সংবাদ : ১৯৭৬
বিশ্ব সেবার কুলু মানালিতে বেড়াচ্ছে যাচ্ছে। দুর্গাপুরে ভালো চাকরি করে, যা মাইনে পায় তার সবটুকুই নিজের পিছনে খরচ করতে পারে। সবসময়ে ঝকঝকে তার জামা কাপড়। নিত্য নতুন।
দেখা হল কল্যাণের অফিসঘরে, যেমন প্রায়ই হত। সে টেবিলের ওপর ঝুঁকে অনায়াস দক্ষতায় কোনও তরুণ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ আঁকছিল। মাথা নীচু থাকায় তার বিরল কেশ তালু দেখা যাচ্ছে। কবিতার বইয়ের মলাটে সে ছিল সিদ্ধ।
তার মনোযোগে ঘা দিয়ে প্রশ্ন করি–কী খবর?
তার দাঁত ছিল চমৎকার, কণ্ঠস্বর অল্প ফ্যাঁসফাঁসে আর নীচু পরদায় বাঁধা।
হেসে সে বলে–কুলু মানালি চ লোম।
একা?
–একা। দোকার চেয়ে একাই ভালো। অন্যরা সঙ্গে গেলে নিজের ইচ্ছে মতো ঘোরা যায় না।
আমার মনে একটা দুশ্চিন্তার মেঘ ছায়া ফেলে গেল। বেড়াতে যেতে বরাবরই আমার এক ভয়াতুর অস্বস্তি! তার ওপর কোনও দূর জায়গায় একা যাওয়া তো আরও অসম্ভব।
বললাম–একা যাচ্ছেন, যদি বাইরে গিয়ে কোনও বিপদ–আপদ হয়?
–বিপদ আবার কী? বিপদ টিপদের কথা ভাবি না। একা বেড়াতেই বেশ লাগে।
–অনেক দূর! দ্বিধাভরে বলি।
–দূরই তো ভালো। নতুন একটা ক্যামেরা কিনেছি, আসাহি পেন্টাক্স। ক্যামেরার কথা জানতাম। বললাম–কত পড়ল যেন?
–দুই চেয়েছিল। আঠারোশো দেব ঠিক করেছি। যা ছবি তুলে আনব না, দেখবেন। চারটে কালার রোল নিয়ে যাচ্ছি। আমার ম্যামিয়া ক্যামেরাটা বেচে দেব। আপনি কিনবেন বলেছিলেন। কী হল?
আমার এক জার্মান ক্যামেরা ছিল বহুকাল আগে। পূর্ণ দাস রোডের মেসে থাকবার সময়ে সেটা কোনও উপকারী সঙ্গী হাতসা ফাঁই করে। তারপর থেকে ক্যামেরার জন্য একট অভাববোধ থেকে গেছে।
বললাম–ম্যামিয়া ক্যামেরাটা বড্ড ভালো। কিনবার ইচ্ছেও ছিল। কিন্তু টাকা কোথায় পাব?
–রেখে দিন না! টাকা না হয় পরে দেবেন।
একটু ভাবি। ক্যামেরাটার দাম বিশ্ব চেয়েছে আটশো টাকা। অতগুলো টাকা একসঙ্গে দেওয়া! একটু ভাবতে হয়। ক্যামেরা মানেই তো খরচ।
বললাম–আপনি ঘুরে আসুন দেখা যাবে।
বিশ্ব একটা চমৎকার কাঠকয়লা রঙে আস্তরণ দিল প্রচ্ছদের ভূমিতে। মিষ্টি হয়ে গেল এযাবৎ ভুতুড়ে ছবিটা। আঁকিয়েরা পারেও বটে ম্যাজিক দেখাতে।
তুলি দিয়ে রং এদিক-ওদিক টেনে দিতে-দিতেই বলল –প্রায়ই ক্যামেরটার জন্য খদ্দের আসছে। আপনার জন্যই ধরে রেখেছি। পাশের অফিসের ভটচায্যিই চাইছে, হাজার দেবে।
একটু লোভ শরীরে কিলবিল করে উঠল। নেব?
কিন্তু বরাবরই যে কোনও কাজের আগে, সিদ্ধান্তের আগে আমি একটু ভাবি। তার ফলেই আমি কিছু ধীর, অপটু এবং ব্যর্থ। দ্বিধা যে মানুষের কত বড় শত্রু।
অনেক ভেবে বললাম–না এক্ষুনি বলতে পারছি না। বরং ভটচায্যিকেই দিয়ে দিন।
–দেব?
–দিন।
বাকি দশ মিনিটে বিশ্ব প্রচ্ছদটা শেষ করল। অসাধারণ এক মলাট এঁকেছে সে। আগাগোড়া কথা বলতে-বলতে, আধা–অন্যমনস্কতায়।
মলাটটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলল –কেমন হল?
–দারুণ।
–তবু কমার্শিয়াল কনসার্নগুলো আমায় কাজ দেয় না।
–আমি চেষ্টা করব। কয়েকজন চেনা আছে।
–দেখবেন তো।
–বিয়ে কবে করছেন?
বিশ্ব ভারী লাজুক, হেসে বলল –এই তোশিগগিরই।
–মেয়ে তো ঠিক হয়ে আছে। দেখতে কেমন?
–মোটামুটি।
–আপনি দেখেছেন?
–হ্যাঁ।
ওর মুখভাব দেখে মনে হয়েছিল, পাত্রী পছন্দই হয়েছে।
সেই দেখা হওয়ার পর মাঝে-মাঝেই মনে হত, একা কুলু মানালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্ব ভালো করেনি। অত দূরে গিয়ে যদি অসুখ করে তো কে দেখবে? যদি দুর্ঘটনায় পড়ে তবে?
ক্যামেরাটার কথাও প্রায়ই মনে হয়েছে। ছেড়ে দিয়ে খারাপ হল। নিয়ে নিলেই হত। যাওয়ার আগে ক্যামেরাটা ভটচায্যিকে দিয়ে গেছে বিশ্ব। এখন আর কিছু করার নেই।
মাসখানেক বাদে ডিউক রেস্তোঁরায় দুপুরবেলা আড্ডাধারীদের খোঁজে হানা দিতেই মাধুর সঙ্গে দেখা। বলল –বিশ্ব মারা গেছে জানেন?
–কুলু মানালিতে?
–না, না। সেখান থেকে কয়েকদিন আগে ফিরে এসেছে। অনেক ফটো তুলে এনেছে, দেখাল।
–তবে?
–মারা গেছে হাওড়ায়, বাস অ্যাকসিডেন্টে।
রেগে গিয়ে বলি–এ হয় না। ভুল খবর।
–কল্যাণকে জিগ্যেস করবেন। আমরা হাসপাতাল যাইনি, ও গেছে। সন্ধেবেলা কল্যাণ এসে বলল –বিশ্বকে শেষ করে এলাম।
–কী দেখলেন?
–কিছু না। খুব নর্মাল মুখচোখ। কোথাও থেঁতলে বা কেটে যা ভেঙে যায়নি। নাক দিয়ে সামান্য রক্ত গড়াচ্ছিল। কেউ কিছু বলতে পারছে না।
–ব্যাপারটা কীরকম হল তাহলে?
–বোধহয় যোলো নম্বর বাসে ঝুলে আসছিল। ল্যাম্পপোস্ট বা ওইরকম কিছুতে মাথাটা লাগে। হাওড়ার রাস্তা তো বড় সরু। রাস্তায় পড়ে ছিল। লোকজন ধরাধরি করে তুলে যখন। হাসপাতালে পাঠায় তখন ফিনিশ। ইন্টারন্যাল হেমারেজ।
অন্তর্গত রক্তক্ষরণ?
মনের মধ্যে একটা বোবা কী যেন বলতে চায়। তার শব্দ শুনি, কথা বুঝতে পারি না। মনে হয়, কখনও সে একটা ক্যামেরার কথা বলে, কিংবা কখনও কুলু মানালির দূরত্বের কথা। নাকি, একা দূরে যেতে নিষেধ করে সে?
২.
মেদিনীপুরের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে কেতোর জুতো চুরি গিয়েছিল। খালি পায়ে ছোটাছুটি করে জুতো খুঁজে এবং না পেয়ে অবশেষে কেতোর সে কি রাগারাগি! চেঁচিয়ে সবাইকে বলছে এখানে ভ ভদ্রলোক নেই, সব কটা চোর।
সে ঠান্ডা হওয়ার পর আমি আর কল্যাণ তার পেছনে হুড়ো দেওয়া শুরু করলাম। কল্যাণ বলে–কেতো, তোমার শ্বশুরের দেওয়া জুতোজোড়া তোমার শ্বশুরই আবার লোক লাগিয়ে চুরি করিয়েছে। জামাইষষ্ঠীতে আবার তোমাকে ওই জুতোই প্রেজেন্ট করবে। জুতোর দাম কী পরিমাণ বেড়েছে জানোই তো!
খ্যাপালে কেতো হি–হি করে হাসত। তার হাসির ভিতর দিয়ে হৃদয়ের ছবি দেখা যেত।
খুব ছেলেবেলা থেকেই কেতো আসত আমার কাছে। আমার ছোটো ভাইয়ের বন্ধু। রাজ্যের গল্প কবিতা লিখে আনত দেখানোর জন্য। লেখাগুলো তেমন কিছু হত না। অবহেলায় দিয়ে বলতাম–এখনও ঢের লিখতে হবে। পাকা হও।
চমৎকার ছাত্র ছিল সে। উচ্চমাধ্যমিকে বৃত্তি পেল, ডাক্তারি পাশ করল একবারে। মেডিকেল কলেজে পড়বার সময়ে তার চেনার সূত্র ধরে আমরা কত জনা যে কতরকম চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছি। কারও কিছু হলেই কেতোর কথা মনে পড়ত সকলের। আমিও কত অনিচ্ছুক রুগিকে ঠেলেঠুলে পাঠিয়েছি কেতোর কাছে।
তার এ বিষয়ে ক্লান্তি ছিল না। কেউ গেলে দৌড়ঝাঁপ করে তার কাজ আদায় করে দিত। ডাক্তারি পড়ার সময়ে সে কোনও হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে একবার ঘুমের বড়ি খায়। বেঁচে গিয়ে পড়ল হেপাটাইটিসে। এ রোগটা সে পেয়েছিল অন্য এক রুগির কাছ থেকে।
তার বিয়ে ঠিক হল কয়েকবার। কপালক্রমে কোনওটাই হল না। নকশাল আন্দোলনের সময়ে একবার হোস্টেলের কিছু ছেলে তাকে মারে। নিরীহ কে তোকে কেউ মারতে পারে এ আমার ধারণায় আসে না আজও। সে তো বরাবর ধমক খেয়ে হেসেছে। কখনও দশ মিনিট একসঙ্গে গম্ভীর থাকেনি!
ডাক্তারি পাশ করার পর বিয়ে হল তার। সে বিয়েতে আমার যাওয়া হয়নি, কেন তা ভেবে পাই না। কিন্তু যাওয়া হয়নি।
বিয়ের পর অন্যরকম এক কেতোর সঙ্গে দেখা হল। প্রথম দিকে বেশ উজ্জ্বল উজ্জ্বল, তারপর কিছু বেশিমাত্রায় অন্যমনস্ক।
বলতাম–কবে বিলেতে যাচ্ছ কেতো?
–শিগগিরই। পাশপোর্ট করতে দিয়েচ্ছি।
গায়নোকলজির দিকে ঝোঁক ছিল। চমৎকার ডাক্তার ছিল সে। ক্যালকাটা হলপিটালে থাকাকালীন সে মেয়াদ ফুরোনোর পরও এক্সটেনশন পায়। নানা হাসপাতাল থেকে চাকরির ডাক এসেছে।
বলতাম–বিলেতে যাবেই কেতো?
–না গিয়ে কী করব? এম . ডি . করলাম, এতে মন ভরছে না। এম আর সি পি, আর এফ আর সি এস করে আসি।
–তখন তোমার ভিজিট কত হবে?
খুব হাসত হি হি করে। হৃদয় দেখা যেত।
–তখন তোমার ভিজিট দেবোকী করে?
–আপনাদের ভিজিট যে কত পাব সে জানি।
সামনে সিগারেট খেত না। আমিই তাকে জোর করে খাওয়াই। মোটা হয়ে যাচ্ছে দেখে অনুযোগ দিয়ে বলতাম–এই ব্যাঙের মতো থপথপ অপদার্থ চেহারা নিয়ে কী যে করবে তুমি!
–না দাদা, ডাক্তারদের একটু ফ্যাট থাকা ভালো। কাজে লাগে।
–দূর বোকা। বিলেতে গিয়ে আমার জন্য কী পাঠাবে?
–সে ভেবে রেখেছি। আপনার তো খুব কলমের শখ। একটা দারুণ কলম পাঠাব।
পাশপোর্ট হয়ে গেল ভিসা এল। টিকিট কাটা শেষ।
যে মাসের উনত্রিশ তারিখে তার রওনা হওয়ার কথা সে মাসেরই বোধহয় আঠারো তারিখে জামসেদপুরের এক আত্মীয়বাড়িতে সে কয়েকটা আপাত নিরাপদ ব্যথাহরা বড়ি খেয়েছিল। মাথা ধরেছিল বোধহয়।
জুডো ক্যারাটের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রুস লিও খেয়েছিল। তারপর অন্তর্গত রক্ত নাক কান মুখ দিয়ে অবিরল ধারায় বেরিয়ে এসেছিল। ট্যাপ খোলা কলের মতো। সেই ট্যাপ বন্ধ করবার কেউ ছিল না।
কেতোর রক্তের কল খুলে গেল সেই রাতে। ঝলকে ঝলকে উঠে আসে মহার্ঘ লোহিত তরল। প্রাণদায়ী। অস্তিত্বের সারাৎসার।
হেমারেজ সে অনেক দেখেছে, সারিয়েছে বহু। নিজের রক্ত দেখতে-দেখতে তার ক্লান্তি এল। মাথা নেড়ে বলল –ইউসলেস। আমি বাঁচব না।
অনেক ডাক্তার জড়ো হয়েছিল। একজন ডাক্তারকে বাঁচাতে।
সে বাঁচলে অনেকে বেঁচে যেত।
কিন্তু অ্যাপয়ন্টমেন্ট ছিল যে। বিলেত থেকে আর একটু রহস্যময় দূরত্বে সে চলে গেল বিনা ভিসায়। সেখান থেকে কলম পাঠানো যায় না।
আমি কি সেই কলমটার কথা ভাবি মাঝে-মাঝে! হাতে কলমটার দিকে চাইলেই কেতোটার কথা বড় মনে পড়ে।
৩.
মানুষের জীবনে এক-একটি মৃত সময় আসে। বড় নিষ্ফলা সময় সেটা। কিছু হয় না তখন, কিছু ঘটে না তখন, কিছু পাওয়া যায় না তখন। জীবন বদ্ধ দরজার মতো নিরেট দাঁড়িয়ে থাকে। মাথা খোঁড়ো, কেউ সাড়া দেবে না।
আমার এইরকম খরা, অজন্মার সময়ে আমাকে শববাহকের মতো অনেকদূরে বহন করেছিল শংকর। শ্মশানের দিকে নয়, বেঁচে থাকার দিকে। ঝাঁড়ফুঁক জানা ছিল তার কিছু। অল্প স্বল্প চিকিৎসার বিদ্যা, সে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে জানত ছেঁড়া কাগজের মতো অন্যের বিষণ্ণতা।
তার নিজের বিষণ্ণতা ছিল অমোঘ। একদিন এই বজ্রপাতের শব্দ শুনিয়ে গেল।
শংকরের জন্য ভাবতে বসে কখন নিজের কথা ভাবতে থাকি। আমারও একদিন দেখা দেবে হৃদরোগ? কিংবা কোনও রক্তক্ষরণ? নিদেন দুর্ঘটনা?
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলে তাকে দেখতে যাই।
–কেমন আছেন শংকর?
–আরে, আসুন, আসুন। মা দেখে যাও, কে এসেছে!
মাসিমা তার মায়ের হাসিটি মুখে করে আসেন–দ্যাখো তো, শংকর কী কাণ্ডটা বাধাল!
শংকর অনেক কিছু বুঝত, জানত। অনেক বিষয়ই ছিল তার প্রিয়। তবু সবচেয়ে প্রিয় ছিল লেখার কথা।
বললাম–ভালো কবিতা লিখছেন এখন।
–ছেড়ে দিন ওসব কথা। অন্য সবার খবর কী?
অনর্গল তার কাছে নানা কথা বলা যেত। তার বিশ্বস্ততা ছিল খাঁটি সোনার মতো।
উনিশশো একষট্টি সালে আমরা দল বেঁধে জামসেদপুর যাই। শংকর যায়নি। কলকাতার বাইরে সে কদাচিৎ গেছে। নৈহাটি যেতে হলেও সে নার্ভাস হয়ে পড়ত। কিন্তু কলকাতা ছিল তার অনায়াস বিচরণের ক্ষেত্র।
বললাম–আর ড্রিংক করবেন না।
–ছেড়ে দিন।
–বিয়ে করছেন কবে?
–ছেড়ে দিন।
–আবার সুতৃপ্তির আড্ডায় আসুন। আপনি নাহলে জমে না।
–ছেড়ে দিন।
ছাড়তে-ছাড়তে অবশিষ্ট তার কী ছিল কে জানে! ক্রমে সে মায়ের আঁচলধরা হয়ে যাচ্ছিল ছেলেবেলার মতো। এমনভাবে ‘মা’ ডাকত যেন এক অবোধ শিশু পৃথিবীতে পথ হারিয়ে ফেলেছে। ‘খুকু’ বলে যখন বোনকে ডাকত মনে হত তার বোনটি বুঝি কোলের খুকি, কোথাও পড়ে টড়ে যাবে, কাঁদবে।
একদিন আচমকা শুনি দ্বিতীয় বর্জ্যের শব্দ–শংকর আবার হাসপাতালে।
অপেক্ষা করি আরোগ্য সংবাদের জন্য।
সংবাদ অবশেষে আসে। শংকর বাড়ি ফিরেছে। যাই।
–শংকর।
–আরে, আসুন, আসুন।
–এসব কী হচ্ছে?
–ছেড়ে দিন।
একবারও কখনও সে তার রোগযন্ত্রণার কথা বলেনি। এসব বলতে সে ভালোবাসত না। কতগুলো ব্যাপারে তার বিরাগ ছিল তীব্র। কমদামি সিগারেট, রুমাল, বাইরে যাওয়া। তেমনি নিজের ব্যাধির কথাও।
একদিন এল ছোট ভাইয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে। সঙ্গে খুকু।
বললাম–ছোট ভাইয়ের বিয়ে! বড় ভাই বাকি রইল কেন?
–আহা, ছেড়ে দিন না ওসব কথা।
–আমার বউ বলল –না ছাড়াছাড়ির কথা নয়। এবার মত করে ফেলুন।
লাজুক মুখে বলল –সময় পার হয়ে গেছে।
সেই বিয়েতে বড় ধুম হয়েছিল। যেন এক সাহিত্যবাসর। শ’খানেক কবি–সহিত্যিকের হল্লা। শংকর বরকর্তার সাজে সেজে বেড়াচ্ছে। হাত ধরে, কাঁধ ধরে, আন্তরিক হর্ষধ্বনিতে অভ্যাগতদের ধরে আনছে দরজার মুখ থেকে। চেঁচাচ্ছে–দ্যাখো, দ্যাখো, কে এসেছে।
তারপর আর একদিনও তার নিরালা দোতলার ঘরে বসে অনেকক্ষণ কত কথা বলেছি।
সে আমাকে আশ্বাস দিয়েছিল–হবে।
এক সন্ধেবেলা মেয়েকে নিয়ে রাসবিহারী অ্যাভনিউয়ের এক ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। ভাবলাম, যাই শংকরকে দেখে আসি।
মাসিমা খুব খুশি হয়ে বলেন–এসো, এসো। শংকর তো অফিসের কাজে গৌহাটি গেছে।
–গৌহাটি! অবাক হই। শংকর কোথাও যেতে ভালোবাসত না যে। মাসিমা বলেন–যেতে দিতেই হল বাবা। চাকরি। শংকরও খুব যেতে চেয়েছিল।
–কীসে গেল?
–প্লেনে।
মনটা দোল খায়। হার্টের রুগি।
মাসিমা মুখ দেখে বুঝে বললেন–শুনল না। কী করব বল!
–এবার ওর বিয়ে দিন মাসিমা। বয়স হল।
–তোমরা ওকে রাজি করাতে পারলে না তো! যা হোক বাবা, এবার এক পাত্রী ঠিক করেছি। মেয়েটির পোলিও হয়েছিল, পা একটু খোঁড়া, কিন্তু বড় ভালো মেয়ে তোমরা প্রার্থনা করো, যেন বিয়েটা দিতে পারি।
খুব খুশি হয়ে এলাম সেদিন।
বারবার একটা উড়োজাহাজের কথা মনে পড়ছিল। বারবার।
উড়োজাহাজ কি ভালো হার্টের রুগির পক্ষে? ভালো?
শংকর এখন গৌহাটির অফিসেই বুঝি স্থায়ীভাবে কাজ করছে। চিঠি দেয় না। সে আমাদের সংসর্গ ত্যাগ করেছে। আসে না। সে আমাদের মুখ দেখতে চায় না।
ভয় হয়, যদি আবার আমার জীবনে কখনও মৃত, নিষ্ফলা সময় আসে তখন কে এসে তার বিশাল কাঁধ দিয়ে ভার নেবে আমার। গম্ভীর কামানের গলায় বলবে–ঘাবড়াবেন না। হবে।