সংশয়

সংশয়

একরত্তি পাখিটার কাণ্ড দেখেই যেন সুনয়নী হেসে ফেললেন। বয়সের গলা বলে হাসিটা প্রবল বা চপল হল না, সামান্য মোটা ও চাপা শোনাল, বেশ সরল। পাখিটা দেখতে দেখতেই সুনয়নী বললেন, “এ জিনিসটা তোমায় বেশ দিয়েছে।”

আর্ম চেয়ারে পিঠ এলিয়ে বসে সুধাকান্ত সিগারেট খাচ্ছিলেন, চেয়ারের চওড়া হাতলে সোনার জল ধরানো সিগারেট কেস, চকচকে নতুন লাইটার। এই সিগারেট কেস, লাইটার, সিগারেট সবই তিনি পেয়েছেন। খুব নরম, দামী তামাকের ধোঁয়া তাঁর গলায়; ছেলেরা জানত, তিনি নরম তামাকটাই পছন্দ করতেন বরাবর, দেবার সময় পছন্দসই তামাকটাই দিয়েছে।

সুনয়নী বললেন, “এ তোমার বেশ দামীই হবে, না?”

সুধাকান্ত অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, তা তো হবেই, বাইরের জিনিস, খুঁজেপেতে যোগাড় করেছে; আজকাল এসব আর এখানে পাওয়া যাবে কোথায়!”

সুনয়নী পাখিঅলা ঘড়িটার কারুকর্ম আরো একটু যেন দেখলেন। না দেওয়াল-ঘড়ি না টাইমপিস, দেখতে শুনতে মাঝারী, রুপোলী গা, মাথার দিকটা গির্জের চূড়ার মতন, ঘড়ির কাঁটা দুটো উজ্জ্বল বাদামী রঙের, ঘণ্টার দাগগুলো কী ছিমছাম সুন্দর। আর ওরই মধ্যে একটা একরত্তি পাখি সেট্ করা; হেয়ারপিন কিংবা ছোট ব্রোচে অনেকটা এই ধরনের পাখিটাখি আগে দেখেছেন সুনয়নী; তবে এ জিনিস আরো সুন্দর। কীরকম সবুজ লালে মেশানো রঙ, ঠোঁটের ডগায় একটা একবিন্দু পুঁতি; ন টার ঘর থেকে লাফিয়ে দশটার ঘরে এল পাখিটা, যেন দাঁড়ে বসে লাফাতে লাফাতে সরে যাচ্ছে; এরপর যাবে এগারোটায়, তারপর বারোটায়। অথচ বাইরে থেকে দৃষ্টিকটু কিছু নেই, শুধু একটা গোল করে কাটা ফাঁক, যার মধ্যে দিয়ে পাখিটা মুখ বাড়িয়ে রয়েছে।

সুনয়নী আদর করেই যেন শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘড়িটার কাচ মুছে দিলেন। “তোমায় যা দিয়েছে সবই ভাল জিনিস।”

জিনিসগুলো সবই প্রায় ছড়ানো ছিল: ইলেকট্রিক শেভার, সিগারেটের পাইপ, হাড়ে বাঁধানো ছড়ি, এক সেট গীতা উপনিষদ, দামী শাল, বিদায় অভিনন্দনপত্র, এমন কি পরিপাটি করে বাঁধা এক বোতল হুইস্কি। শেষেরটা অবশ্য তাঁকে গাড়িতে তুলে দেবার সময় চন্দ্রসাহেব দিয়েছিলেন; আড়ালে বস্তুটি গাড়ির মধ্যে হাতে ধরিয়ে হেসে বলেছিলেন, “দিস ইজ ফ্রম মি, স্যার…”

‘স্যার’-টা ঠাট্টা করে বলা।

অবসর হওয়ায় সুনয়নী এবার বিছানায় এসে বসলেন। ঘরের পশ্চিম দেওয়ালে বাতিটা জ্বলছে, ফুলতোলা কাচে শেড পশ্চিমের খানিকটা দেওয়ালে অস্পষ্ট অথচ ছড়ানো একটা ছায়া ফেলেছে। এখন হেমন্তকাল, অগ্রহায়ণ, মাথার ওপর পাখা চলছে না, জানলা আধ-খোলা।

মাথার কাপড় অভ্যাসবশে খোঁপার কাছাকাছি একটু টেনে সুনয়নী শুধোলেন, “কত লোক হয়েছিল?”

সুধাকান্ত সিগারেটটা নেবালেন। “মন্দ কি!”

“অনেক—? অফিসসুদ্ধ?”

“তা একরকম সব সেকসানের লোকই ছিল।”

“প্যাণ্ডেল বাঁধা হয়েছিল নাকি গো?” সুনয়নী স্বামীর সঙ্গে যেন রঙ্গই করলেন একটু।

“না; আমাদের একটা বড় হলঘর আছে, টেবিল-চেয়ার পড়েছিল।”

“তোমার সব বড় কর্তারা এসেছিলেন?”

“দেখলাম তো অনেককেই…”

সুনয়নী চোখের চশমার আঙটা থেকে কানের চুল ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন, “কি বললেন সব?”

সুধাকান্ত অল্প হাই তুললেন। “কি আর বলবেন, এমনি সব কথা—শরীরটা ফিট রেখো, এখন কিছুদিন বেড়িয়ে এসো, তারপর টাকা-পয়সা তুলে বাড়িটায় হাত দাও, এবার একটু রিলিজানে মন দাও…”

“তোমায় সকলেই খুব ভালবাসত।” সুনয়নী গাঢ় গলায় বললেন।

সামান্য চুপ করে থাকলেন সুধাকান্ত, তারপর অন্যমনস্ক গলায় বললেন, “কি জানি। অনেকদিন চাকরি করলাম, সব সেকসানেই ছিলাম, হয়তো তাই জানাশোনা হয়েছিল সকলের সঙ্গে…।”

“শুধু জানাশোনা নয় গো, এমনি মুখ-চেনাচিনি থাকলে কি তোমায় এত বড় ফেয়ারওয়েল দিত! সব্বাই তোমায় ভালবাসত, খাতির করত…।” সুনয়নী এমনভাবে বললেন যে স্বামীর প্রতি অফিসের লোকের খাতির-ভালবাসা তিনিও অনুভব করতে পারছেন, পেরে বুক ভরে আসছে, এক ধরনের গর্বের সঙ্গে কেমন একটা ব্যথা জাগছে।

সুধাকান্ত কিছু বললেন না, হাত বাড়িয়ে লাইটারটা মুঠোয় নিলেন, বুড়ো আঙুল দিয়ে লাইটারের মসৃণ ঠাণ্ডা গা আলতোভাবে ঘষতে লাগলেন; বুড়ো আঙুলের তলায় একটা কড়ার মতন শক্ত চামড়া পড়েছে অনেকদিন, হয়তো দীর্ঘকাল কলম ধরে ধরে। তিনি সব সময় কলম চেপে লিখতেন, আঙুলের ডগায় জোর পড়ত। তাঁর কলম ধরাটাই শুধু কি শক্ত ছিল? কাজকর্ম করার এবং করাবার শক্তিও ছিল তাঁর। একটার পর একটা সেকসানে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দক্ষতার জন্যে। দক্ষতা অনেক সময় শত্রুতার কারণ হয়, অন্তত সহকর্মীদের কাছে, ছেলে ছোকরাদের কাছে। সুধাকান্ত মনে করতে পারেন না, তাঁর সঙ্গে এ ধরনের সম্পর্ক কোথাও বা কারো সঙ্গে তেমন হয়েছিল; তিনি যেখানেই গেছেন তাঁর চেয়ারের ওপর কুশন রেখে বসে অন্যদের ত্রুটি ধরে ধরে মর্যাদা আদায় করেননি। সে স্বভাব তাঁর নয়। লাগাম ধরে রেখেও যথাসাধ্য স্বাধীনতা দিয়েছেন তাদের। সমবয়সীদের ‘তুমি’ বলেছেন, বড়দের ‘আপনি’ এবং ছোটদের ‘তুই-তোকারি’ও করেছেন, মাঝেমধ্যে শালাটালাও বলেছেন মজা করে। সহানুভূতি সমবেদনা না দেখিয়েছেন এমন তো মনে পড়ে না। প্রয়োজনে যথাসাধ্য করেছেন। এটা ঠিক, তিনি অন্য কাউকে তাঁর এক্তিয়ারের মধ্যে মাথা গলাতে দিতেন না বলে তাঁর দায়িত্ব মাঝে মাঝে তাঁকেই যন্ত্রণা দিত। তা দিক, তবু তিনি সামলে রেখেছিলেন সব দিক।

বিছানার কোলে পা টেনে নিয়েছিলেন সুনয়নী, গোড়ালির কাছটা চুলকোচ্ছিল। আজ সারাদিন থেকে থেকে বাঁ পায়ের পাতা চুলকেছে। এটা শুভ না অশুভ সুনয়নী ঠিক জানেন না; বোধ হয় শুভ: স্বামী মানে মানে তো বটেই—অফিসসুদ্ধ ছোট বড় সকলের ভক্তি ভালবাসা নিয়ে চিরকালের মতন বেরিয়ে এলেন—এর চেয়ে ভাল কি হতে পারে! আজকালকার সংসারে মন্দটাই মানুষ বেশি দেখে, ভাল আর কতটুকু দেখতে পায়!

সুনয়নী বললেন, “লোকের হাসিমুখ দেখে বুড়ো বয়সে বেরোতে পেরেছ এই যথেষ্ট! আমার তো কতরকম মনে হতো।”

সুধাকান্ত কোনো সাড়া দিলেন না।

বিছানার ওপর হেলে পড়ে সুনয়নী এবার হাত দিয়ে চাদরটা মুছতে লাগলেন, যেন এটা তাঁর অভ্যাস। বিছানা মুছে মাথার বালিশ আবার ঠিক করে গুছিয়ে পাতলেন। বললেন, “তোমার মেয়ের কথা শুনলে তখন?”

সুধাকান্ত ঠিক খেয়াল করতে পারলেন না, স্ত্রীর দিকে তাকালেন; জানতে চাইলেন, কি কথা?

সুনয়নী বললেন, “তার তো ইচ্ছে, আমরা শীতটা তাদের কছে গিয়ে থাকি?”

“বার্নপুরে?”

“অসুবিধে কিছু নেই, বড় জায়গা, ঘরদোর ছেড়ে দিতে পারবে। শীতের সময়টাও ভাল, জলবাতাস তোমার সইবে।”

সুধাকান্ত বিশেষ কিছু ভাবলেন না; বললেন, “জামাইয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকা আমার পোষাবে না।…দু’চারদিন হলে অন্য কথা ছিল—।”

সুনয়নী যেন এর চেয়ে ভাল জবাব প্রত্যাশা করেননি, করা উচিতও নয়। প্রায় বত্রিশ-তেত্রিশ বছর ধরে মানুষটিকে তো দেখছেন, কখনো কোনো সময়েই আত্মীয়স্বজনের বাড়ি গিয়ে উঠতে চান না। কিন্তু এবার অন্য একটু কারণও ছিল, মেয়ে আজ দিন পাঁচেক হলো এখানে এসেছে, আসার কারণটাই হল—বাবা চাকরি থেকে অবসর নিচ্ছেন, নেবার পর সব ফাঁকা ফাঁকা লাগবে, হঠাৎ যেন হাতের সামনে থেকে এতদিনের বড় একটা অবলম্বন সরে যাবে, কিছু আর ধরতে পারবেন না, এত বছরের নিয়মিত অভ্যাস থেকে ছাড়া পাবেন, শরীর মন ভেঙে যাবে, অসুখ-বিসুখও বাধাতে পারেন। এ-রকম হামেশাই হয়। চাকরি থেকে ছুটি নেবার পর জীবন থেকেও কত লোক ছুটি নেয়। নিজের শ্বশুরই তার দৃষ্টান্ত।

“তুমি একেবারেই না বলছ, একটু রাজী হলে ভালই করতে”, সুনয়নী বললেন। বলে বিছানা থেকে নেমে শোবার আগে জল, পান খেতে গেলেন শ্বেতপাথরের গোল টেবিলটার দিকে।

সুধাকান্ত স্ত্রীর দিকে তাকালেন, “কেন বলো তো?”

“বলব আর কি, তুমি কি আমার চেয়ে কম বোঝ?”

সুধাকান্ত ভাবলেন সামান্য, বোঝবার চেষ্টা করলেন; এমন কিছু মনে এল না যাতে মেয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকার কোনো সঙ্গত কারণ খুঁজে পেলেন।

সুনয়না আলগোছে জল খাচ্ছিলেন; জল খাওয়া শেষ হলে পানের ডিবে থেকে ছোট্ট খিলি নিয়ে মুখে দিলেন।

সুধাকান্ত বললেন, “আমি কিছু বুঝতে পারলাম না।”

জরদার কৌটো তুলে নিয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন সুনয়নী। জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে, শীত-শুরুর হাওয়া বাতাসে কেমন যেন হিম-শিশিরের গন্ধ। বাইরের দিকে ব্যালকনিতে মস্ত লতানো গাছের লতা-পাতায় আলোর পাতলা একটা প্রলাপ ছিল, এইমাত্র অন্ধকার হলো, আলো নিবে গেছে। বিনুর ঘর থেকে আলো আসছিল, বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়ল বোধ হয় এবার। সুনয়নী কয়েক পা এগিয়ে আলনা থেকে পাতলা চাদরটা উঠিয়ে নিলেন, খুব হালকা অথচ গরম চাদর, এই ঠাণ্ডা বাতাসটা তাঁর তেমন ভাল মনে হচ্ছে না।

সুধাকান্তর পায়ের দিকে জানলা প্রায় ভেজিয়ে হাতের চাদরটা স্বামীর গায়ে আলগা করে জড়িয়ে দিতে দিতে সুনয়নী বললেন, “তুমি একেবারে যাব না বললে বিনুর মনে খুব লাগবে।”

“কেন, মনে লাগার কি আছে?”

সঙ্গে সঙ্গে কোনো জবাব দিলেন না সুনয়নী, অপেক্ষা করলেন, যেন তাঁর কিছু বলার রয়েছে। স্বামীর কাঁধে হাত রেখে একটু যেন হাত বোলালেন আলগাভাবে, তারপর বললেন, “তোমার মেয়ের মনে কোথায় লাগে তা কি তুমি জানো না!…বিনুকে তুমি না বললে মেয়ে মুখে কিছু বলবে না, ভেতরে ভেতরে গুমরোবে। ওর বরাবরই তো সেই অভিমান, আমার পেটের মেয়ে নয়।…আমি বলি কি, ক’দিন গিয়ে থাকবে চলল, মেয়ে খুশি হবে।…তা ছাড়া বাপু বুড়ো হয়েছ, নাতি-নাতনীর ওপর একটা টান থাকবে না!” শেষের দিকে সুনয়নীর গলায় গার্হস্থ্য কোমলতা ও উপদেশ ফুটল।

সুধাকান্ত সামান্য ভাবলেন, “বিনু তো এখন আছে।”

“আছে কোথায়, পরশুই চলে যাবে। তোমার জন্যেই ছুটতে ছুটতে এসেছিল, ছেলেটাকে রেখে এসেছে…সেটা তো দস্যু…”

“বিনুর সঙ্গে কথা বলবো’খন”, সুধাকান্ত বললেন।

মুখে পান জরদার নেশা জমছিল; সুনয়নী বোধহয় সেই নেশার জন্যে কিছুক্ষণ আর কথা বললেন না, দাঁড়িয়ে থাকলেন, অন্যমনস্কভাবে সুধাকান্তর মুখ দেখলেন, আলমারির আয়না চোখে পড়তে নিজের মুখ, গলা, বুক এবং স্বামীর মাথা চোখে পড়ল। গলির মধ্যে গাড়ি ঢুকেছে, শব্দটা কানে এল; কোথাও বোধ হয় কীর্তন গান হচ্ছে, ক্ষীণ একটু শব্দ এল যেন।

অন্যমনস্কতা কেটে যাবার পর সুনয়নী বললেন, “জল দি?”

“দাও—”

সুনয়নী শ্বেতপাথরের টেবিল থেকে কাচের গ্লাসে করে জল এনে দিলেন।

সুধাকান্ত জল খেলেন। বললেন, “তুমি শোও, আমি আসছি।”

জলের গ্লাসটা স্বামীর হাত থেকে নেবার সময় সুনয়নী হঠাৎ কি দেখে হেসে বললেন, “আজ যেন তোমায় অন্যরকম দেখাচ্ছে একটু।”

“কি রকম?”

“বুঝতে পারছি না ভাল—” সুনয়নী এই বয়সেও কপাল কুঁচকে চোখ আধ বোজা করে কৌতুকের মুখ করলেন, “বুড়ো বুড়ো যেন, তোমার এত চুল পেকে ধবধবে হয়ে গেছে, এ বাপু আমার আগে চোখে পড়েনি।”

সুধাকান্তও হাসিমুখ করলেন, হালকা গলায় বললেন, “এতদিন তাহলে তুমি অন্যচোখে দেখতে…”

সুনয়নী হেসে ফেললেন, মুখ জুড়ে হাসির সর পড়ল যেন, বললেন, “ভাল চোখেই দেখেছি বাপু, নিন্দে করতে পারবে না।”

“নিন্দে আর করছি কোথায়, প্রশংসাই তো করছি।”

“এ কিন্তু বেশ।”

“কি?”

“বয়সে যা মানায়। তোমার ধবধবে চুল দেখে আজ বেশ চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে”…সুনয়নী খুব পরিতৃপ্ত, সরল, সুন্দর মুখ করে হাসলেন।

“আমারও বেশ লাগছে, তোমার আধখানা মাথা সাদা—”

“হাতে রেখে বলছ কেন গো, আমারও সবটা সাদা হয়ে এল।”

“কই, আমার তো চোখে পড়ছে না।” সুধাকান্ত হাসলেন।

সুনয়নী এবার হাসিমুখেই শূন্য গ্লাসটা রাখতে শ্বেতপাথরের টেবিলের দিকে চলে গেলেন। “তোমাতে আমাতে কত তফাত জানো?”

“অনেক…।”

“প্রায় দশ।”

“এক যুগ।”

“আমার বিয়ে হয়েছিল পুরোপুরি কুড়িতে…, তোমার তখন তিরিশ।”

“গোঁফ রাখতাম তখন, বেশ মনে আছে।”

“রাখতে দিয়েছিলাম নাকি আমি—।”

“দাওনি; কিন্তু আমিও তোমার একটা জিনিস রাখতে দিইনি।”

“একটা কেন গো কর্তা, কিছুই আর রাখতে দাওনি।”

“তুমি চাইলেই দিতাম।”

“দিতে—! সেই মানুষ তুমি।”

“শেষ রাস্তায় এসে বদনাম করছ, সুনু—” সুধাকান্ত প্রসন্ন স্বরে বললেন, “বেশ, এখনো পথ পেরিয়ে পালিয়ে যাইনি, বলো কি চাও?”

“বাব্বা, বর ভিক্ষা দিচ্ছ নাকি?” সুনয়নী মাথার কাপড় টেনে হেসে বললেন।

“তোমার এই বয়সে আবার কি বর দেওয়া যায়, না আমিই দিতে পারি!”

কথা শুনে সুনয়নী এবার খানিকটা জোরেই হেসে ফেললেন। তারপর বললেন, “তবু বরই দাও।”

“বেশ, বলো।”

“আমি যেন আগে যাই—”

“কোথায়?”

“যেখানে সবাই যায়।”

সুধাকান্ত স্ত্রীর দিকে ভাল করে মুখ ফেরালেন। কয়েক মুহূর্ত যেন কিছু দেখলেন তারপর বললেন, “ও জিনিসটা যে আমার দেবার নয়, সুনু; ভগবানের হাত থেকে চুরি করাও যায় না।…কিন্তু, আমি তোমার চেয়ে দশ বছরের বড়, আমার মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে, আমারই তো আগে যাওয়ার কথা।”

“না; তোমার ছেলে আছে, এখনো পুরো মানুষ হয়নি!”

“ছেলে তোমারও, তুমিই তাকে মানুষ করো…”

“ও কি আমার ক্ষমতা!” সুনয়নী শ্বেতপাথরের টেবিলের সামনে থেকে সরে যাবার সময় আবার পাখিটা দেখলেন। পাশেই দেরাজের মাথায় ঘড়ি, ছড়ি, ইলেকট্রিক শেভার, বই, অভিনন্দনপত্র—ফেরারওয়েলের সব জিনিসই ছড়ানো আছে। পাখিঅলা ঘড়িটা চলছে, কাঁটা নেমে গেছে, আর খানকিটা পরে ওই একরত্তি পাখিটা টুক করে লাফ মেরে এগারোর ঘরে চলে যাবে। সুনয়নী কেমন যেন আবেশভরে পাখি দেখতে লাগলেন।

সুধাকান্ত ডাকলেন, “শুনছ?”

“উ”…

“বাতিটা নিবিয়ে দিয়ে শোও; আমি আসছি।”

সুধাকান্ত এবার উঠলেন।

সুনয়নী আচমকা বললেন, “তোমায় সবাই ভালবেসে কত দিয়েছে, আমি যখন যাব, তখন তুমি কিছু দিও।”

সুধাকান্ত দেরাজের মাথার কাছে এসে সিগারেট কেস, লাইটার রাখলেন। জিনিসগুলো দেখলেন দু’পলক। তারপর স্ত্রীর কাঁধে হাত রাখলেন। “চলো, শোবে চলো; রাত হয়েছে।”

আলো নিবিয়ে সুনয়নী শুতে এলেন। সুধাকান্ত শুয়ে পড়েছেন। পাতলা একটা জুট ব্ল্যাঙ্কেট বুক পর্যন্ত টেনে নিয়েছেন। সুনয়নী ঠাকুর প্রণাম সেরে আস্তে করে বালিশে মাথা রেখে শুলেন; পাশে গায়ে ঢাকা দেবার মোটা সুজনী-চাদর, কাঁথা-কম্বল এখনি গায়ে দিতে পারেন না। সুনয়নী শোবার পর অন্ধকার ঘরে তাঁর হাতের চুড়ির, চাদরে পা ঘষার, পাশ ফেরার এবং ঈশ্বরনাম করার বিড়বিড় শব্দ হল।

তারপর নিস্তব্ধতা। সেই স্তব্ধতা গাঢ় হয়ে আসার পর সুধাকান্ত মৃদু গলায় বললেন, “তুমি একটা ফেয়ারওএল দেখলে সুনু, শেষেরটা কেমন হবে তা দেখবে না ?…আমি তো তাই ভাবছি।”

সুনয়নী তাঁর বয়সের হাত স্বামীর মুখের কাছে এনে ঠোঁট চাপা দিলেন।…

অনেকটা রাত হয়ে এলেও সুধাকান্তর ঘুম আসছিল না। সুনয়নী অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছেন। সুধাকান্ত অনুভব করতে পারছিলেন: গোলগাল, সামান্য খাটো শরীরটা সুজনীর মধ্যে ঢেকে আলগা-বসনে সুনয়নী পাশ ফিরে অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। মাঝে মাঝে নিশ্বাসের দীর্ঘ শব্দ উঠছে। জেগে থেকে থেকে ঘুম না আসায় খানিকটা অবসাদ বোধ করছিলেন সুধাকান্ত, হাই উঠছিল, তার আবেশ এসেও চলে যাচ্ছিল। শোয়ার পরই পাতলা ঘুম এসেছিল তাঁর, হয়তো ঘুমিয়েও পড়তেন, আচমকা সুনয়নী গায়ে ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে দিয়েছিলেন: “শুনছ?” সুধাকান্ত শুনলেন, বড় রাস্তা দিয়ে হরিধ্বনি দিতে দিতে কারা চলে যাচ্ছে। অগ্রহায়ণের প্রায়-নিস্তব্ধ রাত্রে মৃদু অথচ সমস্বরে আবৃত্ত হরিধ্বনির সেই গুঞ্জন দীর্ঘক্ষণ কানে লেগে থাকল। সুনয়নী অন্ধকারেই করজোড়ে নমস্কার সেরে বললেন, “এরা বেশ সভ্যভব্য ভাবে যাচ্ছে, নয়তো যা সব যায়…,” বলে স্বামীর গা স্পর্শ করে শুয়ে থাকতে থাকতে আবার ঘমিয়ে পড়লেন।

সুধাকান্তর পাতলা ঘুম প্রথম দিকে সেই যে কেটে গেল, তারপর থেকে জেগেই আছেন; মাঝে মাঝে নেশার মতন একটা জড়ানি আসছে, আবার কেটে যাচ্ছে। ঘুম না আসায় নানারকম কথা মনে আসছিল। অফিসের কথাটাই বেশি যেন; বিপিনবাবু তাঁর চেয়ারটা পেলেন, ভালই হয়েছে; তারাপদর খানিকটা অসুবিধে হবে বিপিনবাবুর ধাঁচ বুঝতে, অবশ্য বুঝে যাবে, তারাপদ বেশ চটপটে; কাশীনাথের প্রমোশনের জন্যে যা করার সুধাকান্ত করে এসেছেন, এখন তার বরাত; গুহসাহেবকে সৎপরামর্শই দিয়ে এসেছেন সুধাকান্ত, শুধু নিজের জেদ ছেড়ে গুহসাহেব যদি মিলেমিশে চলতে পারেন তাহলেই মঙ্গল। বর্তমানের এইসব চিন্তা স্বাভাবিকভাবে তাঁর মনে ভাসছিল এবং কোনো কোনো স্মৃতি যেন মনের গভীর জলোচ্ছ্বাস ঘটিয়ে উঠে এসে তাঁকে অতীতে টেনে নিচ্ছিল। সেই একেবারে ছোকরা বয়সে প্রথম যেদিন অফিসে ঢুকলেন, পকেটের রুমালে মা’র দেওয়া আশীর্বাদী ফুল ছিল, মুখ মোছার সময় শুকনো ফুলটা অফিসের কলঘরে পড়ে যাওয়ায় কীরকম মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে! প্রথম দু’চারদিনের মধ্যেই তাঁর শখের কলম খোওয়া গিয়েছিল, নোয়াখালির গণপতি দত্তর সঙ্গে ভাব হয়েছিল, গণপতি তাঁকে ফিটনে চাপিয়ে মাঠে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে ছিল আর প্রাণের কথা বলেছিল যত রাজ্যের।…দেখতে দেখতে সুধাকান্ত অফিসে পুরনো হয়ে গেলেন; দু’তিন বছরের মধ্যেই সব নিজের কাছে অভ্যস্ত, পুরনো স্বাভাবিক হয়ে গেল সুধাকান্তর, অফিসের বন্ধু তুলসী মিত্তির কোথা থেকে এক ছবি এনে মা’র কাছে হাজির করল। মা বললেন, ‘বেশ মেয়েটি’। ছবি দেখে সুধাকান্ত তুলসীকে বলেছিলেন, ‘এযে একেবারে দুধের সর রে, কে হয় তোর?’ তুলসী বলেছিল, ‘সম্পর্কে বোন। তোর অপছন্দ হবে না।’…সুধাকান্তর অপছন্দ হয়নি, তবে ছবি দেখে একেবারে নরম, বোকা-বোকা, ছেলেমানুষ মনে হয়েছিল। বিয়েটা হয়ে গেল, মা’র ভারী পছন্দ হয়েছিল সুনয়নীকে। তারপর যা হয়—মা’র হাতে তৈরি অফিসের ভাত খেয়ে, আর সুনয়নীর পরিপাটি করে গুছিয়ে দেওয়া টিফিনের বাক্স পকেটে পুরে অফিস আর বাড়ি করতে করতে সুধাকান্ত পুরোদস্তুর গার্হস্থ্য প্রাণী হয়ে গেলেন। সুনয়নী কিছুটা ভাগ্য নিয়ে এসেছিলেন নিশ্চয়, সুধাকান্ত বেশ তাড়াতাড়ি অফিসের অনেকের নজরে পড়ে যাচ্ছিলেন। অল্পে অল্পে উন্নতি শুরু হল। সুনয়নী ভাগ্যমন্ত হলেও সুধাকান্ত নিশ্চেষ্ট ছিলেন না; উন্নতির জন্যে তাঁর নিরলস পরিশ্রম ছিল; ব্যবহারে, আলাপে সুধাকান্ত সহিষ্ণু, নম্র ও শান্ত প্রকৃতির ছিলেন। ওই বয়সেই তিনি অফিসে একটা স্বতন্ত্র মর্যাদা আদায় করতে পেরেছিলেন। তবু এটা হয়তো ঠিক উন্নতির প্রতি তাঁর কেমন একটা আকাঙক্ষা ছিল এবং দিনে দিনে সেটা তাঁকে পেয়ে বসেছিল। বড় একটা উন্নতির মুখে মা মারা গেলেন। বাবা কৈশোরেই গেছেন। মনে মনে আফসোস থাকল; কিন্তু মা মারা যাবার আগেই সুধাকান্ত পায়ের খুঁটি শক্ত করে ফেলেছিলেন। ছেলে সম্পর্কে মা’র কোনো দুঃখ ছিল না, থাকার কথাও নয়; একটিমাত্র দুঃখ মা’র বুকে কাঁটার মতন বিঁধে ছিল যা, তা পারিবারিক দুঃখ; মা নিঃসন্তান দেখে গিয়েছিলেন ছেলেকে। সুধাকান্ত এবং সুনয়নী তখনো নিঃসন্তান। মা মারা যাবার পর সুনয়নীকে বড় একা ও অবলম্বনহীনের মতন থাকতে দেখে সুধাকান্ত তাঁর আত্মীয় সম্পর্কের এক বোনের একটি মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। বিনু। বিনুর তখন বাচ্চা বয়েস, বিনুর মা রুগ্ন, হাসপাতালে যাবে, স্বামী মারা গেছে। বিনুকে তখন থেকেই সন্তানের মতন করে মানুষ করেছেন সুনয়নী। সন্তানের আশা সুধাকান্তরা ছেড়েই দিয়েছিলেন। প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবে কিছুটা বয়সে সুনয়নীর গর্ভে সন্তান এল; সুধাকান্ত তখন চল্লিশ ছাড়িয়ে গেছেন। আজ খোকার বয়সে কুড়ি-একুশ। নিজের সন্তান আসা সত্ত্বেও সুনয়নী বিনুর প্রতি সমান অনুরাগী ছিলেন, সমান কর্তব্যপরায়ণ; বিনু আর খোকা এখন পর্যন্ত তাদের সম্পর্কের পলকাভাবটা বোঝার চেষ্টা করেনি, বরং সেটা তারা মূল্যবান বলে মনেও করে না। বিনুকে সুধাকান্ত শুধু প্রতিপালন করেননি, মেয়ের যত্নে মানুষ করেছেন, লেখাপড়া শিখিয়েছেন, নিজে পাত্র পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছেন। বিনুর সেই মা কবে কোন যুগে বিগত হয়েছে তা মনেও পড়ে না। সংসারের দিক থেকে সুধাকান্ত শোক দুঃখ, অশান্তি উদ্বেগ ভোগ করেননি প্রায়, মনে যেটুকু অভাব বোধ করতেন, এক সময় তারও পূরণ হয়ে গিয়েছিল। তিনি বা সুনয়নী এদিক থেকে সুখী মানুষ, তৃপ্ত মানুষ। হয়তো ভাগ্যবান মানুষই।

পুরনো এই সব কথা এবং আরো পাঁচরকম কথা সুধাকান্তর মনে পড়েছিল। বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্নভাবে—যেন কোনো অসংলগ্ন স্বপ্ন ছুটে যাচ্ছে—সুধাকান্ত নিজের জীবনের এইসব দৃশ্য ভাবছিলেন, দেখছিলেন, হারিয়ে ফেলছিলেন। ক্রমশই কখনো কখনো এক একটি স্মৃতি কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল। মনে পড়ল, সুনয়নীকে একবার তিনি গঙ্গার ঘাটে প্রায় ডুবিয়ে ফেলেছিলেন। আঘাটায় স্নান করতে নেমে স্ত্রীকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন আর কি! অফিসের পুরনো চিন্তার মধ্যে থেকে প্রমথেশের স্মৃতিও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মাথা-পাগলা ছেলে, অফিসে দুপুরবেলায় রেকর্ডরুমে ঢুকে আত্মহত্যা করেছিল! আত্মহত্যার আগে তার মাথায় একটা খেলা ভর করেছিল, অফিসের নানাজনের কাছে সাদা কাগজের চিট পাঠাত, তাতে লিখত: ‘প্লিজ অ্যাপ্লাই ফর ইওর সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি…।’ কোথায় যে দরখাস্ত পাঠাতে হবে তা অবশ্য লেখা থাকত না। সুধাকান্তও একবার এরকম চিরকুট পেয়েছিলেন। ওকে ডেকে পাঠিয়ে ধমক দেবেন ভেবেও শেষ পর্যন্ত কিছু করেননি, ছেলেটিকে অসুস্থ মনে হয়েছিল। কয়েকদিন পরে দুপুরবেলার রেকর্ডরুমে ঢুকে প্রমথেশ আত্মহত্যা করে। ওর গলায় একটা নামাবলী মাফলারের মতন জড়ানো ছিল।

প্রমথেশের মুখ এখন আর ভাল করে মনে পড়ল না সুধাকান্তর, ঘটনাটা মনে পড়ল, যুদ্ধের মাঝামাঝি এক বর্ষার দিনে অফিসে পুলিশ এসে দ্বিজেন সামন্তকে গ্রেপ্তার করেছিল, দ্বিজেন আগস্ট রেভলিউসানের সঙ্গে জড়িত ছিল গোপনে।

পুরনো ঘটনা থেকে মন আবার দমকা বাতাসে ওড়া পাতার মতন উড়ে বর্তমানে এল। বিনুর স্বামীর নামও দ্বিজেন। মেয়ে-জামাই সুধাকান্তদের বার্নপুরে নিয়ে গিয়ে দু-একমাস রাখতে চায়। সুধাকান্তর তেমন কোনো ইচ্ছে নেই যেতে। বিনুর সঙ্গে কথা বলে দেখবেন কাল, কি বলে বিনু।

সুনয়নী অঘোর ঘুমে। সুধাকান্তর ইচ্ছে হল, স্ত্রীকে জাগিয়ে দেন। বয়সকালে স্ত্রীকে ঘুমের মধ্যে জাগিয়ে তোলার কয়েকটা কলাকৌশল তিনি নিজে নিজে আবিষ্কার করেছিলেন, যেমন সুনুর নাকের কছে নিজের নাক রেখে বড় বড় নিশ্বাস ফেললে সুনু তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট পেয়ে জেগে উঠত কিংবা ভিজে জিব সুনুর নাকের ডগায় রাখলে সুনু সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠত, তার মনে হত মুখে টিকটিকি পড়েছে; টিকটিকির বড় ভয় ছিল সুনুর। এসব কৌশল এ বয়সে আর শোভন নয়, সুধাকান্ত অথবা সুনয়নী কেউ আর সেই বয়সের তাপ ও সুখ এখন নাক বা জিবের স্পর্শ অনুভব করতে পারেন না, ইন্দ্রিয়ের তীক্ষ্ণ অনুভূতিগুলি এখন ওপরে ওপরে তীব্র নয়, বরং সমস্ত কিছু যেন ভেতরে কোথাও শিকড় ছড়িয়ে প্রসারিত হয়ে আছে। জাগাতে হলে সুধাকান্ত এখন হয়তো জল খেতে চাইবেন, বা মাথার দিকে জানালা বন্ধ করতে বলবেন, কিংবা রাত্রের অস্বস্তির জন্যে একটা ওষুধ দিতে বলবেন।

সুধাকান্ত প্রায় অন্যমনস্কভাবেই সুনয়নীর মাথার দিকে হাতটা সরিয়ে দিলেন, স্ত্রীর মাথার চুল, গাল তাঁর আঙুল স্পর্শ করল। এই স্পর্শ তাঁর ঠিক অভিপ্রেত ছিল না, কিন্তু স্পর্শের পর তিনি মমতা ও স্বস্তি অনুভব করলেন। অন্ধকারেই তাঁর কেমন মনে হল, তিনি সুনুর সাদা চুলে হাত দিয়েছেন। সুনুর গাল এখন বেশ পুরু, সামান্য খসখসে। আগে সুনুর গালে দাঁতের দাগ লাগলে নীলচে কালশিটে পড়ত, সুনু লজ্জা পেত, সেসব দাগ কতকাল আর পড়ে না। জীবনের এই দিকটা বাঁকা সেতুর মতন সেই যৌবনে শুরু হয়েছিল, তারপর ধনুকের মত বাঁকা হয়ে আবার আস্তে আস্তে নেমে এল এই বৃদ্ধ বয়সে, এখন সেতুর শেষ।…এরপর?

এরপর কি—সুধাকান্ত অনুভব করার এবং বোঝার চেষ্টা করলেন না। তাঁর হঠাৎ সুনয়নীর কথাটা আবার মনে পড়ল: ‘তোমায় সবাই ভালবেসে কত দিয়েছে আমি যখন যাব, তখন কিছু দিও।’…কথাটা থেকে থেকে তখন থেকেই তাঁর মনে আসছে, চাপা অসুখের মতন ভেতরে যে একটা অস্বস্তি হচ্ছে, তাও তিনি মাঝে মাঝে অনুভব করছেন। অথচ তিনি সুনয়নীকে কিছু দেবার কথা তেমন ভাবছেন না, বরং বহুক্ষণ থেকে অন্য একটা কথা ভাবছেন, সন্ধে থেকেই প্রায়, কিংবা সেই অফিস থেকেই ফেয়ারওএলের পালা ফুরোবার পর থেকেই। সুনয়নীর কথা, সুনয়নীর প্রার্থনার সঙ্গে তার হয়তো কোনো সম্পর্ক আছে। কে জানে!

সুধাকান্ত স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লেন।

ঘুমের মধ্যে সুধাকান্ত তাঁর ফেয়ারওয়েলের স্বপ্ন দেখছিলেন। দেখছিলেন, অফিসের নিচের তলার হলঘর ভিড়ে ভরে গেছে, চেয়ার-গুলো ভরতি হয়ে যাওয়ায় হলঘরের পেছনে এবং পাশে দেয়াল ঘেঁষে অনেকে দাঁড়িয়ে, সুধাকান্তর সামনে চাদর বিছানো লম্বা টেবিল, ফলের তোড়া আর মালা, উপহারের নানান জিনিসে টেবিলটা ভরে রয়েছে, সুধাকান্তর দু’পাশে কিছু চেয়ার, বড় বড় অফিসাররা বসে আছেন। বেশ কিছুক্ষণ যে ফেয়ারওএল চলছিল এবং এতক্ষণে শেষ হয়ে আসছে, সুধাকান্ত তা অনুভব করতে পারছেন: বক্তৃতা, অভিনন্দনপত্র পাঠ—এসব শেষ হয়েছে উপহার দেওয়াও শেষ, এখন শুধু সুধাকান্তকে কিছু বলতে হবে, সকলেই অপেক্ষা করছে। সুধাকান্ত সামনের দিকে তাকালেন: হলঘরের থামের আড়াল মাঝে মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ালেও সিলিং থেকে ঝোলানো আলোয় তিনি যেন সমবেতদের দেখতে পাচ্ছিলেন। ঘরের মধ্যে গুঞ্জন ও অস্পষ্ট কথাবার্তা শুরু হয়ে গেছে, ওরা কিছু শোনার জন্যে অধৈর্য, হয়তো সামান্য উত্তেজিত; সুধাকান্তর বিদায়-সম্ভাষণ শোনার জন্যে ব্যাগ্র বোধ হয়। এত সমাদর, প্রীতি, শুভেচ্ছার পরিবর্তে সুধাকান্ত যে কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। তিনি যে বেশ অভিভূত, গভীর কোনো তৃপ্তি এবং এই বিদায়কালীন বেদনায় বিহ্বল হয়ে আছেন এ কথা ওরা হয়তো বুঝতে পারছে না।

সুধাকান্ত উঠে দাঁড়ালেন। তিনি উঠে দাঁড়াবার পর মনে হল, ঘরের মধ্যে যে গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছিল তা নিম্নস্বর হতে হতে শান্ত হয়ে আসছে। সুধাকান্ত অভিভূত থাকায় তাঁর গলায় স্বর ফুটছিল না। আড়ষ্টভাবে গলা পরিষ্কারের চেষ্টা করতে করতে তিনি মনে মনে কয়েকটা কথা সাজালেন, কি ভাবে সম্বোধন করবেন সকলকে ‘ভদ্রমহোদয়গণ’ না, ‘প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ’, এ নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় পড়লেন। শেষেরটাই তাঁর কাছে ভাল লাগল। কাঁপা, জড়ানো, অভিভূত-স্বরে তিনি কথা শুরু করলেন। সামান্য কয়েকটা কথা, যা নিতান্তই ভূমিকা, স্পষ্ট করে যা শোনাও গেল না সুধাকান্ত বলেছেন কি সবটা বলেনওনি, হলঘরের পেছনের ভিড় নড়তে লাগল! ওখানে নড়াচড়া শুরু হওয়ার পর দেখা গেল, ক্রমশই হলঘরের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো ভিড়টাও নড়াচড়া শুরু করেছে, কারা যেন পা ঘষে ঘষে বেরিয়ে যাচ্ছে, তারপর একে একে সবাই নড়তে চড়তে এগুতে এবং অন্যকে পাশ কাটিয়ে বাইরে চলে যেতে লাগল। সুধাকান্তর এটা পছন্দ হল না, ভাল লাগল না। কেন ওরা চলে যাচ্ছে সুধাকান্ত বুঝতে পারলেন না, অবাক এবং ক্ষুন্ন হয়ে চুপ করে গেলেন। যারা এতক্ষণ ধৈর্য ধরে বসে ছিল, শেষ সময় তাদের অধৈর্যভাব তাঁকে বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ করছিল। অকস্মাৎ তাঁর মনে হল, হলঘর ছেড়ে যারা চলে যাচ্ছে তারা বোধ হয় দুর্বলতা বোধ করছে, সুধাকান্তর এই বিদায়-ভাষণ ওদের কাতর করছে। কোনো বড় দুঃখ বা অ-সহ্যের কাছ থেকে এভাবে অনেকে সরে যায়। সুধাকান্ত কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, সম্ভবত সামান্য অপেক্ষা করার অনুরোধ করতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ অবাক হয়ে দেখলেন, চেয়ারগুলোও খালি হতে শুরু করেছে, সিনেমা থিয়েটারের শো ভাঙার মতন সবাই উঠে দাঁড়িয়ে একে অন্যকে ঠেলে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, দরজার কাছাকাছি চাপাচাপি ভিড়!…কী আশ্চর্য! সুধাকান্ত নির্বোধের মতন তাকিয়ে এই দৃশ্য দেখতে লাগলেন। না, এরা দুর্বলতাবশে দলে দলে সুধাকান্তকে এড়িয়ে চলে যাচ্ছে না, সেটা সম্ভব না। তবে? তবে যে কি—সুধাকান্ত ভেবে পাচ্ছিলেন না। বিমূঢ় হয়ে লক্ষ্য করলেন, ক্রমশ হলঘর শূন্য হয়ে এল, শেষ দলটাও বেরিয়ে চলে গেল। তারপর আশপাশে আর কেউ কোথাও নেই, সিলিং থেকে ঝোলানো বাতিগুলো জ্বলছে, ঘরে একটিও প্রাণী নেই, শূন্য পরিত্যক্ত আসনগুলো এলোমেলো পড়ে আছে। মনে হচ্ছিল, সবাই তাঁকে ফেলে রেখে বা পরিত্যাগ করে চলে গেছে, তিনি একা, একেবারে নিঃসঙ্গ। আর এই সময় হলঘরের বাতিগুলো একে একে নিবে গিয়ে এখানে ওখানে সেখানে অন্ধকার ছড়াতে লাগল শেষে মনে হল, চার পাশ থেকে অন্ধকার আসছে, যেন কালো কোনো মেঘ ভাসতে ভাসতে চলে আসছে। অন্ধকার একেবারে কাছাকাছি এলে সুধাকান্ত ভীত বোধ করলেন, এবং দেখতে দেখতে হাতের নাগালের মধ্যে অন্ধকার পৌঁছে গেলে অতীব আতঙ্ক বোধ করে সরে যাবার চেষ্টা করলেন। ঠিক যে কি হল অনুভব করাও গেল না, মনে হল চারপাশের অন্ধকার তাকে বেড় দিয়ে ঘিরে ফেলেছে, ঠিক যেন কাঠগড়ার চৌহদ্দির মধ্যে তিনি দাঁড়িয়ে, আশেপাশে সামনে কেউ কোথাও নেই।

এই বিশ্রী অবস্থাটা তাঁর শ্বাস রোধ করে আনছিল। সুধাকান্ত ভীত, উদ্বিগ্ন, বিচলিত এবং বিরক্ত। এসব কি? এখানে তিনি আসেননি, আসতেও চাননি; বুঝতেই পারছেন না—কেন তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি ফেয়ারওয়েল নেবার জন্যে অফিসের মস্ত হলঘরে এসেছিলেন, সেখানে দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা ছিল, আলো ছিল ফুল ছিল, উপহার ছিল। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন এটা সে জায়গা নয়, এখানে ফেয়ারওয়েল নিতে তিনি আসেননি, এ জায়গাটা তাঁর সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং অস্বস্তিকর জায়গা।

সুধাকান্ত অত্যন্ত বিরক্ত ও অধৈর্য হয়ে চিৎকার করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, আচমকা সেই শূন্য ঘরে অন্ধকারে হাস্যরোল উঠল। সে রোল যেন থামে না, ফাঁকা হলঘরের বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। এটা উপহাসের অট্টহাস্য, নাকি অন্য কিছু! সুধাকান্ত ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করে উঠলেন। তারপর সুধাকান্ত দেখলেন, তিনি আর ঘরে নেই, ফাঁকা মাঠে, মাঠ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সুনয়নীকে দেখতে পেয়ে গেলেন। সুনয়নী ছেলেমানুষের মতন আঁচলে পুঁটলি বেঁধেছে। সুধাকান্ত বললেন, ‘এসব কী? সুনয়নী হেসে হেসে জবাব দিলেন, ‘তোমার ফেয়ারওয়েলের পাওনা গো, কর্তা। ইস্, তোমায় ভালবেসে ওরা কত কি দিয়েছে!’ এই বলে সুনয়নী আঁচলের পুঁটলি খুলতেই কোথাও কিছু চোখে পড়ল না, যেন বাতাস বেঁধে রেখেছিলেন সুনয়নী, বাতাসেই মিশে গেল শূন্যে।

সুধাকান্তর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে যাবার পর অচেতনের মতন তিনি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলেন। নদীর জলে ডুব দিয়ে মাথা তোলার পরও যেমন মনে হয় জলে ডুবে আছি, কিছুক্ষণ সেই অনুভূতিটা সর্বাঙ্গে জড়িয়ে থাকে, স্বপ্নটাও সেইভাবে তাঁর চোখে ও মনে জড়িয়ে থাকল। সামান্য পরে সুধাকান্ত স্বপ্ন ও নিজেকে পৃথক করতে পারলেন, কিন্তু কিছুতেই সেই পরিত্যক্ত শূন্য হলঘর এবং একে একে বাতি নিবে যাবার দৃশ্যটি চিন্তা থেকে তফাতে রাখতে পারলেন না। আর এখন, জেগে উঠেও তাঁর কেমন যেন মনে হচ্ছিল, চার পাশ থেকে অন্ধকার এসে তাঁকে ঘিরে ধরেছে, কাঠগড়ার চৌহদ্দির মধ্যে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।

সুনয়নী অঘোর ঘুমে। সুধাকান্ত তৃষ্ণা অনুভব করছিলেন। স্ত্রীকে ডাকবার ইচ্ছে হচ্ছিল, তবু ডাকলেন না। অশান্ত মনে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে বাতি জ্বাললেন, উজ্জ্বল আলোটা চোখে লাগার সঙ্গে সঙ্গে নিবিয়ে দিলেন, দিয়ে ফিরে মৃদু নীলাভ আলোটা জ্বেলে দিলেন। জল রাখা ছিল, জল খেয়ে, সিগারেট ধরিয়ে দরজা খুলে বাথরুমে চলে গেলেন।

ফিরে এসে সুধাকান্ত আর বিছানার দিকে গেলেন না, হালকা চাদরটা গায়ে জড়ালেন। বাতি নেবাবার সময় ফেয়ারওয়েলের উপহারগুলো তাঁর চোখে পড়ল। ঘড়ির পাখিটা আরো কয়েক ঘর চলে গেছে।

ঘর অন্ধকার করে সুধাকান্ত আর্ম-চেয়ারে এসে বসলেন। আস্তে আস্তে অলসভাবে সিগারেট খেতে খেতে তিনি ঠাণ্ডাটা অনুভব করলেন সামান্য; এখন প্রায় শেষ রাত, ঠাণ্ডা পড়েছে, হিম ও শিশিরের আর্দ্র ভাবটা যেন ঠাণ্ডায় মেশানো। সুধাকান্ত জানালার দিকে তাকিয়ে থেকেও কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না; অন্ধকারে অতি অস্পষ্ট একটা আভাস ফুটে আছে, বাইরে কোথাও চাঁদ ডুবে গেছে না শেষরাতে উঠে এসেছে বোঝা যায় না। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুধাকান্ত, বুকের কোথাও ভার জমে আছে, ফুলে থাকার মতন কেমন এক বেদনা। স্বপ্নটা এখনও তাঁকে বিব্রত করছে, রাত্রের অন্ধ মাছি যেন; তাড়িয়ে দিলেও আবার মুখে এসে বসছে।

অফিসের ফেয়ারওয়েলটা যে তাঁকে সন্দিগ্ধ করেছে তাতে সন্দেহ নেই। প্রথমাবধি সুধাকান্ত এটা অনুভব করেছেন, অস্পষ্টভাবে তাঁর মনে হয়েছে, এটা কি যথার্থ? তবু, অত সমাদর, বহুজনের প্রশংসা, প্রীতিবচন সহকর্মীদের অনুরাগ তিনি অস্বীকার করতে পারেননি। তিনি অভিভূত হয়েছিলেন, মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু কেন যেন তাঁর মনের কোথাও একটা অদ্ভুত চঞ্চলতা এসেছিল, এটা কি তাঁর প্রাপ্য? যথার্থই কি তিনি এসব পেতে পারেন? তখন সেই বিদায়-অনুষ্ঠানের মঞ্চে বসে রাজ-সমাদর পেতে, নিজের প্রশস্তি শুনতে তাঁর শুধু ভাল লাগেনি, স্বাভাবিকভাবেই আত্মতৃপ্তি লাভ করেছিলেন। এক এক সময় তিনি বিশ্বাস করে নিচ্ছিলেন ওরা তাঁর সহকর্মীরা যা বলছে, সব সত্য। হয়তো আরো একটু বেশি পেতে বা শুনতে তাঁর বাসনা হচ্ছিল। কিন্তু সাময়িকভাবে এই ঘোর থাকলেও প্রায়শই তা কেটে যাচ্ছিল এবং গোপনে কোনো বেদনার অনুভবের মতন মনে হচ্ছিল, এ কি যথার্থ?

সুধাকান্ত যেন একটা নেশার মধ্যে ছিলেন বহুক্ষণ, সেই অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বাড়ি ফিরে আসা পর্যন্ত এই নেশা তাঁকে স্পষ্ট করে বুঝতে দিচ্ছিল না, কিসের কাঁটা মনের মধ্যে বিঁধে গিয়েছে। অথচ এ নেশা তাঁকে গভীরভাবে আচ্ছন্ন করতে পারেনি; ফলে মাঝে মাঝে কোনো গোপন স্থান থেকে একটা অস্বস্তি উঠে আসছিল। সাময়িক-ভাবে এসে আবার চাপা পড়ছিল। বাড়ি ফিরে আসার পর ক্রমশ আচ্ছন্নতার ভাবটা কাটতে লাগল। বিনু আর খোকা তর তর করে নিচে নেমে গিয়ে অফিসের গাড়ি থেকে জিনিসগুলো সব কোলে করে তুলে আনল; সুনয়নীকে হাঁকডাক করে ঘরে নিয়ে এল, ছেলে-মেয়ে আর মায়ে মিলে সুধাকান্তর পাওয়া জিনিসগুলো দেখতে লাগল। ছেলেমেয়ের সামনে সুনয়নী বড় একটা কথা বলছিলেন না, মুখটা শুধু হাসি-খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ছিল। বিনু আর খোকা এমন হইচই করছিল যেন তাদের বাবা মস্ত একটা ট্রফি জিতে এনেছে। বিনু মুখে মুখে একটা হিসেব তৈরি করছিল, কত টাকার জিনিস পাওয়া গেছে; খোকা টাকার হিসেবটা তেমন দেখছিল না, জিনিসগুলো কোথায় কিভাবে সাজিয়ে রাখলে লোকের চোখে পড়বে তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল। অভিনন্দনপত্রটা সে জোরে জোরে পড়ে তার মা দিদিকে শোনাল, তারপর হেসে বলল যে, এমন ভাষা দিয়ে লিখেছে কিছু মানেই হয় না…। সুধাকান্ত কাউকে কিছু বলেননি, কিন্তু মনে মনে ক্ষুন্ন ও পীড়িত হচ্ছিলেন। তাঁর অভিভূত ভাবটা আর ছিল না, নেশা বা আচ্ছন্নতা কেটে আসছিল। তিনি অনুভব করতে পারছিলেন, ছেলেমেয়েরা সমস্ত জিনিসটাকে অন্য চোখে দেখছে, কত পাওয়া গেল, কত লাভ হল, কিভাবে লোকের চোখে এই জিনিসগুলো দেখানো যাবে—এই সবই তাদের চিন্তা। বাবার জন্যে যে তাদের খানিকটা অহংকার প্রকাশ না পাচ্ছিল এমন নয়, তবু ওটা তেমন ধর্তব্যের নয় বলে সুধাকান্তর মনে হচ্ছিল। আসলে ওরা পাওনা দেখছিল, পাওয়ার ইতিহাস দেখছিল না। সেটা বরং সুনয়নী দেখেছেন; সুনয়নী দেখেছেন, বুঝেছেন; হয়ত তাই বলেছেন: ‘তোমায় সবাই ভালবেসে কত দিয়েছে।’

সুধাকান্ত কিন্তু এখন বুঝতে পারছেন, তিনি যা পেয়েছেন তার বড় একটা মূল্য নেই। পাওনাগুলো সাংসারিক, পাওয়ার ইতিহাসটাও যথার্থ নয়। সহকর্মীদের তিনি ছোট করতে চাইছেন না, তাদের এই উপহারকে অবজ্ঞা করতেও তাঁর বাধছে, তবু এটা ঠিক—সুধাকান্ত অনেক মিথ্যা স্তুতি এবং শখের ভালবাসা নিয়ে এসেছেন।

কথাটা মনে আসায় নিজের রূঢ়তার জন্যে তাঁর অস্বস্তি হল। মনে হল, এটা ঠিক হয়নি; হয়ত এই বিদায়-সম্ভাষণের অনেকটাই আন্তরিক। অফিসে আরো অনেক ফেয়ারওয়েল হয়েছে, সুধাকান্তর মতন এমন সমাদর আর কেউ কি পেয়েছে? দু একজনকে মনে পড়ল যাদের সঙ্গে তিনি নিজের ফেয়ারওয়েল-এর তুলনা করলেন। করে দেখলেন, তিনি হেরে যাচ্ছেন। ঘোষ সাহেবকে এয়ারকুলার, হীরের আঙটি দেওয়া হয়েছিল, অন্যান্য জিনিসও অঢেল। এয়ারকুলার আর হীরের আঙটির টাকা দিয়েছিল কলকাতার দুই নামকরা স্টিভেডার। কেন দিয়েছিল?

সুধাকান্তর লজ্জা হল, গ্লানি হল। ঘোষ সাহেব বরাবর দেনা-পাওনা বজায় রেখে কাজ করে গেছেন। অন্যকে তিনি সুযোগ দিতেন, নিজেও নিতেন। সাহেব সকলের কাছেই সেজন্যে পছন্দসই ছিলেন। অথচ মানুষটির চরিত্র সুধাকান্ত খানিকটা না জানেন এমন নয়। অনেকেই জানত না। ফেয়ারওয়েলের সময় কোথাও কিন্তু তার উল্লেখ ছিল না। বরং বিগলিত প্রশংসা উঠেছিল পঞ্চমুখে।

সুধাকান্ত এতক্ষণে স্পষ্ট করেই বুঝলেন, আজ তাঁর সম্পর্কে যেসব প্রশংসা করা হয়েছে তার অনেকটাই মিথ্যে। ঘোষ সাহেবের বেলায় যেমন হয়েছিল তার সঙ্গে ইতর বিশেষ তফাত হতে পারে এই মাত্র। অভিনন্দন পত্রটাকে একেবারে পোশাকি মনে হচ্ছিল, বাজারে বিকোনো বিয়ের পদ্যের মতন, সর্বত্রই চলে, শুধু নামটা বদলে দিলেই যথেষ্ট। খোকা ছেলেমানুষ হলেও ঠিক বলেছে; ওটা নিতান্ত কতকগুলো গালভারী কথার সমষ্টি। মেয়েদের হাতে একরকম বালা থাকে বলে শুনেছেন সুধাকান্ত, যার ভেতরটা গালায় ভর্তি; এতে ফাঁপা ভাবটা নষ্ট হয়। সুধাকান্তর বিন্দুমাত্র সন্দেহ হল না, তাঁর পঁয়ত্রিশ বছরের কর্মজীবনের—যেখানটা ফাঁপা, কৃত্রিম, অন্তসারহীন—সেখানটা সহকর্মীরা গালা দিয়ে ভর্তি করে দিয়েছে। এটাই রেওয়াজ, ভদ্রতা, সৌজন্য।

নিজের সম্পর্কে নিজে পরিহাস করার মতন সুধাকান্ত কয়েকটা সুন্দর সুন্দর কথা মনে করলেন, যা আজ বিকেলে ফেয়ারওয়েলের সভায় শুনেছেন। মন্মথবাবু গীতার কর্মযোগের দৃষ্টান্ত তুলে সুধাকান্তকে একবারে কর্মযোগী করে তুলেছিলেন। গুণগান গাইতে গাইতে কত গলা ভারী হয়ে গিয়েছিল। ছোকরাদের তরফ থেকে অবনীশ বেশ কাব্যময় ভাষায় তাঁকে, নাকি তাঁর অন্তরকে, আকাশের মতন নির্মল উদার বলে বর্ণনা করেছিল। এসব কথা মনে পড়লে হাসি পাচ্ছে।

সুধাকান্ত নিজে জানেন, তিনি কি। নিজের অধ্যবসায়, পরিশ্রম, কর্মক্ষমতা, ব্যবহার-রাতি, ধৈর্য, সহানুভূতি ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁর ধারণা পরিষ্কার। সাধারণ কেরানী থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি চড়েছেন। একেবারে অযোগ্য তিনি নন; তাঁর উচ্চাকাঙক্ষা এবং নিরলস পরিশ্রমের জন্যে অহংকার স্বাভাবিক। কিন্তু সুধাকান্ত জানেন, তিনি অতিশয় চতুর এবং বুদ্ধিমান ছিলেন; নিজের মর্যাদা সম্পর্কে তাঁর প্রখর চোখ ছিল না। এক একটি সিঁড়ি শেষ করে তিনি পরবর্তীর জন্যে তৈরি হতেন। তাঁর সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল গোপনে, ধরা পড়ার ভয় প্রায় ছিল না। কিছু বিশ্বস্ত লোক তিনি রেখেছিলেন, যারা তাঁর রথ টানত। এদের তিনি সাধ্যমত প্রতিদান দিয়েছেন। আজ তিনি বার বার তাঁর সাধুতা ও উদারতার প্রশংসা শুনেছেন। তিনি নাকি অত্যন্ত সৎ, নীতিনিষ্ঠ, দৃঢ়চরিত্র। …আশ্চর্য, সূধাকান্ত এর কোনোটিই নন। ওরা যেভাবে বলেছে সেভাবে নয়। ঘোষ সাহেবের তুলনায় সুধাকান্ত সৎ বা সাধু হতে পারেন; ঘোষ সাহেব হীরের আঙটি পেয়েছেন, সুধাকান্ত সস্তায় জমি নিয়েছেন। হ্যাঁ, জনৈক ব্যক্তিকে খানিকটা সুযোগ-সুবিধে করে দেওয়ার পরিবর্তে তিনি আট হাজার টাকা কাঠার জমি চার করে নিতে পেরেছেন। তিনি সং বা সাধু হলে লোকটার আদালতে যাবার কথা। সময়বিশেষে এবং ছোটখাটো বিষয়ে তিনি সৎ থেকে তাঁর সাধুতার বিজ্ঞাপন প্রচার করেছেন, বেশির ভাগ মানুষ যা করে, কিন্তু বড় জায়গায় তিনি যথারীতি অসৎ। তিনি যদি সৎ তবে শশিকান্ত হাজরার নামে অকারণ একটা কলঙ্ক রটল কেন? কেন বেচারি শশিকান্ত অপবাদ আর দুর্নাম নিয়ে অফিস থেকে ট্রান্সফার হয়ে গেল; না, তিনি নীতিনিষ্ঠও নন, সুযোগ-সুবিধে মতন তিনি নীতি আঁকড়ে থেকেছেন, অসুবিধেয় পড়লে ছেড়ে দিয়েছেন। আজ ফেয়ারওয়েলে যাবার আগে হলঘরের মুখে মলিনার সঙ্গে দেখা হল। মলিনা আজ আঠারো-বিশ বছর এই অফিসে চাকরি করছে। যখন প্রথম এসেছিল তখন তরুণী, বছর উনিশ-কুড়ি বয়স, টাইপিস্ট-এর চাকরি নিয়ে ঢুকেছিল; এখন মলিনার বয়স প্রায় চল্লিশ হতে চলেছে, বিবাহিতা মেয়ে, বাড়িতে দু-তিনটি ছেলেমেয়ে, স্বামী অন্য অফিসের কেরানি। মলিনাকে আজ ভারিক্কি, সাদামাটা, ক্লান্ত দেখায়; তখন এরকম দেখাত না, ময়লা রঙে কেমন একটা টান ছিল, গড়নে দপদপে ভাব ছিল, চোখে চটুলতা। সুধাকান্তর কাছে টাইপের জন্যে মলিনাকে দেওয়া হয়। সুধাকান্ত একটা মাসও ওকে রাখেননি। কেন রাখেননি সুধাকান্ত জানেন, আর জানে মলিনা। টাইপের অজস্র ভুল সেদিন মলিনা কেন করেছিল সুধাকান্ত জানেন, অথচ কি রকম একটা ঈর্শাবশে মলিনাকে তিনি তাঁর কাছ থেকে তাড়িয়ে দিলেন; বেচারি সুনীল, সুধাকান্তর কাছে প্রায় মুচলেকা দিয়ে বাঁচল। মলিনার সঙ্গে এই ব্যবহার উদারতার নয়, ভদ্রজনের নয়, এমন কি হৃদয়বান মানুষেরও নয়। …আজ মলিনা সুধাকান্তকে দেখে সাধারণ একটু হাসিমুখ করল, হয়ত তার পুরনো কথাটা মনে পড়ছিল।

সুধাকান্তর ইচ্ছে হচ্ছিল, যদি সম্ভব হত, এখন তিনি তাঁর পঁয়ত্রিশ বছরের সহকর্মীদের এনে সামনে দাঁড় করাতেন, হলঘরে যেভাবে তারা দাঁড়িয়ে বা বসে ছিল সেই ভাবে। তাদের সামনে রেখে বলতেন: শুনুন, আপনারা শুনছেন নাকি, শুনুন—আমি, যে-মানুষটি আপনাদের মালাটালা নিলাম, অনেক দামি দামি জিনিসপত্র যাকে দিলেন, আর যাকে আপনার কর্মযোগী, সৎ, উদারটুদার কত কি বললেন—সেই মানুষটি আর আমি এক নই। আপনারা একটা সুধাকান্ত চ্যাটার্জি তৈরি করে নিয়েছেন; অবশ্য দোষ আপনাদের নয়, এটা হয়ে থাকে। কিন্তু ভাই বিশ্বাস করুন, আমি অন্য মানুষ, আমার সম্বন্ধে আপনারা প্রায় কিছুই জানেন না। আমি কোনো যোগীটোগী নই; সৎ, উদার, হৃদয়বান, ন্যায়নিষ্ঠ কিছুই নই; আমি খুবই—কি বলব—বিচক্ষণ ব্যক্তি, জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্যে বিচক্ষণতার দরকার হয়, সৎ-টৎ উদার-ফুদার সবই হতে হয় বিচক্ষণতার সঙ্গে, উপকার অপকার তাও বিচক্ষণতার সঙ্গে করতে হয়। আসলে—কি বলব—আসল উদেশ্য সাধনে সব কিছুই নিমিত্ত করে নিতে হয়। কথাটা ভাই আপনারা বোধহয় বুঝলেন না; আমিও ঠিক বোঝাতে পারছি না। …মানে, শুধু এইটুকু বলতে পারি—আমার ধাত বা চরিত্র আপনারা যা বললেন তা নয়, আমি যথেষ্ট ক্লেভার, মাথায় বুদ্ধি রাখি, কোন ঠাকুরের কোনটা মাথায় চড়াবার্‌ পাতা তা অভিজ্ঞতা দিয়ে শিখেছি, আমি সকলকে আপনার করার জন্য ভদ্র ভাঁড়ামি, জানি, ভদ্রলোকের ধাতে সহ্য হয় এমন নীচতা নোংরামি, চালাকি জানি। আর ভাই এও জানি—দিস ফেয়ারওয়েল ইজ নাথিং…স্টুপিডিটি…

হঠাৎ চোখের সামনের অন্ধকার যেন একটানে কেউ তুলে নিয়ে আলো করে দিল। সুধাকান্ত চমকে উঠলেন। ক’ মুহূর্ত কিছুই ঠাওর করতে পারলেন না। তারপর আলোটা চোখের মণিতে ধরা পড়ল।

“কি গো, এখানে এসে বসে আছ?” সুনয়নী গায়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ঘুম ভেঙে সুধাকান্তকে দেখতে না পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন সুনয়নী। কোথায় গেল মানুষটা?

সুধাকান্ত কোনো জবাব দিলেন না। আলো না কি অন্য কিছুর জন্যে তাঁর চোখ জ্বালা করছিল। গলাটা ব্যথা ব্যথা লাগছে, ঠাণ্ডায় না কি অন্য কারণে!

সুনয়নী স্বামীর জন্যে উদ্বেগ বোধ করছিলেন। হল কি মানুষটার! এভাবে বসে আছে! সারা রাতের ঠাণ্ডা জমেছে ঘরে। চাকরি ছেড়ে এসে প্রথম দিনেই এই!

সুধাকান্তর কপালে বুকে হাত দিলেন সুনয়নী, তাঁর চোখেমুখে ঘুমের ঘোর তখনো জড়ানো, গায়ের শাড়ি এলোমেলো। সুধাকান্তর গায়ের চাদরটা ভাল করে বুকের কাছে জড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, “এখানে এসে বসে কেন গো? কি হল?”

“ঘুম আসছিল না।” সুধাকান্ত ছোট করে জবাব দিলেন।

বড় করে হাই তুললেন সুনয়নী, চোখ মুছলেন। “প্রথম দিনেই এই!”

“কি?”

“কিছু না।…চাকরি থেকে সবাই বাপু একদিন ফিরে আসে। তোমার দেখছি প্রথম দিনেই ঘুম গেল!”…

সুধাকান্ত প্রতিবাদ করলেন না। গায়ের চাদরের খুঁটে মুখটা মুছলেন। তারপর চুপচাপ।

সুনয়নী স্বামীর পাশে নানান উদ্বেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে।

বাইরে বুঝি সবে একটি দুটি করে কাক ডেকে উঠছে।

সুনয়নী বললেন, “সারা রাত জেগে?”

“সামান্য ঘুমিয়েছি।”

“বেশ করেছ, নাও শোবে চলো, শরীর খারাপ করবে।” সুনয়নী স্বামীর কাঁধের কাছে হাতটা এমন ভাবে রাখলেন যেন উঠিয়ে নিয়ে যাবেন।

সুধাকান্ত উঠলেন না। বসে থেকে থেকে বললেন, “আলোটা জ্বাললে কেন। নিবিয়ে দাও।”

“শোবে না?”

“না, আজ থাক। শোবার দিন তো পড়েই থাকল।”

“সুনয়নী বাতি নিবিয়ে দিতে গেলেন, সুধাকান্ত শুধোলেন, “কটা বাজল বলো তো?”

সুনয়নী সময়টা বলতে গিয়ে পাখিঅলা ঘড়িটার দিকে তাকালেন, তাকিয়ে কেমন অবাক হলেন। “ওগো, তোমার এই পাখি তো…”

সুধাকান্ত ঘাড় ফেরালেন। স্পষ্ট না হলেও অস্পষ্টভাবে তাঁর চোখে পড়ল, পাখিটা থেমে গিয়েছে, ঘড়ির কাঁটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলতে পারছে না, হয়তো কোথাও আটকে গিয়েছে। সুধাকান্ত বললেন, “কোথাও গণ্ডগোল হচ্ছে, সেরে নিলেই হবে।”

সুনয়নী বাতি নিবিয়ে দিয়ে মৃদু একটা আফসোসের শব্দ করতে করতে স্বামীর কাছে এলেন, “যাই বলো, দেবার জিনিস একটু ভাল করে দেখে দিতে হয়।”

সুধাকান্ত নীরব। অন্ধকারে যে পাতলা হয়ে আসছে বোঝা যায়, খুব হালকা তরল সাদাটে ভাব মিশছে আঁধারে; হিম-ভেজা বাতাস, প্রত্যুষের কেমন ঝাপসা ভাব জমেছে জানলায়।

অনেকক্ষণ কি রকম এক নীরবতার পর সুধাকান্ত আস্তে গলায় বললেন, “সুনু, একটা কথা বলব?”

“কিসের কথা গো?”

সুধাকান্ত অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন, যেন বলার কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারছিলেন না। শেষে বললেন, “আমি যদি আগে যাই তুমি আমায় কি দেবে?”

সুনয়নীর সারা গা শিউরে উঠল; রাতভোরে এ কি অলক্ষুণে কথা! তাড়াতাড়ি স্বামীর মুখ চাপা দিলেন। ছি ছি।

সুধাকান্ত স্ত্রীর হাত অল্প করে সরিয়ে দিয়ে বললেন, “আমার বড় জানতে ইচ্ছে করছে সুনু, সেই ফেয়ারওয়েলটায় কে-কি দেয়।”

সুনয়নী আর হাত উঠিয়ে মুখ চাপা দিলেন না। হাতটা যেন অসার হয়ে সুধাকান্তর থুতনির কাছে থেমে থাকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *