ষোড়শ পরিচ্ছেদ – দেওয়ানের বহির্বাটী
গোবিন্দরাম বহির্বাটীতে আসিয়া প্রাঙ্গণস্থ একখানি চৌকীর উপরে উপবেশন করিলেন। খানসামা আলবোলা আনিয়া দিল, তিনি ধূমপান করিতে করিতে বলিলেন, “দেউড়িতে যাহারা গোলমাল করিতেছে, তাহাদিগকে এইখানে আসিতে বল।”
দারোগা, জমাদার ও কয়েকজন দীর্ঘ ষষ্টিধারী চৌকীদার পুরীমধ্যে প্রবেশ করিল। তাহাদের সঙ্গে আমাদের পূর্ব্ব পরিচিত ধর্ম্মা যুগীও আসিয়াছিল। দারোগা ফতেউল্লা গোবিন্দরামের প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশপূর্ব্বক ধৰ্ম্মাকে জিজ্ঞাসিল, “এই আদমী?”
ধর্ম্মা। আজ্ঞা, হাঁ হুজুর।
দারোগা। তোমার নাম গোবিন্দরাম?
দেওয়ান, ফতেউল্লার মুখের প্রতি তীব্র দৃষ্টি করিয়া, বিদ্রূপব্যঞ্জক ঈষৎ হাসি হাসিয়া, ঘাড় নাড়িয়া উত্তর করিলেন, “আজ্ঞা, হাঁ হুজুর।”
দারোগা। তোমার নামে গ্রেপ্তারী পরওয়ানা আছে। কাল রাত্রে তুমি রাঘব সেনের রেশমের কিস্তি লুঠ করেছ, আর একজন চড়নদারকে খুন করে এসেছ, তোমায় থানায় যেতে হচ্ছে।
দেও। তা ভালই ত। দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বসতে আজ্ঞা হক।
দারোগা। এত ঠাট্টা কেন?
দেওয়ান বলিলেন, “সে কি বড় মিঞা, তোমায় আমি ঠাট্টা করতে পারি? এতটা পথ হেঁটে এই তক্লিফ্ স্বীকার করে, বন্দাখানায় পদার্পণ করেছ, তোমায় অভ্যর্থনা করা আমার কর্ত্তব্য নয়? তুমি কেমন কথা কও?”
এই বলিয়া তিনি আলবোলায় একটি শেষ টান টানিলেন, কলিকা জ্বলিয়া উঠিল; তিনি সেই জ্বলন্ত কলিকা খুলিয়া লইয়া দারোগা সাহেবের দাড়ীর নিকটে ধরিয়া বিনীতভাবে বলিলেন “পিজিয়ে সাহেব।”
দারোগা ‘তোবা তোবা’ বলিয়া ঘাড় ফিরাইয়া লইয়া, দুইহস্তে দাড়ী ঝাড়িতে লাগিল। “কেঁও বদমাস্, তেরা এত্তিবড়ি তাকৎ,” বলিয়া জমাদার গোবিন্দরামের গলা টিপিয়া ধরিল। কিন্তু পরক্ষণেই দেওয়ানের প্রবল পদাঘাতে সে দশহস্ত দূরে যাইয়া পতিত হইল।
পরক্ষণেই গোবিন্দরাম একজন চৌকীদারের লাঠী কাড়িয়া লইলেন। তিনি এই সময়ে এরূপ ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করিলেন যে, কাহার সাধ্য তাঁহার নিকটে একপদ অগ্রসর হয়। তাঁহাকে দেখিয়া বোধ হইল, যেন অমিত-মাতঙ্গ-বল তাঁহার দেহে আবির্ভূত হইয়াছে। তখন তিনি গম্ভীররবে চৌকীদারদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “যদি ভাল চাও, তবে লাঠীগুলি ঐখানে রাখ।”
চৌকীদারগণ পরস্পর মুখাবলোকন করিতে লাগিল।
“কেঁও হাতিয়ার ছোড়েগা? চোরি করকে, খুন করকে কিয়া তোম্ নবাব বন্ গিয়া?” বলিয়া জমাদার একজন চৌকীদারের হাত হইতে একগাছি লাঠী লইল। ধৰ্ম্মা যুগীও যষ্টিহস্তে অগ্রসর হইল এবং উভয়ে ভয়ঙ্কর হুঙ্কার সহকারে যুগপৎ দেওয়ানের প্রতি আক্রমণ করিল। পুরীমধ্যে ক্রন্দনধ্বনি ও চতুর্দ্দিকে হাহাকার শব্দ উঠিল।
গোবিন্দরাম বিপুল বিক্রমের সহিত এ প্রকার ক্ষিপ্রহস্তে যষ্টি সঞ্চালন করিতে লাগিলেন যে, তাহা দেখিয়া দুৰ্দ্দম দস্যু ধর্ম্মার হৃদয়েও ভয়ের সঞ্চার হইল, সে লাঠী ফেলিয়া দিয়া একপার্শ্বে গিয়া বসিল। ভীম সর্দ্দার ও তেওয়ারী তরবারী খুলিয়া চৌকীদারদিগকে আটকাইয়া রাখিল। জমাদার অপমানের ভয়ে, চাকরীর ভয়ে, কিয়ৎক্ষণ যুদ্ধ করিয়া পরাভূত ও আঘাতপ্রাপ্ত হইয়া পড়িয়া গেল। “ভীমে লাঠীগুলো সব জড় করে এইখানে রাখ,” বলিয়া দেওয়ানজী পুনর্ব্বার কাষ্ঠাসনে উপবিষ্ট হইলেন। পুনর্ব্বার খানসামা তামাকু ভরিয়া দিল, গোবিন্দরাম ধূমপান করিতে করিতে গান ধরিলেন
“তারা কোন্ অপরাধে, এ দীর্ঘ মিয়াদে
সংসার-গারদে থাকি বল?”
মুলতান রাগিণীতে গানের এই পদটি মাত্র গাইয়া গোবিন্দরাম দারোগার মুখের দিকে কটাক্ষ করিয়া ঈষদ্ধাস্য সহকারে বলিলেন, “তবে বড় মিঞা! তুমি আমায় দীর্ঘ মিয়াদে গারদে রাখতে চাও না? রাঘবের কতগুলি টাকা খেয়েছ?”
দারোগা। আপনি তবে যাবেন না? যদি একান্ত না যাওয়া হয়, তবে এখানে থেকে আর আমরা কি করব? আমরাও তবে যাই।
দেও। সে কি বড় মিঞা, এখনই যাবেন কি? পা হাত ধুন, দুটা-একটা মোণ্ডা খান, একটু ঠান্ডা হয়ে যাবেন এখন। যাবার জন্য এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আসুন আসুন, এই ঘরে এসে বসুন।
দারোগা সাহেব সদলবলে উৎকণ্ঠিতচিত্তে গবাক্ষবিহীন একটি গৃহমধ্যে উপবেশন করিলেন। ভীম সর্দ্দার দুইটি প্রকাণ্ড কুলুপদ্বারা গৃহদ্বার আবদ্ধ করিয়া দিল।
এমন সময়ে বাহির হইতে গোবিন্দরাম গাইলেন;–
“জানি আমি একদিন ছেড়ে যাবি আত্মারাম।
যখন যাবি গেয়ে যাবি, গগন জুড়ে হরিনাম।
খাঁচা কি পাখীর বাসা, কেন হবে ভালবাসা?
যেখানে তোর ভালবাসা সেই রে তোর নিত্যধাম।”
রুদ্ধগৃহে বসিয়া সদল দারোগা এই গান শুনিল; গান শেষ হইলে, আপন মনে বলিল, “আচ্ছা, থাক বাপু, একদিন আমি তোমার আত্মারামকে খাঁচাছাড়া করিয়া তবে ছাড়িব—আমার নাম ফতেউল্লা।”