ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি প্রস্তাববিরোধী আন্দোলন
১. পাকিস্তান সংবিধান সভায় মূলনীতি নির্ধারক কমিটির সুপারিশ
১৯৪৯ সালের ১২ই মার্চ পাকিস্তান সংবিধান সভার একটি প্রস্তাব অনুযায়ী শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি নির্ধারক কমিটি গঠিত হয়েছিলো। এই কমিটি ১৯৫০ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর সংবিধান সভায় তাঁদের অন্তবর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করেন।[১] এই রিপোর্টে শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে তাঁরা যে সুপারিশ করেন তা হলো নিম্নরূপ।
কেন্দ্রীয় আইনসভা: কেন্দ্রীয় আইন সভায় হাউস অব ইউনিটস্ এবং হাউস অব পিপলস নামে দুটি পৃথক পরিষদ থাকবে। উচ্চ পরিষদ, হাউস অব ইউনিটস, প্রত্যেকটি প্রদেশের সমান সংখ্যক প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হবে। নিম্নপরিষদ হাউস অব পিপলস্ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে। দুই পরিষদের পারস্পরিক ক্ষমতা ও কেন্দ্রীয় শাসনভার-এর বিষয়ে উভয় পরিষদ সমান ক্ষমতার অধিকারী হইবে। কোন বিষয়ে মতবিরোধ উপস্থিত হইলে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে উভয় পরিষদের যুক্ত অধিবেশন আহূত হইবে। বাজেট ও অর্থ সংক্রান্ত বিল উভয় পরিষদের যুক্ত অধিবেশনে আলোচিত হইবে।[২] যুক্ত অধিবেশন আহ্বানের ক্ষমতা থাকবে প্রেসিডেন্টের হাতে। দুই কেন্দ্রীয় পরিষদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তা মীমাংসার জন্যে উভয় পরিষদের যুক্ত অধিবেশন আহ্বান করা হবে। এছাড়া রাষ্ট্রনায়ক নির্বাচন ও অপসারণ এবং মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাবের আলোচনার জন্যেও যুক্ত অধিবেশন আহূত হবে।[৩]
প্রেসিডেন্ট: ফেডারেশনের শাসন কর্তৃত্ব প্রেসিডেন্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং তিনি কেন্দ্রীয় আইন সভার উভয় পরিষদে যুক্ত অধিবেশনে নির্বাচিত হবেন। তাঁর কার্যকাল হবে পাঁচ বৎসর। সশস্ত্র বাহিনীর ওপর প্রেসিডেন্টের সর্বময় কর্তৃত্ব থাকবে। তাছাড়া নির্বাচন পরিচালনা এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করার সর্বপ্রকার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে ন্যস্ত থাকবে। উভয় পরিষদের অধিকাংশ সদস্য দাবী করলে উভয় পরিষদের যুক্ত অধিবেশনে মোট সদস্য সংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ ভোটে প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করা যেতে পারবে।[৪]
প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রনায়ক কর্তৃক প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত হইবেন। জরুরী অবস্থায় কেন্দ্রে রাষ্ট্রনায়কের যে ক্ষমতা থাকিবে প্রদেশে প্রাদেশিক শাসন কর্তারও সেই ক্ষমতা থাকিবে, তবে এই সকল ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপকতায় তিনি রাষ্ট্রনায়কের নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশাধীন থাকিবেন। প্রদেশের মন্ত্রীদের নিয়োগ ও বরখাস্তের ব্যাপারে প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে রাষ্ট্রনায়কের তত্ত্বাবধানে ও নিয়ন্ত্রণাধীনে কাজ করিতে হইবে।[৫]
কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার পারস্পরিক সম্পর্ক: ‘প্রাদেশিক ও সম্মিলিত বিষয়ে তালিকা সম্পর্কে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সমন্বয় সাধনের ক্ষমতা কেন্দ্রের থাকিবে। এই সম্পর্কে কেন্দ্রীয় আইনসভা আইন প্রণয়ন করিতে পারিবেন।’ ‘কেন্দ্রীয় আইনসভা কোন আইন প্ৰণয়ন করিলে পরিচ্ছেদে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসারে আইন প্রণয়ন করিয়া কেন্দ্রীয় আইনসভা ইহা সংশোধিত অথবা বাতিল করিতে পারিবে, কিন্তু যে প্রদেশের উপর এই আইন প্রয়োগ হইবে সেই প্রদেশের আইনসভায় আইন পাস করিয়া সংশোধন ও বাতিল করা চলিবে না। ‘কেন্দ্রীয় আইনসভা ও প্রাদেশিক আইনসভায় প্রণীত আইনের অসামঞ্জস্য বা কোন বৈসাদৃশ্য দেখা দিলে কেন্দ্রীয় আইনসভা প্রাদেশিক আইন সভার উপর প্রাধান্য লাভ করিবে।’ ‘জরুরী অবস্থা ঘোষিত হইলে কেন্দ্র প্রাদেশিক তালিকায় উল্লিখিত যে কোন বিষয়ে আইন প্রণয়ন করিতে পারিবেন।
‘প্রদেশের শাসনক্ষমতা এমনভাবে পরিচালিত করিতে হইবে যাহাতে কেন্দ্রীয় কর্তৃক প্রণীত আইন এবং প্রদেশের প্রচলিত আইনের সহিত উহার সামঞ্জস্য থাকে এবং কেন্দ্রীয় সরকার এ সম্বন্ধে নির্দেশ দেওয়া প্রয়োজন মনে করিলে ফেডারেশনের শাসনক্ষমতা অনুসারে সেই ‘নির্দেশ দান করিবেন।’ ‘প্রত্যেক প্রদেশের শাসনক্ষমতা এনমভাবে পরিচালনা হইবে যাহাতে ফেডারেশনের শাসনব্যবস্থা পরিচালনায় তাহা বাধাস্বরূপ না হইয়া দাঁড়াইতে পারে।’[৬]
জরুরী অবস্থা: কোন বিশেষ অবস্থাকে জরুরী বিবেচনা করে প্রেসিডেন্ট সাময়িকভাবে শাসনতন্ত্র স্থগিত রাখতে পারবেন।[৭]
ক্ষমতাবণ্টন: কেন্দ্র ও প্রদেশসমূহের ক্ষমতা তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা : কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্বাধীন বিভাগ, প্রাদেশিক সরকারের কর্তৃত্বাধীন বিভাগ এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় সরকারের কর্তৃত্বাধীন বিভাগ। তালিকাভুক্ত ক্ষমতা ব্যতীত সমস্ত অবশিষ্ট ক্ষমতা কেন্দ্রের থাকবে।[৮]
প্রধানমন্ত্রী: প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। প্রেসিডেন্ট এমন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করবেন যিনি তাঁর মতো কেন্দ্রীয় আইনসভার উভয় পরিষদের অধিকাংশ সদস্যের আস্থাভাজন। প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ অনুযায়ী মন্ত্রীসভার অপরাপর সদস্য নিযুক্ত করবেন। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীরা কেন্দ্রীয় সরকারের উভয় পরিষদের কাছে সমানভাবে দায়ী থাকবেন।
প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা: প্রাদেশিক পরিষদের অধিকাংশ সদস্যের আস্থাভাজন ব্যক্তিকে প্রাদেশিক শাসনকর্তা প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করবেন। প্রাদেশিক মন্ত্রীরা প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে প্রাদেশিক শাসনকর্তা কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। প্রাদেশিক শাসন কর্তাকর্তৃক কোন মন্ত্রীর নিয়োগ অথবা বরখাস্তের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের করা চলবে না।[১০]
অর্ডিন্যান্স: প্রেসিডেন্ট যে সমস্ত অর্ডিন্যান্স জারী করবেন সেগুলি কেন্দ্রীয় আইনসভার পরবর্তী অধিবেশনে উত্থাপন করতে হবে। আইনসভা অর্ডিন্যান্সের জন্যে নির্দিষ্ট মেয়াদ নির্ধারণ করবেন।[১১]
রাষ্ট্রভাষা: পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।[১২]
২. মূলনীতি নির্ধারক কমিটির প্রভাবের বিরুদ্ধে পূর্ব বাঙলায় বিক্ষোভ
মূলনীতি নির্ধারক কমিটির উপরোক্ত সুপারিশসমূহ এতো নগ্নভাবে অগণতান্ত্রিক এবং পূর্ব বাঙলার প্রতি বৈষম্যমূলক যে মুসলিম লীগ সমর্থক ব্যক্তি ও পত্রপত্রিকাসমূহ, এমনকি মুসলিম লীগের সদস্য পর্যায়ের ব্যক্তিরাও এই সব সুপারিশের বিরুদ্ধে সমালোচনায় অন্যান্যদের মতোই অংশগ্রহণ করেন। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মৌলানা আকরম খাঁ মূলনীতি নির্ধারক কমিটির সদস্য এবং ক্ষমতাসীন দলের একজন পাণ্ডা ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পত্রিকা দৈনিক আজাদ এই সমস্ত সুপারিশের বিরুদ্ধে পর পর কয়েকটি সমালোচনামূলক সম্পাদকীয় প্রকাশ করেন। ৩০শে সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এমনি একটি সম্পাদকীয়তে উচ্চ পরিষদে প্রত্যেক প্রদেশের সমান সংখ্যক প্রতিনিধি থাকা সম্পর্কে বলা হয়:
প্রস্তাব করা হইয়াছে যে, উচ্চ পরিষদে সব প্রদেশেরই সমান সংখ্যক প্রতিনিধি থাকিবে। অর্থাৎ কয়েক লক্ষ অধিবাসীর প্রদেশ বেলুচিস্তানে যতজন প্রতিনিধি উচ্চ পরিষদে থাকিবে চারি কোটি অধিবাসী অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি সংখ্যা সেখানে মাত্র ততজনই থাকিবে। এর চাইতে অন্যায় ব্যবস্থা আর কি হইতে পারে আমরা জানি না। এই প্রস্তাব গৃহীত হইলে উচ্চ পরিষদে চিরদিনের জন্য সংখ্যাগুরু পূর্ব পাকিস্তানকে মাত্র এক পঞ্চমাংশ প্রতিনিধির অধিকার লইয়া সন্তুষ্ট থাকিতে হইবে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থমূলক কোন প্রস্তাব কস্মিনকালেও গৃহীত হইবে না।
ঐ একই বিষয়ে ২রা অক্টোবর দৈনিক আজাদ অন্য একটি সম্পাদকীয়তে বলে :
প্রস্তাবিত দুইটি সভা সম্পূর্ণ গণতন্ত্র বিরোধী ও একান্তভাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের পক্ষে হানিকর। প্রথমতঃ, এই প্রস্তাব করিয়া যুগধর্মকে অস্বীকার করা হইয়াছে। এই যুগে একটি উচ্চতর আইনসভা গঠনের বিরুদ্ধে সকল গণতান্ত্রিক দেশের প্রবণতা দেখা দিয়াছে। কারণ উহা অহেতুক, অবান্তর এবং অপ্রয়োজনীয় একটি শাসনতান্ত্রিক বিলাস ভূষণ ছাড়া কিছুই নয়। শ্বেতহস্তী পোষণের এই বিরাট ব্যয় বহনের দায়িত্ব জনসাধারণ আজ কোন দেশেই বহন করিতে চায় না। সব চাইতে মারাত্মক কথা হইলো—উচ্চতর সভাও সমান ক্ষমতার অধিকার পাইবে। এখানে পূর্ব পাকিস্তান আজ সমূহ বিপদের আশঙ্কা করিতেছে। জনসংখ্যার ও গণতান্ত্রিকতার স্বাভাবিক অধিকারে পূর্ব পাকিস্তান একক নিম্ন পরিষদে সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রভৃতি দেশের সম্মিলিত আসন সংখ্যার চাইতে বেশী আসন লাভ করিবে। উচ্চ পরিষদে প্রতি প্রদেশের সমান আসন লইয়া সমান ক্ষমতার অধিকারী হইলে নিম্ন পরিষদের ক্ষমতাকে ইহা অনায়াসেই অর্থহীন ও ব্যর্থ করিয়া ফেলিবে। এইখানে পূর্ব পাকিস্তানকে জবেহ করিবার সব চাইতে বড় ভয় রহিয়াছে।
এরপর ৪ঠা অক্টোবর দৈনিক আজাদ উচ্চ পরিষদের প্রসঙ্গে উল্লেখ করে অপর একটি কঠোরতর সম্পাদকীয়তে বলে:
উচ্চ পরিষদের পরিকল্পনা গৃহীত হইলে পূর্ব পাকিস্তান একটা কলোনীতে পরিণত হইবে এবং পূর্ব পাকিস্তানীরা নিজ দেশে পরবাসীর জীবনযাপন করিতে বাধ্য হইবে। মনে হয় উহা (খসড়া তদন্ত) রচনা করার সময় তাঁদের চোখে ভাসিতেছিলো কোন নগরের মিউনিসিপ্যাল স্বায়ত্তশাসনের স্বরূপ। তাঁরা প্রদেশকে একটি মিউনিসিপ্যালিটি ছাড়া অধিক ক্ষমতা দিতে রাজী হইতে পারেন নাই। গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র রচনার নামে এত বড় পুকুর চুরির ব্যাপার আর কখনও কোথায় হইয়াছে কিনা আমাদের জানা নাই। কেন্দ্রের হাতে যে ব্যাপক ক্ষমতা ন্যস্ত করার প্রস্তাব এই খসড়ায় করা হইয়াছে তাহা গৃহীত হইলে পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের ক্ষমতা সেরূপ খর্ব হইয়া থাকুক বা না থাকুক, পূর্ব পাকিস্তান একেবারে ঠুটো জগন্নাথে পরিণত হইবে। পূর্ব পাকিস্তানবাসীরা তা মানিয়া লইয়া আত্মহত্যা বরণ করিতে পারে না।
কেন্দ্র ও প্রদেশের পারস্পরিক সম্পর্ক মূলনীতি নির্ধারক কমিটি যেভাবে নির্ধারণের সুপারিশ করেন সে বিষয়ে ৬ই অক্টোবর অপর একটি সম্পাদকীয়তে দৈনিক আজাদ বলে:
বস্তুতঃ পাকিস্তানের রাষ্ট্রকর্তা ও প্রধানমন্ত্রী মিলিয়া এই শাসন ব্যবস্থায় নিরুদ্বেগে যথেচ্ছাচারী শাসন কায়েম করিতে পারিবেন। পাকিস্তান যে আজাদীর স্বপ্ন দেখিয়াছিল এবং গণতন্ত্রের যে আদর্শ গ্রহণ করিয়াছিল তাহার কোন ছাপ প্রস্তাবিত শাসনব্যবস্থায় নাই। উক্ত ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের ধ্বংসস্তূপের উপর একটি ফ্যাসিষ্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত করার আয়োজন চলিয়াছে। মূলনীতি নির্ধারক কমিটির সুপারিশগুলি পূর্ব বাঙলায় কতখানি তীব্র অসন্তোষ ও বিক্ষোভ সৃষ্টি করেছিলো মুসলিম লীগের চির-সমর্থক ও মুসলিম লীগের একজন উচ্চতম নেতার- মালিকানাধীন পত্রিকা দৈনিক আজাদ এর উপরোক্ত মন্তব্যসমূহকে তার একটা মাপকাঠি হিসেবে ধরা যায়। শুধু পূর্ব বাঙলাতেই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানেও এই সব সুপারিশের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ব্যাপক সমালোচনা ও বিক্ষোভ শুরু হয়। ২রা অক্টোবর লাহোর থেকে প্রকাশিত জমিদার এই সুপারিশগুলি সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে বলে:
বৃটিশ ও আমেরিকার শাসনতন্ত্রে গণতন্ত্রের যে আঁচ পাওয়া যায় এই প্রস্তাবে তাহাও রক্ষিত হয় নাই। এই সকল প্রস্তাব ১৯৩৫ সালে রচিত ভারত শাসন আইনের চেয়েও প্রতিক্রিয়াশীল বলিয়া আমাদের অভিমত।
মুসলিম লীগকে সীমিতভাবে সমর্থন দানকারী সিলেট থেকে প্রকাশিত তৎকালীন পূর্ব বাঙলার সব থেকে উল্লেখযোগ্য সাপ্তাহিক নওবেলাল ৫ই অক্টোবর উপরোক্ত সুপারিশসমূহ সম্পর্কে সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেন:
তিন বৎসরের ঊর্ধ্বকাল যাবত কোশেষ করার পর পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সম্পর্কে মূলনীতি নির্ধারণ কমিটি বিগত ২৮শে সেপ্টেম্বর পাক-গণপরিষদে তাহাদের অসম্পূর্ণ রিপোর্ট পেশ করিয়াছেন। এই রিপোর্ট পাঠক মাত্রকেই পর্বতের মূষিক প্রসবের কথা স্মরণ করাইয়া দিবে এবং গণতন্ত্রের অভূতপূর্ব রূপ দর্শনে অপার বিস্ময়ে বিমূঢ় চিত্তে তাহারা প্রশ্ন করিবে ইহাই কি বহু বিঘোষিত ইসলামী গণতন্ত্রের নমুনা।’
খসড়া রিপোর্টে রাষ্ট্রের কর্ণধার নির্বাচন কেন্দ্রের উভয় পরিষদের সদস্যদের উপর ছাড়িয়া দেওয়ার, প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীসভার উপর অনাস্থা প্রস্তাব উভয় পরিষদের মিলিত সভা ব্যতিরেকে বেআইনী করার, উচ্চ পরিষদ অর্থাৎ হাউস অব ইউনিটসের প্রতিনিধি সংখ্যা জনসংখ্যার সহিত সম্পর্কহীনভাবে সকল প্রদেশের জন্য সমান করার এবং উচ্চ ও নিম্ন পরিষদকে সমান ক্ষমতাসম্পন্ন করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। তাহা ছাড়া রাষ্ট্রের কর্ণধারকে বিধিবদ্ধভাবে অবাধ ক্ষমতার অধিকারী করার প্রস্তাব করা হইয়াছে কিন্তু সেই ক্ষমতার অপব্যবহার হইতে তাহাকে প্রতিরোধ করিবার ক্ষমতা জনগণের প্রতিনিধিদের নানা কৌশলে বঞ্চিত করার আয়োজন করা হইয়াছে।
খসড়া রিপোর্টের বিরুদ্ধে সারা পাকিস্তানব্যাপী যে তুমুল প্রতিবাদ উঠিয়াছে আমরাও সেই সঙ্গে সুর মিলাইতেছি। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যে সাম্রাজ্যবাদীসুলভ বিধানের প্রস্তাব করা হইয়াছে তাহা পূর্ব পাকিস্তানবাসীরা কিছুতেই মানিয়া লইবে না একথা সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যেকটি সংবাদপত্র ও প্রতিষ্ঠান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাইয়াছে। যে জনগণ পাকিস্তান অর্জন করিতে পারিয়াছে, তাহারা তাহাদের অধিকার রক্ষা করিতে পিছাইয়া যাইবে না এ সত্য নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করিলে মঙ্গলের পথেই আগাইয়া যাইবেন। এখনও সময় সম্পূর্ণ অতিবাহিত হইয়া যায় নাই। মঙ্গলের পথে আগাইয়া আসুন, এই আহ্বানই আমরা জানাইতেছি।
শাসনতন্ত্র সম্পর্কে মূলনীতি নির্ধারক কমিটির সুপারিশ ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখার জন্যে গণপরিষদের বাঙালী সদস্যেরা আরও সময় চাওয়ায় কমিটির রিপোর্টটি পরিষদে উত্থাপন স্থগিত রাখা হয় কিন্তু মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত রিপোর্টটি পরিষদে গৃহীত হয়।[১৩]
‘কেবলমাত্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ হুমকী অথবা গুরুতর জরুরী অবস্থা ব্যতীত হাইকোর্টে কোন নাগরিক কর্তৃক হেবিয়াস কর্পাসের আবেদনের অধিকার স্থগিত রাখা হবে না’—এই ধারা সম্পর্কে পাঞ্জাবের মিঞা ইফতেখারউদ্দীন ও শওকত হায়াত খান একটি সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। তাঁদের প্রস্তাবটিতে কোন নাগরিককে বিনা বিচারে আটক রাখার ব্যবস্থার বিরোধিতা করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ ভোটে তাঁদের এই সংশোধনী প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।[১৪]
‘মৌলিক অধিকার’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয়তে নওবেলাল এ সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে বলে: বিনা বিচারে কোন নাগরিককেই আটক রাখা যাইবে না, ইহা তাহার সর্ববাদী স্বীকৃত অধিকার। তাহাকে এই অধিকার হইতে বঞ্চিত করিতে হইলে যথেষ্ট সঙ্গত কারণ থাকা প্রয়োজন।
কিন্তু জাতীয় জরুরী অবস্থার ভাওতা দেখাইয়া এই মৌলিক অধিকার খর্ব করার ক্ষমতা কোন আজাদীপ্রিয় জাতিই কাহারও হাতে ছাড়িয়া দিতে পারে না। কারণ, সে ক্ষেত্রে তাহার স্বাধীন সত্তার ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করা হইবে।[১৫]
মূলনীতি নির্ধারক কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিলো। তা সত্ত্বেও ৫ই অক্টোবর ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে আব্দুল জব্বারের সভাপতিত্বে শাসনতন্ত্রের সুপারিশ আলোচনার জন্যে একটি ছাত্র সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে বক্তারা এই সুপারিশের তীব্র সমালোচনা করেন। কমিটি রিপোর্টের বিরুদ্ধে কয়েকটি প্রতিবাদমূলক প্রস্তাব এই সভায় গৃহীত হয়।[১৬]
‘গণতান্ত্রিক কনফেডারেশন প্রতিষ্ঠা কর্মপরিষদ’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান এই সময় গঠিত হয় এবং তাঁদের আহ্বানে ১৩ই অক্টোবর বৈকালে আরমানীটোলা ময়দানে মূলনীতি নির্ধারক কমিটির সুপারিশের প্রতিবাদে একটি জনসভা আহ্বান করা হয়। এই উপলক্ষ্যে উপরোক্ত কর্মপরিষদ একটি ইস্তাহার প্রকাশ করেন। তাতে লোক পরিষদ ও উচ্চ পরিষদের প্রতিনিধিত্ব ও ক্ষমতা, প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রী পরিষদের ক্ষমতা, প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে কমিটির সুপরিশসমূহের কঠোর সমালোচনা করা হয়। ইস্তাহারটিতে মুসলিম লীগের চক্রান্ত সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করতে গিয়ে বলা হয়:
বিগত তিন বৎসরে পাকিস্তান পার্লামেন্ট ও গণপরিষদে কে আসিতেছেন, কে বরখাস্ত হইতেছেন, আর কে কে চলিয়া যাইতেছেন এ সব ব্যাপার দেশের জনসাধারণ অজ্ঞাত। এ সব ব্যাপারে জনসাধারণকে সম্পূর্ণ দূরে রাখিয়া এবং তাহাদের রায়ের অপেক্ষা না করিয়া জোটবদ্ধ কতিপয় কোটারীর পরোক্ষ নির্বাচনে যাহারা নির্বাচিত হইয়াছে, তাহারাই ভবিষ্যতের জন্য জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার অপহরণের এই চেষ্টা করিতেছে। এই রিপোর্ট কার্যকরী হইলে বিপুল সংখ্যাগুরুর পূর্ববঙ্গ শাসক গোষ্ঠির উপনিবেশে পরিণত করিবে। হয়তোবা এমন একদিন আসিবে, যে দিন বিপুল ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রপতি সময় বুঝিয়া দুই একজন প্রধানকে হাত করিয়া মধ্য প্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলির ন্যায় বিদেশীর সাহায্যে পাকিস্তানকে রাজতন্ত্রের কুখ্যাত জুয়ালে জুড়িয়া দিবে।…
উপরোক্ত কোণঠাসা পরিবেশের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানকে ও অন্যান্য প্রদেশকে মিউনিসিপ্যালিটিতে পরিণত করিবার ষড়যন্ত্র চলিতেছে। জমিদারী, জায়গীরদারী প্রথা, শিল্প ও বিদেশী পুঁজির প্রতিষ্ঠান বিনা খেসারতে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত করা যাইবে, শোষণের বিরুদ্ধে জনসাধারণ কোন প্রতিবাদের আওয়াজ তুলিতে পারিবে না, কমিটির সুপারিশে তাহারও ব্যবস্থা করা হইয়াছে।
মূলনীতি নির্ধারক কমিটির ভাষা বিষয়ক সুপারিশের উল্লেখ করে ইস্তাহারটিতে আন্দোলনের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়:
আরও আক্ষেপের বিষয় এই যে, পাকিস্তানের শতকরা ৬২ জন অধিবাসীর সমৃদ্ধিশালী ও বলিষ্ঠ বাংলা ভাষা—যাহা পৃথিবীর ভাষা ও সাহিত্যের আসরে ৭ম স্থান অধিকার করিয়াছে, এমন ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা না করিয়া যাহা পাকিস্তানের কোন প্রদেশেরই ভাষা নহে, এমন একটা বিদেশী ভাষা উর্দুকেই রাষ্ট্রীয় ভাষা করার সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে। উপরোক্ত মূলনীতির সন্দেশ দেখাইয়াই পূর্ববঙ্গকে সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণের ক্ষেত্র করার যে ষড়যন্ত্র চলিতেছে তার বিরুদ্ধেই আজ দেশের গণতান্ত্রিক জনসাধারণ, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র সমাজ ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের সময় আসিয়াছে। পাকিস্তান অর্জনের জন্য দেশময় যে আন্দোলন গড়িয়া উঠিয়াছিলো বর্তমান পরিস্থিতিতে তাহার চাইতেও শতগুণ বেশী জোরদার আন্দোলন প্রয়োজন। আজ প্রশ্ন স্বদেশে মীমাংসার জন্যই আগামী ১৩ই অক্টোবর শুক্রবার বিকাল ৪টায় স্থানীয় আরমানীটোলা ময়দানে একটি বিরাট জনসমাবেশের আয়োজন করা হইয়াছে। দেশের ভ্রাতা ভগ্নিগণকে এই সভায় যোগদান করিয়া সমস্বরে আওয়াজ তুলিতে হইবে –‘পাকিস্তানে ফ্যাসিস্ট শাসনতন্ত্র চাই না’, ‘একনায়কত্ব ধ্বংস হউক’, ‘মূলনীতি নির্ধারক কমিটির সুপারিশ বাতিল চাই’, ‘কনফেডারেশন চাই’, পূর্ববঙ্গের গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে হইবে।
১৩ই অক্টোবর বৈকালে আরমানীটোলা ময়দানে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে বক্তৃতা করেন হাফিজুর রহমান, শামসুদ্দীন আহমদ (কুষ্টিয়া), খয়রাত হোসেন, রফিক, আব্দুল ওদুদ ও শাসসুল হুদা। কতকগুলি প্রতিবাদমূলক প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং সেগুলি উত্থাপন করেন কমরুদ্দীন আহমদ। সভায় ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট অংশের সমাবেশ ঘটে।[১৭]
শুধু ঢাকাতেই নয় পূর্ব বাঙলার সর্বত্র মূলনীতি কমিটির রিপোর্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উত্থাপিত হয় এবং জনমত দ্রুতগতিতে সংগঠিত হতে থাকে। ছাত্র শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী এমনকি মুসলিম লীগ পন্থী, জমিয়ত উল ওলামায়ে ইসলাম সমর্থক প্রভৃতিরা পর্যন্ত ব্যাপকভাবে এই সুপারিশসমূহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগঠিত করার জন্যে এগিয়ে আসেন।[১৮]
এই অবস্থায় করাচী থেকে ঢাকা ফিরে এসে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি মৌলানা আকরম খাঁ মূলনীতি কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে পূর্ব বাঙলার প্রতিবাদকে “মতলববাজদের কারসাজী” হিসেবে আখ্যায়িত করে একটি সংবাদপত্র বিবৃতি প্রদান করেন। তাঁর এই উষ্মার অতিরিক্ত কারণ এই ছিলো যে, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমান ২৭শে অক্টোবর কমিটি রিপোর্টের বিরুদ্ধে প্রদেশব্যাপী একটি ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি মৌলানা আকরম খাঁ একটি পৃথক বিবৃতিতে প্রাদেশিক সম্পাদকের প্রতিবাদ দিবস-এর এই আহ্বানকে বেআইনী ঘোষণা করে জনসাধারণকে তাতে অংশ গ্রহণ না করার পরামর্শ দেন। এর পর শাহ আজিজুর রহমান তার দিবস পালনের আহ্বান প্রত্যাহার করে একটি বিবৃতি প্রদান করেন এবং তাতে বলেন যে, একটি জরুরী সভা আহ্বান করার জন্যে তিনি প্রাদেশিক লীগ কাউন্সিলের প্রায় সকল সদস্যের নিকট থেকে অনুরোধ পত্র পেয়েছেন এবং সেই অনুযায়ী মৌলানা আকরম খাঁর উচিত শাসনতন্ত্রের মূলনীতি প্রস্তাব সম্পর্কে মতামত দানের মৌলিক অধিকার থেকে মুসলিম লীগ কাউন্সিল সদস্যদেরকে বঞ্চিত না করা। সভাপতি আকরম খাঁ সম্পাদকের এই বিবৃতির জবাবে কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান না করে ২৯শে অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনের বাস-ভবনে প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা আহ্বান করেন। [১৯]
১৭ অক্টোবর বৈকালে সরকার সমর্থক ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের উদ্যোগে ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কে মূলনীতি কমিটির রিপোর্টের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাটিতে ঢাকার বুদ্ধিজীবীরা যথেষ্ট সংখ্যায় উপস্থিত থাকেন। আওয়ামী লীগ সম্পাদক শামসুল হক, আতাউর রহমান খান, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, মানিক মিয়া, মুস্তাক আহমদ প্রভৃতিও শ্রোতা হিসাবে সেখানে উপস্থিত থাকেন।[২০]
মূলনীতি নির্ধারক কমিটির সুপারিশসমূহ তৎকালে পূর্ব বাঙলার সর্বস্তরের জনগণকে কিভাবে আলোড়িত ও বিক্ষুব্ধ করেছিলো নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের মতো একটি প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র প্রতিষ্ঠানের এই প্রতিবাদ সভা এবং সেই সভায় সরকার বিরোধী পক্ষের এই সমস্ত ব্যক্তিদের উপস্থিতি থেকেই তা প্রমাণিত হয়।
মূলনীতি কমিটির সুপারিশ উদ্ভূত শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নাবলী বিবেচনার জন্যে পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদের বহুসংখ্যক মুসলিম লীগ সদস্য মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা নূরুল আমীনের কাছে পরিষদের একটি জরুরী অধিবেশন আহ্বান করার অনুরোধ জ্ঞাপন করেন।[২১]
অবকাশের পর ৩১শে অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয় এবং ঐদিনই বেলা ১- ৫০ মিনিট থেকে ৩টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মহম্মদ নূরুল ইসলামের সভাপতিত্বে মূলনীতি নির্ধারক কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে ছাত্রদের একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সৈয়দ মহম্মদ আলী, আব্দুল ওদুদ, মৌলানা নূরুল ইসলামসহ কয়েকজন বক্তৃতা করেন এবং প্রস্তাব উত্থাপন করেন মাহবুব জামাল জাহেদী। সভায় মূলনীতি সংক্রান্ত সুপারিশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগঠনের উদ্দেশ্যে একটি ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।[২২]
৩. জাতীয় মহাসম্মেলন
২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৯৫০ মূলনীতি নির্ধারক কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার রাজনৈতিক মহলে যথেষ্ট চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় এবং কর্মতৎপরতা দেখা দেয়। সারা পাকিস্তান, বিশেষতঃ পূর্ব বাঙলার ওপর একটি সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র চাপিয়ে দেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে সারা দেশব্যাপী যে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুরু হয় তাকে একটি সংগঠিত এবং ঐক্যবদ্ধ রূপ দানের জন্যে ঢাকার সকল স্তরের প্রতিনিধিত্বমূলক নাগরিকদের সমন্বয়ে এক সংগ্রাম কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান অবজার্ভার অফিসে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে একটি সভা হয়। এই সভায় ‘ডেমোক্রেটিক ফেডারেশনের সংগ্রাম কমিটি’[২৩] নামে একটি সংগঠন গঠিত হয় এবং এই সংগঠনটিই মূলনীতি সুপারিশ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে সংগ্রাম কমিটির ভূমিকা পালন করে।[২৪] ডেমোক্রেটিক ফেডারেশনের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। এছাড়া মূলনীতি নির্ধারক কমিটির সুপারিশের একটি বিকল্প শাসনতন্ত্রের খসড়া তৈরীর উদ্দেশ্যে ‘সংবিধান কমিটি’ নামে তাঁরা আরও একটি পৃথক কমিটি গঠন করেন।
১২ই অক্টোবর বেলা ১১টায় পাকিস্তান অবজার্ভার অফিসে সংগ্রাম কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে কমরুদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান, মহম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ, রফিক, আব্দুস সালাম (পাকিস্তান অবজার্ভারের সম্পাদক), মানিক মিয়া প্রভৃতি উপস্থিত থাকেন। এই বৈঠকে তাঁরা পর দিনের অর্থাৎ ১৩ই অক্টোবর তারিখে আরমানীটোলা ময়দানে তাঁদের দ্বারা আহূত জনসভা সংক্রান্ত বিষয়ে আলাপ করেন। এছাড়া ঐক্যফ্রন্ট গঠনের উদ্দেশ্যে মুসলিম লীগের সাথে আলোচনার সিদ্ধান্তও তাঁরা এই বৈঠকে গ্রহণ করেন।[২৫]
৪ঠা ও ৫ই নভেম্বর তারিখে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্ন বিবেচনার জন্যে ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন একটি জাতীয় মহাসম্মেলন আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেন। এই সম্মেলনে মূলনীতি নির্ধারক কমিটির পাল্টা একটি শাসনতন্ত্র পেশ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই অনুযায়ী ১৭ই অক্টোবর থেকে ২৮শে অক্টোবর প্রতিদিনই সাখাওয়াৎ হোসেনের বাসভবনে শাসনতান্ত্রিক কমিটির বৈঠক চলতে থাকে। এই সমস্ত বৈঠকে কমরুদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান, তাজউদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আব্দুস সালাম, সাখাওয়াৎ হোসেন নিয়মিত উপস্থিত থাকেন। মাঝে মাঝে যারা উপস্থিত থাকেন তাঁদের মধ্যে কফিলউদ্দীন চৌধুরী, জহিরুল হক, শামসুর রহমান (জনসন), আবুল কাসেম (তমদ্দুন মজলিশ), মানিক মিয়া, রফিক, ঠাণ্ডা মিয়া, ইদরিস, হাবিবুর রহমান ওদুদ, মহীউদ্দীন, মীর্জা গোলাম হাফেজ, আজিজ আহমদ, শামসুজ্জোহা, এমএ রহিম ও এন ইসলামের নাম উল্লেখযোগ্য।[২৬]
সাখাওয়াৎ হোসেনের বাসভবনে ১লা নভেম্বর সন্ধ্যাবেলায় সংগ্রাম কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে সর্বাপেক্ষা অধিক সংখ্যক কমিটির সদস্য উপস্থিত থাকেন এবং ৪-৫ নভেম্বরের জাতীয় মহাসম্মেলনের বিভিন্ন সমস্যা ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেন। সম্মেলনের প্রেসিডিয়াম সম্পর্কে ৪৮ ভোটে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো আতাউর রহমান খান তাকে মেনে নিতে অস্বীকার করায় এই বৈঠকে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত আতাউর রহমান খানের অনমনীয় মনোভাবের জন্যে প্রেসিডিয়াম সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। সিদ্ধান্ত এইভাবে বাতিল করায় বিক্ষুদ্ধ হয়ে অলি আহাদ উত্তেজিত ভাষায় প্রতিবাদ করেন এবং সংগ্রাম কমিটি থেকে তৎক্ষণাৎ পদত্যাগ করেন।[২৭]
ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন কর্তৃক প্রকাশিত শাসনতন্ত্রের মূল খসড়াটি সাধারণভাবে সংগ্রাম কমিটিতে গৃহীত হলেও তার কতকগুলি সংশোধনী মহাসম্মেলনে বিবেচনার জন্যে কমিটির কাছে দেওয়া হয় এবং ৪ঠা নভেম্বর সকালে কমরুদ্দীন আহমদ সেগুলির চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করেন।[২৮]
‘জনাব লিয়াকত আলী খান নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলির জবাব দেবেন কি?’—এই শীর্ষক একটি ইস্তাহার জাতীয় মহাসম্মেলন উপলক্ষে ডেমোক্রেটিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক প্রচারিত হয়।[২৯] এবং তাতে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নাবলীসহ পূর্ব বাঙলার সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে খোলাখুলিভাবে নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলি করা হয়:
১. পাকিস্তানের ভিত্তি হচ্ছে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব যার মধ্যে বিভিন্ন এলাকার জন্যে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের কথা আছে কিন্তু তা সত্ত্বেও মূলনীতি কমিটির সুপারিশসমূহে সেই সমস্ত নীতিকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করা হয়েছে কেন?
২. আপনি কি স্বীকার করেন না যে, পূর্ব পাকিস্তান অন্য অংশটি থেকে দুই হাজার মাইল বৈদেশিক ভূখণ্ডের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে তার স্থায়িত্ব ও সমৃদ্ধির জন্যে সর্বক্ষেত্রে তার পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসন থাকা দরকার?
৩. আদর্শ প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে, জনগণই সার্বভৌমত্বের মালিক। রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক সংবিধান স্থগিত রাখার ব্যবস্থা কি আদর্শ প্রস্তাবের মূল ভিত্তিকেই নাকচ করে জনগণকে রাষ্ট্রপ্রধানের খামখেয়ালীর অধীনস্থ করে দেয়নি?
৪. সংবিধান স্থগিত রাখার ক্ষমতা যেহেতু রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের মধ্যে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রবণতা সৃষ্টিরই একটি ব্যবস্থা সেজন্যে আপনি কি স্বীকার করেন না যে, তার দ্বারা জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা ভয়ংকরভাবে বিপন্ন হয়ে পড়বে?
৫. মধ্যযুগীয় সমাজব্যবস্থার নিদর্শন একটি উচ্চ পরিষদ সৃষ্টি এবং আইন সভার দুই পরিষদকেই সমান ক্ষমতা প্রদানের অর্থ কী? সংখ্যাগরিষ্ঠকে সংখ্যালঘিষ্ঠে পরিণত করা এবং সর্ব প্রকার প্রগতিশীল আইন প্রণয়নকে বাধা দেওয়াই কি তার উদ্দেশ্য নয়?
৬. বাংলা ভাষার দাবীকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ কি জনসংখ্যার শতকরা বাষট্টি ভাগের দাবীকে স্বেচ্ছাচারী ও বেপরোয়াভাবে লঙ্ঘন করা নয়?
৭. প্রাদেশিক মন্ত্রীসভাকে প্রাদেশিক পরিষদের কাছে দায়ী না করে তাকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিষদের কাছে দায়ী করার ব্যবস্থা কি সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক নয়?
৮. আপনি কি স্বীকার করেন না যে, বিনা বিচারে আটক ব্যক্তিদের হেবিয়াস কর্পাসের অধিকার স্থগিত রাখার ব্যবস্থা গণতন্ত্রের যে কোন ধারণার সাথে সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যহীন?
৯. আপনি কি স্বীকার করেন না যে, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত বিষয়ের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র কর্তৃক দখল জনগণের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে, অপরাপর ক্ষেত্র ছাড়াও, নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে মারাত্মক ফলাফল সৃষ্টি করেছে?
১. ক. পাটের আয় অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। ১৯৪৮ সালে ১৪৪ কোটি, ১৯৪৯ সালে ৭৫ কোটি এবং ১৯৫০ সালে মাত্র ৩৫ কোটি?
খ. উৎপাদকদের প্রাপ্য পাটের মূল্য কমে গেছে, নির্দিষ্ট নিম্নতম মূল্য থেকে অনেক কম—পূর্ব বাঙলায় মণপ্রতি যেখানে ১২ টাকা সেখানে সীমান্তের অপর পারে তা বিক্রী হচ্ছে মণপ্রতি ৫৫ টাকায়।
গ. জুট বোর্ড কি উৎপাদকদের পরিবর্তে ইস্পাহানী ও হারুণদের স্বার্থই রক্ষণাবেক্ষণ
করে না?
২. সুপারীর মূল্য মণপ্রতি ৭৫ টাকা থেকে হ্রাস পেয়ে ১০ টাকায় দাঁড়িয়েছে যেখানে ভারতীয় ইউনিয়নে তা বিক্রী হচ্ছে ৯০ টাকা দরে।
৩. কেন্দ্র কর্তৃক সর্বপ্রকার রাজস্ব নিজের হাতে নিয়ে নেওয়ার ফলে প্রাদেশিক সরকার ব্যয় বহনে অক্ষম হওয়ায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সম্পূর্ণভাবে ধসে পড়েছে।
৪. সরকারের ভ্রান্ত আমদানী রপ্তানী নীতির ফলে গেঞ্জী, চিরুণী, শাঁখা ও বোতাম তৈরীর এবং পিতল ও কাঁসার একদা-বর্ধিষ্ণু কুটীর শিল্পসমূহের উন্নতি হচ্ছে না।
৫. চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নকে অবহেলা করে পূর্ব বাঙলাকে ভারতীয় ইউনিয়নের উপর নির্ভরশীল রাখা হয়েছে এবং তার ফলে জনগণের শিল্প ও বাণিজ্যিক জীবন গুরুতরভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় কমিটি
ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন
৪ঠা নভেম্বর বিকেল ৫টায় ঢাকা বার লাইব্রেরী হলে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে জাতীয় মহাসম্মেলন শুরু হয়। প্রায় চারশত প্রতিনিধি এই সম্মেলনে উপস্থিত থাকেন।[৩০] বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিনিধিরা যোগদান করলেও তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন ঢাকায় বসবাসকারী।[৩১] রাত্রি ৯-৩০ মিঃ পর্যন্ত অধিবেশন চলে এবং মূলনীতি খসড়ার দ্বিতীয় পর্ব এই অধিবেশনেই শুরু হয়।[৩২]
সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে সভাপতি আতাউর রহমান খান এক দীর্ঘ লিখিত ভাষণ প্ৰদান করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণটিতে তিনি পূর্ব বাঙলার তৎকালীন পরিস্থিতিতে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নসমূহের ওপর সম্মেলনের পক্ষ থেকে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে বলেন:
সংবিধান পরিষদের মূলনীতি নির্ধারক কমিটির সাব-কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার এবং পরিষদ কর্তৃক মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত সুপারিশ গৃহীত হওয়ার পর সারা দেশব্যাপী তা যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও সার্বজনীন বিক্ষোভ সৃষ্টি করেছে সে বিষয়ে আপনারা অবগত আছেন। অগণতান্ত্রিক ও অনৈসলামিক এবং শাসকচক্র কর্তৃক স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করে জনগণকে দাসশৃঙ্খলে আবদ্ধ করার সহায়ক হিসেবে সর্বস্তরের জনগণ একবাক্যে এই নীতিগুলির নিন্দা করেছেন। জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবী দাওয়াকে দাবিয়ে রেখে ওপরতলার অল্প কয়েকজনের স্বার্থে স্বৈরাচারী শাসনকে কায়েম রাখার এই নীতিসমূহকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে।
পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিলো সেই জনগণের আত্মত্যাগের দ্বারা যারা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার জন্যে লড়াই করেছিলেন। সকল প্রকার বন্ধন থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বপ্নের দ্বারাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্যেই তাঁরা দেখেছিলেন তাঁদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন এবং তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা। জাতির পিতা –যার অতুলনীয় নেতৃত্বে দশ কোটি মুসলমান স্বাধীনতার লড়াইয়ে এক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তিনি এই উৎপীড়িত জনগণের এমন একটি আবাসভূমির স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে তাঁরা জীবনের একান্ত প্রয়োজনীয় সব কিছু পেয়ে মানুষের মতো জীবনযাপন করবে।
কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বল্পকালের মধ্যেই সমস্ত প্রেরণা ধোঁয়ার মতো উড়ে যেতে লাগলো। সমস্ত উচ্চ আশা ও আকাঙ্ক্ষা ছিন্নভিন্ন হতে শুরু করলো এবং জনগণ হতবুদ্ধি হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলেন কায়েদে আজমের স্বপ্নের পরিণতি কি দাঁড়ালো। মহান নেতা তাঁর জনগণের জন্যে এই পাকিস্তান নিশ্চয়ই চাননি। কিন্তু নেতা আর নেই এবং জনগণের ক্রন্দন এখন কে শুনবে?
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী ক্রমাগতভাবে করা হচ্ছে। যে সমস্ত ‘ল্যাম্পপোস্ট’দেরকে[৩৩] পাকিস্তান প্রশ্নের ওপর নির্বাচনের মাধ্যমে পরিষদে পাঠানো হয়েছিলো তাঁরা আর জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। বিভিন্ন পরিষদের সদস্য থাকার অধিকার তাঁদের বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। পাকিস্তানকে একটি সমৃদ্ধিশালী ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে প্রয়োজন ছিলো নতুন একদল সৎ ও স্বাধীন, মুক্ত ও সচেতন ব্যক্তি। কিন্তু তা হলো না। কিন্তু যতদিন সম্ভব নিজেদের হাতে ক্ষমতা রাখার জন্যে সরকার জনগণের দাবীর প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপ না করে সেগুলিকে রাষ্ট্রবিরোধী বলে আখ্যায়িত করলো। সেই পুরাতন, অথর্ব ও অযোগ্য ‘ল্যাম্পপোস্টরাই’ এখনো পর্যন্ত বহাল রয়েছে।
স্বাধীনতার পরই যে সংবিধান পরিষদ নির্বাচিত হয়েছিলো সেটা ছিলো একটা জোড়তালি দেওয়া ব্যবস্থা। এর কোন আইনগত অথবা প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্র ছিলো না এবং যদিও মূলতঃ তা পাকিস্তানের জন্যে একটি সংবিধান প্রণয়নের জন্যেই সৃষ্টি হয়েছিলো তবু দীর্ঘ তিন বৎসরে এরা সে বিষয়ে কিছুই করেনি এবং সুবিধামতোভাবে সংশোধিত হয়ে ১৯৩৫ সালের সেই পুরাতন ভারত শাসন আইনই এখনো পর্যন্ত পাকিস্তানের সংবিধান হিসেবে চালু রয়েছে।
আমাদের এই তিন বৎসরের স্বাধীন জীবন দেশ যেভাবে উন্নতি করা উচিত ছিলো সেভাবে করেনি। যাঁরা উজ্জ্বল দিন এবং সূর্যালোকের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা সম্পূর্ণভাবে মোহমুক্ত হয়েছেন। অনাহার ও মৃত্যুর মুখেও আশাবাদের যে গভীর চেতনা মানুষকে সজীব রেখেছিলো তার স্থান দখল করছে ভবিষ্যতের একটা হতাশাগ্রস্ত চিত্র এবং আশাভঙ্গের চেতনা। দেশের সব থেকে জরুরী ও গুরুতর সমস্যাসমূহ শুধু যে সমাধান হয়নি তাই নয়, উপরন্তু সেগুলি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আরও প্রকট ও নিয়মিত হচ্ছে। রাষ্ট্রের শিশুত্বের নামে কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা এখনো পর্যন্ত যথাযথভাবে নেওয়া হয়নি যদিও বিপুল পরিমাণ জনগণের অর্থ প্রতিমাসে বিদেশে আনন্দ ভ্রমণের জন্য ব্যয় হচ্ছে এবং তা দেশের কোন উপকারে আসছে না। আমাদের অশিক্ষিত জনগণের শিক্ষার জন্যে কোন অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না এবং শাসকদের অবহেলার কারণে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ধসে পড়ছে। জনগণের সংহতির নামে একটি একদলীয় একনায়কত্বমূলক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং নিরাপত্তা আইন ও নিবর্তনমূলক অর্ডিন্যান্সসমূহের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা
যা প্রতিটি নাগরিকের একটি অত্যন্ত সম্মানজনক ও মূল্যবান অধিকার—তাকে সব রকম নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার দ্বারা শেষ করে দেওয়া হয়েছে। সাংবিধানিক ও আইনসঙ্গত বিরোধিতা সহ্য করা হচ্ছে না এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী অথবা অন্য কোন গণতন্ত্রই যে বিকাশ লাভ করতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। রাষ্ট্র, সরকার ও ক্ষমতাসীন দলকে একাকার করে দেওয়া হয়েছে এবং কোন একজন মন্ত্রীর কোন বিশেষ কাজের বিরুদ্ধে কিছু বললেই তা হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাষ্ট্রের স্বার্থ এবং নিরাপত্তার জন্যে ক্ষতিকর। এবং এসব কিছুই রাষ্ট্রের নামে করা হলেও আসলে তা করা হচ্ছে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের নিরাপত্তার জন্যে। অন্ততঃ একটি বিষয়ে আমাদের করাচীস্থিত শাসনকর্তারা অন্য সব কিছুর থেকে বেশী উদ্বেগ এবং উৎসাহ দেখিয়েছেন। ১৯৩৫ সালের আইনে প্রদেশের হাতে যেটুকু ক্ষমতা ছিলো তার সমস্তটাই কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্বের প্রধান প্রধান উৎসগুলিকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং এমনকি দৈনন্দিন প্রশাসনের সমস্ত ব্যাপারেই সরকারের হস্তক্ষেপের তাগিদ এত বেশী যে তার ফলে অনেক সময় সব ব্যাপারে কেন্দ্রের অনিচ্ছুক এজেন্ট হিসেবে কাজ করা ব্যতীত প্রাদেশিক সরকারের আর কিছুই থাকে না। আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রধান অবলম্বন পাটের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র নিজের হাতে নিয়েছে এবং আমাদের কোটি কোটি বুভুক্ষু জনগণের জীবনে পাট নীতি কি পরিণাম ডেকে এনেছে সে বিষয়ে আপনারা নিশ্চয়ই বেদনাদায়কভাবে সচেতন আছেন। আমাদের মেহনতী কৃষকেরা যা উৎপাদন করছে, তাঁরা তাঁদের প্রাপ্য অংশ পাচ্ছে না, অথচ যাদের স্বার্থে উৎপাদনকারী এলাকা থেকে সমগ্র শিল্পটিকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে তাঁরা উৎপাদকদেরকে বঞ্চিত করে যথেচ্ছভাবে স্ফীত হচ্ছে এবং উৎপাদকেরা ইতিমধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে ধ্বংসের কিনারায়। আমাদের কোটি কোটি জনগণের ক্রন্দন ও বিলাপ অরণ্যে রোদনের মতো হয়েছে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনকে ভালোভাবে খর্ব করা হয়েছে এবং আমাদের জনগণের সমস্ত ন্যায্য দাবী দাওয়াকে প্রাদেশিকতার ধুয়ো তুলে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে একটি সত্যিকার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সর্বপ্রকার বিরোধী শক্তিকে কারাগারে নিক্ষেপ করে বিরোধিতার কষ্টকে কার্যকরভাবে রোধ করা হয়েছে। এই মানসিক পরিবেশে জনগণের আশা প্রায় স্থানীয়ভাবে নির্বাপিত হওয়ার উপক্রম হলেও তা একেবারে শেষ হয়ে যায় নাই। আমরা মনে করেছিলাম যে, শাসকদের নেতৃত্ব একদিন ভেঙে যাবে কারণ জনমতের চাপে তা হতে বাধ্য এবং সব থেকে নিকৃষ্ট ডিক্টেটরকেও একসময়ে উপলব্ধি করতে হবে যে, সংবিধানহীন সরকার যে কোন দেশেরই জনগণের সাথে প্রতারণা ব্যতীত কিছুই নয়। আমরা মনে করেছিলাম যে পাকিস্তানের বিধান যখন প্রণীত হবে তখন সেই সাথে জনগণের মধ্যে আস্থার অভাবও দূরীভূত হবে এবং তা আবার এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতি বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করবে। সংবিধান প্রণীত হতে বিলম্ব হচ্ছে কেন, এই প্রশ্নের জবাবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী রূঢ়ভাবে মন্তব্য করেছিলেন যে, এ বিষয়ে তাড়াহুড়ো করা উচিত নয় এবং সংবিধান যখন দিনের আলোক দেখবে তখন দুনিয়ার মানুষ তার বৈশিষ্ট্য এবং নোতুনত্ব দেখে চমৎকৃত ও স্তম্ভিত হবে। আমরা খুব স্পষ্টভাবেই স্বীকার করবো যে তা আমাদেরকে সত্যি-সত্যিই স্তম্ভিত করেছে এবং সেই সাথে তা জনগণকে রূঢ়ভাবে আঘাত করে তাঁদের সুপ্তি ভঙ্গ করছে।
এই প্রারম্ভিক মন্তব্যের পর সভাপতি আতাউর রহমান খান মূলনীতি নির্ধারক কমিটির রিপোর্টের প্রধান প্রধান সুপারিশগুলির সমালোচনা করেন এবং সেই প্রসঙ্গে অন্যান্য দেশের সংবিধান ও সাংবিধানিক সমস্যাসমূহের তুলনামূলক আলোচনা করে উপরোক্ত কমিটির সুপারিশসমূহকে সম্পূর্ণভাবে গণবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর ভাষণের শেষ দিকে মূলনীতি কমিটির সুপারিশ সম্পর্কে তাঁদের চূড়ান্ত মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন:
সংবিধান পরিষদ কর্তৃক প্রণীত মূলনীতি এবং সংবিধান পরিষদ কর্তৃক গৃহীত ‘মৌলিক অধিকার’ কোন রকম সংশোধিত আকারেও একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা বাতিল করতে হবে। আগামী অধিবেশনে মূলনীতি ও মৌলিক অধিকারের ওপর এই মহাসম্মেলনের সুপারিশসমূহ যদি সংবিধান পরিষদ কার্যকর করতে ব্যর্থ হয় তাহলে এই সুপারিশসমূহ কার্যকর করার জন্যে কি ধরনের কর্মকৌশল গ্রহণ করা দরকার হবে সেটা আপনাদেরকে বিবেচনা করতে হবে।
পরদিন সকাল ৯-৪৫ মিনিটে সম্মেলন আবার শুরু হয় এবং ১০টায় ফজলুল হক বক্তৃতা করেন। পাকিস্তান সংবিধান সভায় তাঁর নিজের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনার জবাব দানের চেষ্টা করেন। বেলা ২-৩০ মিনিট পর্যন্ত সম্মেলনের কাজ চলার পর বিকেল ৪টা পর্যন্ত তা মুলতুবী হয়। বিকেলে অধিবেশন শুরু হওয়ার পর রাত্রি বারোটা পর্যন্ত তা স্থায়ী হয় এবং দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পাঠ সমাপ্ত হয়ে খসড়া মূলনীতি কিছুটা পরিবর্তনের পর চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়।[৩৪]
৫ই নভেম্বরের এই শেষোক্ত অধিবেশনে ‘গণআজাদী লীগের সাথে যুক্ত প্রতিনিধিদের সাথে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিনিধিদের মতবিরোধ এবং খোলাখুলি বিরোধিতা ঘটে। রাত্রি ৮-৩০ মিনিটের দিকে তৃতীয় পাঠ শেষ হওয়ার পর সাংগঠনিক বিষয় আলোচনা শুরু হয় এবং পুরাতন সংগ্রাম কমিটি ভেঙে দিয়ে একটি নোতুন সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।[৩৫] কমরুদ্দীন আহমদ এই সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হওয়ার পরই এই বিরোধিতা চরম আকার ধারণ করে।[৩৬] আওয়ামী মুসলিম লীগের শামসুল হক, আতাউর রহমান খান, মানিক মিয়া, রফিক প্রভৃতি এই নির্বাচনকে মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়ে সদলবলে বার লাইব্রেরী হল পরিত্যাগ করে চলে যান।[৩৭]
৪. জাতীয় মহাসম্মেলনে গৃহীত শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব
৪ঠা ও ৫ই নভেম্বর, ১৯৫০ তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় মহাসম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবাবলী সম্পর্কে ‘গণতান্ত্রিক ফেডারেশন’ এর কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত একটি পুস্তিকার মুখবন্ধে সম্মেলনের সুপারিশসমূহের ভিত্তি সম্পর্কে বলা হয়:
১৯৪৬ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কনভেনশনে যখন ইহা পরিষ্কারভাবে বুঝিতে পারা গেল যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইলেও আসাম প্রদেশ পাকিস্তানের অংশ হিসাবে গণ্য হইবে না এবং বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্ত হইবার যথেষ্ট সম্ভাবনা রহিয়াছে তখন কায়েদে আজম মহম্মদ আলী জিন্নাহর অনুরোধে “স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের” (Independent States) স্থলে “একটি রাষ্ট্র” (A State) এই সংশোধনটি সন্নিবেশিত হইলো। যদিও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাধারণ বার্ষিক সভা ছাড়া ইহার সংশোধন করিবার অধিকার সেই কনভেনশনের ছিলো না কিন্তু যেহেতু পরবর্তী অধিবেশনে ইহার বিরোধিতা করা হয় নাই সেই হেতু আমরা ইহাকে “লাহোর প্রস্তাবের” সংশোধন হিসাবে গ্রহণ করিতে পারি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইবার পরেও লাহোর প্রস্তাবের অন্য কোন সংশোধন করা হয় নাই। সুতরাং গণপরিষদের মুসলিম লীগের সদস্যদের সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করিবার কোন আইনগত অধিকার নাই। ঢাকায় জাতীয় মহাসম্মেলন সেই কারণে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করিয়া তাহাদের মূলনীতি নির্ধারণ করিয়াছেন।[৩৮]
লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে জাতীয় মহাসম্মেলনে তাঁদের সুপারিশগুলি প্রণয়ন করার কথা উপরে বলা হলেও এই সুপারিশগুলি সাম্প্রদায়িক প্রভাবমুক্ত ছিলো। তবে সুপারিশগুলির সূচনায় সার্বভৌমত্ব সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার ওপর অর্পণ করার মধ্যে অবশ্য ধর্মীয় প্রভাব খুব সুস্পষ্টভাবেই দেখা যায়।
জাতীয় মহাসম্মেলন যে শাসনতান্ত্রিক সুপারিশসমূহ পেশ করে সেগুলি হলো নিম্নরূপা
রাষ্ট্রের নাম : রাষ্ট্রের নাম হবে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের দুটি অংশ থাকবে—পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান।[৩৯]
রাষ্ট্রপ্রধান : পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের একজন রাষ্ট্রপ্রধান থাকবেন। তিনি কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হবেন। দেশ-দ্রোহিতা এবং অসদাচরণের জন্যে রাষ্ট্রপ্রধানকে কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের দুই তৃতীয়াংশ ভোটে অপসারণ করা যাবে। রাষ্ট্রপ্রধানের আকস্মিক মৃত্যু বা অপসারণের পর নোতুন রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত পার্লামেন্টের স্পীকার রাষ্ট্রপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত হবেন। নোতুন রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন রাষ্ট্রপ্রধানের পদ শূন্য হওয়ার নব্বই দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতা ও দায়িত্ব হবে : (ক) তিনি ক্ষমা প্রদান করবেন (খ) তিনি হবেন পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, (গ) তিনি নির্বাচন কমিশনার, সুপ্রীম কোর্টের জজ এবং অডিটর জেনারেল নিয়োগ করবেন (ঘ) পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন এমন একজনকে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করবেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মতো অন্যান্য মন্ত্রীরাও তাঁর দ্বারা নিযুক্ত হবেন। তিনি বিদেশী দূতদের পরিচয়পত্র গ্রহণ করবেন এবং সকল আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করবেন।[৪০]
কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট : পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের একটি মাত্র পরিষদ থাকবে। পার্লামেন্টের অধিবেশন পর্যায়ক্রমে একবার কেন্দ্রীয় রাজধানী এবং তারপর পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হবে। প্রত্যেক অঞ্চল থেকে একই সংখ্যক লোকের ভোটে সার্বজনীন ভোটাধিকার ও যুক্ত নির্বাচনের ভিত্তিতে পার্লামেন্টের সদস্যেরা নির্বাচিত হবেন। প্রত্যেক এলাকার ভোটাদাতারা তাঁদের প্রতিনিধিকে ইচ্ছে করলে পার্লামেন্ট থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন। পার্লামেন্ট থেকে সকল অর্থ বিল রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে প্রেরিত হওয়ার তিন দিনের মধ্যে তাঁকে স্বাক্ষর দান করতে হবে। অন্যান্য বিলে তাঁকে স্বাক্ষর দান করতে হবে তিরিশ দিনের মধ্যে। নির্বাচন কমিশন সুপ্রীম কোর্টের জজ ও পাকিস্তানের অডিটর জেনারেলকে দেশদ্রোহিতা ও অসদাচরণের জন্যে পার্লামেন্ট দুই তৃতীয়াংশ ভোটে অপসারণ করতে পারবেন। পার্লামেন্টের সদস্যেরা সরকারের অধীনে কোন লাভবান পদে বহাল হতে পারবেন না। কোন কোন জরুরী জাতীয় প্রশ্নে জনগণের মতামত গ্রহণের উদ্দেশ্যে মন্ত্ৰী পরিষদের পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রধান পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে পারবেন। কোন ব্যক্তি বা দলই পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে মন্ত্রীত্ব গঠন করতে পারছেন না এমতাবস্থায় রাষ্ট্রপ্রধানের অধিকার থাকবে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার। এর ৪৫ দিনের মধ্যে নোতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। [৪১]
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা : মন্ত্রী পরিষদের সদস্যেরা একক এবং যৌথভাবে পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকবেন। পাকিস্তানের যে কোন নাগরিক পার্লামেন্টের সদস্য থাকলে তিনি মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন হবেন। সদস্য নন এমন কোন নাগরিক যদি মন্ত্রী হন তাহলে মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই তাকে পার্লামেন্টের সদস্যরূপে নির্বাচিত হতে হবে।[৪২] সুপ্রীম কোর্ট : পাকিস্তানের একটি সুপ্রীম কোর্ট থাকবে এবং তার সেশন পর্যায়ক্রমে কেন্দ্রীয় রাজধানী
এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হবে। [৪৩]
রাষ্ট্রভাষা : পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা এবং উর্দু।[৪৪]
কেন্দ্রের আওতাভুক্ত বিষয় : দেশরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয় কেন্দ্রের হাতে থাকবে। দেশরক্ষা বাহিনীর দুটি ইউনিট থাকতে হবে যার একটি থাকবে পূর্ব এবং অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তানে। এই ইউনিটগুলি আঞ্চলিক অধিনায়কদের দ্বারা পরিচালিত হবে এবং কেন্দ্রীয় রাজধানীতে অবস্থিত সর্বাধিনায়কের অধীনস্থ থাকবে। প্রত্যেক অঞ্চলের দেশরক্ষা বাহিনী সেই অঞ্চলের লোক দিয়েই গঠিত হতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে একটি আঞ্চলিক বৈদেশিক মন্ত্রণালয় থাকতে হবে। অন্যান্য সকল ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে প্রদেশের হাতে।
কেন্দ্র কতকগুলি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর কর ধার্য করতে পারবে কিন্তু প্রদেশের অনুমতি ব্যতীত কেন্দ্র তা করতে পারবে না।[৪৫]
সংবিধানের সংশোধন : কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট অথবা কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতা সংক্রান্ত
সংবিধানের যে কোন অংশ কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে সংশোধিত হতে পারবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে যে কোন একটি বা প্রত্যেকটি আঞ্চলিক সরকারের সম্পর্ক সম্পর্কিত কোন অংশ প্রথমে সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত হয়ে তার পর কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত হতে হবে। অন্য যে কোন সংশোধন হবে কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক পার্লামেন্টের দুই তৃতীয়াংশ ভোটে।[৪৬]
সংবিধান স্থগিত রাখার ক্ষমতা : কোন অবস্থাতেই সংবিধান স্থগিত রাখার ক্ষমতা কারো থাকবে না।[৪৭]
আঞ্চলিক সরকার : পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে দুটি পৃথক আঞ্চলিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এই সরকারের একজন আঞ্চলিক প্রধান থাকবেন এবং তিনি আঞ্চলিক পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হবেন। কিন্তু আঞ্চলিক পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হবে। যে কোন কারণে আঞ্চলিক প্রধান অপসারিত হলে তার স্থলে আঞ্চলিক পার্লামেন্টের স্পীকার সাময়িকভাবে আঞ্চলিক প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এর নব্বই দিনের মধ্যে আঞ্চলিক পার্লামেন্টকে নোতুন একজন আঞ্চলিক প্রধান নির্বাচিত করতে হবে। আঞ্চলিক পার্লামেন্টের অধিকাংশ সদস্যের আস্থাভাজন একজনকে আঞ্চলিক প্রধান আঞ্চলিক প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করবেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী অন্য মন্ত্রীরা তার দ্বারা নিযুক্ত হবেন।
আঞ্চলিক পার্লামেন্টের একটি মাত্র পরিষদ থাকবে এবং সেই পরিষদের সদস্যেরা সার্বজনীন ভোটাধিকার ও যুক্ত নির্বাচনের ভিত্তিতে ৫ বৎসরের জন্যে নির্বাচিত হবেন। ৫ বৎসরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্বে কোন গুরুতর কারণে প্রয়োজন হলে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী আঞ্চলিক প্রধান আঞ্চলিক পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে পারবেন। তবে এইভাবে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার ষাট দিনের মধ্যে আঞ্চলিক প্রধানকে নোতুন নির্বাচনের অনুষ্ঠান করতে হবে। মন্ত্রীপরিষদের সদস্যের একক ও যৌথভাবে আঞ্চলিক পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকবেন।[৪৮]
পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের কতকগুলি বিশেষত্বের জন্যে সেখানে আঞ্চলিক সরকারের বাস্তব রূপ কি হবে তা নির্ধারণের জন্যে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের একটি কনভেনশন আহ্বানের প্রস্তাব জাতীয় মহাসম্মেলনে করা হয়
জাতীয় মহাসম্মেলনে গৃহীত মূলনীতি প্রস্তাবসমূহের সর্বশেষে নাগরিকদের অধিকার সম্পর্কিত একটি প্রস্তাবে নিম্নলিখিত অধিকারগুলিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়:
ক.
(১) আইনের চোখে সকল নাগরিকই সমান।
(২) আদালতে বিচার না করে কোন ব্যক্তিকে আটক রাখা চলবে না।
খ.
১) অপ্রকৃতিস্থ নয় এমন যে কোন নাগরিক ১৮ বৎসর বয়স হলে ভোট দানের
ক্ষমতা লাভ করবে এবং ২১ বৎসর বয়স হলে পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার জন্যে নির্বাচন প্রার্থী হতে পারবে।
(৪) হেবিয়াস কর্পাস অধিকার রদ করার কোন ব্যবস্থা থাকবে না।
প্রত্যেক নাগরিকের নিম্নলিখিত অধিকারসমূহ থাকবে :
(১) জীবন
(২) শিক্ষা—একটা পর্যায় পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা
(৩) কাজ ও জীবিকা
(৪) চিকিৎসার সাহায্য (৫) আশ্রয়
(৬) জীবিকার মূল্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মজুরী
(৭) ট্রেড ইউনিয়ন ও ট্রেড সেক্রেটারীয়েট গঠন এবং যৌথ দরকষাকষির জন্যে ধর্মঘট।
গ. রাষ্ট্র নিম্নলিখিত বিষয়ে নাগরিকদেরকে নিশ্চিত করবে :
(১) বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, চলাচলের স্বাধীনতা, চিন্তা, কর্ম, সমিতি গঠন, ভাবপ্রকাশ, প্রার্থনা ও বিবেকের স্বাধীনতাসহ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারসমূহ।
(২) মর্যাদা ও সুযোগের সমানাধিকার
(৩) ব্যক্তির মর্যাদা
(৪) বার্ধক্যের সংস্থান
(৫) মাতৃত্বের সুযোগ-সুবিধা
(৬) উৎপাদনের শক্তিসমূহের সামাজিকীকরণ
(৭) কোন আইন পরিষদই এমন কোন আইন করতে পারবে না যার দ্বারা শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষকে শোষণের সুবিধা হয়।[৫০]
৫. ১২ই নভেম্বরের বিক্ষোভ
গণতান্ত্রিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটি মূলনীতি নির্ধারক কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে ১২ই নভেম্বর সভা সমিতি ও মিছিলের মাধ্যমে সারা পূর্ব বাঙলাব্যাপী বিক্ষোভের জন্যে জনসাধারণ ও ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানান। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা ঐ দিন আর্মানীটোলা ময়দানে একটি জনসভার আয়োজন করেন।
আফতাবউদ্দীন খান এডভোকেটের সভাপতিত্বে বিকেল ৫টায় আরমানীটোলার সভা শুরু হয়। সভায় মৌলানা আব্দুল জব্বার, এমএ রহিম, আলি আহমদ খান, খয়রাত হোসেন প্রভৃতি বক্তৃতা করেন। সভায় প্রায় পাঁচ হাজার লোক উপস্থিত থাকেন এবং তা ঘণ্টাখানেক স্থায়ী হয়।[৫১]
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে ১২ই এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মেডিকেল স্কুল, ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, আলীয়া মাদ্রাসা এবং বিভিন্ন স্কুল সমূহের ছাত্রেরা মূলনীতি কমিটির রিপোর্টের বিরুদ্ধে পূর্ণ ধর্মঘট পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরাও ধর্মঘট করেন এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রেরা মিছিল সহকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন। একটি মিছিল যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রবেশ করছিলো তখন প্রক্টর নির্দেশ দিয়ে গেট বন্ধ করে দেন। কিন্তু সমবেত ছাত্রদের প্রতিবাদ এবং সম্মিলিত দাবীর ফলে শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গেট উন্মুক্ত করে দিতে বাধ্য হন।[৫২] বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রেরা একত্রিত হওয়ার পর এমএ সামাদের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি বিরাট ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র অ্যাসোসিয়েশন প্রভৃতির প্রতিনিধিরা বক্তৃতা করেন। বক্তারা মূলনীতি কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং পূর্ব বাঙলার মুসলিম লীগ নেতাদের সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেন যে, মৌলানা আকরম খাঁ ও নূরুল আমীন, লিয়াকত আলীর সাথে আমেরিকা ও বৃটেনের সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র জালে জড়িত হয়ে পড়েছেন।[৫৩]
সভাশেষে ছাত্রেরা দীর্ঘ এক মাইল ব্যাপী মিছিল করে শহর প্রদক্ষিণ করেন এবং ‘লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রস্তুত করা হোক’, ‘দাসত্বসুলভ মূলনীতি কমিটি রিপোর্টের পতন হোক’ এবং ‘পাকিস্তানের প্রিয় জননেতা মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হোক’ প্রভৃতি আওয়াজ তোলেন।[৫৪]
ঢাকা ইডেন কলেজের মহিলা ছাত্রীরাও ১২ই নভেম্বর মূলনীতি কমিটির রিপোর্টের বিরুদ্ধে ধর্মঘট করেন এবং কলেজ প্রাঙ্গণেই এক ছাত্রীসভায় মিলিত হয়ে কমিটির রিপোর্টের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন।[৫৫]
১২ই নভেম্বর পূর্ব বাঙলার অন্যান্য জায়গাতেও সভা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ঐ দিন সিলেটের গোবিন্দ পার্কে মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে মূলনীতি নির্ধারক কমিটির সুপারিশ সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান প্রস্তুতের দাবী জানানো হয়। ৪ঠা ও ৫ই নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় মহাসম্মেলনে মূলনীতির বিকল্প প্রস্তাবগুলির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। মূলনীতি কমিটির রিপোর্টের প্রতিবাদে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ ও সরকারী মহল কর্তৃক কুৎসা রটনারও তীব্র প্রতিবাদ করা হয়।[৫৬]
মূলনীতি কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা, ছাত্র ধর্মঘট ও মিছিল শুধু ১২ই নভেম্বরেই অনুষ্ঠিত হয়নি, রিপোর্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সারা নভেম্বর মাস ধরেই পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন এলাকায় সংগঠিত হয়।
৬. শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ
মূলনীতি নির্ধারক কমিটির রিপোর্টের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক পূর্ব বাঙলার ওপর নির্যাতনমূলক শাসন চাপিয়ে দেওয়ার এবং শোষণকে প্রবল ও অব্যাহত করার চক্রান্ত এত সুস্পষ্ট ছিলো যে তা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের মধ্যে, বিশেষত, তাঁদের কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক বিক্ষোভের সঞ্চার করে। এর ফলে মুসলিম লীগের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের একান্ত অনুগত অংশ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ অংশের মধ্যে বিরোধ ও অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ বেশ প্রকট ও খোলাখুলি আকার ধারণ করে। অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিও এই বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করেন।
মুসলিম লীগের কর্মীরা ঢাকা, কুমিল্লা, বগুড়া, পাবনা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে মূলনীতি কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন।[৫৭] সিলেটে শুধু মুসলিম লীগ কর্মীরাই নয়, নেতৃত্বের একটা বিরাট অংশ এই প্রতিবাদকে যথেষ্ট সংগঠিত রূপ দান করেন।[৫৮] পূর্ব পাকিস্তানের পরিষদ সদস্য ও আসামের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী মুনাওয়ার আলী এক প্রতিবাদমূলক বিবৃতি[৫৯] প্ৰসঙ্গে বলেন:
পাকিস্তানের মূলনীতি নির্ধারক কমিটির সুপারিশ গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করিয়াছে। ফেডারেল ‘লেজিসলেচারে ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের জনসংখ্যাকে অবহেলা করিয়া যে সমসংখ্যক প্ৰতিনিধি নির্বাচনের নীতি নির্ধারণ করিয়াছেন তাহা পূর্ব পাকিস্তানের জনমতকে চরমভাবে পদদলিত করিয়াছে। এই প্রকার শাসনতন্ত্রের নীতি বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না—ইহা নিন্দা করিবার ভাষা আমরা পাইতেছি না।… এই মূলনীতি কমিটির সুপারিশকে একটু সূক্ষ্মভাবে বিচার করিলে একনায়কত্ব ও রাজতন্ত্রের আভাস স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
মুনাওয়ার আলী তাঁর বিবৃতিতে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে যে সুপারিশগুলি করেন তার মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তাঁর নিম্নলিখিত সুপারিশ:
কতকগুলি বিশেষ কারণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান প্রয়োজনবোধে একে অন্য হইতে সরিয়া আসিয়া পৃথক ‘আঞ্চলিক পাকিস্তান রিপাবলিক’ গড়িয়া তুলিতে পারিবেন।
১৪ ই নভেম্বর, ১৯৫০ তারিখে সিলেটের জিন্নাহ হলে পূর্ব বাঙলা সরকারের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী নাসিরউদ্দীন আহমদ মুসলিম লীগের কর্মী ও নেতৃবৃন্দসহ সিলেটের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে মূলনীতি সম্পর্কে আলোচনার জন্যে আহ্বান করেন। দেওয়ান আব্দুর রব চৌধুরী এমএল-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেই আলোচনা সভায় নাসিরউদ্দীন বলেন যে, সামান্য কিছু সংশোধন করে মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলী তাঁর এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন। মাহমুদ আলী, নূরুল হোসেন খান এমএলএ আব্দুল লতিফ এমএলএ আব্দুল মুহীত চৌধুরী, হাবিবুর রহমান, শাহ একরামুর রহমান প্রভৃতি সভায় বক্তৃতা করেন এবং সেই সভায় নাসিরউদ্দীন আহমদকে সিলেটবাসীদের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, মূলনীতি কমিটির সুপারিশসমূহ মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।[৬০]
নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকা মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির ১৩ জন সদস্য কর্তৃক মূলনীতি কমিটির সুপারিশ বিবেচনার জন্যে একটি সভা আহূত হয়। এই সভায় সদস্যের কমিটির সুপারিশসমূহের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে কতকগুলি প্রস্তাবের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারকে নিজেদের বক্তব্য জানিয়ে দেন।[৬১]
প্রস্তাবগুলিতে তাঁরা বলেন যে, মূলনীতি কমিটি কর্তৃক প্রস্তাবিত শাসনতান্ত্রিক নীতি দেশবাসীর মনে গভীর শঙ্কার কারণ ঘটিয়েছে। লাহোর প্রস্তাবের বিরোধী এই রিপোর্টটি ফেডারেশনের আদর্শ থেকে বিচ্যুত এবং এর সুপারিশ অনুযায়ী শাসনতন্ত্র রচিত হলে তা পাকিস্তানে গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করবে। তাঁরা অভিমত প্রকাশ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে একটি আঞ্চলিক শাসনতন্ত্র রচনা করে দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি, মুদ্রা প্রভৃতি ফেডারেশনের হাতে ন্যস্ত রেখে অন্যান্য সমস্ত বিষয় পূর্ব পাকিস্তানের হাতে ন্যস্ত রাখা প্রয়োজন। আঞ্চলিক সমস্ত ব্যাপারই ফেডারেল সরকারের এখতিয়ার বহির্ভূত হতে হবে। বাংলা এবং উর্দু উভয় ভাষাকেই রাষ্ট্র ভাষা করতে হবে। কেন্দ্রীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে এবং ফেডারেল কোর্টের অধিবেশন হবে ঢাকা এবং লাহোর উভয় স্থানে। পার্লামেন্টারী পার্টির উপরোক্ত সদস্যেরা আরও দাবী করেন যে, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র ১৯৫১ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রণীত হয়ে সেই শাসনতন্ত্র অনুযায়ী ১৯৫২ সালের প্রথমভাগেই সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন হতে হবে।
শুধু প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির মধ্যেই যে কেন্দ্রবিরোধী বিক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছিলো তাই নয়, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মধ্যেও কেন্দ্র এবং প্রদেশে তাঁদের নির্বাচিত এজেন্টদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ খুব দ্রুতগতিতে এ সময় দানা বাঁধছিলো। এই বিক্ষোভ এবং অসন্তোষের একটা উল্লেখযোগ্য বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১লা অক্টোবর, ১৯৫০ তারিখে অনুষ্ঠিত ঢাকা জেলা মুসলিম লীগের একটি সভায়। নওয়াব খাজা হাবিবুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় সারা পাকিস্তান লীগ কাউন্সিলের আসন্ন অধিবেশন সম্পর্কে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রকাশ করে কতকগুলি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং তাতে বলা হয় যে, করাচীতে মুসলিম লীগ কাউন্সিলের অধিবেশনে যে কোন সিদ্ধান্তই গৃহীত হোক না কেন তা নিয়মতন্ত্রসম্মত বলে বিবেচিত হবে না। কাউন্সিলের ঐ সভায় লীগের কোন নোতুন গঠনতন্ত্র গৃহীত হলেও তা আইনসঙ্গত বলে গণ্য হবে না বলেও তাঁরা ঘোষণা করেন, কারণ করাচীর প্রস্তাবিত সম্মেলন হলো তাঁদের মতো ‘স্বেচ্ছাচারমূলক’ ও ‘নিয়মবহির্ভূত’। ঢাকা জেলা মুসলিম লীগের এই সভায় আসন্ন করাচী সম্মেলনে যোগদান না করার জন্যে পূর্ব পাকিস্তানী কাউন্সিল সদস্যদের কাছে আহ্বান জানানো হয়।[৬২]
ইতিপূর্বে করাচীর প্রস্তাবিত মুসলিম লীগ কাউন্সিল আহ্বান করে কেন্দ্রীয় সম্পাদক ইউসুফ খটক একটি বিবৃতির মাধ্যমে বলেন যে, মন্ত্রীরা মুসলিম লীগের কর্মকর্তা পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না বলে যে শাসনতান্ত্রিক বিধিনিষেধ আছে আসন্ন অধিবেশনে তা প্রত্যাহার করার প্রস্তাব কাউন্সিলে বিবেচিত হবে।[৬৩]
পাকিস্তান আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগের মধ্যে অসংখ্য সৎ দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি ও ছাত্র সমবেত হয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই মুসলিম লীগ যে নীতিসমূহ অনুসরণ করছিলো এবং নোতুনভাবে জনগণের ওপর শোষণ ও নির্যাতন সংগঠিত করার যে বহুবিধ ব্যবস্থা অবলম্বন করছিলো তার ফলে মুসলিম লীগের মধ্যে ভাঙন ১৯৪৭ সালেই শুরু হয়। এই ভাঙনের ফলে ছাত্র এবং কর্মীদের এক বিরাট অংশ দু-তিন বৎসরের মধ্যেই মুসলিম লীগ পরিত্যাগ করে রাজনীতিকে অন্যভাবে সংগঠিত করতে চেষ্টা করতে থাকেন। এর ফলেই সৃষ্টি হয় গণআজাদী লীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ, মুসলিম ছাত্র লীগ, যুব লীগ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান।
১৯৫০ সালে মূলনীতি নির্ধারক কমিটি যে শাসনতান্ত্রিক সুপারিশ সংবিধান পরিষদে পেশ করে এবং কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সেই সুপারিশসমূহকে যেভাবে সমর্থন করে তার ফলে মুসলিম লীগের মধ্যে ভাঙন আরও ব্যাপক ও ত্বরান্বিত হয়। সিলেটের মুনাওয়ার আলী ও মাহমুদ আলী, বরিশালের মহীউদ্দীন আহমদ প্রভৃতি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং তাঁদের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা মুসলিম লীগের সাথে সাংগঠনিকভাবে সম্পর্কচ্ছেদ না করলেও কার্যতঃ তাঁরা মুসলিম লীগ পরিত্যাগ করেন। এমনকি মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত প্রাদেশিক সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমানও মূলনীতি কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠনের প্রচেষ্টা করেন। প্রাদেশিক লীগ কাউন্সিলের অধিবেশন আহ্বান করার দাবীও তাঁরা জানান। প্রাদেশিক লীগ সভাপতি মৌলানা আকরম খাঁ অবশ্য তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করে প্রাদেশিক সম্পাদকের এই প্রচেষ্টাকে বাধা দেন।
আকরম খাঁ এবং নূরুল আমীন দুজনের কেউই এই প্রতিকূল অবস্থায় প্রাদেশিক লীগ কাউন্সিল অথবা পার্লমেন্টারী পার্টির অধিবেশন আহ্বান করতে একেবারে ইচ্ছুক ছিলেন না। কিন্তু অধিবেশন আহ্বানের চাপ প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মধ্যে ক্রমশঃ বৃদ্ধিলাভ করছিলো। এই অবস্থায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী ঢাকা সফরের জন্যে আসেন এবং তার উপস্থিতিতেই আকরম খাঁ ও নূরুল আমীন যথাক্রমে মুসলিম লীগ কাউন্সিল ও পার্লামেন্টারী পার্টির অধিবেশন আহ্বান করেন। তাঁরা আশা করেছিলেন যে, লিয়াকত আলীর উপস্থিতিতে বিদ্রোহী মুসলিম লীগ সদস্যেরা অনেকখানি সংযত আচরণ করবেন এবং কোন প্রকার “বেয়াড়া” দাবী লিয়াকত আলীর উপস্থিতিতে উত্থাপন করতে পারবেন না।
তাঁদের আশা একেবারে মিথ্যা হয়নি। লিয়াকত আলীর উপস্থিতিতে পার্লামেন্টারী পার্টি ও লীগ কাউন্সিলের সদস্যেরা তাঁদের বিক্ষোভকে অনেকখানি সংযত রাখতে বাধ্য হন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মূলনীতি কমিটির সুপারিশকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণযোগ্য মনে না করে কতকগুলি পরিবর্তনের সুপারিশ তাঁরা করেন।[৬৪]
এই সুপারিশগুলি হলো প্রথমত, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে দূরত্ব অনেক বেশী এবং এই দুই অঞ্চলের মধ্যে যোগসূত্র নাই, সেই কারণে পূর্ব বাঙলাকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে এবং শাসনতন্ত্রে পূর্ব বাঙলার জন্যে একটি বিশেষ তালিকা প্রণয়ন করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, পূর্ব বাঙলার যানবাহন যেহেতু পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্য সকল প্রদেশের সঙ্গে যোগাযোগহীন সেজন্যে তা পরিচালনার ভার ন্যস্ত থাকবে পূর্ব বাঙলার ওপর।
তৃতীয়ত, আমদানী রপ্তানী ব্যবসায়ও যতদূর সম্ভব পূর্ব বাঙলা সরকার দ্বারা পরিচালিত হতে হবে।
চতুর্থত, শিল্প ও বাণিজ্য বিভাগ দুটি পূর্ব বাঙলা সরকারের ক্ষমতাধীনে রাখতে হবে। পঞ্চমত, গঠনতন্ত্র সংশোধনের ব্যবস্থা আরও সহজ করতে হবে।
রাষ্ট্রপ্রধান ও কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা, কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের উচ্চ পরিষদ (হাউস অব ইউনিটস) বাংলা রাষ্ট্রভাষা, মৌলিক অধিকার ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁরা কোন প্রস্তাবই অবশ্য গ্রহণ করলেন না।
ডিসেম্বর মাসে মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য মুনাওয়ার আলী একটি দীর্ঘ বিবৃতি প্রদান করে বলেন, তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের কার্যকরী সমিতির সভায় মূল শাসনতন্ত্র নির্ধারক কমিটির রিপোর্টের আলোচনা সম্পর্কে কোন অভিমত আপাততঃ না দিলেও ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় মহাসম্মেলনের সুপারিশসমূহকে তিনি সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করেন কারণ তার মধ্যে জনগণের সত্যিকার মুক্তির পথ নির্দেশিত হয়েছে।[৬৫]
মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সুপারিশ সম্পর্কে ‘গণতান্ত্রিক ফেডারেশন’ তাঁদের প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় বলে :
পাক-বাঙলার জনসাধারণ তাহাদের এই অপচেষ্টা দেখিয়া হাসিবেন কি কাঁদিবেন স্থির করিতে পারিলেন না – কারণ যাহা বলা হইয়াছে তাহা বাস্তবক্ষেত্রে বিগত তিন বছরে যাহা হইয়া গিয়াছে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনকে পদদলিত করিয়া সকল বিষয়সমূহকে কেন্দ্রীয়করণ করা হইয়া গিয়াছে। আর সেই কারণে পাক-বাঙলায় আজ ক্রন্দনরোল উত্থিত হইয়াছে। কৃষকের পাট, ব্যবসায়ীর সুপারী, শ্রীহট্টের চা ইত্যাদি সমস্ত কাঁচামাল উৎপাদনকারীরা আজ মরণের মুখে। মধ্যবিত্ত আজ ত্রাহী ডাক ছাড়িয়াছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা চারিদিক অন্ধকার দেখিতেছে – পাঠশালা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আজ ভাঙিয়া পড়িতেছে – চাকুরীর ক্ষেত্রে আজ বাঙ্গালীর দুয়ার বন্ধ।[৫৪] হাজার বর্গ মাইলের মধ্যে আজ সাড়ে চার কোটি লোক অন্ধকূপ হত্যার মতো নিশ্বাস বন্ধ হইয়া মরিবার উপক্রম করিয়াছে, অথচ তিন লক্ষ বর্গমাইলের পশ্চিম পাকিস্তানের সুযোগ-সুবিধার তুলনায় আমরা কী পাইতেছি? ওখানে প্রতি ৬০ লক্ষ লোকের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় – তাছাড়া শিল্প বাণিজ্য ক্ষেত্রে তারা কত অগ্রসর হইতেছে – আর আমাদের টাকার অভাবে সকল পরিকল্পনা বন্ধ হইয়া আছে। বিক্রয় কর, আয় কর, আমদানী রপ্তানী শুল্কের উপর আমাদের হাত নাই, কে বা কাহারা আজ সব কিছু কেন্দ্রের হাত তুলিয়া দিলো তাহা বাঙ্গালীর অজানা নয় – তবু আবার তাহারাই নাকি দেয় সংশোধনী প্রস্তাব।[৬৬]
প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিল মূলনীতি নির্ধারক কমিটির রিপোর্ট সংশোধনের জন্যে কতকগুলি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের খসড়া তৈরীর উদ্দেশ্যে একটি সাব-কমিটি নিযুক্ত করেছিলেন। ছয়দিন ব্যাপী আলোচনার পর উক্ত কমিটি তাঁদের রিপোর্টে[৬৭] এই মর্মে সুপারিশ করেন যে, পাকিস্তান মূলতঃ এক দেশ থাকবে তবে পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্বের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করতে হবে এবং পূর্ব বাঙলা সরকারকে সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। পূর্ব বাঙলায় যে সমস্ত বিষয়ের সাথে পাকিস্তানের অবশিষ্টাংশের কোন সাধারণ সম্পর্ক নেই সেগুলি প্রাদেশিক তালিকাভুক্ত করতে হবে এবং যুক্ত তালিকার বিষয়গুলি বহুল পরিমাণে কমিয়ে দিতে হবে। রাষ্ট্র প্রধানের এবং অপরাপর উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে রাখতে হবে। হাইকোর্ট ও ফেডারেল কোর্টের বিচারপতিদেরকে নিয়ে নির্বাচনী ট্রাইবুনাল গঠন করে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। জরুরী ক্ষমতার ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ করতে হবে। কার্যতঃ শত্রুতা ও বিদ্রোহ না করলে কোন ব্যক্তির হেবিয়াস কর্পাসের অধিকার ক্ষুণ্ন করা কখনোই চলবে না। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অধীনে চাকুরে ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে হার নির্দিষ্ট করতে হবে এবং এমনভাবে করতে হবে যাতে বিভিন্ন শ্রেণীর চাকুরীর অর্ধেক পূর্ব পাকিস্তানী প্রার্থীদের দ্বারা পূর্ণ হতে পারে। এই হার দেশরক্ষা সংক্রান্ত চাকুরীতেও প্রযোজ্যে হবে। কোন সরকারী চাকুরে কোন আইন সভারই সদস্য হতে পারবেন না।
মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সাব-কমিটির উপরোক্ত সুপারিশ প্রকাশিত হওয়ার পর গণতান্ত্রিক ফেডারেশনের কাউন্সিল ঢাকায় এক সভায় একত্রিত হয়ে সুপারিশগুলির প্রতারণামূলক চরিত্রের প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁদের এর বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেন। একটি প্রস্তাবে তাঁরা এ সম্পর্কে বলেন:
২০/০১/৫১ তারিখে অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ফেডারেশনের কাউন্সিলের এই সভা মূলনীতি কমিটির রিপোর্টের ওপর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাব-কমিটি সুপারিশসমূহের সাথে দৃঢ় মতানৈক্য ব্যক্ত করছে যাতে কেন্দ্রের জন্যে একটি দ্বি-পরিষদ বিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে কেন্দ্রীয় সরকারকে উচ্চতর মর্যাদা দিয়ে তার হাতে ব্যবসা বাণিজ্য, আমদানী রপ্তানীর নিয়ন্ত্রণ ন্যস্ত করা হয়েছে, যাতে লাহোর প্রস্তাবে যেভাবে নির্দেশিত হয়েছিলো তার খেলাফ করে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণতম স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি অঞ্চলের মর্যাদা দানের সাধারণ দাবীর বিরুদ্ধে তাকে কেবলমাত্র একটি প্রদেশের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, যাতে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি এবং যাতে এই অঞ্চলের জনগণের স্বার্থকে আরো কতকগুলি বিষয়ে পরিকল্পিতভাবে বিপন্ন করা হয়েছে। বিষয়টিকে যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে না দেখে বিপরীতপক্ষে এক্ষেত্রে প্রকৃত সমস্যাসমূহ সম্পর্কে জনগণকে বিভ্রান্ত করার যে দৃষ্টিভঙ্গি এর মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে এই কাউন্সিল তার নিন্দা করছে।
৭. মূলনীতি নির্ধারক কমিটির রিপোর্ট বিবেচনা স্থগিত
সারা পাকিস্তানে, বিশেষতঃ পূর্ব বাঙলায় মূলনীতি নির্ধারক কমিটির রিপোর্টের বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ শুরু হওয়া, এমনকি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের মধ্যেও সেই প্রতিবাদ বিক্ষোভের প্রভাব বিস্তৃত হওয়ার ফলে কেন্দ্রীয় সরকার ভীতিগ্রস্ত হয়ে ২১শে নভেম্বর, ১৯৫০ তারিখে উক্ত রিপোর্ট সম্পর্কে পরিষদীয় আলোচনা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।[৬৯] এই প্রসঙ্গে পাকিস্তান গণপরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেন যে, শাসনতন্ত্রের মূলনীতি সম্পর্কে যারা সুপারিশ করতে চান তাঁদেরকে পূর্ণ সুযোগ দানের উদ্দেশ্যেই তাঁরা রিপোর্ট সম্পর্কে আলোচনা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখছেন।
মূলনীতি নির্ধারক কমিটির আদর্শ প্রস্তাবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট প্রস্তাব পেলে তাঁরা সেগুলি বিবেচনা করবেন বলেও তিনি পরিষদকে জানান।
দেশব্যাপী যে সমালোচনা ও মন্তব্যের ঝড় উঠেছিলো তাকে তিনভাগে বিভক্ত করে লিয়াকত আলী বলেন যে, প্রথমতঃ রিপোর্ট সম্পর্কে অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয়ত, কেউ কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে এবং রিপোর্টে যা নেই তাই জনসাধারণকে বোঝাচ্ছে। শুধু তাই নয়, তাঁরা এই সুযোগে দেশের মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টি করতে চাইছে। তৃতীয়ত, কিছু সংখ্যক ব্যক্তি রিপোর্টের মর্ম উপলব্ধি করতে পারছেন এবং অন্তবর্তীকালীন রিপোর্টে যা নেই সে রকম কিছু কিছু নীতি যোগ করতে চাইছেন। এইভাবে আলোচনা স্থগিত রাখার ফলে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নে কিছু বিলম্ব ঘটবে কিন্তু সমস্ত শ্রেণীর সন্তোষ বিধানের প্রয়োজনেই সেটা তাঁরা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী পরিষদকে জানান। মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট আদর্শ প্রস্তাবের অনুসরণে প্রণয়ন করা হয়নি একথা অস্বীকার করে তিনি সমালোচকদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, কোথায় আদর্শ প্রস্তাব লঙ্ঘন করা হয়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ করতে। এর পর আদর্শ প্রস্তাব সম্পর্কে লিয়াকত আলী বলেন যে, কিছু ব্যক্তির ধারণা এটা তাঁদের “চালাকী”। একথা অস্বীকার করে তিনি আদর্শ প্রস্তাবের নীতিসমূহকে তাঁদের বিশ্বাসের ব্যাপার বলে অভিহিত করেন। ইসলামের নীতিসমূহের ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তানের গঠনতন্ত্র প্রণয়নকে তাঁদের গুরুদায়িত্ব হিসেবে বর্ণনা করে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, প্রত্যেক খাঁটি পাকিস্তানীই সেই দায়িত্ব পালনে অংশগ্রহণ করবেন।
মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট বিবেচনা এইভাবে স্থগিত রাখা সম্পর্কে পূর্ব বাঙলার কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্যদের ভূমিকা প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন কাউন্সিলের আহ্বায়ক কমরুদ্দীন আহমদ ১৯৫০-এর ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি বিবৃতিতে বলেন:
বিগত গণ পরিষদ অধিবেশনে মূলনীতি নির্ধারক কমিটির রিপোর্টের বিবেচনা সাময়িকভাবেই স্থগিত রাখায় পূর্ব বঙ্গের সদস্যগণ আনন্দ প্রকাশ করিয়াছেন; কিন্তু কেহই এই গণস্বার্থ বিরোধী মূলনীতি রিপোর্টটির সমূলে অগ্রাহ্য করিবার দাবী করেন নাই। ইহাতেই দিবালোকের মত স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে যে পূর্ব বাঙলার গণপরিষদের সভ্যগণ আপন রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অগণিত জনসাধারণের স্বার্থকে বলি দিয়া প্রভুদের তোষামোদের জন্য অধীর হইয়া উঠিয়াছেন।
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর গণপরিষদ বক্তৃতার উল্লেখ করে কমরুদ্দীন আহমদ বলেন:
তিনি জনসাধারণকে স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন যে যাহারা কোন বিকল্প প্রস্তাব দিতে চাহেন তাহারা যেন আদর্শ প্রস্তাবের সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া প্রস্তাব প্রেরণ করেন। কিন্তু প্রত্যেকেই দেখিয়াছেন আদর্শ প্রস্তাবের দাবী এমনভাবে রচিত হইয়াছে যে যে কোন ব্যক্তির যে কোনভাবে ইহার ভাষ্য দিতে পারেন। মূলনীতি কমিটির রিপোর্টটি আদর্শ প্রস্তাবকে ভিত্তি করিয়া রচিত হইয়াছে বলিয়া দাবী করে, তাহা না হইলে নিশ্চয় পরিষদে লিয়াকত আলী খান তাহা উপস্থাপিত করিতেন না। প্রস্তাবে শুধু কতকগুলি সুললিত শব্দগুচ্ছ রহিয়াছে, সেখানে জনসাধারণের মত প্রকাশের ও সত্যিকারের গণতান্ত্রিক অধিকার ও রাষ্ট্র কর্ণধারগণের ধুরন্ধর চক্রের অত্যাচার হইতে মুক্ত হইবার কোন পরিষ্কার আভাস নাই। অত্যাচার ও অবিচারের সনদটাই অনাদীকালের জন্য বাঁচিয়া থাকিবে।
আমি এই বিশ্বাস করি যে, মূলনীতি কমিটির এই রিপোর্টটি গণপরিষদে সাময়িক স্থগিত রাখার পেছনে নিশ্চয়ই অসৎ উদ্দেশ্য রহিয়াছে, তাহা শুধু জনসাধারণের গতিশীল আন্দোলনকে বিপথগামী ও চাপা দিবার উদ্দেশ্যেই।
এ প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তের উল্লেখ করে জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে কমরুদ্দীন আহমদ আরো বলেন:
আমি জনসাধারণকে অতীতের একটি কথা স্মরণ করাইয়া দিতে চাই। ১৯৪৮ সালে যখন বাংলা ভাষার আন্দোলন প্রবল হইতে প্রবলতর হইতেছিলো, তখন খওয়াজা নাজিমুদ্দীন ভাষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সহিত একটি চুক্তিপত্রে আবদ্ধ হইয়াছিলেন। কিন্তু পরে নির্লজ্জভাবে এই চুক্তির ধারাগুলি ভঙ্গ করিতে পরান্মুখ হন নাই এবং সেই সময়ে সরকার একটি ইস্তাহার বাহির করিয়া জানাইয়াছিলেন কেন বৈদেশিক ভাষা পূর্ব বাঙলার জন্য চাপাইয়া দেওয়া হইবে না কিন্তু পুনরায় পর মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া সরকার পরীক্ষার নামে উর্দু ভাষা চাপাইয়া দিবার ফিকির করিতেছেন—এই সকল ভূরি ভূরি প্রমাণ আমাদের নিকট রহিয়াছে। আজ মিঃ লিয়াকত আলীর প্রতিশ্রুতির পরিণতি এই পরিপ্রেক্ষিতেই দেখিতে হইবে।
এই বিবৃতিটির শেষে গণতান্ত্রিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে কমরুদ্দীন আহমদ জাতীয় মহাসম্মেলনের গৃহীত প্রস্তাবসমূহের ভিত্তিতে ব্যাপক ও সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলার
জন্যে জনসাধারণের কাছে আহ্বান জ্ঞাপন করেন।
এই শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন এর পরবর্তী পর্যায়ে স্তিমিত হয়ে অল্পকালের মধ্যেই সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যায়। আন্দোলন এইভাবে স্থগিত হওয়ার মূল কারণ গণপরিষদে এ বিষয়ে আর কোন নোতুন প্রস্তাব উত্থাপন অথবা পুরাতন প্রস্তাবের ওপর কোন আলোচনা না হওয়া। বস্তুতঃপক্ষে মূলনীতি কমিটির রিপোর্টের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভ লক্ষ্য করে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুগত মূলনীতি কমিটি শাসনতান্ত্রিক সুপারিশের ক্ষেত্রে কিছু কিছু পরিবর্তন করে নোতুন একটি রিপোর্ট তৈরীর কাজে হাত দেন। সে রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে লিয়াকত আলীর মৃত্যুর পর।[৭১]
৮. শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন ও জনগণের চেতনা
১৯৫০ সালের শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের চেতনায় একটা তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন সৃষ্টি হয়। এদিক দিয়ে এই আন্দোলন পূর্ব বাঙলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখ্যযোগ্য পথচিহ্ন।
১৯৪৭ সালের অগাস্ট মাস থেকেই বস্তুতঃপক্ষে পূর্ব বাঙলার জনগণের ওপর মুসলিম লীগ শাসনের শোষণ ও নির্যাতন শুরু হয় এবং উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু ১৯৫০ সালের এই আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত সেই শোষণ ও নির্যাতনকে মূলতঃ কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত হিসেবে না দেখার ফলে জনগণের বিক্ষোভ অনেক বেশী প্রাদেশিক সরকার ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে স্থাপিত হয়। আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধেও প্রথম থেকেই যথেষ্ট বিক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও তাকে মূলতঃ কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট হিসেবে না দেখে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাকে অবাঙালী হিসেবে চিহ্নিত করেই লোকে ক্ষান্ত থাকতো। শুধু তাই নয়, তৎকালে প্রাদেশিক সরকার, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ এবং প্রাদেশিক আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে নির্যাতন, দুর্নীতি ইত্যাদির প্রতিকারকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন জানানো হতো। কারণ তখন তাঁরা সাধারণভাবে মনে করতেন প্রাদেশিক সরকারই মুসলিম লীগ ও আমলাতন্ত্রের সাহায্যে জনগণের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে তার তেমন কোন সম্পর্ক নেই।
১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গণপরিষদের মূলনীতি নির্ধারক কমিটির সুপারিশ প্রকাশিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। কারণ এই সুপারিশসমূহের মাধ্যমে পূর্ব বাঙলার ওপর শোষণ ও নির্যাতনকে কায়েম করার যে ব্যবস্থা ছিলো জনগণের দৃষ্টি তৎক্ষণাৎ তার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং যেহেতু এই সমস্ত সুপারিশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ নির্দেশ ও তদারকীতেই মূলনীতি কমিটি প্রদান করেছিলো সেজন্যে এর সমস্ত দায়িত্ব যে কেন্দ্রীয় সরকারের সে বিষয়েও তাঁদের কোন সন্দেহ থাকে না।
এই চেতনার ফলেই প্রাদেশিক সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট হিসেবে বিবেচনা করে জনগণ তাঁদের শাসনতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে মূলতঃ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধেই পরিচালনা করেন।
এর পর থেকে শুধু শাসনতান্ত্রিক অধিকারের সংগ্রামকেই নয়, সর্বপ্রকার গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সরকারকেই জনগণ মূল শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে পূর্ব বাঙলায় পাকিস্তানী শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ক্রমাগতভাবে নিজেদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে সংগঠিত করেন।
তথ্যসূত্র
১ Report of the Basic Principles Committee, Published by the Government of Pakistan, 1952, P (1).
২ এই উদ্ধৃত অংশগুলি মূল রিপোর্টের থেকে উদ্ধৃত- ব.উ.।
৩ ৪ঠা ও ৫ই নভেম্বর তারিখে ঢাকায় জাতীয় মহাসম্মেলনে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ গঠনতন্ত্র রচনার মূলনীতি ও মৌলিক অধিকারের প্রস্তাবাবলী। গণতান্ত্রিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় পরিষদের পক্ষে কমরুদ্দীন আহমদ কর্তৃক প্রকাশিত, ১৯৫০, পৃ ১-২।
৪ নওবেলাল, ৫/১০/১৯৫০।
৫ জাতীয় মহাসম্মেলনের প্রস্তাবাবলী, পৃ ৩।
৬ পূর্বোক্ত, পৃ ৪-৫
৭ পূর্বোক্ত, পৃ ৫।
৮ নওবেলাল, ৫/১০/১৯৫০।
৯ পূর্বোক্ত।
১০ পূর্বোক্ত।
১১ পূর্বোক্ত।
১২ জাতীয় মহাসম্মেলনের প্রস্তাবাবলী, পৃ ৬
১৩ নওবেলাল, ১২/১০/৫০। ১৪ পূর্বোক্ত।
১৫ পূর্বোক্ত।
১৬ তাজউদ্দীনের ডায়েরী, ৫/১০/১৯৫০।
১৭ পূর্বোক্ত, ১৩/১০/৫০।
১৮ নওবেলাল, অক্টোবর-নভেম্বর ১৯৫০। ১৯ পূর্বোক্ত, ২৬/১০/৫০।
২০ তাজউদ্দীনের ডায়েরী, ২৭-১০-৫০।
২১ নওবেলাল, ২৬/১০/৫০।
২২ তাজউদ্দীনের ডায়েরী, ৩১/১০/৫০।
২৩ Commitee of Action For Democratic Federation সংক্ষেপে Democratic Federation.
২৪ কমরুদ্দীন আহমদ।
২৫ তাজউদ্দীনের ডায়েরী, ১২/১০/৫০।
২৬ পূর্বোক্ত, ১৭/১০/৫০ থেকে ২৮/১০/৫০।
২৭ পূর্বোক্ত, ১/১১/৫০।
২৮ পূর্বোক্ত, ৪/১১/৫০।
২৯ প্রচারিত মূল ইস্তাহারটি ইংরেজীতে রচিত – Will Janab Liaquat Ali Khan Answer The Folowing Question?
৩০ নওবেলাল, ১৬/১১/৫০।
৩১ তাজউদ্দীনের ডায়েরী, ৫/১১/৫০।
৩২ পূর্বোক্ত, ৪/১১/৫০।
৩৩ ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন ছিলো পাকিস্তান প্রশ্নের ওপর গণভোট। প্রার্থীদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা অযোগ্যতার বিচার না করে এমনকি মোসলেম লীগ ‘ল্যাম্পপোস্ট’কে মনোনীত করলেও তাদেরকে ভোট দানের জন্য মুসলিম লীগ সভাপতি মহম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি নির্বাচনের সময় আহ্বান জানান। – ব.উ.।
৩৪ পূর্বোক্ত, ৫-১১-৫০।
৩৫ পূর্বোক্ত।
৩৬ কমরুদ্দীন আহমদ।
৩৭ কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীনের ডায়েরী, ৫/১১/৫০।
৩৮ ৪ঠা এবং ৫ই নভেম্বর তারিখে ঢাকায় জাতীয় মহাসম্মেলনে পাকিস্তানের ভবিষৎ গঠনতন্ত্র রচনার মূলনীতি ও মৌলিক অধিকারের প্রস্তাবাবলী। গণতান্ত্রিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত, পৃ ৯-১০।
৩৯ Constitution of Pakistan, Basic principles as adopted in Grand National Convention, Dacca, Published by Kamruddin Ahmed, Convenor, Central Committee for Democratic Federation, 4 Zindabahar, 1st Lane, Dacca, 1953 P. 3.
৪০ পূর্বোক্ত, পৃ ৩-৫।
৪১ পূর্বোক্ত, পৃ ৫-৬।
৪২ পূর্বোক্ত, পৃ ৭।
৪৩ পূর্বোক্ত, পৃ ৭।
৪৪ পূর্বোক্ত, পৃ ৭।
৪৫ পূর্বোক্ত, পৃ ৭-৮।
৪৬ পূর্বোক্ত, পৃ ৮।
৪৭ পূর্বোক্ত, পৃ ৮।
৪৮ পূর্বোক্ত, পৃ ৯-১১।
৪৯ পূর্বোক্ত, পৃ ১২।
৫০ পূর্বোক্ত, পৃ ১২-১৩।
৫১ তাজউদ্দীনের ডায়েরী, ১২/১১/৫০।
৫২ নওবেলাল, ২৩/১১/৫০।
৫৩ পূর্বোক্ত।
৫৪ পূর্বোক্ত।
৫৫ পূর্বোক্ত।
৫৬ পূর্বোক্ত, ১৬/১১/৫০।
৫৭। গণতান্ত্রিক ফেডারেশন কর্তৃক প্রকাশিত মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত প্রস্তাবাবলী, পৃ ১১।
৫৮ নওবেলাল, ২৬/১০/৫০, ১৬/১১/৫০, ২৩/১১/৫০।
৫৯ পূর্বোক্ত, ২৬/১০/৫০।
৬০ পূর্বোক্ত, ২৬/১১/৫০।
৬১ পূর্বোক্ত, ২৩/১১/৫০।
৬২ পূর্বোক্ত, ১২/১০ /৫০।
৬৩ পূর্বোক্ত।
৬৪ গণতান্ত্রিক ফেডারেশন কর্তৃক প্রকাশিত মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত প্রস্তাবাবলী, পৃ ১১/১২।
৬৫ নওবেলাল, ২১ / ১২ /৫০।
৬৬ গণতান্ত্রিক ফেডারেশন কর্তৃক প্রকাশিত মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত প্রস্তাবাবলী, পৃ ১২-১৩।
৬৭ নওবেলাল, ১৮/১/১৯৫১; সৈনিক, ২১/১/১৯৫১।
৬৮ Pakistan Observer, 21 / 1 /1951.
৬৯ নওবেলাল, ৩০/১১/১৯৫১।
৭০ পূর্বোক্ত, ৭/১২/১৯৫০।
৭১ Report of the Basic Principles Committee, Published by the Govt. of Pakistan, Karachi, 1952.
যাঁদের সাথে সাক্ষাৎ আলাপ হয়েছে
অজয় ভট্টাচার্য
অলি আহাদ
আজহার হোসেন
আবদুল হক
আব্দুশ শহীদ
ইমতিয়াজউদ্দীন খান
কমরুদ্দীন আহমদ
তফজ্জল আলী
নগেন সরকার
মনি সিং
রমেন মিত্র
শরদিন্দু দে লালা
শান্তি সেন
সইফ-উদ-দাহার
সুখেন্দু দস্তিদার
সুধাংশু বিমল দত্ত
স্বদেশ বসু
হাজী মহম্মদ দানেশ
যাঁদের লিখিত নোট ব্যবহার করা হয়েছে
অজয় ভট্টাচার্য
কামাখ্যা রায় চৌধুরী
নগেন সরকার (খুলনা)
প্রমোদ দাস
সইফ-উদ-দাহার
সুষমা দে
.