সংস্কৃতির কথা
[ওসিআর ভার্সন, প্রুফ্ররিড করা হয়নি]
মনে হয় মানুষ স্বভাবত পৌত্তলিক : কোনো বিশেষ প্রতিমা বিশেষ তত্ত্ব বিশেষ আচার বা বিশেষ ধরন-ধারণ– এ না হলে যেন তার চলতে চায় না। আর এরই সঙ্গে সঙ্গে সে পরিবর্তন প্রিয়–তার প্রতিমা তত্ত্ব আচার বা ধরন-ধারণ ক্রমাগত বদলায়।
সংস্কৃতি কথাটা ইয়োরোপে প্রবল হয় উনবিংশ শতাব্দীতে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইয়োরোপে নানা ধরনের বিপ্লব দেখা দেয়–ভাব-বিপ্লব, অর্থনৈতিক বিপ্লব, রাষ্ট্রিক বিপ্লব, সবই। সেই বিপ্লবের পরে উনবিংশ শতাব্দীতে আসে নূতন সংগঠনের কাল। সেই দিনে অতীতের ধর্মের স্থান দখল করে সংস্কৃতি।
সংস্কৃতি বলতে বোঝা হয় এক বিশেষ সমন্বয়-খ্রিস্টান অখ্রিস্টান সমস্ত রকমের জ্ঞান ও উৎকর্ষ এর অন্তর্ভুক্ত হয়। এর সংজ্ঞা দেওয়া হয়–অতীতের শ্রেষ্ঠ ভাব সম্পদের সমাহার। প্রথমে এর প্রবণতা হয় ব্যক্তিতান্ত্রিকতার দিকে ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষই হয় এর প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু ইয়োরোপে সঘবদ্ধ জীবন অনেক বেশি। সক্রিয়, তাই অচিরেই এই ব্যক্তিতান্ত্রিকতার মোড় ফেলে সামাজিকতার দিকে।
ভারতবর্ষ চিন্তার দিক দিয়ে ইয়োরাপের অন্তত পঞ্চাশ বৎসর পেছনে পড়ে রয়েছে; ইয়োরোপের উনবিংশ শতাব্দীর ঢেউ ভারতবর্ষে যে এসে লাগবে বিংশ শতাব্দীতে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। সংস্কৃতির ব্যক্তিতান্ত্রিক প্রবণতা আমাদের দেশে দুই চার বছর আগেও প্রবল ছিলো। ভদ্রলোক হওয়া বা একটি ভদ্র পরিবার গড়ে তোলা এইই ছিলো আমাদের দেশের শিক্ষিতদের লক্ষ্য। দেশে যে গণতান্ত্রিক শাসন নীতি প্রবর্তিত হয়েছে আর সাম্প্রদায়িক বিরোধ তীব্র হয়ে উঠেছে তার ফলে আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনায় সমাজবোধ একটা বড় জায়গা দখল করতে চাচ্ছে।
ভারতবর্ষের একালের সংস্কৃতিক চিন্তার ইতিহাসে দুই জনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য– একজন বঙ্কিমচন্দ্র অপরজন পাঞ্জাবের ইকবাল। এদের চাইতে শ্রেষ্ঠতর চিন্তাশীলের জন্ম একালের ভারতবর্ষে হয়েছে, কিন্তু চিন্তা নায়ক হিসাবে এঁদের মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে আর কেউ পারেন নি। এঁরা দুজনেই চেয়েছেন প্রাচীন ধর্মের নূতন ব্যাখ্যা দিতে, সঙ্গে সঙ্গে শক্তিশালী রাষ্ট্রজীবন গঠন বলতে যা বোঝায় তারও স্পষ্ট ইঙ্গিত এঁদের বাণীতে রয়েছে। মানুষ একই সঙ্গে স্থিতিশীল ও গতিশীল, আমাদের দেশের লোক স্থিতিশীল কিছু বেশি –জীবনে নূতন নূতন পরীক্ষা করবার সুযোগ তাদের জন্য সংকীর্ণ, বোধ হয় মুখ্যত এই কারণে। বঙ্কিমচন্দ্র ও ইকবালের চিন্তায় সনাতন স্থিতিশীলতার সঙ্গে কিছু গতিশীলতা যে মিশেছে, এরই মধ্যে নিহিত রয়েছে তাদের জনপ্রিয়তার রহস্য। স্থিতিশীলতার আর গতিশীলতার এই যে অদ্ভুত মিশ্রণ আমাদের দেশের চিন্তায় ঘটেছে আমাদের একালের সংস্কৃতিগত চিন্তায় এই একটি গোড়ার কথা। কিন্তু সুচিন্তার কাজ হচ্ছে চিন্তায় গ্রন্থির জটিলতা ঘুচিয়ে তাকে ঋজু করা–জীবনে কার্যকরী করা।
আমাদের জীবনে নূতন নূতন পরীক্ষার সুযোগ সংকীর্ণ-বিচিত্র ও দূরপ্রসারী ব্যাপারটির প্রভাব। এর ফলে যেমন কঠিন আমাদের পক্ষে মাত্রাজ্ঞান সম্পন্ন হওয়া তেমনি দুর্নিবার আমাদের জন্য চরমপন্থিত্বের আকর্ষণ : যে চিন্তার লক্ষ্য দীর্ঘাভিসারী কর্ম-পন্থা আমাদের কৌতূহল সহজেই তা থেকে হয় প্রতিনিবৃত, আর যে চিন্তা আমাদের জন্য এনে দেয় ভাবোন্মত্ততা সহজেই আমাদের মন হয় তার দ্বারা বন্দী। এই প্রতিকূল পরিবেশ আর অব্যবস্থিত চিত্ত বেশ বড় রকমের দুর্ঘটনা এসব আমাদের জীবনে।
সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিতান্ত্রিকতা যে দুর্বল চিন্তা তা বোঝা কঠিন নয়। মানুষ বিশেষভাবে সামাজিক জীব। কাজেই যে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক উৎকর্ষের সামাজিক মূল্য কম তা যত সুদর্শনই হোক শেষ পর্যন্ত অদ্ভুত ভিন্ন আর কিছু নয়। অবশ্য একথা সত্য যে এক যুগে যার সামাজিক মূল্য কম অন্য যুগে তার সামাজিক মূল্য বেশি হতে পারে। কিন্তু এমন কতকগুলো ব্যাপার আছে স্বভাবতই যার সামাজিক মূল্য কম। মানুষের ইতিহাস বিচিত্র বিচিত্রভাবের মধ্যে দিয়ে তার অভিব্যক্তি হয়েছে ও হচ্ছে। তাই যেসব চিন্তা প্রকৃতপক্ষে জনহিতকর নয়, বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠির দলের চেতন বা অবচেতন স্বার্থবোধের অনুকূলের মাত্র, অথবা ক্ষণিক খেয়াল, সে সবের দিকেও মাঝে মাঝে নেতৃস্থানীয়দের প্রবণতা জন্মেছে।
সেকালের ধর্মের মতো একালের সংস্কৃতিরও মূল কথা হওয়া চাই সামাজিক উৎকর্ষ লাভ আর যেহেতু সমাজের অর্থ একদিকে বিশ্বমানব সমাজ উৎকর্ষ বিশেষ বিশেষ দেশগত বা রাষ্ট্রগত সমাজ, সেজন্যে সংস্কৃতিও মূলত বিশ্বসামাজিক ও রাষ্ট্রিক। অন্য কথায়, যে চিন্তা জগতের অনেকের মনে অনুরণন জাগায় না এবং যার রাষ্ট্রিক সার্থকতা কম তা বাস্তবিকই স্বল্পমূল্য বা মূল্যহীন– হোক না তা অন্যভাবে যত অসাধারণ।
এই দিক দিয়ে দেখলে হিন্দু সংস্কৃতি আর্য-সংস্কৃতি সেমীয় সংস্কৃতি ইত্যাদি কথা যে দেশে উঠেছে সে-সবের মূলে সুচিন্তা যে তেমন কার্যকরী হচ্ছে না তা সহজেই বোঝা যায়। যদি হিন্দু ও মুসলমানের রাষ্ট্রিক জীবন সম্মিলিত হয় তবে তাদের সাংস্কৃতিক জীবন ভিন্ন হতে পারে না, অন্তত সে-বিভিন্নতা অগ্রগণ্য হতে পারে না হলে সংস্কৃতি একটি প্রধান লক্ষ্য সামাজিক অর্থাৎ রাষ্ট্রিক উৎকর্ষ লাভ তাই হয় ব্যাহত। হিন্দু-সংস্কৃতি মুসলিম-সংস্কৃতি এসব চিন্তা কিছু পরিমাণে কার্যকরী হতেও পারে যদি হিন্দু ও মুসলমানের রাষ্ট্রিক জীবন স্বতন্ত্র হয়। কিন্তু যারা হিন্দু-সংস্কৃতি মুসলিম-সংস্কৃতি ইত্যাদি কথা বলেছেন তাঁরা ভারতবর্ষের অথবা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের হিন্দু ও মুসলমানের পৃথক পৃথক রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা তেমন ভাবছেন তা মনে হয় না।
সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশ্বজনীনতার কথা তোলা হয়েছে। চিন্তা চিরদিনই বিশ্বজনীন। আর একালে চিন্তার বিশ্বজনীনতা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিভিন্ন দেশের মানুষ পরস্পরের অত্যন্ত কাছাকাছি এসেছে বলে’। এই চিন্তার ক্ষেত্রে নূতন নূতন সম্ভাবনার কথা আজ মানুষ জ্ঞাতসারে মনে স্থান দিচ্ছে, ফলে প্রাচীন চিন্তাধারা তার চিত্তকে আর বন্দী করে রাখতে পারছে না- যেসব দেশে প্রাচীন ধর্মের প্রভাব অত্যন্ত বেশি সে-সব দেশেও নয়। কাজেই সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রাচীন চিন্তার দোহাই একালে বাস্তবিকই অচল। সংস্কৃতি মানুষের সৌখীন পোষাক-পরিচ্ছদ নয়, তা তার জীবন-যুদ্ধের অস্ত্র–আর অস্ত্রের প্রাচীনতাই তার গৌরবের বিষয় নয়।
আমাদের দেশের একশ্রেণীর চিন্তাশীল ব্যক্তিরা এই ব্যাপারের দিকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকান। আমাদের বর্তমান শক্তিহীনতার কথা তারা বোঝেন, আর বুঝে তাঁরা এই ভাবেন যে এ অবস্থায় আক্রমণের চাইতে প্রতিরোধের মনোভাব বরণ করাই আমাদের জন্য প্রশস্ত। এই প্রতিরোধ মুখ্যত তাঁদের জন্য কূর্ম-বৃত্তি অবলম্বন। কূর্ম যেমন বিপদ-কালে নিজেকে গুটিয়ে নেয় তার আবরণের মধ্যে এঁরাও তেমনি আত্মরক্ষার প্রয়াসী হন দেশের বা সমাজের সনাতন ভাবধারার আশ্রয়ে। কিন্তু এই চিন্তাধারা খুবই দুর্বল। কৃর্ম-বৃত্তি অবলম্বন করে বিশেষ বিশেষ প্রাচীন সম্প্রদায় জগতের নানা স্থানে আজো টিকে আছে, কিন্তু তারা নাম পেয়েছে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায় অথবা বর্বর সম্প্রদায়। জগতে বাস্তবিকই তারা পিছিয়ে পড়েছে। সাবধানতা সাধারণত একটি সদগুণ, কিন্তু তা যদি হয় পরাজয় স্বীকৃতির অন্য নাম তবে তার চাইতে দোষাই আর কিছু নেই।
“বাংলার মুসলমানের সংস্কৃতি” সম্পর্কে দুই একটি কথা বলতে গিয়ে আমাদের এই ভূমিকার অবতারণা করতে হলো। বাংলার মুসলমানের উৎপত্তির কথা আমরা অন্যত্র আলোচনা করেছি। [দ্রঃ বাংলার মুসলমানের কথা] তাতে দেখেছি, বৌদ্ধ, হিন্দু, পাঠান আর আরব ইত্যাদি বিচিত্র উপাদানে এই সমাজ গঠিত।
কিছুদিন পূর্বেও এই সমাজে দুইটি শ্রেণী ছিল : একটি সম্ভ্রান্ত “আশরাফ”, অপরটি সাধারণ “আতরাফ”, এবং এই দুই শ্রেণীর মধ্যে সামাজিক আদান-প্রদান প্রায় ছিল না বললেই চলে– কতকটা হিন্দুর জাতিভেদের মতো। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এমনি বিচিত্র সমাজ ও মত ভারতবর্ষের প্রশস্ত বুকে স্থান লাভ করেছে। ক্ষুদ্র সংহতি জীবনই মুখ্যত তাদের উপজীব্য হয়েছে, বৃহত্তর দেশ সম্বন্ধে চেতনা কদাচিৎ অনুভূত হয়েছে। এই যে এক ধরনের “যত মত তত পথ” অথবা “যত পথ তত মত” তত্ত্বের সূত্রে ভারতবর্ষের লোকদের জীবন গ্রথিত হয়েছিল তাতে কিছু শান্তি হয়ত ভারতীয় সমাজ-জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; কিন্তু যার অভাব ঘটেছিল তার নাম সচেতনতা। হাজার বৎসর পূর্বে আলবেরুনী এটি লক্ষ্য করেছিলেন, আর আজো এটি কম লক্ষ্যযোগ্য নয়। ভারতবর্ষের প্রাচীন সাধনা সম্বন্ধে আমাদের একালের অনেক চিন্তাশীলের এই যে এক সিদ্ধান্ত যে অনন্ত বৈচিত্রের ভিতরে একত্বের সন্ধান করতে হবে, এটি আংশিক ভাবেই গ্রহণযোগ্য। সত্য শুধু মানস ব্যাপার নয়, বিশেষভাবে সামাজিক ব্যাপার; বৈচিত্র্য কম হোক আর বেশি হোক তার ভিতরকার একতু হওয়া চাই সুদৃঢ়– সামাজিক অর্থে; আর ততখানি বৈচিত্র্যই স্বীকার্য যা এই সুদঢ় একতের অনুকুলে। ফলের প্রাচুর্যে ডাল যদি ভেঙ্গে পড়ে তবে তা ফল ও ডাল দুইয়েরই জন্য হয় অসার্থক।
বাংলায় মুসলমানের আবির্ভাব হয়েছে অন্তত সাত শতাব্দী পূর্বে। কিন্তু তার এই দীর্ঘ জীবনের ইতিহাস অতি সামান্যই আমরা জানি। যেটুকু জানি তাতে বলা যায়, তার “সম্ভ্রান্ত” ও “সাধারণ” শ্রেণীর মধ্যে দুই বিভিন্ন ইসলামী সংস্কৃতি বলতে যা বোঝা যায় তার, আর যারা “সাধারণ” তাঁদের জীবন সাধারণত চলতো তাঁদের পূর্বপুরুষদের ধারায়। [দ্রঃ হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ: প্রথম বক্তৃতা] অবশ্য দেশের সমস্ত সমাজের মোটের উপর সন্তুষ্ট ছিল তাদের ভাগ্য নিয়ে। এমনিভাবে দীর্ঘকাল কাটবার পরে ভারতবর্ষের, বিশেষ করে বাংলায়, লাভ হলো ইয়োরোপের স্পর্শ। এই স্পর্শে প্রথমে দেশের যা ফল লাভ হলো এক হিসাবে তা বহুমূল্য, কেননা হিন্দু-মুসলমান দেশের সব সমাজেই আত্ম অন্বেষণ সক্রিয় হলো এবং দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে অনেক মহিমাময় ব্যক্তির আবির্ভাব হলো।
কিন্তু অচিরেই দেশের মনোভাব পরিবর্তন ঘটলো। দেশ মুগ্ধ হয়েছিল ইয়োরোপের ভাবুক-রূপের দ্বারা। কিন্তু ইয়োরোপের প্রভুরূপের সঙ্গে পরিচিত হতে তার দেরী হলো না এবং তার ফলে তার ইয়োরোপের পূজা রূপান্তরিত হলো ইয়োরোপ-বিদ্বেষে বা ইয়োরোপ-ভীতিতে।
এই ইয়োরোপ-বিদ্বেষ বা ভীতির সঙ্গে দেশের একালের রাজনৈতিক চেতনা সম্বন্ধ। সুতরাং আমাদের একালের সাংস্কৃতিক চিন্তারও গভীর যোগ এই বিদ্বেষ বা ভীতির সঙ্গে।
আত্মরক্ষার জন্য কৃর্ম-বৃত্তি অবলম্বনের উল্লেখ আমরা করেছি। আমাদের দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সাংস্কৃতিক চেতনা বলতে মোটের উপর বোঝেন এই কৃর্ম-বৃত্তি অবলম্বন–বিপন্ন কৃর্মের মত অক্ষম আক্রোশ হয়ত তাদেরও এই চেষ্টার আনুষঙ্গিক। কিন্তু যারা প্রধানত বিদ্বেষপরায়ণ বা ভীত তাঁদের স্বাভাবিক মনুষ্যত্বে গ্লানি পৌঁছেছে–সুচিন্তা, অর্থাৎ কল্যাণপ্রসূ চিন্তা, সেই অবস্থায় আর তাঁদের পক্ষে সম্ভবপর নয়। তাঁদের সঙ্গে সংস্কৃতির মতো গুৰু বিষয়ের আলাপ আলোচনা না করাই হয়ত শোভন। কিন্তু তাদের আত্মীয়স্থানীয় অপর একটি দল আছেন, তারা সময় সময় চিন্তাশীল বলে’ আদৃত হল। তাঁরা বলতে চান : চিন্তা উচ্চাঙ্গের অথবা সারগর্ভ হলেই জনসাধারণের গ্রহণযোগ্য হয় না, গ্রহণযোগ্য হয় তাদের অভ্যস্ত ভাবধারার অনুকূল হলে; এতকাল এদেশের লোকে বিভিন্ন সমাজে ও ধর্মে বিভক্ত হয়ে জীবন অতিবাহিত করে এসেছে, আজ যদি তাদের– তা যে প্রয়োজনেই যোক বলা হয় যে তাদের সেই ভাবধারা তাদের জন্য আর কল্যাণপ্রসূ নয়, তবে তাদের বিহ্বল ও বিভ্রান্তই করা হবে বেশি, তাদের পথের নির্দেশ দেওয়া হবে মনে হয় না। এই শ্রেণীর ভাবুকদের বড় ক্রটি এইখানে যে যে-চিন্তাকে তারা জনসাধারণের পক্ষে দুর্বোধ্য জ্ঞান করেন সেটি– অথবা অন্য কোন চিন্তাধারা তাদের নিজেদের সহজবোধ্য হয়েছে কিনা সে জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হন তারা কদাচিৎ। অথচ কে না জানে যে সার্থক প্রচার আমাদের দ্বারা তখনই সম্ভবপর যখন কোনো মত বা পথ আমরা সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করেছি। মানুষের নব নব ইতিহাস নিয়তই রচিত হচ্ছে, আর রচিত হচ্ছে তাদের দ্বারা নয় যারা বুদ্ধিমান কিন্তু দ্বিধান্বিত, পরন্তু, তাদের সত্য ও কল্যাণকে বুঝবার চেষ্টায় যাঁদের ত্রুটি নেই সঙ্গে সঙ্গে যা তাঁরা সত্য ও কল্যাণকর বলে বুঝেছেন তাতে আত্মসমর্পণ করেছেন। সংস্কৃতির একটি সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে সুন্দরের সাধনা। যাদের ব্যক্তিতান্ত্রিক প্রবণতা বেশি। তাদেরও এই সংজ্ঞা হয়ত মনঃপূত হবে। কিন্তু সুন্দর তো শুধু মোহকর নয়, সুন্দর বিশেষভাবে সত্যাশ্রয়ী– জগৎ ও জীবনের সঙ্গে তার যোগ যেমন দৃঢ় তেমনি তার গতি সার্থকতা লাভের দিকে। সত্যাশ্রয়িতা, অর্থাৎ সত্য উপলব্ধির চেষ্টা আর সার্থক হবার আকাঙ্ক্ষা, যাদের অন্তরের ধর্ম নয় তারা জ্ঞানীও নন কর্মীও নন।
এই সত্যাশ্রয়িতার দৃষ্টিভূমি থেকে যদি আমরা বাংলার মুসলমানের সংস্কৃতির দিকে তাকাই তাহলে কি দেখব? দেখব– নানা দৈন্যে বাংলার মুসলমান জর্জরিত, আর্থিক দৈন্য তার যত তার চাইতে অনেক বড় তার ভাবে দৈন্য, সঙ্কল্পের দৈন্য। মুসলমান হিসাবে প্রতিমা পূজায় আপত্তি জানিয়ে সে প্রকৃত জীবন অনেকখানি অস্বীকার করেছে; কিন্তু জীবনে বড় কথা অস্বীকার করা নয় বরং বড় কথা হচ্ছে স্বীকার করা মুসলমানের স্বীকার করা উচিত ছিল সজাগ-মানব জীবন অর্থাৎ জ্ঞান ও প্রেমের জীবন ইসলামের অর্থ কেবল তাই হতে পারে। কিন্তু তেমন করে স্বীকার সে কিছুই করতে পারে নি যা স্বীকার করেছে অথবা করতে চেয়েছে তা তুচ্ছ আচার-পূজা ভিন্ন আর কিছু নয়।
তা অতীত যা-ই হোক তার চাইতে বড় কথা বর্তমানের প্রয়োজন। সেই বর্তমানে তার অজ্ঞান ও অভাবাত্মক মনোভাব দূর হোক, সে স্বীকার করুক ভাবাত্মক মনোভাব জাগ্রত আদর্শ। যে-জ্ঞান-ও-প্রেমের জীবন তার স্বীকার করা উচিত ছিল সৌভাগ্যক্রমে তা শুধু আজ তারই স্বীকার্য নয়, জগতের সবারই স্বীকার্য, জগতের বিভিন্ন দেশের বা বিভিন্ন সমাজের মানুষের পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে বলে। সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিতে বৈশিষ্ট্য ও বিরোধ আজ প্রধানত অতীতের কথা। আজ বড় কথা সে সবের প্রাণশক্তির সন্ধান যা থেকে সম্ভবপর হবে জাতিতে জাতিতে অথবা সমাজে সমাজে গাঢ়তর সহযোগিতা ও মঙ্গলতর ভবিষ্যৎ। মানুষের বিচিত্র সংস্কৃতির সেই প্রাণশক্তি আজ চিন্তার ক্ষেত্রে নাম পেয়েছে বৈজ্ঞানিকতা ও মানবহিত আর কর্মের ক্ষেত্রে নাম পেয়েছে সুব্যবস্থিত রাষ্ট্র-জীবন। একালে বাংলার মুসলমানের সাংস্কৃতিক জীবনও প্রতিষ্ঠিত হবে সেই বৈজ্ঞানিক মানব-হিত ও সুব্যবস্থিত রাষ্ট্রের ভিত্তির উপরেই।
দেশের হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের কথা এ ক্ষেত্রে সহজেই ওঠে। এই সমস্যার সম্মুখীন হয়ে যাঁরা বলছেন, হিন্দু-মুসলমানের পৃথক রাষ্ট্র-জীবন ভিন্ন এর সমাধান নেই তাদের কথা বোঝা যাচ্ছে না এই কারণে যে রাষ্ট্র জীবনের অর্থ হচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রভূত ক্ষমতা সমন্বিত সংহতি জীবন, কিন্তু ভারতবর্ষের মতো ভৌগোলিক অবস্থানের দেশে সেই ক্ষমতা সমস্ত দেশের পক্ষে লাভ হওয়াই সম্ভবপর মনে হয়, প্রদেশ-বিশেষের বা অংশবিশেষের জন্য তা একান্তই দুঃসাধ্য। আমরা যতটা ভাবতে পেরেছি তাতে মনে হয়েছে ভারতবর্ষের অথবা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের লোকেরা যদি নিজেদের কোনো রকমের সত্যকার উন্নতি চায় তবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পরস্পরের সঙ্গে সম্মিলিত হওয়া ভিন্ন গত্যন্তর নেই, এবং এই জন্যই তাদের অতীত ও বর্তমানের সমস্ত চিন্তা-ভাবনা সুসঙ্গত হওয়া চাই তাদের জীবনের এই এক শ্রেষ্ঠ প্রয়োজনের সঙ্গে। বলা বাহুল্য এই সম্মিলন বৈচিত্র্যহীন হতেই পারে না কিন্তু বৈচিত্র্য যেন কদাচ বিপন্ন না করে একত্বকে। আজকার বিবৰ্দ্ধিত বিরোধের দিনে এই চিন্তাধারা কারো কারো মনে হতে পারে অবাস্তব। এই ‘বাস্তব’ বাদীদের সৃষ্টি এই কঠিন বাস্তবতার দিকে আকৃষ্ট করেছে তাতে শক্তিতে শক্তিতে বোঝাবুঝির পরিচয় নেই আদৌ, আছে দুর্দৈব ও দুর্বুদ্ধির পরিচয় মাত্র। অবশ্য রোগভোগ দীর্ঘদিন ধরে চললে তাকেই সময় সময় ভ্রম হয় স্বাভাবিক অবস্থা বলে। কিন্তু রোগ রোগই তা কদাচ স্বাস্থ্য নয়।
হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত জীবন ভিন্ন আর কিছু যদি এদেশে সম্ভবপর না হয় তবে হিন্দু-সংস্কৃতি মুসলমান-সংস্কৃতি আর্য-সংস্কৃতি সেমীয়-সংস্কৃতি এসব কথা হয়ে পড়ে দায়িত্বহীন, এবং এসবের প্রচলন আমাদের ভাষায় ও সাহিত্যে যত কম হয় ততই মঙ্গল–ততই চিন্তার সৌখিনতা আমাদের ঘুচবে আর আমরা সত্যাশ্রয়ী হব। সার্থক সমাজ সত্তার দিক দিয়ে বাংলার মুসলমান অথবা হিন্দু বাংলার অথবা বিশাল ভারতবর্ষের অংশ ভিন্ন যখন আর কিছু নয় তখন তার সাংস্কৃতিক জীবনের সার্থকতা লাভের পথ এই বিশাল সত্তার সঙ্গে তার গূঢ় যোগ উপলব্ধির ভিতর দিয়েই–ঝরণার সার্থকতা যেমন নদীর পুষ্টিসাধন করে’–এ সত্য যত অকপটভাবে স্বীকার করা যাবে ততই শক্তি ও শ্রী লাভের পথে আমরা অগ্রসর হব।
আজকার অসার্থক সংস্কৃতি-চিন্তার স্তর থেকে সার্থক সংস্কৃতি-চিন্তার স্তরে উপনীত হতে হলে যে সব ধাপ আমাদের অতিক্রম করতে হবে তার কিছু নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে এইভাবে :
(১) দেশে অভুক্ত ও কর্মহীন কেউ থাকবে না।
২) একান্ত বীভৎস না হলে কোনো সমাজেরই ধর্মাচার অশ্রদ্ধেয় বিবেচিত হবে না, সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে হবে যে–যা প্রাচীন তা প্রাচীন বলেই বরণীয় নয়, বরণীয় তার বর্তমান কার্যকারিতার জন্য।
(৩) হিন্দু-মুসলমানের পোষাক ও নামের ব্যবধান থাকবে না অথবা অস্বীকার করা হবে।
(৪) সামাজিক আদান-প্রদান-বিবাহ-আদি সমেত-সর্বত্র সহজ হবে। (৫) আইন সমস্ত দেশের জন্য এক হবে।