প্রথম পর্ব : সাহিত্য 
দ্বিতীয় পর্ব : সংস্কৃতি 
তৃতীয় পর্ব : সমাজ, শিক্ষা ও রাষ্ট্র 

সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তা 

সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তা 

আমরা যারা বহুনিন্দিত পরাধীনতার যুগে লেখার কিছুটা বদূ-অভ্যাস করে বসেছিলাম, তাদেরই হয়েছে সব চেয়ে কাহিল অবস্থা এখন। সে পুরোনো বন্দু-অভ্যাসটা আজো আমরা ছাড়তে পারি নি বলে দেশ-দুনিয়া, রাষ্ট্র-সংস্কৃতি ইত্যাদি যা কিছু মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত সে সম্বন্ধে লিখতে চাই। লেখার জন্য আমাদের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে–যা এ যুগের লেখক মাত্রেরই এক বিবেকী দায়িত্ব বলে আমার বিশ্বাস। সে দায়িত্ব আমরা। এখন আংশিকভাবেও পালন করতে পারছি না–এ আমাদের এক বড় দুঃখ। অধিকন্তু আমরা এ দায়িত্ব পালনের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত থাকলেও প্রেস আর পত্রিকা সে ঝুঁকি নিতে মোটেও রাজি নয়। ঝুঁকি নেওয়া তাদের পক্ষে হয়তো সম্ভব হচ্ছে না, দেশের কোন কোনো প্রেস আর পত্রিকার ভাগ্য দেখে তারা যদি আতঙ্কিত হয়ে থাকেন তার জন্য তাদের দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু লেখা তথা সাহিত্য-শিল্পের জন্য প্রকাশের মাধ্যম প্রাথমিক শর্ত। প্রকাশ ছাড়া সাহিত্য আর সাহিত্যিক জন্মাতে পারে না, পারে না বাঁচতে, বিকাশ তো দূরের কথা। আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার এখন যে জীবন্ত অবস্থা তার জন্য চারদিকের এ পরিবেশই অনেকখানি দায়ী। সমাজের দিকে তাকালে এখন। কী দেখতে পাই আমরা? দেখতে পাই একদিকে লেখা লিখলে বা কি কথা বললে সরকারের বিরাগভাজন হবো না আর পত্রিকা সম্পাদকরাও ছাপতে সাহস পাবেন–এ হিসেব করে আর এ কথা স্মরণে রেখে ভেবে ভেবে লিখতে গেলে ছাপার উপযোগী লেখা এক রকম দাঁড় করানো যায় বটে, কিন্তু তা সাহিত্য হয় না। সাহিত্য মুক্ত আবহাওয়া আর স্বাধীন পরিবেশের ফসল। সাহিত্য আর শিল্পের এ এক মৌল দাবি। 

এখন যে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় আমরা বাস করছি তা রাষ্ট্রের জন্যও কিছুমাত্র লাভজনক ও কল্যাণকর নয়। অ্যামিয়েল তার জানালে মন্তব্য করেছেন : A state founded upon interest alone and cemented by fear is an ignoble and unsafe construction (p 178), অর্থাৎ স্বার্থ আর আতঙ্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রসৌধের ভিত অত্যন্ত নড়বড়ে হয়ে থাকে। সমাজের সর্বস্তরে উঁচু থেকে নিচু পর্যন্ত স্বার্থপরতা কী ভাবে তার অটুট জাল বিস্তার করেছে তা বোধ করি বলার প্রয়োজন রাখে না। যারা এখন যে কোনো রকমে ক্ষমতার বসে আছেন, আগে তাঁদের আর তাদের আত্মীয়দের কতটুকু সম্পত্তি ছিল আর এখন তা কতখানি হয়েছে। তার একটা খতিয়ান পাওয়া গেলে এ স্বার্থপরতার কিছুটা স্বরূপ হয়তো জানা যেতো। কিন্তু তা জানার উপায় নেই। 

প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম তখন এ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ নামে একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল আর তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় আর আশে-পাশের স্কুল-কলেজের শিক্ষক আর অধ্যাপকবৃন্দ। আজ কি তেমন কথা ভাবা যায়? নবতর চিন্তার ক্ষেত্রে, যে-চিন্তার সঙ্গে ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র আর সংস্কৃতিচর্চার সম্পর্ক রয়েছে, তাতে অংশগ্রহণ কিংবা নেতৃত্বদানের কথা বললে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাও আঁতকে ওঠেন, ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখেন একবার। তারা জানেন, দেওয়ালের শুধু নয় হাওয়ারও কান গজিয়েছে। এখন, অথচ স্বাধীন চিন্তার প্রকাশ ছাড়া কোনো সমাজ, কোনো রাষ্ট্র এবং কোনো সভ্যতাই সামনের দিকে এগুতে পারে না। গ্রিক, রোমান ও আবার সভ্যতার যুগে যাদের স্বাধীন নাগরিক’বলা হতো, এ অবস্থা দীর্ঘকাল চললে, তেমন স্বাধীন নাগরিক এ দেশে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। গ্রিক কবি ইউরিপিডিস গোলাম বা দাসের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে : ‘A slave is he who cannot speak his thought’. আমার আশঙ্কা–দোতলা কিংবা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাড়ি, গাড়ি বা টেলিভিশন ইত্যাদি যাবতীয় আধুনিক সম্পদের মালিক হয়েও দিন দিন মনের দিক দিয়ে আমরাও হয়তো একটা দাস জাতিতে পরিণত হতে চলেছি। বলা বাহুল্য, স্বাধীন মনই সব সভ্যতার বাহন আর সব সভ্যতার নির্মাতা। সে স্বাধীন মনের অধিকার হারালে মনুষ্যত্ব বলতে আমাদের আর কিছু থাকবে না–তখন সভ্যতার মানে দাঁড়াবে খোশামোদ তোষামোদে দক্ষতা আর ইজ্জত-সম্মানের মাপকাঠি হবে তোরণ, ইলেকট্রিক বালব আর ডিনার পার্টির সংখ্যা। অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে বলছি, আমরা প্রায় এ অবস্থায় পৌঁছে গেছি। সব রকম সুরুচি, মূল্যবোধ আর নৈতিক চেতনা যা সভ্যতার বুনিয়াদ উপকরণ তা আজ দেশ-ছাড়া! অ্যামিয়েল অন্যত্র বলেছেন : ‘Society rests upon conscience not upon science. Civilization is first and foremost a moral thing’ (p 177).

বিবেকের চর্চা ও অনুশীলন কি সমাজে কোথাও আছে এখন? তার কোন মূল্য কি সমাজ ও রাষ্ট্র দিয়ে থাকে? সমাজে বিবেকী মানুষের আজ আর কোন স্থান নেই, সরকার তেমন মানুষকে মনে করে শত্রু,শুধু নিজের নয়, মনে করে দেশেরও। সরকার চায় Yes-man বা হাঁ-হুজুর অথবা ভয়ে কাবু হয়ে থাকা নিবর্যি মানুষ। বিবেকের সাথে আইনের শাসন চালাতে গিয়ে কোনো কোনো সুদক্ষ বিচারপতিকে যে সরকারের বিরাগভাজন হতে হয়েছে সে খবর দেশের কারো অজানা নয়। 

গ্রিসকে বলা হয় আধুনিক সভ্যতার সূতিকাগৃহ–সে গ্রিসের অধিবাসীদের সম্বন্ধে হেরোডোটাসের মন্তব্য হচ্ছে : They obey only the law. শুধু গ্রিসের নয় সব সভ্যতারই বুনিয়াদ আইন আর আইনের শাসন–আইনের প্রতি শাসক আর শাসিতের সার্বিক ও বিনা শর্তে আনুগত্য। এ-সম্বন্ধে অন্য একটা প্রবন্ধে আমি কিছুটা আলোচনা করেছি–এখানে পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। শুনেছি মুসলিম শাসনের আমলে বাদশাহের পার্শ্বেই থাকতো কাজীউল কুজাতের আসন। আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রকেও বলা হয় ইসলামি বা মুসলিম রাষ্ট্র। অথচ মুসলিম রাষ্ট্রের এ সব সুস্থ ঐতিহ্য এখানে অনুসৃত হয় না। আইন যে আজ আমাদের দেশে কতখানি বিপর্যয়ের সম্মুখীন তার বহু দৃষ্টান্তই আমি উল্লেখ করতে পারতাম। কিন্তু ওপরে যে আতঙ্কের কথা বলেছি, অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করছি আমিও সে আতঙ্ক-মুক্ত হতে পারি নি। লেখকের স্বাধীনতা 

যে আজ কতখানি সংকুচিত হয়ে পড়েছে এ থেকে তা অনুমেয়। আমরা লেখকরাও আজ মনের দিক দিয়ে বন্দি। সেদিন ঢাকার মনস্তত্ত্ব সম্মেলনে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী জিজ্ঞাসা করেছেন : দেশের তরুণরা এখন এমন সিনিক হয়ে পড়েছে কেন? সমাজের সার্বিক চেহারার দিকে তাকালে তিনি সহজেই তার এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতেন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে, শিক্ষায়তন আর বিচারালয়গুলিতে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে মূল্যবোধের যে চরম অনবতি ও অবক্ষয় তরুণরা, বিশেষ করে সচেতন ছাত্রসমাজ, প্রতিনিয়ত দেখছে তাতে সিনিক না হয়ে উপায় কী? এসব কি ওদের তরুণ মনকে প্রভাবিত করছে না? যখন সমাজে কোথাও সততা, আন্তরিকতা ও মহৎ মনুষ্যত্বের ক্ষীণ রশ্মিরেখাও দেখা যাচ্ছে না তখন তরুণ সমাজ কী দেখে প্রেরণা পাবে ও উৎসাহবোধ করবে? কী করে হয়ে উঠবে তারা আশাবাদী? আমাদের জাতীয় জীবনে এ এক চরম দুর্দিন। স্বাধীনতার আগে বা পরে মননশীলতা আর সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে এমন দুর্দিন আমি আর কখনও দেখি নি। 

কোনো দেশের কোনো সংস্কৃতিই স্বয়ম্ভ নয় বা আসমান থেকেও ঝুপ করে ঝরে পড়ে না। মাটিই তার জন্মভূমি। সংস্কৃতিও ভূগোলের রেখায় হয়ে ওঠে রেখায়িত। ক্রমাগত অনুশীলন আর চর্চার দ্বারাই ঘটে তার বিকাশ। তার জন্য অনুকূল ক্ষেত্র আর পরিবেশ অত্যাবশ্যক। সে ক্ষেত্র দেশে কীভাবে সংকুচিত হয়ে এসেছে আর প্রতিনিয়ত তার ওপর কীভাবে হামলা চলছে তার তিক্ত অভিজ্ঞতা এদেশের সব সংস্কৃতিসেবী আর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানেরই অল্পবিস্তর জানা আছে। আগে সমাজে অধিকারী-ভেদ কথাটার স্বীকৃতি ছিল–যার যে বিষয়ে অধিকার নেই সে সে বিষয়ে কথা বলতে, মতামত দিতে লজ্জা ও সংকোচ বোধ করতো। এখন ক্ষমতা মানে সবজান্তামি আর অনধিকারচর্চাই তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, শিল্প ইত্যাদি নিয়ে যারা সরাজীবন কিছুমাত্র মাথা ঘামান নি, ক্ষমতা পাওয়ার সাথে সাথে তারা হয়ে ওঠেন ঐ সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আর শুরু করেন ফতোয়া দিতে। আবার বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ’। সরকারি এ দৃষ্টিভঙ্গির ফলে আমাদের সাংস্কৃতিক জীবন আজ এক বিরাট সঙ্কটের সম্মুখীন। আগেই ইঙ্গিত করেছি Academic freedom তথা জ্ঞানগত অনুশীলনের স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তা আজ প্রদেশের শিক্ষায়তনগুলিতে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাও এখন স্বাধীন চিন্তার চর্চা করেন না। করলেও তা প্রকাশ করার সাহস পান না। এ অবস্থায় দেশে চিন্তাবিদ ও সত্যিকার সংস্কৃতিসেবীর আবির্ভাব কল্পনা করা যায় না। সব রকম উচ্চতর জ্ঞানের উৎস-কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। চিন্তা আর জ্ঞানচর্চার দিক দিয়ে সে বিশ্ববিদ্যালয় আজ স্রেফ এক বন্ধ্যা ঊষর মরুভূমিতে পরিণত। এমন মরুভূমিতে আশাবাদ অঙ্কুরিত হয় না। 

সাহিত্যক-শিল্পীরা স্বভাবতই আশাবাদী–সব রকম প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা নিজের মনের আশাটাকে জিইয়ে রাখতে চায়। কারণ, আশা তাদের শিল্পী-সত্তার অচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু এ রকম সার্বিক অবক্ষয়ের মাঝে তারা আর কতদিন আশার এ ক্ষীণ দীপশিখাকে অনির্বাণ রাখতে সক্ষম হবে? মনে হয়, প্রতিকারের সব পথই যেন আজ বন্ধ। এ সার্বিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে লেখকরা সংগ্রাম করবেন কী করে? এ অবক্ষয়ের প্রতিভূ যে ক্ষমতা তা আজ এত অন্ধ, এত হৃদয়হীন ও নির্মম রূপ নিয়েছে যে, তা মানুষের জীবিকা কেড়ে নিতেও দ্বিধা করে না–এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম আত্মহত্যার সামিল। হয়ে উঠেছে! সরকার বা অন্য যেই হোক তার বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম চালাতে হলেও বিপক্ষেরও কিছুটা অন্তত মানবিক গুণ, শুভবুদ্ধি ও সহনশীলতা থাকা প্রয়োজন। মত্ত হাতি বা পাগলা ষাঁড়ের সামনে আপনি বুক পেতে দাঁড়াবেন কী করে? আজ যে কোন প্রতিবাদ বা বিরুদ্ধতা ক্ষমতার কাছে যেন ষাঁড়ের সামনে লাল সালু! শিক্ষা সম্পর্কিত ব্যাপারে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রদেশের কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীদের ভাগ্যে যে দুর্ভোগ ও অনিশ্চয়তা নেমে এসেছে তা কারও আগোচর নয়। আমি নিজে শিক্ষক ছিলাম–ছাত্র-ছাত্রীদের এ দুঃখ ও অসহায়তা আমাকে বারে বারে বেদনার্ত করে তোলে। চোখের সামনে প্রতিকারের কোন উপায় দেখতে পাই না বলে বেদনাটা আরো মর্মান্তিক হয়ে বাজে। বাট্রাণ্ড রাসেল তার সম্প্রতি প্রকাশিত আত্মজীবনীতে লিখেছেন : But it depends upon the exisence of certain virtues in those against whom it is employed, প্রতিবাদ যে শক্তির বিরুদ্ধে করা হয় তারও কিছুটা অশুভ-সহনশীলতা ও মানবিক গুণ থাকা অত্যাবশ্যক। দুঃখের বিষয়, আমাদের বর্তমান কর্তৃপক্ষ এ Virtue বা মানবিক গুণ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। ফলে নিরাপদ কোনো আলোচনা-সমালোচনা কিংবা প্রতিবাদ কি আন্দোলন কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না এখন দেশে। অথচ এ সবই সভ্যতা আর গণতান্ত্রিক জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। কর্তৃপক্ষের বোঝা উচিত পৃথিবীতে কোন দিন কোন yes-man কিছু গড়ে তোলে নি, করে নি কিছুই সৃষ্টি। হা-হুজুর কখনো সৃজনশীল হতে পারে না। তেমন নজির ইতিহাসে কোথাও নেই। সাহিত্য, শিল্প, নাটক, সঙ্গীত, নৃত্যকলা ইত্যাদি সব কিছুই স্বাধীন মন ও স্বাধীন শিল্পী-প্রতিভারই অবদান। কিন্তু তার জন্য মুক্ত হাওয়া আর স্বাধীন পরিবেশ অত্যাবশ্যক। মনের যে স্বাধীনতার কথা বলছি তার জন্য আত্মপরীক্ষা অপরিহার্য–আত্মপরীক্ষা শুধু স্বাধীনতাকে নয়, মনুষ্যত্বকেও সার্থক করে তোলে। সব রকম শিল্পসাধনাকেও করে তোলে বিচিত্রমুখী! পশুর আত্মপরীক্ষা নেই, কিন্তু মানুষ মানুষ হয় এ আত্মপরীক্ষার পথেই। সক্রেটিস তার Apology তে বলেছেন, The unexamined life is not worth living ‘ অর্থাৎ অপরীক্ষিত জীবন টিকে থাকারও অনুপযুক্ত। আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার মূলেও রয়েছে আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মসমালোচনা। আমাদের সমাজ আর সরকার দুইই আত্মসমালোচনাকে শুধু যে ভয়ের চোখে দেখে তা নয় বরং তার সম্বন্ধে অত্যন্ত অসহিষ্ণুও। ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য ও শিল্প-কলা–সব কিছুই এ আত্মপরীক্ষারই পরিণতি। এ কারণেই তা বিভিন্ন ও স্বাতন্ত্র-অভিসারী। ধর্ম বা সংস্কারের ওপর রোলার চালাতে গেলে মননশীলতা আর সংস্কৃতিচর্চা একটা অচলায়তনের নিগড়ে আটকে না পড়ে পারে না। সংস্কৃতির রূপ কখনো একবর্ণ হয় না–জীবন্ত সংস্কৃতি সব সময় বিচিত্র ও বহুবর্ণ। এমনকি তার মধ্যে স্ববিরোধিতার স্থানও রয়েছে। মৃত্যুর বর্ণ এক, জীবন বহুবর্ণ। যে সংস্কৃতি বহুবর্ণ হতে অনিচ্ছুক তার অকালমৃত্যু অনিবার্য। যে সংস্কৃতি বিশ্বের তাবত মূল্যবোধকে স্বীকৃতি দিতে, গ্রহণ ও আত্মস্থ করতে অপারগ সে সংস্কৃতি অচিরে রুগ্ণ, রক্তহীন ও ফ্যাকাসে যে হয়ে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। গোঁড়ামি সব সময় আত্মবিনাশী–সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তা আরো বেশি মারাত্মক। সংস্কৃতির ধর্মই হলো গ্রহণ–বর্জন নয়। তাই সরকারি অনধিকারী মুখপাত্ররা যখন বর্জনের ধুয়া তোলেন তখন সত্যিকার সংস্কৃতিসেবীরা আতঙ্কিত না হয়ে পারেন না। সংস্কৃতির প্রধান বাহন ভাষা–যে ভাষায় আপনি সংস্কৃতি সাধনা করবেন সে ভাষার শ্রেষ্ঠ সম্পদকে বাদ দিয়ে সংস্কৃতি-সাধনা মানে ডেনমার্কের রাজকুমারকে বাদ দিয়ে হ্যামলেট অভিনয় করা। ধর্ম আর সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার–এ সত্যটা উপলব্ধি না করে অনেকে তালগোল পাকিয়ে বসেন। আরো দুঃখের বিষয় যারা সংস্কৃতিচর্চাকে সবসময় ধর্মের আলখাল্লা পরাতে চান তারা নিজেরা ধার্মিক যেমন নন তেমন নন সংস্কৃতিসেবীও। ধর্মের ক্ষেত্র অত্যন্ত সীমিত, আধ্যাত্মিক উন্নয়ন আর স্রষ্টার সঙ্গে বোঝাপড়াই তার একমাত্র লক্ষ্য–সাহিত্য-শিল্পও যে সময় সময় এ কর্তব্য পালন করে না তা নয়, কিন্তু তার দিগন্তরেখা আরো প্রসারিত, আরো বহুবিস্তৃত। জীবনের সব রকম অভিব্যক্তিই তার এলাকাভুক্ত–চরম পাপীও তার প্রিয় বিষয়বস্তু! যে দিন মানুষের মন স্রষ্টার ধ্যান-ধারণা তথা পরলোকমুখীনতা ত্যাগ করে মানুষের জাগতিক জীবন আর তার বিচিত্র রহস্যময় অভিব্যক্তির দিকে ফিরে তাকিয়েছে, সত্যিকার অর্থে সেদিন থেকেই শিল্পসাহিত্যের জন্ম–সেদিন থেকেই তার দিগৃবিজয়, সেদিন থেকেই তার জয়যাত্রা মাত্র। রহস্য, অলৌকিকতা আর অপৌরুষের কর্তৃত্বের বন্ধন থেকে মানুষের মন যেদিন মুক্তি পেয়েছে সেদিন থেকে সাহিত্য-শিল্পেরও ঘটেছে বন্ধন-মুক্তি এদিন থেকেই হয়েছে মানুষ সৃজনশীল। স্রষ্টার মতোই স্রষ্টাপ্রেরিত ধর্মও অচল, স্থির ও অপরিবর্তনীয়–তাতে জিজ্ঞাসা, অনুসন্ধান ও মতভেদের কোনো স্থান নেই। অথচ ওটা ছাড়া সাহিত্য সাহিত্যই হতে পারে না। ব্যাপক অর্থে মানব মনের জিজ্ঞাসা আর তার উত্তর সন্ধানই সাহিত্য আর শিল্প। সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, নাটক, নৃত্য–এ সবই মানুষের তৈরি, মানুষের আত্মজিজ্ঞাসারই ফল, মানব-মনীষারই অবদান। মানবজীবনের মতো এ সবেরও পরিবর্তন পরিবর্ধন আছে, আছে রূপান্তর। যুগে যুগে দেশে দেশে মানুষের প্রয়োজন, চাহিদা, এষণা ও অভী অনুসারে এগুলি নব নব ভাবে রূপায়িত হয়েছে ও হচ্ছে। আঙ্গিকে যেমন তেমন ভাবে আর বিষয়বস্তুতেও নবায়িত হয়ে ওঠার ওপরই নির্ভর করে এ সবের আয়ু আর অস্তিত্ব। আমাদের ধর্মহীন ধর্মধ্বজীদের নিষেধ মানতে গেলে দেশে সব রকম সংস্কৃতি-সাধনার ভরাডুবি অনিবার্য। জিজ্ঞাসা বন্ধ হওয়া মানে উত্তর না খোঁজা, সমস্যার মোকাবিলা করতে অস্বীকার করা মানে সমাধানের দিকে পিঠ ফিরে থাকা। এভাবে উটপাখি সাজা বকধার্মিক কাজ হতে পারে কিন্তু সাহিত্যের ধর্মও এ নয়। সাহিত্যের ধর্ম স্বর্গ মর্ত্য তন্ন তন্ন করা, সব বন্ধ দরজা খুলে দেওয়া। সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ট্র্যাজেডি–যা মানুষের সর্ব সত্তাকে নাড়া দেয়। সে ট্র্যাজেডি সৃষ্টি সম্বন্ধে হাবটি জে, মুলার তাঁর Freedom in the Ancient World গ্রন্থে লিখেছেন : …great tragedy can be written only by men who are free in mind and spirit, no longer slaves to ‘miracle, mystery and authority. (p 172)

এ বক্তব্যের আলোয় আমরা ধর্মস্থান আর ধর্মপ্রধান বা ধর্মপ্রাণ দেশগুলির দিকে তাকালে বুঝতে পারবো কেন সেখানে শুধু মহৎ ট্র্যাজেডি নয়, এমন কি কোনো ভালো নাটক, নভেল বা উচ্চাঙ্গের সংগীত কিংবা নৃত্যকলারও সৃষ্টি হয় নি। আমাদের দেশেও এমন কি উচ্চাঙ্গের ইসলামি সংগীত যারা রচনা করেছেন তারাও প্রচলিত অর্থে উচ্চাঙ্গের ধার্মিক ছিলেন না। ধর্ম অপ্রয়োজনীয় বা মানবজীবনে তার কোন মূল্য নেই–তেমন কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার বক্তব্য, ধর্মকে ধর্মের এলাকায় সীমিত রাখাই সঙ্গত–আর সাহিত্য-শিল্প তথা সাংস্কৃতিক সাধনাকে দেওয়া উচিত মানবজীবনের বিচিত্র রহস্য সন্ধানের পুরোপুরি সুযোগ ও স্বাধীনতা। যারা ধর্মকে মানুষের জীবনের একমাত্র অবলম্বন বা সারাক্ষণের বস্তু মনে করেন–আমার বিশ্বাস, মানবজীবন তথা মানবচরিত্র সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণাই নেই। যে মানুষ উদয়াস্ত সারাদিন তসবিহ জপেই কাটিয়ে দেন তিনি কি কখনো পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারবেন? এমন মানুষের দ্বারা দেশের সমাজের ও রাষ্ট্রের কি কিছুমাত্র ফায়দা হবে? চারদিকে পৃথিবীব্যাপী আমরা সভ্যতার যে বিচিত্র উপকরণ দেখছি তার কোন কিছুই এসব ধার্মিকের অবদান নয়। বরং এর অনেক কিছুর সঙ্গে ধর্মের বিরোধ রয়েছে। সিনেমা টেলিভিশনকে ধর্ম-সম্মত প্রমাণ করতে হলে ধর্মের কাটাটাকে ইচ্ছামতো মোচড়াতে হবে! আমার বিশ্বাস, জীবনের আনন্দবেদনাকে উপেক্ষা করে কোন ধর্মপ্রবর্তকও এভাবে জীবন কাটান নি বা কাটাবার নির্দেশ দেন নি। আমাদের দেশে যারা ধর্মের কথা বলেন, তারা আনুষ্ঠানিক ধর্মের বাইরে মানব-জীবন, মানবচরিত্র ও মানবস্বভাবের কোন খোঁজই রাখেন না। তাই এ সবের বিকাশ কী করে ঘটে সে খবরও তাঁদের অজানা। এরা ধর্মকে ধর্মের জন্য ব্যবহার করেন না,তদুপরি ধর্মকে এরা ব্যবহার করেন জাগতিক স্বার্থ লক্ষ্য করেই। এঁদের উপেক্ষা করে চলা ছাড়া শিল্পী আর সংস্কৃতিসেবীদের অন্য কোনো উপায় নেই। বিবাদে লিপ্ত হওয়া মানে অযথা নিজের শক্তি ক্ষয় করা। বলা বাহুল্য, মহৎ শিল্পীমাত্রই বিদ্রোহী। শিল্পীর এ বিদ্রোহী সত্তার সম্বন্ধেও আমাদের সব সময় সচেতন থাকতে হবে। যুগে যুগে বিদ্রোহী পথেই শিল্পের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। আমাদেরও এ পথ, ঐতিহ্যের নামে সংস্কারের নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে থাকলে আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না সংস্কৃতিচর্চার পথে এক পাও এগিয়ে যাওয়া। ফলে আমাদের দেশ, আমাদের যুগ বন্ধ্যা হয়েই থাকবে–ভবিষ্যতের হাতে আমরা কিছুই তুলে দিতে পারবো না। শুধু গ্রহীতা হয়েই থাকবো, দাতার ভূমিকা আমাদের ভাগ্যে কখনো জুটবে না। কোনো দেশ বা জাতির পক্ষে এ ভূমিকা যে–সৌন্দর্যের পসরা খুলে দেয় তাতে মন আমাদের উন্নত হয়, রুচি হয় মার্জিত, পাই আমরা এক অনির্বচনীয় আনন্দের স্বাদ। তা ছাড়া, আরো একটি বিশেষ ভূমিকা আছে সাহিত্য আর শিল্পের। বাইরের বন্ধন মানুষ সহজেই কাটতে পারে কিন্তু মনের বন্ধন কাটাই কঠিন। যে শত্রুকে দেখা যায় তার সঙ্গে মোকাবিলা সহজ, কিন্তু অদৃশ্য আর অশরীরী শত্রুই সাংঘাতিক। দিনের আলোয় যারা ভূতের অস্তিত্বেই বিশ্বাস করে না, রাতের অন্ধকারে তেমন মানুষকেও ভূতের ভয়ে দুরু দুরু বুক হতে দেখা যায়। মানুষের মনোরাজ্যে আর তার দিগদিগন্তে সাহিত্য আর ললিতকলা হচ্ছে দিনের আলো, দিনের আলোরও বেশি; কারণ দিনের আলোতেও যেসব ভূত পালায় না, এ সব শিল্পের আলোয় সে সব ভূতও পালাবার পথ খোঁজে। মানুষের মনে কতরকম ভূতের যে আড্ডা তার কোন ইয়ত্তা নেই–ব্যক্তি, সমাজ, সম্প্রদায়, দেশ, জাতি শাস্ত্র ও দেশাচারের হাজারো রকমের ভূত তথা সংস্কারের বন্ধনে মানুষের মন বাধা। ভয়, মোহ ও অহমিকা এ সব বাঁধনকে প্রায় অচ্ছেদ্য করে তোলে। সাহিত্য আর সব রকম শিল্পসাধনা হচ্ছে এ বাঁধন কাটার মন্ত্র। এ সব বাধন কাটাতে পারলে মুক্তবুদ্ধির দিনের আলোয় বিচরণ হয় সহজ। শিল্পসাধনাও হয় তখনই সার্থক। প্রকৃত cultured বা সংস্কৃতিবান হওয়ার এ-ই পথ। 

দেশের সংস্কৃতিসেবীরা অনেক বাধা-বিঘ্ন আর দুঃখ-দুর্দশার শিকারে পরিণত। তবুও বলবো মানবাত্মা অজেয়–শত বাধা-বিঘ্ন আর নির্যাতনেও তার পরাজয় নেই। এ বিশ্বাসের জোরেই মানুষ মৃত্যুঞ্জয়। এ বিশ্বাস মানুষের এক পরম সম্পদ। এ সম্পদ পড়ে পাওয়া বস্তু নয়, প্রতিদিনের সাধনা ও অনুশীলনের দ্বারা এ সম্পদকে জয় করতে হয়, রাখতে হয় সজীব আর সচল। এ রাখার জন্যই সংস্কৃতি-সাধনা–সব রকম ভয় ভীতিকে উপেক্ষা করে অবিচলিত চিত্তে তাতে আত্মনিবেদন করা। 

[‘সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তা’ প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় সমকালীন চিন্তা গ্রন্থে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *