সংগীত যাঁর কাছে পরম আনন্দের
বোধহয় তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। সন্ধের পর বাড়ির বাইরে থাকা দণ্ডনীয় অপরাধ ছিল তখন। ভবানীপুরে সুবারবান স্কুল রোডে একটা ফাংশনে প্রথম ধনঞ্জয়দার গান শুনি। ‘মহল’১ ছবির একটি গানের মতো। যতদূর মনে হয় গানের লাইনটা ছিল ‘শোনো শোনো কথাটি শোনো’২ ইত্যাদি। তারপর দীর্ঘদিন ওঁর গানের শুধু ভক্তই ছিলাম না, একটু পাগলও ছিলাম। যেখানেই গান হত, ঠিক হাজির হয়ে যেতাম।
১৯৬২ সালে বায়োস্কোপে নামার পর একদিন একটা কাণ্ড ঘটেছিল। বেশ নাম হয়ে গেছে তখন আমার। ক্রিক রো-তে একটা ফাংশনে আমায় যেতে হয়েছিল। ফাংশনে কর্তারা আমাকে নিয়ে যখন প্যান্ডেলে পৌঁছোলেন, তখন ধনঞ্জয়দার গান চলছে। আমি কর্তাদের বারবার বললাম যে, এখন প্যান্ডেলে ঢুকব না। ডায়াসে যেতে হলে প্যান্ডেলের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। কর্তারা কিন্তু আমার কথায় কোনও কর্ণপাত করলেন না। আমায় প্রায় কোলে করেই প্যান্ডেলের মধ্যে নিয়ে গেলেন এবং যথারীতি পাবলিকের মধ্যে হইচই শুরু হয়ে গেল এবং ধনঞ্জয়দার অমন সুন্দর গানটায় বাধা পড়ল। হায় গ্ল্যামার বায়োস্কোপের! ধনঞ্জয়দার কাছে গিয়ে ক্ষমাও চাইলাম। ধনঞ্জয়দা হেসে শুভেচ্ছা জানালেন। এখনও বাড়িতে বসে ধনঞ্জয়দার বহু গান শুনি। প্রাণ ভরে যায় এমন কণ্ঠ ধনঞ্জয়দার। ধনঞ্জয়দা বোধহয় এমন একজন শিল্পী, যিনি নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকতে ভালোবাসেন। সংগীত ওঁর কাছে একটা পরম আনন্দের জিনিস, সেখানে ব্যাবসা খুব একটা দাপট দেখাতে পারেনি। বম্বে পাড়ি উনি দিতে রাজি হননি কোনও দিন। আমি আমার পরম শ্রদ্ধা জানালাম ধনঞ্জয়দাকে।
‘অনন্য ধনঞ্জয়’ / নিতাই মুখোপাধ্যায়; (সম্পাদিত গ্রন্থ) বইওয়ালা, পুস্তকমেলা ২০০৮
টীকা
১) ‘মহল’—১৯৪৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এক জনপ্রিয় ছবি। পরিচালক ছিলেন কমল আমরোহি। অশোককুমার-মধুবালা ছিলেন নায়ক-নায়িকা। ক্ষেমচাঁদ প্রকাশের সংগীত পরিচালনায় ছবির গানগুলি ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল।
২) ‘শোনো শোনো কথাটি শোনো…’—গানটি ‘মহল’ ছবির কোনও গানের আদলে নয়। এটি ছিল ‘সমাধি’ ছবিতে সি. রামচন্দ্রের সুরে আমীরবাঈ কর্ণাটকী ও লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘গোরে গোরে ও বাঁকে চোরে…’ গানের সুরে তৈরি। এরই অপরপিঠে যে ‘শোনো গো…’ গানটি ছিল সেটি ‘মহল’ ছবির লতার গাওয়া ‘আয়েগা আয়েগা…’ গানের সুরে প্রভাবিত। বাংলা গান দু’টির রেকর্ডটি প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। গীতিকার—সৌম্যেন মুখোপাধ্যায়, সংগীত আয়োজক—দেবু চট্টোপাধ্যায়, গায়ক—ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য।