সংশয়, শঙ্কা ও ভরসা

দিনের মনে দিন চলে গেল, রাত্রির মনে রাত্রি। কিন্তু ভানুকে মুক্তি দিতে কেউ এল না। গঙ্গার বুকের দূরবিসারী চর থেকে উঠে আসা কালবৈশাখীর ঝড় বয়ে গেছে প্রতি সন্ধ্যায়। গুপ্তিপাড়ায় ছিন্নভিন্ন লতাপাতায়, ভাঙা গাছপালায়, গরিবের দোমড়ানো চালায় প্রকৃতির সেই রুদ্র উল্লাসের দাগ লেগে আছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের খর রৌদ্রে ফাটল ধরেছে মাঠ ও পথে। ঝিঙে পটলের ক্ষেতগুলি ঝলসে নেতিয়ে পড়ছে। ফুটি খরমুজা ফেটে হাঁ করে রয়েছে মাঠে। তাপ-তাড়নায় গর্ত ছাড়া তৃষ্ণার্ত আল-কেউটে খরমুজার ঠাণ্ডা গহ্বরে ঢুকিয়ে রয়েছে মাথা। ফুটি খরমুজার তীব্র গন্ধেও তার নেশা লাগে। গঙ্গা তীরের চিড় খাওয়া উঁচু পাড়ে এখানে সেখানে হাঁ করে রয়েছে হাড়ল গর্ত। মুখ ব্যাদান করে রয়েছে পিপাসার্ত মাটি।

জ্যৈষ্ঠেরও শিয়রে সংক্রান্তি। আষাঢ় আসছে। আসছে, কিন্তু রোদজ্বলা দপদপে আকাশটার দিকে তাকিয়ে আষাঢ়ের সাড়া মেলে না এখনও।

বন্দিনী ভানু তাকিয়ে দেখে। শৈলীর বেড়াকাটা জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকে সারা দিন মাঠের দিকে। শুধু মাঠ। চাষ-আবাদহীন ফুটিফাটা মাঠ। গাঁয়ের একটেরে, মাঠের ধারেই শৈলর ঘর। লোকজনের আনাগোনা ছিল না।

এখন প্রায়ই থেকে থেকে দেখা যায় নীলকুঠির লেঠেলদের। নজর টাটিয়ে ওঠা দুস্তর মাঠের এখানে সেখানে খাড়া পেত্নির মতো পোঁতা বাঁশ। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, পেত্নিগুলি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে এদিকেই, এই বেড়াকাটা ঘুলঘুলিতে ভানুর দিকে। ওই পোঁতা বাঁশগুলি নীলের আবাদের দাগ। গায়ের জোরে দাদন দেওয়া রায়তের জমি। ওখানে সারাদিন পালা করে পাহারা দেয় কুঠির লেঠেলরা। রায়তের ভয়ে নয়। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নাকি আসতে পারেন যে কোনওদিন। এ সব নেই হালিশহরে, ভানুদের গাঁয়ে। ব্যাপার শুনে ভানু ভয়ে আরও কাঁটা। ধান রুইতে পারবে না। এক বার দাদন দেওয়া হল তো, হাল বলদ সবেরই দাদন। লোকে চাষ করবে নীল, গিলবেও নীল! তাই নিয়ে কথা হয়েছে। কথা উঠেছে কলকাতার কাগজে। চারিদিকে এই নিয়ে গণ্ডগোল। গুপ্তিপাড়াতেও শোরগোল পড়েছে খুব। হুগলির বড় সাহেব নয়, হুগলি বর্ধমানের বড় সাহেব আসবেন। সে গোরা নাকি আবার রায়তের দিকে টেনে চলেন। গোরারও আবার টান! টান বইকী। নইলে কুঠির সাহেবরা অমন ভয়ে কাঁটা হয়ে লেঠেল বসায় দাগের বাঁশে। বড় সাহেব আসছে এই খবর পেলেই দাগের বাঁশ তুলে সব বেমালুম পাচার করে দেবে তারা। কুঠির সাহেবের হুকুম।

সারা গুপ্তিপাড়া তোলঘোল। একরকমের ঝড় লেগেছে সারা গাঁয়ে, মস্ত চাকলায়। তার চেয়েও বড় ঝড়ের মাতন ভানুর বুকে। সেই উথাল-পাথাল মন নিয়ে সে যখন বেড়াকাটা ঘুলঘুলি দিয়ে তাকিয়ে থাকে দুরে, তখন চোখে পড়ে শুধু এই সব। চোখে পড়ে আর শোনে শৈলর মুখে। শৈল এসে গল্প করে।

যাবার সময় লেঠেলরা ডাক দিয়ে যায়, শৈল দিদি আছ নাকি গো৷ থাকলে শৈলী জবাব দেয়। ওরা যমের দোসর, কিন্তু শৈলর সঙ্গে দিব্যি হেসে গল্প করে। কুঠির সাহেবদের মনের সুখে গাল দিয়ে যায় নিজেরাই। যমের দোসর যমকে গালি দেয়। শৈল না থাকলে, না জবাব দিলেও দিক করে না। চলে যায় আপন মনে। শৈলকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে একটু হাস্য-রসের কথা বলে।

কিন্তু বুকের মধ্যে কাঁপে ভানুর। বড় ঘরের ঘুলঘুলি থেকে চকিতে সরে আসে। বুকের ধুকধুকিতে শোনে ওদের চলে যাওয়া পায়ের শব্দ। তারপর উঁকি মারে। ওরা কোনওদিন ভানুকে দেখেনি। দেখা দিতে বারণ আছে শৈলর। বুকের মধ্যে টনটন করে লোকগুলির দিকে তাকিয়ে। যেন তার বাবার মতো। হুমদো হুমদো মানুষগুলি। দেখলেই মনে হয়, তার বাপের মতো গোঁয়ার। এখুনি এদিকে ফিরে গাঁক করে উঠবে তাকে।

কোনও কোনও দিন দেখা যায়, মাটি কাঁপিয়ে, ধুলো উড়িয়ে, ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে স্বয়ং কুঠির সাহেব। মাথার উপরে ফটফট হিসহিস করে বাজে চাবুক। আমিনের ঘোড়াও কখনও সখনও ছুটে যায় এমনি। অমনি ভয়ে আতঙ্কে যন্ত্রণায় অবশ হয়ে যায় ভানুর শরীর। মনে হয়, ওই ঘোড়ার খুরের বাজ ফাটা শব্দ বাজছে তার মাথায়। মনে হয়, সত্যি মনে হয়, ঘোড়া লাথি মারছে তার মাথায়। ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে তার খুলি। দুহাতে মাথা চেপে চাপা গলায় চিৎকার করে, গেলুম, মলুম গো!এমনি অবস্থায় যখন তার চেতনা হারিয়ে যেতে থাকে, তখন সে দেখে ঘোড়ার ঘাড়ে মানুষের মাথা। তার বাবার রক্তাক্ত ভাঙা খুলি। বলে, কই লো গঙ্গা, চোখ খোল, আমি এইছি! ভয় কী! খাচ্ছিস, পরছিস, বেশ আছিস। আমি তো আর ফিরে আসব না। শৈলী বাগদিনি তো তোকে ভালবাসে, ওর কথা শুনিস। ভয় কী? এই তো আমি চলে যাচ্ছি।

ধীরে ধীরে, মাঠের বুকে মিলিয়ে যায় ঘোড়ার পদশব্দ। কিন্তু সহজে জ্ঞান ফেরে না ভানুর। শৈল এসে চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দেয়। মুখের মধ্যে খুন্তি পুরে দিয়ে দাঁতকপাটি ছাড়ায়। বুকের উপর মাথাটি টেনে নিয়ে ডাকে, নাতনি! নাতনি গো!

যেন ঘুমের ঘোরে ডাক শুনতে পায় ভানু। চোখ খোলে। রক্তবর্ণ চোখ। সেই চোখ দেখলে শৈলর বুকের মধ্যে কাঁপে। কী চোখ! যেন কান পর্যন্ত টানা মা দুর্গার দপদপে চোখে জ্বর-বিকারের ঘোর। শৈল ভাবে, প্রকৃত মহিষমর্দিনী ভর করেছে ভানুর উপর। হয়তো এখুনি রুদ্রাণী রূপে ঠেলে উঠে দাঁড়াবে শৈলর বুকের উপর! হুশ ফিরিয়ে আনার জন্য সে সন্ত্রস্ত গলায় জোরে ডাকে, নাতনি। গঙ্গা…গঙ্গা… ।

ভানু তাকায়, যেন ঘুম ভাঙা চকিত চমক চোখে। চেনা অচেনার বিস্মিত সংশয়ে ভরা সেই চোখ। কে? কে গো তুমি? কালো কালো মুখোনি। তরাস ভরা চোখ! কালো চুলের গোছা মাথায়, গলায় রুপোর হাঁসুলি। সারা গায়ে রামধনু রং খেলা করছে শান্তিপুরে ডুরে শাড়ির। কে? চিনি চিনি, চিনিনে যেন! এ যেন বিনি জেলেনি। তবে কালো; কালো বিনি জেলেনি যেন এটি! তুমি কি গঙ্গার মা?

না। বিনি জেলেনি নয়, শৈল বাগদিনি। সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে ভানুমতীকে। কী মেয়ে এল আর কী হল। জ্বলন্ত আগুনের গায়ে ছাই পড়েছে। মেয়ের সে আগুনের মতো রং কালি হয়েছে। হাসি নেই, এসে অবধি ছিলও না কোনওদিন। কিন্তু জাত শলুইয়ের মতো যে তেজ ছিল, ফোঁসফোঁসানি ছিল তা কোথায় চাপা পড়ে গেছে। আর বাড়া ভাতে লাথি দেয় না, কাপড় ছিঁড়ে কুচি কুচি করে না। কাঁদে না মেঝেয় দাপিয়ে পড়ে। নতুন খোলস ছাড়া সাপের মতো তার ধীর গতি। মন্ত্রবাণ ছুঁড়ে কে হরণ করেছে তার কথা। চোখে ছিল আগুনের লেলিহান শিখা। এখনও আগুন আছে। কিন্তু সে শিখা এখন অঙ্গারের মতো স্থির। চোখের এ দীপ্তি যেন আরও অসহ্য। এখন সে শান্ত। বোবা পাগলিনীর মতো বিস্মিত স্থিরতা, থমকানো ভাব।

তবুও তলে তলে চোরা বানের ধারা বইছে। যেন আঁস্তাকুড়ের ছাই ধুলো মাখা তেজি লাউ ডগাটির মতো ভানুর সর্বাঙ্গে জোয়ারের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। নতুন দেখা দেয়নি, জোয়ার নিয়েই সে এসেছিল। শৈল দেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ভানুর আলতা পরা পা। প্রথম প্রথম আলতার বাটি লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে। এখন আর দেয় না। শুধু চেয়ে দেখে। হাতে বড় বড় রুপোর চুড়ি। শৈলর হাতের চুড়ি। তেল জলে ধোয়া মোছা যত্ন করে বাঁধা মেনকা খোঁপা। গলায় শৈলরই রুপোর হার। সারা দেহ যেন একটু ভার ভার। যেন একটু বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। কিন্তু শৈল মেয়েমানুষ, ভানুর একমাত্র সঙ্গিনী। সে তো জানে, মেয়েটা শিশু। একেবারে বাচ্চা। ওর কিছুই হয়নি।

শৈল আবার ডাকে, গঙ্গা, নাতনি লো

সংশয় দূর হয় ভানুর চোখের। বিনি জেলেনি নয়, দিদিমণি। এই ডাকই শিখিয়ে দিয়েছে তাকে শৈল। সে জবাব দেয়, অ্যাঁ?

শৈল বলে, কী হয়েছে তোর। কী হল তোর?

ভানুর চোখে অমনি বড় বড় ফোঁটায় জল জমে ওঠে। চোখের সামনে শৈলর মুখটা কাঁপতে কাঁপতে দুরে সরে যেতে থাকে। ফিসফিস করে বলে, দিদিমণি। বাবা..আমার বাবা!…

জানে শৈল। বাপের চিন্তাই মেয়েটাকে এমনি পাগল করে। বড় বাপ-সোহাগি মেয়ে। শুতে বসতে বাপকে দেখে। মা-পালানো মেয়ে যে! তাই অমনি সব বিষয়ে বাবাকে মনে হয়।

শৈল বলে, মিছে কেন ভাবিস নাতনি। ও কিছু নয়। সে যে মরে গেছে। বড় যে বাপ-সোহাগি ছিলি, তাই সে অমনটি করে দুঃখু দেয়।

তারপর আপন মনে বলে ফিসফিস করে, যে কাঁদিয়ে যায়, সে শব্দুর। মরে যে তোর বাপ শত্রুর হয়েছে। মিছে ভাবিসনে।

বলতে বলতে শৈলর চোখেও জল দেখা দেয়। আর তো সব কথাই বলেছে সে ভানুকে, শুধু বাবার মৃত্যু-সংবাদটুকু জিইয়ে রেখেছে শৈল। তক্ষকের নজরে জক্কি দিয়ে আগলে রেখেছে শুধু সেই সংবাদটি, বাপ নেই! বাপ নেই, বাপ নেই।

তবু জল আসে শৈলর চোখে। সে কারও মা নয়, কারও বোন নয়, আজকে আর কোনও মায়ের সে কন্যা নয়। সে বউ নয়, গুপ্তিপাড়ার পঙ্ক। স্বৈরিণী শৈলবালা। তবু তার চোখে জল আসে। জল আসে পোড়চোখে, এক ফোঁটা মেয়েটাকে তার বাবার মরার কথা বলতে।

দিন চলে গেছে। বৈশাখের রুদ্র ঝড়ে শৈল কেঁদেছে এই মেয়েটাকে বুকে করে। এই মেয়েটার মতো কেউ কাঁদেনি তার বুকে পড়ে। কেউ কাঁদায়নি তাকে। আর যে কটি মেয়ে ইতিপূর্বে এসেছে, তারা এসেছে ভারী বয়সে, নিরাশ্রয় ও অনাহারের তাড়নায়। তারা কাঁদেনি, মজায়নি। হেসেছে, খেয়েছে, ব্রাহ্মণী সেজে বরের ঘরে চলে গেছে।

দিন চলে যায়। শৈল আর ভানু বুকে মুখে কাঁদে। শৈলর যে বলিষ্ঠ দেহে কোনও সন্তান মানুষ হয়নি, যে দেহ সমাজের অন্ধ-যৌবনের রং-এর বিবি হয়ে ফিরেছে, সেই দেহে, সেই কোলে বুকে, সেই আগুনের মতো পাঁকে ভানু শান্তি পেয়েছে। বিশ্বাস ও মমতায় নিজেকে সঁপে দিয়েছে। কোনও গোপনতার আড়াল রাখেনি শৈল। ধীরে ধীরে, সইয়ে সইয়ে সে সবই একটু একটু করে বলেছে ভানুকে। শৈলর জীবনের অনেক অধ্যায়ের কয়েকটি পর্বের অভিজ্ঞতায় তাকে সাবালিকা করে তুলেছে।

লোকে বলে, কী হল শৈলীর? পাড়ায় আসে কম। আসে তো বসে না, দু দণ্ড কথা বলে না। কী হল? নতুন কেউ জুটল, নাকি আগের কেউ আবার ধরে বাঁধল। বলা তো যায় না। দিন যাচ্ছে, চেহারা ৪৪

ফিরছে যেন শৈলর। পাড়ার মিনসেদের নজর ফাঁকি দিয়ে খুঁড়ি পাড়ায় ঢুকতে পায় না। পাপিষ্ঠার ছলকলারও তো অন্ত নেই।

কি ছোট জাত আর বড় জাত, দুপুরের সধবা বিধবা আর পান দোক্তার আসরে শৈল কত গল্প বলে, কত রকমারি গল্প। পুরুষদের বেহায়াপনার, পাগলামির ও মাতলামির। সে গল্প শুনতে ঘরের মেয়েরা বড় ভালবাসে। শুনতে শুনতে নিজেরাও মাতালের মতো ঢলাঢলি করে, এ ওকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে। তারপর যেন কেঁদে ফেলে বলে, মিনসেরা আমাদের কাছে রাত্রে যখন ঘরে আসে, তখন যেন ভিজে ন্যাতা। হাজার কাছে ঘেঁষলেও চোখ মেলে না, যেন ঘাটের মড়া।

ক দিন ধরে শুধু জিজ্ঞেস করে সবাই, কী হয়েছে লো তোর শৈল?

শৈল বলে, মাথাধরা অষ্টপোহর!

ওমা, তাই নাকি? কেন লো?

কী জানি গো। গা বমি বমি করছে সারাদিন। বলে শৈল হাঁপায়। মাথায় হাত দিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। করুণ চোখে তাকিয়ে হাসে।

আসরের মহিলাদের গায়ে কাঁটা। বলে, ওমা গো! আবার? বলি, কবে থেকে লো মুখপুড়ি, কার ব্যাপার?

শৈল বলে, কী জানি! কার নাম করব বলো?

আসরের সধবাদের মুখ চুন হয়ে ওঠে। সত্যি, কার নাম করবে শৈল? কার, কোন পুরুষের, এ আসরের কার স্বামীর নামে কলঙ্ক দেবে সে। বলে, ও, তাই বুঝি ঘর থেকে বেরুস না বড় একটা। তা এত লোকের ব্যবস্থা করিস, নিজের ব্যবস্থাও একটা করে নে।

শৈল বলে, তাই ভাবছি।

সত্যি, কত ছলাকলা। ছলাকলার অন্ত নেই। পাড়ায় পাড়ায় রাষ্ট্র হয়েছে, শৈল গর্ভবতী। অমনি কাজে কর্মে শৈলর ডাক কমেছে। রং-সন্ধানী পুরুষেরা ঠোঁট উলটে মুখ ফিরিয়েছে। আর ওদিক মাড়ায় না। এই তো চেয়েছিল শৈল।

মনে মনে বলে শৈল, সত্যই সে গর্ভবতী। ঘরজোড়া তার অমন মেয়ে, সে যে সবদিক থেকে তার গর্ভযন্ত্রণারই সামিল। গর্ভাধারের যন্ত্রণা, সে যে সুখের, দুঃখের আর সংশয়ের। শৈলরও তাই।

দিন গেছে আর শৈল বলেছে সব কথা ভানুকে। বলেছে, কী চায় সর্বেশ্বর আর নন্দন। শুনে ভানু ভয়ে, আতঙ্কে, ব্যথায় কুঁকড়ে উঠেছে। শৈলকে আঁকড়ে ধরেছে আরও জোরে। বলেছে, না, না, না, তুমি আমায় ছেড়ো না দিদিমণি।

কী হবে, কী হবে এই মেয়ে নিয়ে! তবু বলেছে শৈল, বাপ-মরা কুলছাড়া মেয়ের ভবিষ্যতের ভয়াবহ ছবি এঁকেছে শৈল ভানুর চোখের সামনে। এঁকে বলেছে, একি ভাল?

ভানু ডুকরে উঠেছে, না না না।

শৈল বলেছে, তার চেয়ে এই ভাল। এই হোক। সে বুঝিয়েছে ভানুকে, বিয়ে বর ঘর, সে আশা আজ ঘুচেছে তার। তার চেয়ে এই ভাল। ভানুও শোধ নিতে পারবে, আবার ফিরে আসতে পারবে শৈলর কাছে এক গা গহনা নিয়ে। কার কাছে কাঁদবে, কার কাছে হাত পাতবে ভানু। কে দয়া করবে, কে ভালবাসবে। যে পথে আজ তাকে টেনে আনা হয়েছে, সেই পথেই নিজের জীবনকে চালিয়ে নিতে হবে। বাপ নেই, এ পথে শৈল আছে তার পেছনে। সমাজ ও পুরুষের মিথ্যা আশ্বাসে লাভ নেই। ভানু এ সংসারকে চিনুক, দেখুক, বুঝুক। এই সমাজেরই বুকে ডঙ্কা মেরে বেঁচে থাকতে হবে তাকে। বেঁচে থাকতে হবে ওদেরই মধ্যে।

সর্বেশ্বর নন্দন তাকে যেখানে দিয়ে আসবে, সেখানে থাকবে শৈলর সতর্ক চোখ। যেদিন খুশি, যখন খুশি আত্মপরিচয় দিয়ে কিংবা না দিয়ে সে আবার ফিরে আসতে পারবে শৈলর কাছে। তার কীসের দায়, কীসের দায়িত্ব। মহারানির রাজত্বে তো প্রকাশ্যে মানুষ বিক্রি নেই। তবে? এমনি করে সর্বেশ্বরেরও সর্বনাশের মন্ত্র পড়িয়েছে শৈল ভানুকে। বাইরে বৈশাখের ঝড় হয়েছে, শৈলর চালা দুলেছে। আর ভানুকে সে এই বুঝিয়েছে। সে সৎভাবে যা বিশ্বাস করে, এ অবস্থায় ভানুর জন্য যা ভাল বুঝেছে, তাই বলেছে। সর্বেশ্বরের হাত থেকে আপাতত রেহাই নেই। কিন্তু রেহাই রয়েছে ভানুরই হাতে। আজ বেঁকে বসলে সর্বেশ্বর অন্য মতলব ভাঁজবে। কার কাছেই বা ফিরে যাবে ভানু! বাপ নেই। সে কি আজীবন শৈলর কাছে থাকতে রাজি নয়?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, রাজি ভানু। এমন করে কে অকপটে সব সত্য কথা বলে। শৈল তাকে মিথ্যে আশা দিয়ে ভোলাতে পারত। সেজে থাকতে পারত সর্বেশ্বরের বিধবা বোন। কিন্তু সে সব ফাঁস করে দিয়েছে। সর্বেশ্বরের নন্দনের চরিত্রের কথাও বলে দিয়েছে। বলেনি শুধু ভানুর বাবার বেঁচে থাকার কথা।

তবু, বড় ভয়, বড় ভয়। এই ছোট বুকে এত ভয় সয় না। এত সব অজানা অচেনা বিপদ ও আতঙ্কের মুখোমুখি দাঁড়াতে এ বয়স বার বার মুখ থুবড়ে পড়ছে। এসময়ে থেকে থেকে, বিদ্যুৎচমকে একটি মুখ মনে পড়ে ভানুর। সামান্য দেড়-দুমাসের অভিজ্ঞতায় অনেক অগ্রসর হয়েছে তার মন। তাই মনে পড়ে। মনে পড়ে, নবর মুখ। হালিশহরের নব, তার বাবার চব্বিশ ঘণ্টার সঙ্গী, শাকরেদ। হাঁ করে লোকটা তাকে দেখত, অকারণে হাসত, আর কাছে কাছে ঘুরঘুর করত। বড় রাগ হত ভানুর। কী যে সব ছাই আনকথা বকত! কিন্তু সেই নবর চাউনি মনে হতেই আজ ঠোঁট ফুলে ওঠে ভানুর। সেদিন নবর চাউনির অর্থ যে আবছায়ার মধ্যে ছিল, আজ তা কেমন করে যেন স্পষ্টই হয়ে ওঠে তার চোখে। চোখে ও মনে। আর কল্পনায় নবকে সামনে দাঁড় করিয়ে, দ্বিধাহীন চিত্তে সে অভিমানে ঠোঁট ফুলায়। কাঁদে আর মনে মনে বলে, এখন দেখছ না? বাপ মরল চুঁচুড়োয়, সেই সংবাদটা নিয়েও তো হালিশহরে আসতে পারতে। এমনিতে কত ঘোরাফেরা। যখন সর্বেশ্বর আর নন্দন নিয়ে এল, তখন কোথায় ছিলে? আজ নবর কথা মনে করে বুকের মধ্যে হা হা করে ওঠে। যুবতীর অনুরাগে নয়, ছোট মেয়েটির একমাত্র স্বর্গের মতো আশ্রয়ের জন্য। নবকে আজ অকূল সমুদ্রের ভেলা মনে হয়। না, মুখ ঝামটা ছাড়া নবর সঙ্গে সে কথা বলতে পারবেনা। এত ভয়, এত আমতা আমতা কথা পুরুষের! তার সঙ্গে আর কেমন করে কথা বলবে। ভানু। কিন্তু সে-ই যে আজ বন্দিনী রাজকন্যার চোখে মুক্তিদাতা রাজপুত্র। কোন মন-ভ্রমরা গিয়ে সংবাদ দেবে তাকে, কোন পক্ষী গিয়ে বলবে তাকে।

আশা নেই। তবু সারা মন চায় নবকে। নবর জন্য আজ বুকের মধ্যে হাহাকার। শুধু বিপদে নয়, নিজের অগোচরে সে যে নবকেই এক পুরুষ বলে জানত। তাকেই গাল দিতে, ভেংচাতে, খুনসুটি করতে ভাল লাগত। সে যে তখন বুঝত না, তার অপ্রস্ফুটিত কুঁড়ির গায়ে বার বার নব-ভোমরা পাখার ঝাঁপটা দিয়ে গেছে। আজ সেই কুঁড়ি দল মেলেছে, কিন্তু ভোমরা আজ ডানা ভেঙে কোথায় পড়ে আছে।

দিন গেছে, আশা গেছে। আজ আশা শুধু শৈল, যে ভরসা দিয়ে তাকে বলেছে, ভয় নেই। এই জীবনের রীতি বুঝিয়েছে, কাঁটা হয়ে কাঁটা তুলতে হবে। যেদিন চলে আসতে চাইবে ভানু, সেইদিনই শৈল তাকে নিয়ে আসবে। পৃথিবীর কোনও শক্তি তাকে আটকাতে পারবে না। ভানুকে সে বিয়ে দেবে, যাকে ভানুর মন চায় তার সঙ্গে। ঘর দেবে, তার সবই সে দেবে ভানুকে। তার মতো স্বৈরিণী করে তুলতে চায় না সে তাকে। কিন্তু ভানু যেন ভুলে না যায়, সর্বেশ্বরের খাঁচা থেকে কেমন করে মুক্ত হয়ে আসতে হবে। সে-ই হবে সর্বেশ্বরের সবচেয়ে বড় পরাজয়। লোভের প্রতিশোধ।

বিয়ে দেবে শৈল বাগদিনি ভানুকে মুক্ত করে এনে৷ যাকে মন চায়। কী অভাবিত, কী বিচিত্র, কত আশার কথা বলে শৈল। কাকে মন চায়!নবর কথা মনে আসে। ঠোঁটে ভেসে ওঠে। কিন্তু বলতে বাধে। শুধু এক অপরিচিত রসে ফুরিত ঠোঁটে চাপা ব্যথা ও যন্ত্রণা থাকে কাঁপতে। শৈলকে বলে, কিন্তু দিদিমণি, যদি না ছাড়ে?

কে ছাড়বে না?

যার কাছে নিয়ে যাবে?

শৈলর চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। তীব্র চাপা গলায় বলে, ছাড়বে না? ছাড়বে না তো সাপ পুষবে? তুই যে কালনাগিনীর মতো সর্বনাশী লো! তোকে ওঁয়ারা ঘরে রাখতে পারবে? ফণা তুলে নাচতে পারবিনে? বিষ ছইড়ে শেষ করতে পারবিনে?

বলতে বলতে শৈল নিজেই দোলে কালনাগিনীর মত। দ্রুত নিশ্বাসে ওঠা নামা করে বুক।

শৈলর আগুন ভানুর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ে চোখে মুখে সর্বাঙ্গে। কালসাপিনীর মতোই চাপা রোষে সে দুলতে থাকে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো দোলে বুক। বলে, পারব। খুব পারব।

ভানুর এ রূপ চোখ ভরে দেখে শৈল। কিশোরী গৌরী, এই তো তবে রণচণ্ডী মূর্তি। এইটুকু সাফল্য শৈলর। এ সাফল্য অর্থের জন্য নয়, সর্বেশ্বরের জন্য নয়, সে যেন তার নিজের জীবনেরই কোনও প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছে ভানুকে দিয়ে।

তবু কাঁদে ভানু। শৈলও কাঁদে। কোনও কোনওদিন ভানু ধরে বসে শৈলকে। বলে, গান করো।

গান গাইতে পারে না, তবু গায় শৈল। ভানু বলে, নাচো। শৈল নাচে যাত্রার দলের সঙের মতো। তারা দুজনেই নারী। তাদের কোনও বিষয়েই বিশেষ লজ্জা নেই পরস্পরের মধ্যে। তার মধ্যে শৈলর জীবনধারণের বিশেষ একটা রীতি আছে। একটা অভ্যাস আছে। সেই অভ্যাস তার রক্তবাহী শিরায় শিরায়। জীবনের অনেকটাই তার ফাঁকি। ফাঁকির মধ্যে একটা মূঢ় ও ভয়ংকর সুখের সন্ধান করেছে তার অন্ধ জীবন।

ভানুর সঙ্গে নিজেকেও বন্দিনী করছে সে। বাইরের কাজে যায় অল্প। ভানুকে সে এখন করেছে তার রঙ্গরসের সঙ্গিনী। ভানুর কাঁচা রক্তে ঘুষঘুষে আগুন জ্বালিয়ে দেয় সে মাঝে মাঝে। এই বোবা উত্তেজনার মধ্যে ভানুর ঘৃণা ও আনন্দ আছে সমপরিমাণে। কিন্তু সবটাই তার জ্ঞানের বাইরে।

তবু তারা কাঁদে। ভানু বলে বাপের কথা, মায়ের কথা, হালিশহরের কথা। শৈল বলে না তার অতীত জীবনের কথা। কিন্তু মনে পড়ে, বড় জ্বালায় স্মৃতির মালা চটকায় আড়ালে আড়ালে।

তারা কাঁদে, যখন তারা এ সংসারে তাদের অসহায়তা অজান্তে অনুভব করে। শৈল কাঁদে, যখন তার ঘন কালো কেশের মাঝখান থেকে এক গাছি সাদা চুল লুটিয়ে পড়ে মুখে। যখন সে ঘুমন্ত ভানুর মুখে চুমু খায়। যখন তার বুকে এক মায়ের প্রেত চিৎকার করে কাঁদে। জ্যৈষ্ঠের আকাশে ছায়া পড়ে আবার মিলিয়ে যায়। সন্ধ্যাকালের বাতাস থমকে যায় মাঝে মাঝে। গাছপালা স্থির হয়ে থাকে। তোক গিলতে থাকে সারা ধরিত্রী। বড় যে তৃষ্ণা।

কোনও সময় দারুণ উল্লাসের গম্ভীর গর্জন শোনা যায় আকাশের। কিন্তু জল আসে না। পূর্ণ আষাঢ়ের আবির্ভাব ঘটেনি এখনও।

বর্ধমান বিভাগের বড় সাহেব আসেনি আজও। আষাঢ়ের জলের মতো সকলেই সাহেবকেও চাইছে। সারা গুপ্তিপাড়া ও আশেপাশের সকলেই চাইছে। সকলেই জটলা করছে পথে পথে, বৈঠকখানায়, চণ্ডীমণ্ডপে, জেল সদর কোর্ট কাছারিতে। এমনকী টোল পড়ুয়া চতুষ্পঠীতে বাদ যায় না। গাঁয়ের মধ্যে ভানুকে গোপন করে রাখতে পারার এটা একটা সুযোগ বটে। সকলেই এই বিষয়ে ব্যস্ত, এস্ত, সংশয়ান্বিত। শৈল এ বিষয়ে জড়িত। তার পাঁচ বিঘা জমি, সেইটুকুরও দাদন নিতে হয়েছে তাকে। তবে শৈলর অভাব নেই। বড় সাহেব তাকে খাতির করে, খাতির করে অনেকে। দাদন নেয়, কিন্তু ষোলো আনা নেয়। তাকে দেয়, সে নেয়। তা ছাড়া, একার আয়ের পক্ষে শৈলর কিছু কমতি নেই। কিন্তু গাঁয়ের অন্যান্য মানুষগুলির অবস্থা তো দেখতে হবে। নীলের প্রতি সকলের ঘৃণা, সকলের রাগ। সমাজের লোক যত ঘৃণা করে শৈলকে তার চেয়ে বেশি ঘৃণা করে নীলের দাদন নিতে।

তাই ঈশান মিত্তির মশাই বারবার করে অনুনয় করেছেন শৈলকে। ভাল মানুষ মিত্তির মশাই। কায়েত কুলের শিরোমণি হয়েও কোনওদিন মরা মাছের মতো চোখ নিয়ে তাকাননি শৈলর দিকে। বলেছেন, দ্যাখ বেটি, বড় সাহেবের কাছে সবাই যা বলবে, তুইও তাই বলিস। কুটির সাহেব তোকে খাতির করে, করতে পারে। তোর একটা পেট, নানা রকমে করে কম্মে চলে যায়। আমাদের তো তা নয়। মাটির জিনিস খেয়ে আর বেচে বেঁচে থাকতে হয়। গাঁয়ের মেয়ে তুই, জানিস সবই। নদে যশোরের মতো হুগলির কুটিয়ালদেরও নোলা বাড়ছে দিনকে দিন। আমার তো নিতে নিতে সবই নিয়েছে। বেউলির পশ্চিমে যে বিঘা সতেরো-আঠারো আছে, সেইটুকুই সোমবছরে ভরসা। তাই বলছি, সবাই যা বলবে, তুইও তাই বলিস মা।

কী বলতে হবে, সে কথা জানে শৈল। মিত্তির মশাই মিছে কথা শেখাননি। সত্য কথা বলতে বলেছেন! বড় সাহেবের কাছে বলতে হবে, জোর করে দাদন দিয়েছে কুটির সাহেবরা। সে কথা তো মিথ্যে নয়। দাদন তো জোর করেই দেওয়া হয়। না নিলে মারধোর পর্যন্ত হয়।

কোনও কোনও সময় আমিন মশায়ের ঘোড় এসে দাঁড়ায় শৈলর দরজায়। জিজ্ঞেস করে গাঁয়ের হালচালের কথা। শৈল বলে, বেরুই না, জানব কেমন করে? শৈলর ঘরে বাইরে ভাবনা।

একদিন কুটির পেশকার রাত দুপুরে এসে হাজির। বড় হ্যাংলা মানুষ। শৈল বিরক্ত হয়ে বলেছিল, রাতে থাকতে দিতে পারব না প্যাশকার মশায়, আমার শরীল ঠিক নেই।

পেশকার হাঁপাতে হাঁপাতে ফিসফিস করে বলেছিল, সেজন্য আসিনি, অন্য কথা ছিল। ঘরে কেউ নেই তো?

ভানু ছিল। পুরুষের গলা শুনে আচমকা জেগে কাঁটা হয়েছিল মেয়ে। শৈল ভেবেছিল, তা হলে কুটির কোনও কাজ হাসিলের জন্য ডাক পড়েছে। সে বলেছিল, না, কেউ নেই। তা বলে আমি এখন রাত দুকুরে তোমার কুটির কথা শুনতে পারব না বাপু।

পেশকার বলেছিল, কুটি না শৈল, নিজের কথা, ঘরের কথা।

কী কথা?

পেশকার পদবিতে চক্রবর্তী। ঘোর কুলীন মানুষ। গুটি সাতেক বিয়ে করেছে নিজে। বলেছিল, বোনটা সর্বনাশ করেছে রে।

আর বলতে হয়নি, শৈল বুঝে নিয়েছিল। আজ সাত বছর বোনের বিয়ে দিয়েছে বর্ধমানের এক কুলীনের সঙ্গে। বিয়ের রাত ছাড়া সে মেয়ে আর বরের মুখ দেখেনি কোনওদিন। এখন তার গর্ভ সঞ্চার হয়েছে, বাড়ির লোকে টের পেয়েছে, সেই সর্বনাশের কথাটাই বলতে এসেছিল পেশকার।

শৈলর ঘুমন্ত চোখ অন্ধকারে জ্বলে উঠেছিল ধকধক করে বলেছিল, সর্বনাশ কেন! যার সঙ্গে হয়েছে, তার সঙ্গে বোনকে পাঠিয়ে দাও কোথাও।

কিন্তু সে যে জাতে পোদ।

হলই বা।

 না না, দিক করিসনে শৈল। যা হোক একটা ব্যবস্থা করে ফেল রাত্রেই।

হ্যাঁ, আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, রাত করে যাই জীব হত্যে করতে। আর সে জিনিসও আমার কাছে নেই এখন বাপু।

তা হলে–একটু থেমে, গলা আরও নামিয়ে বলেছিলে পেশকার, তা হলে অন্য কিছু দে। একেবারে সবই যাক।

বিষ! বোনকে খুন করতে চেয়েছিল পেশকার। শৈল বলেছিল, মরণ তোমার। যাও এখন, কাল ব্যবস্থা করব।

তারপর ঠোঁট উলটে আপন মনেই বলে শৈল, নিজের বোনকে হত্যে করতে চায় নিজে কুলীন বাপের ব্যাটা হয়ে। নিজের মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে দ্যাখ, সে তোর বাপের মুখ আদপে দেখেছিল কি না!

ভানু এই সব দেখে, শোনে। জীবনের সব ভয়াবহ দরজা তার চোখের সামনে খুলে যায়। এখন হালিশহরের অনেক কুলীন ঘরের প্রকৃত ছবি স্পষ্ট দেখতে পায় সে, অনেক ঘটনা পরিষ্কার হয়ে যায়।

তবু ভানু কাঁদে, শৈলও কাঁদে। কিন্তু শৈল যে কেন কাঁদে, কত কারণে কাঁদে তা কেউ জানে না। কুলটার কান্না থাকতে নেই। স্বৈরিণীর চোখে জলের দাগ থাকে না। সে শুধু লীলাসঙ্গিনী।

এই মেয়েটি, এই ভানুমতী এসে কাঁদালে তাকে। সে কি জানত, কত বিষয়ে তার কত কান্না আসে। সে কি জানত, তার রক্তের লীলাখেলায় যখন সে ভানুকে ডেকে নেয়, তাতেও তাকে কাঁদতে হয়। সে কি জানত, এই সমাজের পাপের আড়কাঠিদের হাতের সরস পুতুল বনতে গিয়েও তার কান্না পাবে। সে জানত না, এই মা বাপ-হারানি মেয়েটা তার বুকে এক নতুন নীরব কান্নার ঢেউ তুলে দেবে। বহু ঘাটের জল খেয়ে এসে, এক ঘাটে আজ আটকে গেছে শৈল। এই মেয়েটা তার বুকে পড়ে এমনি করে কাঁদলে সে কেমন করে তাকে ছাড়াবে, কেমন করে না কেঁদে থাকবে। তাই সে মনে মনে বলে, হে দেবতা, আমাকে পাপ বোঝাও, পুণ্যি বুঝিও না।

দিন চলে গেল। আকাশে আষাঢ়ের ঘনঘটা দেখা দিল সত্যি। জল এল। প্লাবিত হল সারা জগৎ। বড় সাহেব এলেন না। নীল বুনবার আয়োজন চলল।

তারপর এল একদিন সর্বেশ্বর আর নন্দন।

ভানু দু হাতে শৈলকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে ছেড়ো না, ছেড়োনা।

শৈল বলল, ছি, কী বলেছি তোমাকে মনে নেই?

মনে আছে। কিন্তু সে যে নতুন জায়গা, নতুন মানুষ নতুন সবই, আর ভানু সেখানে একা। সর্বেশ্বর হেসে খালি বলল, কেমন আছিস লো নাতনি। চ এবার তোকে গুপ্তিপাড়ার মস্ত বড় রথ দেখিয়ে আনব। শৈল ভেংচে বলল, কলা বেচার কথাটাও মনে রেখো।