রাজমালা - প্ৰথম ভাগ - উপক্রমণিকা
রাজমালা - দ্বিতীয় ভাগ
রাজমালা - তৃতীয় ভাগ
রাজমালা চতুৰ্থ ভাগ

ষষ্ঠ অধ্যায় – চাকলে রোসনাবাদ

ষষ্ঠ অধ্যায় – চাকলে রোসনাবাদ

ত্রিপুরার সমতল ক্ষেত্র মুসলামনগণ ক্রমে ক্রমে অধিকার করিয়াছিলেন, তাহা পূর্বে বর্ণিত হইয়াছে। ১১৪২ ত্রিপুরাব্দে মির হবিবের দ্বারা ত্রিপুরার সমতলক্ষেত্র শেষবার সম্পূর্ণ রূপে অধিকৃত হয়। এই সময় তাহাকে রোসনাবাদ আখ্যা প্রদান করা হইয়াছিল। এই রোসনাবাদ চাকলা তৎকালে ২৪টি পরগণায় বিভক্ত ছিল। দাউদপুর পরগণা তাহার অন্যতম। অল্পকাল পরে দাউদপুরের মুসলমান জমিদারগণ তাহা রোসনাবাদ হইতে খারিজ করিয়া লইয়াছিলেন। সুতরাং মির হবিবের ত্রিপুরা বিজয়ের পর ত্রিপুরেশ্বর ২৩টি পরগণা মাত্র জমিদারী স্বরূপ প্রাপ্ত হন। ক্রমে রোসনাবাদ ৫৩পরগণায় বিভক্ত হইয়াছে। প্রধানত রাজপরিবারের যৌতুক (যুলাই) দ্বারা এবং ত্রিপুরেশ্বরের প্রাচীন কর্মচারিগণ কর্তৃক (স্ব স্ব নাম চিরস্মরণীয় করিবার জন্য) এক একটি বৃহৎ পরগণার কিয়দংশ দ্বারা (স্বয়ং তালুক স্বরূপ গ্রহণ॥ ৫৩৯॥ করত স্ব স্ব নামে) ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এক একটি পরগণা সৃষ্ট হইয়াছিল। যুবরাজ চম্পকরায় মহারাজ রত্নমাণিক্যের সময়ে নুরনগরের শাসন কর্তৃত্বে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি নুরনগরের কিয়দংশ দ্বারা জয়দেবনগর নামক পরগণা সৃষ্টি করিয়াছিলেন। প্রকৃতপক্ষে রোসনাবাদ মধ্যে নুরনগর, মেহেরকুল, বগাসাইর, তীষ্ণা, ও খণ্ডল এই ৫টি মূল ও বৃহৎ পরগণা ছিল। এই ৫টি দ্বারা মির হাবিবের সময় ২৪টি পরগণা গণনা করা হয়। এই ২৪টি হইতে দাউদপুর খারিজ হইয়া ২৩টি ছিল। ১৮৬১- ৬৪ খ্রিস্টাব্দের রেভিনিউ সার্বেকালে। রোসনাবাদ মধ্যে ৫৩টি পরগণা প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। উক্ত সার্বে কাগজ দৃষ্টে পরগণা সমূহের ভূমির পরিমাণ এস্থলে উদ্ধৃত হইল।

রেভেনিউ সার্বেয়ার স্মার্ট সাহেব স্বীয় রিপোর্টে পরগণা সমূহের ভুমির যে পরিমাণ লিখিয়াছেন, তাহা আমাদের সংগৃহীত কাগজের সহিত অনৈক্য হইতেছে। এজন্য এস্থানে উভয় পরিমাণ প্ৰদৰ্শিত হইল।॥৫৪০।।

রেভেনিউ সার্বেয়ার স্মার্ট সাহেব স্বীয় রিপোর্ট
রেভেনিউ সার্বেয়ার স্মার্ট সাহেব স্বীয় রিপোর্ট

ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণের লিখিত রিপোর্ট সমূহে চাকলে রোসনাবাদের পরিমাণ ৩৭৭১০০ একর বা ৫৮৯ বর্গমাইল লিখিত আছে। আমাদের সংগৃহীত সার্বে কাগজ অনুসারে ভূমির পরিমাণ এইরূপ হইতেছে :

বিভাগএকরকডপোল
উত্তর বিভাগ১৪১০৯৬১৩
সদরকাচারী মোগরা মধ্যবিভাগ১৪২৩৮৫২৩
সদরকাচারী কুমিল্লা দক্ষিণ বিভাগ৮৩৮৫২১৭
সদরকাচারী ফেণী৩৬৭৩৩৫১৩

উমাকান্ত বাবুর মন্ত্রীত্বকালে, তিনি ১৩০০ ত্রিপুরাব্দের যে বার্ষিক বিজ্ঞাপনী প্ৰকাশ করিয়াছিলেন, তাহাতে মহারাজের জমিদারীর ভূমি ও স্থিতের তালিকা নিম্নলিখিত রূপ প্রদত্ত হইয়াছে।॥৫৪৪

বিভাগসদরকাচারীভূমির পরিমাণ (একর)স্থিত টাকা
দক্ষিণ বিভাগফেণী৭৯৫০২২০০৩৬৪ দুই আঃ ৮ পাঃ
মধ্যবিভাগকুমিল্লা১৪৬১৮৬২৯৭১২৫ ছয় আঃ ৬ পাঃ
উত্তরবিভাগমোগরা১৪০৯৪৩১২১৬৫৭ চার আঃ ৩ পাঃ
শ্রীহট্ট বিভাগলাহারপুর২৯০০০২৫৬৫৫ আট আঃ ৭ পাঃ
সর্বশুদ্ধ ৩৯৫৬৩১৬৪৪৮০২ নয় আঃ ১১ পাঃ৪

ফেণী অর্থাৎ দক্ষিণ বিভাগ নওয়াখালী জেলার অধীন। চাকলে রোসনাবাদ ব্যতীত নওয়াখালী জেলার মধ্যে মহারাজের অতি অল্প পরিমাণ অন্য জমিদারী আছে। মধ্যবিভাগ মধ্যে জেলা ত্রিপুরার প্রধান নগরী কুমিল্লা অবস্থিত। এই বিভাগ সম্পূর্ণ ত্রিপুরা জেলার অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে।

উত্তর বিভাগের অধিকাংশ ত্রিপুরা জেলার মধ্যে অবস্থিত। মন্তলা প্রভৃতি কয়েকটি ক্ষুদ্র পরগণা শ্রীহট্ট জেলার অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে।

লাহারপুর কাচারির অধীন শ্রীহট্ট বিভাগ, চাকলে রোসনাবাদের অন্তর্গত নহে। মহারাজ রামগঙ্গা মাণিক্য কিরূপ শ্রীহট্টের অন্তর্গত জমিদারী ক্রয় করেন, তাহা পূর্বে বর্ণীত হইয়াছে। তদনন্তর মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য বাহাদুর কয়েকটি মহাল ক্রয় করত তাহার পরিমাণ বৃদ্ধি করিয়াছেন।

পূর্বে বর্ণীত হইয়াছে যে, মহারাজ কৃষ্ণ মাণিক্যের শাসনকালে ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে নুরনগর (কসবা) ॥৫৪৫॥ নগরে প্রথম ব্রিটিস বিজয়বৈজয়ন্তী উড্ডীন হইয়াছিল। এই সময় ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারিগণ রোসনাবাদের শাসনকার্য্যে হস্তক্ষেপ করেন। রেসিডেন্ট লিক সাহেব রোসনাবাদের প্রথম শাসনকর্তা। ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দের ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণ রোসনাাদের রাজস্ব ১০০০০১ টাকা ধার্য্য করেন।

১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগষ্ট সম্রাট সাহা আলম ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানিকে বাঙ্গালা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী পদ প্রদান করেন। তদনন্তর কোম্পানির কর্মচারীগণ রোসনাবাদের রাজস্ব আদায় ও শাসনকাৰ্য্য নির্বাহ জন্য নানা প্রকার বন্দোবস্ত করিয়াছেন।

পূর্বে বর্ণীত হইয়াছে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে বলরাম মাণিক্যের হস্তে রোসনাবাদের শাসনভার অর্পিত হইয়াছিল। অল্পকাল পরে পুনর্বার কৃষ্ণ মাণিক্য স্বীয় অধিকার প্রাপ্ত হন।

১৭৮২ খ্রিস্টাব্দের (১১৯২ ত্রিপুরাব্দে) রেসিডেন্ট লিক সাহেব স্বহস্তে রোসনাবাদের শাসনভার গ্রহণ করেন। এই সময় মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্যের ভ্রাতুষ্পুত্র (ত্রিপুরার ভাবী নরপতি) “রাজধর ঠাকুর” কোম্পানির প্রতিকূলে অস্ত্রধারণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিলেন বলিয়া রেসিডেন্ট গবর্ণমেন্টে রিপোর্ট করেন। যদিচ নানাবিধ কারণে এবপ্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা সূত্রপাত হইয়াছিল, কিন্তু সুখের বিষয় যে, প্রকৃতপক্ষে ॥৫৪৬॥ তদ্রূপ কোন ঘটনা হয় নাই। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য পরলোক গমন করেন। তদনন্তর কিছুকাল তাঁহার পত্নী জাহ্নবী দেবী রাজ্য শাসন করিয়াছিলেন। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দের গবর্ণমেন্টের অনুমতি মতে রেসিডেন্ট লিক সাহেব মৃত রাজার ভ্রাতুষ্পুত্র উল্লিখিত রাজধর ঠাকুরকে ত্রিপুরায় সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন। কিন্তু ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের (১২০২ ত্রিঃ অঃ) পূর্বে রোসনাাদের শাসনভার সম্পূর্ণরূপে তাহার হস্তে অর্পিত হয় নাই।

প্রায় দশ বৎসর কাল লিক, কেম্পবল, বুলার প্রভৃতি রেসিডেন্ট সাহেবগণের হস্তে রোসনাবাদের শাসনকাৰ্য্য ন্যস্ত ছিল। কিন্তু তাঁহারা মহারাজ ও তাঁহার কর্মচারিগণের যোগে শাসনকাৰ্য্য নির্বাহ করিতেন। রেসিডেন্ট সাহেবগণের কর্তৃত্বাধীনে চাকলে রোস- নাবাদ জরিপ হইয়াছিল।

তৎকালে চাকলে রোসনাবাদের অন্তর্গত নুরনগর, বিশালগড়, ধর্মপুর, গোপীনাথপুর, উত্তর গঙ্গানগর ও চম্পকনগর প্রভৃতি পরগণার অধিকাংশ অরণ্যপূর্ণ ছিল। মহারাজ তাহার বনকর প্রভৃতি (শুল্ক) দ্বারা বার্ষিক প্রায় ৩০৭৬২ টাকা “সায়রত” জমা প্রাপ্ত হইতেন। রেসিডেন্ট বুলার সাহেবের যত্নে ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে উল্লিখিত সায়রত জমা বন্ধ হইয়া যায়। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই আগষ্ট সেই মর্ম্মে বুলার সাহেব এক ঘোষণাপত্র প্রচার করেন। ॥৫৪৭

১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের মহারাজ রাজধর মাণিক্যের সহিত চাকলে রোসনাবাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয় এবং ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণ রোসনাবাদের শাসনভার সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেন। তৎকালে উল্লিখিত সায়রত জমা ২৮০০০ টাকা বাদে শিক্কা ১৩৭০০১ টাকা রোসনাবাদের রাজস্ব অবধারিত হয়। ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ই এপ্রিল (১২১২ বঙ্গাব্দের ৭ই বৈশাখ) মহারাজ রামগঙ্গামাণিক্য হইতে রোসনাবাদের জন্য গবর্নমেন্ট যে কবুলিয়ত গ্রহণ করেন, তাহাতে শিক্কা ১৩৯৬৭৬ টাকা বার্ষিক রাজস্ব লিখিত আছে। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ২রা মার্চ (১২৩৬ বঙ্গাব্দের ২০শে ফাল্গুন) মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য রোসনাবাদের জন্য এক কবুলিয়ত দাখিল করেন, তাহাতে রাজস্বের কোন পরিবর্তন হয় নাই। তৎপর একশত বিঘার অধিক পরিমাণ অসিদ্ধ নিষ্করের জন্য (৮০০০-৩৩৭৩০৩=) ৪৬২৬ সাত আনা ৯ পাই টাকা এবং শিক্কা ১৩৯৬৭৬ টাকার পরিবর্তে কোম্পানির মুদ্রা ১৪৮৯৮৪ টাকা এগার আনা ৯ পাই সংযুক্ত করত সর্বশুদ্ধ ১৫৩৬১৪ টাকা আনা ৬ পাই মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্য ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২১শে মে (১২৬২ বঙ্গাব্দে ৮ই জ্যৈষ্ঠ) “কোম্পানী বাহাদুর” সমীপে একখানা কবুলিয়ত প্ৰদান করেন। অধুনা তদনুসারে রোসনাবাদের রাজস্ব পরিশোধ হইতেছে।

রোসনাবাদ মধ্যে অনেক প্রকার নিষ্কর ও মধ্যস্বত্বের তালুক আছে। উত্তর বিভাগস্থিত নুরনগর ও তৎসামিলা ॥৫৪৮॥ পরগণা সমূহ ব্যতীত মধ্য দক্ষিণ বিভাগে তালুকের সংখ্যা নিতান্ত অল্প। মকররী তালুকগুলি অপেক্ষাকৃত প্রাচীন। দুর্বল ও অনভিজ্ঞ লাখেরাজদারবর্গের মস্তকে কুঠারাঘাত করিয়া বিপিনবিহারী গোস্বামী কতকগুলি পত্তনি তালুক সৃষ্টি করিয়াছিলেন। তদনন্তর বর্তমান মহারাজ আরও কতকগুলি পত্তনি তালুক প্রদান করিয়াছেন। কতকগুলি পরিবর্ত্তনশীল জমার তালুক আছে, সম্পূর্ণরূপে না হইলেও তাহার প্রকৃতি নুরনগর পরগণার ঐ শ্রেণীর তালুকের সদৃশ।

পূর্বে বর্ণীত হইয়াছে যে, মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের শাসনকালে গুরু বিপিনবিহারী গোস্বামী রোসনাবাদের অন্তর্গত সর্বপ্রকার নিষ্কর বাজেয়াপ্ত করিবার জন্য বদ্ধ পরিকর হইয়াছিলেন। তৎকালে (১৮৬১ খ্রিঃ) তিনি প্রকৃতপক্ষেই লোভে উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন, সিদ্ধ, অসিদ্ধ কিম্বা ১০০ বিঘার উর্দ্ধ নিষ্কর বলিয়া তাঁহার জ্ঞান ছিল না। “লাখেরাজ” আঘ্রাণ পাইলেই তাহা কিরূপ বাজেয়াপ্ত করিবেন সেই চিন্তায় তিনি উন্মত্ত হইয়া উঠিতেন। কতকগুলি দুর্বল, অনভিজ্ঞ লাখেরাজদরকে ছলে বলে ও কৌশলে করতলস্থ করিয়া সেই সকল লাখেরাজ বাজেয়াপ্ত করত কতকগুলি তালুক সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন। যে সকল ॥৫৪৯॥ লাখেরাজদার করদানে সম্পূর্ণ অসম্মত হইলেন, তাহাদের নামে লাখেরাজ বাজেয়াপ্ত করিবার জন্য প্রায় লক্ষাবধি টাকা খরচ করিয়া অনেকগুলি মোকদ্দমা উপস্থিত করা হইল। কিন্তু দুর্ভাগ্য বসত তাঁহার আশা সফল হইল না।

কতকগুলি এক তরফা ব্যতীত বিতর্কিত মোকদ্দমায় রাজসরকার পরাজিত হইলেন।

এই শ্বাপদ সঙ্কুল, অনার্য প্লাবিত অরণ্যময় প্রদেশে আর্য্য উপনিবেশ স্থাপন জন্য প্রাচীন নরপতিগণ যে মুক্ত হস্তে নিষ্কর প্রদান করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন, তাহা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতে হইবে। বাঙ্গালার পূর্ব সীমান্তে যেরূপ ত্রিপুরা অবস্থিত, তদ্রূপ বাঙ্গালার পশ্চিম সীমান্তে বিষ্ণুপুর ও পঞ্চকোট রাজ্য অবস্থিত ছিল। বিষ্ণুপুর রাজ্য বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে, কিন্তু পঞ্চকোটের নাম অদ্যাপি বিলুপ্ত হয় নাই। সেই পঞ্চকোটের পরিমাণ তিনটি চাকলে রোসনাবাদের সমান হইবে। সেই পঞ্চকোট রাজ্যের দুই তৃতীয়াংশ ভূমি লাখেরাজ ও জায়দীরদারদিগের অধিকৃত। বর্তমান ত্রিপুরেশ্বর যৎকালে ত্রিপুরাজাতির জলাচরণ জন্য দেশবাসীর সহিত কলহ করিতেছিলেন, তৎকালে জলতরঙ্গের পৃষ্ঠপোষক স্বীয় অনুচর দ্বারা “সাময়িক সমালোচনার সমালোচনা ও মীমাংসা” নামক এক পুস্তিকা প্রকাশ করেন, উক্ত গ্রন্থের ২৭ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে :- “ত্রিপুরারাজগণ পুরুষানুক্রমে দেবতা ॥৫৫০॥ দ্বিজ এবং গুরুভক্তি পরায়ণ। ত্রিপুর রাজত্বের প্রায় অৰ্দ্ধাংশ ভূমি দেব ব্রহ্মত্র এবং পুরস্কারস্বরূপ প্রদত্ত হইয়াছে, এরূপ বলিলে অত্যুক্তি হয় না।” এই বর্ণনা অত্যুক্তিপূর্ণ হইলেও ইহা স্বীকার করিতে হইবে যে, প্রাচীন ত্রিপুরেশ্বরগণ তাঁহাদের অধিকৃত প্রদেশে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্রভৃতি উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুগণকে উপনিবিষ্ট করিবার জন্য প্রচুর পরিমাণে নিষ্কর দান করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু অধুনা রাজবংশীয় দিগের প্রকৃতি অন্যরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহারা তাঁহাদের পূর্বপুরুষদত্ত লাখেরাজ কিরূপ বাজেয়াপ্ত করিবেন। সেই চিন্তায় মগ্ন হইয়াছেন। কৃত্রিম লাখেরাজের দোহাই দিয়া তাঁহারা সর্বপ্রকার নিষ্কর গ্রাস করিতে সমুদ্যত হইয়াছেন। গুরুবিপিনবিহারী যে সমস্ত লাখেরাজ বাজেয়াপ্তের মোকদ্দমা উপস্থিত করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে সিঙ্গারবিল নিবাসী উজির বংশধর শিবজয় ঠাকুর, চৌদ্দগ্রাম নিবাসী উমাকান্ত সেন বাহাদুর, বানাসুয়া নিবাসী উদয় চন্দ্ৰ বিশ্বাস এবং লেসীয়াড়া নিবাসী গৌরচন্দ্র ভট্টাচার্য্য প্রভৃতির নামীয় মোকদ্দমা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।[৯] এই সকল মোকদ্দমা ॥৫৫১।। বিশেষ তর্কের সহিত আপীল আদালত পৰ্য্যন্ত চলিয়াছিল এবং সমস্ত গুলিতে লাখেরাজদারগণ জয়লাভ করেন।

যে সকল মোকদ্দমা একতরফা সূত্রে রাজসরকারের অনুকূলে নিষ্পত্তি হইয়াছিল, তন্মধ্যে অল্প কয়েকটি মোকদ্দমায় ॥৫৫২॥ বাজেয়াপ্ত ভূমিতে কর ধার্য্য হয়। অবশিষ্ট গুলির তদ্বির চালাইতে রাজসরকার বিবিধ কারণে সঙ্কোচিত হইয়াছিলেন। দীর্ঘকাল পরে সেই সকল “একতরফা” মোকদ্দমা গুলিকে বর্তমান মহারাজ পুনর্জীবিত করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। কলিকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিগণ সেই পন্থা রুদ্ধ করত গরিব লাখেরাজদারদিগকে রক্ষা করিয়াছেন।[১০] ॥৫৫৩॥

.

টীকা

১. ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা ডিসেম্বর ত্রিপুরা জেলার সার্বে কার্য্য আরম্ভ হয়। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে তাহা সম্পূর্ণ হইয়াছিল।

২. Smart’s Report of the District of Tipperah. pp / 15.16

৩. এই ক্ষুদ্র পরগণার নুরনগরের অন্তর্ভুক্ত।

৪. স্মার্টের তালিকায় এই সকল পরগণার নাম নাই।

৫. মন্তলা, মণিপুরের সহিত পরিমাপ হইয়াছে।

৬. জয়দেব নগরের সহিত পরিমাপ হইয়াছে।

৭. স্মার্ট এই দুইটি পরগণা মেহেরকুল ভুক্ত করিযাছেন।

৮. Hunter’s Bengal Ms. Records Vol. I. P/ 36

৯. এই সকল মোকদ্দমার মধ্যে ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে ২৩৬ নং বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২৩৬ নং মোকদ্দমার সুদীর্ঘ নিষ্পত্তিপত্রে ত্রিপুরার প্রধান সদর আমিন বাবু জগবন্ধু বন্দোপাধ্যায় পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সুদীর্ঘ মন্তব্য প্ৰকাশ করিয়াছেন*। আপীল আদালত তাঁহার নিষ্পত্তি বহাল রাখেন। লাখেরাজ বাজেয়াপ্তের অনেকগুলি মোকদ্দমায় লাখেরাজদার কালেক্টরির মহাফেজখানায় রক্ষিত মিনাহি তেরিজের নকল দাখিল করেন। রাজ সরকার পক্ষে এই সকল কাগজ অপ্রামাণ্য বলিয়া আপত্তি উত্থাপন করেন। কিন্তু মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য, রামলোচন বর্দ্ধন প্রভৃতির নামীয় জমানি খণ্ডের মোকদ্দমায় ১২৪৯ সনের ১০ই পৌষ এক দরখাস্ত দ্বারা উক্ত মিনাহী কাগজ অনুসারে রাজ সরকারের প্রতিকূলে মোকদ্দমা নিষ্পত্তি করিয়াছেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ একটি মোকদ্দমার নিদর্শন এস্থলে প্রদত্ত হইল।
ত্রিপুরার জজ আদালত, আপীল নং ২৭, সন ১৮৬৩ ইং। ত্রিপুরার প্রধান সদর আমিন শ্রীযুক্ত বাবু জগবন্ধু বন্দোপাধ্যায়ের সন ১৮৬৩ ইং ১৯ শে জানুয়ারীর নিষ্পত্তি অস্বীকারে আপীল।
বীরচন্দ্র ঠাকুর আপীলান্ট। রামজয় বর্ম্মণ গং রেস্পাডেন্ট। ১৮৬৩ ইং ১৮ ই আগষ্ট আপীল ডিসমিস হইয়াছিল।

১০. Indian Law Reports, Calcutta Series. Vol. XVI. PP. 449-450.

* বীরচন্দ্র যুবরাজ বাদী, উদয়চন্দ্র বিশ্বাস গং বিবাদী, ১৮৬১ ইং ৩৭৪ নং ২৯শে ডিসেম্বরের নিষ্পত্তিপত্র দ্রষ্টব্য

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *