‘সংসার করতে দোষ কি?’

‘সংসার করতে দোষ কি?’

শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন : আমি বলি যে, সংসার করতে দোষ কি? তবে সংসারে দাসীর মত থাক। (১-১০-৮) ঠাকুর আর এক জায়গায় বলছেন, এ যেন দুর্গের মধ্যে থেকে তুমি লড়াই করছ। কোন্‌ অর্থে সংসারে থাকলে দুর্গের মধ্যে থাকা? অর্থাৎ সংসারে থাকলে সেখানে আত্মীয়স্বজন আছে, প্রতিবেশীরা আছে, নিয়মবিধি আছে ; সেখানে আমি ভুল করলে আমার হয়তো নিকট-আত্মীয় যারা তারা আমাকে সাবধান করে দিচ্ছে—না, এরকম কোরো না। আমি তাদের দেখে শিখছি, আমার যাঁরা বড়, আমার যাঁরা গুরুজন তাঁদের দেখেও আমি শিখছি। সংসারের বাইরে থাকলে আমি হয়তো ‘ঠেকে’ শিখব, কিন্তু সংসারে আমি ‘দেখে’ শিখতে পারি। একটা পাঁচিল দিয়ে আমাকে যেন রক্ষা করা হয়েছে, যাতে বাইরের-আক্রমণ থেকে আমি নিজেকে বাঁচাতে পারি।

কিন্তু যে সংসার ত্যাগ করেছে তার ক্ষেত্রে উপরে শুধু ভগবান আর নীচে সে নিজে। আর রয়েছে তার বিবেক—তার নিজের বিচারবুদ্ধি। কিন্তু আমাদের মন তো বড় পাজি জিনিস। অনেক সময় মন আমাদের এমন ভুল বোঝায় যে, ভাল-মন্দ ঠিক করতে পারি না। ভাল ভেবে মন্দটাই করে বসি। সংসারে থাকলে, আমি বুঝতে না পারলেও আমার হিতৈষীরা অনেক সময় আমার ভুলটা ধরিয়ে দেন। কিন্তু সংসারের বাইরে যে আছে তার এই সুবিধে নেই। সে নিজে ছাড়া তার আর কোন সহায় নেই, বন্ধু নেই। তার বিবেক, তার আত্মবিশ্বাস, তার ঈশ্বরনির্ভরতা এসব যদি প্রবল না হয়, তাহলে পতনের ভয় থাকে। খুব কঠিন পথ। অল্প কয়েকজনের জন্য। ঠাকুর সেইজন্য বলছেন : দুর্গের মধ্যে থেকে লড়াই কর। খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করার চেয়ে দুর্গের ভেতর থেকে যুদ্ধ করা সহজ। তেমনি, সংসারের বাইরে বেরিয়ে তাঁকে ডাকার চেয়ে সংসারের মধ্যে থেকে তাঁকে ডাকা অনেক সহজ। ঠাকুর ‘কথামৃতে’ গল্প করছেন। একজন সংসার ত্যাগ করবে ঠিক করেছে। তার স্ত্রী এসে তাকে বোঝাচ্ছে : আচ্ছা, তুমি আমার কয়েকটা কথার উত্তর দাও। সংসার তুমি কেন ছাড়তে যাচ্ছ? ভগবানকে ডাকবে বলেই তো? তুমি এখানে থেকেই যত ইচ্ছা তাঁকে ডাক না কেন—আমি তোমাকে কোন রকম বিরক্ত করব না। আর সন্ন্যাসী হলে তো তোমাকে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করে বেড়াতে হবে। তা, সাত দুয়ারে ভিক্ষে না করে তুমি বরং আমার কাছেই রোজ ভিক্ষে নাও। তাহলেই তোমার সংসারে থেকেও সংসারের বাইরেই থাকা হল।

এ থেকে কেউ যেন মনে না করেন যে ঠাকুর সন্ন্যাসের নিন্দা করছেন। ঠাকুর নিজে তো সন্ন্যাসীর রাজা। ত্যাগসম্রাট তিনি। আমাদের শাস্ত্রেও বলা আছে ; যখনই ঠিক ঠিক বৈরাগ্য জাগবে তখনই সংসার ত্যাগ করবে। কিন্তু এও দেখা যায়, প্রতি যুগে খুব অল্পসংখ্যক লোকের মনেই সেরকম বৈরাগ্য জাগে। সন্ন্যাস অত্যন্ত কঠিন আদর্শ। খুব মুষ্টিমেয় লোকেই এ পথে যেতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ধর্ম মুষ্টিমেয়ের জন্য। ধর্মজীবন সকলের জন্য। সংসারে যাঁরা থাকবেন তাঁরাও ধর্মজীবন যাপন করবেন। ঠাকুর সেটাই বারবার করে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন : সংসারে আছ বলেই তুমি হতাশ হয়ো না, ঈশ্বরলাভ মানুষের জীবনের লক্ষ্য। সংসারে থেকেও সেই লক্ষ্যে পৌঁছনো যায়। তাই যাঁরা সংসারে আছেন, তাঁদের ঠাকুর সংসার ত্যাগ করতে বলছেন না—‘দাসীর মতো’ সংসারে থাকতে বলছেন অর্থাৎ অনাসক্ত হয়ে থাকতে বলছেন। মনের ত্যাগই তো প্রকৃত ত্যাগ। সেই ত্যাগের উপর ঠাকুর জোর দিচ্ছেন। একজন হয়তো সংসারে নেই, কিন্তু তার মনে ভয়ানক বাসনা। তাহলে? তাহলে কি সেটা ত্যাগ হল? মনে যদি বাসনা থেকে থাকে, তাহলে ত্যাগ হয়নি তার। গীতায় বলছে :

কর্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরন্‌ ॥

ইন্দ্রিয়র্থান্‌ বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে ॥

—বাইরে ত্যাগ করেছে, কিন্তু মনে মনে সে বিষয়চিন্তা করছে। এরকম লোক মূঢ়, মিথ্যাচারী। কিছু না থাকাটাই যদি ত্যাগ হয়, তাহলে ফুটপাথে যে ভিক্ষুক আছে, সে-ই তো সব থেকে বড় ত্যাগী। কিন্তু আমরা কি দেখি? তার হয়তো কয়েকটা ভাঙা টিন আর ছেঁড়া নেকড়া সম্বল, তাই নিয়েই হয়তো সে আর একজন ভিক্ষুকের সঙ্গে মারামারি করছে। এ থেকেই বোঝা যায়, ত্যাগ জিনিসটা বাইরের নয়। ত্যাগ হচ্ছে ভিতরের, মনের। আমার যদি কোন জিনিসের প্রতি আকর্ষণ থেকে থাকে, তাহলেই বুঝতে হবে যে, ত্যাগ হয়নি আমার। তাই শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন : আমি বলছি না তুমি সংসারে থেকো না। তবে তোমার কোন জিনিসের প্রতি যে আকর্ষণ সেটাকে তুমি বর্জন করতে চেষ্টা কর। বলছেন : অনাসক্ত হয়ে সংসারে থাক, বড়লোকের বাড়ির দাসীর মতো থাক। দাসী⋯মনিবের বাড়িকে দেখিয়ে মুখে বলে, ‘আমাদের বাড়ি’। মনে জানে যে ওবাড়ি আমাদের নয়, আমাদের বাড়ি সেই পাড়াগাঁয়ে। আবার মনিবের ছেলেকে মানুষ করে, আর বলে, ‘হরি আমার বড় দুষ্টু হয়েছে’ আমার হরি মিষ্টি খেতে ভালবাসে না।’ ‘আমার হরি’ মুখে বলে বটে, কিন্তু জানে যে, হরি আমার নয়, মনিবের ছেলে। (ঐ) আসলে তার ছেলে হয়তো কোন্‌ পাড়াগাঁয়ে আছে, সে হয়তো তার খববই রাখতে পারে না।

তারপরে বলছেন : তাই যারা আসে, তাদের আমি বলি, সংসার কর না কেন, তাতে দোষ নাই। তবে ঈশ্বরেতে মন রেখে কর, জেনো যে বাড়ি ঘর পরিবার আমার নয় ; এ সব ঈশ্বরের। আমার ঘর ঈশ্বরের কাছে। আর বলি যে, তাঁর পাদপদ্মে ভক্তির জন্য ব্যাকুল হ’য়ে সর্বদা প্রার্থনা ক’রবে। (ঐ) এটাই হচ্ছে মোক্ষম কথা—সংসারে নির্লিপ্ত হয়ে থাকতে হবে, অনাসক্ত হয়ে থাকতে হবে। কিন্তু অনাসক্তিটা কি? অনাসক্তি আর কিছু না, ঈশ্বরের প্রতি ‘আসক্তি’ই হচ্ছে অনাসক্তি। কারণ, যদি ঈশ্বরের পাদপদ্মে মন যায়, তাহলে আপনা-আপনিই সংসার থেকে মনটা ‘দূরে সরে আসে। ভগবানের দিকে আমরা যতই এগিয়ে যাই সংসার ততই পিছনে পড়ে থাকে। শ্রীশ্রীঠাকুরের কথা : তুমি যতই পূবদিকে এগিয়ে যাবে, পশ্চিম ততই পিছনে পড়ে থাকবে। অর্থাৎ ঈশ্বরের দিকে এগিয়ে যাও, ঈশ্বরকে ভালবাস, তাঁকে আপনার করে নাও। তাহলে দেখবে সংসার আপনা-আপনিই পিছিয়ে থাকবে।

অনেকে মনে করেন, ত্যাগ মানে, আমি পান খাই, এই পান খাওয়াটা আমাকে ত্যাগ করতে হবে ; সুপুরি খাব শুধু। তারপরে সুপুরিটাকেও ত্যাগ করতে হবে। এটাকে ত্যাগ বলে না। ত্যাগ বৈরাগ্য এগুলো কোন নেতিবাচক জিনিস নয়। ত্যাগ মানে গ্রহণ, ঈশ্বরকে গ্রহণ। বৈরাগ্য মানে ঈশ্বরে অনুরাগ। ঈশ্বরে অনুরাগ হলেই বিষয়ে বিরাগ আপনা-আপনি এসে যাবে। তখন আমি পান খেলাম কি খেলাম না—তাতে কিছু এসে যায় না। তাই ঠাকুর বলছেন : ঈশ্বরকে ভালবাস। যতই তুমি ঈশ্বরকে ভালবাসতে থাকবে ততই তোমার কাছে সংসার ‘আলুনী’ মনে হবে, বিষয় ‘বিষ’ মনে হবে। আপনা-আপনি তখন সবকিছু ত্যাগ হয়ে যাবে। সেটাই প্রকৃত ত্যাগ।

সংসার সম্বন্ধে ঠাকুর বলছেন যে, যতক্ষণ তাঁকে না জানা যায়, ততক্ষণ (সংসার) মিথ্যা। (১-৯-১) এটাই বড় আশ্চর্য ব্যাপার। আমরা ঈশ্বরের দিকে মন দিতে চাই না। কিন্তু এটা বুঝি না যে, ঈশ্বরের দিকে মন দিই না বলেই সংসার আমাদের এত দুঃখ দেয়। তাঁকে জানি না বলেই সংসার আমাদের মোহগ্রস্ত করে রাখে। তখন তাঁকে ভুলে মানুষ ‘আমার আমার’ করে। (ঐ) মায়ায় বদ্ধ হয়ে বিষয়ে মুগ্ধ হয়ে মানুষ আরও ডোবে মায়াতে এমনই মানুষ অজ্ঞান হয় যে, পালাবার পথ থাকলেও পালাতে পারে না! (ঐ) কতরকম উপমা দিয়ে ঠাকুর বোঝাচ্ছেন যে, সংসার আমাদের কিভাবে মুগ্ধ করে রেখে দেয়। বলছেন : উট যেমন কাঁটাঘাস খায়, খেতে খেতে মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে, তবুও সে কাঁটাঘাস খেয়ে যাচ্ছে। সংসার এরকম কষ্ট দেয়, ব্যথা দেয়, তবুও আবার সেই সংসারের প্রতি মানুষের কত আকর্ষণ। আবার খুব নিষ্করুণ ভাষায় বলছেন : সংসারটা কিরকম জান? মেছুনীর মেয়ে, মাছের গন্ধ তার খুব ভাল লাগে। একদিন সে কোথায় গেছে বেড়াতে ; সেখানে গিয়ে যেখানে সে শুয়েছে, তার কাছেই ফুলের বাগান। সুন্দর ফুলের গন্ধ আসছে, কিন্তু তার ঘুম আসছে না। ফুলের গন্ধে তার কষ্ট হচ্ছে। সে উঠে পড়ল। বাড়ির লোককে বলে তার মাছের ঝুড়িটা আনাল। তারপর সেই ঝুড়িতে জল ছিটিয়ে দিল, অমনি ভুরভুর করে মাছের গন্ধ বের হতে লাগল আর সে আরামে ঘুমিয়ে পড়ল। আঘাত দিয়ে কথা বলছেন ঠাকুর। সংসারের স্বরূপটা আমাদের চিনিয়ে দিচ্ছেন, বলছেন : সংসারের আকর্ষণ এইরকম।

ঠাকুর যেটা বলতে চাইছেন সেটা হচ্ছে এই যে, সংসারকে জেনে তুমি সংসার কর। আমরা যদি ধরেই নিই যে, সংসার অতি মধুর জায়গা, সুন্দর জায়গা, তাহলে আমরা দুঃখ পাব। আমাদের ধর্মগ্রন্থে দেখি সংসারকে বলা হচ্ছে ‘ভব-অটবী’—একটা বন এটা। আবার বলছে : ‘সংসার-অর্ণব’—সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করছে সংসারকে। মানুষ এই সংসারে পথ হারিয়ে ফেলে, দিশেহারা হয়ে যায়। তাই সংসারের চরিত্রটা প্রথমে জেনে নেওয়া দরকার। মনে রাখতে হবে সংসারে কিছু আনন্দ আছে বটে, কিন্তু দুঃখও আছে প্রচুর। তবে কোনটাই স্থায়ী নয়—সুখ বা দুঃখ দুটোই ক্ষণিক। সংসারে যে আছি সেটাই তো ক্ষণিক। জন্ম আর মৃত্যু এই দুয়ের মাঝে এ একটা সেতু। এই সেতু বেয়ে আমি চলেছি—কিছুক্ষণ বাদেই পার হয়ে যাব। এই সেতুটাকেই যদি আমি আবাসস্থল মনে করি তাহলে ভুল করব। আবার বলা হচ্ছে : এ যেন একটা সরাইখানা। তুমি এখানে আছ রাতটুকুর জন্য। কোথাও যাচ্ছিলে, রাতটুকুর জন্য এখানে বিশ্রাম করছ, কাল সকালেই চলে যাবে গন্তব্যস্থলে। আবার বলছে : এ যেন একটা রঙ্গমঞ্চ, আমরা এখানে সবাই অভিনয় করছি। একজন রাজার ভূমিকায় অভিনয় করছে। ভালো চেহারা, তাই রাজা সাজানো হয়েছে—আসলে হয়তো সে খুবই গরীব, দুবেলা খেতেই পায় না। কিন্তু যখন সে রাজা সেজেছে তখন কথাবার্তা আচার-আচরণে সে পুরোপুরি রাজা। যে তার সেনাপতি সেজেছে, যে তার হুকুম তামিল করছে, বাইরের সমাজে সে-ই হয়তো ধনী ব্যক্তি, প্রভাবশালী ব্যক্তি। কিন্তু যতক্ষণ অভিনয় চলছে, ততক্ষণ সে রাজার কাছে অবনতমস্তক। সংসারে আমরাও যেন এক একজন এক এক ভূমিকায় অভিনয় করছি। আমরা যদি এটা মনে রাখতে পারি যে, সংসারে আছি দুদিনের জন্য, সংসারে আমার যা ভূমিকা সেটা আমার আসল পরিচয় নয়, আমার আসল পরিচয় হচ্ছে আমি ঈশ্বরের সন্তান, ঈশ্বরের আশ্রিত কিংবা আমি নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মা—তাহলে সংসারের প্রতি আকর্ষণটা অনেক কমে যায়।

বাস্তবিক, আমরা তো এই ভুলটাই করি। অহরহ দেখতে পাচ্ছি চারদিকে মৃত্যু, তবু নিজে যে একদিন মরব সেকথা ভাবি না, ভাবতে চাই না। মহাভারতে আছে, যুধিষ্ঠিরকে ধর্ম জিজ্ঞাসা করছেন : আচ্ছা বল দেখি, এই সংসারে সবচেয়ে বড় আশ্চর্য কি? যুধিষ্ঠির উত্তর দিচ্ছেন : সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে, আমরা আমাদের চারধারে এত মৃত্যু দেখছি, তবু আমরা কেউ ভাবি না যে, আমাদেরও মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আমরা ধরেই নিই যে, সংসার চিরকাল থাকবে, আমি চিরকাল থাকব, আমার এই রূপ চিরকাল থাকবে, আমার এই যৌবন চিরকাল থাকবে, আমার এই স্বাস্থ্য, অর্থ, মান-মর্যাদা চিরকাল থাকবে। আর সেইজন্যই আমাদের এতটা দুঃখ পেতে হয়। ঠাকুর সেটাই বোঝাতে চাইছেন। বলছেন : সংসার এই আছে এই নাই। অনিত্য! যাদের এতো ‘আমার আমার’ করছো চোখ বুজলেই নাই। কেউ নাই, তবু নাতির জন্য কাশী যাওয়া হয় না। ‘আমার হারুর কি হবে?’…এরূপ সংসার মিথ্যা, অনিত্য। (ঐ) আমরা দেখি একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী যতক্ষণ ক্ষমতায় আছেন ততক্ষণ তাঁর কত সম্মান, কত খাতির। কিন্তু চাকরি থেকে অবসর নেবার পর কেউ তাঁর দিকে ফিরেও তাকায় না। পশ্চিমবঙ্গের একজন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, তিনি যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন তাঁর বাড়ির সামনে কত গাড়ি, তাঁর জন্মদিনে কত ফুল আর কত রকমের উপঢৌকন। তারপর যখন তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্ব গেল, তখন আর কেউ তাঁর খবর রাখে না, তাঁর জন্মদিনের কথাও কেউ আর মনে রাখে না। আবার মজা হয়েছে : যখন তিনি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন একজন তাঁকে কিছু মিষ্টি পাঠিয়েছিলেন। যখন তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্ব গেল তখন সেই ভদ্রলোকই সেই মিষ্টির বিল আবার তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সংসার হচ্ছে এইরকম। এইরকম নিষ্ঠুর, এইরকম রূঢ়, এইরকম কঠিন।

ঠাকুর এ কথাটা বোঝাতে চাইছেন এইজন্য যে, এটা মনে না রাখলে দুঃখ পেতে হবে বেশি করে। বলছেন : দেখ না, নরেন্দ্র কি মুশকিলেই পড়েছে। বাপ মারা গেছে, বাড়িতে খেতে পাচ্ছে না,—কাজ-কর্মের এত চেষ্টা ক’রছে, জুট্‌ছে না—এখন কি করে বেড়াচ্ছে দেখো। (১-১১-১) ঠাকুরের কাছে আসার প্রায় দুবছর পরে, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে নরেন্দ্রের পিতৃবিয়োগ হয়। বি.এ. পরীক্ষা দিয়েছিলেন, সবে তার ফল বেরিয়েছে, এই সময় হঠাৎ তাঁর বাবার মৃত্যু হল। বাবা খুবই ধনী ছিলেন। কিন্তু টাকাপয়সা কিছুই সঞ্চয় করে রেখে যাননি। তার ফলে নরেন্দ্রকে খুবই আর্থিক কষ্টে পড়তে হয়। রোজ খাওয়াও জুটত না, এরকম অবস্থা। ঠাকুর সেইকথাই বলছেন এখানে। নরেন্দ্রকে এত ভালবাসেন ঠাকুর, তার দুঃখ ঠাকুরের বুকে লাগছে, তবুও সেই নরেন্দ্রকেই তিনি উদাহরণ হিসাবে দেখাচ্ছেন, বলছেন। এই হচ্ছে সংসার, এই আকর্ষণে আমরা ছুটছি।।

অনেকে হয়তো বলতে পারে, পাশ্চাত্যদেশের লোকেরা যেমন বলেন, হিন্দুধর্মে সবসময় একটা বিষাদের ভাব ; এ সংসার মিথ্যা, মৃত্যু অনিবার্য, ইত্যাদি ইত্যাদি—নৈরাশ্যবাদ। কিন্তু আসলে নৈরাশ্যবাদ নয়। হিন্দুধর্ম বলছে—যা সত্য তাকে স্বীকার করে নিয়ে তুমি সংসারে থাক। আনন্দ কর, ভোগ কর, কিন্তু ভোগ করা মানে এই নয় যে, বেপরোয়াভাবে ভোগ করবে। ভোগেরও কতগুলো নিয়মকানুন আছে। আমার রসগোল্লা ভাল লাগে, আমি যদি একসঙ্গে পাঁচ হাঁড়ি রসগোল্লা খেয়ে ফেলি, তাহলে তো তক্ষুনি আমাকে ডাক্তারের কাছে ছুটতে হবে। সেইজন্যই সংযতভাবে একটা নিয়মের মধ্যে থেকে ভোগ করতে হয়।

প্রাচীন ভারতবর্ষে ব্যবস্থা ছিল, প্রথমে গুরুগৃহে বাস, ব্রহ্মচর্য। অর্থাৎ গুরুগৃহে বাস করে জীবনের কি উদ্দেশ্য সেই সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করার পর সংসার করা। আমি সংসারের স্বরূপ জেনে নিলাম, জীবনের উদ্দেশ্য জেনে নিলাম, তারপর সংসার করলাম। ঠাকুর বলছেন : এভাবে সংসার করলে দোষ নেই। হিন্দুধর্ম ভোগ করতে নিষেধ করছে না। বলছে : ধর্মসঙ্গতভাবে ভোগ কর, সংযতভাবে ভোগ কর। আর সংসারের চরিত্রটা সবসময় মনে রেখো। তা না হলে তোমাকে দুঃখ পেতে হবে বেশি করে। ঠাকুর যেটা বলতে চাইছেন সেটা হচ্ছে এই যে, সংসারকে জেনে তুমি সংসার কর।

বলছেন : তাঁকে জেনে সংসার করলে অনিত্য নয়। (১-৯-১) যে তাঁকে জেনেছে, সে দেখে যে জীব-জগৎ সে তিনিই হয়েছেন।(১-৯-২) অনেকবার একটা উপমা দিয়েছেন, বলছেন : একটা গাছ পোঁতা হল, তাতে যদি বেড়া দেওয়া না হয়, তাহলে গরু-ছাগলে গাছটাকে খেয়ে ফেলে। বেড়া দাও। যখন সেই গাছটা বড় হবে, শক্ত হবে, তখন তার গায়ে একটা হাতী বেঁধে রাখ, তাতেও গাছের কোন ক্ষতি হবে না। অর্থাৎ আমাদের বুদ্ধি, বিবেচনা, বিবেক, এগুলি যখন বেশ একটু পাকা হবে, তখন সংসারে আর আমাদের কিছু ক্ষতি করতে পারবে না। আসল কথা, ঈশ্বরে অনুরাগ নিয়ে সংসারে প্রবেশ করা। তাহলেই আর কোন কিছুতে জড়িয়ে যাব না। তাঁর সেই বিখ্যাত উপমা : হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙ। বলছেন :হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙ্গলে হাতে আঠা লাগে না। চোর চোর যদি খেল বুড়ি ছুঁয়ে ফেললে আর ভয় নাই। (১-৮-২) অর্থাৎ ঈশ্বরানুরাগের তেল মেখে সংসারে প্রবেশ করলে আর জড়িয়ে পড়বার ভয় থাকে না। ঠাকুরের এই যে উপদেশ, তা কোন্‌ নিষেধাত্মক জিনিস নয়। সংসার মিথ্যা, অনিত্য, স্বপ্নবৎ, তাই ত্যাগ কর—এইসব বলছেন না। আমাদের শাস্ত্রও একথা বলছে না। শাস্ত্র বলছে : ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ। ধর্ম আগে, তার পরে অর্থ এবং কাম। ধর্ম হল ভিত্তি। বলছে : ঈশ্বরনির্দেশিত পথে, ধর্মানুমোদিত পথে নিশ্চয়ই ভোগ করবে, মনে এক রেখে মুখে আর এক বলা ধর্ম নয়। শাস্ত্রনির্দেশিত এই চতুর্বর্গের সব শেষে হচ্ছে মোক্ষ। ঠাকুরও এই উপদেশ দিচ্ছেন। যাঁদের উপদেশ দিচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশই সংসারী লোক। তাঁদের যা উপযোগী, তা-ই তিনি বলছেন। এ সংসার ‘ধোঁকার টাটি’ প্রসাদ (অর্থাৎ রামপ্রসাদ) বলেছিল। তাঁর পাদপদ্মে ভক্তি লাভ করলে—এই সংসারই মজার কুটি, আমি খাই-দাই আর মজা লুটি। (১-২-৬) ঈশ্বরে ভক্তি-বিশ্বাস হলে সংসার আর মিথ্যে বলে মনে হয় না। কারণ, তখন সংসারকে আমি ঈশ্বরের প্রকাশ হিসেবে দেখছি। সংসার তখন দুঃখের নয়—আনন্দের জায়গা। আসল কথা হচ্ছে, লক্ষ্যটা স্থির রেখে চলা। একজন নৌকো করে যাচ্ছে নদীতে, কোন্‌ দিকে যাচ্ছে, নৌকোটাকে কোন্‌ মুখে রেখেছে—সেটা খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের এক স্বামীজী বলতেন, টিকিট তো কেটেছি আর ট্রেনেও চেপেছি, এখন আর ভাবনাটা কি? অর্থাৎ আমার গন্তব্যস্থল ঈশ্বরলাভ। আমি ঈশ্বরলাভ করতে চাই, সেইজন্য টিকিট কেটেছি—নিজেকে আমি প্রস্তুত করেছি। ট্রেনেও চেপেছি অর্থাৎ আমি একজন সদ্‌গুরুর আশ্রয় পেয়েছি। কাজেই ভাবনা কিছু নেই। আজই হোক বা একশ বছর পরেই হোক আমার গন্তব্যস্থলে আমি পৌঁছবই, ঈশ্বরলাভ করবই। কারণ, লক্ষ্যটা আমার ঠিক আছে। তাই শ্রীশ্রীঠাকুর,বলছেন : জীবনের লক্ষ্যটা মনে রেখে তুমি সংসারে থাক। জীবনের লক্ষ্য ঈশ্বরলাভ। ঈশ্বরকে মনে রেখে আমি সংসারে আছি, সংসারের সব কর্তব্য পালন করছি। আমার যা কিছু কর্মপ্রচেষ্টা সবকিছুর মধ্য দিয়ে আমি তাঁরই দিকে এগিয়ে চলেছি। আমার কোন বাসনা নেই, স্বতন্ত্র কোন ইচ্ছা নেই। তাঁর ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। তিনি আমাকে যেভাবে সংসারে রেখেছেন, যতদিন রেখেছেন, তাতেই আমি খুশি।

ঠাকুরের একটা কথা ‘কথামৃতে’র অনেক জায়গায় আছে যে, মোড় ফিরিয়ে দাও। খুব বাস্তব একটা কথা, মনোবিজ্ঞান-সম্মত কথা। আমার মনটা ভোগের দিকে ছুটছে, সেটাকে ঈশ্বরের দিকে ঘুরিয়ে দেব। মনের সব চিন্তা, সব বৃত্তির মোড় ফিরিয়ে দেব, বিষয় থেকে ঘুরিয়ে ঈশ্বরমুখী করে দেব। বাইরের কাজটাকে পালটাতে হবে না। যে মন দিয়ে কাজ করছি সেটাকে ঈশ্বরমুখী করে দিতে হবে। আমি রান্না করছি, অফিসে চাকরি করছি, দোকান চালাচ্ছি—সবকিছু করব আমি। তবে সব ঈশ্বরের উদ্দেশে করব। এই যে বিষয়, সেটা ‘নির্বিষয়’ হয়ে যায়, যদি এই ভাবটা অবলম্বন করা যায়। আমি ভাইকে ভালবাসি, বোনকে ভালবাসি, বন্ধুকে ভালবাসি—সবকিছুর মধ্য দিয়ে আমি ঈশ্বরকে ভালবাসি। স্বামীজী এক জায়গায় বলছেন যে, উপনিষদ্‌ কি করে? উপনিষদ্‌ একজন শিক্ষককে আরও ভাল শিক্ষক করে তোলে। একজন জেলেকে আরও ভাল জেলে হতে সাহায্য করে। বাস্তবিক, ধর্ম কর্তব্যবিমুখতা শেখায় না। অলস হয়ে বসে আছি, জীবনযুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি—সেটা ধর্ম না। ‘ক্লৈব্যং মাস্ম:গমঃ। ধর্ম বলে তুমি ক্লীব হয়ো না। কর্তব্যে অবহেলা কোরো না। যেটা করছ, আরও ভাল করে করতে চেষ্টা কর। কেননা, তুমি তো সবকিছুই ঈশ্বরের উদ্দেশে করছ। ফাঁকি দেবে কেন? অবহেলা করবে কেন? এটা সকলেই জানেন যে, রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুরা কেউ টাইপ করছেন, কেউ স্কুলে পড়াচ্ছেন, কেউ বাগানে কাজ করছেন, কেউ গ্রন্থ-প্রকাশনার কাজ করছেন, কেউ হাসপাতালে ওষুধ দিচ্ছেন, ইত্যাদি। সাধারণ গৃহস্থ যাঁরা তাঁদের সঙ্গে তফাৎটা কি হল? তফাৎটা হল এই যে, সাধুরা ঐ মোড় ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা যা কিছু করছেন সব ঈশ্বরের উদ্দেশে। কাজের মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনা করছেন। যেমন মন্দিরে গিয়ে উপাসনা করা হয়, তেমনি তাঁরা কাজের মাধ্যমে ঈশ্বরের উপাসনা করছেন। কাজটাই তাঁদের ক্ষেত্রে উপাসনা হয়ে গেছে। স্বামীজী এটাকেই বলেছেন : Work is worship. গীতায় শ্রীকৃষ্ণও অর্জুনকে বলছেন :

যৎ করোষি যদশ্নাসি. যজ্জুহোষি দদাসি যৎ।

যৎতপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম্‌ ॥

—তুমি যা কিছু করছ—খাচ্ছ, হোম করছ, দান করছ কিংবা হয়তো তপস্যা করছ—সবকিছুই তুমি আমাকে অর্পণ কর। সংসারে যাঁরা আছেন তাঁরা যদি এই ভাবটা রাখতে পারেন যে, সংসারের সব কাজের মধ্য দিয়ে আমি ঈশ্বরেরই সেবা করছি, তাহলে কাজটা আর কাজ থাকে না, উপাসনা হয়ে যায়। ঠাকুর এই যে বারবার করে বলছেন, কামকাঞ্চন, সেটা আর ‘কামকাঞ্চন’ থাকে না, অন্য জিনিস হয়ে যায়। সংসারের চেহারাটাই তখন বদলে যায়, আনন্দের জায়গা হয়ে যায় সংসারটা।

আমাদের শাস্ত্র কখনও একথা বলছে না যে, সবাইকে সংসার ছেড়ে পালাতে হবে। সংসার ত্যাগ জোর করে হয় না বা যখন-তখন হয় না। একটা অবস্থাতে আপনা-আপনিই সংসার ত্যাগ হয়ে যায়। ঠাকুর বলছেন : যখন ফল পেকে যায় তখন নিজে থেকেই সেটা খসে পড়ে। সংসার আর কোথায়, মনেই তো? মানুষ মনেতেই বদ্ধ মনেতেই মুক্ত। সেই যে গল্প আছে, ‘কৌপীন-কা-ওয়াস্তে’। ‘কথামৃতে’ই আছে সেই গল্প। এক সাধু, তাঁর সম্বল একটা কৌপীন, ইঁদুরে সেই কৌপীন খেয়ে যায়। ইঁদুর তাড়াতে সেই সাধু বিড়াল পুষলেন। বিড়ালের জন্য দুধ চাই। দুধের জন্য পুষলেন গরু। এবার গরুর জন্য জায়গা-জমি, ঘরবাড়ি ইত্যাদি। এভাবে একটার পর একটা—শেষকালে সাধু একেবারে পুরো গৃহস্থ। কৌপীন বাঁচাতে গিয়ে শেষটায় পুরো গৃহী বনে গেলেন সাধু। ত্যাগটা যদি মনের না হয়, তাহলে এরকম হয়। মনের বাসনা থাকলে বাইরের নিবৃত্তিতে কিছু হয় না। যে কোন মুহুর্তে, অতি তুচ্ছ জিনিসকে উপলক্ষ্য করেও ভিতরের বাসনা প্রকাশ পেয়ে যায়। সেইজন্য বলা হয়, সংসার বাইরে নয়, সংসার ভিতরে, আমাদের মনে। সেই সংসার নিজে থেকেই দূরে সরে যায় যখন মানুষ ঈশ্বরের দিকে এগিয়ে যায়। সংসারীদের তাই ঠাকুর বলছেন ; সংসার কেন ত্যাগ করতে হবে? সংসার হচ্ছে নিরাপদ স্থান, দুর্গ। সংসার ত্যাগ করার উদ্দেশ্য তো ঈশ্বরলাভ? তা, সংসারে থেকেই যদি ঈশ্বরলাভ করা যায় তবে সংসার ত্যাগ করার কি দরকার? সংসারে থাক, সব কর। তাতে কোন ক্ষতি নেই। শুধু মোড় ফিরিয়ে দাও।

ঠাকুরের কাছে এসে এক ভক্ত মহিলা বলছেন : আমার কিছুতেই ধ্যান হয় না। ইষ্টকে ভাবতে যাই, ইষ্টের জায়গায় আমার ভাইপোর মূর্তি এসে যায়। ঠাকুর তাঁকে বললেন : তোমার ভাইপোকেই তুমি ইষ্ট মনে কর। মনে কর যে, তোমার ইষ্ট ঐ মূর্তিতে এসেছেন তোমার সেবা নিতে। সেইভাবে চলে সেই মহিলা অল্পদিনের মধ্যেই খুব ভাল ফল পেলেন। এই হচ্ছে মোড় ফিরিয়ে দেওয়া। ঠাকুর বলছেন : ছেলেদের খাওয়াবে, যেন গোপালকে খাওয়াচ্ছো। পিতামাতাকে ঈশ্বর-ঈশ্বরী দেখবে ও সেবা করবে। (১-৯-২) এই সংসারটাকে মন্দির মনে কর তুমি! তোমার আশেপাশে যাঁরা আছেন, তাঁদের মনে কর দেববিগ্রহ। এই ঘরবাড়ি তাঁর, পুত্রকন্যা তাঁর, ধনসম্পত্তি তাঁর, সব তাঁর। তুমি আগলাচ্ছ শুধু। তুমি তাঁর ভৃত্য, তাঁর সেবক। তাঁকে জেনে সংসার করলে বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে প্রায় ঐহিক সম্বন্ধ থাকে না। দুজনেই ভক্ত, কেবল ঈশ্বরের কথা কয়, ঈশ্বরের প্রসঙ্গ লয়ে থাকে। ভক্তের সেবা করে। সর্বভূতে তিনি আছেন, তাঁর সেবা দুজনে করে। (ঐ) তিনি কৃপা করে তাঁর সেবার সুযোগ দিয়েছেন। নানা রূপে, নানা মূর্তিতে তিনি আমার সেবা গ্রহণ করছেন। আমি তাঁর সেবা করছি, তাঁরই জিনিস দিয়ে তাঁকে সেবা করছি—গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো। সেই সেবায় আমি এতটুকু ফাঁকি রাখব না, এতটুকু অবহেলা করব না। কেননা সবই যে তাঁর। আমিও যে তাঁর। ‘আমার’ নয়, ‘তাঁর’। মুখে হয়তো বলব ‘আমার’, কিন্তু আমি মনে মনে জানব, এ সব তাঁর। এই ভাব নিয়ে যদি সংসারে থাকি, তাঁকে কেন্দ্র করে যদি আমরা সংসারে থাকি, তাহলে সব মধুর লাগে, সব ভাল লাগে, সংসারটা আনন্দের সংসার হয়। তাই বলছেন : মোড় ফিরিয়ে দাও। এ যুগের পক্ষে একটা মহৎ কথা বলেছেন ঠাকুর : মোড় ফিরিয়ে দাও।

ঠাকুর বলছেন : সংসারে ঈশ্বরলাভ হবে না কেন? জনক রাজার হয়েছিল।⋯

জনক রাজা মহাতেজা তার বা কিসের ছিল ত্রুটি।

সে যে এদিক ওদিক দুদিক রেখে, খেয়েছিল দুধের বাটি। (১-২-৬)

জনকরাজা এদিক-ওদিক দুদিকই রেখেছিলেন। তিনি মিথিলার রাজা অথচ তিনি ঋষি, তিনি সংসারে আছেন, অথচ তিনি সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসজীবন এবং সংসারজীবন এই দুয়ের সংমিশ্রণ হয়েছিল তাঁর জীবনে। মহাভারতে আছে, শুকদেব তাঁর পিতা ব্যাসদেবকে বলছেন ; আমাকে এমন উপদেশ দিন যাতে আমার মনের পরম শান্তি হয়। আমাকে মোক্ষ উপদেশ দিন আপনি। ব্যাসদেব বলছেন : তুমি মিথিলায় রাজর্ষি জনকের কাছে যাও। তিনি তোমাকে মোক্ষধর্ম বলবেন। রাজর্ষি জনক ধর্মে নিপুণ এবং মোক্ষশাস্ত্রে বিশারদ। তিনি তোমাকে যা বলবেন, সব তুমি নিঃশঙ্কচিত্তে কোরো। তাতে তোমার মনের সমস্ত সন্দেহ দূর হয়ে যাবে। জনক হচ্ছেন আদর্শ জীবন্মুক্ত পুরুষ। আমাদের শাস্ত্রে বলে, আদর্শ হল জীবন্মুক্ত হওয়া। মুক্তি—এক হচ্ছে বিদেহ মুক্তি, অর্থাৎ আমার মৃত্যু হল, সাথে সাথে আমি মুক্ত হয়ে গেলাম। আর একরকম মুক্তি হচ্ছে জীবন্মুক্তি—‘জীবন্‌ এব মুক্তিঃ’, জীবিত অবস্থাতেই মুক্তি। আমার দেহ আছে কিন্তু এই দেহের মধ্যে থেকেও আমি অনাসক্ত হয়ে আছি। সংসারে আছি, পুত্র, কন্যা, আত্মীয়-পরিজন, বিষয়-সম্পত্তি—সবকিছু নিয়েই আছি, কিন্তু কোন কিছুতে আসক্তি নেই, নির্লিপ্ত। এইরকম ছিলেন জনকরাজা। মিথিলা নগরী আগুনে পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু জনকরাজা নির্বিকার। বলছেন :

অনন্তং বত মে বিত্তং যস্য মে নাস্তি কিঞ্চন।

মিথিলায়াং প্রদীপ্তায়াং ন মে কিঞ্চিৎ প্রদহ্যতে ॥

—কী আশ্চর্য! আমার অনন্ত ধনসম্পত্তি, কিন্তু আসলে আমার কিছুই নেই। সমস্ত মিথিলায় আগুন লাগলেও আমার কিছুই পুড়ে যাবে না। অর্থাৎ এই বিশাল রাজ্য, এই অগাধ ধনসম্পত্তি এসবের প্রতি আমার কোন মমত্ববোধ নেই। এসব পুড়ে নষ্ট হয়ে গেলেও আমার কিছুই নষ্ট হবে না। আমি সব অবস্থায় নির্লিপ্ত—এই হচ্ছে আমাদের আদর্শ।

কিন্তু ঠাকুর বলছেন : নির্লিপ্ত হ’য়ে সংসার করা বড় কঠিন। প্রতাপ (ব্রাহ্মনেতা প্রতাপচন্দ্র মজুমদার) বলেছিলেন, ‘মহাশয়, আমাদের জনক রাজার মত। জনক নির্লিপ্ত হ’য়ে সংসার করেছিলেন, আমরাও তাই করবো।’ আমি বললুম, ‘মনে করলেই কি জনকরাজা হওয়া যায়! জনক রাজা কত তপস্যা করে জ্ঞানলাভ করেছিলেন, হেঁটমুণ্ড উর্ধ্বপদ হ’য়ে অনেক বৎসর ঘোরতর তপস্যা ক’রে তবে সংসারে ফিরে গিছলেন।’ (১-৮-২) তোমরা কিছু কর, তবে তো ‘জনক রাজা’ হবে।(১-১২-৪) অর্থাৎ কষ্ট করতে হবে, সাধনভজন করতে হবে। শ্রীশ্রীঠাকুর কোন সময় বলছেন না যে, সংসারে থেকে ঈশ্বরলাভ হবে না। বলছেন : সংসারীর কি উপায় নাই?—হ্যাঁ অবশ্য আছে। (১-৮-২) তবে এটার উপরে জোর দিচ্ছেন যে, কিছুদিন অন্তত তাঁকে ডাকতে হবে, নাহলে হবে না। আর খুব সহজ করে দিচ্ছেন সবকিছু। এমন একটা পথ তিনি বলছেন না যেটা অনুসরণ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব একেবারে। বলছেন : দিন কতক নির্জনে সাধন করতে হয়। নির্জনে করলে ভক্তিলাভ হয়, জ্ঞানলাভ হয় ; তারপর গিয়ে সংসার কর, দোষ নাই। (ঐ) বাড়ির কাছে এমন একটি আড্ডা করতে হয়, যেখান থেকে বাড়িতে এসে অমনি একবার ভাত খেয়ে যেতে পার। (১-১২-৪) খুব বাস্তব প্রস্তাব দিচ্ছেন একটা। বাড়ির কাছেই একটা জায়গা থাকবে। বাড়িতেই খাওয়া-দাওয়া করছ, সব করছ, মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে তুমি সাধনভজন করছ। প্রথম প্রথম নির্জনে গিয়ে ঈশ্বরের ধ্যানচিন্তা একটু বেশি করে করতে হয়। যেন ঈশ্বরের সঙ্গে একটু পরিচয় করিয়ে নিতে হয়। তিনি যে আমার আপনার জন, তিনি যে সবসময় আমাকে আগলে রয়েছেন, আমাকে দেখছেন, তাঁর ওপর যে আমার জোর খাটে—এইটা বোঝার জন্য প্রথম প্রথম একটু বেশি করে তাঁর ধ্যানচিন্তা করতে হয়। একবার তাঁর প্রতি অনুরাগ যদি হয়, তাহলে তখন আমি নিশ্চিন্ত। সংসারে থাকলেও তখন আর আমার কোন ক্ষতি হবে না। এই যে ঠাকুর বারবার করে বলছেন, হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙা—এর মানেটা কি? হাতে তেল মাখা মানেই ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ, ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা, ঈশ্বরই আমার একমাত্র আপনার জন এই বোধ। যদি একবার ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ হয়, তারপরে সংসারে সুখদুঃখ যাই আসুক আমি তা হাসিমুখে বরণ করে নেব, আমার আর ‘আঠা’ লাগবে না অর্থাৎ সংসারের প্রতি আমার যে একটা দারুণ আকর্ষণ সেই আকর্ষণটা কমে যাবে।

কেন ঠাকুর বলছেন, নির্জনে গিয়ে সাধন করতে? কারণ সংসারের ভিতর, বিশেষ কর্মের মধ্যে থেকে, প্রথমাবস্থায় মন স্থির করতে অনেক ব্যাঘাত হয়। (১-২-৬) উত্তরগীতাতে বলা হচ্ছে : ‘পুত্ৰদারাদিসংসারো যোগাভ্যাসস্য বিঘ্নকৃৎ’। দারা-সুত-পরিবারের এই সংসার যোগ-অভ্যাসের পক্ষে বিঘ্নকর। স্ত্রী-পুত্র ইত্যাদি রয়েছে বলে সংসারে থেকে যোগ-অভ্যাস করতে অসুবিধে হয়। কিন্তু নির্জনে গেলে সেসব বিঘ্ন নেই। সেখানে সহজেই ঈশ্বরের দিকে মন দেওয়া যায়। সেইজন্য নির্জনে থেকে মাঝে মাঝে ভগবানের জন্য সাধন করতে হয়! (ঐ) মনের সম্বন্ধে বলা হচ্ছে : ‘মনস্তু প্রবলং নিত্যং সবিকারং স্বভাবতঃ’। মন নিত্যই প্রবল —শক্তিশালী। তার ওপর মানুষের কোন হাত নেই। আবার সেই মন স্বভাবতই বিকারযুক্ত। এই আমি খুব খুশি, আবার পরক্ষণেই একেবারে দমে গেছি। এই খুব উচ্চ চিন্তা করছি, আবার পরক্ষণেই এমন চিন্তা মনে উঠছে যা দেখে নিজেই আঁতকে উঠছি। এইরকম উত্থান-পতন—তরঙ্গের মতো। ঠাকুর উদাহরণ দিচ্ছেন, হাতির স্নান। ‘কুঞ্জরশৌচবৎ’। ‘কুঞ্জর’ মানে হাতি। হাতি কাদা মেখে আছে। তাকে নদীতে নিয়ে যাওয়া হল। স্নান করে পরিষ্কার হল। আবার নদী থেকে উঠেই ধুলোতে সে একটু গড়াগড়ি দিয়ে নিল—যে-কে-সেই। কিন্তু সেই হাতিকে স্নান করিয়ে কোন রকমে একবার যদি জোর করে ঘরের মধ্যে ঢোকানো যায়, তাহলে আর কোন ভাবনা নেই। তেমনি মনকে যদি কোন রকমে একবার ঈশ্বরের পাদপদ্মে এনে বসানো যায় তাহলে সব হয়। কিন্তু তা তো আসতে চায় না। সেইজন্য প্রথমটায় একটু নির্জনে সাধনা করলে ভাল হয়। ঠাকুর বলছেন : (সংসারে) যে ঘরে বিকারী-রোগী, সেই ঘরেই আচার, তেঁতুল আর জলের জালা ! (অর্থাৎ চারপাশে বিষয়) ⋯এতে কি বিকার রোগ সারে? (বিকার রোগ অর্থাৎ সংসারের প্রতি আসক্তি। বিষয়ের মধ্যে সবসময় থাকলে কি সংসারাসক্তি যায়?) দিন কতক ঠাঁইনাড়া হয়ে থাকতে হয়, যেখানে আচার-তেঁতুল নাই, জলের জালা নাই। তারপর নীরোগ হয়ে আবার সেই ঘরে এলে (অর্থাৎ ঈশ্বরের পাদপদ্মে ভক্তিলাভ করলে, সংসারাসক্তি চলে গেলে) আর ভয় নাই। (১-১২-৪) সেইজন্য বলছেন : বেড়া দিতে হয়। যেমন ফুটপাথের গাছ ; যখন চারা থাকে, বেড়া না দিলে ছাগল-গরুতে খেয়ে ফেলে। প্রথমাবস্থায় বেড়া দিতে হয় ; গুঁড়ি হলে আর বেড়ার দরকার থাকে না। তখন গুঁড়িতে হাতী বেঁধে দিলেও কিছু হয় না।(১-২-৬) তেমনি প্রথম প্রথম মনের চারপাশেও একটা ‘বেড়া’ দিতে হয়। মনে একটা সদ্ভাব জেগেছে—সেটা যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হয়। একটা শ্লোকে বলা হচ্ছে :

অঙ্কুরো ভক্তিবৃক্ষস্য ভক্তসঙ্গেন বর্দ্ধতে।

পরং হরিকথালাপ-পীযূষসেচনেন চ ॥

—ভক্তিবৃক্ষের অঙ্কুর রয়েছে আমার মধ্যে। তাকে বড় করে তুলতে হবে। সে যাতে ফুলে-ফলে পুষ্ট হয়ে উঠতে পারে, শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে দিতে পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে। কিভাবে সেটা সম্ভব হবে? যদি আমি ভক্তসঙ্গ করি, আর হরিকথারূপ অমৃত তাতে সেচন করি। ঠাকুর এক জায়গায় বলছেন :সংসারে ঈশ্বরলাভ হবে না কেন, নিশ্চয়ই হবে। তবে তার জন্য কতগুলি জিনিস করতে হয় ; মাঝে মাঝে নির্জনে বাস ; তাঁর নাম গুণগান, বস্তু-বিচার ; এইসব উপায় অবলম্বন করতে হয়। (১-১-৫) বস্তুত, এগুলি হচ্ছে ‘বেড়া’। নির্জনে বাস, ঈশ্বরের নাম গুণগান আর বস্তুবিচার। বস্তুবিচার অর্থাৎ সৎ-অসৎ বিচার, ভাল-মন্দ বিচার, শ্রেয়-প্রেয় বিচার। কতগুলি জিনিস আছে যা আপাত-সুখকর—কিন্তু পরিণামে দুঃখকর। সেগুলি প্রেয়। আবার কতগুলি জিনিস আছে, এখন হয়তো ততটা ভাল লাগছে না, কিন্তু পরিণামে তা আমাকে আনন্দ দেবে, ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যাবে। সেগুলি হচ্ছে শ্রেয়। সবসময় আমার খেয়াল রাখতে হবে, যে জিনিসের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছি সেটা শ্রেয় না প্রেয়। শ্রেয়টাকে গ্রহণ করব, প্রেয়টাকে বর্জন করব। সবসময় নিজের মনের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। কোন বিশ্বাস নেই মনকে। এই মন কখন কি করে বসবে বলা যায় না কিছু। সেইজন্য বলা হয়েছে যে, ‘The condition upon which God hath given liberty to man is eternal vigilance.’* ধর্মপথে চলতে গেলে, মনকে সবসময় চোখে চোখে রাখতে হয়। অতন্দ্র প্রহরায় রাখতে হয়। আর এর সঙ্গে সঙ্গে সাধুসঙ্গ করতে হয়, সৎপ্রসঙ্গ করতে হয়, সদ্‌গ্রন্থ পড়তে হয় আর ঈশ্বরের কাছে ব্যাকুলভাবে প্রার্থনা করতে হয়। —এগুলোই হচ্ছে বেড়া দেওয়া। এর মধ্যে সাধুসঙ্গের উপর ঠাকুর খুব জোর দিয়েছেন। বলছেন ; সাধুসঙ্গ করলে বিষয়াসক্তির বিকার কেটে যায়। আবার বলছেন : সাধুসঙ্গ করলে ঘড়ি ঠিক করে নেওয়া যায়। অর্থাৎ মনে একটা বিচার আসে : আমি ঈশ্বরকে মনে রেখে সংসার করছি, নাকি সংসারে জড়িয়ে পড়ছি? সেইজন্য যাঁরা সংসারে থাকেন তাঁদের বিশেষ দরকার সাধুসঙ্গ করা।

ঠাকুর বলছেন : যখন নির্জনে সাধন ক’রবে, সংসার থেকে একেবারে তফাতে যাবে। তখন যেন স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, মাতা, পিতা, ভাই, ভগিনী, আত্মীয়-কুটুম্ব কেহই কাছে না থাকে। নির্জনে সাধনের সময় ভাব্‌বে, আমার কেউ নাই ; ঈশ্বরই আমার সর্বস্ব। আর কেঁদে কেঁদে তাঁর কাছে জ্ঞানভক্তির জন্য প্রার্থনা ক’রবে। (১-৮-২) কিন্তু সংসারে তো দায়দায়িত্ব আছে, সেসব ছেড়ে কতদিন দূরে থাকব? শ্রীশ্রীঠাকুর এর উত্তরে বলছেন : তা একদিন যদি এই রকম ক’রে থাক, সেও ভাল ; তিন দিন থাকলে আরও ভাল ; বা বারোদিন, এক মাস, তিন মাস, এক বৎসর, যে যেমন পারে। (ঐ) ঠাকুর এমন কিছু এখানে বলছেন না যা একেবারে অসম্ভব আমাদের পক্ষে। জ্ঞান ভক্তি লাভ ক’রে সংসার ক’রলে আর বেশী ভয় নাই।⋯চোর চোর যদি খেল বুড়ি ছুঁয়ে ফেললে আর ভয় নাই। একবার পরশমণিকে ছুঁয়ে সোনা হও, সোনা হবার পর হাজার বৎসর যদি মাটিতে পোঁতা থাক, মাটি থেকে তোলবার সময় সোনাই থাকবে। (ঐ) ঠাকুর একটা সুন্দর উপমা দিচ্ছেন : মনটি দুধের মত। সেই মনকে যদি সংসার জলে রাখ, তা হ’লে দুধে-জলে মিশে যাবে। তাই দুধকে নির্জনে দই পেতে মাখন তুলতে হয়। (ঐ) ‘নির্জনে’ কেন বলছেন? কারণ, নড়াচড়া হলে দইটা জমবে না। সেইজন্য বলছেন : নির্জনে দুই থেকে মাখন তুলতে হবে। কিসের মাখন? জ্ঞানভক্তিরূপ মাখন। জ্ঞানভক্তি আমার মনের মধ্যেই আছে। সাধনভজন করে সেটাকে ‘তুলতে’ হবে। যখন নির্জনে সাধন ক’রে মনরূপ দুধ থেকে জ্ঞান ভক্তি রূপ মাখন তোলা হলো তখন সেই মাখন অনায়াসে সংসার-জলে রাখা যায়। সে মাখন কখনও সংসার-জলের সঙ্গে মিশে যাবে না—সংসার-জলের উপর নির্লিপ্ত হ’য়ে ভাস্‌বে। (ঐ) সংস্কৃতে আছে ঠিক এরকম একটি কথা। আশ্চর্য এই যে, শ্রীরামকৃষ্ণ গ্রাম্য ভাষায় গ্রাম্য উপমা দিয়ে যেসব কথা বলেছেন, সেগুলি সবই শাস্ত্রসমর্থিত। গরুড়পুরাণে আছে :

নবনীতং যথা দধ্নো জ্যোতিঃ কাষ্ঠাদপি ক্কচিৎ।

মন্থনৈঃ সাধনৈরেবং পরং জ্ঞাত্বা সুখী ভবেৎ ॥

—দই থেকে মন্থন করে যেমন মাখন তুলে নেওয়া হয়, অরণি মন্থন করে অর্থাৎ কাঠ ঘষে ঘষে কাঠ থেকে যেমন একসময় আগুন জ্বলে ওঠে, তেমনি মন্থনরূপ সাধনের দ্বারা পরমস্বরূপকে জেনে তুমি সুখী হতে পারবে। ঠাকুর যা বলছেন তা হল ; একবার যদি তোমার ভিতরে ঈশ্বরের প্রতি প্রেমভক্তি হয় তাহলে আর তুমি সংসারে জড়িয়ে পড়বে না। নির্লিপ্ত হয়ে থাকতে পারবে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে : ‘In the world, not of the world.’ সংসারে আছি, কিন্তু আমি সংসারের হয়ে যাইনি, সংসার আমার মালিক হয়ে যেতে পারেনি—ঈশ্বরই আমার মালিক। ঠাকুর বলছেন :নৌকো জলে থাকলে ক্ষতি নেই, কিন্তু নৌকোর ভিতর যেন জল না থাকে। আমি সংসারে থাকতে পারি, কিন্তু আমার ভিতরে যেন সংসার না থাকে। এই হচ্ছে নির্লিপ্ততা বা অনাসক্তি। এটা সম্ভব হয় ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা থাকলে।

Aldous Huxley-র ‘Ends and Means’ বলে একটা বিখ্যাত বই আছে। সেখানে তিনি এই অনাসক্তির (detachment)কথা বলেছেন। গীতাতেও এই অনাসক্তির কথাই বারবার করে বলা হয়েছে। আমাদের শাস্ত্রের সারকথাই এই। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন :১০

ব্ৰহ্মণ্যাধায় কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা করোতি যঃ।

লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রমিবাম্ভসা ॥

—ঈশ্বরে সমস্ত কর্ম সমর্পণ করে, কর্মফলের প্রতি সমস্ত আসক্তি ত্যাগ করে যে কাজ করে তাকে কোন পাপ স্পর্শ করতে পারে না, পদ্মপাতা জলে থাকলেও জল যেমন কখনও পদ্মপাতাকে স্পর্শ করতে পারে না। আমরা ঠিক সেইভাবে সংসারে থাকব। অনাসক্ত হয়ে কাজ করলে, কাজটা যাই হোক না কেন, সেটা তখন আর বন্ধনের কারণ হয় না। ‘যোগ’ হয়ে যায়, ঈশ্বরলাভের উপায় হয়ে দাঁড়ায়। জপ-ধ্যান,পূজা-উপাসনার থেকে সেই কাজ একটুও ছোট না—যদি ঠিক ঠিক অনাসক্ত হয়ে করা যায়। ঠাকুর বলছেন : অনাসক্ত হ’য়ে কর্ম করার নাম কর্মযোগ। (১-১০-৬) ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়, তাই কর্মযোগ। অনাসক্ত হয়ে কর্ম করো ;—কিনা, কর্মের ফল আকাঙক্ষা ক’রবে না। (ঐ) ‘ঈশ্বরার্থং কর্ম১১ করব আমি। কাজের যা ফল, ঈশ্বরে সমর্পণ করব। নিজের জন্য আমি কোন ফল চাই না।—এই হচ্ছে অনাসক্তি।

সহজিয়াদের একটা গান আছে। তাতে বলা হচ্ছে অনাসক্তিটা কিরকম। ‘রাঁধুনী হইবি ব্যঞ্জন বাটিবি হাঁড়ি না ছুঁইবি তায়’। রান্না করবে, তরকারি কাটবে, সব করবে—কিন্তু হাঁড়ি ছোঁবে না। অর্থাৎ সব কাজ কর কিন্তু ‘আমি করছি’ এই বোধটা রেখো না। ‘আমি’ আর ‘আমার’ এই দুটোই বন্ধনের কারণ। এটাকে করতে হবে : তুমি, তোমার। তুমি কর্তা, তুমি সব ; তোমার সংসার, তোমার সব। সহজিয়ারা তাই বলছেন : তুমি সংসার কর, কিন্তু তুমি করছ এই বোধটা রেখো না। এই হচ্ছে অনাসক্তি। আবার বলছে : ‘অমিয় সাগরে সিনান করিবি কেশ না ভিজিবে তায়।’ অমিয় সাগরে তুমি স্নান করছ অর্থাৎ সবসময় ঈশ্বরের স্মরণ-মনন করছ, তাঁর প্রেমের সাগরে অবগাহন করছ। কিন্তু ‘কেশ না ভিজিবে তায়’—কাউকে জানতে দিচ্ছ না, বুঝতে দিচ্ছ না। গোপনে, সকলের অগোচরে তাঁকে ডেকে যাচ্ছ। তাঁর চিন্তা যত গোপনে করা যায়, ততই ভাল। গোপনে ঈশ্বরকে ডাকার একটা আলাদা মাধুর্য আছে। সেইজন্য বলছেন : সবাই দেখুক যে, তুমি সংসারে ডুবে আছ। কিন্তু আসলে তুমি সংসারে ডুবে নেই—দিনরাত তাঁর স্মরণ-মনন করে যাচ্ছ। শ্রীশ্রীমার জীবনে দেখি এর দৃষ্টান্ত। সংসারে ডুবে আছেন যেন। অনেকে সন্দেহ চেপে রাখতে পারত না, বলে ফেলত : মা, আপনি দেখছি মায়ায় ঘোর বদ্ধ। মা বলতেন : কি করব বাবা, আমরা মেয়েমানুষ তো, আমাদের এইরকমই। এড়িয়ে যেতেন, ধরা দিতে চাইতেন না সহজে। তবে একদিন বলে ফেলেছিলেন : কি জান? বিদ্যুৎ যখন চমকায় সার্শিতে চমকায়, খড়খড়ির কিছু হয় না। অর্থাৎ বলতে চাইছেন : আমি যা কিছু করছি, অনাসক্ত হয়ে করছি। আমাকে কিছু স্পর্শ করতে পারছে না। স্বামীজী ‘কর্মযোগে’ বলছেন : আদর্শ মানুষ তিনিই যিনি তীব্র কর্মব্যস্ততার মধ্যেও সম্পূর্ণ প্রশান্ত থাকেন। শ্রীশ্রীমার জীবনে ঠিক সেটাই দেখতে পাওয়া যায়। কী অদ্ভুত সংসার তাঁর! একদিকে শরৎ মহারাজ, যোগীন মহারাজ—এঁদের মতো মহাপুরুষ, অন্যদিকে পাগলী মামী, রাধু—কেউ পাগল, কেউ তার থেকেও বেশি। একদিকে ঘোর ত্যাগী, আর একদিকে ঘোর বিষয়ী। এঁদের সবাইকে নিয়ে মা সংসার করে যাচ্ছেন। কত কোলাহল, সামান্য জিনিস নিয়ে কত ঝগড়া কত কি! তার মধ্যে মা শান্ত, নির্বিকার, উদাসীন, দ্রষ্টা—’দুঃখেস্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ’।১২ এই আমাদের আদর্শ। আমাদের সমস্ত শাস্ত্র এই আদর্শের কথা বলছে।

‘কথামৃতে’ শ্রীরামকৃষ্ণ কতভাবে এই অনাসক্তির কথা বোঝাচ্ছেন। ‘হাতে তেল মেখে কাঁঠাল-ভাঙা’র উদাহরণ আগে দিয়েছি। আবার বলছেন ; পাঁকাল মাছের মতো সংসারে থাক। কিংবা কচ্ছপের মতো থাক। পাঁকাল মাছ পাঁকে থাকে, কিন্তু গায়ে পাঁক লাগে না। কচ্ছপ জলে চরে বেড়ায়, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে ‘আড়া’তে (ডাঙায়), যেখানে তার ডিম রয়েছে। সংসারে তেমনি নির্লিপ্ত ভাবে থাক। সংসারের সব কর্তব্য করে যাও, কিন্তু মন পড়ে থাক ঈশ্বরের পাদপদ্মে। ঠাকুর বলছেন : সংসারে এক হাতে ঈশ্বরের পাদপদ্ম ধ’রে থাকবে আর এক হাতে কাজ ক’রবে। (১-১২-৪) ঠাকুরের আর একটা উদাহরণ : যে খুঁটি ধরে ঘুরপাক খায় সে কখনও পড়ে না। ঈশ্বর হচ্ছেন সেই খুঁটি। তাঁকে ধরে রেখে যে সংসারে চলে তার কখনও ভুল হয় না।

স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলতেন : বারো আনা মন ভগবানে দিয়ে চার আনা মন দিয়ে কাজ করলে খুব ভালভাবে কাজ করা যায়। বস্তুত, কাজ তো আমরা হাত দিয়ে করি না, মন দিয়ে করি। ঈশ্বরের দিকে যদি মন দেওয়া যায়, মন খুব শুদ্ধ হয়ে যায়, স্বচ্ছ শান্ত হয়ে যায়। সেই মন দিয়ে তখন যা করা যায়, তা-ই খুব সুষ্ঠুভাবে করা যায়। এটা আমাদের সবসময় মনে রাখা উচিত যে, অনাসক্তি মানে কর্তব্যে অবহেলা নয়—ঈশ্বরে মন রেখে যথাযথভাবে সবকিছু করে যাওয়া। জনক ব্যাস বশিষ্ঠ এঁদের উদাহরণ দিয়ে ঠাকুর বলছেন : এঁরা সংসারে ছিলেন। এঁরা দু’খানা তরবার ঘুরাতেন। একখানা জ্ঞানের, একখানা কর্মের। (ঐ) একটা তালোয়ার জ্ঞানের। কিসের জ্ঞান? ঈশ্বরই আমার একমাত্র প্রিয়জন এই জ্ঞান। আর একটা তলোয়ার কর্মের অর্থাৎ সংসার করছেন তাঁরা, সংসারের সমস্ত কর্তব্য করছেন। যাঁরা সংসারে আছেন, তাঁদের এটাই আদর্শ হওয়া উচিত।

অনেকে বলেন যে, হিন্দুধর্ম বা সব ধর্মই মানুষের মধ্যে এই জীবনসংগ্রাম থেকে পালিয়ে যাবার একটা মনোভাব সৃষ্টি করে। মোটেই না। হিন্দুধর্মে মোটেই সেকথা বলে না—কোন ধর্মেই বলে না। হিন্দুধর্ম স্পষ্টই বলে—‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ’। নিজের ধর্ম পালন করতে গিয়ে যদি তোমার নিধন হয় সেও ভাল। সংসারে আছ, সংসারের ধর্মই তুমি পালন করে যাও। কিন্তু ‘পরধর্মো ভয়াবহঃ’।১৩ সংসারে থেকে সন্ন্যাসীর মতো আচরণ করতে যেও না। দু-নৌকোয় পা দিয়ে চলার চেষ্টা কোরো না। গীতাতে বলছে :১৪ কে সন্ন্যাসী? কে যোগী? ‘অনাশ্রিতঃ কর্মফলং কার্যং কর্ম করোতি যঃ স সন্ন্যাসী চ যোগী চ’ —কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা না করে যে কর্তব্য কর্ম করে যাচ্ছে, সে-ই সন্ন্যাসী, সে-ই যোগী। ‘ন নিরগ্নির্ন চাক্রিয়ঃ’—যে অগ্নি অর্থাৎ যাগ-যজ্ঞ অর্থাৎ সকাম কর্ম ত্যাগ করেছে এবং কোন কাজ না করে চুপ করে বসে রয়েছে—সে কখনও সন্ন্যাসী নয়, সে কখনও যোগী নয়। কাজেই কর্তব্যে অবহেলা ধর্ম নয়। ঠাকুরকে একজন জিজ্ঞাসা করছেন ; যাতে আমার অর্থ বেশি হয় সেই চেষ্টা করতে পারি কি? ঠাকুর তো মুদ্রা স্পর্শ করতে পারতেন না, টাকা আর মাটি তো তাঁর কাছে সমান। অথচ কী অদ্ভুত উত্তর দিচ্ছেন তিনি! বলছেন : বিদ্যার সংসারের জন্য পারা যায়। বেশী উপায়ের চেষ্টা করবে কিন্তু সদুপায়ে। (৩-২-২) অর্থাৎ সন্ন্যাসীর ধর্ম আর সংসারীর ধর্ম এক নয়। এটা যেন আমরা কখনও ভুলে না যাই। সন্ন্যাসী সব ত্যাগ করেছে। সর্বতোভাবে সে ঈঁশ্বরের উপরে নির্ভরশীল। তার কাছে টাকা-মাটি সমান—‘সমলোষ্টাশ্মকাঞ্চনঃ’।১৫ কিন্তু আমি সংসারী, আমার স্ত্রী আছে, পুত্র-কন্যা আছে। কতগুলি প্রাণী আমার উপর নির্ভর করে আছে। আমার অর্থের প্রয়োজন আছে বই কি। নিশ্চয়ই আমি অর্থোপার্জন করব—তবে সদুপায়ে করব। অর্থাভাবে পরিবার-পরিজন কষ্ট পাচ্ছে অথচ আমি মুখে বলছি, ‘টাকা মাটি মাটি টাকা’—সেটা ধর্ম নয়, ঘোর তামসিকতা। তবে এটাও ঠিক, অর্থের একটা ভয়ঙ্কর মোহ আছে। সেই মোহ যাতে আমাকে গ্রাস না করতে পারে, সেদিকেও আমার নজর দিতে হবে। আমি যেন অর্থের কাঙাল হয়ে না পড়ি কখনও। ঠাকুর বলছেন : অর্থ যার দাস, সেই মানুষ। যারা অর্থের ব্যবহার জানে না, তারা মানুষ হ’য়ে মানুষ নয়। আকৃতি মানুষের কিন্তু পশুর ব্যবহার! (১-১২-৯) খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা। অর্থ আমি উপার্জন করব, কিন্তু সবসময় সদুপায়ে করব, সৎ ভাবে তা ব্যয় করব। তা না হলে, এই অর্থই অনর্থের কারণ হবে। সংসারে যা-কিছুই আমি করি না কেন, তার মধ্যে একটা পরিমিত বোধ থাকা দরকার—এতদূর পর্যন্ত করব, এর বেশি নয়। কিন্তু কতদুর পর্যন্ত গিয়ে আমি দাঁড়ি টানব সেটা বোঝা খুব সহজ না। সেটা বুঝতে পারা যায়, আমার নিজের মনই আমাকে সেটা বলে দেয়—যদি ঈশ্বরের প্রতি আমার একটা স্বাভাবিক টান থাকে। এই কারণেই ঠাকুর বারবার করে বলছেন এক হাতে ঈশ্বরের পাদপদ্ম ধরে থাক, খুঁটি ধরে ঘুরপাক খাও, ইত্যাদি।

সংসারে যাঁরা আছেন তাঁদের লক্ষ্য করে ঠাকুর বলছেন : তোমাদের কর্তব্য আছে বৈকি! (১-১২-৫) কি কি কর্তব্য আছে, কতদিন আছে সেগুলি ঠাকুর বলে দিচ্ছেন : ছেলেদের মানুষ করা ; স্ত্রীকে ভরণপোষণ করতে, তোমার অবর্তমানে স্ত্রীর ভরণপোষণের যোগাড় ক’রে রাখতে হবে। তা যদি না কর, তুমি নির্দয়। শুকদেবাদি দয়া রেখেছিলেন। দয়া যার নাই, সে মানুষই নয়। (ঐ) সন্তানকে কতদিন পর্যন্ত প্রতিপালন করতে হবে? ঠাকুর বলছেন : সাবালক হওয়া পর্যন্ত। পাখী বড় হ’লে যখন সে আপনার ভার নিতে পারে, তখন তাকে ধাড়ী ঠোক্‌রায়, কাছে আসতে দেয় না। (ঐ) ‘ধাড়ী’ অর্থাৎ মা-পাখি। এই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম। বড় হয়েছ, এখন তুমি নিজেকে নিজে দেখ। সন্তানকে আমি স্বাবলম্বী করে দিয়েছি—আর আমার তার প্রতি কোন কর্তব্য নেই। এখন সে স্বাধীন। নিজের ইচ্ছামতো চলুক। আমি তাতে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছু বলব না। বস্তুত, অনাসক্তির প্রকৃত পরীক্ষা কিন্তু এখানে। সন্তান হয়তো সত্যিই স্বাবলম্বী হয়েছে, কিন্তু বাবা-মা অনেক সময় মন থেকে সেটা মেনে নিতে পারেন না। তাঁরা হয়তো অর্থ প্রত্যাশা করছেন না, কিন্তু এটা অনেক সময় প্রত্যাশা করেন যে, ছেলে বা মেয়ে তাঁদের কাছে এসে কিছু পরামর্শ চাইবে, তাঁদের উপর নির্ভর করবে একটু। এটা যে খুব দোষের বা অস্বাভাবিক কিছু, তা বলছি না। কিন্তু এটার জন্য অনেক সময় দুঃখ পেতে হয় বাবা-মাকে। ছেলে বা মেয়ের কাছে এইটুকুও প্রত্যাশা করব না আমি। তাদের প্রতি আমার শুভেচ্ছা রাখব, ঈশ্বরের কাছে তাদের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করব, তারা যদি কোন পরামর্শ চায়, তাহলে দেবও। কিন্তু অযাচিতভাবে কোন পরামর্শ দিতে যাব না বা মনে মনে এটা আশাও করব না যে, তারা আমার কাছ থেকে কোন পরামর্শ নিতে আসবে। অনাসক্তির প্রকৃত লক্ষণ এটাই। এ তো গেল সন্তানের কথা। আর স্ত্রীর প্রতি কি কর্তব্য? বলছেন : তুমি বেঁচে থাক্‌তে থাক্‌তে ধর্মোপদেশ দেবে…। (ঐ) আমরা বলি সহধর্মিণী। স্বামী ধর্মজীবন যাপন করছেন, তাঁর কর্তব্য হচ্ছে স্ত্রীকেও সেই ধর্মজীবনে সঙ্গিনী রাখা। উভয়ে উভয়কে দেখবে, উভয়ে উভয়কে উৎসাহ দেবে। এই হচ্ছে কর্তব্য। আর কি করবে? ভরণপোষণ করবে। যদি সতী হয়, তোমার অবর্তমানে তার খাবার যোগাড় ক’রে রাখতে হবে। (ঐ) এগুলি সংসারীর কর্তব্য। ঠাকুর বলছেন ; এসব তুমি করবে কিন্তু ঈশ্বরকে ধরে রেখে। এক হাতে ঈশ্বরের পাদপদ্ম ধরে থাকবে আর এক হাতে এসব করে যাবে! যখন সংসারের প্রতি তোমার কর্তব্য সব শেষ হয়ে যাবে, তখন দুই হাতেই ঈশ্বরের পাদপদ্ম ধ’রে থাকবে, তখন নির্জনে বাস ক’রবে, কেবল তাঁর চিন্তা আর সেবা ক’রবে। (১-১২-৪)

তবে জ্ঞানোন্মাদ হ’লে আর কর্তব্য থাকে না।(১-১২-৫) এই যে বিভিন্ন কর্তব্যের কথা বলা হল, এগুলি সাধারণের জন্য। ঈশ্বরের প্রেমে যে পাগল হয়ে গেছে, তার এসব কোন কর্তব্য নেই। তার সবকিছু ঈশ্বরই করে দেন। তখন কালকার জন্য তুমি না ভাবলে ঈশ্বর ভাবেন। জ্ঞানোন্মাদ হ’লে তোমার পরিবারদের জন্য তিনি ভাববেন। যখন জমিদার নাবালক ছেলে রেখে ম’রে যায়, তখন ‘অছি’ সেই নাবালকের ভার লয়। (ঐ) যে সম্পূর্ণভাবে তাঁর উপর নির্ভর করেছে, তার সব ভার তিনিই নেন। ঠাকুর গল্প করছেন ; বৈকুণ্ঠে নারায়ণ আর লক্ষ্মী একদিন বসে রয়েছেন। হঠাৎ নারায়ণ খুব হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন। আবার কিছুক্ষণ পরেই তিনি ফিরে এলেন। লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করলেন ; কি ব্যাপার? তুমি এরকম হঠাৎ গেলেই বা কেন, ফিরেই বা এলে কেন? ভগবান বললেন : আমার এক ভক্ত খুব বিপদে পড়েছিল। সে তন্ময় হয়ে আমার নাম করতে করতে যাচ্ছিল। ধোপারা রাস্তায় কাপড় মেলে রেখেছিল, তার খেয়াল নেই, তার উপর দিয়ে সে চলেছে। ধোপারা রেগে গিয়ে তাকে মারতে যাচ্ছিল, তাই আমি তাকে রক্ষা করবার জন্য ওরকম ছুটে বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম, সে আত্মরক্ষার জন্য হাতে একটা পাথর তুলেছে। তাই দেখে আবার ফিরে এলাম। অর্থাৎ ঈশ্বরই যার কাছে সর্বস্ব, তার সমস্ত দায়দায়িত্ব ঈশ্বরই বহন করেন। গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন :১৬ তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্ ।’ যারা নিত্য আমাতে যুক্ত হয়ে আছে, তাদের ‘যোগ’ এবং ‘ক্ষেম’ আমি বহন করি। অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রাপ্তি হল ‘যোগ’ আর প্রাপ্ত বস্তুর রক্ষা হল ‘ক্ষেম’। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : যা তাদের নেই সেটা আমি যোগ করে দিই, আর যা তাদের আছে সেটা যাতে নষ্ট না হয়, এও আমি দেখি। যে সর্বদা ঈশ্বরে যুক্ত হয়ে আছে, ঈশ্বর ছাড়া আর কিছু যে জানে না, তার প্রতি এটা যেন ঈশ্বরের কর্তব্য। ঈশ্বর যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আছেন এইরকম ভক্তের সমস্ত দায়দায়িত্ব বহন করতে।

সংসারে যাঁরা আছেন, তাঁদের পক্ষে সবচেয়ে সহজ হল তাঁর উপর নির্ভর করা। অনেক সময় সংসারে এত ব্যস্ততা থাকে যে, তাঁকে ডাকবার সময় হয় না। মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় সংসারে যে, ভাল-মন্দ কর্তব্য-অকর্তব্য ঠিক করা যায় না। এই অবস্থায় একমাত্র উপায় শরণাগতি। ঠাকুর বলছেন : তাঁকে আমমোক্তারী দাও। (ঐ) ঈশ্বরের উপর সব ছেড়ে দাও আমমোক্তারী শব্দটা আজকাল বেশি ব্যবহার হয় না। এর ইংরেজী প্রতিশব্দটাই বেশি প্রচলিত, সেটা হচ্ছে ‘Power of Attorney’। একজনের ওপর ভার দেওয়া হল, কাগজে একটা সই করে লিখে দেওয়া হল : এখন থেকে আমার হয়ে ইনিই সব করবেন। এই হচ্ছে আমমোক্তারী দেওয়া। ঠাকুর বলছেন : ঈশ্বরকে আমমোক্তারী দাও। বলছেন : ভাল লোকের উপর যদি কেউ ভার দেয়, সে লোক কি তার মন্দ করে? তাঁর উপর আন্তরিক সব ভার দিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত হ’য়ে বসে থাক। তিনি যা কাজ ক’রতে দিয়েছেন, তাই ক’রো।(ঐ) যদি ভাল লোকের উপরে, অর্থাৎ ঈশ্বরের উপরে তুমি ভার দাও তাহলে তিনি কখনও তোমাকে ছেড়ে যাবেন না, ফেলে দেবেন না। তাঁর উপর ভার দিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি যে কাজ তোমাকে করতে দিয়েছেন তাই কর। তারপরেই একটি সুন্দর উপমা দিয়ে বলছেন : বিড়ালছানার পাটোয়ারী বুদ্ধি নাই। মা মা করে। মা যদি হেঁসেলে রাখে সেইখানেই পড়ে থাকে। কেবল মিউ মিউ করে ডাকে। মা যখন গৃহস্থের বিছানায় রাখে, তখন সেই ভাব। মা মা করে। (ঐ) ঠাকুর বলতেন : দুই রকমের ভক্ত আছে। বাঁদরছানার ভাব আর বিড়ালছানার ভাব। শাস্ত্রেও দেখি ঠিক একই কথা :১৭ প্রবৃত্তির্দ্বিবিধা প্রোক্তা মার্জারী চৈব বানরী’। দুই রকমের ‘প্রবৃত্তি’ বা চেষ্টার কথা বলা হয়—বিড়ালছানার আর বাঁদরছানার। বাঁদরছানা তার মাকে জাপটে ধরে থাকে। তার দুর্বল অক্ষম দুটো হাত, তাই দিয়ে মাকে ধরে থাকে। আর মা এক গাছ থেকে আর এক গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। তবু বাঁদরছানা নিশ্চিন্ত। সে জানে মাকে যতক্ষণ ধরে আছি ভয় নেই। তবে ভুল করে সে যদি মাকে ছেড়ে দেয় তাহলেই তার বিপদ। কিন্তু বিড়ালছানার সেরকম কোন ভয় নেই। সে কি করে? তার মা তাকে যেখানে রাখে সেখানেই সে নিশ্চিন্ত মনে থাকে। মা হয়তো তাকে বাবুর বিছানার উপর রেখেছে। হঠাৎ হয়তো সেই ঘরে কেউ ঢুকল, দেখল, একটা বিড়ালছানা বিছানার উপর শুয়ে আছে, তখন তাড়া দিল। বিড়ালছানার কোন মাথাব্যথা নেই। সে শুয়ে আছে। কিন্তু মা ছুটে এসে তাকে মুখে করে নিয়ে গেল। নিয়ে গেল অন্য জায়গায়, হয়তো ছাইয়ের গাদায়। তাতেও বিড়ালছানার কোন আপত্তি নেই। যখন যেখানে মা রাখে। যে ঈশ্বরকে আমমোক্তারী দেয়, তার ঐ বিড়ালছানার ভাব।

আমরা দেখি, গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন :১৮ ‘সর্বধমান্‌ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ’। অনেক উপদেশ দিলেন অর্জুনকে। দিয়ে বোধহয় দেখলেন যে, অর্জুন যেন নিজেকে অসহায় মনে করছেন। ভাবছেন, এ কি আমার দ্বারা সম্ভব? তখন শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : তুমি শুধু আমাকেই ধরে থাক, ধর্ম-অধর্ম ওসব কিছু দরকার নেই, শুধু আমাকেই স্মরণ কর। কত বড় আশ্বাস! বলছেন : ‘অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি’—সমস্ত পাপ থেকে আমি তোমাকে মুক্তি দিয়ে দেব ; ‘মা শুচঃ-শোক কোরো না, দুঃখ কোরো না। যে ভগবানকে ধরে থাকে, তার কোন ভাবনা থাকে না। একটা গানে. বলছে :

ভবে সেই সে পরমানন্দ।

যে জন পরমানন্দময়ীরে জানে ॥

সে জন, না যায় তীর্থপর্যটনে

কালীছাড়া কথা না শুনে কানে,

সন্ধ্যা পূজা কিছু না মানে,

যা করেন কালী সেই সে জানে ॥

এই পৃথিবীতে সেই সবচেয়ে আনন্দে আছে যে পরমানন্দময়ীকে ধরে আছে। তাকে তীর্থ বা আর কোথাও যেতে হবে না। সে শুধু জানে, যা করেন কালী, যা করেন মা—মা-ই তার সব। সেই আমমোক্তারী দেওয়া।

আমরা দেখি, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, বিখ্যাত নাট্যকার, ঠাকুরের কাছে যাতায়াত করেন। একদিন তিনি ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন : এখন থেকে আমি কি করব বলে দিন। অর্থাৎ ভগবানকে ডাকার জন্য আমাকে কি করতে হবে বলুন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, ঠাকুর তাঁকে থিয়েটার ইত্যাদি ছেড়ে দিতে বলবেন। ঠাকুর কিন্তু বললেন : যেমন আছ তেমনি থাক, যেমন করছ তেমনি কর। কেবল তুমি সকাল-বিকাল একটু ঈশ্বরের স্মরণমনন কোরো। একথা শুনে গিরিশ ঘোষ ভাবছেন : আমার কোনটা সকাল কোনটা বিকাল সেই জ্ঞানই থাকে না, আমাকে আবার উনি বলছেন সকাল-বিকাল ঈশ্বরের স্মরণ করতে। এ আমি পেরে উঠব না। ঠাকর বুঝতে পেরেছেন, বলছেন : তুমি তাহলে অন্তত খাওয়ার সময় একটুখানি আর শোবার সময় একটুখানি ঈশ্বরকে স্মরণ কোৱো। গিরিশ ঘোষ আরও চিন্তায় পড়লেন। চুপ করে আছেন : কোন কথা বলতে পারছেন না! ভাবছেন : আমি কখন খাই, তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। খেতে বসে হয়তো চিন্তা করছি, মামলা চলছে, এই মামলায় আমার যিনি ব্যারিস্টার তাঁকে ফি দেওয়া হয়েছে কিনা, আজ মামলার দিন, টাকাটা যদি ব্যারিস্টারের হাতে না পৌঁছায় ব্যারিস্টার তো কোর্টে দাঁড়াবেন না, তখন আমি মামলায় হেরে যাব। খেতে বসে আমি তো এসব চিন্তা করি। তখন কিভাবে আমি ঈশ্বরের চিন্তা করব? এ আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এসব ভাবছেন, কিন্তু মুখে বলতেও লজ্জা করছে। এত কৃপা ঠাকুরের। বলছেন, তুমি যেমন আছ তেমনি থাক, বা করছ তা-ই কর। অর্থাৎ, তুমি নেশা করছ নেশা কর, থিয়েটার করছ থিয়েটার কর। কত সোজা উপায় বলে দিলেন ঠাকুর, আর আমি এত অধম যে সেটুকুও করতে পারছি না। গিরিশচন্দ্র তাই লজ্জায় চুপ করে আছেন, কিছু বলতে পারছেন না।

ঠাকুর তখন ভাবস্থ হয়েছেন—তাহলে তুই আমাকে বকল্‌মা দে। তখন ‘তুমি’ নয়, ‘তুই’। খুব আপনার বোধ। এই ‘আমমোক্তারী’—‘বকল্‌মা’। অনেক সময় যে চিঠি লিখতে পারে না, তার হয়ে আর একজন চিঠি লিখে দেয়। এই হচ্ছে বকল্‌মা। সাধারণত লেখে, বঃ—অর্থাৎ আমি আর একজনের হয়ে লিখছি। ঠাকুর বলছেন : তাহলে তুই আমাকে বকল্‌মা দে। গিরিশ ঘোষ তখন মনে মনে খুব খুশি : বকল্‌মা দিয়ে দিয়েছি। ঠাকুরের উপর সব ভার ছেড়ে দিয়েছি। আর আমার কোন চিন্তা নেই। কিন্তু একদিন কি কথায় কথায় গিরিশবাবু হঠাৎ বলে ফেলেছেন যে, ‘আমি করব’। ঠাকুর সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলছেন : কি বললে? ‘আমি করব!’ তুমি না বকল্‌মা দিয়েছ? বলবে, ঈশ্বরের ইচ্ছা হলে এটা হবে। ‘আমি করব’—এ তুমি বলতে পার না।

গিরিশ ঘোষ পরে বলেছিলেন : বকল্‌মা দেওয়ার ভিতর যে এত সব ব্যাপার আছে এ আগে বুঝিনি। জপধ্যান এসব করলে তো দিনের মধ্যে কিছুক্ষণ করতাম, তাহলেই হয়ে যেত। আর বকল্‌মা দিয়ে দেখছি সবসময় ‘ঠাকুর ঠাকুর’ করছি। তাতেও নিস্তার নেই। প্রতি পদক্ষেপে ভাবতে হচ্ছে, আমি তাঁর উপর সব ভার দিতে পেরেছি তো? এই যে কাজটা করছি, এই যে চিন্তাটা করছি, এমনকি এই যে নিঃশ্বাসটা ফেলছি—সেটাও কি আমি তাঁর উপরে নির্ভর করে করছি, না কি নিজের অহংকারের বশে করছি? বকল্‌মা দিয়ে আমার এই অবস্থা। স্বামী সারদানন্দ ভারী সুন্দর একটা কথা বলেছেন। বলছেন : গিরিশ নিয়মের বন্ধন পরতে ভয় পাচ্ছিলেন, তাই বকল্‌মা দিলেন। কিন্তু তিনি তখন বুঝতেও পারলেন না, কত বড় বন্ধন তিনি স্বেচ্ছায় গলায় পরে নিলেন। সেটা হচ্ছে ভালবাসার বন্ধন। ভালবাসার বন্ধন সব থেকে বড় বন্ধন।

বকল্‌মা দেওয়া প্রসঙ্গে ঠাকুর একটা মজার গল্প বলতেন। এক ব্রাহ্মণ খুব যত্ন করে সুন্দর একটা ফুলের বাগান করেছেন। এই বাগানটার জন্য খুব গর্ব তাঁর। একদিন একটা গরু সেই বাগানে ঢুকে ফুলের গাছগুলি সব নষ্ট করে দিয়েছে। দেখে ব্রাহ্মণের খুব রাগ হয়েছে। রাগের মাথায় একটা লাঠি দিয়ে গরুটাকে মেরেছেন। এমন মেরেছেন যে, গরুটা মরে গেছে। প্রথমটায় তাঁর মনে খুব দুঃখ হল—ব্রাহ্মণ হয়ে গো-হত্যা করলাম! গো-হত্যার পাপ তো আমাকে স্পর্শ করবে! এই ব্রাহ্মণ আবার একটু-আধটু বেদান্ত চর্চা করতেন। তাই পরমূহুর্তেই তাঁর মনে হল : আমি তো আর মারিনি, আমার হাত গরুটাকে মেরেছে। হাতের অধিপতি ইন্দ্র, অতএব ইন্দ্র মেরেছে। মুণ্ডকোপনিষদে একটা কথা আছে যে, যখন ব্রহ্মজ্ঞান হবে তখন এই সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলি ‘প্রতি দেবতাসু’ চলে যাবে। ‘দেবাশ্চ সর্বে প্রতি দেবতাসু’১৯ —এখানে ‘দেব’ মানে ইন্দ্রিয়। শাস্ত্রে বলছে, প্রতি ইন্দ্রিয়ের একজন করে অধিপতি আছেন। যেমন চোখের অধিপতি সূর্য, কানের অধিপতি বায়ু হাতের অধিপতি ইন্দ্র। ব্রাহ্মণ জানতেন যে, হাতের অধিপতি ইন্দ্র। তাই গো-হত্যা করার ফলে পাপ যখন তাঁর শরীরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, তখন তিনি পাপকে বাধা দিয়ে বললেন : আমার শরীরে তুমি প্রবেশ করবে কোন্‌ অধিকারে? গরু তো আমি মারিনি মেরেছে আসলে ইন্দ্র। আমার হাত গরুটাকে মেরেছে, হাতের অধিপতি ইন্দ্র। কাজেই অপরাধ তো ইন্দ্রের। তুমি ইন্দ্রের শরীরে গিয়ে প্রবেশ কর। এই যুক্তি শুনে পাপ সেখান থেকে সোজা চলে গেল ইন্দ্রের কাছে। ইন্দ্র পাপের মুখে সবকিছু শুনে বললেন : আচ্ছা, দাঁড়াও, আমি একটু ব্রাহ্মণের সঙ্গে কথা বলে আসি। ইন্দ্র ছদ্মবেশে এসে সেই ব্রাহ্মণের বাগানে প্রবেশ করলেন। তারপর যেন বাগানটা দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছেন এমন ভান করে ঘুরে ঘুরে ফুলগুলো দেখছেন। ব্রাহ্মণের সঙ্গে দেখা হল। দেখা হতেই ইন্দ্র ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করছেন : ভারী সুন্দর বাগানটি তো! কে করেছে? কার বাগান?

—আমার বাগান।

—কে এসব গাছ লাগিয়েছে?

—আমিই লাগিয়েছি।

—কে এসব দেখাশুনা করে?

—আমিই এসব দেখাশুনা করি।

ব্রাহ্মণের তখন দারুণ উৎসাহ। ইন্দ্রকে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখাচ্ছেন আর বলছেন—এটা দেখুন, ওটা দেখুন, এ সব আমি করেছি। দেখাতে দেখাতে যেখানে মরা গরুটা পড়ে আছে একেবারে সেখানে এসে উপস্থিত। ইন্দ্র বলছেন : হায়, হায়! এখানে গরু কে মারল? ব্রাহ্মণ তখন মুশকিলে পড়ে গেছেন। এতক্ষণ ‘আমি-আমি’ করেছেন, এখন আর বলতে পারছেন না যে, আমি মারিনি। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। তখন ইন্দ্র আসল মূর্তি ধারণ করে বললেন ; ভণ্ড, এতক্ষণ ‘আমি আমি’ করে এসেছ, আর এই বেলা চুপ, বলতে চাও, ইন্দ্র মেরেছে! তা হবে না। গো-হত্যার পাপ তোমাকেই নিতে হবে।

এই যে আমমোক্তারী দেওয়া, এ বড় শক্ত জিনিস। একটুও ‘আমি’ বোধ থাকলে চলবে না। একেবারে ‘আমি’-শূন্য যদি কেউ হয় তবে সে নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান পুরুষ। ‘ভবে সেই সে পরমানন্দ’। কোন দুঃখ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে মহানন্দে সে থাকে।

প্রশ্ন হচ্ছে : সংসারে থেকে একজনের হয়তো জ্ঞান হয়েছে বা ঈশ্বর লাভ হয়েছে। বাইরে থেকে কি কি লক্ষণ দেখে বোঝা যাবে সেটা? ঠাকুর বলছেন : হরিনামে ধারা আর পুলক। তাঁর মধুর নাম শুনেই শরীর রোমাঞ্চ হয়ে চক্ষু দিয়ে ধারা বেয়ে পড়বে। (ঐ) এই হচ্ছে লক্ষণ। ঈশ্বরের নাম শুনলেই তার একটা উদ্দীপন হবে। কিরকম? বলছেন যে, যেন একটা শুকনো দেশলাই কাঠি, একবার ঘষলেই দপ্‌ করে জ্বলে ওঠে। কিন্তু যদি সেটা ভিজে থাকে তাহলে অনেক কষ্ট করে জ্বালাতে হয়। কিসে ভিজে আছে? বিষয়রসে ; বিষয়বসে মনটা ভিজে আছে। তখন ঈশ্বরের নাম শুনেও কোন উদ্দীপনা হচ্ছে না, আনন্দ হচ্ছে না, হয়তো শুনতে ভালও লাগছে না। কিন্তু মনটা যদি বাসনামুক্ত হয়, আসক্তিশূন্য হয়, তখন দেখা যাবে যে, ঈশ্বরের নাম শুনলেই পুলক হবে, রোমাঞ্চ হবে। এক জায়গায় বলছে যে, কিরকম রোমাঞ্চ হবে? না, পনসের মতো। ‘সর্বাঙ্গ পুলক ঢাকা পনসের পারা।’২০ পনস মানে কাঁঠাল। কাঁঠালের গায়ে আমরা যেমন দেখি কাঁটা, শরীরের সমস্ত লোম সেইভাবে খাড়া হয়ে আছে—এরকম রোমাঞ্চ। ভাগবতে বলছে :২১ ‘এবং হরৌ ভগবতি প্রতিলব্ধভাবঃ’—হরির প্রতি, ভগবানের প্রতি ভাব বা অনুরাগ হয়েছে। তার ফলে কি হয়েছে? ‘ভক্ত্যার্দ্রবদ্ধৃদয়ঃ’—ভক্তিতে হৃদয় বিগলিত হচ্ছে। ‘উৎপুলকঃ প্রমোদাৎ’—আনন্দে রোমাঞ্চ উদগত হচ্ছে। ‘ঔৎকণ্ঠ্যবাষ্পকলয়া’ —‘বাষ্প অর্থাৎ জল। উৎকণ্ঠায় চোখ দিয়ে জলধারা বইছে। এরকম যখন হবে, হরিনাম করতেই চোখে জল আসবে, শরীরে রোমাঞ্চ হবে,তখনই বুঝতে হবে যে, তার ঈশ্বরলাভ হয়েছে।

ঈশ্ববলাভ করে যে সংসারে আছে তার আর একটা লক্ষণ হল, তার দেহবোধ থাকে না। দেহবোধ থাকে না মানে কি এই যে, যদি কেউ তাকে চিমটি কাটে সে ব্যথা পাবে না? তা নয়। দেহবোধ থাকে না বলতে এই বোঝায় যে, এই যে দেহাভিমান, দেহটাই আমি, সেইটা না থাকা। সাধারণ অবস্থায় আমরা তো সবাই দেহাভিমানী। আমাদের যা কিছু চিন্তাভাবনা, কর্মপ্রচেষ্টা, সবকিছু এই দেহকে কেন্দ্র করে। দেহের সামান্য সুখদুঃখ আমাদের বিচলিত করে। ঠাকুর বলছেন ; সংসারে থেকে যে ঈশ্বরলাভ করেছে, তার এই দেহাভিমান চলে গেছে। সে কিরকম? একটা অদ্ভুত উপমা দিচ্ছেন ঠাকুর—খড়ো নারকেল। বলছেন : ঈশ্বরলাভ হলে লক্ষণ এই যে, সে ব্যক্তি খ’ড়ো নারিকেলের মতো হ’য়ে যায়—দেহাত্মবুদ্ধি চ’লে যায়। দেহের সুখ-দুঃখে তার সুখ-দুঃখ বোধ হয় না, সে ব্যক্তি দেহের সুখ চায় না। সে জীবন্মুক্ত হ’য়ে বেড়ায়। (ঐ) ‘খড়ো’ অর্থাৎ খড়্‌খড়্‌ করে। এমনি যে ডাব নাবকেল, সেটাকে যদি আমরা ঝাঁকা দিই, তাহলে সেটা খড়্‌খড়্‌ করবে না। কিন্তু যেটা শুকনো নারকেল, ঝুনা নারকেল সেটা খড়্‌খড়্‌ করবে। কারণ, তার ভিতরের শাঁস আর মালা এ দুটো আলাদা হয়ে গেছে। যার ঈশ্বরলাভ হয়েছে সে ঐ খড়ো নারকেল, শাঁস আর মালা যে আলাদা, আত্মা আর দেহ যে ভিন্ন এই বোধটা তার হয়ে গেছে। ঠাকুরের ভাইপো অক্ষয়, খুবই ভালবাসতেন ঠাকুর তাঁকে, তাঁর হঠাৎ মৃত্যু হল। ঠাকুর বলছেন : দেখলাম, যেন একটা খাপ থেকে তরোয়ালটা বের করে নিল। শরীরটা যেন খাপ আর তরোয়াল হচ্ছে আত্মা। দেখলাম যে, শরীরটা পড়ে রইল, আত্মা তিনি বেরিয়ে এলেন। বলছেন : এই দেখে আমি হাসতে লাগলাম। সবাই কাঁদছে, কিন্তু ঠাকুর হাসতে লাগলেন। কেননা তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন : শরীর আর আত্মা আলাদা। শরীরটার মৃত্যু হয়েছে, আত্মা যেমন ছিল তেমনি আছে।

সংসারে যে জ্ঞান লাভ করেছে সে ঐ খড়ো নারকেলের মতো। ঠাকুর আর এক জায়গায় বলছেন : ঝড়ের এঁটো পাতা। একটা শুকনো পাতা, হাওয়াতে তাকে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে সেদিকেই সে যাচ্ছে। তার নিজের কোন স্বতন্ত্র চেষ্টা নেই। ঈশ্বরলাভ করার পর মানুষ ঐভাবে সংসারে থাকে। ‘ক্ষিপ্তঃ সংস্কারবাতেন চেষ্টতে শুষ্কপর্ণবৎ।২২ কিসের হাওয়া? না, সংস্কারের হাওয়া। তার দ্বারা ক্ষিপ্ত অর্থাৎ চালিত হয়ে সে শুকনো পাতার মতো কাজ করে থাকে অর্থাৎ ঘুরে বেড়ায় ইতস্তত। সংস্কার তাকে যখন যেখানে চালিয়ে নিয়ে যায় সেখানেই সে যায়। তার নিজের ইচ্ছা বা চেষ্টা কিছু থাকে না। সংস্কার অর্থাৎ যেটাকে আমরা বলি ‘প্রারব্ধ’। এতদিন আমি যত কাজ করেছি—এ জন্মে বা আগের জন্মগুলিতে—তাকে দুভাগে ভাগ করা যায়। প্রারব্ধ আর সঞ্চিত। ‘প্রারব্ধ’ হচ্ছে সেই কাজটা যেটা এর মধ্যেই ফল দিতে শুরু করেছে। যে কাজটা এখনও ফল দিতে শুরু করেনি, পরে করবে, তাকে বলে ‘সঞ্চিত’। আর আমি এই মুহূর্তে যে কাজটা করছি সেটা হচ্ছে ‘ক্রিয়মাণ’। ঈশ্বরলাভ হলে ‘সঞ্চিত’ আর ‘ক্রিয়মাণ’ কর্ম নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু ‘প্রারব্ধ’টা থেকে যায়। যতদিন না প্রারব্ধ ভোগ শেষ হয়, ততদিন শরীরটা থেকে যায়। চাকার উদাহরণ দিয়ে এটা বোঝানো হয়। একটা চাকাকে যদি ঠেলে চালিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে যতটা জোরে ঠেলা হল, সেই অনুসারে চাকাটা কিছু দূর গড়িয়ে যাবে। সে নিজের ইচ্ছাতে যাচ্ছে না! তেমনি যে জ্ঞানলাভ করেছে, ঈশ্বরলাভ করেছে, তার আর স্বতন্ত্র কোন ইচ্ছা নেই। যা সে করে সব ঐ ‘সংস্কারবাতেন’—প্রারব্ধ তাকে যা করায়, তা-ই সে করে। যতদিন করায়, ততদিনই কবে, ততদিনই তার শরীর থাকে।

এই যে খড়ো নারকেলের অবস্থা, যদি আমাদের দেশে এরকম মানুষ আমরা না দেখতাম, তাহলে আমরা বলতাম—এ একটা কষ্টকল্পনা, অবাস্তব অসম্ভব একটা জিনিস। কিন্তু আমরা দেখি যে, কল্পনা নয়। মাঝে মাঝে এরকম মানুষ সত্যিই আসেন, যাঁরা সংসারে থেকেও সংসারে নেই, শরীরে থেকেও শরীরে নেই। স্বামী ব্রহ্মানন্দের কথাই ধরা যাক। তাঁর এরকম অবস্থা। ঘরভর্তি লোকের মধ্যে তিনি বসে আছেন—চোখ অর্ধনিমীলিত, অন্যমনস্কভাবে বসে আছেন। হঠাৎ মাঝে মাঝে চোখ খুলছেন, যেন নতুন দেখছেন—অনেকগুলো মানুষ সামনে বসে আছে। যেন অন্য কোন জগৎ থেকে ফিরে এসেছেন্‌ এই জগৎটাকে হঠাৎ চিনে উঠতে পারছেন না। মহাপুরুষ মহারাজকে দেখেছি—সমস্ত রাত হাঁপানিতে কষ্ট পেয়েছেন, বুকে বালিশ চাপা দিয়ে বসে কাটিয়েছেন। সবাই ফিসফিস করে বলছে—কাল খুব কষ্ট পেয়েছেন। সবারই মন খারাপ। কিন্তু সকালবেলায় যখন তাঁর কাছে যেতাম, মুখে হাসি, মুখ দিয়ে যেন একটা জ্যোতি ফুটে বেরুচ্ছে। কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করল : মহারাজ, কেমন আছেন?—আমি? আমি বাবা খুব ভাল আছি। ঠাকুব দয়া করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই দেহটা আমি নই। আমি খুব ভাল আছি। তবে যদি দেহের কথা জিজ্ঞেস কর, এ এর ধর্ম পালন করছে, বৃদ্ধ হয়েছে, দুদিন পরে ধ্বংস হবে।—সেই খড়ো নারকেল। বলছেন : ঠাকুরের কৃপায় আনন্দে আছি। আর সেটা শুধু তাঁর মুখের কথা নয়। লোকে জোর করেও তো বলতে পারে, আনন্দে আছি। কিন্তু তাঁর মুখে, চেহারায়, ব্যবহারে—সবকিছুর ভিতর দিয়ে ফুটে বেরুচ্ছে যে, তিনি আনন্দে আছেন। আবার স্বামী তুরীয়ানন্দ। ফোঁড়া হয়েছে তাঁর, কার্বাঙ্কল। ডাক্তার এসেছেন ফোঁড়া কাটতে। তিনি চোখ খোলা রেখে শরীর থেকে মন তুলে নিলেন। ক্লোরোফর্ম ছাড়াই ডাক্তার ফোঁড়া কাটলেন। কত রক্ত, কত পুঁজ বের হচ্ছে। উনি চুপ করে চোখ মেলে দেখছেন। তাঁর মুখে কোথাও বেদনার কোন চিহ্ন নেই। যেন অন্য কারও শরীরে ফোঁড়া কাটা হচ্ছে। ‘খড়ো নারকেল’। যেটার সম্বন্ধে শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন যে, দেহবোধটা নেই, দেহ থেকে আমি আলাদা।

অনেক সময় আমরা স্বপ্ন দেখি যে, মরে গেছি—দেহটা পড়ে আছে দেখতে পাচ্ছি। বয়োজ্যেষ্ঠ সন্ন্যাসীদের কাছে শুনেছি এই রকম স্বপ্ন দেখা খুব ভাল। অর্থাৎ আমি দেহ থেকে আলাদা এই বোধ আমার হয়েছে, স্বপ্নে হলেও হয়েছে। দেহকে কেন্দ্র করে আমরা আমাদের জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এটা যদি আমরা নিশ্চিতভাবে জেনে রাখি যে, দেহ থেকে আমি আলাদা, আমার একটা আলাদা স্বরূপ আছে, সেই যে স্বরূপ তাতে ব্যাধি নেই, সুখদুঃখ নেই, জন্মমৃত্যু নেই—তাহলে সংসারের সুখ বা দুঃখ কোনটাই তখন আর আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। আমার আর কোন চিত্তচাঞ্চল্য থাকবে না।

কঠোপনিষদের এক জায়গায় বলছে :২৩ তং স্বাচ্ছরীরাৎ প্রবৃহেৎ’—তুমি নিজের শরীর থেকে ‘তং’ অর্থাৎ তাঁকে, আত্মাকে আলাদা করে নেবে। কিরকমভাবে আলাদা করে নেবে? ‘মুঞ্জাদিবেষীকাম্‌’—মুঞ্জঘাস থেকে তার ঈষীকাকে যেমন করে ছাড়ানো হয়। উপনয়নের সময় মুঞ্জঘাসের উপবীত পরতে হয়। যাগযজ্ঞ করতে গেলে হাতে মুঞ্জঘাসের আংটি পরতে হয় যাকে আমরা ‘শর’ বলি তা-ই হচ্ছে মুঞ্জঘাস। আর ‘ঈষীকা’ কি? ঈষীকা হচ্ছে মাজ, মুঞ্জঘাসের ভিতরে যে শীষ থাকে। বলছে : মুঞ্জঘাসের ভিতর থেকে তার মাজটাকে যেভাবে আলাদা করে নেওয়া হয়, সেইভাবে তুমি শরীর থেকে আত্মাকে আলাদা করে নেবে। আলাদা করে নিতে বেশ সময় লাগে, সন্তর্পণে সাবধানে করতে হয়। সেইজন্য বলছে :‘ধৈর্যেণ’—ধৈর্য চাই।

ঠাকুর বলছেন : ঈশ্বরকে যে জেনেছে, সে জীবন্মুক্ত হয়ে বেড়ায়। কালীর ভক্ত জীবন্মুক্ত নিত্যানন্দময়। (ঐ) জীবন্মুক্ত অর্থাৎ জীবদ্দশাতেই মুক্ত। আর সে নিত্যানন্দময়। সবসময় তার আনন্দ। আমরা তো সবসময় এই আনন্দই খুঁজছি। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ সংসারে আমরা পাই না। একটু আনন্দ হয়তো পেলাম, সঙ্গে সঙ্গে আবার দুঃখ এসে গেল। ছোটবেলাতে একটা কথা শুনতাম—যত হাসি তত কান্না, বলে গেছে রামশর্মা। কে এই রামশর্মা জানি না, কিন্তু খুব একটা মোক্ষম কথা বলে গেছেন। কিন্তু যে ঈশ্বরলাভ করেছে, সে নিত্য আনন্দময়। বেপরোয়া কাউকে সে ভয় করে না। ডঙ্কা মেরে সে বেড়ায়। কিসের ভয়? কার কাছে আমি মাথা নোয়াব? রাজা? না। আমার রাজা তিনি যিনি আমার হৃদয়ে বিরাজ করছেন। আর কারও আমি অপেক্ষা রাখি না। অনপেক্ষ। ‘আত্মতৃপ্ত’ আমি-নিজেতেই নিজে তৃপ্ত। ‘পর্যাপ্তকামঃ’—সব পেয়ে গেছি। যাঁকে পেলে সব পাওয়া হয়ে যায়, যিনি কিনা ‘পরমপ্রাপ্তি’ তাঁকেই আমি পেয়ে গেছি। আমার আর কোন কামনা-বাসনা নেই। আমি ‘বিমৃত্যুঃ’। জন্মমৃত্যুর ঊর্ধ্বে চলে গেছি। মৃত্যু যে শরীরের মৃত্যু, আত্মার কিছু না—এ বোধ আমার হয়ে গেছে। আমি জীবন্মুক্ত।

কিভাবে আমি তখন সংসারে আছি? কিরকম কাব্যময়ী ভাষায় বলছেন :২৪

শকুনীনামিবাকাশে জলে বারিচরস্য চ।

পদং যথা ন দৃশ্যেত তথা জ্ঞানবতাং গতিঃ ॥

—‘শকুনী’ অর্থাৎ পাখী, শকুন না। আকাশে পাখী যেমন উড়ে যায়। কিরকম অনায়াসে সে উড়ে যাচ্ছে। জলে যেমন ‘বারিচর’ অর্থাৎ মাছ ইত্যাদি জলজন্তুরা স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায়। তাদের কোন ‘পদ’ বা চিহ্ন দেখা যায় না। তারা কোথাও কোন দাগ রেখে যায় না। তেমনি হল জ্ঞানীর গতি। এ সংসারে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত, অনাসক্ত। সংসারের সব কাজ তিনি করে যাচ্ছেন, কিন্তু কোন কিছুই তাঁকে আর জড়াতে পারছে না। তিনি নির্লিপ্ত হয়ে আছেন। ঠাকুর বলছেন : পাখী যখন ডিমে তা দেয়, তার চোখ দুটো দেখেছ? সে চোখ চেয়ে আছে, কিন্তু কিছুই যেন দেখছে না। ফ্যালফ্যালে চোখ। তার সন্তান আসছে, সেই সন্তানের চিন্তাই তার সমস্ত মন জুড়ে রয়েছে। তাই চোখ চেয়েও সে বাইরের কিছু দেখতে পাচ্ছে না। জীবন্মুক্ত যিনি, তিনি ঐ ডিমে-তা-দেওয়া পাখীর মতো। আমরা যে জগৎটাকে দেখি, সেটাকে তিনি দেখতেই পান না। তাঁর কাছে সেটা স্বপ্নের মতো। তাঁর যে জগৎ সে অন্য জগৎ। তাই তিনি সংসারে আছেন, সব করছেন, অথচ কিছুই করছেন না। গীতায় বলছে :২৫ তিনি ‘আত্মন্যেবাত্মনা তুষ্টঃ’—নিজেতেই নিজে তুষ্ট। নিজের পরমাত্মস্বরূপ তিনি জেনেছেন। তাই তিনি নিজের মধ্যে নিজে বুঁদ হয়ে আছেন। আর কি? না, ‘বীতরাগভয়ক্রোধঃ’। ‘রাগ’ মানে, আমরা যাকে বাংলায় রাগ বলি, তা কিন্তু বলছে না। রাগ মানে আসক্তি, অনুবাগ, কোন জিনিসের প্রতি আকর্ষণ। ‘বীতরাগভয়ক্রোধঃ’ অর্থাৎ তাঁর সমস্ত আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ দূর হয়ে গেছে। আবার ‘আত্মবোধে’ বলছে :২৬ ‘তীর্ত্বা মোহাৰ্ণবম্‌’—এই সংসার, এ মোহের সমুদ্র। সেই সমুদ্র তিনি পার হয়েছেন। ‘হত্বা রাগদ্বেষাদিরাক্ষসান্‌’—রাগ, দ্বেষ প্রভৃতি রাক্ষসকে তিনি হত্যা করেছেন। স্বামীজী বলতেন, আমাদের শাস্ত্রেরও কথা, যেখানে অনুরাগ আছে সেখানে বিদ্বেষও আছে, যেখানে আকর্ষণ আছে সেখানে বিকর্ষণও আছে। একটাকে ছাড়া আর একটাকে ভাবা যায় না। এই উভয়কেই এখানে রাক্ষস বলা হয়েছে। আমাদের আদর্শ হচ্ছে দুয়ের উর্ধ্বে যাওয়া, দ্বন্দ্বাতীত হওয়া। যিনি জীবন্মুক্ত পুরুষ, তিনি রাগ দ্বেষ উভয়কেই অতিক্রম করে গেছেন। আর কি? তিনি ‘যোগী শান্তিসমাযুক্ত আত্মারামো বিরাজতে’—আত্মাতেই আরাম তাঁর। নিজেতেই নিজের আনন্দ তাঁর। আত্মতৃপ্ত। ‘শান্তিসমাযুক্তঃ’ —শান্তিতে তিনি ডুবে আছেন। আর একটা কথা বড় সুন্দর বলছে : ‘ঘটস্থদীপবৎ স্বস্থঃ’। ‘স্বস্থঃ’—নিজের মধ্যে নিজে ডুবে আছেন। ‘আপনাতে আপনি থেকো মন যেও নাকো কারও ঘরে।’ ঘটের মধ্যে একটা প্রদীপ জ্বলছে, জ্ঞানের প্রদীপ। সেই প্রদীপের আলোয় তিনি আলোকিত। নিজের আলোতে নিজে আলোকিত। এরকম একটা অবস্থা হয়, সংসারে যিনি জ্ঞানলাভ করেছেন তাঁর।

কিন্তু এরকম অবস্থা মানুষের হবে কি করে? ঈশ্বরই যে আমার সর্বস্ব, সমস্ত আনন্দের উৎস যে তিনি, তিনি যে আমার ভিতরেই—এ বোধ আমার হবে কি করে? ঠাকুর বলছেন ; বিষয়াসক্তি গেলেই এরকম হবে। বলছেন : বিষয়রস শুকুলে তৎক্ষণাৎ উদ্দীপন হয়। (ঐ) বিষয়রস শুকোবার উপায়টা কি? বিষয়ের প্রতি যে আকর্ষণ সেটা যাবে কিভাবে? ঠাকুর বলছেন : ব্যাকুল হয়ে তুমি মাকে ডাক। একটা সহজ কথা বলছেন। অত তোমাকে শাস্ত্র পড়তে হবে না, অত তপস্যা করতে হবে না, তুমি মাকে ডাক, মাকে ভালবাস। বলছেন : আপনারই মা! (ঐ) ‘কথামৃতে’ খুব বড় বড় হরফে লেখা রয়েছে : আপনারই মা! যেমন আমরা দেখি, শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীকে। নিজের সম্বন্ধে বলছেন : পাতানো মা না, গুরুপত্নী মা না, ধর্ম মা না—সত্যিকারের মা। আমি সত্যিকারের মা। বলছেন ; যেখানে যাও, যেমন থাক, সবসময় মনে রেখ, তোমাদের একজন মা আছে। কত বড় আশ্বাস দিচ্ছেন! ঠাকুর বলছেন ; আপনার মা বোধ থাকলে এক্ষণেই হয়। (ঐ) আমরাই তাঁকে দূরে সরিয়ে রেখেছি, আপনার বোধ করতে পারছি না। তাঁকে আপনার মনে করতে পারলে তিনি কৃপা করেন। তিনি তো ধর্ম-মা নন। আপনারই মা! ব্যাকুল হয়ে মার কাছে আবদার কর। (ঐ) তারপরে বড় সুন্দর উপমা দিচ্ছেন : ছেলে ঘুড়ি কিন্‌বার জন্য মার আঁচল ধরে পয়সা চায়—মা হয়তো আর মেয়েদের সঙ্গে গল্প করছে। (ঐ) প্রতিবেশীরা এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে বসে গল্প করছেন, এইসময় ছেলে এসে হাজির : মা, ঘুড়ি কিনব, পয়সা দাও। প্রথমে মা কোনমতে দিতে চায় না। বলে, ‘না, তিনি বারণ ক’রে গেছেন, তিনি এলে ব’লে দিব, এক্ষণই ঘুড়ি নিয়ে একটা কাণ্ড করবি।’ যখন ছেলে কাঁদতে শুরু করে, কোনমতে ছাড়ে না, মা অন্য মেয়েদের বলে, “বোস মা, এ ছেলেটাকে একবার শান্ত ক’রে আসি।’ (ঐ) এমন ছেলে যে, বাধ্য হয়ে মা পয়সা দিতে ছুটলেন। এই বাধ্য করা! আপনার মা তো। ছেলের সেজন্য কোন দ্বিধা নেই। তখন মা কি করেন? চাবিটা নিয়ে কড়াৎ কড়াৎ করে বাক্স খুলে একটা পয়সা ফেলে দেয়। (ঐ) মা কিন্তু মনে মনে খুশি হন। ছেলে বা মেয়ে যদি কখনও কিছু না চায়, আবদার না করে, মা ক্ষুন্ন হন। মা খুশি হন যদি চায়। ছেলে অনেক সময় জোর করে চায়। বলে : না, এটা আমাকে দিতেই হবে, আজকে আমার জন্য এটা তোমার রান্না করতেই হবে। মা খুশি হন তাতে। শ্রীমা সারদাদেবীকে ভক্তরা কাপড়-টাপর দেয়। উনি সেসব ওঁর সেবকদের দিয়ে দেন। একটি সেবক কখনও মায়ের কাছ থেকে কাপড় না। বলে : আমার আছে—আপনাকে দিতে হবে না। একদিন মা ঐ সেবককে ডাকিয়েছেন। বলছেন : তোমাকে আজ বলতে হবে কেন তুমি আমার কাছ থেকে নাও না! সেবক বলছে : মা, ভক্তেরা আপনার নিজের ব্যবহারের জন্যই দেয়—সে জিনিস আমি কি করে নেব? তাছাড়া, আপনি সব বিলিয়ে দেন, আপনার নিজের জন্য একটাও থাকে না। মা জিজ্ঞেস করছেন ; তুমি আমায় কি ভাব? সেবক বলছে ; কেন, নিজের মা বলে ভাবি। মা তখন রেগে গেছেন : বোকা ছেলে! তোমার কি একটুও বুদ্ধি নেই? মা কি কখনও ছেলেকে না দিয়ে খেতে পরতে পারে? মার ভাঁড়ার কি ছেলের বেলা খালি থাকে? আজ বলে দিচ্ছি, যখনি যা দরকার হবে, আমার কাছে চেয়ে নেবে—তাতে আমি খুশি হব।—এই বলে সেবককে একটা নয়, তিনটে কাপড় দিলেন মা। সেবকের চোখে জল। মা তাকে আদর করে বলছেন : মার ওপরও ছেলের জোর আছে, বাবা—যা দরকার হবে, চেয়ে নেবে।২৭ ঠাকুর বলছেন : তোমরাও মার কাছে আবদার করো, তিনি অবশ্য দেখা দিবেন। (ঐ)

তারপর বলছেন : আমি শিখদের ঐ কথা বলেছিলাম।⋯তারা বলেছিল, ঈশ্বর দয়াময়। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কিসে দয়াময়? তারা বললে, কেন মহারাজ!(‘মহারাজ’ মানে সাধু-মহাত্মা, উত্তর ও পশ্চিম ভারতে ‘মহারাজ’ মানে সাধু-মহাত্মা।) তিনি সর্বদা আমাদের দেখছেন, আমাদের ধর্ম, অর্থ সব দিচ্ছেন, আহার যোগাচ্ছেন। আমি বললুম, যদি কারো ছেলেপুলে হয়, তাদের খাওয়ার ভার, বাপে নেবে, না, তো, কি বামুনপাড়ার লোকে এসে নেবে? (ঐ) সন্তানের দায়িত্ব তো বাবা-মা-ই নেবেন। তাছাড়া আর কে নিতে যাবে? তার জন্য কি আমরা বলি, ধন্যবাদ বাবা, ধন্যবাদ মা, তোমাদের কত করুণা! বলি না। তেমনি ঈশ্বর আমার আপনার জন, তিনি আমার দায়িত্ব নিয়েছেন। আমার দায়িত্ব তো তাঁরই, সেটা তিনি পালন করছেন। এতে তিনি অতিরিক্ত আর কি দয়া করলেন? তিনি কি তবে দয়াময় ন’ন? (ঐ) ঠাকুর বলছেন : তা কেন গো? ও একটা বললুম; তিনি যে বড় আপনার লোক! (ঐ) দয়াময় তিনি নিশ্চয়ই। তবে এই যে আমরা বলি, ঈশ্বর দয়াময়, কৃপাসিন্ধু, এগুলো হচ্ছে তাঁর ঐশ্বর্য। এইসব ঐশ্বর্যের কথা ভাবতে গেলে আমি তাঁর আর আমার মধ্যে একটা যেন দেয়াল তুলে বসি। প্রকৃত ভক্ত ঈশ্বরের ঐশ্বর্য নিয়ে মাথা ঘামায় না। ঈশ্বরকে সে আপনার মনে করে ভালবাসে। তার মনোভাব হচ্ছে—ভালবাসি তাই ভালবাসি, কেন ভালবাসি জানি না। ঠাকুর সেটাই বলতে চাচ্ছেন : তিনি যে বড় আপনার লোক! তাঁর উপর আমাদের জোর চলে! আপনার লোককে এমন কথা পর্যন্ত বলা যায়, দিবি না রে শালা!’ (ঐ) যেটা দরকার সেটা হচ্ছে তাঁকে আপনার বলে বিশ্বাস।

ঠাকুর বলছেন : জীব ঈশ্বর চিন্তা করে, কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাস নাই, আবার ভুলে যায় ; সংসারে আসক্ত হয়। যেমন এই হাতীকে স্নান করিয়ে দিলে, আবার ধূলা-কাদা মাখে। (১-১২-৬) ঠাকুরেরই একটা কথা আছে, নোঙর ফেলে দাঁড় টানা। মাঝিরা এক জায়গায় রাত্রিতে এসে নোঙর ফেলেছে, ভোরবেলা উঠে তারা নৌকো ছেড়ে দেওয়ার জন্য দাঁড় টানছে, কিন্তু নোঙরটা তুলতে ভুলে গেছে। তাই দাঁড় টানছে তবুও নৌকো চলছে না। এই হচ্ছে নোঙর ফেলে দাঁড় টানা। অর্থাৎ সংসারে মনটাকে আমি আসক্ত করে রেখেছি অথচ এদিকে আমি মালা জপছি। আমি মালা জপছি কিন্তু মনে মনে অন্য চিন্তা করছি। আমি শাস্ত্র পাঠ করছি, মনে মনে স্বার্থচিন্তা করছি। মনটাই তো সব। মনটা যদি আমার ঈশ্বরের দিকে না যায়, তাঁর স্মরণমনন না হয় তাহলে সব বৃথা। বলছেন : সংসার আসক্তি ভিতরে থাকলে মৃত্যুকালে সেটি দেখা যায়। (ঐ) সারাজীবন যদি ঈশ্বরের স্মরণমনন না করা যায়, তাহলে মরবার সময়ও সংসারের কথাই মনে পড়বে। ঠাকুর বলছেন : কখনও কখনও দেখা যায় যে, একজন মৃত্যুর সময় তেজপাতা, পাঁচফোড়ন এসব বলে চেঁচিয়ে উঠল। সংসার-আসক্তি প্রবল থাকলে এরকম হয়। শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন : মৃত্যুর সময় আমরা যা চিন্তা করি, পরজন্মে আবার তা-ই হয়ে যাই। সেই যে গল্প আছে, ভরতমুনি, তিনি হরিণের চিন্তা করতে করতে দেহত্যাগ করলেন, পরে সেই হরিণ হয়েই জন্মালেন। গীতাতে বলছেন শ্রীকৃষ্ণ :২৮ ‘যং যং বাপি স্মরন্‌ ভাবং ত্যজত্যন্তে কলেবরম্‌’—যিনি যে দেবতাকে বা যে বস্তুকে ভাবতে ভাবতে দেহত্যাগ করেন, ‘তং তমেবৈতি কৌন্তেয় সদা তদ্ভাবভাবিতঃ—তিনি সেই দেবতা বা সেই বস্তুর স্বরূপই প্রাপ্ত হন। যা তুমি চিন্তা করবে মৃত্যুকালে তা-ই হবে তুমি! আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, বাঃ, এ তো খুব সহজ ব্যাপার। সারাজীবন যা খুশি করলাম, মৃত্যুকালে যদি কোনরকমে একটু ভগবানের চিন্তা করি তাহলেই একেবারে ভগবানের কাছে পৌঁছে যাব। তা হয় না। শেষ সময়ে ভগবানের চিন্তা করার জন্য সমস্ত জীবন ধরে তৈরী হতে হয়। ঠাকুর বলছেন : অভ্যাস করতে হয়। খুব সুন্দর একটা উদাহরণ দিচ্ছেন ঠাকুর। একজন খুব তরতর করে ইংরেজি লিখতে পারে। তা কি সে একবারেই লিখতে শিখেছে? না। তার জন্য তাকে অনেক কষ্ট করে পড়াশুনা করতে হয়েছে, ইংরেজি লেখা অভ্যাস করতে হয়েছে, তারপরে হয়েছে। আমরা দেখি, একজন হার্মোনিয়াম বাজিয়ে গান করছে, সে কিন্তু মোটেই রীডের দিকে তাকাচ্ছে না, আপনা-আপনি হাত ঠিক রীডে পড়ছে। কি করে হয়েছে? অভ্যাসের ফলে। শাস্ত্রে তাই বলছে, ‘অভ্যাসযোগ’। অভ্যাসকে একটা যোগ বলা হচ্ছে। অনেকরকম যোগ আছে, তার মধ্যে এ একটা যোগ—‘অভ্যাসযোগ’। ‘অভ্যাসযোগযুক্তেন চেতসা নান্যগামিনা।’২৯ প্রথম প্রথম তো মন ঈশ্বরের দিকে ততটা যেতে চায় না। কিন্তু অভ্যাসের ফলে এমন করা যায় যে, সেই মনই আর ঈশ্বর ছেড়ে অন্য দিকে কিছুতেই যাবে না। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে যাঁরা যেতেন, তাঁরা যদি ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ ছাড়া অন্য প্রসঙ্গ করতেন, ঠাকুর বিরক্ত হতেন—না, ঈশ্বরীয় কথা ছাড়া আর অন্য কোন কথা না। ‘অন্যা বাচো বিমুঞ্চথ।’৩০ অভ্যাসযোগ। বারবার মনকে টেনে ঐদিকে ঘুরিয়ে রাখ। কবীর একটা দোহাঁতে বলছেন :৩১ স্বাঁস প্রস্বাঁস সুমিরণ করো’—প্রতি নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসে ঈশ্বরকে স্মরণ কর। কারণ, ‘ঔর উপায় কুছ নহী’—আর কোন উপায় নেই। অনেককে আমরা দেখি এরকম। নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে জপ করে যাচ্ছেন। নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস যেমন আমাদের চেষ্টা করে করতে হয় না, জপটাও তখন আর চেষ্টা করে করতে হয় না। ‘অজপা’ বলে একে। আপনা-আপনি আমার মন ঈশ্বরের নাম করে যাচ্ছে। এরকম যদি হয় তাহলে দেখা যাবে মৃত্যুকালেও ঈশ্বরের নাম ছাড়া আমি আর কিছু করছি না। একজন স্বামীজীর কথা জানি, মৃত্যুশয্যায়, বাইরে জ্ঞান নেই, অথচ তাঁর আঙুল নড়ে যাচ্ছে, অবচেতন মনে জপ করে যাচ্ছেন। অভ্যাসের ফলে এ সম্ভব। আমি ঈশ্বর ছাড়া আর কিছু চিন্তা করতে পারি না, চেষ্টা করলেও পারি না।—এরকম একটা অবস্থা। স্বামীজী বলতেন : nervous association. একটা বড় চিন্তা আমি এমনভাবে আয়ত্ত করেছি যে, স্বপ্নেও তার অন্যথা করতে পারছি না। করতে যাচ্ছি, অমনি কে যেন আমাকে আটকে দিচ্ছে। সমস্ত শরীর-মন-বুদ্ধি ঐ ভাবে ঐ চিন্তায় একেবারে বাঁধা রয়েছে, ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘attuned’ হয়ে আছে। আজকাল মনোবিজ্ঞানীরাও এটাকে স্বীকার করেন। তাঁরা বলছেন : censorship. একে বিবেক বলি, সংস্কার বলি, নীতিবোধ বলি বা অন্য যে কোন শব্দই ব্যবহার করি না কেন—এই censorship. এ আছেই। মনকে কে যেন শাসাচ্ছে—খবরদার, এ করবে না, ওদিকে যাবে না। অভ্যাসের ফলে এ সম্ভব। ইংরেজিতে একটা কথা আছে : Habit is the second nature. স্বামীজী বলছেন :৩২ ‘second nature’ না,- ‘first nature’. ‘…it is first nature also, and the whole nature of man: everything that we are is the result of habit.’ আমরা যা অভ্যাস করি, তা-ই হয়ে যাই আমরা আমাদের চরিত্রটা কি? অভ্যাসের ফল। এই জন্মে বা পূর্ব পূর্ব জন্মে আমরা যা করেছি, সে সব আমাদের মনে ছাপ ফেলে গেছে। সেই ছাপগুলির সমষ্টি হচ্ছে আমাদের চরিত্র। হয়তো আমার মনে একটা খারাপ ছাপ পড়ে আছে। আজ থেকে যদি আমি ভাল কাজ করা শুরু করি, আমার মনে ভাল ছাপ পড়তে শুরু করবে। ধীরে ধীরে সেই খারাপ ছাপ ম্লান হয়ে যাবে। অভ্যাসের ফলে এ সম্ভব। আমাদের একজন সাধু কফি খেতে চাইতেন না—বলতেন, ছারপোকার গন্ধ। কিন্তু সেই সাধুকেই এখন দেখি, মাঝে মাঝে কফি খান, আনন্দ করেই খান। আর ছারপোকার গন্ধ পান না এখন। অনেকে ‘চীজ’ প্রথম প্রথম মোটেই সহ্য করতে পারেন না। পরে সেই ‘চীজ’-ই কত তৃপ্তি করে খাচ্ছেন তাঁরা, দেখেছি। কয়েকজনের কথা জানি, তাঁরা নিরামিষ খেতেন প্রথম—মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারতেন না, তাঁদের পাশে বসে কেউ মাছ খেলে, তাঁদের খাওয়া প্রায় নষ্ট হয়ে যেত। পরে তাঁরাই আবার মাছ খাওয়া ধরেছেন, এমন অভ্যাস হয়ে গেছে, মাছ ছাড়া ভাত মুখে রোচে না। জীবনে আমরা এইরকম কত অভ্যাস করি—ভাল অভ্যাস, আবার মন্দ অভ্যাস। পুরনো অভ্যাস ছেড়ে দিই, কত নতুন অভ্যাস ধরি। সেইরকম ঈশ্বরের স্মরণমনন করার অভ্যাসটাও যদি ধরা যায়! প্রথম প্রথম হয়তো ভাল লাগে না। কারও কারও প্রথম থেকেই ভাল লাগে। কারও কারও প্রথম দিকে ভাল লাগে না— ঐ ‘চীজ’ খাওয়ার মতন লাগে। কিন্তু একবার অভ্যাস হয়ে গেলে, আর চেষ্টা কবে ঈশ্বরের স্মরণমনন করতে হয় না। আপনা-আপনিই মনটা ঈশ্বরের দিকে যায়। ঈশ্বরচিন্তা করতে না পারলেই বরং তখন খারাপ লাগে। অভ্যাসের এমনই শক্তি। সংসারে যাঁরা আছেন, তাঁদের সবাইকে পথ নির্দেশ করে ঠাকুর সেইজন্য বলছেন : উপায়—অভ্যাসযোগ। ঈশ্বর চিন্তা অভ্যাস করলে শেষের দিনও তাঁকে মনে পড়বে। (ঐ)।

আকর-তালিকা

 । গীতা, ৩/৬

 । ঐ, ২/৩

 । ঐ, ৯/২৭

 । মহাভারত, শান্তিপর্ব, ১৭/১৯

 । উত্তরগীতা, ৩/২

 । গরুড়পুরাণ, উত্তরখণ্ড, ৭/৮২

 । ভাগবত, ৬/১/১০; সম্পূর্ণ শ্লোকটির জন্য ‘ভক্তিপথ’ দ্রষ্টব্য।

 । ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, (কৃষ্ণজন্মখণ্ড), ১১১/১৫

 । গরুড়পুরাণ, উত্তরখণ্ড, ৭/৯৫

১০। গীতা, ৫/১০

১১। শঙ্করভাষ্য, গীতা, ৩/১৯

১২। গীতা, ২/৫৬

১৩। ঐ, ৩/৩৫

১৪। ঐ, ৬/১

১৫। ঐ, ৬/৮

১৬। ঐ, ৯/২২

১৭। সন্ন্যাসোপনিষদ্‌, ২/১০১

১৮। গীতা, ১৮/৬৬

১৯। মুণ্ডকোপনিষদ্‌, ৩/২/৭

২০। চৈতন্যচন্দ্রোদয়, কবি কর্ণপুর রচিত, প্রেমদাস সিদ্ধান্তবাগীশ অনূদিত, পৃঃ ১০৩

২১। ভাগবত, ৩/২৮/৩৪

২২। অষ্টাবক্রসংহিতা, ১৮/২১

২৩। কঠোপনিষদ্‌, ২/৩/১৭

২৪। শঙ্করভাষ্য, মুণ্ডকোপনিষদ্‌, ৩/২/৬

২৫। গীতা, ২/৫৫-৬

২৬। আত্মবোধ, ৫০-১

২৭। শ্রীমা, আশুতোষ মিত্র, পৃঃ ১৮২-৮৩

২৮। গীতা, ৮/৬

২৯। ঐ, ৮/৮

৩০। মুণ্ডকোপনিষদ্‌, ২/২/৫

৩১। কবীরপন্থা, স্বামী ভূমানন্দ, ১৩৪০, পৃঃ ১৭

৩২। C. W. .Vol. 1, 1962, p. 207

* John Philpot Curran (Speech on the right of election of Lord Mayor of Dublin, 10 July 1790)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *