সংস্কার
শুধু ‘ঠাকুর, ঠাকুর’ বলে চিৎকার করলে কি কিছু হবে বাবা! থেকে থেকে ‘জয় ঠাকুর’ বলে লাফিয়ে ওঠাটাও একটা মুদ্রাদোষ। যে যত চেল্লায়, ঈশ্বর থেকে সে তত দূরে সরে যায়। কারণ ঈশ্বর শব্দদূষণের ভয়ে দূরে পালান। তিনি শান্ত, তিনি ধীর, তিনি নির্জনতাপ্রিয়। তিনি বাতাসের সাহায্যে গাছের পাতায়, পাতায় কথা বলেন। তিনি সমুদ্রের ঢেউ ভাঙায় শ্বাস ফেলেন। পর্বতের উচ্চ শিখরে তাঁর শীতল রূপ। মধ্যদিনের বালি-ওড়া মরুভূমি তাঁর রুদ্র রূপ। তিনি স্থিতধী মানুষের, ধ্যানী মানুষের কানে হৃদয়ের শব্দে জীবনের গান গেয়ে থাকেন। আগুনের শিখার ফরফর শব্দে জীবনপাখির ডানা মেলে অসীমে উড়ে যাওয়ার ধ্বনি শোনান। অনিত্যের ডানার শব্দ।
সরতে সরতে সরে আসতে হবে মনে। মানুষের মন তো হাটের মতো। নিজের তৈরি চিন্তার সদা হট্টগোল, যেন কাঁকড়া-বোঝাই ঝুড়ি। এটা উঠছে তো ওটা পড়ছে। সমস্ত চিন্তাকে দলা পাকালে যে-ডেলাটা হবে, তার নাম কাম। এইবার একটা গল্প শোন—
একজন একটা কুকুর পুষেছিল, সে দিনরাত সেইটাকে নিয়ে থাকত, কখনো তাকে কোলে করত, কখনো তার মুখের ওপর মুখ দিয়ে বসে থাকত। পরে একজন বিজ্ঞ লোক এসে তাকে ধমক দিয়ে বুঝিয়ে দিল যে, কুকুরকে অত আদর দিতে নেই, ওরা পশুর জাত, কোনদিন আদর করতে করতে ফট করে কামড়ে দেবে ঠিক নেই। লোকটি সেই কথা শুনে কুকুরটাকে কোল থেকে ফেলে দিল এবং ‘আর কখনো ওটাকে কোলে নেব না’ বলে প্রতিজ্ঞা করল। কুকুরটা কিন্তু তা বোঝে না, সে লোকটাকে দেখলেই দৌড়ে তার কোলে উঠতে যায়। কিন্তু লোকটা তাকে মেরে তাড়িয়ে দেয়। এইভাবে দিনকতক বাধা পেয়ে কুকুরটা নিরস্ত হলো। তোমাদেরও সেই দশা। অনেককাল আদর করে কাম-কুকুরকে কোলে করেছ, এখন তুমি নিরস্ত হলেও সে ছাড়বে কেন! তবে ওতে কোন দোষ নেই। কুকুর তোমার কোলে উঠতে আসুক, তুমি আর তাকে কোলে তুলো না; বরং তাকে খুব মারধোর কর, দিনকতক বাদে সে পালিয়ে যাবে।
একসময় সাবেক ধরনের মুদির দোকানে দেখতুম, মালিক বসে আছেন টাটে। চারপাশে হরেক মালপত্র, নানা রকমের বস্তা। তার মধ্যে একটা বস্তায় ভেলিগুড়। সেই বস্তার গায়ে গোটা চারেক হলদে বোলতা ভ্যান ভ্যান করছে। মালিক নির্বিকার। তিনি জানেন, বস্তায় মোড়া আছে আসল মাল। সে-মাল ঠিকই থাকবে। আর যতক্ষণ গুড়ের গন্ধ আছে, বোলতা ততক্ষণ লেগে থাকবে। আর যতক্ষণ মেতে থাকবে ততক্ষণ তাকে দংশন করবে না।
ঠাকুর বলছেন, কায়দা শেখ। সংসারে আসতেই হবে। না এসে উপায় নেই। থাকতেও হবে কিছুকাল। তাহলে কি করবে, নৌকার কাছে কায়দা শেখ। নৌকা জলে থাকে, নৌকার ভেতর জল থাকে না। যা সামান্য থাকে তা নৌকার ভেসে থাকার কাজে লাগে। একটু তেল চাই। বেশ করে দুহাতে মেখে সংসার-রূপ কাঁঠাল ভাঙ।
কাঞ্চন! সে যে কী আসক্তি! আরেকটা গল্প শোন। এক নাপিত পথ চলতে চলতে হঠাৎ শুনতে পেল, কে যেন বলছে, সাত ঘড়া মোহর নিবি? নাপিত আশ্চর্য হয়ে চারদিক চেয়ে দেখে, কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। সাত ঘড়া টাকা! কম কথা! লোভ হলো। চিৎকার করে বলল, হ্যাঁ নেব। সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য কণ্ঠস্বর বললে, আচ্ছা, তোর বাড়িতে দিয়ে এলাম, নিগে যা। নাপিত বাড়ি গিয়ে দেখে, সত্যিই সাতটা ঘড়া পাশাপাশি। ছটা মোহরে ভর্তি; কিন্তু সপ্তমটায় মাত্র আধ ঘড়া। তা হোক, ছটা তো ভর্তি। এইবার নাপিতের বাসনা এল—প্রবল বাসনা-আধ ঘড়াটাকে ভর্তি করতে হবে। ঘরে সোনাদানা যা ছিল সব ঢেলে দিল। কিছুই হলো না তাতে। এইবার সংসার-খরচ কমিয়ে সেই ঘড়ায় টাকা ঢালতে লাগল। তাতেও কিছু হয় না। সেই আধ ঘড়া তো আধ ঘড়া! নাপিত রাজামশাইকে গিয়ে বলল, আজ্ঞে! সংসার চালাতে পারছি না, যা মাইনে দেন তাতে চলছে না। যদি কিছু ব্যবস্থা করেন! রাজামশাই মাইনে বাড়ালেন, কিন্তু নাপিতের যে-দশা সেই দশা! এইবার সে ভিক্ষায় বেরল। যা পায় সব ঐ ঘড়ায়! ঘড়া তবু ভরে না। একদিন রাজামশাই জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁরে, আগে তুই কম মাইনে পেতিস, তাতে তো তোর বেশ চলত, এখন তোর মাইনে দুনো হয়েছে, তবু তোর চলে না কেন রে? তুই কি সাত ঘড়া মোহর পেয়েছিস? নাপিত থতমত খেয়ে বলল, আজ্ঞে, আপনাকে একথা কে বললে! রাজা বললেন, যে সেসব পায় তার এমনটা হয়! আরে, সে যে যক্ষের ধন, যক্ষটা আমার কাছে এসে বলেছিল, সাত ঘড়া মোহর নেবে? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, এসব ধনদৌলত জমার না খরচের? এই শুনে যক্ষটা পালিয়ে গেল, কোন জবাবই দিল না। শোন, ওসব মোহর কি নিতে আছে? ওর থেকে একটা মোহরও খরচ করার যো নেই, ভাল চাস তো ওগুলো ফিরিয়ে দিয়ে আয়। এইকথা শুনে নাপিত তাড়াতাড়ি সেই জায়গাটায় গিয়ে বলল, এই যে, তোমার মোহরের ঘড়া তুমি নিয়ে যাও, ওসবে আমার কাজ নেই। যক্ষ বলল, আচ্ছা।
এইবার নাপিত বাড়ি ফিরে দেখে, ঘড়াগুলো যেমন ভেলকির মতো এসেছিল তেমনি ভেলকির মতোই যেন চলে গেছে! লাভের মধ্যে এই হয়েছে, তার এতদিনের রক্ত জল করা সঞ্চয়ও ঐ আধ-ভরা ঘড়াটার সঙ্গে হাওয়া!
ঠাকুর বলতেন, বিচার কর, টাকায় কি হয়? একাল কেন সেকালেও বিষয়ীরা বলত, ‘ওরে, টাকায় কী না হয়!’ বরং ঠাকুরের পথ ধরে এই বিচার করা যাক, টাকা না থাকলে কি হয়? অকারণে লোকের দেঁতো খাতিরে উদ্বাস্তু হতে হয় না। বাড়িতে সদাসর্বদা তীর্থের কাকের মতো জ্ঞাতি-গুষ্টি বসে থাকে না। এক গেলাস জল চাইলে পাঁচ গ্লাস তেড়ে আসে না। বাড়িটা ক্রমশই ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স হয়ে ওঠে না। গুরুভোজনে ভরা যৌবনেই রোগের মালগুদাম হতে হয় না। অসময়ে টাক পড়ে না বা চুল পাকে না। রাস্তা দিয়ে টাল খেতে খেতে হেঁটে গেলে কেউ বলে না—ঐ দ্যাখ, আদ্দির পাঞ্জাবি পরা হাতি যাচ্ছে। টাকা না থাকলে ওরা থাকে না, ঐ যারা সকাল-সন্ধ্যে বেড়ে ধরে সঙ্কীর্তন করে—দাদার মতো দাদা নেই! যদ্দিন দাদার কড়ি আছে, এমনি করে ঘিরে ধরে নেচে নিই।
বুঝেছি ঠাকুর। আপনি ঐ কথাটাই বললেন, “However fast you run, you cannot run away from your feet.” বরং আত্মার অসীম নির্জনতায় শান্ত হয়ে বসি। আপনি আমার সামনে এক হাত দূরে বসুন। পাশে যেন আপনার দুঃখ-সুখের সাথী মা জননী থাকেন। তিনি বলবেন, সাধক দেখতে চাস? এই দেখ। সংগ্রাম দেখতে চাস? এই দেখ। প্রেম দেখতে চাস? এই দেখ। ঠাকুর মৃদু মৃদু হাসবেন। তারপর তিনি বলবেন, মা দেখতে চাস? এই দেখ।
তখন আমি শ্রেষ্ঠ দুটি সযত্নে চয়িত ফুল তাঁদের পায়ে রাখব, একটির নাম বোধ অপরটির নাম বুদ্ধি। তারপর প্রার্থনা করব—এবার আমার নতুন সংস্কার গড়ে দিন।