সংবর্ধনা

সংবর্ধনা

‘এই যে বিশুবাবু, নমস্কার। শুনলাম আপনার মামাশ্বশুর নাকি লটারি পেয়েছেন?’

‘ঠিকই শুনেছেন।’

‘তা কত টাকা পেলেন তিনি?’

‘ভালোই পেয়ে থাকবেন। পাঁচ—দশ লাখ পেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

‘তাহলে বিশুবাবু, এ তো বেশ গৌরবের কথাই, কী বলেন? লটারি ক—জন পায় বলুন। লটারি পাওয়া মানে তো দশজনের একজন হয়ে ওঠা। এই গৌরবজনক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে কি আপনার কিছু করা উচিত নয়? মামাশ্বশুর তো আর পর নয়। আমাদের সকলেরই তো মামাশ্বশুর আছে, কেউ তো এমন বিরল কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। আমার মামাশ্বশুর তো হাড়হাভাতে। আপনার কি মনে হয় না যে লটারি জেতার জন্য ওঁকে প্রথমে একটা গণ ও পরে একটা নাগরিক ও তারও পরে একটা পুর সংবর্ধনা দেওয়া উচিত!’

‘তা তো বটেই।’

‘এ বিষয়ে একটা কমিটিও কি অবিলম্বে গঠন করা উচিত নয়? লটারিতে জয় তো চাট্টিখানি কথা নয়। লাখ লাখ লোক প্রতিদিন লটারি খেলছে, কিন্তু প্রাইজ পায় ক—জন বলুন!’

‘অতি ঠিক কথা।’

‘এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা প্রায় ত্রিশ বছরের। ত্রিশ বছরে মোট সাতশো একত্রিশজনকে নানারকম কৃতিত্বের জন্য সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা আমিই করেছি। ব্যায়ামবীর বলরাম শীল, নৃত্যশিল্পী কল্লোলিনী কয়াল, জাদুকর পি পাল, সাঁতারু বিপ্লব বসুর মতো বিখ্যাত লোকেরা তো আছেই। তা ছাড়া ধরুন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরল কৃতিত্বের জন্য আমরা পাঁচু চোর, পরেশ পকেটমার, গুল মারার জন্য গয়েশ গায়েন— এদেরও বাদ দিইনি। সংবর্ধনায় আমার খুব হাতযশ।’

‘শুনে বড্ড খুশি হলাম। আপনি করিতকর্মা লোক।’

‘আজ্ঞে সবাই তাই বলে, তবে এটাকে আমি দেশ বা দশের সেবা বলেই মনে করি। অনেকেই বলে বটে, নিতাইবাবুর মতো এরকম আত্মত্যাগ, এরকম কর্মোদ্যাগী এতবড়ো সংগঠক বড়ো একটা দেখা যায় না, কিন্তু আমি ভাবি, এটা তো আমার পবিত্র কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। কী বলেন?’

‘না না, তা বললে হবে কেন? আপনি বিনয়ী মানুষ বলেই কৃতিত্ব স্বীকার করতে চাইছেন না। কিন্তু আত্মত্যাগ ক—টা লোক আর করছে বলুন।’

‘সে অবশ্য ঠিক কথা। সেদিন নবীনবাবু তো বলেই ফেললেন, নিতাইবাবু, আপনি দেশের যুবসমাজের কাছে এক জ্বলন্ত উদাহরণ।’

‘নবীনবাবু ঠিকই বলেছেন।’

‘আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে এভাবে জনগণের সেবা যেন আজীবন করে যেতে পারি।’

‘সে তো বটেই। সেবাটা চালিয়ে যাওয়াই উচিত।’

‘তবে কিনা সেবা করতে করতেই জীবনটা কেটে যাচ্ছে, নিজের দিকে আর তাকাতে পারলাম কই বলুন।’

‘দেশসেবকরা, জনগণের সেবার্তরা নিজের দিকে তো তাকায় না। তাকাতে নেইও।’

‘এই আপনার মামাশ্বশুরের কথাই ধরুন, আমরা পাঁচজন তাঁর কৃতিত্বের কথা সর্বসমক্ষে তুলে না ধরলে একটা জাতীয় কর্তব্যকেই কি অবহেলা করা হবে না? আগামী রোববারই আমরা সংবর্ধনা কমিটি তৈরি করছি। লোকের অনুরোধে আমি সভাপতি হতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়েছি।’

‘আপনার মতো কৃতী লোক থাকতে অন্য কাউকে সভাপতি করা হবেই বা কেন বলুন। সেটা যে গুরুতর অন্যায় হবে।’

‘হেঁঃ হেঁঃ, সেইজন্যই রাজি হতে হল। সংবর্ধনা তো চাট্টিখানি কথা নয়! হল ভাড়া করা, ফুলের তোড়া, মালা ইত্যাদির জোগাড়, তারপর ধরুন উদবোধনী সংগীতের আর্টিস্ট, এসব তো লাগবেই। সংবর্ধনার পর জনগণের মনোরঞ্জনেরও তো একটু ব্যবস্থা রাখতে হবে না কী? তার জন্য কিশোরকণ্ঠী, মুকেশকণ্ঠী, হেমন্তকণ্ঠী কয়েকজন আর্টিস্টকে আনা, একটা মূকাভিনয়, একটু ম্যাজিক—ট্যাজিক, তারপরে একখানা নাটক, হরবোলা, অর্কেস্ট্রা কোনটা না হলে চলে বলুন। মাইকের ভাড়া, জলযোগের ব্যবস্থা এসবও তো না করলেই নয়।’

‘যে আজ্ঞে। এসব তো সংবর্ধনার চিরকালীন অঙ্গ, বাদ দিলে অঙ্গহানি হবে।’

‘খরচাপাতিও আছে, তা ধরুন গিয়ে হাজার বিশেক টাকা হলে ম্যানেজ করে নেওয়া যায়।’

‘বিশ হাজার তো আজকালকার বাজারে কিছুই নয়! আপনি ভালো সংগঠক বলেই হয়তো ম্যানেজ করতে পারবেন।’

‘যে আজ্ঞে, তবে ওটা জনগণের চাঁদা থেকেই তুলে নিতে হবে। আর বাকি হাজার বিশেক টাকা যদি আপনার মামাশ্বশুরকে বলে একটা ডোনেশনের ব্যবস্থা করতে পারেন তাহলে আর ভাবনা থাকে না। লটারিটা তো হেলায় জয় করেছেন, ওই সামান্য টাকা ওঁর গায়েই লাগবে না।’

‘সে আর বেশি কথা কী? যিনি লটারি মেরেছেন তার তো আর টাকার অভাব নেই। ও নিয়ে আপনি ভাববেন না।’

‘নিশ্চিন্ত হতে পারি তো?’

‘নিশ্চয়ই। তবে মামাশ্বশুরকে বলে টাকা আদায় করতে একটু সময় লাগবে।’

‘কেন বলুন তো, উনি কি খুব ব্যস্ত?’

‘তা ব্যস্তই বোধ হয়। লটারি পেলে সকলেই তো খুব ভিআইপি হয়ে ওঠে।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তা তো ঠিকই। আপনি বরং আমাকে একবার তাঁর কাছে নিয়ে চলুন।’

‘সেটাও শক্ত নয়, তবে দেরি হবে।’

‘আচ্ছা, এই দেরিটার কথা বারবার বলছেন কেন বলুন তো! নিজের মামাশ্বশুরের সঙ্গে কি আপনার সদ্ভাব নেই?’

‘আজ্ঞে সদ্ভাব থাকারই তো কথা ছিল।’

‘তবে দেরি হবে কেন?’

‘লজ্জার কথা হল তাঁকে খুঁজে বার করতে একটু সময় লাগবে।’

‘বলেন কী? তিনি কি লটারি পেয়ে সাধু বা পাগল বা বিবাগি হয়ে বেরিয়ে পড়েছেন? লটারি পাওয়ার শক অবশ্য অনেকে ঠিক সামলাতে পারে না।’

‘সেরকম হতে পারে। আমার কাছে সঠিক তথ্য নেই। তবে সময় দিলে আমি তাকে ঠিকই খুঁজে বের করব?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সাক্ষাৎ মামাশ্বশুর বলে কথা। তার ওপর শাঁসালো মানুষ। এরকম মানুষ নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে আমাদের কাজকারবারই চলবে কীসে?’

‘ঠিক কথাই, তবে আপনার অনুরোধ আমার মনে থাকবে। আমি তাকে খুঁজে বের করবই।’

‘কত দেরি হবে বলতে পারেন?’

‘তা দু—চার বছর ধরে রাখুন।’

‘অ্যাঁ! সর্বনাশ! দু—চার বছর কী বলছেন মশাই? তাহলে সংবর্ধনার কী হবে? পাড়ার ক্লাবের ছোকরারা যে আমাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে। বলি পুলিশে খবর দিয়েছেন তো!’

‘আজ্ঞে না, পুলিশকে এখনও জানানো হয়নি অবশ্য। তবে ঘটককে বলা হয়েছে বলে শুনলাম।’

‘ঘটক! এর মধ্যে ঘটক আসছে কেন? লটারি পেয়ে আপনার মামাশ্বশুর কি আরও বিয়ে করতে চান নাকি?’

‘তা চাইতেও পারেন। আমার ঠিক জানা নেই, তবে ঘটক ছাড়া তাকে খুঁজে বার করা মুশকিল।’

‘কেন বলুন তো! ঘটকের ভূমিকাটা কী?’

‘উনিই খুঁজে আনবেন কিনা, অবশ্যি মামাশ্বশুরের আগে তার ভাগনিকেই খুঁজে পাওয়া দরকার।’

‘ভাগনি! আচ্ছা মশাই, ভাগনির কথা উঠছে কেন?’

‘যার ভাগনি নেই তার যে মামাশ্বশুর হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতাই নেই, এটা তো মানবেন!’

‘সে তো ঠিকই, কিন্তু আপনার মামাশ্বশুরের অসুবিধাটা কী?

‘সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করা যেতে পারত যদি তিনি বিধিমতো আমার মামাশ্বশুর হতেন।’

‘বাধাটা কোথায়?’

‘মামাশ্বশুর হননি বলেই বাধা, যার মামাশ্বশুর থাকে না সে যে অতি হতভাগ্য তা আজ আপনার কথা শুনেই বুঝলাম। ব্যাপারটা হল আপনার কথামতো লটারি জেতা মামাশ্বশুর খুঁজতে হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।’

‘সবই যে গুলিয়ে দিচ্ছেন মশাই।’

‘ব্যাপারটা গোলমেলে ঠিকই, কথাটা হল মামাশ্বশুর বা নিদেন তার ভাগনিটিকে যদি খুঁজে না পাওয়া যায় তাহলে সমস্যাটা জটিলই থেকে যাবে। প্রথম তার ভাগনিকে খুঁজে বার করা, পাত্রী দেখা, বিয়ের জোগাড়যন্তর করা, বিয়ে হওয়া— এই এতসব কাণ্ডের পর তবে না আপনি আমার মামাশ্বশুরের নাগাল পাবেন?’

‘তার মানে কী আপনার মামাশ্বশুরই নেই বিশুবাবু?’

‘আজ্ঞে না। মামাশ্বশুর নেই, তার ভাগনির সঙ্গে আমার বিয়েটাই যে হয়নি এখনও, আর আমি বিশুবাবুও নই।’

‘তাহলে তো মুশকিলে ফেললেন মশাই। সংবর্ধনাটা কি ভেস্তে যাবে তাহলে? সংবর্ধনার জন্য যে পাড়ার ছেলেগুলো খেপে উঠেছে।’

‘আহা, তাতে আটকাচ্ছে কেন? আপনার মতো একজন কৃতী মানুষকেও তো জনগণের সংবর্ধনা দেওয়া উচিত।’

‘তা অবশ্য খুব একটা খারাপ বলেননি, তাহলে দিন তো মশাই, শতখানেক টাকা চাঁদা দিন, নিজের সংবর্ধনাটা সেরে ফেলি।’

‘সেই ভালো, কিন্তু ওই যাঃ, অত টাকা যে সঙ্গে নেই!’

‘কত আছে?’

‘দাঁড়ান, বোধ হয় টাকা পাঁচেক হতে পারে।’

‘তাই বা মন্দ কী! কাটছাঁট করে ওতেও সংবর্ধনা দেওয়া যাবে। দিন, পাঁচ টাকাই দিন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *