সংকেত

সংকেত

তখনও আকাশ ভালো করিয়া পরিষ্কার হয় নাই, নানারকমের পাখি আগামী দিনের ঘোষণায় প্রাণপণে ডাকাডাকি করিতেছে, বনগ্রামের মরা নদীর কঠিন বুকেও ভয়ানক ঝড় তুলিয়া কাহাদের এক লঞ্চ তীরে আসিয়া ভিড়িল।

প্রথমে দেখিয়াছিল অন্ধ দশরথ। তাহার দুই ছেলে—এক ছেলে গিয়াছে বাহিরে আর এক ছেলে যার বয়স অল্প, হাতের বৈঠাটি এক পাশে রাখিয়া সে তখন অন্ধ পিতার জন্য এক ছিলিম তামাক ভরিতেছিল, আর দশরথও তখন তাহার হাতের জালটি গুটাইয়া গলাটি একটু ভিজাইবার আশায় পশ্চিমের প্রায়ান্ধকার আকাশের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে চাহিয়া ছেলের তামাকের প্রতীক্ষা করিতেছিল, হঠাৎ কেমন একটা গুম গুম আওয়াজ তাহার কানে বাজিতে লাগিল, কিছুক্ষণ গভীর মনোযোগে কান পাতিয়া শুনিয়া সে ডাকিল, রাম?

দশরথ-পুত্র রাম তখন তামাক ভরিতে ব্যস্ত, তাহার কিছুই ভালো লাগিতেছে , রাগিয়া বলিল, ক্যান?

দশরথ বলিল, কিছু হুনসনি?

রাম মুখ না তুলিয়াই বলিল, না।

দশরথ আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, দ্যাখ তো চাহিয়া ইস্টীমার তো না?

—তা অইলে তুমি কিছু দেখতে পাও, না বাবা?

রামচন্দ্রের বিশ্বাস, তাহার বাবা তেমন করিয়া না দেখিলেও কিছুটা নিশ্চয় দেখিতে পায়, কিন্তু দশরথ ইহা শুনিলে আর রাগ সামলাইতে পারে না। এবার হয়তো শুনিতে পায় নাই, তাই রক্ষা। কোনো উত্তর না পাইয়া আবার সে ডাকিল, রাম।

-কী। কিন্তু অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাম একবার সেদিকে তাকাইল : দশরথের কথা মিথ্যা নয়, সত্যই একটা ছোটো জাহাজের মতো চোখে পড়ে, এখন আওয়াজ আরও স্পষ্ট–

দারুণ খুশি হইয়া সে বলিল, হ, বাবা।

—দ্যাখ আমার কথা হাছা কি না। দশরথ হাসিয়া ফেলিল এবং সঙ্গে সঙ্গে গল্প জুড়িয়া দিল : সে অনেকদিন আগেকার কথা, বেলতলীর জমিদার বাড়ির বড়ো ছেলে সদ্য বিলাত হইতে ফিরিয়া সেই প্রথম যখন নিজ গ্রামে প্রবেশ করিলেন, তখন আসিবার পথে বিস্তর দুর্ভোগ ভুগিয়া এত বিরক্ত হইয়াছিলেন যে তার কিছুদিন পরেই দেখা গেল, মস্ত এক স্টিমার ভীষণ হাঁকডাকের সঙ্গে আশপাশের গ্রামের সমস্ত লোককে আনিয়া হাজির করিয়াছে নদীর পারে। স্টিমার কোম্পানি নতুন লাইন খুলিয়াছে, তখনকার নদী কী আর এখন আছে। দশরথ সেই দৃশ্য দেখিয়াছে তাহার জীবনে। আজকাল কী আর সেরকম ঘটনা ঘটে। সেসব দিনের মানুষও আজ আর নাই, তাহাদের কীর্তিও নাই। এবং পরক্ষণেই এই অদ্ভুত খবরটি শ্রীরামচন্দ্রের মুখে সারা গ্রামে রটিয়া গেল।

অনেকক্ষণ পরে লঞ্চের সিঁড়ি বাহিয়া যে লোকটি সদলবলে নামিয়া আসিল, তাহার গায়ে চমৎকার পাঞ্জাবি আর সিল্কের চাদর, পায়ে চকচকে পাম্পশু মুখে একটি সিগারেট আর মৃদু হাসি।

যাহারা ঘিরিয়া দাঁড়াইয়াছিল তাহাদের কেহ দূরে সরিয়া দাঁড়াইল, কেহ সেখানে থাকিয়াই বুকের ওপর দুই হাত রাখিয়া এমনভাবে চাহিল, তাহাদের মতো তাহারাও চলিয়া বাইবে না, মারিয়া ফেলিবে না তো আর! ইহারা নবীন। যাহারা প্রৌঢ়া অথবা বৃদ্ধ তাহারা দূরে দাঁড়াইয়া হাসিল। ইহাদের স্পর্ধা তো কম নয়। ব্যাপার যাই হোক না কেন সবটাতেই একটা বাহাদুরি দেখানো চাই। বাবু সেলাম। ইয়াসিন একটা সেলাম দিয়া বলিল, আজ জীবনের শেষ ঘন্টাগুলি ঢং ঢং করিয়া বাজিতেছে, এতকাল যে সেলামের জোরেই সে সকলের প্রিয় হইয়া আসিয়াছে আজও তাহার অন্যথা হইবে না।

বাবু সেলাম গ্রহণ করিলেন এবং মৃদু মৃদু হাসিলেন।

২.

খবরে যদিও জানা গেল লোকটি কোনো এক কাপড়ের কলের ম্যানেজার—অর্থাৎ একেবারে বড়ো কর্তা, মিলের জন্য এখানে লোক সংগ্রহ করিতে আসিয়াছে তবু তাহার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে মতভেদের অন্ত রহিল না।

শীতের সকাল। রহমানের বাড়ি পার হইয়া দূরে কাহাকে যেন দেখিয়া বলরাম পাশে সরিয়া দাঁড়াইল, লোকটা একটু কাছে আসিলে পর হাসিয়া বলিল, কাকা না গো? ইয়াসিন বলিল, হুঁ।

-কী যে অইছে, দূরের থনে তোমারে চিনতেই পারি নাই। হ্যাশে— হুনছোনি? তোমরা যতই কও, আমার কিন্তু মনডা খালি কয় এখবর মিছা।

–দুরো! তোমার তো হগলটাতেই খালি সন্দ। ইয়াসিন পরম নিঃসন্দেহে অন্যদিকে চাহিয়া রহিল—এমনভাবে চাহিল যেন ইহার পরে আর দ্বিতীয় কথা নাই। সে সকলের আগে নিজের কানে যাহা শোনে, তাহাকে মিথ্যা বলিয়া প্রমাণ করিবে, এমন হতভাগ্য এ অঞ্চলে কেহ নাই। ধীরে ধীরে সে বলিল, বাবুটি যেকোনো মিলেরই বড়বাবু, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই এবং তিনি যে লোক সংগ্রহ করিতে আসিয়াছেন, একথাও মিথ্যা নহে-বলরাম তাহার কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারে। তাহার ছোটো বেলায়ও যে এমনি আর একটি ঘটনা ঘটেছিল। সে তখন ছোটো, হঠাৎ এমনি একদিন কোথা হইতে এক বাবু আসিয়া সারাটা গাঁ তোলপাড় করিয়া তুলিল!–

ইতিমধ্যে আকবার আলি আসিয়া তাহার কথা মনোযোগ দিয়া শুনিতে ছিল। তাহার হাতে একটি আমের কচি ডাল, সেটা দাঁত দিয়া চিবাইতে চিবাইতে সে মাথা নাড়িতে লাগিল। ফিক করিয়া কিছু থুথু ফেলিয়া বলিল, লড়াইয়ের খবর রাখনি, ইয়াসিন মিঞা? হেইর লেইগা ফাঁকি দিয়া লোক লিবার আইছে, জান?

আরও দুই একজন আসিয়া জুটিয়াছিল। এমন একটি কথা শুনিয়া তাহারা সকলে বিস্ময়ে আর ভয়ে তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। কিন্তু সকলে আকবরের দিকে আকৃষ্ট হইতেছে দেখিয়া ইয়াসিন রাগিয়া উঠিল, হঠাৎ নিজের বুড়া আঙুলটি তাহার চোখের সামনে ধরিয়া বলিল, তুমি এইটা জান? আকবর আলী গম্ভীর ভাবে বলিল, তোমার কুন ডর নাই, হ্যারা বুড়া মানুষ গো নিব না।

ঝগড়া ক্রমেই বাড়িয়া চলিল। আরও বাড়িত। কিন্তু কে একজন বলিল, বাচ্চা মৌলবি।

সকলের দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট হইল, ঝগড়া কিছুক্ষণের জন্য থামিল—এই আশায় যে বাচ্চা মৌলবিই ইহার মীমাংসা করিতে পারিবে।

বাচ্চা মৌলবি বলিয়া তাহাকে সবাই ডাকে, তার একমাত্র কারণ এই যে তাহার বয়স অত্যন্ত অল্প এবং এই বয়সেই সে মৌলবি হইয়াছে। সে পাশের গ্রামেই থাকে এবং মাঝে মাঝে কোনো পত্রিকা হাতে করিয়া আসিয়া বেলা দুইটা আড়াইটা অবধি এ অঞ্চলের সকলকে যুদ্ধের খবর শুনাইয়া যায়। শহরের খবর তাহার কাছে অবিদিত নাই, মাসের মধ্যে পনেরো দিনই তো সে সেখানে কাটায়। এ কথা সবাই জানে, নবাবের সঙ্গে বসিয়া সে খানা খাইয়াছে এবং নবাব সাহেব তাহার হাতে চুমা খাইয়াছেন।

বাচ্চা মৌলবির পরণে পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি, গোঁফ এখনও ভালো করিয়া উঠে নাই, হাতে একটা ঘড়ি। কিন্তু ঘড়িটা কখন চলিতে শুরু করে, আর কখন থামে এ খবর কেউ রাখে না। ঘড়িটা একবার চোখের সামনে ধরিয়া এই শীতের সকালেও পত্রিকা দিয়া বাতাস খাইতে খাইতে মৌলবি শুদ্ধ ভাষায় বলিল, ওনারে আমি চিনি। এই বলিয়া ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে তাহার এক সুদীর্ঘ পরিচয়ের ইতিহাস বিবৃত করিয়া অবশেষে বলিল, তাইন লোক নিতে আইছে ঠিকই। রহমান তোমার ঘরে তা তো তাঁত আছে তোমারে নিবে আগে।

রহমান এতক্ষণ চুপ করিয়া শুনিতেছিল, মৌলবির কথা শুনিয় হাসিয়া ফেলিল। নতুন বিবাহ করিয়াছে সে, তেলে আর জলে চুলগুলি চমৎকার পরিপাটি চোখে সুরমা, পরনের জামা আর লুঙ্গি রঙিন।

বেলা হইয়া যাইতেছিল। মৌলবির সময় নাই, একবার সূর্যের দিকে এবং আর একবার ঘড়ির দিকে চাহিয়া সে বলিল, দশটা বাইজা গেছে, আমি যাই, কাজ আছে, আমার একটু চৌধুরী বাড়ি যাইতে অইব।

আকবর আলী তবু কিছুতেই বিশ্বাস করিবে না। কিন্তু মৌলবিকে চলিয়া যাইতে দেখিয়া তাড়াতাড়ি তাহার পাশে গিয়া ফিক করিয়া থুথু ফেলিয়া বলিল, মৌলবি।

মৌলবি পাশে তাকাইল।

আকবর আলী বলিল, আমার একটা কথা রাখবা তুমি? কও?

—আমার ভাই-এর লেইগা একটু কইয়া দিবা তুমি–

মৌলবি পরিষ্কার ভাষায় বলিল, দিব, দিব। বলিয়া তর তর করিয়া চলিয়া গেল।

শত আনন্দ হইলেও হাসিয়া কখনো আনন্দ প্রকাশ করে না ইয়াসিন। সকলের দিকে একবার তাকাইয়া সে বলিল, অহনও বিশ্বাস অয় না?

বলরাম আগে সন্দেহ প্রকাশ করিলেও ইতিমধ্যে আবার বিশ্বাস করিয়া ফেলিয়াছে। ইয়াসিনের কাছে ঘেঁসিয়া বলিল, কাকাগো, তোমার কাছেই আইছিলাম, একটা আলাপ করুম। মন্ডল-পুত্র কীসের পরামর্শ চাহিতে আসিয়াছে কে জানে। ইয়াসিন হাসিল।

৩.

বিকালের রৌদ্রে চারদিক ঝলমল করিতেছে। গাছের ছায়ার নীচে একটা চেয়ারে বসিয়া ম্যানেজারবাবু মৃদু মৃদু হাসিয়া বলিলেন, হ্যাঁ তোমাদের গাঁ-টি বেশ ভালো লেগেছে। তোমরাই দেশের গৌরব। ফেমিন হবার আগে সারা ভারতের কাপড় জোগাতে তোমরাই। এমনকি বিদেশেও ছড়িয়ে দিতে, অথচ আজ শুকিয়ে মরছো। তোমাদের কদর কজনা বোঝে? নদীর দিকে আঙুল দেখাইয়া তিনি বলিলেন, সেখানেও এমনি নদীর হাওয়া, নদীর একেবারে পার ঘেঁষেই চমৎকার ব্যারাক সেখানে, তোমরা থাকবে। হাতের কাছ হাসপাতাল, খেলার মাঠ, সিনেমা , যখন যা খুশি!–ম্যানেজারবাবু মৃদু হাসিলেন।

রহমান নাম লিখাইয়া ফেলিল। আজ রাত বারোটার সময় লঞ্চে উঠিতে হইবে।

বাড়ি ফিরিলে তাহার বুড়া বাপ কাটি ছেলের হাতে দিয়া বলিল, তাড়াতাড়ি খাওন দাওন সাইরা শুইয়া পড়, বারোটা বাজলে পর আমি ডাইকা দিমুনে, যাও শুইয়া পড় গিয়া।

রহমান পিতৃআজ্ঞা যথারীতি পালন করিল।

তাড়াতাড়ি খাইয়া দাইয়া শুইতে আর দেরি করিল না।

 কিন্তু রাত বারোটা বাজিতে আর কতোক্ষণ লাগে? বুড়া রহমানের ঘরের দরজার কাছে গিয়া ডাকিল, বাপ, সময় অইয়া গেছে, অ্যালা ওঠ।

কোনো উত্তর আসিল না, বা কেউ বাহির হইয়া আসিল না। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে অপেক্ষা করিয়া বুড়া মনে মনে হাসিল, নিজের মৃত স্ত্রীর কথা মনে পড়িল।

অথচ এদিকে বারোটা বাজিয়া যাইতেছে। বুড়া আবার ডাকিল, রহমান ওঠ ইষ্টিমার ছাইড়া দিতে আর কতোক্ষণ! এই বলিয়া নিজের ঘরের দাওয়ায় আসিয়া আবার তামাক সাজিতে বসিল। কিছুক্ষুণ এমনি কাটিবার পরও রহমানকে আসিতে না দেখিয়া হুঁকা হাতে বুড়া আবার বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখিল, দাওয়ার খুঁটি চাপিয়া ধরিয়া অন্ধকারে নিঃশব্দে রহমান বসিয়া আছে।

হুঁকাটি তাহার হাতে দিয়া বুড়া বলিল, তাড়াতাড়ি তৈয়ার অইয়া লও, বাপ, আর দেরি কইরো না।

রহমান তেমনি খুঁটি ধরিয়া বসিয়া রহিল।

এক হাতে একটি বহু পুরোনো লণ্ঠন, আর এক হাতে একটি প্রকান্ড চকচকে লাঠি লইয়া পথ দেখাইয়া চলিল বুড়া। রাস্তায় সাপ বা মানুষের ভয় থাক বা নাই থাক, এ দুটিকে ছাড়া সে কখনো পথ চলিতে পারে না। ধীরে ধীরে চলিতে চলিতে সে বলিল, হেইখান গিয়া চিঠি দিও, তা না অইলে চিন্তায় থাকুম।

রহমান আস্তে বলিল, আইচ্ছা। গোলাম আলীর বাড়ি পার হইলেই একটা মস্ত বকুল গাছের নীচ দিয়া হাঁটিতে হয়। সেখানে বকুল ফুলের গন্ধে চারিদিক ভরিয়া থাকে। সেই গাছের নীচ দিয়া চলিতে চলিতে রহমানের শরীর অবশ হইয়া আসিল, ঘুমে ভরা চোখ বুজিয়া আসিল, সে অনুভব করিল এখনও যেন সে কারও ফুলের মতো বুকে মুখ রাখিয়া গভীর নিঃশ্বাস ফেলিতেছে।

ঠক ঠক করিয়া এখানে লাঠি ফেলিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে বুড়া আবার ডাকিল, বাপ।

—কও? কিন্তু কিছুক্ষণ কান পাতিয়া থাকিয়াও রহমান আর কোনো কথাই শুনিতে পাইল না। বোধ হয় যা বলিতে হইবে সব ভুলিয়া গিয়াছে বুড়া।

একুট পরেই লঞ্চের আলো দেখা গেল। আশে পাশে অনেক লোক ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। সকলেই উচ্চস্বরে গল্প করিতেছে। কেহ সিঁড়ি বাহিয়া লঞ্চে উঠিবার চেষ্টা করিতেছে। সব মিলিয়া একটা মস্ত হল্লা।

একটু নির্জনতায় ছেলেকে টানিয়া বুড়া আবার বলিল, বাপ?

-কও?

একটা কথা কমু। এত বুড়া হইয়া গেলাম, তুমি আমারে ছাইড়া কোনো কালে কোনো খানে যাও নাই, কিন্তু আইজ ছাইড়া গেলা, আমার মনটারে কী দিয়া বান্ধুম, তুমিই কও? বুড়া অনেক কষ্টে তাহার সবগুলি কথা এতক্ষণে বলিয়া ফেলিল এবং ঝর ঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। এমন দৃশ্যের সঙ্গে রহমানের এই প্রথম পরিচয়, সে কী যে করিবে ভাবিয়া পাইল না।

নদীর উপরের ঠাণ্ডা বাতাসে লণ্ঠনের ক্ষীণ আলো কাঁপিতেছে। চারিদিকে জলের গন্ধ। আকাশে অজস্র তারা। পাশেই আগামী কোনো সুখের সৌরভে বিহ্বল লোকজনের হল্লা। বুড়ার শীর্ণ হাতের লাঠিখানাও ঠকঠক করিয়া কাঁপিতেছে।

অনেকক্ষণ পরে রহমান উপরে উঠিয়া দেখিল, সেই বাচ্চা মৌলবি সারা লঞ্চময় চরকিবাজীর মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। লোকটা এমনি পাতলা ছোটোখাটো মানুষ যেন হাওয়ার সঙ্গে উড়িয়া চলে, এক মিনিটে হাজার মাইল অতিক্রম করে।

রহমানকে দেখিয়া সে ঘড়ি দেখিয়া এদিক সেদিক তাহার চঞ্চল দৃষ্টি বুলাইয়া তর তর করিয়া বলিল, এতক্ষণে আইছ! টাইম আইয়া গেছে।

মৌলবি টাইম ধরিয়া চলে। আবার ঘড়ি দেখিয়া সে সামনের দিকে অগ্রসর হইল।

রেলিং ধরিয়া রহমান একা দাঁড়াইয়া রহিল।

কয়েক হাত নীচেই তাহাদের গ্রামের নদী, আজ ছাড়িয়া যাইতেছে বলিয়া অত্যন্ত আপনার বলিয়া মনে হয়। নদীর জলে লঞ্চের আলো পড়িয়া চিকমিক করিতেছে, লঞ্চের ভিতরের মানুষগুলির আবক্ষ ছায়াও সেখানে দেখা যায়, অন্ধকারের বুকে কেবল আরও কতকগুলি গভীর অন্ধকারের মতো মনে হয়। আর তাহাদের আত্মীয়-স্বজনরা—তাহারাও লণ্ঠন হাতে বিদায়ের প্রার্থনায় কাতর।

রহমানের চোখের পাতা বুজিয়া আসিল, সে দেখিল, নদীর জলে কে এক নারীমূর্তি, নাকের চোখের জলে এক হইয়া তাহাকে ডাকিতেছে। তাহার নাকের ডগায় ঘাম, ঘর্মাক্ত সমস্ত শরীরটিকে রহমান ঝুঁকিয়া দেখিল। তাহার গায়ে এখনও সেই মেয়েটির ঘামের গন্ধ। আরও নিবিড় হইয়া সে সেই গন্ধ শুকিতে লাগিল।

ঘুমে তাহার চোখ জড়াইয়া আসিল।

কোনোরকমে একটা জায়গা করিয়া ছটো পুটুলিখানা মাথার নীচে রাখিয়া সে শুইয়া পড়িল। একটু পরেই সে স্বপ্ন দেখিল। আকাশে ঝড়ের পূর্বাভাষ, এখন ভয়ানক বাতাস ছাড়িয়াছে দীর্ঘ সুপারি আর নারিকেল গাছের মাথায় ভীষণ মাতামাতিতে নদীর জলে দুরন্ত ঢেউ, বড়ো বড়ো ধান গাছের শিষগুলি যন্ত্রণায় কাঁপিতেছে, আকাশে পাখির কলরব, রহমান যেন শুনিতে পাইল, তাহাদের গোয়াল ঘরের গোরুগুলি মা মা করিয়া কাতরস্বরে ডাকিতেছে। মনে হয় এমন করিয়া যেন তাহারা আর কোনোদিনও ডাকে নাই। তাড়াতাড়ি দৌড়াইয়া গিয়া সে দেখিল, তাহার গোরু নয় তো, তাহার বউ, আর গোয়াল ঘরটা আসলে গোয়াল ঘর নয় তো, তাহার শোবার ঘর। বউ তাহাকে দেখিয়া কাঁদিয়া ফেলিল, গলা জড়াইয়া ধরিল, বুকের মাঝখানে তাহার হাতকে রাখিয়া বলিল, এই দ্যাখো, এহান কেমুন ব্যথা। তোমারে ছাইড়া আমি থাকতে পারুম না বন্ধু মইরা যামু। একটু পরে রহমান টের পাইল, তাহার দুইটি পা আরও দুইটি পায়ের সঙ্গে সুতার মতো হইয়া গিয়াছে।

–রহমান? ও রহমান?

রহমান ধড়মড় করিয়া জাগিয়া উঠিল, ভালো করিয়া চাহিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, কে? আজু?

মৌলবি তাহার বউয়ের নাম জানিত হাসিয়া বলিল, না আমি তোমার বউ না, আমি মৌলবি।

রহমান চোখ রগড়াইতে রগড়াইতে বলিল, ও!

কিন্তু মৌলবি কাজের লোক, তাড়াতাড়ি ঘড়ি দেখিয়া বলিল,

–ভোর অইয়া আইছে, আর কত ঘুমাইবা?

রহমান বাহিরের দিকে চাহিয়া দেখিল, সেখানে অনেক অন্ধকারের সারি এখনও ঠেলাঠেলি করিয়া মরিতেছে।

ম্যানেজারবাবুর কামরায় আলো দেখা যায়।

মৌলবি গল্প করিতে লাগিল, তাহার অভিজ্ঞতার ইতিহাস বলিয়া যাইতে লাগিল, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, রহমান কেবল হাঁ করিয়া শুনিল।

মৌলবি অনেক গল্প করিল।

কিন্তু ভোর আর হয় না, তাহারা উঠিয়া এবার ওধার অনেক ঘুরিল। দুই একজনকে জাগাইয়া গল্প করিল ঘণ্টা দুই চলিয়া গেল। তবু ভোর আর হয় না, বাহিরে তেমনি অন্ধকার, গভীর রাত্রির নিস্তব্ধতা কেবল জলের শব্দ।

মৌলবির ঘড়ির কাঁটা কখন চলিতে শুরু করে, আর কখন গিয়া থামে, সে তথা রহমান আজও জানিতে পারিল না, কেবল হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল।

আবার সে একা একা কিছুক্ষণ ঘুরিয়া বেড়াইল, লঞ্চের এটা-ওটা উঁকি ঝুঁকি মারিয়া কতক্ষণ দেখিল, শেষে হাত পা গুটাইয়া বউ-র কথা ভাবিতে লাগিল।

অনেকক্ষণ পরে ভোর হইল। এখন মস্তবড়ো নদী, ওপারের সীমানা কুয়াশায় ভরা, সূর্যের আলোয় জলের উপর কেহ কতকগুলি চকচকে নতুন টাকা ছড়াইয়া রাখিয়াছে মনে হয়। নদীর দুইপাশে মাঝে-মাঝে ইটের খোলা, পাটের গুদাম।

দূরে মিলের চিমনি দেখা গেল। কিন্তু ধোঁয়ার চিহ্ন নাই। কোথা হইতে আসিয়া আবার মৌলবি দেখা দিল। কোনো নতুন খবর সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছে নিশ্চয়। বলিল, আমরা আইসা পড়ছি।

৪.

সকলের মধ্যে একটা সাড়া পড়িয়া গেল। তাহারা তাহাদের কর্মস্থলে আসিয়া পড়িয়াছে। সকলে সামনের দিকে ছুটিয়া আসিল। ওই যে কী একটা গম্বুজের মতে, এটাই কী তাদের মিল? মৌলবি তাদের বুঝাইয়া দিতে লাগিল। সে সবই জানে। সকলে বিস্ময়ে আর আনন্দে এমন একটা জিনিসের প্রতি চাহিয়া রহিল।

পৌঁছিতে বেশি দেরি হইল না। ধীরে ধীরে লঞ্চের গতি মন্থর হইয়া আসিল, এখন পাড়ে ভিড়িবে। ম্যানেজারবাবু আসিয়া দেখা দিলেন। কেমন একটা সফলতার আনন্দে তাঁহার সারামুখ উজ্জ্বল। সকলে তাঁহাকে পথ ছাড়িয়া দিল। দুই হাত ছাড়িলে যদি চলে সেখানে পাঁচ হাত সরিয়া দাঁড়াইল।

কিন্তু তখনও লঞ্চটা পারে একেবারে ভিড়ে নাই, ধীরে ধীরে যেন একটা ভীষণ কলরব, সহস্র কণ্ঠের মিলিত চীৎকার ধ্বনি সকলের কানে আসিয়া বাজিল। সকলে উৎকর্ষ হইয়া উঠিল, মিল দেখার আনন্দে একেবারে ভাঙিয়া না পড়িয়া রহমান আগেই কিছুটা লক্ষ করিয়াছিল, এখন সকলের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হইয়া শব্দটা আরও লক্ষ করিতে চেষ্টা করিল। মৌলবির মুখে বিস্ময়ের চিহ্নমাত্র নাই, সে নিতান্তই নির্বিকারভাবে ম্যানেজারবাবুর পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, ব্যাপারটা সকলের আগে বুঝিবার আশায় তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিয়াছে। কিন্তু ম্যানেজারবাবুর মুখ হঠাৎ ম্লান হইয়া গিয়াছে, মুখের সেই মৃদুমন্দ হাসি আর নাই। লঞ্চ চালকদের কী একটা নির্দেশ দিতে তিনি তাড়াতাড়ি ভিতরে চলিয়া গেলেন।

কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই যা দেখা গেল, তা অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার সন্দেহ নাই। নদীর পারেই প্রকান্ড চর, ধু-ধু করে বালু। তার পরে মিলের সীমানা। সেই ভীষণ গোলমাল আরও ভীষণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকান্ড চরটা মুহূর্তে হাজার হাজার লোকে ভরিয়া গেল; সেই লোক-গুলি প্রাণপণে দৌড়িয়া আসিতেছে, প্রাণ যায় কী বাঁচে। ব্যাপার দেখিয়া রহমানের চোখে বিস্ময়ের অন্ত নাই—যেন একটা প্রকান্ড নদীর মুখ হঠাৎ খুলিয়া গিয়াছে, তাহার সমস্ত জল বিপুল বেগে সারাটা পৃথিবী ভাসাইয়া লইল। রহমানের বুক কাঁপিতে লাগিল, নিঃশ্বাস দ্রুত হইয়া আসিয়াছে।

লোকগুলির কতক হুড়মুড় করিয়া জলে নামিয়া পড়িল, লঞ্চটাকে একেবারে ঘিরিয়া ফেলিল। আর বেশিরভাগই দাঁড়াইয়া রহিল পাড়ে কিন্তু সকলের মধ্যেই একটা ভয়ানক চঞ্চলতা,কেহ হাত নাড়িয়া কিছু বলিতেছে, কেহ কেবলই চীৎকার করিতেছে, সকলের মুখে চোখে কার্যকলাপে এমন একটা ভাব যেন এখনই পারিলে লঞ্চটাকে ডুবাইয়া দেয়। আর কী গোলমাল! আকাশকেও ফাটাইয়া চৌচির করিয়া দিবে মনে হয়। অমন দৃপ্ত রাগান্বিত পদক্ষেপে তাহাদের পায়ের নীচের ভূমিখন্ড মুহূর্তে ধসিয়া বাইবে যেন, তাহাদের চীৎকার ধ্বনিতে নদীর জলও উত্তাল হইয়া উঠিল।

কিন্তু রহমান লক্ষ করিয়া দেখিল, একেবারে সামনে একটা লোকের মধ্যে পেছনের সকলের শক্তি যেন একত্রিত হইয়াছে। লোকটার বয়স অল্প, চেহারায় এই হাজার হাজার লোকের মধ্যে একটা পার্থক্য ধরা পড়ে। সে হাত নাড়িয়া ভয়ানক চীৎকার করিয়া কী যেন বলিতেছিল, প্রথম কিছুক্ষণ কিছুই শোনা যায় নাই, কিন্তু শেষে গোলমাল আপনিই কমিয়া আসিল। রহমান আশ্চর্য হইয়া শুনিল, লোকটা দৃপ্তস্বরে বলিতেছেঃ বন্ধুগণ, আমাদের দেখে আশ্চর্য হবেন না। আমরা এই মিলেরই শ্রমিক, আপনারা যেখানে কাজ করতে এসেছেন আমরা সেখানেই প্রথম কাজ করতে আসি। আমরা জানি আপনাদের শুধু চাকরির কথা বলেই আনা হয়েছে, আসল কথা বলা হয়নি। এই চাকরির ভেতর কী রহস্য তা আপনাদের কাছে গোপন করা হয়েছে। বন্ধুগণ, আমাদের কথা আপনারা একটিবার শুনুন, আমাদের বিশ্বাস করুন। যারা আপনাদের চাকরি দেবে বলে নিয়ে এসেছে তাদের আপনারা চেনেন না, কিন্তু আমরা চিনি। আমরা তাদের কাছে শুধু আমাদের অভাব অভিযোগের কথা জানাতে গিয়েছিলাম, আমাদের সামান্য কয়েকটা মাত্র দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম কিন্তু তারা গ্রাহ্যই করেনি। তারা আমাদের মুখের ওপর লাথি মেরেছে! কিন্তু আমরা কেন তা সহ্য করব? আমরা স্ট্রাইক করেছি, মিলের কাজ বন্ধ। আমরা তার প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমাদের এই শক্তিকে পিযে ফেলবার জন্যে, আমাদের মুখের ভাত কেড়ে নেওয়ার জন্যে তারা মিথ্যে কথা বলে আপনাদের এখানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আপনারা তাদের বিশ্বাস করবেন না। ভাই সব। আপনাদের চোখে পৃথিবী যেমন, আমাদের কাছেও তাই, আপনাদের যতখানি শোষণ দুঃখ দুর্দশার কষ্ট সহ্য করে চলতে হয়, আমাদেরও তাই। আমাদের ঘর নেই, বাড়ি নেই। আজ এখান থেকে তাড়িয়ে দিলে কাল কোথাও দাঁড়াবার জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই—আমার চাষি ভাইরা, দোহাই আপনাদের, ভাই হয়ে ভাই-এর মুখের ভাত এমন করে কেড়ে নেবেন না। একথা মনে রাখবেন, আজ যারা আমাদের লাথি মেরে তাড়িয়ে দিচ্ছে, কাল তারা আপনাদেরও সেই লাথি থেকে রেহাই দেবে না। বন্ধুগণ আমরা আপনাদের ভাই, ভাই-এর কথা একটিবার মন দিয়ে শুনুন, ভাই-এর কথা বিশ্বাস করুন—আপনারা এ কাজে যোগ দেবেন না, দোহাই আপনাদের, যে লোক আজ আপনাদের ভাই-এর ভাত কেড়ে নিচ্ছে, তার উল্লাসকে আর বাড়াবেন না।

রমহান স্তব্ধ হইয়া গেল, তাহার মনের ভিতর সব গোলমাল হইয়া গেল, সে আর কিছুই ভাবিতে পারে না।

ম্যানেজারবাবুর মুখে সেই হাসি আর নাই। রাগে অগ্নিমূর্তি হইয়া তিনি বলিলেন, সিঁড়ি ফ্যালো, সিঁড়ি ফ্যালো।

মৌলবি হাসিমুখে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল, হাসিয়া হাসিয়া সকলকে বুঝাইল, ও কিছু নয়, একটা চাকরি খালি হইলে পঞ্চাশটা লোক আসিয়া যেমন দাঁড়ায়, ইহারাও তেমনি, পঞ্চাশটা চাকরি খালি হইয়াছে তো পঞ্চাশ হাজার লোক আসিয়া হাজির হইয়াছে। জোর করিয়াই হইবে আর কী। যেন মগের মুল্লুক। যেন মামার বাড়ির আব্দার। —প্রিয়নাথ, শ্রীপতি, বাদশা মিঞা, চাঁদ-মিঞা এবং আরও অনেকে মৌলবির কথায় সায় দিল, চরের উপর বিপুল জনতার দিকে আঙুল দেখাইয়া বোকার মতো তাহারা হাসিতে লাগিল।

ওদিকে সিঁড়ি পড়িয়াছে। একজন দুইজন করিয়া সকলে নামিতেছে সকলের শেষে নামিল রহমান। নামিয়াই সে আশে পাশে চাহিয়া দেখিল, তাহাদের গ্রামের কেহ তাহার পাশে নাই, সকলে জনতার সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে। সে একা একা ঘুরিতে লাগিল, একবার গেল উপরের দিকে। এখন জনতা আর সেই রকম জমাট বাঁধিয়া নাই, ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়াছে।

একজন তাহার জামা ধরিয়া টানিল-বলিল,–শুনুন?

রহমান দেখিল তাহাকে যে জামা ধরিয়া টানিতেছে সে নিতান্ত অল্প বয়সের একটি ছেলে। বয়েস ষোল সতেরোর বেশি হইবে না।

মুখের রঙ বেশ ফর্সা কিন্তু রোদে লাল ঘর্মাক্ত—মাথায় বড়ো বড়ো চুল, অবিন্যস্ত, সার্টের বুকের বোম খোলা, ফর্সা বুক আর গলা বেশ চোখে পড়ে। ছেলেটি চমৎকার মিষ্টি গলায় বলিল, আপনাদের বাড়ি কোথায় ভাই?

রহমান বিস্ময়ে স্তব্ধ হইয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। ছেলেটি আবার বলিল, বলুন না, আপনার বাড়ি কোথায়? রহমান এবার বলিল, বনগাঁ।

—বনগাঁ। বাঃ চমৎকার নামটি তো। আচ্ছা, সেটা এখান থেকে কতদূর হবে? রহমান হিসাব করিয়া বলিল কতদূর হইবে।

ছেলেটি বলিল, এখানে এই এলেন, না? এখানে কেন এসেছেন? এমনি, বেড়াতে না?

তাহার এই অনুসন্ধিৎসায় রহমান প্রথমে একটু বিরক্তি বোধ করিল, কিন্তু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আর মিষ্টি কথা শুনিয়া তাহা ভুলিয়া গেল। বলিল, এহান কাজ করতে আইছি।

–ও। ছেলেটি চারিদিকে চাহিয়া একটু পরে বলিল,-কিন্তু কাজ যারা এখন করছে তাদের উপায় হবে কী। ব্যাপার কী হয়েছে জানেন? এদের কোনো দোষ নেই তবু এদের তাড়িয়ে দিয়ে আপনাদের সে জায়গায় বসানো হবে। যার আর কোনো উপায় নেই এমন একজনের ভাত মারতে আপনার ইচ্ছে হয়।

রহমান কিছু বলিল না।

-বলুন না ইচ্ছে হয় কি না?

রহমান তবু কিছু বলিল না। ছেলেটি বলিল, মনে করবেন না, আপনিও চিরকালই ওদের সুনজরে থাকতে পারবেন, আপনাকেও এমনি একদিন তাড়িয়ে দেবে।–এই বলিয়া একটু হাসিয়া ছেলেটি চলিয়া গেল।

রহমানের ইচ্ছা হইল তাহাকে একটি বিড়ি খাওয়াইয়া দেয়, কিন্তু ছেলেটি তখন চলিয়া গিয়াছে।

রৌদ্রের তেজ ক্রমেই বাড়িতেছে। বালুর চর চিক চিক করে। নদীর হাওয়া রৌদ্রের মতোই তীব্র।

রহমান এদিক সেদিক ঘুরিয়া একবার উপরের দিকে গেল, দেখিল গেটের কাছে কয়েকটি লোক হাত ধরাধরি করিয়া দাঁড়াইয়া আছে অর্থাৎ কাহাকেও যাইতে দিবে না, এই মতলব। একটু দূরে তাহাদের গ্রামের কয়েকজন হাত গুটাইয়া জটলা করিতেছে। রহমান তাহাদের সঙ্গে জুটিল। সেই জটলায় বাদশা মিঞাই প্রধান বক্তা। তাহাকে দেখিয়া সে এক পলক হাসিয়া বলিল, রহমানরে হ্যারা তো যাইতেই দিব না, মনডা কয়।।

রহমান হাসিল, একটু পরে কী মনে করিয়া হঠাৎ বলিল, আইচ্ছা, বাদশা মিঞা—

-কও?

—হ্যাঁরা জোর কইরা গেলে কী করতো?

বাদশা মিঞা সমস্যায় পড়িল। সে এমন ব্যাপারের কথা আরও শুনিয়াছে বটে কিন্তু ইহার পরের ঘটনা আর জানে না। আমতা আমতা করিয়া বলিল, কী করতো আবার। ধইরা, মাইর দিত!

বাদশা মিঞা অকূলে কূল পাইয়া মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিল, হ, মাইর দিত। ঠিক, ঠিক, ঠিক।

সুতরাং স্থির হইল, ওখানে জোর করিয়া ঢুকিলে উহারা খুব কষিয়া মার দিবে।

কিছু পরে মৌলবি আসিয়া বলিল, সামনের আর একটা গেটে তাহাদের যাইতে হইবে। সেখানে সকলেই আছে, শুধু তাহারাই কেন এখানে দাঁড়াইয়া আছে?

সকলে তাড়াতাড়ি মৌলবিকে অনুসরণ করিল।

সেই গেটের কাছে গিয়া দেখিল সেখানেও কয়েকটি লোক তেমনি হাত ধরাধরি করিয়া দাঁড়াইয়া আছে।

বাদশা মিঞার মেজাজটা খারাপ হইয়া গেল।

—যেখানেই যাই সেখানেই ইহারা জোঁকের মতো লাগিয়া থাকে কেন? মৌলবি তুড়ি মারিয়া বলিল, ভাই তোমরা হগলে আস।

এই বিপদের সময় ভাগ্যিস মৌলবির মতো মানুষ সঙ্গে ছিল। তা না হইলে কী উপায় হইত কে জানে। সকলে দল বাঁধিয়া সামনের দিকে গেল কিন্তু ততোক্ষণে সেই লোকগুলি সারা গেট জুড়িয়া শুইয়া পড়িয়াছে।

এ আবার কোন কায়দা? বাদশা মিঞা আশ্চর্য হইল। মার দিবে না তো! ব্যাপার দেখিয়া রহমান দূরে সরিয়া আসিল, তাহার সঙ্গে আরও কয়েকজন। আসিল। মৌলবি আর শেষ পর্যন্ত যাইতে পারিল না।

এইভাবে আরও অনেকক্ষণ কাটিয়া গেল। সূর্য এখন মাথার উপর উঠিয়াছে। চারিদিকে তেমনি গোলমাল। এই সমস্যার কখন যে শেষ হইবে, রহমান ভাবিয়া কুল পায় না।

এদিক-ওদিক দৌড়াইয়া, এ গেট—ও গেট করিয়া তাহার ক্ষুধা পাইয়া গিয়াছিল। একটা ছোটো পুটলিতে বউ কিছু মুড়ি চিড়া আর গুড় বাঁধিয়া দিয়াছিল। রহমান আর একজনকে লইয়া একটু নির্জনে গিয়া পুটলি খুলিয়া বসিল। খাওয়া শেষ হইলে নদীতে গিয়া হাত ধুইয়া আসিল। এখন একটা বিড়ি না খাইলে চলে না। কিছু দূরে একটা দোকানে গিয়া এক পয়সার বিড়ি সে কিনিল। কিন্তু একটা মুখে দিতেই আর একজন সামনে আসিয়া দাঁড়ায়। এক মুহূর্তে এক পয়সার বিড়ি শেষ হইয়া গেল। রহমান নূতন বিবাহ করিয়াছে, সে এমনি দিয়া থুইয়া খাইবে না তো কে খাইবে!

হাজার হাজার লোকের এমন বিপুল সমাবেশ, মুহূর্তের পর মুহূর্ত এমন বিস্ময়কর ঘটনাবলির সঙ্গে সাক্ষাৎ, একটা গাছের নীচে দাঁড়াইয়া বিড়ি খাইতে খাইতে রহমান যতই ভাবিতে লাগিল ততই আশ্চর্য হইতে লাগিল।

ক্রমে বিকাল হইতে লাগিল। রৌদ্রে, অনাহারে, দৌড়াদৌড়িতে, চিন্তায় প্রত্যেককেই যেন এখন এক একটি ভূতের মতো দেখিতে। এমন সময় আবার মৌলবির ডাক আসিল। সে তাড়াতাড়ি আসিয়া জানাইয়া গেল যে তাহাদের এখন ঢুকিতে হইবে। আর দেরি করিলে চলিবে না, অনেক সময় পার হইয়া গিয়াছে।

সকলে দৌড়াইয়া গিয়া আর একটা গেটের কাছে গিয়া জড়ো হইল। গোলমাল আরও বাড়িয়া গেল। আকাশ বিদীর্ণ করিয়া নানারকম ধ্বনি উঠিল। কান ফাটাইয়া ফেলিবে আর কী। রহমান সকলের পিছনে ছিল, একেবারে সামনের দৃশ্য দেখিতে পায় না। পরে টের পাইল। তাহার সামনের লোকগুলি অনেকখানি অগ্রসর হইয়া গিয়াছে। সে এখন একা পাশে চাহিয়া দেখিল, আরে সেই ছেলেটি, কী একটা উত্তেজনার লাল তাহার মুখ, চুলগুলি এলোমেলো, প্রাণপণে সে চীৎকার করিতেছে। রহমান বুঝিতে পারিল না সেই ভাষার অর্থ। সামনের দিকে চাহিয়া দেখিল, আশ্চর্য, এবার গেট জুড়িয়া শুইয়া কয়েকটি লোক। আর তাহাদের পা দিয়া মাড়াইয়া ভিতরে চলিয়া গেল মৌলবী,আর তাহার পেছনে আরও কয়েকজন। রহমান নিজের চোখকে বিশ্বাস করিতে পারল না, লোকগুলির দিকে কিছুক্ষণ। একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল সে।

এমন হল্লা সে জীবনেও শোনে নাই। কান ফাটিয়া গেলেও কান পাতিয়া শুনিতে লাগিল। দেখিল, এখান হইতে সেখানে লোক ছুটাছুটি করিতেছে, কেহ ঘুসি দেখাইতেছে, কেহ দৌড়াইতেছে, হঠাৎ একটা লোক উঁচু ঢিপির উপর দাঁড়াইয়া বক্তৃতা দিতে শুরু করিল। রহমান আশ্চর্য হইয়া দেখিল, সে লোকটি আর কেহ নয়, তাহাদের লঞ্চ পারে ভিড়িবার সময় যে লোকটি প্রথম জলের কাছে দাঁড়াইয়া বক্তৃতা দিয়াছিল সে-ই। তাহার তখনকার কথাগুলি রহমান এখনও ভুলে নাই। তাড়াতাড়ি সে আরও কাছে গিয়া দাঁড়াইল তাহার সঙ্গে বিক্ষিপ্ত জনতা আরও ঘন হইয়া আসিল। লোকটি দৃঢ়কণ্ঠে বলিতে লাগিল :

বন্ধুগণ, আমার চাষিভাইরা…।

সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে। এখন প্রায় সারাটা আকাশ লাল। নীচে ধ্বংসের উৎসব দেখিয়া রক্তবর্ণ আকাশ যেন রক্তনেত্রে তাহার প্রতি চাহিয়া বিস্তর অশুভ কামনা করিতেছে। মানুষের পায়ের চাপে মাটির পৃথিবী বিদীর্ণ হইতে আর বাকি নাই। এখানকার এই কলরবের আগুনের মতো যদি কোনো শিখা থাকিত তবে সারাটা পৃথিবী নিশ্চয় পুড়াইয়া ফেলিত। বক্তা মাটিতে লাথি মারিয়া, বলিষ্ঠ ডানহাতে শূন্যে ঘুষি দেখাইয়া দৃপ্ত-স্বরে বলিল, বন্ধুগণ, আমার চাষি ভাইরা…।

কিন্তু এমন সময় হঠাৎ গুলির ভীষণ আওয়াজ, আশে পাশের সব লোক পাগলের মতো ছুটোছুটি করিতেছে, কারোর কোনো দিকে কোনো খেয়াল নাই, কে ধাক্কা খাইয়া পড়িয়া গেল, কে পায়ের তলায় পিষিয়া গেল, কারোর কোনো দিকে লক্ষ নাই, সকলেই যার যার প্রাণ হাতের মুঠায় লইয়া দৌড়াইতেছে। এক মুহূর্তে সারাটি মাঠ সশস্ত্র সৈন্যে ভরিয়া গেল।

রহমান প্রথমে লক্ষ করে নাই, যখন খেয়াল হইল তখন তাহার মাথা ঘুরিতেছে, হাত-পা কাঁপিতেছে, কানের ভিতর ভীষণ ঝাঁঝাঁ করিতে লাগিল, সে কোনো রকমে দৌড় দিল, দৌড়াইতে দৌড়াইতে শুনিতে পাইল—পেছনে কত লোকের তীব্র আর্তনাদ, কত লোকের কাতর গোঙানি। মুখ ফিরাইলে দেখিতে পাইত, কেহ রক্তাক্ত দেহে মাটিতে গড়াগড়ি দিতেছে, কেহ পড়িতে পড়িতে হাঁটিতেছে; আবার হঠাৎ বসিয়া পড়িল। শীতের দিনের গৈরিক ধুলি রক্তবর্ণ হইয়া গেল।

অনেকদূর গিয়া আর দৌড়াইতে পারিয়া রহমান তবে থামল, একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে সে বসিয়া পড়িল। হাত-পা তাহার এখনও ঠকঠক করিয়া কাঁপিতেছে, বুকের ভিতর কালবৈশাখীর ঝড়। পেছনে যাদের ফেলিয়া আসিয়াছে, রহমান সেদিকে আবার চাহিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু পারিল না চক্ষু তাহার বুজিয়া আসিল। সেখানকার কথা স্মরণ করিয়া চোখে তাহার জল ভরিয়া আসিল। রহমান নির্জীবের মতো পড়িয়া রহিল।

যখন উঠিল তখন অনেক রাত। কোথাও টুঁ শব্দটি নাই। রহমান ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল, শরীরের সবগুলি গ্রন্থি তাহার বেদনায় টনটন করিতেছে। তবু কোনো রকমে সে হাঁটিতে হাঁটিতে অনেক পরে নদীর পারে আসিয়া দাঁড়াইল, চমৎকার ঠাণ্ডা বাতাস বহিতেছে এখানে, নদীতে নৌকা আর জাহাজের শব্দও শোনা যায়। রহমানের মনে পড়িল সেই লোকটির কথা : বন্ধুগণ, একথা আপনারা মনে রাখবেন, আজ আমাদের যারা শুধু লাথি মেরে তাড়িয়ে দিচ্ছে, কাল তারাই আপনাকেও লাথি থেকে রেহাই দেবে না।

নদীর জলের দিকে চাহিয়া রহমানের চোখ আবার ছল ছল করিয়া উঠিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *