব দরদ আছে কি না, নিষ্ঠুরতাকে সে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে কি না, তা-ই সে দেখতে চায়, এবং দেখতে পেলে খুশি হয়ে সাত খুন মাফ করে দেয়। কেননা, সে জানে প্রেম ও সৌন্দর্যের পূজারীদের জীবনে এখানে-সেখানে শুলন-পতন থাকলেও যাকে বলা হয় ব্যভিচার তা কখনো থাকতে পারে না। লোভ ও লালসার হাতে ক্রীড়নক হতে চায় না বলে তার সর্বদা পবিত্র-গঙ্গাধারার মতো কখনো কখনো পঙ্কিলতা বহন করেও অপঙ্কিল। কিন্তু পঙ্কিলতা, অপঙ্কিলতার প্রতি ধার্মিকের দৃষ্টি নেই। তার দৃষ্টি কেবল নীতিরক্ষার দিকে। নীতিরক্ষা হলেই ব্যস, লেফাফাদুরস্তি ও লেবাসপোরস্তিই তার কাছে জীবনের প্রথম ও শেষ কথা। আত্মার দিকে তার নজর নেই, নীতিরক্ষী নির্দয় ও নিষ্প্রাণ মানুষকেও সে শ্রদ্ধা জানায়।

কামকে দমাতে গিয়ে ধর্ম ও ধর্মসৃষ্ট সমাজ প্রেমকেই দমায়। প্রেম মরে যায়, কাম গোপনতার আশ্রয় গ্রহণ করে টিকে থাকে-মুখ নিচু করে চোরের মতো চলে। সমাজ তাতেই খুশি। কেননা, সে ভীরুতাই পছন্দ করে, সাহস নয়। প্রেম অন্যায়কারী বলে নয়, সাহসী বলেই সমাজের যত ক্রোধ তার উপরে গিয়ে পড়ে। প্রেমিকের আচরণে একটা চ্যালেঞ্জ দেখতে পায় বলে সে তাকে সহ্য করতে পারে না। (সমাজ যেন নীরব ভাষায় বলে ডুবে-ডুবে জল খা না– কে তাতে আপত্তি করে? অত দেখিয়ে দেখিয়ে খাচ্ছিস যে, সাহসের বাড় বেড়েছে বুঝি? আচ্ছা দাঁড়া, তোর বড়াই ভাঙছি।) গোপনে পাপ করে চলো কেউ কিছু বলবে না; না জানলে তো নয়ই, জানলেও না। তুমি যে মাথা হেঁট করে চলেছ তাতেই সকলে খুশি, তোমাকে অবনতশিরই তারা দেখতে চায়। প্রেমের শির উন্নত বলেই তার বিপদ-সমাজের যত বজ্রবাণ তার মাথার ওপরেই বর্ষিত হয়।

নীতির ব্যর্থতার-যে এই একটি দিকই তা নয়, অন্য দিকও আছে। একটি ব্যাপারে কেন্দ্রীভূত হওয়ার দরুন জীবনের সর্বত্র তার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে না। যৌনব্যভিচারী যেমন সমাজের চক্ষুশূল, উৎকোচগ্রহণকারী বা ব্লাকমার্কেটিয়ার তেমনটি নয়। অথচ যৌনব্যভিচারের চেয়ে উৎকোচ গ্রহণ আর কালোবাজারি-যে সমাজের পক্ষে কম অকল্যাণকর তা কেউ বলবে না। নীতির কেন্দ্রীভবনজাত এই শোচনীয়তা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে নীতির বিকেন্দ্রীকরণ। যাদের নীতিবোধ একটা নির্জীব সংস্কার মাত্র নয়, সজীব উপলব্ধির ব্যাপার, তারা তা মানতে বাধ্য। য়ুরোপে নীতির বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে বলেই জীবনের সর্বত্র, বিশেষ করে অর্থের ব্যাপারে, তার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। একটি ব্যাপারেই আবদ্ধ হয়ে না থাকায় ঘৃণা সেখানে জীবনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। যৌনব্যভিচারীর চেয়ে উৎকোচগ্রহণকারী সেখানে বেশি বৈ কম ঘৃণার পাত্র নয়। আমাদের এখানে কিন্তু ঠিক তার উটো। আমরা যৌনব্যভিচারীকে দেখলে নাসিকা কুঞ্চিত করি, অথচ উৎকোচগ্রহণকারীকে শ্রেষ্ঠ আসনটি দিতেও দ্বিধা করিনে।

বাইরের নীতির এই-যে অস্বাস্থ্যকর প্রাধান্য, এর প্রতিবাদ রয়েছে হিন্দুপুরাণে। সত্যিকার মনুষ্যত্বের অধিকারী বলে তথাকথিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীরা সেখানে প্রাতঃস্মরণীয় ও প্রাতঃস্মরণীয় বলে গৃহীত। কালচারের গোড়ার কথা যে মূল্যবোধ, তা পুরাণকারদের ছিল। তাই দেখতে পাওয়া যায় নীতিকে বড় করে না-দেখে তারা অন্তরাত্মার মহিমাকেই বড় করে দেখেছেন, আর যেখানেই তা দেখতে পেয়েছেন সেখানেই শ্রদ্ধায় অবনতশির হয়েছেন। মনুষ্যত্ব তথা সজীব দয়া-মায়া স্নেহ প্রীতি ও মহত্ত্বই তাদের পূজ্য। নীতির খোলস ভেদ করে তারা মানুষের মর্মকে দেখতে সক্ষম হয়েছেন। পুরাণকারদের সেই ধারা বয়ে শরৎবাবু সাহিত্য-ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। পূরাণকারদের মতো তিনিও সত্যিকার মনুষ্যত্ব তথা মহত্ত্বের খোঁজে মহত্ত্বই তার কাছে মনুষ্যত্ব আর কিছু নয়–যাত্রা করেন এবং সমাজপরিত্যক্ত তথাকথিত পতিত পতিতাদের মধ্যেই তার সাক্ষাৎ পান, সভ্যভব্য নীতিপরায়ণদের জীবনে নয়। সেখানে তিনি দেখতে পেয়েছেন শুধু মিথ্যার খেলা আর সঙ্কীর্ণতার জয়জয়কার। লেফাফাদুরস্তি ও লেবাসপোরস্তি ঠিকই আছে, নাই কেবল মনুষ্যত্বের প্রতি ঐকান্তিক টান–যার ফলে মানুষ সঙ্কটসঙ্কুল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতেও দ্বিধা করে না।

কিন্তু হিন্দুপুরাণের ধারাবাহী শরৎবাবু সম্বন্ধে যখন হিন্দু অধ্যাপককেই সাবধানবাক্য উচ্চারণ করতে শুনি তখন বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। হিন্দুর ঐতিহ্য-যে নীতির ঐতিহ্য নয়, নীতির চেয়ে বহুগুণে শ্রেয় প্রীতির ঐতিহ্য, মহত্ত্বের ঐতিহ্য হিন্দুঐতিহ্যের ধ্বজাবাহী অধ্যাপক মশাই তা-ই উপলব্ধি করতে পারেন না। যার কথা বলা হল, তিনি আমারও শিক্ষক আর শিক্ষক কি মুরুব্বির সঙ্গে আমি তর্ক করতে পারিনে–ঘাবড়ে যাই, থতমত খেয়ে যাই। নইলে তাঁকে বললুম, শরৎবাবু সম্বন্ধে তো ছেলেদের সাবধান করে দিলেন স্যার, কিন্তু শরৎবাবু যার ধারাবাহী সেই পুরাণ সম্বন্ধে তো কিছু বললেন না–বিষবৃক্ষের আগাটা কাটা হল বটে, কিন্তু গোড়াটা রয়ে গেল যে। উত্তরে তিনি কী বলতেন জানিনে, তবে যা বলতেন তা বোধহয় এইরকম একটা কিছু আন্দাজ করা যায় : হিন্দুর প্রাতঃস্মরণীয় ও প্রাতঃস্মরণীয়াদের জীবনে যা ঘটেছে তা তাদের জীবনেই খাটে, অন্যের জীবনে নয়; একথা হিন্দু জানে, তাকে সে-কথা বুঝিয়ে দেওয়ার দরকার নেই।

জানে বৈকি, নইলে হিন্দুর পতন হবে কী করে? যেদিন থেকে হিন্দু, দেবতাদের জন্য এক জীবন আর নিজের জন্য অন্য জীবন মেনে নিলে সেদিন থেকেই তো তার পতনের সূত্রপাত হল–নীতিধর্মী, অশক্ত, বেদনাবিহীন, দুর্বল জীবন কামনা করার ফলে। জীবনের সমৃদ্ধিকে কামনা না করে কোনোপ্রকারে টিকে থাকাকেই সে বাঞ্ছনীয় মনে করলে। আর সত্যি-সত্যি কোনোপ্রকারেই সে টিকে রইল-museum specimen হয়ে। সেদিন থেকে হিন্দুসমাজে নীতিধর্মী মাঝারির রাজত্ব স্থাপিত হল, এবং অ-নীতিধর্মী মহতেরা অন্তর্ধান করলে। মহতেরা বললে : তোমার নীতি আমি মানিনে।…. জীবন নিয়ে পরীক্ষা করবার অধিকার আমার আছে। আমার ভেতরে যে অমৃত লুকিয়ে আছে তা আমার চাই-ই। আর তা আমাকে আবিষ্কার করে নিতে হবে, তোমার দেওয়া বাধা নীতির অনুসরণ করলে পাওয়া যাবে না। কে তোমাকে শেষ কথা বলার অধিকার দিয়েছে? আমি যে অশেষের পূজারী। ছোট ছোট নীতির বাধনে বেঁধে আমার জীবনকে, আমার আগমনকে ব্যর্থ করে দিও না, আমাকেই আমার উদ্ধারকর্তা হতে দাও, আমার জীবনের নিয়ামক হতে দাও। নীতিধর্মী মাঝারি বললে : চুপ করো, অত সাহস দেখিয়ো না, ঐ পরীক্ষাতে বিলক্ষণ ভয়ের কারণ আছে, ওখানে উন্নতির সম্ভাবনার চেয়ে পতনের সম্ভাবনাই বেশি। সুতরাং সাবধান। উন্নতি না হলে হোড়াই ভাবনা, পতন না হলেই হল। আমার দেওয়া এই নীতির মাদুলি পরিধান করো, পতন থেকে রক্ষা পাবে, আর এই রক্ষা পাওয়াটাই বড় কথা। দেখো না চারিদিকে কেবলই পতনের ফাঁদ। আমার কথা শুনলে তুমি অমৃত পাবে না বটে, কিন্তু বিষ থেকে বেঁচে যাবে। আর তাই তো চাই, অমৃত না-খেলেও বঁচা যায় কিন্তু বিষ খেলে তো বাঁচা যায় না। উত্তরে মুহূর্তকামীরা বললে : তাহলে বিদায়, এক্সপেরিমেন্টের ক্ষুধা আমার রক্তে, তোমার রাজ্যে আমার স্থান নেই। আমি অমৃতাভিসারী, মরণ ভয় আমার নেই। শুধু কোনোপ্রকারে টিকে থাকার সাধনা আমার নয়। মাঝারিরা বললে: ভালোই হল, আপদ গেছে। আমাদের সনাতন শাস্তির রাজ্যে সে অশান্তির হাওয়া বইয়ে দিয়েছিল। কী কেবল অমৃত অমৃত করে! অমৃত কি মানুষের? সে তো দেবতার। দেবতার পাতে হাত দিতে চায় যত অকালকুম্মারা!

দেবতার জন্য প্রেম, দেবতার জন্য মুহূর্ত, দেবতার জন্য সমৃদ্ধি। আমরা শুধু জন্মগ্রহণ করেছি আপিসের বড়বাবুটি হয়ে, বে-থা করে নিশ্চিন্তে ছেলের মাথায় হাতটি রেখে মরে যাওয়ার জন্য। দূরাভিসারী চিত্ত আমাদের নয়, কঠিনের সাধনাকে আমরা ভয় করি। তাই প্রেমকে ভয় করি, মহত্ত্বকে ভয় করি, জীবন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে ভয় করি। মৃত্যুর পরে যার তহবিলে কিছু টাকাপয়সা পাওয়া যায়, সে ব্যক্তিই আমাদের কাছে সার্থক মানুষ, তারই প্রশংসায় আমরা পঞ্চমুখ। আমাদের ছেলেদের তারই চরিত্র অধ্যয়ন ও অনুসরণ করতে বলি। ভুলে যাই যে, অন্তরের দিক দিয়ে যে যতবেশি ছোট, তারি তত বেশি টাকাপয়সা জমাবার সম্ভাবনা। ছোটলোকমির সাধনাই আমাদের কাছে জীবন-সাধনা হয়ে দাঁড়ায়। নীতি এ সাধনার সহায়ক, একটা ধরাবাধা পদ্ধতির অনুসরণ না করলে আর যাই করা যাক টাকাপয়সা করা যায় না। তাই আমরা নীতিধর্মী হয়েছি।

কথায় কথায় হিন্দুর উন্নতি-অবনতির কথা এসে পড়ল। ভালোই হল, কথায় বলে নসিহতের চেয়ে নজির ভালো। আর এ নজিরে বিপদের সম্ভাবনা কম। কারণ, আর যে-কারণেই হোক ধর্মের সমালোচনায় হিন্দু, অন্তত বাঙালি হিন্দু, উদ্দণ্ড হয় না। ধর্ম ব্যাপারে পাশাপাশি বিভিন্ন মতবাদ চলার দরুন সে অনেকখানি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা অর্জন করেছে।

ধার্মিক আর কাঁচাৰ্ড মানুষে আরেকটা লক্ষ্যযোগ্য পার্থক্য এই যে, ধার্মিকের চেয়ে কালচার্ড মানুষের বন্ধন অনেক বেশি। উল্টা কথার মতো শোনালেও, কথাটি সত্য। ধার্মিকের কয়েকটি মোটা বন্ধন, সংস্কৃতিবান মানুষের বন্ধনের অন্ত নেই। অসংখ্য সূক্ষ্মচিন্তার বাঁধনে যে বাধা সেই তো ফ্রি-থিংকার আর ফ্রি-থিংকিং কাল্ডারের দান। যেখানে ফ্রি-থিংকিং নেই। সেখানে কাঁচার নেই।

প্রশ্ন হবে : ধর্ম আর কালচারকে যেভাবে আলাদা করে দেখা হল তাতে মনে হচ্ছে নাকি ধার্মিক কখনো প্রকৃত অর্থে কালচার্ড হতে পারে না? কিন্তু কথাটি কি সত্য? ধার্মিকদের মধ্যেও তো অনেক কালচার্ড লোক দেখতে পাওয়া যায়। উত্তরে বলব : তা বটে, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই টের পাওয়া যাবে, সেখানেও কালচারই কালচার্ড হওয়ার হেতু। অনুভূতি, কল্পনার সাধনা করেছেন বলেই তারা কালচার্ড, অন্য কারণে নয়।

একটা অভিজ্ঞতার সহায়তায় আমি কথাটা পরিষ্কার করবার চেষ্টা করছি। আমি মিলিটারি কন্ট্রাক্টারের খাতায় নাম লেখানোর দরুন পাদরি ওয়াটসন সাহেব যা বলেছিলেন তা এখানে মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন : কবিত্বের প্রবণতাসম্পন্ন মানুষের পক্ষে বস্ট্রাকটার, বিশেষ করে মিলিটারি কন্ট্রাকটার হওয়া অপরাধ, মহাঅপরাধ। নিজের প্রতিভাকে মরতে দেওয়া আর নিজের আত্মাকে মরতে দেওয়া এক কথা। তুমি নিজেকে মরতে দিতে পার, কিন্তু নিজের আত্মাকে মরতে দিতে পার না। যে-পেশা গ্রহণ করলে তোমার সূক্ষ্ম অনুভূতি ও সৌন্দর্যবোধ ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা, তুমি সে পেশা গ্রহণ করেছ শুনে আমি সত্যিই দুঃখিত। আমি চাই তুমি না-খেয়ে মরো তথাপি তোমার সূক্ষ্মানুভূতিকে বাঁচিয়ে রাখো, কেননা সূক্ষ্মানুভূতিরই অপর নাম আত্মা। তুমি বলবে তোমার সামান্য প্রতিভা, আর little genius is a great bondage –সামান্য প্রতিভা, কঠিন বন্ধন। কিন্তু সামান্য হলেও তা মূল্যবান। আর যা মূল্যবান তার যত্ন না নেওয়া মহাপাপ। বুঝলে? কথায় বলে, ভালো লোকদের ভাত নেই। তোমার ভাত না থাক, কিন্তু ভালোও বজায় থাক, এই আমার কামনা।

তখন মার্ক্সের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ হয়নি। তাই কথাটা শুনে খুশি হয়ে ঘরে ফিরে এলাম, কোনো তর্ক না করে। এখনো মাঝে মাঝে আমার সেই বোকামিকে আমি চুমু খাই। কেননা, আমি জানি খুশি হওয়ার জন্যে বোকা হওয়ার প্রয়োজন আছে। বাইবেলের ভাষাটা একটু বদলে দিয়ে বলা যায় : Blessed are the simple hearted for they shall he happy. * [* এর কিছুদিন পরে আমার এক ধার্মিক বন্ধুকে বললাম : দেখুন তো খ্রিস্টান পাদরিরা কী সুন্দর কথা বলেন, আমাদের মৌলবী সাহেবদের তো এমন সুন্দর কথা বলতে শোনা যায় না। উত্তরে বন্ধুটি বললেন : বোকা কোথাকার, ওদের পাদরিদের যে কালচার আছে। আমাদের মৌলবী সাহেবদের তা কোথায়? ব্যস, আমার বোকামির পুরস্কারটি হাতে হাতে পেয়ে গেলাম :কাঁচারই যে সৌন্দর্যের কারণ, অন্যকিছু নয়, তা প্রমাণিত হয়ে গেল।]

এখন এই যে মূল্যবোধ, এই যে সূক্ষ্ম অনুভূতি আর আত্মাকে এক করে দেখার প্রবৃত্তি একি ধর্মের দান, না কাল্ডারের কীর্তি? কই সচরাচর তো ধার্মিকের মুখে এধরনের সুন্দর কথা শুনতে পাওয়া যায় না। তার কাছে তো আল্লার হুকুম আর বেহেশত দোজখই বড় হয়ে ওঠে, সুক্ষ্ম অনুভূতির কথা নয়। সূক্ষ্ম অনুভূতি কালচারের দান। Human value সম্বন্ধে কাঁচারই মানুষকে সচেতন করে। তবে কাশ্চার্ড মানুষ ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করে কেন? উত্তর, আরামের জন্য। একটা বিশ্বাসের আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে সহজে জীবন যাপন করা যায় বলেই তিনি তা করেন। যে ধর্মকে তিনি আশ্রয়রূপে গ্রহণ করেন তাতে তিনি নিজেরই কালচার্ড মনের প্রতিবিম্ব দেখতে পান, এবং দেখতে পেয়ে ঘোষণা করে বেড়ান : দেখো, দেখো এখানে সব আছে, এখানে এসো; কাস্টার্ড মনের উপযোগী ধর্ম যদি কোথাও থেকে থাকে তবে তা এখানে, এখানে, এখানে ব্যাপারটা যে মোটের ওপর তাঁরি মনের প্রতিফলন, বাইরের তেমনি কিছু নয়, তা তিনি টের পান না। প্রেমিক যেমন নিগ্রো মেয়ের ভুরুতেও হেলেনীয় সৌন্দর্য দেখতে পেয়ে মুগ্ধ হয়ে থাকে, এখানেও তেমন একটা ব্যাপার ঘটে। তা তিনি মুগ্ধ হয়ে থাকুন কিন্তু তাঁর ‘সুন্দরী’কে অপরেও সুন্দর বলুক, এমনি একটা গোয়ার্তুমি যেন তাকে পেয়ে না বসে, এই আমাদের প্রার্থনা।

সংস্কৃতি মানে জীবনের values** [**** অনেকে বলেন হায়ার ভ্যালু, কিন্তু হায়ার ভ্যালু বলে কোনো কথা থাকা উচিত নয়। কেননা, ‘ভ্যালু জিনিসটা নিজেই একটা ‘হায়ার’ কিছু সুতরাং হায়ার কথাটা ফাজিল, অতিরিক্ত।] সম্বন্ধে ধারণা। ধর্মের মতো মতবাদ বা আদর্শও তা ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই সে সম্বন্ধে সাবধান হওয়ার দরকার। অতীতে ধর্ম ঈশ্বরকে আচ্ছন্ন করেছিল, বর্তমানে মতবাদ বা আদর্শ মনুষ্যত্বকে আচ্ছন্ন করতে পারে। লোকটা মোটের উপর ভালো কি মন্দ সেদিকে আমাদের নজর নেই, তার গায়ে কোন দলের মার্কা পড়েছে সেদিকেই আমাদের লক্ষ্য। মার্কাটি নিজের দলের হলে তার সাত খুন মাফ, না হলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার দোষ বের করা আমাদের স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। এই মনোবৃত্তি থেকে মুক্তি না পেলে কালচার্ড হওয়া যায় না। মনে রাখা দরকার, ধর্মের সমস্ত দোষ মতবাদের ঘাড়ে এসে চেপেছে। মতবাদী ধার্মিকের মতোই অসহিষ্ণু ও সঙ্কীর্ণ, ধার্মিকের মতোই দলবদ্ধতায় বিশ্বাসী, অধিকন্তু ধার্মিকের চেয়েও নিষ্ঠুর। ধার্মিকের নিষ্ঠুরতার সহায় ছিল ধর্মগ্রন্থের সমর্থন, মতবাদীর সহায় বিজ্ঞান। আমি আমার জন্য নিষ্ঠুর হচ্ছি না, পৃথিবী-উন্নয়নের বিজ্ঞানসম্মত আদর্শের জন্যই নিষ্ঠুর হচ্ছি। অতএব এখানে আমার গৌরব নিহিত, কলঙ্ক নয়। নিষ্ঠুরতাব্যাপারে এই যুক্তিই মতবাদীর আত্মসমর্থনের উপায়। সৌভাগ্যের বিষয় সত্যিকার সংস্কৃতিকামীরা কখনো মতবাদী হতে চায় না, মতবাদকে তারা যমের মতো ভয় করে। কেননা, তাদের কাজ বাইরের থেকে কোনো দর্শন গ্রহণ করা নয়, বহু বেদনায় নিজের ভিতর থেকে একটা জীবনদর্শনের জন্ম দেওয়া, এবং দিন দিন তাকে উন্নতির পথে চালনা করা।

আইডিয়ার গোঁড়ামি থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় নিজের বা নিজের দলের অভ্রান্ততা সম্বন্ধে একটুখানি সন্দেহ রাখা। এই সন্দেহটুকুই মানুষকে সুন্দর করে তোলে, আর সৌন্দর্যই সংস্কৃতির লক্ষ্য। স্কেপটিসিজমের প্রভাব না থাকলে যে সভ্যতা সৃষ্টি হতে পারে না, এতো একরকম অবিসংবাদিত সত্য। মনে রাখা দরকার, সংস্কৃতিবান হওয়ার কোনো ধরাবাধা পথ নেই, বিচিত্র পথ। কার জন্য কোন্ পথটি সার্থক কে বলবে? সেকালে বলা হত যত জীব, তত শিব; একালে বলা যেতে পারে যত সংস্কৃতিবান মানুষ তত সংস্কৃতি-পন্থা। যে-পথটি ধরে মানুষ কালচার্ড হয় তা অলক্ষ্য না হলেও দুর্লক্ষ্য। তা পরে আবিষ্কার করা যায়, আগে নয়। তাই সংস্কৃতিবান মানুষটি একটা অলাদা মানুষ, স্বতন্ত্র সত্তা। তার জীবনের একটি আলাদা স্বাদ, আলাদা ব্যঞ্জনা থাকে। সে মতবাদীর মতো বুলি আওড়ায় না, তার প্রতিকথায় আত্মা স্পন্দিত হয়ে ওঠে। প্রেমের ব্যাপারে, সৌন্দর্যের ব্যাপারে, এমনকি সাধারণত ধর্মীয় কল্যাণের ব্যাপারেও তার আত্মার ঝলকানি দেখতে পাওয়া যায়। নিজের পথটি নিজেই তৈরি করে নেয় বলে সে নিজেই নিজের নবী হয়ে দাঁড়ায়। তাই সে স্বাতন্ত্র্যধর্মী, গোলে হরিবোলের জগতে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কল্যাণের ব্যাপারে সাম্যকে স্বীকার করলেও প্রেমের ব্যাপারে, সৌন্দর্যের ব্যাপারে, চিন্তার ব্যাপারে সে স্বাতন্ত্র্য তথা বৈচিত্রের পক্ষপাতী। সত্যকার সংস্কৃতিকামীরা নিজেদের ছাঁচে ঢালাই করতে চায় না। নকল যিশু, নকল বুদ্ধ, নকল মার্ক্স বা নকল লেনিন হওয়া তাদের মনঃপূত নয়। ক্ষুদ্র হলেও তারা খাঁটি কিছু হতে চায়!

কিন্তু পথের বিভিন্নতা থাকলেও তাদের লক্ষ্যের সাম্য রয়েছে–সকলেই অমৃত তথা আত্মাকে চায়। যিশুখ্রিস্ট যখন বলেন : For what is man profited if he shall gain the whole world, and lose his own soul?–তখন সংস্কৃতিকামীর অন্তরের কথাই বলেন। এই খ্রিস্টবাণীরই ঔপনিষদিক ভাবান্তর হচ্ছে ‘যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাম’–যা দিয়ে আমি অমৃত লাভ করব না তা দিয়ে আমি কী করব? অমৃতকে কামনা, তথা প্রেমকে কামনা, সৌন্দর্যকে কামনা, উচ্চতর জীবনকে কামনা, এই তো সংস্কৃতি। এইজন্য সংস্কৃতিকে একটা আলাদা ধর্ম, উচ্চস্তরের ধর্ম বলা হয়েছে। প্রাণিজীবনের ঊর্ধ্বে যে-জীবন রয়েছে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিয়ে, এবং তার দ্বারা প্রাণিজীবনকে খণ্ডিত করে দিয়ে, তা মানুষের অন্তরে মুক্তির স্বাদ নিয়ে আসে। তাই বলে প্রাণিজীবনের তথা ক্ষুৎপিপাসার মূল্য যে তা দেয় না তা নয়। খুবই দেয়। Man doesnot live by bread alone –এই কথাটার মধ্যেই ক্ষুৎপিপাসার স্বীকৃতি রয়েছে। তবে মর্যাদাভেদ আছে। যা নিয়ে বাঁচা যায়, আর যার জন্য বাঁচতে হয়, তা কখনো এক মর্যাদা পেতে পারে না। তাই সংস্কৃতিকামীদের ইচ্ছা : ক্ষুৎপিপাসার জগৎটি তৈরি করা হোক ক্ষুৎপিপাসার উর্ধ্বে যেজগৎটি রয়েছে তারই পানে লক্ষ্য রেখে। নইলে সংস্কৃতি ব্যাহত হবে। সংস্কৃতিকামীরা আরো কামনা করে : ক্ষুৎপিপাসার জগৎ তথা কল্যাণের জগৎ নির্মাণে লক্ষ্যের চেয়ে উপায়কে যেন কম বড় স্থান দেওয়া না হয়। কেননা, উপায়ই চরিত্রের স্রষ্টা, লক্ষ্য নয়। একবার একরকম চরিত্র সৃষ্টি হয়ে গেলে পরে তার থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন।

হিমালয়ের চুড়ায় চূড়ায় যে ধনধারা আবদ্ধ হয়ে আছে, ভগীরথের মতো সমতলভূমিতে নামিয়ে এনে তাকে সাধারণের ভোগের বস্তু করতে না পারলে জগতের মুক্তি নেই কথা স্বীকার করলেও, এই একটি সুরই সংস্কৃতিকামীদের জীবনে বেজে ওঠে না, সঙ্গে সঙ্গে বিচিত্ৰসুরের সমারোহ দেখা দেয়। একসুরা, একফেঁকা জীবন যে দীন জীবন, তা তারা জানে। বিভিন্ন, এমনকি বিপরীত সুরের চমকে সিমফনি সৃষ্টি করতে না পারলে তারা খুশি হয় না। তাদের জীবনবীণাটি একতারা নয়, বহুতারসমন্বিত। তাই একত্ববাদে তাদের এত আপত্তি। একত্ববাদী তথা মতবাদীরা অনেক সময় সূক্ষ্ম তারগুলিকে আমলই দিতে চায় না, অথচ প্রকৃত সংস্কৃতিকামীদের নজর সেদিকেই। মতবাদীর সবচেয়ে বড় ত্রুটি এই যে, একটি আদর্শের আলোকে সমস্ত কিছু দেখতে চায় বলে সে অবজেকটিভ তথা ময় হতে পারে না। অবজেকটিভ হতে হলে নিজেকে লুকোতে হয়। মতবাদী, নিজেকে, তথা নিজের মতটিকে লুকোতে পারে না বলে বিচিত্র ভাব ও অনুভূতির আগার মানুষের মর্মে গিয়ে পৌঁছতে পারে না। সে কেবল নিজের মতবাদটিকেই খোঁজে, বারে বারে ফিরে ফিরে তার সেই এক কথা। বিভিন্ন ব্যাপারকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে, এমনকি একটি ব্যাপারকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে না জানলে-যে জীবন দরিদ্র থেকে যায় তা সে বোঝে না। আদর্শের গোড়ামির দরুন সে বৈচিত্র্যবোধ তথা জীবনবোধ হারিয়ে বসে। তাই কান পাততে নয়, মুখ খুলতেই সে পটু। অথচ কান পাতাতেই সংস্কৃতি, মুখ খোলাতে নয়। কান পাতার ফলে যখন লোকের মনের বিচিত্র ভাব ও অনুভূতি এসে আপনার অন্তরকে অজ্ঞাতসারে ভরে তোলে, তখনই আপনি অভাবিতের দেখা পান। মুখ খুললে শুধু ‘ভাবিতে’র প্রকাশ। মতবাদী কান পাততে জানে না। বলে অন্তরের দিক দিয়ে মরে যায়, যদিও হইচই করে বলে ভাবে, সে-ই সবচেয়ে বেশি বেঁচে আছে। প্রবলভাবে বাঁচা বাঁচা নয়, মৃত্যু। প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচাই বাঁচা-সংস্কৃতিকামীই এ-সত্য উপলব্ধি করতে পারে। মতবাদ ঝড়ের মতো এসে জীবনের সমস্ত মুকুল ঝরিয়ে দেয়। সংস্কৃতি ঠিক তার উল্টো, দখিন হাওয়ার মতো জীবনের সমস্ত ফুল ফুটিয়ে তোলাই তার কাজ। তখন কত রং, কত বৈচিত্র্য, কত সৌন্দর্য। একসুরা, একরঙা জীবন মতবাদীর সংস্কৃতিকামীর নয়। সংস্কৃতিসাধনা বহুভঙ্গিম জীবনের সাধনা। Let us agree to differ–’ভিন্নরুচিহি লোকঃ–এই উক্তিতে মতবাদীর আস্থা কম। অথচ সংস্কৃতিকামীর কাছে এরচেয়ে শ্রদ্ধেয় বাণী আর নেই।

সাধারণ লোকের কাছে প্রগতি আর সভ্যতার কোনো পার্থক্য নেই। যা সভ্যতা তা-ই প্রগতি, অথবা যা প্রগতি তা-ই সভ্যতা। কিন্তু কাশ্চার্ড লোকেরা তা স্বীকার করে না। উভয়ের সূক্ষ্ম পার্থক্য সম্বন্ধে তারা সচেতন। প্রগতি তাদের কাছে মোটের উপর জ্ঞানের ব্যাপার। কেননা, জ্ঞানের ক্ষেত্রেই পরিবর্তনশীলতা অবধারিত, সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে নয়। তাই জ্ঞান, বিশেষ করে বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানপ্রসূত কল্যাণকেই তারা প্রগতি মনে করে। প্রকৃতিবিজয়লব্ধ সমৃদ্ধির সার্থক বিতরণই তাদের কাছে প্রগতি। কিন্তু সভ্যতা শুধু প্রগতি নয়, আরো কিছু। প্রগতির সঙ্গে সৌন্দর্যের সম্বন্ধ, প্রেমের সম্বন্ধ স্থাপিত না হলে সভ্যতা হয় না। আর সৌন্দর্য ও প্রেমের ব্যাপারটা তথা শিল্পের ব্যাপারটা–কেননা শিল্প, সৌন্দর্য ও প্রেমেরই অভিব্যক্তি–চিরন্তন ব্যাপার, প্রগতির ব্যাপার নয়। এ-সম্বন্ধে গির্ট মারের উক্তিটি উল্লেখযোগ্য : Doubtless there is in every art an element of knowledge or science, and that element is progressive. But there is another element, too, which does not depend on knowledge and which does not progress but has a kind of stationary and eternal value, like the beauty of the dawn, or the love of a mother for her child, or the joy of a young animal in being alive, or the courage of a martyr facing torment. We cannot, for all our progress, get beyond these things; there they stand, like light upon the mountains. The only question is whether we can rise to them. And it is the same with all the greatest births of imagination–চিরন্তনকে স্পর্শ করতে না পারলে সভ্যতা সৃষ্টি করা যায় না। কেননা, সভ্যতা ‘ভ্যালু’র ব্যাপার, আজ ‘নিউভ্যালু’ বলে কোনো চিজ নেই। জীবনে সোনা ফলাতে হলে প্রগতিকে চলতে হবে সভ্যতার দিকে মুখ করে, নইলে তার কাছ থেকে বড়কিছু পাওয়া যাবে না। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, আজকাল প্রগতি কথাটা যত্রতত্র শুনতে পাওয়া গেলেও সভ্যতা কথাটা একরকম নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। লোকেরা কেবল প্রগতি-প্রগতি করে, সভ্যতার নামটিও কেউ মুখে আনে না।

অনেকে সংস্কারমুক্তিকেই সংস্কৃতি মনে করে, উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পায় না। কিন্তু তা সত্য নয়। সংস্কারমুক্তি সংস্কৃতির একটি শর্ত মাত্র। তাও অনিবার্য শর্ত নয়। অনিবার্য শর্ত হচ্ছে মূল্যবোধ। সংস্কারমুক্তি ছাড়াও সংস্কৃতি হতে পারে, কিন্তু মূল্যবোধ ছাড়া সংস্কৃতি অসম্ভব। মূল্যবোধহীন সংস্কারমুক্তির চেয়ে কুসংস্কারও ভালো। শিণোদর-পরায়ণতার মতো মন্দ সংস্কার আর কী হতে পারে? অর্থগৃধুতাও তাই–কিন্তু এসব মূল্যবোধহীন সংস্কারমুক্তিরই ফল। তাই শুধু সংস্কারমুক্তির ওপরে আস্থা স্থাপন করে থাকা যায় না। আরো কিছু দরকার। কামের চেয়ে প্রেম বড়, ভোগের চেয়ে উপভোগ এ-সংস্কার না জন্মালে সংস্কৃতি হয় না। সূক্ষ্ম জীবনের প্রতি টান সংস্কৃতির জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু মূল্যবোধহীন সংস্কারমুক্তির টান সে-দিকে নয়, তা স্কুল জীবনেরই ভক্ত।

সংক্ষেপে সুন্দর করে, কবিতার মতো করে বলতে গেলে সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহভাবে বাঁচা; প্রকৃতি-সংসার ও মানব-সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে দিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা; কাব্যপাঠের মারফতে, ফুলের ফোঁটায়, নদীর ধাওয়ায়, চাঁদের চাওয়ায় বাঁচা; আকাশের নীলিমায়, তৃণগুল্মের শ্যামলিমায় বাঁচা, বিরহীর নয়নজলে, মহতের জীবনদানে বাঁচা; গল্পকাহিনীর মারফতে, নরনারীর বিচিত্র সুখ-দুঃখে বাঁচা; ভ্রমণকাহিনীর মারফতে, বিচিত্র দেশ ও বিচিত্র জাতির অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে বাঁচা; ইতিহাসের মারফতে মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশে বাঁচা; জীবনকাহিনীর মারফতে দুঃখীজনের দুঃখ নিবারণের অঙ্গীকারে বাঁচা। বাঁচা, বাঁচা, বঁচা। প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচা। বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।

সংস্কৃতিবান মানুষ সমাজের কল্যাণ কামনা করে এবং সেজন্য প্রাণপাত করতেও প্রস্তুত থাকে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি চায় সে নিজের জীবনে সোনা ফলাতে। কেননা, সেখানে তার অবাধ অধিকার। তাই জগৎকে মেরামত করার চেয়ে নিজেকে শোধরানোর দিকেই তার অধিক কোঁক। তার সমুখ দিয়ে কে যেন সর্বদা গান গেয়ে যায় :

মন তুমি কৃষিকাজ জানো না,
এমন মানব-জনম রইল পতিত
আবাদ করলে ফলত সোনা।

জীবনে সোনা ফলাতে হলে যে-জিনিসটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় তা হচ্ছে সঙ্কীর্ণ ব্যক্তিত্ব মুক্ত হয়ে বিচিত্র জীবনধারণার সঙ্গে যোগযুক্ত হওয়া–নিজেকে বিশ্বের পানে মেলে ধরা, সঙ্কুচিত ও সঙ্কীর্ণ করে রাখা নয়। কবির যে প্রার্থনা–যুক্ত করহে সবার সঙ্গে, মুক্ত করহে বন্ধ–তাতে সংস্কৃতিকামনাই ব্যক্ত হয়েছে। সকলের সঙ্গে যুক্ত হওয়াতে মুক্তি সকলের থেকে আলাদা হয়ে, সঙ্কুচিত হয়ে, দূর্যের মতো আত্মগত হয়ে থাকা মুক্তি নয়–বন্ধন। জীবনে জীবন যোগ করা, নহিলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা, এই উক্তিটিও একই কামনার অভিব্যক্তি। পার্থক্য কেবল, ওখানে বাধনটা চাওয়া হয়েছে নিজের দিকে তাকিয়ে এবং নিজের জন্য, এখানে সকলের দিকে তাকিয়ে এবং সকলের জন্য। বাধন, বঁধন, বাঁধন। সকলের সঙ্গে বাঁধন পরাতেই সমৃদ্ধি, ‘ধরণীর পরে শিথিল বাঁধন ঝলমল প্রাণ করিস যাপন’–শিথিল বাঁধন না হলে ‘ঝলমল প্রাণ লাভ করা যায় না। আর ঝলমল প্রাণ লাভ করাই সংস্কৃতির উদ্দেশ্য।

শিথিল বাধনের অন্তরায় বলেই সংস্কৃতিকামীরা উগ্র জাতীয়তাকে এত ভয় করে। সব দেশে তাদের যে-ঘরটি রয়েছে, সেই ঘরটি তারা খুঁজে নিতে চায়। সকল দেশের, সকল জাতির, সকল কালের লোকই তাদের আত্মীয়। তারা বিশ্বনাগরিক অনাত্মীয়তা, মানুষকে আপন না-জানা, ধর্ম বা মতবাদের বিভিন্নতার জন্য মানুষকে পর ভাবা সংস্কৃতির মনঃপূত নয়। কেননা, সংস্কৃতি মানেই অহমিকামুক্তি। অহমিকার গুমটভরা অন্ধকারে সংস্কৃতিকামীর বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। অহঙ্কার পতনের মূল কি না তা সে বলতে পারে না, কিন্তু তা যে আনন্দের অন্তরায় সে সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ সচেতন। অহঙ্কারী হওয়ার মানে নিজের চারদিকে বেড়া দিয়ে মানুষকে পর করা, আর মানুষকে পর করা মানে আনন্দকে পর করা। মানুষে-মানুষে মিলনেই আনন্দের জন্ম, বিরোধে নয়। বিরোধ আনন্দের শত্রু।

সংস্কৃতিসাধনা মানে ripe হওয়ার সাধনা। সেজন্য জ্ঞানের প্রয়োজন আছে, বিজ্ঞানের প্রয়োজন আছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রেমের। সংস্কৃতিবান হওয়ার মানে প্রেমবান হওয়া। প্রেমের তাগিদে বিচিত্র জীবনধারায় যে স্নাত হয়নি সে তো অসংস্কৃত। তার গায়ে প্রাকৃত জীবনের কটুগন্ধ লেগে রয়েছে, তা অসহ্য!’সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীরে স্নাত না হলে সংস্কৃতিবান হওয়া যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *