সংঘর্ষ যদি হয়

সংঘর্ষ যদি হয়

কার জন্যে এসব লিখে যাচ্ছি জানি না। জানি না, আমার হাতে আর কত দিন, কত ঘণ্টা, কতটুকু সময় আছে। কে জানে কবে শেষদিন! এই শহরের অলিগলিতে, আনাচেকানাচে একটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে, পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাকে । তাকে দেখতে হুবহু আমারই মতো। তবে মিল শুধু বাইরের চেহারাতেই। ভেতরের চেহারাটা আমার ঠিক উলটো। সেই লোকটার নামও জানি আমি। শরেন। আমার নাম “নরেশ”-কে উলটে নিয়ে এই নাম রেখেছে প্রভাস। শরেনকে নিয়ে ওর অহঙ্কার কম নয়! ও বলে, শরেনের কথা জানাজানি হলে সারা পৃথিবী নাকি চমকে যাবে…।’

হাতের লেখাটা চিনে ফেলতে শোন্তার কোনও অসুবিধে হল না। বাবার লেখা। কিন্তু এইসব অদ্ভুত কথা বাবা লিখেছেন কেন? বইয়ের তাকে বাবার কয়েকটা দরকারি বইয়ের ফাঁকে গুঁজে রাখা ছিল কাগজগুলো। অবন ঠাকুরের ‘বুড়ো আংলা’ বইটা খুঁজতে গিয়ে হঠাৎই কাগজগুলো বেরিয়ে পড়েছে। কাল রাতে শোওয়ার সময়ে বইটা পড়ছিল শোন্তা। পড়তে-পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে! ব্যস, তারপর আজ সকালে ঘুম ভেঙেই দেখে বই উধাও। মা বইটাকে যথারীতি লুকিয়ে ফেলেছেন। মায়ের ধারণা, একটু-আধটু গল্পের বই পড়লে নাকি পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাবে। সবসময় খালি বলেন, ‘এই গল্পের বই পড়ে-পড়েই ক্লাস টেস্টের রেজাল্ট খারাপ হয়েছে—।’ ক্লাস টেস্টে কুড়িতে পনেরো পেলেও মা বলেন, রেজাল্ট খারাপ। তারপর কেমন একটা সুর করে বলেন, ‘দ্যাখো তো, অর্পিতা কেমন কুড়িতে আঠেরো পেয়েছে।’ অর্পিতা তিনটে সেকশান মিলিয়ে ফার্স্ট হয়। কিন্তু মা তো আর জানেন না, অর্পিতাও গল্পের বই পড়ে। ‘বুড়ো আংলা’ বইটা ওর কাছ থেকেই শোন্তা নিয়ে এসেছে।

সেই বইটা খুঁজতে গিয়েই কাগজগুলো দেখতে পেয়েছে শোন্তা। তারপর বিছানায় বসে পড়তে শুরু করেছে।

আজ বৃহস্পতিবার। ওর স্কুল ছুটি। কিন্তু বাবা অফিসে গেছেন। আর মা রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত। দেওয়ালে টাঙানো কোয়ার্টজ ঘড়ির দিকে তাকাল ও। প্রায় পৌনে বারোটা বাজে। শোন্তা জানে, রান্না শেষ করে মা স্নান করতে ঢুকবেন। তারপর স্নান করে বেরোতে-বেরোতে সাড়ে বারোটা। ততক্ষণ ও একা। ওর সঙ্গী বলতে সামনের ঝুলবারান্দার এক চিলতে মেঘলা রোদ, আর বারান্দার রেলিঙে ছড়ানো কয়েকটা জামাকাপড়। নিস্তব্ধ দুপুরে একটা কাক কোথাও ক্লান্তভাবে ডাকছে। যেন বলতে চাইছে, আমার আর কেউ নেই।

বাবাকেও ক’দিন ধরে ওর কেমন যেন ক্লান্ত মনে হয়েছে। আর কেমন যেন হয়ে গেছেন ধীরে-ধীরে। সবে ক্লাস সেভেনে উঠলে কী হবে, শোন্তা বুঝতে পারে অনেক কিছু। বর ও যে বুঝতে পারে, সেটা বাবা-মা-ই বুঝতে পারেন না সবসময়।

যেমন, গত কয়েক মাসে বাবাকে বেশ পালটে যেতে দেখেছে শোন্তা। এমনিতে বাবার মেজাজ ছিল বেশ খিটখিটে, সবসময় দুশ্চিন্তা করতেন, অফিসের কাজের চাপে কাহিল হয়ে পড়তেন, বাড়িতেও কথাবার্তা কম বলতেন, কেমন একটা রাশভারী মুখ করে বসে থাকতেন। ফলে মায়ের মনে এতটুকু শান্তি ছিল না। আর শোন্তারও ভীষণ খারাপ লাগত। মনে হত, বাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে যায়। অর্পিতার বাবা-মাকে ও স্কুলে পেরেন্টস ডে-তে দেখেছে। ওঁরা সবসময় কেমন হাসছিলেন। ওদের দেখে অর্পিতাকে হিংসে করতে ইচ্ছে হয়েছিল। অথচ বেশি নম্বর পাওয়া নিয়ে শোন্তা কখনও অর্পিতাকে হিংসে করেনি।

হঠাৎই একদিন বাবা বদলে গেলেন। কোথায় গেল সেই দুশ্চিন্তামাখা রাশভারী মানুষটা! খিটখিটে মেজাজটাও কোথায় উধাও হয়ে গেল। আর ক্লান্তি? ক্লান্তি শব্দটাই যেন কেউ মুছে দিল বাবার জীবনের ডিকশনারি থেকে। সারাটা দিন বাবা তাজা শক্তি আর স্ফূর্তিতে টগবগ করতে লাগলেন। যেন টাইম মেশিনে চাপিয়ে কেউ ঝট করে অন্তত পনেরোটা বছর কমিয়ে দিয়েছে বাবার জীবন থেকে।

তারপর থেকে তিনটে মাস কী যে আনন্দে কেটেছে!

অফিস থেকে ফিরে এসে জামাকাপড় ছেড়েই বাবা শোন্তার সঙ্গে খেলতে বসে যেতেন। প্রথম দিন শোন্তা তো ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল। ও ভুল দেখছে না তো! যে-বাবা খেলার কথা বললেই সবসময় বলেন, ‘এখন যাও তো, শুধু-শুধু বিরক্ত কোরো না—’, সেই বাবা ওকে হাসিমুখে আদর করে ডেকে নিয়ে বলছেন, ‘কীরে, খেলবি নাকি—আয়। তোর ওই মুরগি-খেলনাটা নিয়ে আয় তো—যেটা বোতাম টিপলেই কঁক-কঁক করে ডিম পাড়ে।’

অবাক ভাবটা কেটে যেতেই শোন্তা মুরগি-খেলনাটা বের করে নিয়ে সোজা বাবার কাছে গিয়ে হাজির। মা রান্নাঘরে চায়ের জোগাড় করছিলেন। শোন্তা লক্ষ করেছে, মায়ের চোখেমুখে আনন্দ, অবাক হয়ে বাবাকে দেখছেন।

সেইদিন থেকেই অবাক হওয়ার শুরু। খেলা, হই-হুল্লোড়, গাড়ি চালিয়ে বেড়াতে যাওয়া, আর দরকার মতো বই নিয়ে শোন্তাকে ক্লাসের পড়া বুঝিয়ে দেওয়া— কী না করেছেন বাবা!

দেখতে-দেখতে কেটে গেছে তিনটে মাস। কিন্তু তারপর…শোন্তার স্পষ্ট মনে আছে, একদিন ও বারান্দায় বসানো টবের ফুলগাছগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিল, বাবা হঠাৎই বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। চোখেমুখে দুশ্চিন্তা, ভয়। আকাশের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবছেন। শোন্তা ‘বাবা’ বলে ডাকতেই একটা অচেনা মানুষ ওর দিকে তাকিয়েছিল।

‘দ্যাখো, কী সুন্দর ফুল ফুটেছে এই গাছটায়!’ শোন্তা বাবার মন ভালো করার চেষ্টা করছিল।

‘ফুল…’ চিন্তার ঘোর কাটিয়ে অস্পষ্টভাবে কী যেন বললেন বাবা। তারপর কথার শেষটুকু আবার শোনা গেল, ‘যদি একটা ফুল জানত অনেকদিন সে ফুটে থাকবে…অথচ একদিন পরেই তাকে টুপ করে ঝরে পড়তে হত, তা হলে ফুলটার খুব কষ্ট হত…না রে?’

শোন্তা কী বলবে বুঝতে পারছিল না! আর ঠিক তখনই মা চায়ের কাপ নিয়ে এসেছিলেন বারান্দায়।

সেইদিন থেকে ধীরে-ধীরে পালটাতে শুরু করেছিলেন বাবা।

শোন্তা লেখাটা আবার পড়তে শুরু করল।

‘…ও বলে, শরেনের কথা জানাজানি হলে সারা পৃথিবী নাকি চমকে যাবে।

বলা যায় না, হয়তো নোবেল প্রাইজ-টাইজও জুটে যেতে পারে ওর কপালে। ‘মাস চারেক আগে প্রভাসের সঙ্গে আমার হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিল অফিসপাড়ায়, পার্ক স্ট্রিটে। অফিসের লাঞ্চের সময় বাইরে বেরিয়ে একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হাতে সিগারেট ছিল। কিন্তু সিগারেটের কথাটা আমার বোধহয় খেয়াল ছিল না। কীসব উলটো-পালটা ভাবছিলাম। মাথার ভেতরে ভীষণ টেনশান ছিল। হঠাৎ আঙুলে ছ্যাঁকা লাগতেই চমকে উঠে সিগারেটটা ফেলে দিলাম, আর তখনই কে যেন আমাকে চেনা গলায় নাম ধরে ডাকল। তাকিয়ে দেখি, প্রভাস। সেই কোনকালে আমার সঙ্গে কলেজে পড়ত। কসবায় থাকত, বেশ ডানপিটে আর বেপরোয়া ছিল। খেলাধুলো, আড্ডা, সিনেমা—কোনওটাই বাদ দিত না। কিন্তু কী করে যে ভালো রেজাল্ট করত কে জানে। সেই প্রভাস, বাইশ বছর পর, আমার সামনে।

‘চিনতে পারামাত্রই ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। কোথায় হারিয়ে গেল একটু আগের টেনশান আর ক্লান্তি। তারপর রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়েই শুরু হয়ে গেল আমাদের গল্প। কত পুরোনো কথা, কত ভুলে যাওয়া ঘটনা, কত হারিয়ে যাওয়া সুখের স্মৃতি। কিছুক্ষণের জন্যে সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম আমি। প্রভাস আমাকে ওর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে হাত ধরে রীতিমতো টানাটানি শুরু করে দিল। ও এমন যে, ওকে কখনও “না” বলা যায় না। অগত্যা অফিস থেকে ছুটি করিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ওর সঙ্গে। অফিসের পার্কিং স্পেসে আমার পুরোনো আমলের ফিয়াট গাড়িটা দাঁড় করানো ছিল। ওটা আমি নিজেই চালাই। মাঝে-মাঝে নমিতা আর শোন্তাকে নিয়ে ভিক্টোরিয়ায় বা আউটরাম ঘাটে বেড়াতে যাই। সেটা প্রভাসকে বলতেই ও ওর ড্রাইভারকে বলে দিল ওর মারুতিটা নিয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার জন্যে। আমি একটু হেসে ওকে বললাম, “আমার ছ্যাকরাগাড়ি চড়তে তোর কষ্ট হবে না তো?” উত্তরে ও যেটা বলল সেটা আর লেখা যাবে না।

‘সল্ট লেকে প্রভাসের বাড়ি দেখে যেমন তাজ্জব হয়ে গেলাম, তেমনই অবাক হয়ে গেলাম ওর ল্যাবরেটরি দেখে। বড়লোক ওরা বরাবরই, তবে প্রভাস যে-মাপের ল্যাবরেটরি করেছে তার জন্যে লক্ষ-লক্ষ টাকা দরকার। আমাকে ল্যাব দেখাতে-দেখাতে নানা কথা বলছিল প্রভাস। ও সাতটা কোম্পানির টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার। গবেষণার জন্যে সরকারি টাকাও পায়, আর সংসার করেনি গবেষণা করবে বলে। কথা বলতে-বলতে মাঝে-মাঝেই দরাজ গলায় হেসে উঠছিল ও। একটা সুখী মানুষের প্রাণখোলা হাসি। স্পষ্টই বোঝা যায়, ওর তেমন কোনও দুশ্চিন্তা নেই।

‘রাতের খাওয়াদাওয়া প্রভাসের বাড়িতেই করতে হল। তখন আমি নিজের কথা বলছিলাম। শোন্তার কথা, নমিতার কথাও বলেছি। শেষে বলেছি আমার দুশ্চিন্তা, টেনশান আর ক্লান্তির কথা। আমি জানি, অফিসে আড়ালে অনেকেই আমাকে বদমেজাজি, খিটখিটে বলে। না, কথাগুলো একেবারে মিথ্যে নয়। কিন্তু আমি তো সাধ করে ওরকম হইনি। আমার মাথার ভেতরটা সবসময় যেন কেমন করে।

‘পরে বুঝেছি, প্রভাসকে ওই কথাগুলো বলেই আমি নিজের বিপদ ডেকে এনেছি। প্রভাস সিগারেট ধরিয়েছিল। ফুরফুর করে ধোঁয়া ছেড়ে বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল, “নরেশ, তোর এই প্রবলেম আমি এক্ষুনি সল্ভ করে দিতে পারি—।

‘আমি অবাক হয়ে বলেছি, “সত্যি!”

‘তখন প্রভাস আমাকে বলতে শুরু করল।

“যখন আমাদের দুশ্চিন্তা, টেনশান, বদমেজাজ এসব হয়, তখন আমাদের শরীরের ভেতরে কারেন্ট বইতে থাকে। আসলে বায়োকারেন্ট থাকে সবসময়েই, কিন্তু সেটা এত কম যে, হিসেবের মধ্যেই আসে না। দুশ্চিন্তা, টেনশান এসব হলে ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়, হার্ট বিট বেড়ে যায়, পাল্স রেটও যায় বেড়ে। এসবের মূলে হচ্ছে অটোনোমিক নার্ভস আর অটোনোমিক অরগ্যানিক স্টেট। তো এই অবস্থায় এক অদ্ভুত ধরনের বায়োরেডিয়েশান লক্ষ করেছি আমি। সেই রেডিয়েশান আর বায়োকারেন্ট—এই দুটোকে ব্যবহার করে তোর সব প্রবলেম সল্ভ করে দেওয়া যায়।”

‘প্রভাস ফিজিক্স অনার্স নিয়ে বিএসসি পড়েছিল। পরে আরও বহু ডিগ্রি কুড়িয়ে খ্যাতি পেয়েছে। ওর কাছেই শুনেছি, গত পাঁচ-সাত বছর ধরে ওর গবেষণা বায়ো-পার্টিকল্স-এর স্ট্রাকচার, ফিল্ড আর রেডিয়েশান নিয়ে। ও আমাকে আরও কীসব বোঝাতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমি কিছুই বুঝিনি বোঝার কথাও নয়। কোনওরকমে পাস কোর্সে বিএসসি পাশ করার পর আমি কস্ট অ্যাকাউনট্যান্সি পড়েছি। এখন বলতে গেলে শুধু জমা-খরচের হিসেব নিয়েই নাড়াচাড়া করি। সুতরাং প্রভাস খুব আগ্রহ নিয়ে আমাকে অনেক কিছু বললেও তার বেশিরভাগটাই বেনা বনে মুক্তো ছড়ানো হচ্ছিল।

‘প্রভাস তখন বলছে, “শোন, তোর একটা অ্যান্টি-বায়ো-মডেল তৈরি করে দেব আমি। তার মধ্যে ঠিক বিপরীত ব্যবস্থা থাকবে। অ্যান্টি-বায়োকারেন্ট, অ্যান্টি-বায়োরেডিয়েশান—এইসব। ফলে যখনই তোর কোনও টেনশান বা দুশ্চিন্তা হবে, তখন ওই অ্যান্টি-বায়ো-মডেল তোর সমস্ত রিঅ্যাকশন শান্ত করে দেবে। এক মুহূর্তের জন্যেও তুই অশান্ত হবি না, তোর মেজাজ খারাপ হবে না কখনও। আর বালিশে মাথা ঠেকলেই গভীর ঘুম। তুই বোধহয় আর কখনও স্বপ্নও দেখবি না।”

‘প্রভাস এমনভাবে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে হাত নেড়ে সব বোঝাচ্ছিল যেন ব্যাপারটা জলের মতোই সহজ। আমি শুনতে-শুনতে একেবারে বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম। বুকের ভেতর থেকে একটা বিশাল পাথর নেমে যাচ্ছিল ক্রমশ। আর ঠিক তখনই প্রভাস বলল, “নরেশ, বুঝতেই পারছিস, এতসব সুবিধে তো একেবারে বিনি পয়সায় পাওয়া যায় না…।”

‘টাকার কথা বলতে চাইছে নাকি প্রভাস? টাকা যে আমার একেবারে নেই তা নয়, তবে যদি ও খুব বেশি কিছু চেয়ে বসে…। সুতরাং ওকে সরাসরি জিগ্যেস করলাম, “ঠিক করে বল তো, কত টাকা লাগবে?”

‘প্রভাস হেসে বলল, “দূর, টাকার কথা কে বলছে! আমি বলতে চাইছি…মানে…তুই এতসব সুবিধে পাবি ঠিকই, তবে তার জন্যে তোকে ছোট্ট একটু ঝামেলাও ঘাড়ে নিতে হবে।”

‘আমার গলাটা হঠাৎ কেমন শুকিয়ে গেল। জিগ্যেস করলাম, “কী ঝামেলা?”

“বলছি—” বলে প্রভাস হাতের সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে নতুন আর একটা ধরাল। বলল, “মানে…তোকে একটু সাবধানে থাকতে হবে। নইলে বিপদ হতে পারে।”

‘বিপদ! প্রভাস বলে কী!’

ঠিক এমনসময় মায়ের হাতের চুড়ির শব্দ শুনতে পেল শোত্তা। মায়ের স্নান শেষ। মা গুনগুন করে গান করছেন। পায়ে-পায়ে এদিকেই আসছেন বোধহয়। একলাফে বিছানা থেকে নেমে পড়ল ও। কাগজগুলো আবার আগের মতো ভাঁজ করে রেখে দিল বাবার দরকারি বইয়ের ফাঁকে। তারপর ভূগোল বইটা খুলে ধপাস করে বসে পড়ল মেঝেতে।

মা ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে-আঁচড়াতে জিগ্যেস করলেন ‘কীরে, কী পড়ছিস?’

‘ভূগোল—’শোন্তা বইয়ের পাতায় চোখ রেখেই জবাব দিল। ওর মাথায় তখন বিপদের কথা ঘুরছিল। কীসের বিপদ হতে পারে বাবার?

প্রায় তিনটে দিন ছটফট করে কেটেছে শোন্তার। ও কিছুতেই বাবার লেখা কাগজগুলো আর পড়তে পারেনি। বাবাকে কিছু বলতেও পারেনি। শুধু চুপচাপ মানুষটাকে লক্ষ করেছে।

অবশেষে সুযোগ এল রবিবার বিকেলে। বাবা বললেন, আজ বেড়াতে বেরোবেন না। গাড়িটা কোনও মিস্ত্রিভাইয়ের কাছে নিয়ে গিয়ে ভেতরটা প্লাস্টিক দিয়ে নাকি মুড়ে নেবেন। মা অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘এ আবার কী খেয়াল?’

বাবা অস্পষ্টভাবে কী একটা বলে বেরিয়ে গেলেন।

আর তার একটু পরেই সুযোগ পেল শোন্তা। স্কুলের পড়া তৈরি করতে একগাদা বইখাতা নিয়ে ছড়িয়ে বসল ও। তারপর বাবার লেখা কাগজগুলো খুলে আবার লুকিয়ে পড়তে শুরু করল। মাকে নিয়ে এখন আর ভাবনা নেই। মা টিভির সামনে সিনেমা দেখতে বসে গেছেন।

‘…বিপদ! প্রভাস বলে কী!

‘আমি সাহস দেখিয়ে বললাম, “কীসের বিপদ? খুলে বল তো শুনি—’

‘প্রভাস আমার কথার জবাব না দিয়ে জোরে হেসে উঠল। ওর বিশাল বাড়ির দেওয়ালে-দেওয়ালে সে-হাসির প্রতিধ্বনি শোনা গেল যেন। একটু পরে হাসি থামলে প্রভাস বলল, “নরেশ আমি দেড়বছর ধরে এই এক্সপেরিমেন্টটা করার জন্যে অপেক্ষা করেছি, কিন্তু সুযোগ পাইনি। এর অঙ্ক-টঙ্ক সব আমার আগেই কষা হয়ে গেছে। এখন শুধু হাতেনাতে পরখ করে দেখা বাকি। এমনই কপাল দ্যাখ, হঠাৎই আজ তোকে পেয়ে গেলাম। চল, ল্যাবে চল—।”

‘প্রভাস উঠে দাঁড়াল। আমাকে একরকম হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল ল্যাবের দিকে। আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওকে অনুসরণ করলাম। দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবনের লোভ আমাকে আচ্ছন্ন করে দিল। বারবার মনে হচ্ছিল, আমার ব্যবহারে শোন্তা কিংবা নমিতা এরপর আর কখনও ব্যথা পাবে না। তবুও প্রভাসের বিশাল ল্যাবরেটরিতে পা রাখার সময় কোনওরকমে বললাম, “একটু দাঁড়া। তুই যে কী একটা বিপদের কথা বলছিলি…।”

‘প্রভাস আমার কথায় আমল না দিয়ে বলল, “ও কিছু নয়। একটু সামলে থাকলেই হবে। আগে চল তো, কাজ শেষ করি— তারপর তোকে সব বুঝিয়ে দেব। ঘাবড়ানোর কিছু নেই, একদম সিম্পল।”

‘ল্যাবের একটা জায়গায় আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল প্রভাস। নানারকম বোতাম-টোতাম টিপে বেশ কয়েকটা রঙিন আলো জ্বেলে দিল। হঠাৎই দেখি আমাকে ঘিরে মেঝে ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে গেল চকচকে চারটে দেওয়াল। দেওয়ালের বাইরে থেকে প্রভাস চেঁচিয়ে বলল, “দেওয়ালগুলো নন্‌ম্যাগনেটিক— অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি।” তারপর ও কয়েকটা পাওয়ার সুইচ অন করে দিল। ফলে হাই পাওয়ার ম্যাগনেটিক ফিল্ড চালু হয়ে গেল, আরও কী-কী যেন হল। ক্রিকেট খেলার কমেন্ট্রির মতো চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে সব বলে যাচ্ছিল প্রভাস। ধীরেধীরে ওর গলার স্বর যেন মিলিয়ে যাচ্ছিল। তারপর একসময় আমার আর কিছু মনে নেই।

‘যখন আবার সব টের পেলাম, তখন প্রভাসের বসবার ঘরে সোফায় বসে আছি। আর প্রভাস আমার পিঠ চাপড়ে বলছে, “…সেরকমভাবেই চলবি। তোর আর কোনও চিন্তা নেই, নরেশ। এবার সত্যিই তুই নরেশ—মানে, রাজা।

এই দুনিয়ায় তুই-ই সবচেয়ে সুখী। তবে ছোট্ট একটা ব্যাপারে তুই একটু খেয়াল রাখিস…।” প্রভাসের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। একটু থেমে-থেমে ও বলল, “তুই নিশ্চয়ই এটুকু বুঝতে পারছিস যে, তোর অ্যান্টি-বায়ো-মডেলটা অ্যান্টিম্যাটার দিয়ে তৈরি। ম্যাটারে যেমন ইলেকট্রন কণা থাকে, অ্যান্টিম্যাটারে তেমনই থাকে পজিট্রন। আর সাধারণ পদার্থের প্রোটনের জায়গায় অ্যান্টিম্যাটারে থাকে অ্যান্টিপ্রোটন। সুতরাং এটা স্বাভাবিক যে, ম্যাটার আর অ্যান্টিম্যাটার পরস্পরকে স্পর্শ করলেই সর্বনাশ। সাংঘাতিক বিস্ফোরণের সঙ্গে-সঙ্গে বিকিরিত হবে অ্যানিহিলেশন রেডিয়েশান। আর তৎক্ষণাৎ ম্যাটার আর অ্যান্টিম্যাটার—দুটোরই অস্তিত্ব শেষ। মানে তোর আর তোর মডেলের সংঘর্ষ যদি হয় তা হলে তোরা দুজনেই শেষ। তুইও থাকবি না, আর শরেনও থাকবে না—।”

‘আশ্চর্য! প্রভাসের কথা শুনে আমার এতটুকু দুশ্চিন্তা হল না। বরং ওর শেষ কথাটায় অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, “শরেন মানে?”

‘ও হো-হো করে হাসল। তারপর বলল, “বুঝলি না? তোর অ্যান্টি-বায়োমডেলের আমি নাম রেখেছি শরেন—নরেশের ঠিক উলটো। শরেনকে দেখতে হুবহু তোর মতো—শুধু ওর দেহটা খানিকটা স্বচ্ছ…মানে অনেকটা ঘষা কাচের মতো। তবে ওর ভেতরটা তোর একেবারে উলটো—ম্যাটার, অ্যান্টিম্যাটার।” আবার হেসে উঠল প্রভাস। ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। ওর চোখেমুখে অহঙ্কার টগবগ করে ফুটে বেরোচ্ছে। ওর ঘরের দেওয়ালে নানা বিজ্ঞানীর ফটোগ্রাফ বাঁধানো। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পল ডিরাকের ফটোর কাছে গিয়ে দাঁড়াল প্রভাস। আবেগভরা গলায় বলল, “অ্যান্টিপার্টিকূলের ধারণা প্রথম দিয়েছিলেন পল ডিরাক ১৯৩০ সালে। তখন তাঁর কথা কেউ বিশ্বাস করেনি, কিন্তু দুবছর পরেই মার্কিন বিজ্ঞানী কার্ল ডেভিড অ্যান্ডারসন পজিট্রন আবিষ্কার করেন। তারপর ১৯৩৩-এ ডিরাক নোবেল পুরস্কার পান।” আমার দিকে ফিরে তাকাল প্রভাস : “আমার পরীক্ষার প্রথম পদক্ষেপ হল শরেন। ওর কথা সবাই যখন জানবে তখন তাজ্জব হয়ে যাবে—কী বলিস? কে বলতে পারে, হয়তো নোবেল প্রাইজও জুটে যেতে পারে আমার কপালে।”

‘হঠাৎ করেই আমার মনে হল প্রভাসের বোধহয় মাথার ঠিক নেই। ঝোঁকের মাথায় এ-কোন ফাঁদে পা দিলাম আমি! এখন কি আর ফেরার পথ আছে? কিন্তু প্রভাসের পরীক্ষায় কোনও ভুল হয়নি। ওর মুখে এরকম বিপদের কথা শুনেও কেমন শান্ত, স্থির রয়েছি আমি। সত্যিই দুশ্চিন্তা আর টেনশান একেবারে নেই। ভীষণ হালকা লাগছে। শুধু মাথাটা একটু ঝিমঝিম করছে। প্রভাসকে সেটা বলতেই ও বলেছে, ওটা হাই-ইনটেনসিটি ফিল্ডের জন্যে। একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর ওকে জিগ্যেস করলাম, “শরেন, মানে, ওই মডেলটা এখন কোথায়? সেই বুঝে আমাকে তো চলাফেরা করতে হবে।”

‘প্রভাস বলল, ‘নরেশ, সত্যি বলছি, শরেন কোথায় আছে আমি জানি না। শুধু এটুকু জানি, যে-মুহূর্তে আমার এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল হয়েছে ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে শরেনের জন্ম হয়েছে। আমার থিয়োরি বলছে, এই অ্যান্টিবায়োমডেলটা তোর ঠিক দুশো কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে থাকবে। আর তোর বায়োফিল্ডের টানে ওটা তোর কাছে আসার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। অন্য কোনও মানুষ বা অন্য কোনও জিনিসের দিকে শরেনের কোনও টান থাকবে না। এক্সপেরিমেন্টের পর ঠিক কোন কো-অর্ডিনেটে শরেন অ্যাপিয়ার করবে, এটা আমার জানা নেই। থিয়োরির ওই জায়গাটা একটু ঝাপসা রয়ে গেছে। সবই স্পেস-টাইম আর ফিল্ড-রেডিয়েশানের ব্যাপার। সে যাকগে, দুশো কিলোমিটার দূরত্ব মানে প্রায় একত্রিশ হাজার চারশো বর্গকিলোমিটার এলাকা শরেনকে খুঁজতে হবে। ফলে ও চট করে তোকে খুঁজে পাবে না। কিন্তু তোর রেডিয়েশানের সিগন্যাল ওর অ্যানটেনায় সবসময় ধরা পড়বে।”

‘শোন্তার কথা মনে পড়ল আমার। নমিতার কথা মনে পড়ল। কেমন একটা ব্যথা টের পেলাম বুকের ভেতরে। শরেন যদি শেষ পর্যন্ত আমাকে খুঁজে পায়! ওকে ঠেকানোর কি কোনও উপায় নেই? সে-কথা প্রভাসকে জিগ্যেস করতেই ও কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে চিন্তা করে তারপর বলল, “একটা জিনিস দিয়ে শরেনকে হয়তো আটকানো যায়—তবে আমি কখনও পরীক্ষা করে দেখিনি।”

“কী জিনিস?” অনেক আশা নিয়ে জানতে চাইলাম আমি।

“আয়োনাইড্ পলিমার—মানে, আয়োনাইজ্‌ড্ড প্লাস্টিকও হতে পারে। কিন্তু বললাম যে, ওতে কতটা কাজ হবে ঠিক জানি না।”

‘আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। কেমন একটা নেশার মধ্যে পাঁচ ঘণ্টা সময় কেটে গেছে আমার। কোথা থেকে কী হয়ে গেল! দুশ্চিন্তা, টেনশান, ক্লান্তি, খিটখিটে রুক্ষ স্বভাব হয়তো আমার আর থাকবে না, কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, মনের মধ্যে এক অসহায় ভয় বাসা বেঁধেছে। আর বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত কষ্ট। নমিতা যদি এসব জানত! আমার ক্লাস সেভেনে পড়া ছোট্ট মেয়েটা যদি এসব জানত! তা হলে ওরা বোধহয় আগের খিটখিটে মানুষটাকেই মেনে নিত।

‘প্রভাসের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় ও বলল, “তোর দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন সুখের হোক।”

‘আমি কোনও জবাব দিলাম না, পেছন ফিরেও তাকালাম না। গাড়ি নিযে রওনা হয়ে পড়লাম বাড়ির দিকে

‘ফেরার পথে একটা মানুষকে আমার চোখ খুঁজে বেড়াল। শরেন, তুই কোথায়?’

পড়তে-পড়তে শোন্তা থামল। বাবার লেখা ও সবটা যে বুঝতে পারছে তা নয়। বিশেষ করে বিজ্ঞানের জায়গাগুলো বেশ জট পাকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা হলেও বাবার কষ্ট বুঝতে ওর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। এখন ও বুঝতে পারছে, কেন বাবা গাড়িটাকে প্লাস্টিক দিয়ে মুড়তে চাইছেন। ওই প্লাস্টিকটা নিশ্চয়ই আয়োনাইজ্‌ড প্লাস্টিক।

এর পরের লেখাগুলো এলোমেলো, খাপছাড়া। স্কুলের পড়া ভুলে সেই লেখাগুলো পড়তে লাগল শোন্তা।

…শরেনকে আমি দেখতে পেয়েছি! গত পরশু সন্ধেবেলা রাজা দিনেন্দ্র স্ট্রিটে একটা বস্তিতে ঢোকার মুখে হঠাৎই শরেনকে দেখতে পেলাম। একটা অশথ গাছের গায়ে হেলান দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নির্বিকার হবে না কেন? ওর যে শুধু একটাই কাজ—আমাকে খুঁজে বের করা।

‘বাথরুমের কলটা সারানোর জন্যে কলের মিস্ত্রিকে খবর দিতেই ওই বস্তিটায় ঢুকেছিলাম আমি। আর প্রভাসের এক্সপেরিমেন্ট, শরেন, অ্যান্টি-বায়োমডেল—এসবের কথা ভাবছিলাম। এমন সময় ওকে দেখতে পেলাম।

‘প্রভাস ঠিকই বলেছিল, ওকে হুবহু আমারই মতো দেখতে। গায়ে কালো জামা আর কালো প্যান্ট। আধো-অন্ধকারে অন্তত তাই মনে হল। আর সবচেয়ে ভয় পাইয়ে দেয় ওর মুখ। সে-মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই। যেন পাথর কেটে তৈরি এক মরা মানুষের মুখ। বরফের মতো ঠান্ডা।

‘আমাকে দেখতে পেয়েই শরেনের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল বলে মনে হল। ও পা বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করল আমার দিকে। লাইটপোস্টের আলোয় ওর হাসিটা ব্যঙ্গের অথবা তাচ্ছিল্যের হাসি বলে চিনতে পারলাম। আর তারপরই আমি প্রাণপণে ছুটতে শুরু করলাম। ছুটতে-ছুটতেই পেছনে তাকিয়ে দেখি শরেনও এগিয়ে আসছে। কিন্তু ওর মুখের ভাবে কোনও পরিবর্তন হয়নি! এখনও পাথর আর বরফ। আমি ভাবছি…।’

‘…শরেনকে আবার দেখলাম। রবিবার, সন্ধের মুখে। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের কাছে। নমিতা আর শোন্তাকে নিয়ে কিছু কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিলাম।

হঠাৎ দেখি ছুটে যাওয়া গাড়িঘোড়ার মধ্যে দিয়েই রাস্তা পার হয়ে শরেন আমার দিকে এগিয়ে আসতে চাইছে। সামান্য যেটুকু সময় ওর দিকে তাকিয়েছি তাতেই লক্ষ করেছি, প্রভাস মিথ্যে বলেনি। শরেনের শরীর খানিকটা স্বচ্ছ। কারণ, ওর ঠিক পিছনে দাঁড়ানো একটা লোককে আমি অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি চট করে নমিতা আর শোন্তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে চাইলাম। ওরা অবাক হয়ে আমাকে অনেক কথা জিগ্যেস করছিল, কিন্তু আমি কোনও জবাব না দিয়ে সংক্ষেপে শুধু বলেছি, পরে বলব। তারপর তাড়াতাড়ি সরে পড়েছি সেখান থেকে। আমার বুকের ভেতরে হাপর টানার শব্দ হচ্ছিল।’

শোন্তার স্পষ্ট মনে পড়ল ঘটনাটা। মাত্র দু-সপ্তাহ আগে, রবিবারেই হয়েছিল এই ব্যাপারটা। কেনাকাটা শেষ না করে আচমকা চলে আসার জন্য মা কম ঝগড়া করেননি বাবার সঙ্গে। আর শোন্তাও রাগ করে পুরো একটা দিন বাবার সঙ্গে কথা বলেনি। সোমবার রাতে বিছানায় শুয়ে বাবা বড় একটা শ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘একদিন তোরা সব বুঝতে পারবি।’—আজ সেই কারণটা জানতে পেরে শোন্তার কষ্ট হল। আর রাগ হল বাবার বন্ধুর ওপর।

ও খাপছাড়া লেখাগুলো আবার পড়তে শুরু করল।

‘…প্রভাসের কাছে আমি অনেকবার ছুটে গেছি মুক্তির আশায়, কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। ও শুধু বলেছে, “একবার যদি তুই শরেনের চোখে ধুলো দিতে পারিস, তা হলে ওর পুরোনো স্মৃতি সব মুছে যাবে। ও আবার নতুন করে একতিরিশ হাজার চারশো বর্গকিলোমিটার এলাকায় তোকে খুঁজতে শুরু করবে। তবে চিন্তা করিস না। আমি অ্যান্টিম্যাটার নিয়ে নতুন একটা এক্সপেরিমেন্ট শুরু করছি। ওটা সাকসেসফুল হলে বোধহয় তোর একটা ব্যবস্থা করতে পারব—” আমার কেমন মনে হচ্ছিল, প্রভাস আমার কাছে সব সত্যি কথা খুলে বলছে না।

‘তারপর থেকে আর মিথ্যে আশা নিয়ে প্রভাসের কাছে ছুটে যাইনি। শরেনের দেখা পেলেই ওর চোখে ধুলো দিয়ে শুধু নিজের আয়ু বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন! প্রভাস বলেছিল আয়োনাইড্ প্লাস্টিকের কথা। সেটা জোগাড় করার জন্যেও চেষ্টা করিনি, কিন্তু কোনও খোঁজ পাইনি।

‘শোন্তাকে, শোন্তার মাকে, আমি এত ভালোবাসি যে, ওদের ছেড়ে যেতে আমার খুব কষ্ট হবে…।’

শোন্তাকে ছোটবেলায় বাবা প্রায়ই জিগ্যেস করতেন, ‘আমাকে তুই কতটা ভালোবাসিস রে?

উত্তরে শোন্তা ওর ছোট-ছোট দুটো হাত দুপাশে টান-টান করে বলত, ‘এই এত্তখানি।’এখন, এই মুহূর্তে ওর মনে হল, ওর হাত দুটো খুব ছোট। বাবাকে ও এত ভালোবাসে যে, ওই দুটো হাত টান-টান লম্বা করেও সেই ভালোবাসার এতটুকুও বোঝানো সম্ভব নয়। ওর হাত দুটো যদি ভগবানের হাতের মতো লম্বা হত!

‘অনেক কষ্টে আয়োনাইড্ড প্লাস্টিকের সন্ধান পেয়েছি। একজন মেকানিককে ধরেছি, সে প্লাস্টিক দিয়ে গাড়ির ভেতরটা মুড়ে দেবে। তারপর কোনও টেলারিংএর দোকান থেকে ওই প্লাস্টিকের একটা জামা-প্যান্ট তৈরি করে নেব। ‘দেখি, পারলে কালই গাড়িটা নিয়ে যাব মেকানিকের কাছে…।’

বাবার লেখা এখানেই শেষ। মানুষটার কষ্ট, মানুষটার বারবার পালটে যাওয়া—সবকিছু এখন বুঝতে পারছিল শোন্তা। কিন্তু কী করবে ও এখন? বলবে মাকে? নাকি…।

ক্রি রি রিং, ক্রি রি রিং…।

টেলিফোন বেজে উঠল ঘরের ভেতরে।

শোন্তা চমকে উঠল। তারপর তাড়াতাড়ি গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের একপাশে রাখা টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল। মা ও-ঘরে টিভি দেখছেন। নিশ্চয়ই ফোনের বাজনা শুনতে পাননি।

‘হ্যালো—

কয়েক সেকেন্ড কোনও উত্তর নেই।

তারপর ও-প্রান্ত থেকে ভাঙা-ভাঙা গলায় কেউ জিগ্যেস করল, ‘এটা নরেশ দত্তর বাড়ি?

শোন্তা চটপট জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আছেন?’ বলুন— ‘

‘নরেশবাবু বাড়ি?’

‘না, উনি একটু বেরিয়েছেন। আপনি কে কথা বলছেন?’ বাবা বাড়িতে থাকলে শোন্তা কখনও এ-প্রশ্ন করে না। সেটা নাকি অভদ্রতা।

‘তুমি কে বলছ?’ ও-প্রান্তের আড়ষ্ট গলা পালটা প্রশ্ন করল। শোন্তার খুব রাগ হল। কিন্তু সেটা সামলে নিয়ে বলল, ‘আমি ওনার মেয়ে। আপনি কে বলছেন?’

আবার পালটা প্রশ্ন : ‘তোমার বাবা কখন বাড়ি ফিরবেন?’

শোন্তা কোনওরকমে বিরক্তি চেপে বলল, ‘ঘণ্টাখানেক পরে ফিরতে পারেন।’

ও-প্রান্তের কণ্ঠস্বর যেন আপনমনেই বিড়বিড় করল, ‘তা হলে তো অনেক সময়…।’

‘উনি ফিরলে কি কিছু বলতে হবে?’ শোন্তা জিগ্যেস করল। ‘নাঃ, তার দরকার নেই, আমি দেখা করে নেব।’

‘কিন্তু আপনার নাম বললে ভালো হত। বাবা ফিরলেই খবরটা দিতাম।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কণ্ঠস্বর বলল, ‘শুধু বোলো, শরেন দত্ত ফোন করেছিল। এটা বললেই তোমার বাবা সব বুঝতে পারবেন।’ ফোনের লাইন কেটে গেল।

শোন্তার হাত কাঁপতে লাগল, পা কাঁপতে লাগল। লোকটা বলেছে, “…আমি দেখা করে নেব।”

রিসিভার রেখে ও ডুকরে কেঁদে উঠল। তারপর চিৎকার করে মাকে . ডাকতে লাগল।

মা ছুটে এলেন টিভি ছেড়ে। শোন্তা মাকে নিয়ে দৌড়ে গেল বারান্দায়। তাকাল রাস্তার মোড়ের দিকে। ওই পথ ধরেই গাড়ি নিয়ে ফিরবেন বাবা। ফিরবেন তো?

কয়েক মিনিট পরেই বিস্ফোরণের ভয়ঙ্কর শব্দটা ওরা বারান্দা থেকেই শুনতে পেল। আগুন আর কালো ধোঁয়ার মেঘও দেখা গেল। ঝুলবারান্দা কেঁপে উঠল থরথর করে।

আয়োনাইড প্লাস্টিক শরেনকে আটকাতে পারেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *