দ্বিতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
ষোড়শীর কুটীর
[সন্ধ্যা এইমাত্র উত্তীর্ণ হইয়াছে। গৃহের অভ্যন্তরে প্রদীপ জ্বলিতেছে। বাহিরে ষোড়শী উপবিষ্ট। এমনি সময়ে নির্মল ও হৈম প্রবেশ করিল। পিছনে ভৃত্য]
ষোড়শী। এস, এস, কিন্তু এ কি কাণ্ড! তোমাদের যে আজ দুপুরের গাড়িতে যাবার কথা ছিল?
[নির্মল ও হৈম নিকটে উপবেশন করিল]
হৈম। কথা ছিল, কিন্তু যাইনি। এঁকেও যেতে দিইনি। দিদির এই নতুন ঘরখানি চোখে দেখে না গেলে দুঃখ করতে হতো।
নির্মল। চোখে দেখে গিয়েও দুঃখ কম করতে হবে মনে হয় না।
হৈম। সে ঠিক। হয়ত চোখে না দেখলেই ছিল ভালো। এ ঘরের আর যা দোষ থাক, অপব্যয়ের অপবাদ শিরোমণিমশায় কেন, বোধ হয় আমার বাবাও দিতে পারেন না। কিন্তু এ পাগলামি কেন করতে গেলে দিদি, এ ঘরে ত তুমি থাকতে পারবে না!
ষোড়শী। এর চেয়েও কত খারাপ ঘরে কত মানুষকে ত থাকতে হয় ভাই।
হৈম। তা হলে সত্যিই কি তুমি সব ছেড়ে দেবে?
নির্মল। তা ছাড়া কি উপায় আছে বলতে পার? সমস্ত গ্রামের সঙ্গে ত একজন অসহায় স্ত্রীলোক দিবানিশি বিবাদ করে টিকতে পারে না।
হৈম। আমরা সমস্তই শুনেছি। তুমি সন্ন্যাসিনী, সবই তোমার সইবে, কিন্তু এর সঙ্গে যে মিথ্যে দুর্নাম লেগে রইল সেও কি সইবে দিদি?
ষোড়শী। দুর্নাম যদি মিথ্যেই হয় সইবে না কেন? হৈম, সংসারে মিথ্যে কথার অভাব নেই, কিন্তু সেই মিথ্যে কথার সঙ্গে ঝগড়া করে মিথ্যে কাজের সৃষ্টি করতে আমার লজ্জা করে বোন।
হৈম। দিদি, তুমি সন্ন্যাসিনী, তোমার সব কথা আমরা বুঝতে পারিনে, কিন্তু তোমাকে দেখে কি আমার মনে হয় জানো? আমার শ্বশুরকে কোন্ এক রাজা একখানি তলোয়ার খিলাত দিয়েছিলেন। খাপখানা তার ধূলো-বালিতে মলিন হয়ে গেছে, কিন্তু আসল জিনিসে কোথাও এতটুকু ময়লা ধরেনি। সে যেমন সোজা, তেমন খাঁটি, তেমনি কঠিন। তার কথা আমার তোমার পানে চাইলেই মনে পড়ে। মনে হয় দেশসুদ্ধ লোকে সবাই ভুল করেছে, আসল কথা কেউ কিছুই জানে না।
ষোড়শী। (হৈমর হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া) আজ তোমাদের কেন যাওয়া হলো না হৈম? বোধ হয় কাল যাওয়া হবে, না?
হৈম। আমার ছেলের কথা তুললেই রাগ কর, সে আর বলব না, কিন্তু ভয়ঙ্কর দুর্যোগের রাতে আমার এই অন্ধ মানুষটিকে যিনি হাতে ধরে নদী পার করে এনে নিঃশব্দে দিয়ে গেছেন, তাঁর পায়ের ধূলো না নিয়েই বা আমরা যাই কি করে? কিন্তু যাবার আগে এই কথাটি আজ দাও দিদি, আপনার লোকের যদি কখনো দরকার হয়, এই প্রবাসী বোনটিকে তখন ভুলো না।
হৈম। (ষোড়শীকে নীরব দেখিয়া) কথা দিতে বুঝি চাও না দিদি?
ষোড়শী। কথা দিলাম, ভুলব না। ভুলিওনি হৈম। আঘাত পেয়ে আজই তোমাকে একখানা চিঠি লিখছিলাম, ভেবেছিলাম, তুমি চলে গেলে সেখানা তোমাকে ডাকে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু শেষ করতে পারলাম না, হঠাৎ মনে পড়ল এর জন্যে হয়ত তোমার বাবার সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত বিবাদ বেধে যাবে।
হৈম। যেতেও পারে। কিন্তু আরও যে একটা মস্ত কথা আছে দিদি। আমার এই অন্ধ মানুষটিকে তুমি রক্ষে করেছ, তার চেয়ে বড় সংসারে ত আমার কিছুই নেই।
ষোড়শী। সত্যিই কিছু নেই হৈম?
হৈম। না, নেই। আর এই সত্যি কথাটিই বলে যাব বলে আজ যেতে পারিনি।
ষোড়শী। (হাসিয়া) কিন্তু এই ছোট্ট কথাটুকুর জন্যে ত একজনই যথেষ্ট ছিল ভাই, নির্মলবাবুকে ত অনায়াসে যেতে দিতে পারতে?
হৈম। এঁকে? একলা? হায়, হায়, দিদি, বাইরে থেকে তোমরা ভাব প্রচণ্ড ব্যারিস্টার, মস্তলোক। কিন্তু আমিই জানি শুধু এই বিনি-মাইনের দাসীটিকে পেয়েছিলেন বলেই উনি জগতে টিকে গেলেন। বাস্তবিক দিদি, পুরুষমানুষদের এই এক আশ্চর্য ব্যাপার। বাইরের দিকে যিনি যত বড়, যত দুর্দম, যত শক্তিমান, ভিতরের দিকে তিনি তেমনি অক্ষম, তেমনি দুর্বল, তেমনি অপটু। দরকারের সময় কোথায় হারাবে এঁদের কাগজপত্র, বার হবার সময়ে কোথায় যাবে জামা-কাপড়-পোশাক, রাস্তায় বেরিয়ে কোথায় ফেলবে পকেটের টাকাকড়ি—কোন্ ভরসায় একলা ছেড়ে দিই বল ত? (সহাস্যে) একটুখানি চোখের আড়াল করেছিলাম বলেই ত সেদিন অমন বিভ্রাট বাধিয়েছিলেন। ভাগ্যে তুমি ছিলে!
ভৃত্য। মা, কালকের মত আজও ঝড়-জল হতে পারে—মেঘ উঠেচে।
হৈম। আজ তা হলে উঠি। মেঘের জন্যে নয় দিদি, তোমার কাছ থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু কাল সকালেই যাত্রা করতে হবে—আজ যেন আর কাজের অন্ত নেই। এঁকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি, লুকিয়ে বাড়ি ঢুকতে হবে—বাবা না দেখতে পান। এতক্ষণে খোকা হয়ত ঘুম ভেঙ্গে বসে কাঁদচে, তাকে আবার দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াতে হবে, এঁর খাওয়া-দাওয়া আমি ছাড়া আর কেউ বোঝে না, আড়ালে থেকে সে ব্যবস্থা করতে হবে—তার পরে রেলগাড়িতে দীর্ঘ পথের সমস্ত আয়োজনই আমাকে নিজের হাতে করে নিতে হবে। কারও উপর নির্ভর করবার জো নেই। স্বামী, পুত্র, চাকর-বাকর—তার কত ঝঞ্ঝাট, কত ভার—আমার নিঃশ্বাস ফেলবারও সময় নেই দিদি।
ষোড়শী। এতে ত তোমার কষ্ট হয় বোন?
হৈম। (হাসিমুখে) তা হয়। তবু এই আশীর্বাদ আমাকে কর তুমি, যেন এই কষ্ট মাথায় নিয়েই একদিন যেতে পারি। আর ফিরে যদি আবার জন্ম নিতেই হয়, যেন এমনি কষ্টই বিধাতা আমার অদৃষ্টে লিখে দেন। সেদিনও যেন এমনি নিঃশ্বাস ফেলবারও অবকাশ না পাই।
ষোড়শী। তোমার কথাটা আমি বুঝেচি হৈম। এ যেন তোমার আনন্দের মধুচক্র। ভার যতই বাড়চে ততই এর রন্ধ্র মধুতে ভরে ভরে উঠচে। তাই হোক, এই আশীর্বাদই তোমাকে আজ করি।
হৈম। (সহসা পদধূলি লইয়া) তাই কর দিদি, মেয়েমানুষের জীবনের এর বড় আশীর্বাদ কি আছে!
নির্মল। আঃ, কি বকে যাচ্চো বল ত? আজ তোমার হলো কি?
হৈম। কি যে হয়েছে তুমি তার জানবে কি?
ষোড়শী। জানার শক্তিই আছে নাকি আপনাদের?
নির্মল। আপনাদের অর্থাৎ পুরুষদের ত? না, এতবড় কঠিন তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করবার সাধ্য নেই আমাদের সে কথা মানি, কিন্তু আপনিই বা এ সত্য জানলেন কি করে?
হৈম। কেন? দেবীর ভৈরবী বলে? কিন্তু ভৈরবী কি নারী নয়? ওগো মশায়, এ তত্ত্ব আমাদের চেষ্টা করে শিখতে হয় না। আমাদের জন্মকালে বিধাতা স্বহস্তে তাঁর দুই হাত পূর্ণ করে আমাদের বুকের মধ্যে ঢেলে দেন। সে সম্পদের কাছে ইন্দ্রাণীর ঐশ্বর্যও কামনা করিনে এ কি সত্যি নয় দিদি?
ষোড়শী। সত্যি বৈ কি ভাই!
ভৃত্য। মা, মেঘ যে বেড়েই আসচে?
হৈম। এই যে উঠি বাবা। অনেক বাচালতা করে গেলাম দিদি, মাপ করো।
নির্মল। হৈমকে যে চিঠিখানা লিখেছিলেন তাঁর হাতে দিলে সময়ও বাঁচত, খরচও বাঁচত।
ষোড়শী। (হাসিয়া) না দিলেও বাঁচবে। হয়ত আর তার প্রয়োজনই হবে না।
নির্মল। ঈশ্বর করুন নাই যেন হয়, কিন্তু হলে আপনার প্রবাসী ভক্ত-দুটিকে বিস্মৃত হবেন না।
হৈম। আসি দিদি। (পদধূলি লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল) তোমার মুখের পানে চেয়ে আজ কত-কি যেন মনে হচ্চে দিদি! মনে হচ্চে, এমন যেন তোমাকে আর কখনো দেখিনি—যেন সহসা কোথায় কত দূরেই চলে গিয়েছ।
নির্মল। নমস্কার। প্রয়োজনে যেন ডাক পাই।
[সকলের প্রস্থান
ষোড়শী। হৈম, তুমি যেন আজ আমার কত যুগের চোখের ঠুলি খুলে দিয়ে গেলে বোন।—কে?
[সাগরের প্রবেশ]
সাগর। আমি সাগর।
ষোড়শী। তোদের আর সবাই? কাল যারা দল বেঁধে এসেছিল?
সাগর। আজও তারা তেমনি দল বেঁধেই গেছে হুজুরের কাছারি-বাড়িতে। আর বোধ হয় তোমারই বিরুদ্ধে—
ষোড়শী। বলিস কি সাগর? আমারই বিরুদ্ধে?
সাগর। আশ্চর্য হবার ত কিছু নেই মা! সর্বপ্রকার আপদে বিপদে চিরকাল তোমার কাছে এসে দাঁড়ানই সকলের অভ্যাস। প্রথমটা সেই অভ্যাসটাই বোধ হয় তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু আজ জমিদারের একটা চোখ-রাঙ্গানিতেই তাদের হুঁশ হয়েছে।
ষোড়শী। ভালো। কিন্তু সভাটা যে শুনেছিলাম মন্দিরে হবার কথা ছিল?
সাগর। কথাও ছিল, হুজুরের ভোজপুরীগুলোর ইচ্ছেও ছিল। কিন্তু গ্রামের কেউ রাজী হলেন না। তাঁরা ত এদিককার মানুষ—আমাদের খুড়ো-ভাইপোকে হয়ত চেনেন।
ষোড়শী। কি স্থির হলো সভাতে?
সাগর। তা সব ভালো। এই মঙ্গলবারেই মেয়েটার অভিষেক শেষ হবে। তোমারও ভাবনা নাই—কাশীবাসের বাবদে প্রার্থনা জানালে শ’খানেক টাকা পেতে পারবে।
ষোড়শী। প্রার্থনা জানাতে হবে বোধ করি হুজুরের কাছে?
সাগর। বোধ হয় তাই।
ষোড়শী। আচ্ছা, জমিজমা যাদের সমস্ত গেল, তাদের উপায় কি স্থির হলো?
সাগর। ভয় নেই মা, চিরকাল ধরে যা হয়ে আসচে তার অন্যথা হবে না।
ষোড়শী। আর তোদের?
সাগর। আমাদের খুড়ো-ভাইপোর? (একটু হাসিয়া) সে ব্যবস্থাও রায়মশায় করেছেন, নিতান্ত চুপ করে বসেছিলেন না। পাকা লোক, দারোগা পুলিশ মুঠোর মধ্যে, কোশ-দশেকের মধ্যে একটা ডাকাতি হতে যা দেরি।
ষোড়শী। (ভয় পাইয়া) হাঁরে, একি তোরা সত্যি বলে মনে করিস?
সাগর। মনে করি? এ ত চোখের উপর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মা। আমাদের জেলের বাইরে রাখতে পারে এ সাধ্য আর কারও নেই। (একটু থামিয়া) তা বলে যাদের জেল হবে না তাদের দুর্ভাগ্য কিছু কম নয় মা।
ষোড়শী। কেন রে?
সাগর। তাদের অবস্থা আমাদের চেয়েও মন্দ। জেলের মধ্যে খেতে দেয়, যা হোক আমরা দুটো খেতে পাব, কিন্তু এরা তাও পাবে না। রায়মশায়ের কাছে ধার করে জমিদারের সেলামি জুগিয়েছে, সেই খতগুলো সব ডিক্রি হতে যা বিলম্ব, তার পরে তাঁর নিজ জোতে জন খেটে দুমুঠো জোটে ভালো, না হয়—
ষোড়শী। না হয় কি?
সাগর। না হয় আসামের চা-বাগান আছেই। কেন মা, তোমারই কি মনে পড়ে না ওই বেলডাঙাটায় আগে আমাদের কত ঘর ভূমিজ বাউরির বস্তি ছিল?
ষোড়শী। (ঘাড় নাড়িয়া) পড়ে!
সাগর। আজ তারা কোথায়? কতক গেল কয়লা খুঁড়তে, কতক গেল চালান হয়ে চা-বাগানে। কিন্তু আমি দেখেচি ছেলেবেলায় তাদের জমিজমা, হাল-বলদ দু’মুঠো ধানের সংস্থান তাদের সবাইয়ের ছিল। আজ তাদের অর্ধেক এককড়ি নন্দীর, অর্ধেক রায়মশায়ের।
ষোড়শী। (স্তব্ধ থাকিয়া) আচ্ছা, সাগর, এ-সব তুই শুনলি কার মুখে?
সাগর। স্বয়ং হুজুরের মুখেই।
ষোড়শী। তা হলে এ-সকল তাঁরই মতলব?
সাগর। (চিন্তা করিয়া) কি জানি মা, কিন্তু মনে হয় রায়মশায়ও আছেন।
ষোড়শী। এ ত গেল তাদের কথা সাগর। কিন্তু আমি ত একা। জমিদার ইচ্ছে করলে ত আমারও প্রতি অত্যাচার করতে পারেন?
সাগর। তা জানিনে মা, শুধু জানি তুমি একা নও। (ক্ষণকাল নিঃশব্দে থাকিয়া) মা, আমাদের নিজের পরিচয় নিজে দিতে নেই, গুরুর নিষেধ আছে (বংশদণ্ড সজোরে মুষ্টিবদ্ধ করিয়া)—হরিহর সর্দারের ভাইপো সাগরের নাম দশ-বিশ ক্রোশের লোকে জানে—তোমার উপর অত্যাচার করবার মানুষ ত মা পঞ্চাশখানা গ্রামে কেউ খুঁজে পাবে না।
ষোড়শী। (দুই চক্ষু অকস্মাৎ জ্বলিয়া উঠিল) সাগর, এ কি সত্যি?
সাগর। (তৎক্ষণাৎ হেঁট হইয়া হাতের লাঠি ষোড়শীর পায়ের কাছে রাখিয়া) বেশ ত মা, সেই আশীর্বাদই কর না, যেন কথা আমার মিথ্যে না হয়।
ষোড়শী। (চোখের দৃষ্টি একবার একটুখানি কোমল হইয়া আবার তেমনি জ্বলিতে লাগিল) আচ্ছা সাগর, আমি ত শুনেচি তোদের প্রাণের ভয় করতে নেই?
সাগর। (সহাস্যে) মিথ্যে শুনেচ তাও ত আমি বলচি নে মা।
ষোড়শী। কেবল প্রাণ দিতেই পারিস, আর নিতে পারিস নে?
সাগর। পারিনে? এই আদেশের জন্য কত ভিক্ষেই না চাইলাম, কিন্তু কিছুতেই যে হুকুমটুকু তোমার মুখ থেকে বার করতে পারলাম না মা।
ষোড়শী। না সাগর, না। অমন কথা তোরা মুখেও আনিস নে বাবা।
সাগর। কিন্তু মন থেকে যে কথাটা তাড়াতে পারচি নে মা!
[পূজারী প্রবেশ করিল]
পূজারী। মন্দিরের দোর বন্ধ করে এলাম মা।
ষোড়শী। চাবি?
পূজারী। এই যে মা। (চাবির গোছা হাতে দিয়া) রাত হলো এখন তা হলে আসি?
ষোড়শী। এস, বাবা।
[পূজারীর প্রস্থান
ষোড়শী। সাগর, ফকিরসাহেব চলে গেছেন। তিনি কোথায় আছেন, খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাতে পারিস বাবা?
সাগর। কেন মা?
ষোড়শী। তাঁকে আমার বড় প্রয়োজন। তোরা ছাড়া তাঁর চেয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী আমার কেউ নেই।
সাগর। কিন্তু তোমার কাছেই ত কতবার শুনেছি তিনি সাধুপুরুষ। যেখানেই থাকুন তাঁকে যথার্থ মন দিয়ে ডাকলেই এসে উপস্থিত হন।
ষোড়শী। (চমকিয়া) তাই ত সাগর, এতবড় কথাটা আমি কি করে ভুলেছিলাম! আর আমার চিন্তা নেই, আমার এতবড় দুঃসময়ে তিনি না এসে কিছুতেই পারবেন না।
সাগর। আমারও বিশ্বাস তাই। কিন্তু কথায় কথায় রাত্রি অনেক হলো মা, তুমি বিশ্রাম কর, আসি?
ষোড়শী। এসো।
সাগর। (ঈষৎ হাসিয়া) ভয় নেই মা, সাগর তোমাকে একলা রেখে কোথাও বেশীক্ষণ থাকবে না।
[প্রস্থান
[তখন পর্যন্ত ষোড়শীর আহ্নিক প্রভৃতি নিত্যকার্য সমাধা হয় নাই, সে এই আয়োজনে ব্যাপৃত থাকিয়া]
ষোড়শী। সাগর আমাকে কতবড় কথাই না স্মরণ করিয়ে দিলে। ফকির-সাহেব! যেখানে থাকুন, এ বিপদে আপনার দেখা আমি পাবোই পাব।
নেপথ্যে। আসতে পারি কি?
ষোড়শী। (সচকিত উঠিয়া দাঁড়াইয়া ব্যাকুল-কণ্ঠে) আসুন, আসুন—আমি যে সমস্ত মন দিয়ে শুধু আপনাকেই ডাকছিলাম!
[জীবানন্দ প্রবেশ করিলেন]
জীবানন্দ। এতবড় পতিভক্তি কলিকালে দুর্লভ। আমার পাদ্য অর্ঘ্য আসনাদি কৈ?
ষোড়শী। (ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া, সভয়ে) আপনি? আপনি এসেছেন কেন?
জীবানন্দ। তোমাকে দেখতে। একটু ভয় পেয়েছ বোধ হচ্ছে। পাবারই কথা। কিন্তু চেঁচিও না। সঙ্গে পিস্তল আছে, তোমার ডাকাতের দল শুধু মারাই পড়বে, আর বিশেষ কিছু করতে পারবে না।
[ষোড়শী নির্বাক হইয়া রহিল]
জীবানন্দ। তবু, দোরটা বন্ধ করে একটু নিশ্চিন্ত হওয়া যাক। কি বল?
[এই বলিয়া জীবানন্দ অগ্রসর হইয়া দ্বার অর্গলবদ্ধ করিয়া দিলেন]
ষোড়শী। (ভয়ে কণ্ঠস্বর তাহার কাঁপিতেছিল) সাগর নেই—
জীবানন্দ। নেই? ব্যাটা গেল কোথায়?
ষোড়শী। আপনারা জানেন বলেই ত—
জীবানন্দ। জানি বলে? কিন্তু আপনারা কারা? আমি ত বাষ্পও জানতাম না।
ষোড়শী। নিরাশ্রয় বলেই ত লোক নিয়ে আমার প্রতি অত্যাচার করতে এসেছেন? কিন্তু আপনার কি করেছি আমি?
জীবানন্দ। লোক নিয়ে অত্যাচার করতে এসেছি? তোমার প্রতি? মাইরি না! বরঞ্চ মন কেমন করছিল বলে ছুটে দেখতে এসেছি।
[ষোড়শীর চোখে জল আসিতেছিল, এই উপহাসে তাহা একেবারে শুকাইয়া গেল। জীবানন্দ অদূরে বসিয়া তাহার আনত মুখের প্রতি লুব্ধ তৃষিত চক্ষে চাহিয়া রহিলেন]
জীবানন্দ। অলকা?
ষোড়শী। বলুন।
জীবানন্দ। তোমার এখানে তামাক-টামাকের ব্যবস্থা নেই বুঝি?
[ষোড়শী একবার মুখ তুলিয়াই অধোমুখে স্থির হইয়া রহিল]
জীবানন্দ। (দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিয়া) ব্রজেশ্বরের কপাল ভাল ছিল। দেবীরানী তাকে ধরিয়ে আনিয়েছিল সত্যি, কিন্তু অম্বুরী তামাকও খাইয়েছিল, এবং ভোজনান্তে দক্ষিণাও দিয়েছিল। বিদায়ের পালাটা আর তুলব না, বলি বঙ্কিমবাবুর বইখানা পড়েছ ত?
ষোড়শী। আপনাকে ধরে আনলে সেইমত ব্যবস্থাও থাকত—অনুযোগ করতে হত না।
জীবানন্দ। (হাসিয়া) তা বটে। টানা-হেঁচড়া দড়িদড়ার বাঁধাবাঁধিই মানুষের নজরে পড়ে। ভোজপুরী পেয়াদা পাঠিয়ে ধরে আনাটাই পাড়াসুদ্ধ সকলেই দেখে; কিন্তু যে পেয়াদাটিকে চোখে দেখা যায় না—হাঁ অলকা, তোমাদের শাস্ত্রগ্রন্থে তাঁকে কি বলে? অতনু, না? বেশ তিনি। (ক্ষণেক নীরব থাকিয়া) যৎসামান্য অনুরোধ ছিল; কিন্তু আজ উঠি। তোমার অনুচরগুলো সন্ধান পেলেই জামাই আদর করবে না। এমন কি শ্বশুরবাড়ি এসেছি বলে হয়ত বিশ্বাস করতেই চাইবে না—ভাববে প্রাণের দায়ে বুঝি মিথ্যেই বলচি।
[লজ্জায় ষোড়শী আরও অবনত হইল]
জীবানন্দ। তামাকের ধুঁয়া আপাততঃ পেটে না গেলেও চলত, কিন্তু ধুঁয়া নয় এমন কিছু একটা পেটে না গেলে আর ত দাঁড়াতে পারিনে। বাস্তবিক, নেই কিছু অলকা?
ষোড়শী। কিছু কি? মদ?
জীবানন্দ। (হাসিয়া মাথা নাড়িয়া) এবারে ভুল হলো। ওর জন্যে অন্য লোক আছে, সে তুমি নয়। তোমাকে বুঝতে পারার যথেষ্ট সুবিধে দিয়েছ—আর যা অপবাদ দিই, অস্পষ্টতার অপবাদ দিতে পারব না। অতএব তোমার কাছে যদি চাইতেই হয়, চাই এমন কিছু যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, মরণের পথে ঠেলে দেয় না। ডাল, ভাত, মেঠাইমণ্ডা, চিঁড়ে, মুড়ি যা হোক দাও, আমি খেয়ে বাঁচি। নেই?
[ষোড়শী নির্নিমেষ-চক্ষে চাহিয়া রহিল]
জীবানন্দ। আজ সকালে মন ভাল ছিল না। শরীরের কথা তোলা বিড়ম্বনা, কারণ সুস্থদেহ যে কি আমি জানিনে। সকালে হঠাৎ নদীর তীরে বেরিয়ে পড়লাম, কত যে হাঁটলাম বলতে পারিনে—ফিরতে ইচ্ছেও হলো না। সূর্যদেব অস্ত গেলেন, একলা জলের ধারে দাঁড়িয়ে কি যে ভাল লাগল বলতে পারিনে। কেবল তোমাকে মনে পড়তে লাগল। মনে পড়ল আমার কাছারি-বাড়িতে এতক্ষণে লোক জমেছে—তোমাকে নির্বাসনে পাঠাবার ব্যবস্থাটা আজ শেষ করাই চাই। ফিরে এসে সভায় যোগ দিলাম, কিন্তু টিকতে পারলাম না। একটা ছুতো করে পালিয়ে এসে দাঁড়ালাম ওই মনসা গাছটার পিছনে।
ষোড়শী। তার পরে?
জীবানন্দ। দেখি দাঁড়িয়ে সাগর সর্দার এবং তুমি। আলাপ-আলোচনা সমস্তই কানে গেল, তাৎপর্য গ্রহণ করতেও বিলম্ব হলো না। ভাবলাম, আমাদের মত সাধু ব্যক্তিরা যে এ-হেন নির্বোধ ভৈরবীকে দূর করে দিতে চেয়েছে সে ঠিকই হয়েছে। সে-রাত্রি বাড়ি ঘেরাও করে পুলিশ পেয়াদা হাতকড়া নিয়ে হাজির, সামান্য একটা মুখের কথার জন্য স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পর্যন্ত কি পীড়াপীড়ি—আর তুমি বললে কিনা আমি নিজের ইচ্ছায় এসেছি। আর ছোট্ট একটুখানি হুকুমের জন্যে সাগরচাঁদের কত অনুনয়-বিনয়, কি সাধাসাধি—আর তুমি বলে বসলে কিনা অমন কথা মুখেও আনিস নে বাবা। অভিমানে বাবাজীবন মুখখানি ম্লান করে চলে গেলেন সে ত স্বচক্ষেই দেখলাম। মনে মনে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বললাম, জয় মা চণ্ডীগড়ের চণ্ডী! তোমার এই অধম সন্তানের প্রতি এত কৃপা না থাকলে কি আর এই মেয়েমানুষটির বার বার এমন করে বুদ্ধি লোপ কর! এখন একবার একে বিদায় করে আমাকে তক্তে বসাও মা, জনার্দন আর এককড়ি, এই দুই তাল-বেতালকে সঙ্গে নিয়ে আমি এমনি সেবা তোমার শুরু করে দেব যে, একদিনের পূজোর চোটে তোমার মাটির মূর্তি আহ্লাদে একেবারে পাথর হয়ে যাবে। কিন্তু ভক্তি-তত্ত্বের এ-সব বড় বড় কথা না হয় পরে ভাবা যাবে, কিন্তু এখন ক্ষিদের জ্বালায় যে আর দাঁড়াতে পারিনে। বাস্তবিক নেই কিছু অলকা?
ষোড়শী। কিন্তু বাড়ি গিয়ে ত অনায়াসে খেতে পারবেন।
জীবানন্দ। অর্থাৎ, আমার বাড়ির খবর আমার চেয়ে তুমি বেশি জানো। (এই বলিয়া সে একটুখানি হাসিল)
ষোড়শী। আপনি সারাদিন খাননি, আর বাড়িতে আপনার খাবার ব্যবস্থা নেই, এ কি কখনো হতে পারে?
জীবানন্দ। না পারবে কেন? আমি খাইনি বলে আর একজন উপোস করে থালা সাজিয়ে পথ চেয়ে থাকবে এ ব্যবস্থা ত করে রাখিনি। আজ খামকা রাগ করলে চলবে কেন অলকা? (বলিয়া সে তেমনি মৃদু হাসিল) আমার যে শান্তিময় জীবনযাত্রা সেদিন চোখে দেখে এসেছ সে বোধ হয় ভুলে গেছ। আজ তা হলে আসি?
ষোড়শী। (ব্যাকুল-কণ্ঠে) দেবীর সামান্য একটু প্রসাদ আছে, কিন্তু সে কি আপনি খেতে পারবেন?
জীবানন্দ। খুব পারব। কিন্তু সামান্য একটু প্রসাদ। কিন্তু সে ত নিশ্চয় তোমার নিজের জন্যে আনা অলকা?
ষোড়শী। নইলে কি আপনার জন্যে রেখেছি এই আপনি মনে করেন?
জীবানন্দ। (হাসিমুখে) না, তা করিনে, কিন্তু ভাবচি, তোমাকে ত বঞ্চিত করা হবে।
ষোড়শী। সে ভাবনার প্রয়োজন নেই। আমাকে বঞ্চিত করায় আপনার নূতন অপরাধ কিছু হবে না।
জীবানন্দ। না, অপরাধ আর আমার হয় না। একেবারে তার নাগালের বাইরে চলে গেছি। কিন্তু হঠাৎ একটা অদ্ভুত খেয়াল মনে উঠেছে অলকা, যদি না হাসো ত তোমাকে বলি।
ষোড়শী। বলুন।
জীবানন্দ। কি জানো, মনে হয়, হয়ত আজও বাঁচতে পারি, হয়ত আজও মানুষের মত—কিন্তু এমন কেউ নেই যে আমার—কিন্তু তুমিই পারো শুধু এই পাপিষ্ঠের ভার নিতে—নেবে অলকা?
ষোড়শী। কি বলচেন?
জীবানন্দ। (আত্মসমর্পণের আশ্চর্য কণ্ঠস্বরে) বলচি আমার সমস্ত ভার তুমি নাও অলকা।
ষোড়শী। (চমকিয়া, একমুহূর্ত থামিয়া) অর্থাৎ আমার যে কলঙ্কের বিচার করছেন, আমাকে দিয়ে তাকেই প্রতিষ্ঠিত করিয়ে নিতে চান। আমার মাকে ঠকাতে পেরেছিলেন, কিন্তু আমাকে পারবেন না।
জীবানন্দ। কিন্তু সে চেষ্টা ত আমি করিনি। তোমার বিচার করেচি, কিন্তু বিশ্বাস করিনি। কেবলি মনে হয়েছে, এই কঠোর আশ্চর্য রমণীকে অভিভূত করেছেন সে মানুষটি কে?
ষোড়শী। (আশ্চর্য হইয়া) তারা আপনার কাছে তার নাম বলেনি?
জীবানন্দ। না। আমি বার বার জিজ্ঞাসা করেচি, তারা বার বার চুপ করে গেছে। যাক, এবার আমি যাই; কি বল?
ষোড়শী। কিন্তু আপনার যে কি কাজের কথা ছিল?
জীবানন্দ। কাজের কথা? কিন্তু কি যে ছিল আমার আর মনে পড়চে না। শুধু এই কথাই মনে পড়চে, তোমার সঙ্গে কথা কহাই আমার কাজ। অলকা, তোমার কি সত্যিই আবার বিয়ে হয়েছিল?
ষোড়শী। আবার কিরকম? সত্যি বিয়ে আমার একবার মাত্রই হয়েছে।
জীবানন্দ। আর তোমার মা যে তোমাকে আমাকে দিয়েছিলেন সেটাই কি সত্যি নয়?
ষোড়শী। না, সে সত্যি নয়। মা আমার সঙ্গে যে টাকাটা দিয়েছিলেন আপনি তাই শুধু নিয়েছিলেন, আমাকে নেননি। ঠকানো ছাড়া তার মধ্যে লেশমাত্র সত্য কোথাও ছিল না।
জীবানন্দ। (কিছুক্ষণ ধ্যানমগ্নের মত বসিয়া; যেন কতদূর হইতে কথা কহিল) অলকা, এ কথা তোমার সত্য নয়।
ষোড়শী। কোন্ কথা?
জীবানন্দ। তুমি যা জেনে রেখেচ। ভেবেছিলাম সে কাহিনী কখনো কাউকে বলব না, কিন্তু সেই কাউকের মধ্যে আজ তোমাকে ফেলতে পারচি নে! তোমার মাকে ঠকিয়েছিলাম, কিন্তু ভগবান তোমাকে ঠকাবার সুযোগ আমাকে দেননি। আমার একটা অনুরোধ রাখবে?
ষোড়শী। বলুন?
জীবানন্দ। আমি সত্যবাদী নই; কিন্তু আজকের কথা আমার তুমি বিশ্বাস কর। তোমার মাকে আমি জানতাম, তাঁর মেয়েকে স্ত্রী বলে গ্রহণ করবার মতলব আমার ছিল না—ছিল কেবল তাঁর টাকাটাই লক্ষ্য। কিন্তু সে রাত্রে হাতে হাতে তোমাকে যখন পেলাম, তখন না বলে ফিরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেও আর হলো না।।
ষোড়শী। তবে কি ইচ্ছে হলো?
জীবানন্দ। থাক, সে তুমি আর শুনতে চেয়ো না। হয়ত শেষ পর্যন্ত শুনলে আপনিই বুঝবে, এবং সে বোঝায় ক্ষতি বৈ লাভ আমার হবে না। কিন্তু এরা তোমাকে যা বুঝিয়েছিল তা তাই নয়, আমি তোমাকে ফেলে পালাই নি।
ষোড়শী। আপনার না পালানোর ইতিবৃত্ত এখন ব্যক্ত করুন।
জীবানন্দ। আমি নির্বোধ নই, যদি ব্যক্তই করি, তার সমস্ত ফলাফল জেনেই করব। তোমার মায়ের এতবড় ভয়ানক প্রস্তাবেও কেন রাজি হয়েছিলাম জানো? একজন স্ত্রীলোকের হার আমি চুরি করি; ভেবেছিলাম টাকা দিয়ে তাকে শান্ত করব। সে শান্ত হলো, কিন্তু পুলিশের ওয়ারেন্ট শান্ত হলো না। ছ’মাস জেলে গেলাম—সেই যে শেষ রাত্রে বার হয়েছিলাম, আর ফেরবার অবকাশ হলো না।
ষোড়শী। (রুদ্ধ-নিশ্বাসে) তার পরে?
জীবানন্দ। (মৃদু হাসিয়া) তার পরেও মন্দ নয়। জীবানন্দবাবুর নামে আরও একটা ওয়ারেন্ট ছিল। মাস-কয়েক পূর্বে রেলগাড়িতে একজন বন্ধু সহযাত্রীর ব্যাগ নিয়ে তিনি অন্তর্হিত হন। অতএব আরও দেড় বৎসর। একুনে বছর-দুই নিরুদ্দেশের পর বীজগাঁয়ের ভাবী জমিদারবাবু যখন রঙ্গমঞ্চে পুনঃপ্রবেশ করলেন, তখন কোথায় বা অলকা আর কোথার বা তার মা! (দু’জনেই ক্ষণিক নিস্তব্ধ হইয়া রহিল) আর একবার সভায় যেতে হবে। অলকা, আসি তা হলে!
ষোড়শী। সভায় আপনার অনেক কাজ, না গেলেই নয়। কিন্তু কিছু না খেয়েও ত যেতে পারবেন না।
জীবানন্দ। পারব না? তা হলে আনো। কিন্তু মস্ত বদ অভ্যেস আমার, খেয়ে আর নড়তে পারিনে।
ষোড়শী। না পারেন এখানেই বিশ্রাম করবেন।
জীবানন্দ। বিশ্রাম করব! যদি ঘুমিয়ে পড়ি অলকা?
ষোড়শী। (হাসিয়া) সে সম্ভাবনা ত রইলই। কিন্তু পালাবেন না যেন! আমি খাবার নিয়ে আসি।
[প্রস্থান
[গৃহকোণে একখানা পত্রের খণ্ডাংশ পড়িয়া ছিল, জীবানন্দের দৃষ্টি পড়িতেই তাহা সে তুলিয়া লইয়া দীপালোকে পড়িয়া ফেলিল। তাহার মুহূর্তকাল পূর্বের সরস ও প্রফুল্ল মুখের চেহারা গম্ভীর ও অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিল। ষোড়শী খাবারের পাত্র লইয়া প্রবেশ করিল। তাহার মনে পড়িল ঠাঁই করা হয় নাই, তাই সে পাত্রটি তাড়াতাড়ি একধারে রাখিয়া আসনের অভাবে কম্বলই পুরু করিয়া পাতিল এবং নিজের একখানি বস্ত্র পাট করিয়া দিতেছিল, এমনি সময়ে জীবানন্দ কথা কহিলেন।]
জীবানন্দ। ও কি হচ্ছে?
ষোড়শী। আপনার ঠাঁই করচি। শুধু কম্বলটা ফুটবে।
জীবানন্দ। ফুটবে, কিন্তু আতিশয্যটা ঢের বেশী ফুটবে। যত্ন জিনিসটায় মিষ্টি আছে সত্যি, কিন্তু তার ভান করাটায় না আছে মধু, না আছে স্বাদ। ওটা বরঞ্চ আর কাউকে দিয়ো।
[কথা শুনিয়া ষোড়শী বিস্ময়ে অবাক হইয়া গেল]
জীবানন্দ। (হাতের কাগজ দেখাইয়া) ছেঁড়া চিঠি—সবটুকু নেই। যাঁকে লিখেছিলে তাঁর নামটি শুনতে পাইনে?
ষোড়শী। কার নাম?
জীবানন্দ। যিনি দৈত্য-বধের জন্য চণ্ডীগড়ে অবতীর্ণ হবেন, যিনি দ্রৌপদীর সখা—আর বলবো?
[এই ব্যঙ্গোক্তির ষোড়শী উত্তর দিতে পারিল না, কিন্তু তাহার চোখের উপর হইতে ক্ষণকাল পূর্বের মোহের যবনিকা খানখান হইয়া ছিঁড়িয়া গেল]
জীবানন্দ। এই আহ্বান-লিপির প্রতি ছত্রটি যাঁর কর্ণে অমৃত বর্ষণ করবে তাঁর নামটি?
ষোড়শী। (আপনাকে সংযত করিয়া লইয়া) তাঁর নামে আপনার প্রয়োজন?
জীবানন্দ। প্রয়োজন আছে বৈ কি। পূর্বাহ্নে জানতে পারলে হয়ত আত্মরক্ষার একটা উপায় করতে পারি।
ষোড়শী। আত্মরক্ষার প্রয়োজন ত একা আপনারই নয় চৌধুরীমশায়। আমারও ত থাকতে পারে।
জীবানন্দ। পারে বৈ কি!
ষোড়শী। তা হলে সে নাম আপনি শুনতে পাবেন না। কারণ, আমার ও আপনার একই সঙ্গে রক্ষা পাবার উপায় নেই।
জীবানন্দ। বেশ, তা যদি না থাকে রক্ষা পাওয়াটা আমারই দরকার এবং তাতে লেশমাত্র ত্রুটি হবে না জেনো। (ষোড়শী নিরুত্তর) তুমি জবাব না দিতে পারো, কিন্তু তোমার এই বীরপুরুষটির নাম যে আমি জানিনে তা নয়।
ষোড়শী। জানবেন বৈ কি। পৃথিবীর বীরপুরুষদের মধ্যে পরিচয় থাকবারই ত কথা।
জীবানন্দ। সে ঠিক। কিন্তু এই কাপুরুষকে বার বার অপমান করার ভারটা তোমার বীরপুরুষটি সইতে পারলে হয়। যাক, এ চিঠি ছিঁড়লে কেন?
ষোড়শী। এর জবাব আমি দেব না। জীবানন্দ। কিন্তু সোজা নির্মল সাহেবকে না লিখে তাঁর স্ত্রীকে লেখা কেন? এ শব্দভেদী বাণ কি তাঁরই শেখানো নাকি?
ষোড়শী। তার পরে?
জীবানন্দ। তার পরে আজ আমার সন্দেহ গেল। বন্ধুর সংবাদ আমি অপরের কাছে শুনেচি, কিন্তু রায়মশায়কে যতই প্রশ্ন করেচি, ততই তিনি চুপ করে গেলেন। আজ বোঝা গেল তাঁর আক্রোশটাই সবচেয়ে কেন বেশি।
ষোড়শী। (সচকিত) নির্মলের সম্বন্ধে আপনি কি শুনেছেন?
জীবানন্দ। সমস্তই। তোমার চমক আর গলার মিঠে আওয়াজে আমার হাসি পাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হাসতে পারলাম না—আমার আনন্দ করবার এ কথা নয়। সেই ঝড়-জল অন্ধকার রাত্রে একাকী তার হাত ধরে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া মনে পড়ে? তার সাক্ষী আছে। সাক্ষী ব্যাটারা যে কোথায় লুকিয়ে থাকে আগে থেকে কিছুই জানবার জো নেই। আমি যখন গাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে পালাই, ভেবেছিলাম কেউ দেখেনি।
ষোড়শী। যদি সত্যই তাই করে থাকি সে কি এতবড় দোষের?
জীবানন্দ। কিন্তু গোপন করার চেষ্টাটা? এই চিঠির টুকরোটা? নিজেই একবার পড়ে দেখ ত কি মনে হয়? আমার মত ইনিও একবার তোমার বিচার করতে বসেছিলেন না?
দেখচি, তোমার বিচার করবার বিপদ আছে। (এই বলিয়া জীবানন্দ মুচকিয়া হাসিল। ষোড়শী নিরুত্তর) এ আমি সঙ্গে নিয়ে চললাম, আবশ্যক হলে যথাস্থানে পৌঁছে দেবার ত্রুটি হবে না। এই ক’টা ছত্র আমার পুরুষের চোখকেই যখন ফাঁকি দিতে পারেনি, তখন আশা করি হৈমকেও ঠকাতে পারবে না।
[ষোড়শী নিরুত্তর]
জীবানন্দ। কেমন, অনেক কথাই জানি?
ষোড়শী। হাঁ।
জীবানন্দ। এ-সব তবে সত্যি বল?
ষোড়শী। হাঁ, সত্যি।
জীবানন্দ। (আহত হইয়া) ওঃ—সত্যি! (স্তিমিত দীপশিখাটা উজ্জ্বল করিয়া দিয়া ষোড়শীর মুখের প্রতি তীক্ষ্ণচক্ষে চাহিয়া) এখন তাহলে তুমি কি করবে মনে কর?
ষোড়শী। কি আমাকে আপনি করতে বলেন?
জীবানন্দ। তোমাকে? (ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া, দীপশিখা পুনরায় উজ্জ্বল করিয়া দিয়া) তা হলে এঁরা সকলে যে তোমাকে অসতী বলে—
ষোড়শী। এঁদের বিরুদ্ধে আপনার কাছে ত আমি নালিশ জানাই নি। আমাকে কি করতে হবে তাই বলুন। কারণ দেখাবার প্রয়োজন নেই।
জীবানন্দ। তা বটে। কিন্তু সবাই মিথ্যা কথা বলে, আর তুমি একাই সত্যবাদী এই কি আমাকে তুমি বোঝাতে চাও অলকা?
[ষোড়শী নিরুত্তর]
জীবানন্দ। একটা উত্তর দিতেও চাও না?
ষোড়শী। (মাথা নাড়িয়া) না।
জীবানন্দ। অর্থাৎ আমার কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার চেয়ে দুর্নামও ভালো। বেশ, সমস্তই স্পষ্ট বোঝা গেছে! (এই বলিয়া তিনি ব্যঙ্গ করিয়া হাসিলেন)
ষোড়শী। স্পষ্ট বোঝা যাবার পরে কি করতে হবে তাই শুধু বলুন!
[তাহার এই উত্তরে জীবানন্দের ক্রোধ ও অধৈর্য শতগুণে বাড়িয়া গেল]
জীবানন্দ। কি করতে হবে সে তুমি জানো, কিন্তু আমাকে দেবমন্দিরের পবিত্রতা বাঁচাতেই হবে। এর যথার্থ অভিভাবক তুমি নয়, আমি। পূর্বে কি হতো জানিনে, কিন্তু এখন থেকে ভৈরবীকে ভৈরবীর মতই থাকতে হবে, না হয় তাকে যেতে হবে।
ষোড়শী। বেশ তাই হবে। যথার্থ অভিভাবক কে সে নিয়ে আমি বিবাদ করব না। আপনারা যদি মনে করেন আমি গেলে মন্দিরের ভালো হবে আমি যাব।
জীবানন্দ। তুমি যে যাবে সে ঠিক। কারণ, যাতে যাও সে আমি দেখব।
ষোড়শী। কেন রাগ করচেন, আমি ত সত্যিই যেতে চাচ্চি। কিন্তু আপনার ওপর এই ভার রইল যেন মন্দিরের যথার্থই ভাল হয়।
জীবানন্দ। কবে যাবে?
ষোড়শী। যখনই আদেশ করবেন। কাল, আজ, এখন—
জীবানন্দ। কিন্তু নির্মলবাবু? জামাইসাহেব?
ষোড়শী। (কাতর-কণ্ঠে) তাঁর নাম আর করবেন না।
জীবানন্দ। আমার মুখে তাঁর নামটা পর্যন্ত তোমার সহ্য হয় না। ভাল। কিন্তু কি তোমাকে দিতে হবে?
ষোড়শী। কিছুই না।
জীবানন্দ। এ ঘরখানা পর্যন্ত ছাড়তে হবে জানো? এও দেবীর।
ষোড়শী। জানি। যদি পারি, কালই ছেড়ে দেব।
জীবানন্দ। কোথায় যাবে ঠিক করেছ?
ষোড়শী। এখানে থাকব না, এর বেশি কিছুই ঠিক করিনি। একদিন কিছু না জেনেই আমি ভৈরবী হয়েছিলাম, আজ বিদায় নেওয়ার বেলাতেও এর বেশি ভাবব না। আপনি দেশের জমিদার, চণ্ডীগড়ের ভালোমন্দের ভার আপনার পরে রেখে যেতে শেষ সময়ে আর আমি দ্বিধা করব না। কিন্তু আমার বাবা ভারী দুর্বল, তাঁর উপরে নির্ভর করে যেন আপনি নিশ্চিন্ত হবেন না।
জীবানন্দ। তুমি কি সত্যিই চলে যেতে চাও নাকি?
ষোড়শী। আর আমার দুঃখী দরিদ্র ভূমিজ প্রজারা। একদিন তাদের সমস্তই ছিল—আজ তাদের মত নিঃস্ব নিরুপায় আর কেউ নেই। ডাকাত বলে বিনাদোষে লোকে তাদের জেল দিয়েছে। এদের সুখ-দুঃখের ভারও আমি আপনাকেই দিয়ে গেলাম।
জীবানন্দ। আচ্ছা, তা হবে হবে। কি তারা চায় বল ত?
ষোড়শী। সে তারাই আপনাকে জানাবে।
[এই বলিয়া সে সহসা জানালা দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দড়ির আলনা হইতে গামছা ও কাপড় হাতে লইল]
ষোড়শী। আমার স্নান করতে যাবার সময় হলো।
জীবানন্দ। স্নানের সময়? এই রাত্রে?
ষোড়শী। রাত আর নেই—এবার আপনি বাড়ি যান। (এই বলিয়া সে যাইতে উদ্যত হইল)
জীবানন্দ। (ব্যগ্রকণ্ঠে) কিন্তু আমার সকল কথাই যে বাকী রয়ে গেল?
ষোড়শী। থাক, আপনি বাড়ি যান।
জীবানন্দ। না। কোথায় যেন আমার মস্ত ভুল হয়ে গেছে অলকা, কথা আমার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি—
ষোড়শী। না সে হবে না, আপনি বাড়ি যান। আমার বহু ক্ষতিই করেছেন, এ জীবনের শেষ সর্বনাশ করতে আর আপনাকে দেব না।
জীবানন্দ। আচ্ছা, আমি চললাম অলকা।
[প্রস্থান]