সংসর্গ – সর্বাণী মুখোপাধ্যায়

সংসর্গ – সর্বাণী মুখোপাধ্যায়

কমলজিৎ কউরকে বাপের বাড়িতে ফেলে দিয়ে চলে গেল তার শ্বশুর যশবন্ত সিং মান৷ পুরো গিল খানদানের মুখে থুতু ছিটিয়ে দিয়ে গেল৷ কমলজিতের বাবা গুরবচন সিং গিল মেয়েকে ধাক্কা মারতে মারতে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে স্ত্রীকে সাবধান করে দিল৷—খবরদার! কেউ যদি দরজা খুলতে চেষ্টা করে তো খতম করে দেব একদম৷

রূপীন্দর কউর গিল স্বামীকে চেনে৷ মিথ্যে শাসানি নয় এটা, যা বললো সত্যিই তাই করে বসতে পারে এখন৷ মাথা ঠিক নেই, অকল্পনীয় অপমান আর দুর্দান্ত ক্রোধে দাউদাউ জ্বলছে জাঠ-রক্ত৷ রূপীন্দর কউরও খাঁটি শিখের মেয়ে, শিখ-পাঞ্জাবীর বউ, জাঠের গরম রক্ত তারও৷ কিন্তু সে এখন জ্বলছে না, পুড়ছে৷ সরমের চ্যাটচেটে বিষ পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে তাকে৷ এই লজ্জা এই যন্ত্রণা মেয়ের মা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না৷ জন্মদাতা বাপও না৷

কৃপাণে হাত রেখে দাঁত কড়মড় করে কঠিন শপথ নিতে নিতে বেরিয়ে যায় গুরবচন সিং গিল৷ আর একই সঙ্গে চোখে জল আর জ্বালা নিয়ে গুরু নানকের ছবিতে মাথা কোটে রূপীন্দর কউর গিল৷—হায় গুরুজী, হায় রাব্বা, এ কি করলে তুমি!

যাকে নিয়ে এত অশান্তি সেই কমলজিৎ কউর মান? সে নিশ্চিন্ত মনে হাঁটুতে মুখ রেখে বসে আছে৷ লজ্জা-সরম বা ভয়-উদ্বেগ কিচ্ছু নেই৷ বরাবর হেসেছে সে, এখনো বন্ধ ঘরে বসে বসে হাসছে৷ স্বামী-সোহাগ পেয়েছে সে৷ সোহাগরাতেই স্বামী-সংসর্গ হয়েছে তার৷ সে সুহাগন৷ কুলদীপের বাচ্চা রয়েছে তার পেটে৷

প্রথমে খেয়াল করেছিল কমলজিতের শাশুড়ি, সুখদেব কউর মান৷ বউ খেতে পারে না, প্রায়ই বমি করে, চোখের নিচে কালির আস্তর৷ সুখদেব কউর ভেবেছে, নিশ্চয় কোনো অসুখ করেছে তার বহুর৷ হবে না? যা ঘটে গেল…! চোখের জল মুছতে মুছতে কমলজিতের গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে সস্নেহে জিগ্যেস করেছিল, তোর বাপুজিকে বলি ডাগদার আনতে?

কমলজিৎ উল্টে তার শাশুড়িকে জিগ্যেস করল, কিঁউ? এখনি ডাগদার এসে কি করবে?

—তোকে দেখে যাবে৷ জরুর কোনো বিমার হয়েছে তোর৷

বিমার? অসুখ? কমলজিৎ খিলখিল করে হেসে উঠেছিল৷ হাসতে হাসতেই তারপর একেবারে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল শাশুড়িকে৷—বিমার-টিমার কিছু না… চার বেটাবেটির মা তুমি, তবু বুঝতে পারলে না কি হয়েছে আমার?

সুখদেব কউর নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না৷ খানিকক্ষণ হাঁ করে কমলজিতের দিকে চেয়ে রইল৷ তারপর বউকে ধরে প্রচণ্ডভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে চলল৷ সঙ্গে হিসহিসানি—কি বললি তুই? বল! নিজের মুখে খোলসা করে বল…

কমলজিৎ হাসি থামিয়ে খুব সহজভাবে বলে উঠেছিল, বাচ্চা এসেছে পেটে, আজতক তিন মাহিনা চলছে৷

সুখদেব কউর মান নিজের মুখে চেপে ধরেছিল বেরিয়ে আসা চিৎকারটা আটকাতে৷ তারপর এলোপাথাড়ি মারতে মারতে কমলজিৎকে শুইয়ে ফেলেছিল৷ কাজের লোকেরা উঁকিঝুঁকি দিতে হুঁশ ফিরে পেল৷ ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকতে ঢাকতে দৌড়লো স্বামীর ‘আপিস’ ঘরের দিকে৷ যে ঘরে সবসময় বাইরের লোকের ভিড়, লোকজন নিয়ে যশবন্ত সিং মান যেখানে পলিটিক্স ইলেকশন ভোট এ-সমস্তের কাজকাম আলাপ-আলোচনা সারে, যে ঘরে সুখদেব কউর কখনো যেত না, সেই ঘরের অন্দরের দিকের দরজার শেকল ঝনঝন করে উঠল৷ করেই চলল৷ ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকালো যশবন্ত সিং৷ স্ত্রীর চুড়ি পরা হাত শিকল নাড়িয়েই চলেছে৷ অবাক হয়ে উঠে দাঁড়াল যশবন্ত সিং মানে৷ সুখদেব তো এভাবে কখনো কাজের ঘরে এসে ডাকে না!

স্বামীর কানে-কানে কথা বলল সুখদেব কউর৷ মাথা ঘুরে চোখে ধাঁধা দেখল গাঁয়ের মাতব্বর মানুষ, রাজনীতির লিডার যশবন্ত সিং মান৷ স্ত্রীর হাত চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল কমলজিতের ঘরের দরজায়৷ চাপা গর্জন করে উঠল, ডাকো ছোঁড়িকে! আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলুক তোমাকে যা বলেছে তা সাচ বাত!

সুখদেব কউরকে ডাকতে হল না৷ মাথায় ওড়না জড়িয়ে ধীরপায়ে শ্বশুরের সামনে এসে দাঁড়াল কমলজিৎ৷ যশবন্ত সিং-এর চোখে তাকিয়ে মাথা নেড়ে স্পষ্ট জানাল, হাঁ, যা বলেছি সাচ বলেছি৷

সাহস দেখে তাজ্জব হয়ে গেল দুজনে৷ যশবন্ত সিং মান কোমরের কৃপাণে হাত দিল৷—কে? কে সে? নাম বল তার?

মুখ তুলে পরিষ্কার জবাব দিল কমলজিৎ৷—তোমাদের বেটা, কুলদীপ সিং মান৷

বিরাশিসিক্কা থাপ্পড়ে ছিটকে পড়ল কমলজিৎ কউর৷ বাইরে থেকে শেকল তুলে যশবন্ত সিং স্ত্রীকে বলল, আমি বদ্যি আনছি, তুমি বুঢ়িয়াকে খবর পাঠিয়ে আনাও৷ ওরা ঠিক বলতে পারবে৷

বুঢ়িয়া এ খানদানের পুরনো দাই-মা৷ যখন ডাক্তার-বদ্যির চল ছিল না তখন এ বংশের সমস্ত প্রসব তার হাতেই হত৷ এখন বুড়া হয়ে গেছে কিন্তু তার অভিজ্ঞতার দাম অনেক৷ যশবন্ত সিং মানের বিশ্বস্ত বদ্যি আর বুঢ়িয়া কমলজিৎকে পরীক্ষা করে জানিয়ে গেল, ঠিকই…গর্ভই হয়েছে…আর বহু তো নিজের মুখেই স্বীকার করছে তিন মাহিনা ধরে…

মাথার পাগড়ি খামচে ধরল যশবন্ত সিং মান৷ সুখদেব কউর মুখে উড়নি চেপে কেঁদে উঠল৷ আর ভারি নিশ্চিন্ত হয়ে হাসল কমলজিৎ৷ ‘সুহাগন’ হয়েছে সে৷ এই সোজা কথাটা এরা বুঝতে পারছে না কেন?

কমলজিৎ কউরের ‘সোজা কথাটা’ ক্ষুরধার কৃপাণের চেয়েও বহুগুণ তীক্ষ্ন হয়ে মান খানদানকে টুকরো করে দিচ্ছিল৷ যশবন্ত সিং হ্যাঁচকা টানে তাকে দাঁড় করিয়ে দিল৷—চল তোর বাপের ঘরে গিয়ে এর ‘ফয়েসলা’ হবে৷

কমলজিৎ কউর মান সুহাগন নয়৷ কমলজিৎ কউর মান বিধবা৷ সবাই জানে সোহাগরাতই হয়নি তার৷ শরীরে সে কুমারী৷ কিন্তু এখন তার পেটে তিন মাসের বাচ্চা৷

পাঞ্জাবের ফরিদকোট জেলার এক গ্রাম দওলতপুরা৷ সেখানকার সমান সমান দুই সম্পন্ন জাঠের ঘর—মান আর গিল৷ তাদের দুই ছেলে যশবন্ত সিং মান আর গুরবচন সিং গিল৷ ছোট থেকে একসঙ্গে ওঠাবসা, একসাথে বড় হওয়া৷ বিয়ে-শাদিও কয়েক দিনের এদিক-ওদিকে৷ তাদের বউরা, সুখদেব কউর মান আর রূপীন্দর কওর গিলও স্বামীদের বন্ধুত্বের সুতোয় নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছে৷ যশবন্ত সিং মানের তিন মেয়ের পরে একমাত্র ছেলে কুলদীপ৷ আর কুলদীপের জন্মের পরের বছরেই এতদিন ধরে নিঃসন্তান থাকা গিল বংশের কোল ভরে এল কমলজিৎ৷ গুরবচন সিং মিঠাই নিয়ে নাচতে নাচতে গেল জিগরী-দোস্ত যশবন্তের বাড়ি৷ যশবন্ত সিং গম্ভীর মুখে বলল, মেয়ে হয়েছে বলে এত ফুর্তি কিসের? ও ছোঁড়ি কি তোমার নাকি?

গুরবচন সিং গিলের হাসি নিভে গেছিল৷ হকচকিয়ে স্বামীর দিকে তাকালো সুখদেব কওর মান, তার কোলে এক বছরের কুলদীপ৷ স্ত্রী আর বন্ধুর মুখের দিকে আড়চোখে চেয়ে ছেলেকে তুলে নিয়ে লোফালুফি খেলা শুরু করল যশবন্ত সিং মান৷ দাড়ির ফাঁকে ফাঁকে হাসির ঝিলকানি৷—ও ছোঁড়ি আমার৷ ওর জন্যেই তো তিন-তিন মেয়ের পর এই বেটা এসে বসে আছে এক বরষ ধরে৷ এ কুলদীপ, লেড়কি সেয়ানা হলেই উঠিয়ে নিয়ে আসবি৷ এ ঘরই তো আসলি ঘর ও ছোঁড়ির৷

ছুঁড়ে দেওয়া কুলদীপকে এবার লুফে নিল গুরবচন সিং গিল৷ অট্টহাসি, কোলাকুলি, জড়াজড়িতে বুড়ো-খোকা হয়ে গেল দুই বন্ধু৷ সুখদেব কউর ছুটল মিষ্টি আনতে৷ গুরবচনের কাঁধে চেপে ফিকফিকিয়ে হাসতে লাগল ছোট কুলদীপ৷ তাই দেখে বাল্লে-বাল্লে করে কয়েক পাক ভাঙরা নেচে নিল গুরবচন সিং৷—দেখেছ? ছোঁড়ির কথায় এখনি কেমন খুশ হয়েছে আমার দামাদ?

…যশবন্ত সিং মান আর গুরবচন সিং গিলের ছোটবেলার মতোই হাত-ধরাধরি করে বড় হতে লাগল কুলদীপ আর কমলজিৎ৷ ঝগড়া মারামারি দস্যিপনা চলত পাল্লা দিয়ে৷ দুজনের মায়ের হাতেই একসঙ্গে চড়-চাপড় যেমন খেয়েছে, তেমনি একসাথে দুই মায়ের কাঁখে চেপে ঘুরেছে দুজনে৷ ক্রমশ মারামারিটা চলে গিয়ে ঝগড়ার জায়গায় এল অভিমান৷ আর ছোটবেলার দস্যিপনা চেহারা পাল্টালো বড়বেলার নতুন খেলায়, যার নাম প্রেম৷ এর সঙ্গে মিশল অন্ধ বিশ্বাস যা ছোট্টবেলা থেকে শুনে এসেছে তারা—ওদের জন্মের আগে থেকেই স্বয়ং রাব্বা (ভগবান) এ শাদি পাক্কা করে রেখেছেন৷

বিয়ের দিন ঠিক হল কমলজিতের কুড়ি আর কুলদীপের একুশ বছরে৷ গুরবচন সিং একটু পুরনো ধাঁচের৷ সে চেয়েছিল আরো আগেই শুভ কাজটা হয়ে যাক৷ কিন্তু যশবন্ত সিং রাজনীতি করা, আধুনিক, আর প্র্যাকটিক্যাল বেশি৷ সে বন্ধুকে বুঝিয়েছিল, আজকালকার জমানায় ছেলের অন্তত বি.এ. পাশটা করে থাকা উচিত৷ তাছাড়া,—একটা চোখ টিপে চার ছেলেমেয়ের বাপ যশবন্ত কম বয়েসের ফিচেল হাসি দিয়েছিল৷—এখন অ্যাডভারটাইসমেন্টে সমানে বলছে না বিশ বছরের আগে মেয়েদের মা হওয়া ঠিক নয়? কিন্তু ও ছোঁড়া-ছোঁড়ি সেই ছোট্ট থেকে এমন গায়ে গায়ে লেগে মিশেছে যে শাদি হওয়া মাত্র আমরা নানা-নানী দাদা-দাদী হয়ে যাব৷ তাই একটু দেরি করিয়ে দেওয়াই ভালো৷

বন্ধুর কথায় গুরবচন সিং গলা ফাটিয়ে বাড়ি কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করেছিল৷

যশবন্ত সিং মান পাক্কা কথার মানুষ৷ কমলজিতের বিশ বছর হতে হতে কুলদীপও বি.এ. পাশ করে নিল ফরিদকোট জেলা-কলেজ থেকে৷ যশবন্ত সিংহও ভালো দিন দেখে আত্মীয় বন্ধুবান্ধব আর দওলতপুরার বিশিষ্ট লোকেদের নিয়ে গেল গুরবচনের বাড়ি৷ আঙটি, লাল চুড়ি, দোপাট্টা-চুড়নী আর মিঠাই দিয়ে মেয়ের ‘সগন’ করে এল৷ ক’দিন পরেই মেয়ের চাচা মামা আর গ্রামের দলবলের মিছিলের আগে আগে হাঁটতে লাগল গুরবচন সিং গিল৷ আঙটি, ঘড়ি, জরির পাগড়ি নিয়ে গিয়ে ভাবী জামাইকে আশীর্বাদ করে ‘মঙ্গনা’ সেরে বিয়ের দিন ঠিক করে ফিরল যশবন্ত সিং মানের বাড়ি থেকে৷

শুভকাজ সকালবেলায়, বেলা বারোটার মধ্যে সারতে হয়৷ শাদির সক্কাল থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল গিল খানদান৷ ছেলের বাড়ি থেকে আসা হলদি, আটা, দহি, তেল দিয়ে মেয়েকে বাপের ঘরের শেষ কুমারী-স্নান ‘নাইধোই’ করিয়ে কনের সাজে সাজালো গাঁওয়ের মেয়েরা৷ বিয়ের মণ্ডপ তৈরি, শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থসাহেব’ স্থাপন করে গুরদ্বারার পূজারীঠাকুর ‘গ্রন্থি’ অপেক্ষা করছে বরাত আসার জন্যে৷ বধূবেশে বসে কমলজিৎ ভাবছে—চুলের চূড়ায় কাঠের নতুন কাঙ্গা (চিরুনি), হাতে ঝকঝকে কড়া (বালা), কোমরে বড় কৃপাণ, মাতার মঙ্গনার আশীর্বাদী জরির পাগড়ি—কুলদীপ আসছে সত্যিই এবার তাকে ‘উঠিয়ে নিয়ে যেতে’—যেটার জন্যে তাদের দুজনেরই জন্ম, যা তাদের জন্মের আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে৷ গায়ে কাঁটা দিল কমলজিৎ কওর গিলের, যে আর একটু পরেই কমলজিৎ কওর মান হয়ে যাবে৷

যশবন্ত সিং মান বরাত নিয়ে ঢুকল গুরবচনের বাড়িতে৷ কিন্তু বর ছাড়া বরাত৷ শাদির আগে বর গুরদ্বারায় প্রণাম সেরে মেয়ের বাড়ি যাবে এটাই সামাজিক রীতি৷ গুরদ্বারা থেকে বেরুনোর সময় তাকে তুলে নিয়ে গেছে উগ্রপন্থীরা৷ যশবন্ত সিং মান তাদের শত্রু, তার রাজনৈতিক আদর্শ তাদের বিপক্ষে৷ ভারতবর্ষ যাতে টুটা-ফাটা না হয় সেদিকে মদত দেয় সে৷ তারা অনেক চেষ্টা করেছে যশবন্ত সিং-এর মতো কাজের লোককে তাদের দিকে টানতে, কিছুতেই পারেনি৷ দওলতপুরা গাঁওকে যে উগ্রপন্থীদের ঘাঁটি বানানো যাচ্ছে না তা যশবন্ত সিং মানের জন্যেই৷ তাই আজ শাদির দিন মওকা বুঝে কুলদীপকে তারা নিয়ে গেছে৷ বদলি চুক্তি—ছেলে ফেরত চাও তো হাত মেলাও৷

যশবন্ত সিং মান ওই অবস্থাতেই বরাত নিয়ে মেয়ের বাড়ি এল৷ খবরটা ততক্ষণে সারা গ্রামে ছড়িয়ে গেছে, কান্নার রোল উঠেছে গুরুবচন সিং-এর ঘরে, মাথায় হাত দিয়ে মণ্ডপে বসে আছে গুরবচন সিং গিল৷ যশবন্ত বন্ধুর হাত ধরে বলল, শেরের বাচ্চা কখনো হায়নার সঙ্গে হাত মেলায় না৷ ওঠো, যা হবার হয়েছে, কিন্তু ছোঁড়ি যেন লগনভ্রষ্ট না হয়৷ আমার দলের যত জাঠ ছেলে আছে, তাদের মধ্যে যাকে তোমার পছন্দ কমলের জন্যে বেছে নাও৷

বন্ধুর হাত ধরে কেঁদে ফেলল গুরবচন সিং৷—কুলদীপের বদলে…কি করে আমি কমলকে…কাকে বাছতে বলব…

কারুর কিছু বলতে হল না কমলজিৎ কওরকে৷ মণ্ডপে বেরিয়ে এসেছে সে৷ বলল, জাঠ মেয়ে একবারই স্বামী বাছে৷ কুলদীপের ছবি আনাও৷ ছবির সঙ্গেই আনন্দকারজ হবে৷

‘আনন্দকারজ’ অর্থাৎ বিয়ে৷ পাঞ্জাবের পুরনো প্রথা এটা৷ ভারতবর্ষের স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় ঘরে ঘরে এরকম হয়েছে৷ যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে বহুদিন থেকে, সে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে ফেরার, কবে ফিরবে বা ফিরবে কিনা কোনোই ঠিক নেই, তখন তার ছবির সঙ্গেই বিয়ে করেছে মঙ্গেতা, তার বাগদত্তা বধূ৷ এরপরেই হয়তো শহীদ হবার খবর এসেছে ছেলের, বৈধব্য মেনে নিয়ে সেইসব মেয়েরা সারাটা জীবন ছবির সম্পর্ককেই মেনে গেছে৷

সেইভাবে বিয়েয় বসল কমলজিৎ৷ কুলদীপ সিং মান ছবির মধ্যে থেকে তার দিকে চেয়ে হাসছে৷ ছবির ওপর গোলাপী চাদর বিছিয়ে একটা কোণা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিয়ের বাণী পাঠ শুরু করল গ্রন্থি৷ চোখ বন্ধ করল কমলজিৎ কওর৷ তার জেদে বিয়ের প্রত্যেকটা নিয়ম নিখুঁতভাবে মানা হল৷ এক এক মন্ত্রপাঠের সঙ্গে সঙ্গে কুলদীপের ছবি নিয়ে চাদরের খুঁট ধরে পবিত্র গ্রন্থসাহেবকে চারবার প্রদক্ষিণ করল কমলজিৎ, সম্পন্ন হল ‘চার লামা’৷ এরপর ‘আরদাস’৷ আনন্দকারজ অর্থাৎ শুভবিবাহের শেষ পর্ব৷ কুলদীপের ছবি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কমলজিৎ৷ সবাই হাতজোড় করে উঠে দাঁড়াল৷ গ্রন্থি সুর করে প্রার্থনা করে চলল—‘দওলতপুরার যশবন্ত সিং মান আর সুখদেব কওর মানের সুপুত্র কুলদীপ সিং মানের সঙ্গে গুরবচন সিং গিল আর রূপীন্দর কওর গিলের একমাত্র পুত্রী কমলজিতের আনন্দকারজ শেষ হল৷ রাব্বা, তোমার কৃপায় ধর্মত এরা এখন স্বামী-স্ত্রী, এদের তুমি সুখী রেখো…’

এবার মেয়ে বিদাই৷ চোখ মুছতে মুছতে রূপীন্দর কওর দেশি ঘিউতে পাকানো আটার প্রসাদী হালুয়া ছবিতে জামাইয়ের মুখে ছুঁইয়ে, মেয়েকে খাইয়ে সবার হাতে বেঁটে দিল৷ কুলদীপের ছবির গোলাপী চাদরের আঁচলে কমলজিতের মাথা নিজের হাতে ঢেকে দিল যশবন্ত সিং মান৷ গুরবচন সিং গিল-এর বুক থেকে গিল খানদানের একমাত্র মেয়েকে মান বংশের বধূর স্বীকৃতি দিয়ে নিজের বুকে টেনে নিল যশবন্ত৷ কমলজিৎকে ডাকল, চল বহু, আপনা ঘর চল…

যশবন্ত সিংকে এই প্রথম বাপ সম্বোধন করল কমলজিৎ কওর মান৷ অস্ফুটে বলল, বাপুজী!…

যশবন্ত সিং মানের বাড়ি৷ যেখানে কুলদীপের উঠিয়ে নিয়ে আসার কথা ছিল কমলজিৎকে, সেখানে তার ছবি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কমলজিৎ কওর মান৷ চোখের জলে ভেসে ছেলের ছবি আর বউ বরণ করল সুখদেব কওর মান৷ কমলজিৎ শাশুড়ির চোখ মুছিয়ে ডাকল, বিজি! (মা)

পেটের মেয়ের মতো কোলেপিঠে বড় হওয়া ছোঁড়ির মুখের এই নতুন সম্পর্কের ডাক আজ হু হু করে কাঁদালো সুখদেব কউরকে৷ বউকে জড়িয়ে ধরল৷—বেটি!

কমলজিৎ তার ঠোঁটে আঙুল রাখল৷—উঁহু, বহু বোলো!

সোহাগরাত৷ সব আলো নেভাতে নেই৷ দুলহা এসে চুড়নি সরিয়ে দুলহানের মুখ দেখবে৷ তারপর…তারপর সে-ই আলো নিভিয়ে দেবে৷ একখানা মাত্র বাতি জ্বালিয়ে রেখে ফাঁকা ঘরে খালি বিছানায় একলা বসে এতক্ষণে বুকভেঙে কেঁদে উঠল কমলজিৎ৷—কুলদীপ! কুলদীপ! আমি যে সুহাগন হয়েছি তোমার!…কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল শ্রান্ত অবসন্ন কমলজিৎ৷

ঘুম ভেঙে গেল৷ শরীরের ওপরের চাপে আর ভারে সে নড়তে পারছে না৷ ঘোর কাটিয়ে এক ঝটকা মেরে উঠতে গেল৷ আরো নিবিড় হল শরীরের ওপরের শরীর৷ ঘুমের ঘোর নয়! সত্যিই—সত্যিই! রাত নিঝুম, ঘরের আলো নেভানো, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু কমলজিতের বড় চেনা এই স্পর্শ, এই গন্ধ৷ ঠোঁটের ওপর কুলদীপের তপ্ত ঠোঁট, বুকের ওপর চওড়া বুক, আর…আর বাকিটা…বাকিটা সেই চেনা শক্ত হাত চিনিয়ে দিতে যাচ্ছে৷ কমলজিৎ গুঙিয়ে উঠল, কুলদীপ!

কুলদীপ সিং মান কমলজিতের মুখে হাত চাপা দিল৷ ফিসফিসিয়ে বলল, চুপ! এখন কোনো কথা নয়!…খরকৃপাণের মতোই এক তীক্ষ্ন বিদ্যুৎ কমলজিতের মধ্যে ঢুকে গেল৷ তীব্র ব্যথা, তীব্র সুখ৷ শিউরে উঠল কমলজিৎ, আ! আঃ, আ—আ—আহ…

বড় ঘড়িতে রাত তিনটের ঘণ্টা৷ লাফ দিয়ে উঠল কুলদীপ সিং মান৷ কমলজিতের ঠোঁটে ঘন করে চুমু খেয়ে বলল, যাচ্ছি৷ আমি যে এসেছিলাম কাউকে বলবে না, তাহলে আর আসতে পারব না৷

কমলজিৎ আঁকড়ে ধরল স্বামীকে৷—কবে ছেড়ে দেবে ওরা তোমাকে?

কুলদীপ হাসল৷—ছাড়বে কি! ওদের কাছ থেকে তো পালিয়েছি আমি!

কমলজিৎ আরো জোরে ধরে রইল কুলদীপকে৷—কিন্তু কতদিন এভাবে পালিয়ে বেড়াবে? আমাকেও তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো!

কুলদীপ সিং মান অনেক আদর করল তার সুহাগনকে৷—এখন না৷ সময় হলেই ঠিক এসে নিয়ে যাব৷ আর যখনই পারব রাতে এরকম লুকিয়ে চলে আসব৷ কাউকে বলো না যেন!

—না, না, না৷ কথা দিল কমলজিৎ৷

জানলা দিয়ে লাফিয়ে নিচে পড়ল কুলদীপ৷ জানলায় দাঁড়িয়ে রইল কমলজিৎ৷ ভোরের আর বেশি দেরি নেই৷ ঘড়িতে ঢং করে সাড়ে তিনটে৷ পেছন ফিরে তাকালো কুলদীপ, হাত নাড়লো, ছায়াছায়া আঁধারের মধ্যে দিয়ে কমলজিতের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল৷

বিছানায় এসে বসল কমলজিৎ কউর৷ সারা শরীরে এক আশ্চর্য স্বাদ৷ হাঁটতে-চলতে কষ্ট হচ্ছে, কোমর টনটন করছে ব্যথায়, তবু বড় মধুর এ যন্ত্রণা৷ নেশার মতো মাদক আচ্ছন্নতায় চোখ বুজে আসছিল৷ শুয়ে পড়তে গেল৷ বুকে আঙুল লেগে চিনচিন করে উঠল জ্বালায়৷ কাপড় সরিয়ে দেখল কুলদীপের হাতের লোহার কড়ার ঘষায় চামড়া ছড়ে গেছে৷ হাসল কমলজিৎ, ঘুমিয়ে পড়ল৷

ধড়মড় করে জেগে উঠল কমলজিৎ কউর৷ কখন সকাল হয়ে গেছে! দরজায় ধাক্কার পর ধাক্কা পড়ছে৷ তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দেখে তার শ্বশুর—যশবন্ত সিং মান৷ তার চোখ রক্তবর্ণ৷ কমলজিৎকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে নিজের ঘরে গেল৷ সেখানে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রয়েছে সুখদেব কউর, গুরবচন সিং গিল আর রুপীন্দর কউর মুখ ঢেকে কাঁদছে৷ মেয়েকে দেখে হাহাকার করে উঠল তারা৷ ঘরে আরো অনেক লোক৷ তাদের টুকরো টুকরো কথা শুনতে পাচ্ছিল কমলজিৎ৷ পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে কুলদীপ সিং মান৷

তার সঙ্গে সোহাগরাত বানাতে আসার ফলেই তাহলে…গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল কমলজিৎ৷—কব, কব, কব! কখন?

যশবন্ত সিং তাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কেঁদে উঠল৷—রোও বিটিয়া, কাঁদ বেটি কাঁদ৷ সে নেই—‘কখন’ তা জেনে কি হবে?

গুরবচন সিং কান্নার মধ্যে বলল, কাল রাত বারোটার ইধার-উধার৷

সব্বাইকে চমকে দিয়ে হেসে উঠল কমলজিৎ৷ হাসতে হাসতে সমানে মাথা নেড়ে নেড়ে বলতে লাগল—না, না, না, না…

পাগল হয়ে গেল নাকি মেয়েটা? গুরুবচন আর যশবন্ত একসঙ্গে ভীষণ ঝাঁকুনি দিল কমলজিৎকে৷—হ্যাঁ বেটি হ্যাঁ৷ রাত বারোটা নাগাদ পালাতে গিয়েই…৷ গলা বন্ধ হয়ে গেল দুই হতভাগ্য বাপের৷ যশবন্ত সিং মান তার একমাত্র ছেলের নিশানী ছেলের বউয়ের হাত ধরে মিনতি করল, হোঁশ মে আ বেটি, হোঁশ মে আ! কাঁদ বেটি কাঁদ!

কিন্তু কাঁদবার বদলে ফুলে ফুলে হেসেই চলল কমলজিৎ কউর৷ তবে তো এদের জরুর গলতি হয়েছে! রাত বারোটার পরে তো কুলদীপ আর ও…৷ বুকের খাঁজে হাত দিল কমলজিৎ৷ ছালওঠা চামড়া জ্বলে উঠল সঙ্গে সঙ্গে চিনচিনিয়ে৷ হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল কমলজিৎ এবার৷ তবে তো আচ্ছা বুদ্ধু বানিয়েছে সকলকে তার কুলদীপ! সাড়ে তিনটের সময় জানলা দিয়ে লাফিয়ে নেমে তো সে…৷ না, না৷ মুখে চুড়নি গুঁজে দিল কমলজিৎ৷ কাউকে সে কিচ্ছু বলবে না৷ সে জবান দিয়েছে৷ জানাজানি হয়ে গেলে কুলদীপ আর তার কাছে আসতে পারবে না!

তিন মাস পরে সোহাগ রাত না হওয়া কুমারী বিধবা কমলজিৎ কউর নিঃসঙ্কোচে জানিয়ে দিল সে তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা৷

হাজার জেরা, মারধোর, কিন্তু না—তার এক কথা৷—বাচ্চার বাপ কুলদীপ সিং মান৷ এ ছাড়া আর কিচ্ছু বলব না আমি৷

বলবে কি করে? মান বংশের ইজ্জত নিয়ে তাদের মরা ছেলের দোহাই দিয়ে খেলতে নেমেছে যে বেইমান ছোকরি! যাকে মেয়ের চেয়ে বেশি আদরে তারা বুকে করে রেখেছিল৷ তবু যশবন্ত সিং স্ত্রীর কাছ থেকে নিঃসন্দেহ হয়ে নিতে চাইল৷—কুলদীপের কারণেই…মানে বিয়ের আগেই কি…

সুখদেব কউর দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ল৷—না৷ মাসের ঋতুস্নান সেরেই এ বিয়ে হয়েছে৷ তখন গর্ভ হতে পারে না৷ এ গর্ভ হয়েছে শাদির পরে৷ যেখানে সোহাগরাত পর্যন্ত হয়নি, তার আগেই যেখানে কুলদীপ…৷ কাঁদতে কাঁদতে হিসহিসিয়ে উঠল সুখদেব৷—হঠাও, এ কালনাগিনকে হঠাও জী…

আর কোনো সন্দেহ রইল না৷

…ফেটে পড়ল গুরবচন সিং গিল৷ এ হতে পারে না৷ মেয়ে তার পাগল হয়ে গিয়ে কি না কি বলেছে সেই অজুহাতে বিধবা মাথা খারাপ বউকে ঘাড় থেকে নামানোর জন্যে এই ফিকির৷ মুছে গেল ছোটবেলা থেকে চুন চুন করে গড়ে ওঠা দোস্তি৷ মাঝে কমলজিৎ, তার দুধারে দুই ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো যশবন্ত সিং মান আর গুরবচন সিং গিল৷ এসব ঝগড়া আস্তে হয় না৷ লোক জমে গেল৷ গর্জন করে উঠল গুরবচন৷—খবরদার! বলো বউয়ের ওপর দরদ ফুরিয়েছে, বিধবা বউকে আর রাখতে চাইছ না, কিন্তু বদনামী করো না৷ গুরুবচন সিং গিল অমন শও বিটিয়াকে জীবনভোর খাওয়ানোর ক্ষমতা রাখে, কিন্তু তার জাঠ-লহু বদনামী সহ্য করে না৷

জাঠ লহু? জাঠ রক্ত? ঘেন্নায় থুতু ফেলল যশবন্ত সিং মান৷—সেজন্যেই তো আরো লজ্জা আমার৷ জাঠের লহুতে এত ময়লা?

ছাতি ফুলিয়ে বিশাল হয়ে উঠল গুরবচন সিং৷ কোমর থেকে কৃপাণ টেনে নিতে গিয়েও সামাল দিল৷—ঠিক আছে! এখুনি আমি ফরিদকোট যাচ্ছি৷ সেখান থেকে সবথেকে ভালো মেয়েদের ডাগদার এনে কমলকে পরীক্ষা করাব৷ তোমরা সবাই সাক্ষী থাকবে৷ যদি এ কথা মিছা হয় তো গুরুজীর শপথ—আবার কৃপাণে হাত দিল গুরবচন৷

যশবন্ত বুক টান করে বলল, তখন তোমার কৃপাণের সামনে এ কলিজা ধরে দেব৷ সবাই সাক্ষী৷ কিন্তু তোমার মেয়েকে জিগ্যেস করছ না কেন?

—ও তো পাগল! কুলদীপের মরার খবর পেয়েই তো ও পাগল হয়ে গেছে৷ ওকে জিগ্যেস করে কি হবে?

শান্ত মুখে এতক্ষণে কথা বলল কমলজিৎ৷—না বাপু, আমি সুহাগন, কুলদীপের বাচ্চার…

থাবা দিয়ে মেয়ের মুখ বন্ধ করে দিল গুরবচন সিং গিল৷ ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে টেনে নিয়ে গিয়ে ঘরে বন্ধ করে রেখে স্ত্রীকে সাবধান করে দিয়ে বেরিয়ে গেল৷

ডাক্তার, লেডি গাইনি ডাক্তার, প্যাথোলজিস্ট, ফরিদকোট থেকে নানারকম পরীক্ষার পুরো টিম নিয়ে এসে গুরবচন সিং গিল যখন ঘরের দরজা খুললো তখন কমলজিৎ কোমায় আচ্ছন্ন৷ সব ব্যবস্থা নিয়ে আসতে আসতে পুরো দুটো দিন এর মধ্যে কেটে গেছে৷ কমলজিতের অবস্থা দেখে তীব্র ভর্ৎসনা করে ওই অবস্থাতেই যাবতীয় টেস্ট সারল ডাক্তাররা৷ রায় বেরুল—ফলস প্রেগনেন্সি! পেটে বাচ্চা নেই!

গ্রামের বিশিষ্ট লোকেরা জড়ো হয়েছে গুরবচনের বাড়ি৷ যশবন্ত সিং-ও এসেছে৷ ডাক্তাররা, বিশেষ করে মহিলা ডাক্তারটি বুঝিয়ে দিল ব্যাপারটা৷ মা হবার তীব্র লিপ্সা থেকে মেয়েদের, বিশেষ করে বিবাহিত মেয়েদের, অনেকসময় এরকম হয়৷ আর কমলজিৎ কউর তো সবদিক থেকেই রিক্ত৷ প্রচণ্ড মানসিক আকাঙ্ক্ষা থেকে তার এরকম হতেই পারে৷ তবে, খরদৃষ্টিতে ডাক্তারটি বিঁধল যশবন্ত সিং মান আর গুরবচন সিং গিলকে, এখন যে অবস্থা হয়েছে এর, বাঁচবে কিনা সন্দেহ৷ আমাদের যা করার করেছি…৷

জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল তারা৷ গুরবচনের পায়ের কাছে বুকের জামাটা ছিঁড়ে দিয়ে আছড়ে পড়ল যশবন্ত সিং মান৷ গুরবচন সিং গিল বাঘের গলায় গর্জে উঠল, আরো অনেক কঠিন শাস্তি তোমায় আমি দেব! জাঠ-গিলের রক্তে এত ময়লা, না?

গাইনি ডাক্তার ঘুরে তাকালো৷ গুরবচনকে ডেকে বলল, একটু শুনুন এদিকে এসে!

সকলের কানের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল তারা৷ লেডি ডাক্তার আস্তে আস্তে বলল, নীতির দিক থেকে আপনার বন্ধুর সঙ্গে ঝামেলা না করাই আপনার উচিত৷ আপনার মেয়ের প্রেগনেন্সি ফলস, কিন্তু ভার্জিন—কুমারী সে নয়৷ তার পুরুষ-সংসর্গ হয়েছে৷

হাঁ করে উঠল গুরবচন সিং গিল, ডাক্তার সহানুভূতির গলায় বলল, বিশ্বাস করুন…এখনকার টেস্ট-এ এগুলো ধরা যায়, এক্ষেত্রেও ধরা পড়েছে৷

চলে গেল তারা৷ একইভাবে পড়ে রয়েছে যশবন্ত সিং মান৷ তার সামনে এসে দাঁড়াল গুরবচন সিং গিল৷ বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে মেয়ের ঘরে এসে বসল৷ দুজনের বুক তখন দুভাবে জ্বলছে৷

রাত৷ হঠাৎ কমলজিতের চোখ খুলে গেল৷ নেভার আগের প্রদীপের মতো দপদপে দৃষ্টি৷ দরজার দিকে চেয়ে হাসিমুখে ডেকে উঠল, কুলদীপ! এসেছ? এবার সময় হয়েছে আমাকে নিয়ে যাবার? দেখেছ, আমি কথা রেখেছি৷ সোহাগরাতে যে আমার কাছে এসেছিলে কাউকে তা বলিনি!

গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল যশবন্ত সিং মানের৷ শাদির দিন কুলদীপের গলায় তার নিজের হাতে পরিয়ে দেওয়া গুরুজীর লকেট! গুরদ্বারা থেকে তুলে নিয়ে যাবার সময়েও যেটা তার গলায় ছিল কিন্তু সৎকারের সময় আর পাওয়া যায়নি, সেটা কমলজিৎ বেণীর ভেতর থেকে বের করেছে! যশবন্ত সিং মান বন্ধুর হাত খামচে ধরল৷ রুদ্ধশ্বাসে কথাটা জানাল৷

ততক্ষণে প্রদীপ নিভে গেছে৷ চোখ বন্ধ, বিছানায় পড়ে আছে কমলজিৎ৷ চিৎকার করে কেঁদে উঠেছে রূপীন্দর কওর৷ এবার গ্লানিমুক্ত হয়ে শুদ্ধ কান্না কাঁদতে পারল গুরবচন সিং গিল৷—ছোঁড়ি হামাদের সত্যিই সুহাগন, দোস্ত!

—সমাপ্ত—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *