ষষ্ঠ অধ্যায় – কৃষি ও বাণিজ্যিক অর্থনীতির বিস্তার (খ্রীঃ পূঃ ১৭৫-খ্রীঃ ৩০০)
খ্রীঃ পূঃ চতুর্থ শতকের শেষভাগ থেকে খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতাব্দীর গোড়ার দিক অবধি রাজনৈতিক কেন্দ্রীকরণ ও রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যে সহাবস্থান ভারতের বৃহত্তর অংশে দেখা দিয়েছিল, মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের ফলে তাতে ছেদ ঘটল। দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম সিকি ভাগের মধ্যেই মৌর্য সাম্রাজ্যের অবসান হয়; তারপর সমগ্র উপমহাদেশ ব্যাপী আর কোনও একটি রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দেখা না দিলেও উত্তর ভারতে সুঙ্গ, কাণ্ব, চেদী, নাগ প্রভৃতি ক্ষমতাবান রাজবংশের একের পর এক উত্থান ঘটে, দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন, ইক্ষ্বাকু প্রভৃতি রাজবংশের ক্ষমতা বিস্তারের কথাও জানা যায়। সুদূর দক্ষিণ ভারতেও রাজনীতির রূপরেখা স্পষ্টতর হয়ে ওঠে যখন চোল, চের ও পাণ্ড্যদের রাজনৈতিক প্রতাপ বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক অবস্থার অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল অনেকগুলি বৈদেশিক আক্রমণ ও অনুপ্রবেশ: গ্রীক, শক, পহ্লব, কুষাণ প্রভৃতি বিদেশী জাতির আক্রমণের ফলে উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম ভারতে বিভিন্ন সময়ে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম হয়। মৌর্য আমলের মত কেন্দ্রীকৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থা যদিও ছিল না এবং রাজনৈতিক স্থিতিও মৌর্য আমলের সঙ্গে তুলনীয় নয়, তবে স্বীকার করতেই হবে যে আপেক্ষিক রাজনৈতিক টানাপোড়েন সমকালীন অর্থনৈতিক জীবনে বড় মাপের বিপর্যয় ডেকে আনেনি। এই আমলের বিবিধ তথ্যসূত্রের বিচার করলে অর্থনৈতিক জীবনে রাজনৈতিক পরিবর্তনের দরুন উপদ্রবের চিত্র দেখা যায় না। খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতকের প্রথম অংশ থেকে খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতকের শেষ পর্যন্ত প্রায় পৌনে পাঁচশত বছরের যে যুগ এই অধ্যায়ে আলোচিত হবে, তার সবচেয়ে বড় লক্ষণ অর্থনৈতিক জীবনে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের ব্যাপক অপসরণ; তার ফলে কৃষি, শিল্প ও ব্যবসায়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পুনরুত্থানের সুযোগ আসে; কৃষি অর্থনীতির সুদৃঢ় ভিত্তি দাক্ষিণাত্যে ও দক্ষিণভারতেও প্রতিষ্ঠিত হয়; ব্যবসা বাণিজ্যে বিশেষত জলপথে দূর পাল্লার বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপে প্ৰভূত বিস্তার ঘটে এবং নগরায়নের দিক দিয়েও আলোচ্য পর্বটি সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে। এই অর্থনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষণগুলির উপস্থিতির জন্য আলোচ্য যুগটির স্বাতন্ত্র্য অস্বীকার করা যায় না।
অর্থনৈতিক জীবনের সন্ধান ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে নানা প্রকার উপাদানে পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলি মধ্যে লেখমালার ভার সংখ্যা ও গুরুত্ব উভয় দিক দিয়েই এই যুগে বেড়েছে। বিশেষত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে লেখমালার অনেকগুলিই দান সংক্রান্ত, যেখানে দাতা নিজের পারিবারিক, দেশ ও বৃত্তিগত পরিচয় দিতেন। এই পৌণে পাঁচশত বছরে মুদ্রার ব্যবহারও বৃদ্ধি পেয়েছিল, তাই মুদ্রার সাক্ষ্যও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। বিগত তিন দশকের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন ও অনুসন্ধান ঐতিহাসিকের সামনে বহু নতুন তথ্য উদঘাটন করেছে, বিশেষ করে বসতি ও জীবন যাপনের নানা উপকরণ বিষয়ে নূতন আলোকপাত করা সম্ভব হয়েছে। সাহিত্যগত উপাদান পরিমাণে ও বৈচিত্র্যে আগের যুগের তুলনায় বেশী। সৃজনশীল সাহিত্যের ভিতর সমাজ ও অর্থনীতি সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক তথ্যগুলির উপর ঐতিহাসিক নির্ভর করতে পারেন। এই আমলেই ধর্মশাস্ত্রের দুই প্রধান গ্রন্থ মনুস্মৃতি ও যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি রচিত হয়; মহাভারতের শান্তিপর্ব ও অনুশাসনপর্বের সময়সীমাও আলোচ্য যুগটিতে নির্দিষ্ট। ধর্মশাস্ত্রগুলি সমাজ, অর্থনীতি, রাষ্ট্রীয় সংগঠনের আদর্শ রূপ সম্বন্ধে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়। তবে খেয়াল রাখা দরকার যে শাস্ত্রগ্রন্থগুলির বক্তব্য মূলত উপদেশাত্মক; বাস্তবে কি ঘটছিল বা ঘটছিল না, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ শাস্ত্রগ্রন্থে নেই। তাই শাস্ত্রগ্রন্থের তথ্যগুলি অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণের দ্বারা সমর্থিত হওয়া প্রয়োজন। যুদ্ধ, ব্যবসায় ও ধর্মীয় তথা সাংস্কৃতিক কারণে উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে বহির্ভারতীয় ভূখণ্ডের যোগাযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক বিবরণীতে ভারতের অবস্থার কথা আগের তুলনায় বেশী পরিমাণে ঠাঁই পেয়েছে। এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিদেশী বিবরণীগুলি হল স্ট্রাবোর জিওগ্রাফিকন, ডিওডোরাসের বিবলিওথেকেস হিস্টরিকে, প্লিনির ন্যাচারালিস হিস্টোরিয়া, অজ্ঞাতনামা গ্রীক নাবিকের বিবরণী পেরিপ্লাস টেস ইরিথ্রাস থালাসেস্ ও টলেমীর জিওগ্রাফিকে হুফেগেসিস। এছাড়াও চৈনিক গ্রন্থ হৌ হান-শু ও ছিয়েন-হান-শু-তে সমকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য জানা যায়।
॥ ২ ॥
অর্থনৈতিক জীবনে ধারাবাহিকতার লক্ষণগুলি মূলত কৃষি অর্থনীতির ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়। কৃষির উপর অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপিত হবার সূত্রপাত মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় খ্রীঃ পূঃ ৬০০ নাগাদ দেখা গিয়েছিল। মৌর্য আমলের রাষ্ট্র-নিয়মিত অর্থনীতিতে কৃষিজাত উদ্বৃত্তের গুরুত্ব সম্বন্ধে সম্যক ধারণা গড়ে ওঠে। আলোচ্য যুগে অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান উপজীবিকা হিসেবে কৃষি অব্যাহত ছিল। গ্রীক বিবরণীতে বিশেষত স্ট্রাবো ও ডিওডোরাসের রচনায় সামগ্রিকভাবে ভারতের স্বচ্ছল কৃষিকর্মের কথা উল্লিখিত। বিস্তীর্ণ সমতলভূমির স্বাভাবিক উর্বরা শক্তি, নদীবাহিত পলিমাটি, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত যে কৃষির সাফল্যের প্রত্যক্ষ উপাদান, এ বিষয়ে গ্রীক লেখকেরা যথেষ্ট সচেতন। গ্রিক লেখকরা অন্তত দুইবার বর্ষার কথা বলেছেন, যদিও মিলিন্দপঞহোতে (১১৪) তিনটি বর্ষার উল্লেখ রয়েছে।
উৎপন্ন ফসলের মধ্যে ধানের কথা সর্বপ্রথম উল্লেখ করা দরকার। ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকেই ধারাবাহিকতা লক্ষণীয় গ্রিক রচনায় ধানের কথা জানা যায়। তবে ধানের বৈচিত্র্য সম্বন্ধে অধিকতর তথ্য দেশীয় সাহিত্যে মিলবে। মিলিন্দপঞহোতে সাধারণ ধান (ব্রীহি) ও উৎকৃষ্ট ধানের (শালি) পার্থক্য স্পষ্টভাবে চিহ্নিত। (পৃঃ ২৬৭. ১০৬-০৭)। ঐ গ্রন্থে শালি ধানকে সমস্ত ফসলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। রক্তবর্ণের শালিধান মিলন্দপঞহো অনুসারে রাজার আহারের উপযুক্ত, আর দাস ও কর্মকরদের জন্য অপরান্ত দেশের (কোঙ্কন উপকূল অঞ্চল) কুমুদভণ্ডিকা ধানই প্রশস্ত। অর্থাৎ আজকের মত সরু ও মোটা এবং দামী ও সাধারণ চালের পারস্পরিক তফাৎ সম্বন্ধে প্রাচীন রচনাকারদের সচেতনতা ছিল। ধান ছাড়া অপর দুই প্রধান শস্য ছিল গম ও যব। এই দুই ফসলের কথা মহাভারত (১৩. ১১১. ৭১), মিলিন্দপঞহো (পৃঃ ২৬৭) ও প্লিনির রচনায় পাওয়া যায়। ১০৬ খ্রীঃ উৎকীর্ণ হুবিষ্কের মথুরা লেখতে সক্তু (ছাতু) ও সমিৎকর (ময়দা-প্রস্তুতকারী) সম্বন্ধে উল্লেখ আছে। অনুমান করা চলে যে ছাতু ও ময়দা যব ও গম থেকে তৈরী হত। প্লিনি আখের উৎপাদনও ভারতীয় ফসলের তালিকায় রেখেছেন। আখের ক্ষেতের উল্লেখ জৈন আচারঙ্গ সূত্রে দেখা যায়। (২. ৭. ২. ২) অপর জৈন গ্রন্থ উত্তরাধ্যায়ন সূত্রে আখের রসের শ্রেষ্ঠত্বের সম্বন্ধে মন্তব্য আছে (১. ৬. ২০)। খাদ্যশস্যের মধ্যে সর্ষে, জোয়ার, বাজরা, কলাই-এর কথা মহাভারত, মিলিন্দপঞহোতে জানা যায়।
খাদ্যশস্যের পাশাপাশি কয়েকটি পণ্যশস্যের চাষও আলোচনার দাবী রাখে। গ্রিক লেখকরা বিশেষত প্লিনি ভারতে কার্পাস ফলনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন; প্লিনি অবশ্য কার্পাসকে সঠিক ভাবে শনাক্ত করতে পারেননি। তিনি ভারতবর্ষে বিশেষ জাতীয় এক বৃক্ষের সম্বন্ধে লিখেছেন যাতে পশম জন্মায়: এই গাছ নিঃসন্দেহে তুলো চাষের পরিচয় বহন করে। তুলো ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম খ্রীঃ পূঃ পঞ্চম সহস্ৰকে চাষ করা হয়। তবে আলোচ্য যুগে তুলো চাষের বিস্তার ঘটার অন্যতম কারণ দাক্ষিণাত্যে কৃষিকাজের প্রসার, যে অঞ্চলের কৃষ্ণমৃত্তিকা তুলোর ফলনের পক্ষে বিশেষ সহায়ক। বস্ত্রশিল্পের দ্রুত বিকাশ যে এই আমলে চোখে পড়ে, তার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল তুলোর প্রচুর ফলন অপরিহার্য ছিল। দাক্ষিণাত্যে অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ফলের নিয়মিত উৎপাদন শুরু হয়: এই ফল নারকেল। খ্রীঃ প্রথম শতকের শেষ ভাগে উৎকীর্ণ নহপানের নাসিক লেখতে বত্রিশ শত নারিকেল মূল ও শিশু নারিকেলের রোপনের কথা জানা যায়। দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বী মনে করেন যে মহারাষ্ট্রের উপকূল অঞ্চল যে ব্যাপক নারকেল ফলনের পক্ষে প্রশস্ত তার প্রথম নির্দিষ্ট প্রমাণ এই লেখটিতে হাজির রয়েছে। কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে নানা প্রকারের মশলার ভূমিকা এই পর্বে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্লিনির ন্যাচারাল হিস্ট্রি, পেরিপ্লাস ও টলেমির জিওগ্রাফিতে বিবিধ ভারতীয় মশলা ও সুগন্ধীর কথা বলা হয়েছে। মশলার মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল গোলমরিচ চাষ। প্লিনি ও পেরিপ্লাস থেকে জানা যায় যে গোলমরিচ উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ছিল মালাবার উপকূল। এই দুই বৈদেশিক সূত্রে মালাবার অঞ্চলে উৎপন্ন দুই রকম গোলমরিচের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। গোলমরিচ ছাড়াও ভারতে উৎপন্ন মশলা ও সুগন্ধীর তালিকায় প্লিনি দারুচিনি, এলাচ অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এই মশলাগুলির চাষ যে মূলত দাক্ষিণাত্যের পশ্চিমাংশে ও সুদূর দক্ষিণভারতে বেশী করে হত, তা ‘পেরিপ্লাস’ থেকে প্রমাণ করা সম্ভব। প্রাচীনতম তামিল সাহিত্য, সঙ্গম কাব্যেও এই মশলা বিশেষত গোল মরিচের প্রচুর উল্লেখ লক্ষ্য করা যায়।
কৃষিকর্ম সম্বন্ধে জ্ঞান যে ক্রমবর্ধমান তা ফসল ফলানোর বিভিন্ন পর্বের তালিকা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। মিলিন্দপঞহো-র মত নিছক ধর্মগ্রন্থেও এই পর্বগুলি যথেষ্ট অনুপুঙ্খসহ বর্ণিত: (১) জমি থেকে আগাছা, কাঁটা, পাথর ইত্যাদি উৎপাটন, (২) লাঙ্গল চালনা, (৩) বীজবপন, (৪) সেচন, (৫) কৃষিক্ষেত্রের চারপাশে বেড়া দেওয়া, (৬) কৃষিক্ষেত্রে নজরদারী বজায় রাখা, (৭) ফসল কাটা ও (৮) ঝাড়াই বাছাই করা। বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, খ্রীঃ প্রথম-দ্বিতীয় শতকের গন্ধার শৈলীর ভাস্কর্যে কৃষককে হলচালনারত অবস্থায় দেখা যায়। দুটি বা একটি বলদ লাঙ্গলের সঙ্গে যুক্ত থাকত; কৃষকের হাতে লাঠিও রয়েছে। ভারতীয় কৃষক বললে যে চিত্রটি এখনও আমাদের সামনে ফুটে ওঠে তার মোটামুটি বিশ্বস্ত রূপ প্রাচীন কালেই পরিগ্রহ করেছে। তক্ষশিলায় ভির, ও সিরকাপ ঢিবিতে উৎখনন চালিয়ে নানা প্রকারের কৃষি উপকরণ আবিষ্কৃত হয়েছে: এর মধ্যে আছে লাঙ্গল, কোদাল, কুঠার, কুড়াল, দা ও মাটি কোপাবার হাতিয়ার। বেশীরভাগ উপকরণই লৌহনির্মিত। মধ্যপ্রদেশের সাঁচী অঞ্চলেও লাঙ্গলের ফলা আবিষ্কৃত হয়েছে। অনুমান করা যায় যে লাঙ্গল চালিয়ে চাষ করার পদ্ধতি উত্তরভারতে তো বটেই দাক্ষিণাত্যে তথা দক্ষিণ ভারতেও নিয়মিত হয়ে আসে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে উত্তর ভারতের তুলনায় বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিণে বিস্তৃত ভূখণ্ডে হাল চালানোর উদ্ভব অনেক পরে ঘটে। দাক্ষিণাত্যের পশ্চিম ও পূর্ব দিকে লাঙ্গল ভিত্তিক কৃষিকর্মের প্রসার যে খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতক থেকে দেখা যেতে থাকে, তার নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যাবে সমকালীন লেখমালায়। এই লেখগুলিতে ‘হালিক’ বা হালের মালিক অর্থাৎ হাল ব্যবহারকারী কৃষকের উল্লেখ আছে। এই ‘হালিক’ কখনও কখনও বৌদ্ধসংঘে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পত্তি প্রদান করেছেন। অতএব তাঁদের আর্থিক সঙ্গতি নিতান্ত সামান্য ছিল না, এই আর্থিক সঙ্গতি অনেকাংশে স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যক্ষ ফল। এছাড়াও দাক্ষিণাত্যের লেখমালায় কুটুবি বা কুটুম্বী অর্থাৎ স্থায়ী কৃষকদের উল্লেখ নিয়মিত ভাবে পাওয়া যায়। রামশরণ শর্মা মনে করেন যে মৌর্য সাম্রাজ্যের আমলে মগধের আধিপত্য ভারতের বৃহত্তর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ায় উত্তর ভারতের লাঙ্গলাশ্রয়ী কৃষি অর্থনীতির প্রভাব দক্ষিণ ভারতে দেখা যেতে থাকে। এতাবৎ কৃষি অর্থনীতির সাফল্য বিন্ধ্যের উত্তরের ভূখণ্ডেই অধিক পরিমাণে দৃষ্টিগোচর হত; খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতক থেকে কৃষি প্রধান অর্থনৈতিক অবস্থা-ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসারের ফলে তা কার্যত সর্বভারতীয় রূপ ধারণ করে। লাঙ্গল চালিয়ে বহুল পরিমাণ শস্য উৎপাদনের উপযোগী কৃষিব্যবস্থার রীতি ও পদ্ধতি উত্তর থেকে দক্ষিণ ভারতে প্রসারিত হবার ক্ষেত্রে মালব, বিদর্ভ প্রভৃতি অঞ্চলগুলি বিশেষ সহায়ক হয়ে ওঠ। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই জনপদগুলি অবস্থিত থাকার দরুন সেগুলি উত্তর ভারতের কৃষিপ্রধান বস্তুগত সংস্কৃতি দক্ষিণে ছড়িয়ে দেবার পক্ষে একটি সংযোগরক্ষাকারী ভূমিকা নিয়েছিল। গত দুই দশকে নর্মদা ও গোদাবরী উপত্যকায় পুরাতাত্ত্বিকদের উৎখনন ও অনুসন্ধানের ফলে এই অঞ্চলের বস্তুগত সংস্কৃতির পরিবর্তনশীল চরিত্র চোখে পড়ে। এই ভূখণ্ডে বেশ কিছু প্রত্নক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে যেখানে কৌম গোষ্ঠী পরিচালিত সমাজ থেকে জটিলতর কৃষিজীবী সমাজে উত্তরণের চিত্রটি ফুটে ওঠে। উত্তর ভারতের মতই স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজে উদ্বৃত্ত কৃষি উৎপাদনের সম্ভাবনা দাক্ষিণাত্যেও দেখা যেতে থাকে। তার ফলে বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন কারিগর ও ব্যবসায়ীদের আপন আপন বৃত্তিতে টিকিয়ে রাখার মত উদ্বৃত্ত খাদ্যসংস্থানের সুযোগ ঘটে। উত্তর ভারতের মতই কৌম গোষ্ঠীগুলির স্থানে বৃহৎ জটিলতর রাষ্ট্রশক্তির উদ্ভবের পথ প্রশস্ত হয়। কৃষির সর্বভারতীয় প্রসার আলোচ্য যুগটিকে বিশেষ মর্যাদায় চিহ্নিত করে। কৃষি অর্থনীতির দিক থেকে এই পর্বের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হল বিচিত্রতর ও বহুলতর পণ্যশস্যের নিয়মিত উৎপাদন; এক একটি অঞ্চল পণ্যশস্যের ফলনের দিক দিয়ে প্রসিদ্ধি লাভ করে। উদাহরণস্বরূপ দাক্ষিণাত্যের কার্পাস তুলোর চাষ, দক্ষিণ ভারতে গোলমরিচ সহ সুগন্ধী মশলার চাষ, কোঙ্কন উপকূলে নারকেল ও গাঙ্গেয় উপত্যকায় আখের চাষের নিয়মিত উল্লেখের কথা বলা চলে।
কৃষি যে সর্বভারতীয় চরিত্র পেল তার পিছনে সেচব্যবস্থার অবদান নিঃসন্দেহে স্বীকার করতে হয়। ধর্মশাস্ত্রে সেতু বা সেচ প্রকল্পের গুরুত্ব সম্বন্ধে যথাযথ সচেতনতা দেখা যায়। ধর্মশাস্ত্রকারগণ কেবলমাত্র সেচের প্রয়োজনীয়তার কথাই বলেছেন তাই নয়, সেচপ্রকল্প বা সেতু নষ্ট করলে শাস্তিবিধানের উল্লেখ করেছেন। মনুস্মৃতিতে সেতুভঙ্গকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেবার নির্দেশ দেখা যায়, দোষী ব্যক্তিকে জলে ডুবিয়ে বা শিরচ্ছেদ করে মৃত্যু দণ্ড দিতে হবে (৯.২৭৯)। তবে দোষী ব্যক্তি যদি সেচ প্রকল্প মেরামতি করে দেন তাহলে মৃত্যুদণ্ড রহিত হবে এবং হাজার পণ জরিমানাই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে। মনুর মতই অপর স্মৃতিগ্রন্থকার বিষ্ণু সেতুভঙ্গকারীর জন্য মৃত্যুদণ্ডই নির্দিষ্ট করেছেন। এই শাস্তির বিধান ও ব্যবস্থাগুলি অবশ্যই তৎকালীন সমাজে সেচব্যবস্থার প্রতি সচেতনতার পরিচায়ক।
প্রাপ্ত তথ্যসূত্রের থেকে অনুমান করা যায় যে অন্তত তিন প্রকার জল সেচ প্রকল্প ছিল: কূপ, জলাশয় ও খাল মারফৎ সেচ ব্যবস্থা। কূপ খনন করার ঘটনা এই যুগের বেশ কিছু লেখতে জানা গিয়েছে। খ্রীঃ পূঃ ৪-৩ সালে বশিশুগ নামক এক ব্যক্তির উঃ-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে একটি কূপ খনন করেন। ঐ রকম আরও একটি কূপ খনন করার কৃতিত্ব লেখতে কৃসাকবি নামক জনৈককে দেওয়া হয়েছে। মথুরাতে শক সোডাশের গঞ্জবর (অর্থ দপ্তরের অধিকারিক) আঃ ১০ খ্রীষ্টাব্দে একটি পুষ্করিণী খনন করেন, অপর একটি পুষ্করিণীর পশ্চিম দিকের পাড় বাঁধিয়ে দেন এবং একটি কূপ খনন করেন। তবে ঐ কূপ বোধহয় সেচের কাজে ব্যবহৃত হত না, কারণে লেখতে কূপটি উদপান (উদকপান) বা পানীয় জলের ব্যবহারের জন্য চিহ্নিত হয়েছে। ঐ শতাব্দীরই মধ্যভাগে (১১৩ বিক্রমাব্দে = ৫৬ খ্রীঃ) গ্রিক থিয়োডোরাস পুষ্করিণী খনন করে ছিলেন বলে তক্ষশিলার একটি লেখতে জানা যায়। দ্বিতীয় শতকের গোড়ার দিকে সম্রাট দ্বিতীয় কনিষ্কের রাজত্বকালে দাসফোত নামে আর এক ব্যক্তি দ্বারা কূপ খননের ঘটনা আরা লেখ (৪১ কনিষ্কাব্দ = ১১৯ খ্রীঃ)-তে জানা যায়। তক্ষশিলা নগরে সিরকাপ ঢিবিতে উৎখনন করে একটি মন্দিরে লাগোয়া জলাশয় পাওয়া গিয়েছে; ঐ জলাশয় খ্রীঃ প্রথম শতকে তৈরি হয়েছিল বলে পুরাতাত্ত্বিকদের ধারণা। ঐ শতকেরই শেষ দিকে তক্ষশিলাতে ধর্মরাজিকা স্তূপের নিকট অনুরূপ আর একটি জলাশয়ের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে উত্তর ভারতের ও দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে (যেমন হস্তিনাপুর, দিল্লী, রোপার, উজ্জয়িনী, মথুরা ও নাসিক) পোড়ামাটির কলসী পাওয়া গিয়েছে। পোড়ামাটির অনেকগুলি কলসী একসঙ্গে একটির উপর একটি লম্বালম্বি বসানো হত ও কলসীর এই খাড়াখাড়ি সারি ভূগর্ভে প্রোথিত থাকত। এইগুলি সম্ভবত কূপ হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। তবে এর মধ্যে কয়েকটি প্রত্নক্ষেত্র নিঃসন্দেহে নগর হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব, সেখানে কলসীর লম্বালম্বি সারি কূপের চেয়ে পয়ঃপ্রণালী হিসেবেই বোধ হয় ব্যবহার করা হত। কিন্তু উজ্জয়িনীর কাছে পোড়ানো ইঁটের তৈরী যে কূপ পাওয়া গিয়েছে তা যে পাকা বাঁধানো কূপ ও কোনও মতেই পয়ঃপ্রণালী নয়, তাতে সন্দেহ নেই।
আরও এক প্রকার পুরাবস্তুর প্রতি এ প্রসঙ্গে নজর দেওয়া দরকার। তক্ষশিলা, হস্তিনাপুর, উদয়পুর, অহিচ্ছত্র, কৌশাম্বী, ভিটা, মথুরাতে পোড়ামাটির তৈরি বা কখনও কখনও কাদামাটি দিয়ে তৈরি ক্ষুদ্রাকৃতি জলাশয়ের মডেল পাওয়া গিয়েছে। জলাশয়ে নামার সিঁড়ির ধাপ, জলচর সরীসৃপ, জলাশয়ের পাশে বাসগৃহও দেখানো হয়েছে কোথাও কোথাও। এইগুলি প্রকৃত জলাশয়ের অনুকৃতি মাত্র; কিন্তু তার ভিত্তিতে প্রকৃত জলাশয় ও পুকুরগুলির আকার আয়তন সম্বন্ধে খানিকটা ধারণা করা সম্ভব। পণ্ডিতদের বিচারে এই ক্ষুদ্রাকৃতি জলাশয়ের মডেলগুলি কোনও পূজা উপচারে ব্যবহৃত হত; এই জাতীয় লোকাচার সম্ভবত বর্তমানের পুণ্যি পুকুর জাতীয় ব্রতের সঙ্গে তুলনীয়। পোড়া মাটির জলাশয়ের অনুকৃতিগুলি এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছে; এগুলি সবই খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতক থেকে খ্রীঃ ২০০-এর মধ্যে বহুল ব্যবহৃত হয়। এর থেকে জলাশয়গুলি কৃষিপ্রধান সমাজে কতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়েছিল, তারও পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া সম্ভব। জলাশয়গুলির প্রয়োজনীয়তা কেবলমাত্র উত্তর ভারতেই নয় দাক্ষিণাত্যেও যথাযথ গুরুত্ব পায়। শক ক্ষত্রপ নহপান ও তাঁর জামাতা দাক্ষিণাত্যের পশ্চিমাংশে অনেক জলাশয় নির্মাণ করেছিলেন (নহপানের নাসিক লেখ), আর কিছু দক্ষিণে বৈজয়ন্তী (উত্তর কর্ণাটক অঞ্চল) দেশের অমাত্য স্কন্দস্বাতী খ্রীঃ দ্বিতীয় শতকে একটি পুষ্করিণী সহ আরও কিছু স্থাপত্যকর্ম নির্মাণের সময় তত্ত্বাবধান করছিলেন (প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে বনবাসী থেকে পাওয়া লেখ)। এই পুষ্করিণী দানের জন্য রাজকন্যা মহাভোজী শিবস্কন্দনাগশ্রীর উদ্যোগের কথাও লেখটিতে বলা হয়েছে।
এ পর্যন্ত সেচ ব্যবস্থার আলোচনায় ক্ষুদ্র ও স্থানীয় সেচ প্রকল্পের কথা বলা হল। ক্ষুদ্র প্রকল্পগুলি স্থানীয় সেচের প্রয়োজন মেটাত। কিন্তু বৃহত্তর অঞ্চলকে সেচসেবিত করার জন্য খাল বা প্রণালীর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। প্রত্নতাত্ত্বিক গার্দাঁ ও জেন্টল জানিয়েছেন যে আফগানিস্তানের আইখানুমের উৎখনন থেকে সেচের জন্য প্রণালীর অস্তিত্ব বোঝা যায়। এই সেচপ্রণালীগুলি সম্ভবতঃ ব্যাকট্রিয়ার গ্রীক রাজাদের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছিল। সেচ প্রণালী খনন করার অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্বন্ধে ধারাবাহিক সচেতনতা কুষাণ আমলেও উঃ পঃ সীমান্ত অঞ্চলে দেখা যায়। জারাভশান নদীর উপর দারগোম, বুলুঙ্গর, নরপাই ও শাহরুদ খালখনন প্রত্নতাত্ত্বিক বিচারে কুষাণ আমলে ঘটেছিল। ঐ একই সময়ে পেশাওয়ার অঞ্চলে প্রাচীন প্রণালীর সন্ধান পাওয়া যায়। ঐ প্রণালীগুলিও কুষাণ আমলেই নির্মিত বলে প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা। উঃ পঃ সীমান্ত অঞ্চলে বৃষ্টিপাত পর্যাপ্ত না হওয়ায় সেচের জন্য জল সংরক্ষণ ও তার যথাযথ সরবরাহ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতেই হয়। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে আফগানিস্তানের সুর্খকোটালে পাওয়া একটি কুষাণ লেখ অনুসারে (৩১ কনিষ্কাব্দ = ১০৯ খ্রীঃ) সুর্খকোটালে অবস্থিত কনিষ্ক নিকাটরের দেবকুল ব্যাপক জলাভাবের কারণে পরিত্যক্ত হয়। পরে এক উচ্চপদস্থ কুষাণ রাজপুরুষ শুধু মন্দিরের সংস্কারই করেননি, তিনি একটি কূপ খনন করেন ও জল সরবরাহের জন্য প্রণালী খনন করান এই আশায়, দেবতারা যেন ঐ স্থান আর পরিত্যাগ না করেন। জলাভাব ও তার সমাধানের জন্য এই পদক্ষেপের বাস্তবতা স্বীকার করতেই হয়।
আলোচ্য আমলের সেচব্যবস্থার সম্ভবত শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত কাথিওয়াড় অঞ্চলের সুদর্শন হ্রদ। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে এই বিশাল জলাধারটি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে তৈরী হয়েছিল, এবং অশোকের আমলে হ্রদটির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন ঘটানোও হয়েছিল। হ্রদ ও জলসরবরাহ ব্যবস্থা সম্বন্ধে বিস্তৃততর তথ্য শক মহাক্ষত্ৰপ রুদ্রদামনের জুনাগড় প্রশস্তিতে পাওয়া যায়। রুদ্রদামনের রাজত্বের প্রথম বর্ষেই এক ভীষণ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দরুন হ্রদের বাঁধে এক বিশাল ফাটল ধরে; এবং তার মধ্য দিয়ে সুবর্ণসিকতা, পলাশিনী প্রভৃতি নদীর সঞ্চিত জল বেরিয়ে যায় (‘নিঃসৃত সর্বতোয়ম্’)। এর ফলে নিকটবর্তী অঞ্চল মরুভূমির মত ভয়াবহ আকার ধারণ করে (‘মরুধন্বং কল্পং অতিভৃশ্ম্’)। এই বর্ণনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে সেচের জল নষ্ট হলে ও একটি বৃহৎ সেচপ্রকল্পের ক্ষতি ঘটলে তা সামগ্রিক কৃষি অর্থনীতির পক্ষে ব্যাপক প্রতিকূলতার সৃষ্টি করত। এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাবার জন্য রুদ্রদামন হ্রদটি সংস্কার করেন। এই সংস্কারের বিশ্বস্ত ও বিশদ বর্ণনা প্রশস্তিতে লিখিত: এই সংস্কারের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ (‘মহতা ধনৌঘ’) রুদ্রদামন নিজের কোশ থেকে (‘স্বস্মাৎকোশাৎ’) ব্যয় করেছিলেন, এবং অর্থ সংগ্রহের জন্য প্রজার উপর কোনও জরুরীকালীন করভার চাপিয়ে তাদের পীড়িত করেননি (‘অপীড়য়িত্বা’), সংস্কার কার্য শেষ হতে খুব বেশী সময়ও লাগেনি (‘অনতিমহতাকালেন’); এই সংস্কারের ফলে বাঁধটি তিনগুণ দৃঢ় ও বিস্তৃত করা হয় (‘ত্রিগুণ দৃঢ়তর বিস্তারায়াম’) এবং সুদর্শন হ্রদ সার্বিকভাবেই সুন্দরতর (সুদর্শনতর) করে তোলা হয়। গুজরাট ও কাথিয়াওয়াড় অঞ্চলে বৃষ্টিপাত গাঙ্গেয় উপত্যকার মত বেশী নয়; সেখানে হিমবাহ থেকে উৎপন্ন নদীও নেই। ফলে বৃষ্টির জলই সেচের একমাত্র উপাদান এবং সযত্নে তাকে সংরক্ষণ করা দরকার। তাই এই বাঁধটিতে ফাটল ধরলে কৃষি অর্থনীতির পক্ষে তা কতটা বিপজ্জনক, তা বুঝতে রুদ্রদামনের সম্ভবত কোনও অসুবিধা হয়নি। শাসক যে সেচব্যবস্থার অপরিহার্যতার ব্যাপারে যথেষ্ট সজাগ ছিলেন, তার অন্যতম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সুদর্শন হ্রদ সংস্কারে রুদ্রদামনের উদ্যোগ। সুদর্শন হ্রদ নিঃসন্দেহে একটি বৃহৎ সেচ প্রকল্প; যার জলের প্রধান উৎস ছিল স্থানীয় নদীগুলি।
নদীর জলের ওপর নির্ভরশীল প্রকল্পের আর একটি সাম্প্রতিক নিদর্শন এলাহাবাদের নিকটবর্তী শৃঙ্গবেরপুরের উৎখনন থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। শৃঙ্গবেরপুরের চতুর্থ পর্বে (খ্রীঃ পূঃ ২০০-খ্রীঃ ২০০) একটি বৃহৎ জল সংরক্ষণ প্রকল্প নির্মিত হয়েছিল। গঙ্গার জল একটি প্রণালীর মারফৎ আনা হত এই প্রকল্পে; প্রথমে নদীর জল পৌঁছত দুটি পরিস্রবণ কক্ষে; জল পরিস্রুত হলে একটি প্রণালীর মধ্যে দিয়ে তা পরপর দুটি পাকা ইঁটের তৈরি জলাশয়ে গিয়ে পৌঁছত। প্রথম ও দ্বিতীয় জলাশয়ের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী একটি নালী ছিল (৫.৩০ মি × ১.৩৫ মি)। জলাশয় দুটির আকার ও আয়তন এক নয়। প্রথম জলাশয়টি দৈর্ঘ্যে ৩৪ মিঃ, প্রস্থে ১০ মিঃ এবং গভীরতায় চার মিটার; দ্বিতীয় জলাশয়টি লম্বায় অন্ততঃ ১২০মি (পূর্ণ দৈর্ঘ্য মাপা সম্ভব হয়নি), প্রস্থ ২৬ মি ও গভীরতা ৭ মি। এই প্রকল্প কার দ্বারা নির্মিত তা সঠিক ভাবে বলা কঠিন। এই প্রকল্প সরাসরি সেচের জন্য ব্যবহৃত হত কিনা সে ব্যাপারে চূড়ান্ত মতামত দেওয়াও শক্ত; কারণ প্রকল্পটি মূলত একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাছাড়া জল পরিস্রুত করার প্রয়োজন পানীয় জলের ক্ষেত্রেই দরকার লাগে। ফলে এই প্রকল্পটি পানীয় জল সরবরাহ করার জন্যও তৈরী হবার সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না। কিন্তু জল কিছুটা দূরের সূত্র থেকে নিয়ে আসা, তাকে পরিস্রুত, সংরক্ষণ ও সরবরাহ করার যে জটিল ব্যবস্থা একটি প্রকল্পে সুসংহত ভাবে দেখা যায়, তা কারিগরী দক্ষতার দিক দিয়ে বিশেষভাবে প্রশংসাৰ্হ। এই জাতীয় প্রকৌশল আয়ত্তে থাকলে তা জল সংরক্ষণ ও সরবরাহের কাজে বিশেষ সহায়ক হয়ে উঠত, সেই জল পান বা সেচ কার্য যে জন্যই ব্যবহৃত হোক না কেন।
নদীর জলের যথাযথ ব্যবহার করলে যে বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে সেচের আওতায় আনা যায়, এই সচেতনতা কেবলমাত্র উত্তর ভারতে সীমাবদ্ধ ছিল না। সুদূর দক্ষিণে চোলদের অঞ্চলে (তাঞ্জোর ও সন্নিহিত ভূখণ্ড, তামিলনাড়ু) চোলরাজ করিকাল কাবেরী নদীর জল নিয়ন্ত্রণ করে কৃষির যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন বলে প্রাচীনতম তামিল সাহিত্য—সঙ্গম কাব্যে—জানা যায়। কাবেরী নদীতে প্রতি বছর বন্যার দরুন কাবেরীর বদ্বীপ অঞ্চলে (চোলদের ক্ষমতাধীন ভূখণ্ড) কৃষিকর্ম বিঘ্নিত হত। করিকাল বাঁধ দিয়ে নদীর জল নিয়ন্ত্রণ করেন ও বদ্বীপ অঞ্চলকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করেন। এখানে সেচব্যবস্থার যে রূপটি চোখে পড়ে তাতে জল সংরক্ষণ ও সরবরাহের চাইতে জলনিকাশী ব্যবস্থার প্রতিই অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
জল সংরক্ষণ, সরবরাহ ও নিকাশী ব্যবস্থা বিভিন্ন পরিবেশে ও পরিস্থিতিতে নেবার মত উপযুক্ত কারিগরী দক্ষতার অস্তিত্ব অনুমান করা যেতে পারে, যদিও এই জাতীয় কারিগরী কৌশলের নিশ্চিত প্রমাণ এখনও জানা নেই। তবে নাসিক থেকে পাওয়া একটি লেখতে ওদযন্ত্রিক (উদক যন্ত্রিক) বা জল ব্যবহারের যন্ত্রবিদের কথা জানা যায়। জল সরবরাহ করার জন্য অপর একটি যন্ত্র ছিল রহট্টগডিয়া (অরহট্ট ঘটিকা)। এই যন্ত্রের উল্লেখ হালের গাথাসপ্তশতীতে আছে। যন্ত্রটি চক্রাকার, তার গায়ে ঘটিকা বসানো থাকত। বৃহৎ কূপ ও জলাশযের মধ্যে চক্রটি বসানো থাকত, চক্রটি ঘুরলে ঘটিতে জল ভরে যেত ও ক্রমশ ঘটির জল ঘুরন্ত চক্রের সঙ্গে নিম্নমুখী হলে জল সেচ বা পানের উদ্দেশ্যে পাওয়া যেত।
লক্ষ্য করা যেতে পারে নদী থেকে জল আহরণ করে, তা সংরক্ষণের পর কৃষি-জমিতে সরবরাহ করার কাজটি কলাকৌশলের দিক দিয়ে তো বটেই সাংগঠনিক দিক দিয়েও জটিল। এত বিশাল সেচপ্রকল্পের প্রবর্তন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা সাধারণভাবে কোনও ব্যক্তিবিশেষের আয়ত্তের অতীত। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই জাতীয় বড় সেচ প্রকল্পের পিছনে রাজা বা উচ্চপদস্থ রাজপুরুষদের সরাসরি মদত দেখা যায়। কিন্তু ক্ষুদ্রতর ও স্থানীয় প্রকল্পের ব্যাপারে প্রশাসনিক উদ্যোগের বদলে স্থানীয় মানুষের ব্যক্তিগত উদ্যোগ, উৎসাহ ও আগ্রহই দেখা যায়। ফলে মৌর্য আমলের মত সেচ ব্যবস্থার উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের আভাস সামান্য; তার ওপর অর্থশাস্ত্রের নির্দেশমত সেচের জন্য জলের ওপর কর বসানোর দৃষ্টান্তও আলোচ্য যুগে চোখে পড়েনি। আলোচ্য আমলের সেচ ব্যবস্থায় বৃহৎ সেচ প্রকল্পের ভূমিকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু অব্যবহিত আগের পর্বের সেচ ব্যবস্থাতে রাষ্ট্রীয় নজরদারীর দৃষ্টান্ত এই যুগে বিশেষ নেই। ফলে এই আমলে ক্ষুদ্রতর ও স্থানীয় সেচ প্রকল্প গড়ে তোলায় ব্যক্তিগত উদ্যোগ অধিকতর সক্রিয়।
কৃষি অর্থনীতিতে মৌর্য আমলের থেকে আর একটি প্রধান পার্থক্য হল কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের ভূমিকা ক্ষীণতর হয়ে আসা। অর্থশাস্ত্র বর্ণিত সীতা জমির কথা ও ‘সীতা’ জমিতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে উৎপাদনের ব্যবস্থা নেওয়া খ্রীঃ পূঃ ২০০ খ্রীঃ ২০০-র মধ্যে প্রায় চোখে পড়েনি। সীতা জাতীয় জমির অস্তিত্ব অপেক্ষাকৃত কম। অবশ্য সাতবাহন রাজা গৌতমপুত্র সাতকর্নির একটি নাসিক লেখতে রাজকীয় ভূমিখণ্ডের (‘রাজকং ক্ষেত্তং’) উল্লেখ আছে। কিন্তু সাতবাহন ও শকদের লেখমালাতে বিশাল ‘সীতা’ জমির সন্ধান নেই; ‘সীতা’ জাতীয় রাজকীয় ক্ষেত্র চাষের কাজে লাগানোর চেয়ে বৌদ্ধ সংঘে দান করার প্রবণতাই বেশী। এছাড়া ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণাও অব্যাহত ছিল। খ্রীঃ প্রথম শতাব্দীর শেষভাগে ক্ষত্ৰপ নহপানের রাজত্বকালে বৌদ্ধ সংঘকে জমি দেবার সময় রাজার জামাতাকে এক ব্রাহ্মণের কাছ থেকে নগদ মূল্যে জমি তিনি বৌদ্ধ সংঘে প্রদান করেন। একটি জমি অন্ততঃ দুইবার হাত বদল হওয়া; জমি পাবার জন্য নগদ মূল্যে কেনাবেচা ও ভূসম্পত্তির উত্তরাধিকার পিতা থেকে পুত্রে বর্তানোর দৃষ্টান্ত নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে জমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা যথেষ্ট জোরালো। সকল জমির ওপর রাজকীয় নিয়ন্ত্রণ থাকার যে সম্ভাবনার কথা মেগাস্থিনিসের রচনায় আছে, সমকালীন রচনায় জমির ওপর রাজকীয় মালিকানার পরিবর্তে ব্যক্তিগত অধিকারের কথাই বেশী চোখে পড়ে। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির সংখ্যা বাড়ার ফলে অনেকক্ষেত্রেই জমির আকার ও আয়তন বোধহয় ক্ষুদ্রতর হয়। ফলে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে যেখানে বিশাল সীতা জমিতে কৃষি উৎপাদন চলত, সেই রকম বৃহদায়তন ভূখণ্ডের পরিচয় এযুগের সুলভ নয়। বরং ব্যক্তিগত মালিকানাধীনে ক্ষুদ্রতর ভূখণ্ডের পরিচয়ই নিয়মিত দেখা যায়। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক অবস্থা ব্যবস্থার তুলনায় এই পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন।
॥ ৩ ॥
অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় আলোচ্য যুগের বৈশিষ্ট্য কারিগরী শিল্পের ব্যাপক প্রসারের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। প্রাক-মৌর্য আমলের গ্রন্থ দীঘনিকায়তে যেখানে কারিগরী ও সেবামূলক বৃত্তির সংখ্যা ছিল চব্বিশ, মহাবস্তু অবদানে (খ্রীঃ ২য় শতক) ও মিলিন্দপঞহোতে (খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতক) সেই সংখ্যা যথাক্রমে ছত্রিশ ও পঁচাত্তর। পরবর্তী দুই গ্রন্থের বক্তব্যের মধ্যে কিছুটা অতিশয়োক্তি আছে এ কথা মানলেও অস্বীকার করার উপায় নেই যে কারিগরী শিল্প বৈচিত্র্যে ও সংখ্যায় আগের তুলনায় অনেকটা বেশী। এই ধারণা আরও সমর্থিত হয় জাতক কাহিনীগুলিতে কারিগরদের নিয়মিত ও বিশদ উল্লেখের ধারা। তবে কারিগরী শিল্পে বিকাশের অন্যতম প্রধান ও বিশ্বস্ত সাক্ষ্য মিলবে খ্রীঃ পূঃ ২০০ থেকে খ্রীঃ ২০০-র মধ্যে উৎকীর্ণ অসংখ্য লেখ-তে। উত্তরভারতের মথুরা, মধ্য ভারতের সাঁচী, ভারহুত, দাক্ষিণাত্যের পশ্চিম দিকে জুন্নার, কার্লা, ভাজা, পিতল খোরা ও দাক্ষিণাত্যের পূর্বভাগে অমরাবতী, ধান্যকটক, জগ্গয্যপেটা প্রভৃতি স্থান থেকে বহুল পরিমাণে লেখ পাওয়া গিয়েছে। এই লেখগুলি অধিকাংশই দানপত্র যার মারফৎ বিভিন্ন কারিগর সাধারণতঃ বৌদ্ধ বা জৈন ধর্ম প্রতিষ্ঠানে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি দান করতেন। দাতারা লেখমালায় তাদের নামধাম, পারিবারিক ও পেশাগত পরিচয় লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন, যা বর্তমান আলোচনার জন্য বিশেষ উপযোগী।
অন্যতম প্রধান বৃত্তি ছিল সূত্রধার বা ছুতোরের, সমকালীন সূত্রে যারা বর্দ্ধকি বা বড্ঢকি বলে উল্লিখিত। লেখমালাতে নিয়মিত উল্লেখ ছাড়াও বর্দ্ধকিদের কথা জাতকেও পাওয়া যায়। একটি জাতক কাহিনী অনুসারে বারাণসীর প্রত্যন্ত (সীমান্তবর্ত্তী) গ্রামে বহু বড়ঢকির বাস ছিল; তাঁরা স্থানীয় বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করতেন ও কাঠের নানা জিনিস তৈরী করে বারাণসীর বাজারে বিক্রী করতেন। এই কাহিনী থেকে অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে কারিগররা হয়তো তাঁদের কাঁচামালের উৎসের কাছাকাছিই থাকতেন এবং তাদের বসতি নিকটস্থ বাজারের থেকে খুব দূরে অবস্থিত ছিল না। লেখমালা থেকে বাঁশের কারিগর (বসকার) ও কঞ্চির কারিগরের (কোনাচিক) কথাও জানা যায়; লক্ষ্যণীয় যে কারিগরী শিল্পে দক্ষতা ও বিশেষীকরণ আসায় বাঁশ ও কঞ্চির কারিগরকে আলাদা করা হয়েছে। প্রাচীন ভারতের অন্যতম প্রধান শিল্প ছিল বস্ত্রশিল্প। নাসিকে প্রাপ্ত নহপানের একটি লেখতে কৌলিক বা তাঁতীদের উল্লেখ আছে। মথুরার একটি লেখতে যে প্রাবরিক গোষ্ঠীর কথা বলা হয়েছে তাঁরা প্রবর নামক এক বিশেষ বস্ত্র তৈরি করার বৃত্তিতে যুক্ত ছিলেন। প্রথম শতকের শেষ ভাগে লেখা পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সী থেকে জানা যায় যে দাক্ষিণাত্যের মধ্যভাগে অবস্থিত টগর (আধুনিক টের) ও পৈঠান (প্রতিষ্ঠান, সাতবাহনের রাজধানী) ছিল বস্ত্র শিল্পের দুই প্রধান কেন্দ্র। টের-এ উৎখননের ফলে কাপড় রঙ করার বিশাল আধার আবিষ্কৃত হয়েছে। এই নিদর্শনটি অবশ্যই টগরের বস্ত্রশিল্পের ইঙ্গিত দেয়। পেরিপ্লাস-এর তথ্যও অবশ্যই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে জাতক গ্রন্থে কাপড় রং করার কাজ একটি পৃথক বৃত্তিরূপে চিহ্নিত—এই বৃত্তিতে যুক্ত কারিগর রঙ্গকার বলে কথিত। তামিলনাড়ুর পণ্ডিচেরীর নিকটবর্তী আরিকামেডু-র উৎখনন থেকেও অনুরূপ কাপড় রং করার ভাণ্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। সামগ্রিক ভাবে বস্ত্রশিল্পের প্রসঙ্গে কাপড় রং করার বৃত্তির বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আলোচ্য যুগের বিভিন্ন কাপড়ের মধ্যে সাধারণ মোটা ও দামী বস্ত্র দুইই উৎপাদন করা হত। পেরিপ্লাসের সাক্ষ্য থেকে দেখা যায় টগর ও পৈঠানে বহুল পরিমাণে সাধারণ আটপৌরে কাপড় তৈরি হত। দামী কাপড়ের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ছিল মসলিন, যার প্রশংসায় পেরিপ্লাস ও প্লিনির ন্যাচারাল হিস্ট্রি পঞ্চমুখ। মসলিন ভারতের নানা স্থানে তৈরি হত: যেমন, বারাণসী, উজ্জয়িনী, ভৃগুকচ্ছ প্রভৃতি। তবে গ্রীক ও ল্যাটিন রচনায় সব সময়েই গ্যাঙ্গে দেশের মসলিনকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। বৈদেশিক রচনায় গ্যাঙ্গের যে বিবরণ আছে তা থেকে মনে হয় যে গ্যাঙ্গে বলতে গাঙ্গেয় বদ্বীপকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রাচীন বাংলার মসলিনের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য তথ্য গ্রীক ও ল্যাটিন রচনায় পাওয়া যায়। আর একটি কারিগরী বৃত্তির কথা লেখমালায় বারবার পাওয়া যায়: তা হল ‘গধিক’ বা ‘গন্ধিকের’ বৃত্তি, অর্থাৎ যাঁরা গন্ধ দ্রব্য প্রস্তুত করতেন। কখনও কখনও গন্ধিক ‘সোবাসক’ বা সুবাসক (অর্থাৎ সুগন্ধী প্রস্তুতকারী) বলেও বর্ণিত। গন্ধিকের কাজের সঙ্গে ‘মালাকার’ বা মালাগাঁথার কাজে যুক্ত ব্যক্তিদের নিকট সম্পর্ক কল্পনা করা অযৌক্তিক হবে না। ‘মালাকার’দের উল্লেখও দানপত্রগুলিতে নিয়মিত পাওয়া যায়। কোসাম্বীর মতে ভারতের মত গ্রীষ্মপ্রধান দেশে সুগন্ধী ও মালার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না, এবং এই দুই বৃত্তিকে কেবলমাত্র বিলাস ব্যসনের উপকরণ হিসেবে বিচার করলে ভুল হবে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া বিলাসদ্রব্যের উৎপাদন হত, যদিও তার চাহিদা মূলতঃ সমাজের বিত্তশালী অংশেই সীমাবদ্ধ ছিল। এইরকম একটি বিলাসদ্রব্য ছিল হাতির দাঁতের কাজ, যে শিল্পে জড়িত কারিগররা সাহিত্যগত ও লেখমালাগত সূত্রে ‘দন্তকার’ বলে উল্লিখিত। এই রকম একজন ‘দন্তকার’ ছিলেন সাতবাহন রাজা প্রথম সাতকর্নির সমসাময়িক এবং সাঁচী স্তুপের একটি তোরণ দ্বার নির্মাণে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতার কথা সাঁচীর একটি লেখতে বলা আছে। টলেমীর ভূগোলে হাতির দাঁতের কাজের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসাবে পলৌরা বা অন্ধ্র-কলিঙ্গ অঞ্চলের দন্তপুরের কথা জানা যায়। হাতির দাঁতের কাজের মান কতটা উৎকর্ষ লাভ করেছিল তার চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া যাবে আফগানিস্তানের বেগ্রামে উৎখনন থেকে, যেখানে বিভিন্ন প্রত্নবস্তুর মধ্যে কয়েকটি ভারতীয় হাতীর দাঁতের কাজের নমুনাও রয়েছে। শেীখিন রুচির পরিচয় পাওয়া যায় সমকালীন অলঙ্কার শিল্পে; সোনার অলঙ্কার তৈরী করতেন ‘সুবর্ণকার’। মথুরার একটি লেখতে ‘মণিকারের’ উল্লেখ আছে। ‘মণিকার’ সম্ভবতঃ দামী পাথরের অলঙ্কার তৈরি করতেন। খ্রীঃ পূঃ ২০০ থেকে ২০০ খ্রীঃ-র মধ্যবর্তী বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্র থেকে নানা ধরনের দামী ও আধাদামী পাথরের পুঁতি পাওয়া গিয়েছে। এই জাতীয় পুঁতিই হয়তো ‘মণিকার’ ব্যবহার করতেন। অলঙ্কারের বহুল ব্যবহারের ও অলঙ্কারশিল্পীদের দক্ষতার কিছুটা আন্দাজ করা যায় সমকালীন ভাস্কর্য্যে, বিশেষতঃ নারীমূর্তিগুলিতে, ব্যবহৃত অলঙ্কারের রূপায়নে।
এ পর্যন্ত আলোচনা থেকে দুটি মন্তব্য করা সম্ভব: (১) শিল্পক্ষেত্রে বৈচিত্র্য ও বিশেষজ্ঞতার বৃদ্ধি ঘটেছে; শিল্পে ধাতুর ব্যবহারও অধিকতর হয়েছে; (২) শিল্পে রাষ্ট্রের উদ্যোগের তুলনায় ব্যক্তিগত/ বেসরকাবী উদ্যোগের বেশী উপস্থিতি। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ শিল্পক্ষেত্রে সম্ভবত একটি বিষয়েই সীমাবদ্ধ ছিল: তা হল খনি ও খনিজ শিল্প। কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের মতই মনু ও যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতিগ্রস্থে খনির উপর রাজকীয় অধিকারের ধারণা স্বীকৃত। খ্রীঃ পূঃ ২০০ থেকে খ্রীঃ ২০০-র মধ্যে খনি ও খনিজ শিল্পে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের চরিত্র ও লক্ষণ বিচার করা যাক।
টলেমীর ভূগোলে নর্মদা নদীর পূর্ব দিকে কোসা নামক স্থানে হীরার খনির কথা বলা হয়েছে। এই অঞ্চল মালব দেশের পূর্ব অংশে অবস্থিত ছিল বলে মনে হয়। সাধারণতঃ মালবদেশের পূর্বভাগ প্রাচীন সাহিত্যে দশার্ণ নামে আখ্যাত। কিন্তু গৌতমীপুত্র সাতকর্নির নাসিক প্রশস্তি (১১৯ খ্রীঃ) ও শক মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামনের জুনাগড় প্রশস্তিতে (১৫০ খ্রীঃ) পূর্ব মালব ‘আকর’ নামে অভিহিত। ‘আকর’ নামটি খনির অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়। পূর্ব মালবে কুষাণ অধিকারের স্পষ্ট প্রমাণ আছে: কনিষ্ক ও তাঁর উত্তরসূরী বাসিস্কের (=বাসকুষাণ) দুটি লেখ সাঁচীতে পাওয়া গিয়েছে (শকাব্দ ২২=১০০ খ্রীঃ ও শকাব্দ ২৪ = ১০২ খ্রীঃ)। লামা তারনাথের রচনায় পূর্ব মালবে হীরার খনির অস্তিত্বের সম্বন্ধে জানা যায়, যে খনিগুলি—তারনাথের মতে—কনিষ্কের আমলেই নিয়মিতভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। রুদ্রদামনের রাজকোশ যে (অন্যান্য ধনরত্নসহ) হীরাতে পরিপূর্ণ ছিল, এই উক্তি জুনাগড় প্রশস্তিতে আছে। টলেমীর ভূগোল, কুষাণ, শক ও সাতবাহন লেখমালা ও লামা তারনাথের তিব্বতী বিবরণীয় অনুপুঙ্খসহ বিচার বিশ্লেষণ দ্বারা ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে পূর্ব মালবে হীরার খনি ছিল; এই অঞ্চলকেই টলেমী কোসা নামে অভিহিত করেন। তাঁর মতে এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম দশার্ণ বদলিয়ে ‘আকর’ নাম রাখার কারণই হল ঐ অঞ্চলে হীরার খনির আবিষ্কার ও হীরার নিয়মিত খনন। কুষাণ, সাতবাহন ও শক লেখমালাগুলি মিলিয়ে পড়লে যুক্তিসঙ্গত অনুমান করা চলে যে হীরার খনির উপর এই তিন রাজবংশীয় শাসকদের প্রত্যক্ষ আগ্রহ ছিল এবং খনিগুলি সম্ভবতঃ রাজকীয় নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হত। পূর্ব মালব নিয়ে কুষাণ, শক, সাতবাহনদের মধ্যে যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কথা রাজনৈতিক ইতিহাসে জানা যায়, তার পিছনে হীরার খনির উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার আগ্রহ হয়তো সক্রিয় ছিল।
অপর একটি খনিজ সম্পদ—বৈদুর্যের উৎপত্তি স্থান, টলেমীর মতে, ছিল পুনাটা। এই জায়গাটি সম্ভবত বর্তমান তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুরের কাছাকাছি কোনও অঞ্চলে অবস্থিত। কিভাবে বৈদুর্য খনন করা হত সে বিষয়ে আমাদের তথ্যসূত্রে কোনও সরাসরি তথ্য নেই, তবে এই জাতীয় মূল্যবান পাথরের খনির খনন যে রাজকীয় তত্ত্বাবধানে হবে, এমত অনুমান অসঙ্গত নয়।
প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণাধীনে খনিজ শিল্পের চেহারা দক্ষিণ ভারতের মুক্তো চাষের ক্ষেত্রে স্পষ্টতর। পেরিপ্লাসে ও টলেমীর ভূগোলে কোলচি-তে মুক্তো চাষের সম্বন্ধে বিবরণ আছে। কোলচি তামিলনাড়ুর কোরকাই অঞ্চলের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে হয়; কোরকাই মান্নার উপসাগরের (তিরুনেভেলি জেলা) কাছে অবস্থিত। পেরিপ্লাসের বর্ণনানুযায়ী মুক্তোর উৎপাদন কেন্দ্রগুলি প্রত্যক্ষভাবে পাণ্ডিয়ন বা পাণ্ড্য রাজাদের (রাজধানী মাদুরা) দ্বারা পরিচালিত হত। সমুদ্রের তলা থেকে ঝিনুক তোলার জন্য মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত কয়েদীদের ডুবুরি হিসেবে নামানো হত। কোলচিতে মুক্তো তোলার পর তা নিয়ে যাওয়া হত উপকূল অঞ্চল থেকে কিছু দূরে আরগারুস নামক শহরে; একমাত্র ঐ শহর থেকেই মুক্তো বিক্রী করা হত। এই বর্ণনার মধ্যে মুক্তো চাষ, উৎপাদন ও বিক্রির ব্যবস্থাপনায় পাণ্ড্যরাজ্যের কর্তৃত্ব নিঃসন্দেহে ফুটে ওঠে। কোলচি বা আধুনিক কোরকাইতে উৎখননের ফলে প্রচুর পরিমাণে ঝিনুকের খোলা, ভূগর্ভ থেকে উদ্ধার করা গিয়েছে। এই খোলাগুলি কোলচিতে মুক্তো উৎপাদন কেন্দ্রের অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে দৃঢ়তর করে। উৎপাদনে কয়েদীদের নিয়োগ করার পদ্ধতিটিও অভিনব। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত কয়েদীদের বোধ হয় যথার্থ শ্রমিক বা কারিগরের মর্যাদা দেওয়া হত না; ফলে তাদের বেতন বা অনুরূপ কোন অর্থ দেবার দায় রাষ্ট্রের ছিল কি না, এ বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়। এই দিক দিয়ে বিচার করলে এই দারুণ ঝুঁকির কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের পিছনে পাণ্ড্যরাজাদের বোধ হয় বিশেষ অর্থব্যয় করতে হত না। অথচ মুক্তো রাষ্ট্রীয় তদারকিতে বিক্রি করলে অবশ্যই যথেষ্ট অর্থ লাভের সম্ভাবনা। পেরিপ্লাস ও ন্যাচারাল হিস্ট্রীতে ভারতীয় মুক্তোর উচ্চমান ও যথেষ্ট চাহিদার উল্লেখ আছে। এই জাতীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত খনিজ শিল্প থেকে পাণ্ড্য রাজকোশের প্রচুর অর্থাগম হত বলে মনে হয়।
খনিজ পদার্থগুলি অধিকাংশই বহুমূল্য ও সমাজের উচ্চবিত্ত মানুষের চাহিদা মেটাত। কিন্তু নুন—যা প্রাচীন ভারতে খনিজ সম্পদের তালিকাভুক্ত ছিল—আপামর জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য। নুনের উৎপাদনের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের কিছুটা আভাস পাওয়া যায় সাতবাহন লেখমালায়। সাতবাহন রাজারা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বা ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে নিষ্কর জমি দান করতেন। প্রদত্ত জমিকে যে সব কর থেকে ছাড় দেওয়া হত তার একটি হচ্ছে ‘অলোনখাদক’; অর্থাৎ লবণের উপর শুল্ক ছাড়। যেহেতু এই জাতীয় কর ছাড় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রেই ঘটত, সেইহেতু মনে করা যায় যে সাতবাহন আমলে সাধারণভাবে নুন তৈরির উপর কর বসানো হত। তা হলে দেখা যাচ্ছে সাতবাহনরা সম্ভবত নুন উৎপাদনে সরাসরি অংশ নিতেন না। এবং নুন উৎপাদনে ব্যক্তিগত উদ্যোগ মেনে নিতেন; তবে যাবতীয় খনিও খনিজ দ্রব্য যেহেতু তত্ত্বের দিক দিয়ে রাজকীয় অধিকারভুক্ত, তাই উৎপাদনের একটি ভাগ তাঁরা কর বা শুল্ক হিসেবে নিতেন। এই প্রসঙ্গে প্লিনির একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, অরোমেনাস পাহাড়ে (পাকিস্তানের সল্ট রেঞ্জ) নুনের উৎপাদন থেকে যে পরিমাণ শুল্ক আদায় হয় তা বোধহয় হীরার খনির শুল্ক থেকে পাওয়া যায় না। খ্রীঃ পূঃ ২০০ থেকে খ্রীঃ ২০০-র ভিতরে নুন উৎপাদনের উপর শুল্ক আদায়ের ঘটনাটি প্লিনির মন্তব্যেও সমর্থিত। কিন্তু প্লিনির বক্তব্যের আলাদা তাৎপর্য আছে। হীরার তুলনায় নুন নিতান্তই নগণ্য এক পণ্য; উভয়ের দামের ভিতরও আকাশ পাতাল তফাৎ। কিন্তু হীরা বহুমূল্যবান পদার্থ হওয়ার জন্য তার ক্রেতার সংখ্যা সীমিত; ফলে হীরার উৎপাদন প্রচুর হওয়া কঠিন। কিন্তু নুন যেহেতু সকলের পক্ষে অপরিহার্য, সেইহেতু নুনের প্রচুর উৎপাদন হওয়া একান্ত আবশ্যক। প্রচুর পরিমাণ লবণ উৎপাদন পক্ষান্তরে রাজকোশে যথেষ্ট শুল্ক আহরণের পথ প্রশস্ত করত। প্লিনির এই মন্তব্য থেকে আটপৌরে প্রয়োজনের পণ্য দৈনন্দিন জীবনে ও রাষ্ট্রপরিচালনায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়।
চারশত বছরে কারিগরী শিল্পের যে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হল তার থেকে বোঝা যায় যে শিল্পে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের ভূমিকা নিতান্ত সামান্য, এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগের সুযোগ যথেষ্ট। বিশেষীকরণের ঝোঁক ও ধাতুর ব্যবহারের বৃদ্ধিও এই আমলের শিল্প অর্থনীতির বড় বৈশিষ্ট্য।
প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের আপেক্ষিক অনুপস্থিতির অর্থ কিন্তু শিল্পক্ষেত্রে নৈরাজ্য নয়। যে কারিগরী শিল্পগুলির তালিকা আগে দেওয়া হয়েছে, তার প্রায় সবগুলিই শ্রেণী, গণ, পুগ, সংঘ জাতীয় সংগঠনের আওতায় ছিল। এই সংগঠনগুলির ভূমিকা প্রথম দেখা গিয়েছিল খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকে: খ্রীঃ পূঃ চতুর্থ থেকে দ্বিতীয় শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের চাপে বোধহয় এই সংগঠনগুলির বিকাশ কিছুটা ব্যাহত হয়। কিন্তু খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতকের প্রথম পাদের পর থেকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ক্রমশঃ শিথিল হওয়ায় এই গিল্ড জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সক্রিয় ভূমিকা মূর্ত হয়ে ওঠে। জাতক কাহিনীগুলিতে ও লেখমালায় শ্রেণী ও সংঘ জাতীয় কবিগরী সংগঠনের ভূরি ভূরি উল্লেখ রয়েছে।
জাতকের গল্পে যখন বলা হয় একটি গ্রামে সহস্র কর্মকারের কুটির রয়েছে (‘সহস্স কুটিক কম্মারগাম’), তখন কর্মকারদের সংগঠিত কারবারের ছবিই ফুটে ওঠে। এক একটি অঞ্চলে এক একটি শিল্প বোধহয় সংগঠিত হচ্ছিল। কামারদের গ্রামের মত বর্দ্ধকির গ্রামের উল্লেখ জাতকে আছে। আবার শ্রাবস্তীর মত শহরের একটি রাস্তায় মূলত পদ্মফুলের মালাকাররা কাজ করত থাকত (‘উপ্পলবীথি’; উপ্পল= উৎপল বা পদ্ম, বীথি= রাস্তা), সেই উল্লেখ আর একটি জাতকের গল্পে পাওয়া যায়। আধুনিক আমলে কোনও শহরে বা গ্রামে শাঁখারীটোলা, কুমোরপাড়া, তেলীপাড়ার সঙ্গে এই জাতীয় ঘটনার তুলনা করলে তার তাৎপর্য বোঝা সহজ হবে। সংগঠনের আওতায় আসার ফলে এক একটি শিল্প আঞ্চলিক রূপ নিচ্ছিল ও কুশলতার অধিকারী হয়ে উঠছিল। ধর্মশাস্ত্রের তথ্যও ‘শ্রেণী’/ সংঘ জাতীয় সংগঠনের গুরুত্ববৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী একটি অঞ্চলে কোনও শিল্পের একটি সংগঠন থাকার কথা; অর্থাৎ শাস্ত্রকাররা সাংগঠনিক ঐক্যের সমর্থক ছিলেন। তবে নহপানের একটি লেখতে নাসিকে দুটি কৌলিক বা তাঁতীদের সংগঠন (‘কৌলিক নিকায়’ এবং ‘অপর কৌলিক নিকায়’) যুগপৎ সক্রিয় থাকার উল্লেখ পাওয়া যায়। জাতকের কাহিনীগুলিতে ‘শ্রেণী’ বা সংঘের প্রধান হিসেবে ‘জেট্ঠক’ (জ্যেষ্ঠক) বা ‘পমুখ’ (=প্রমুখ)-এর দেখা পাওয়া যায়। তিনি সম্ভবত সংঘের সদস্যের সর্বসম্মত নেতা ছিলেন। তবে তাঁর নেতৃত্ব কিসের উপর নির্ভর করত—তাঁর কারিগরী কুশলতায় শ্রেষ্ঠত্ব না বয়োবৃদ্ধি না দুই-ই—এ বিষয়ে নিশ্চিত হবার মত তথ্য প্রমাণ নেই। ‘জেটঠক’ বা ‘পমুখ’ হয়তো খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতাব্দী থেকেই শ্রেণী বা সংঘের পরিচালন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মনু ও যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতিগ্রন্থ দুইটিতে ‘শ্রেণী’র পরিচালন ব্যবস্থায় সংঘের নেতা ছাড়াও ‘কার্যচিন্তক’ নামক পদাধিকারীদের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘কার্যচিন্তক’রা সদ্বংশজাত, কর্মকুশল, বিশ্বস্ত, ন্যায়পরায়ণ ও সৎহবেন—এই বিধান স্মৃতিশাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে। পমুখ’ বা ‘জেটঠককে’ সংঘ পরিচালনার কাজে ‘কার্যচিন্তক’ বা প্রশাসনিক আধিকারিকরা সহায়তা করতেন। এর থেকে বোঝা যায় ‘শ্রেণী’র কাজের পরিমাণ ও পরিধি দুইই বোধ হয় বাড়তির পথে যাচ্ছিল, তাই পরিচালন ব্যবস্থায় নূতন একটি উপাদান সংযোজনের দরকার পড়ে। এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ‘শ্রেণী’ বা সংঘের নির্দিষ্ট নিয়ম, আইনকানুন ও রীতিনীতি না থাকলে সংঘের সাংগঠনিক শক্তি ও স্থায়িত্ব দুর্বল হয়ে পড়বে। ‘শ্রেণী’র সদস্যদের জন্য আচরণবিধি ও নিয়মাবলীর পরিচয় মনু ও যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতিগ্রন্থে আছে। নিয়মগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সংঘের সামূহিক চরিত্রের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ। সংঘভুক্ত কারিগরদের উপার্জিত সম্পদ সমভাবে বণ্টিত হ’ত; কোনও বিশেষ কারিগর সদস্যের উদ্ভাবিত অভিনব কোনও কৌশল বা পদ্ধতিতে কারবারে অধিক উপার্জন হলে ঐ সদস্যের তাতে কোনও বিশেষ অধিকার স্বীকৃত হ’ত না। অপরদিকে কোনও সদস্য যদি সংঘের স্বার্থের বিরুদ্ধে বা চুক্তির পরিপন্থী কোনও কাজ করতেন ও তার ফলে ‘শ্রেণী’র আর্থিক ক্ষতি হ’ত, তাহলে ক্ষতিপূরণের দায় ঐ দোষী সদস্যের উপর বর্ত্তাত। সংঘের রীতিনীতি না মানলে অপরাধী সদস্যকে নির্বাসন দণ্ড দেবার বিধান দিয়েছেন মনু; যাজ্ঞবল্ক্যের বিধানও অনুরূপ, তবে তিনি অপরাধী সদস্যের সম্পত্তিও সংঘের দ্বারা বাজেয়াপ্ত করার পক্ষপাতী। ধর্মশাস্ত্রের বিধানগুলির যে চরিত্রটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তা এই যে ‘শ্রেণী’র আইন কানুনকে (‘শ্রেণীধর্ম’) দেশ ও রাজার আইনের সমমর্যাদা (‘রাজধর্ম’) দেওয়া হয়েছে। তার ফলে ‘শ্রেণী’র সদস্যবৃন্দ ও নেতৃত্বের মধ্যে গুরুতর বিবাদ বিসংবাদ দেখা না দিলে, রাজকীয় তথা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের বিশেষ সুযোগ ধর্মশাস্ত্রের বিধানে নেই। কোনও সদস্যের বিরুদ্ধে ‘শ্রেণী’ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ নিলে সচরাচর রাজা তা অনুমোদন করবেন, এই জাতীয় মনোভাবই শাস্ত্রকাররা ব্যক্ত করেছেন।
কারিগরী বৃত্তিগুলিকে সুসংগঠিত করা ছাড়াও ‘শ্রেণী’ জাতীয় সংগঠনগুলি আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। লেখমালার তথ্যাদি, অবিসংবাদিত ভাবে প্রমাণ করে যে ‘শ্রেণী’গুলি বহুক্ষেত্রে আধুনিক ব্যাঙ্কের অনুরূপ ভূমিকা নিত। শক ক্ষত্রপ নহপানের রাজত্বকালে (নাসিক লেখ, ৪১, ৪২, ৪৫ বর্ষ) নাসিকে দুটি তন্তুবায় ‘শ্রেণী’ ছিল (‘কৌলিক নিকায়’)। নহপানের জামাতা প্রথম ‘শ্রেণী’তে দুই হাজার কার্ষাপণ গচ্ছিত রাখেন; ঐ মূল অর্থের উপর বার্ষিক ১২% হারে সুদ (‘বৃদ্ধি’) ‘শ্ৰেণী’টি দিত। তন্তুবায়দের অপর নিকায়তে ঋষভদত্ত হাজার কার্ষাপণ জমা রাখেন, এর উপর বার্ষিক ৯% হারে সুদ দেওয়া হত। লেখটিতে স্পষ্টই বলা আছে যে কোনও ‘শ্রেণী’ই মূল অর্থে হাত দিতে পারবেন না; কেবলমাত্র ‘বৃদ্ধি’ বা সুদ ব্যবহার করা যাবে (‘বৃদ্ধিভোজ্য’)। ঐ সুদের থেকে যে অর্থ পাওয়া যাবে তাই দিয়ে নিকটস্থ বৌদ্ধ সংঘের ভিক্ষুদের সামান্য আহারাদির ব্যয় নির্বাহিত হবে (‘কুশনমূল’=‘কৃশান্নমূল্য’?)। সুদের হিসাব করলে প্রথম শ্রেণীর থেকে বছরে ২৪০ কার্ষাপণ ও দ্বিতীয় শ্রেণীর থেকে বছরে ৯০ কার্ষাপণ—অর্থাৎ মোট ৩৩০ কার্ষাপণ পরিমাণ অর্থ পাওয়া যাবে। কুষাণ রাজা হুবিষ্কের আমলে মথুরাতে ময়দা তৈরি করার কারিগরদের ‘শ্রেণী’তে এক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ৫৫০ পুরাণ পরিমাণ আমানত গচ্ছিত রাখেন। ঐ আমানতের থেকে প্রাপ্য সুদ দিয়ে একটি মন্দিরে প্রত্যহ তিন আঢ়ক সক্তু বা ছাতু ও তিন ঘড়া কাঁচা আনাজ (‘হরিতকলাপাক’) ও এক প্রস্থ লবণ যোগানের ব্যবস্থা করা হত। আবার নাগার্জুন কোণ্ডায় অনুরূপ ব্যবস্থায় ৩৩০ কার্ষাপণ পরিমাণ অর্থ চারটি ‘শ্রেণী’র দায়িত্বে গচ্ছিত রাখা হয়েছিল। ‘শ্ৰেণী’গুলিতে কখনও কখনও নগদ অর্থ ছাড়াও স্থাবর সম্পত্তি যেমন ভূখণ্ড, গাছ ইত্যাদি স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা হত। সেইক্ষেত্রে ‘শ্রেণী’ প্রায় অছির ভূমিকা গ্রহণ করত। ‘শ্রেণী’গুলির এই ভূমিকা কিন্তু ধর্মশাস্ত্রে পাওয়া যায় না। যাবতীয় আমানত চিরকালীন বা অক্ষয়নীবী ব্যবস্থা অনুসারে গচ্ছিত থাকত। লেখমালার তথ্য প্রমাণ করে আমানতকারীদের মধ্যে যেমন রাজা বা রাজবংশের অন্তর্গত ব্যক্তি ছিলেন, তেমনই উচ্চপদস্থ রাজপুরুষ এবং বিভিন্ন প্রকার বণিক ও কারিগর সহ সাধারণ মানুষ ও ছিলেন। এই ঘটনা ‘শ্রেণী’গুলির গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তার সন্দেহাতীত প্রমাণ। যেহেতু আমানতগুলি সবক্ষেত্রেই চিরকালীন, অতএব এও বোঝা যায় যে শিল্প সংগঠনগুলি বিশ্বস্ততা নিয়ে জনজীবনে দ্বিধা বা সংশয়ের স্থান ছিল না। অতএব অর্থনৈতিক জীবনে ‘শ্রেণী’গুলির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্ব স্বীকার না করে উপায় নেই। ব্যাঙ্কের ভূমিকা গ্রহণ করে ‘শ্রেণী’গুলি যেমন জনজীবনে ও সাংস্কৃতিক তথা ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে অংশ নিত, অন্যদিকে চিরকালীন ভিত্তিতে আমানত পাবার দরুন শিল্পের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয় মূলধনের ব্যবস্থাও করা হ’ত। আলোচ্য যুগে কারিগরী বৃত্তিগুলির প্রসার ও উন্নতির পিছনে সংশ্লিষ্ট ‘শ্রেণী’ বা সংঘগুলির মূল্যবান অবদান ছিল।
॥ ৪ ॥
কৃষি ও কারিগরী শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বাণিজ্যের ব্যাপক অগ্রগতি আলোচ্য যুগটিকে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দিয়েছে। সমসাময়িক লেখমালাতে—যার বেশীরভাগই দানপত্র বা ঐ জাতীয়—কারিগরদের তুলনায় বণিকদের উল্লেখ কম নয়। ব্যবসায়ীরা কখনও ‘বণিক’, কখনও ‘সার্থবাহ’ আবার কখনও বা ‘শ্ৰেষ্ঠী’ বলে অভিহিত। জাতকের কাহিনীতে বারবার ‘বণিক’, ‘সার্থবাহ’ ও ‘শ্ৰেষ্ঠী’র কথা শোনা যায়। ‘বণিক’ বলতে বোধহয় সাধারণ ছোট মাপের ব্যবসায়ীকে বোঝাত; ‘সার্থবাহ’ ছিলেন ‘সার্থ’ বা কাফেলার প্রধান বা নায়ক। গোযান বা অন্যকোনও পশুবাহিত অনেকগুলি শকটে পণ্য নিয়ে দূরদূরান্তে যাঁরা ঘুরে ঘুরে ব্যবসা করতেন, তারা ‘সার্থ’ বলে আখ্যাত। এই জাতীয় বণিকদের প্রধান বা নেতা ‘সার্থবাহ’ বলে উল্লিখিত। সার্থবাহ পাঁচশ বা হাজারটি গোশকট নিয়ে ‘পুব্বন্ত’ (পূর্বসীমা) থেকে ‘অপরান্ত’ (পশ্চিম সীমা) পর্যন্ত বাণিজ্যে চলেছেন, এমন দৃশ্যের বর্ণনা জাতক কাহিনীতে বারবার এসেছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন ‘সেটঠি’ বা ‘শ্ৰেষ্ঠী’; জাতকের গল্পে ‘শ্ৰেষ্ঠী’ সর্বদাই বিপুল সম্পত্তির অধিকারী রূপে বর্ণিত ও তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ আশী কোটি (‘অশীতিকোটি বিভব’)। এই সংখ্যা অবশ্যই গতানুগতিক; কিন্তু এতে সন্দেহ নেই যে বণিক সমাজে অর্থের বিচারে শ্ৰেষ্ঠীই ছিলেন সর্বোত্তম। শ্রেষ্ঠীকে জাতক গ্রন্থে দুই ভূমিকায় দেখা যায়। প্রথম ভূমিকায় তিনি এক অত্যন্ত ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী যিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁর ব্যবসা চালান। দ্বিতীয় ভূমিকাটির তাৎপর্য বেশী। জাতকের গল্পে শ্রেষ্ঠী অনেকক্ষেত্রে বণিকদের নেতা বলে প্রতিভাত হন। সম্ভবতঃ তাঁর আর্থিক কৌলিন্যের কারণেই তাঁর নেতৃত্ব বণিক সমাজ মেনে নিত। জাতকগুলিতে রাজা ও শ্রেষ্ঠীর মধ্যে অত্যন্ত নিকট সম্পর্কের কথা প্রায়ই দেখা যায়; শ্রেষ্ঠী কখনও কখনও দিনে তিনবার করেও রাজদরবারে যেতেন (দিবসসসো তয়ো বারে রাজুপট্ঠনম্ গচ্ছতি’)। অথচ ‘রাজভোগ্য’ বা রাজার বেতনভুক কর্মচারীদের তালিকায় শ্রেষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত নন। শ্ৰেষ্ঠীর সঙ্গে রাজার বিশেষ সম্পর্ক ছিল একথা অস্বীকার করা যায় না। এই সম্পর্ক খুব সম্ভবত পারস্পরিক আর্থিক স্বার্থ রক্ষার জন্যই বজায় রাখতে শ্রেষ্ঠী ও শাসক উভয়েই আগ্রহী ছিলেন। শ্রেষ্ঠী যে রাজদরবারে উপস্থিত থাকতেন তা বোধহয় প্রধানত বণিককুলের প্রতিনিধি বা মুখপাত্র হিসেবে। বণিকদের সুযোগ সুবিধা ও অভাব অভিযোগ বিষয়ে ও সামগ্রিকভাবে বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপ বিষয়ে শাসক শ্রেষ্ঠীর মারফৎ অবগত হতে পারতেন। অবদান সাহিত্যের কাহিনীতে জানা যায় যে মগধ ও কোশলের লড়াইতে কোশলের রাজাকে এক শ্ৰেষ্ঠী প্রচুর অর্থ ঋণ দিয়েছিলেন। এই কাহিনীর বাস্তবতা স্বীকার করলে বোঝা যায় যে বণিকদের প্রধান হিসেবে শ্রেষ্ঠী রাজার আর্থিক প্রয়োজনে সাহায্য করতেন। শাসক ও ব্যবসায়ীর মধ্যে এত নিকট ও নিয়মিত সম্পর্ক এই যুগের অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি বিশেষ লক্ষণ। শ্রেষ্ঠীদের মধ্যে যাঁরা রাজশ্রেষ্ঠী বলে পরিচিত ছিলেন, তাঁরা সরাসরি রাজার হয়ে অথবা রাজার জন্য ব্যবসায়ে লিপ্ত হতেন। রাজার আর্থিক প্রয়োজন মেটানো ও তাঁর জন্য কোনও প্রয়োজনীয় সামগ্রী যোগাড় করাও রাজশ্রেষ্ঠীর অন্যতম কর্তব্য ছিল। পহ্লব বংশীয় রাজা গণ্ডোফারেসের (১৯-৪৬ খ্রীঃ) রাজশ্রেষ্ঠীর নাম ছিল হাব্বান; তাঁর সম্বন্ধে সেন্ট টমাসের জীবনীতে জানা যায়। সেন্ট টমাসের জীবনীর সিরীয় সংস্করণে (আঃ তৃতীয় শতাব্দী) বলা হয়েছে গণ্ডোফারেস তাঁর নিজের প্রাসাদ বানাতে দক্ষ এক সূত্রধর যোগাড় করার জন্য হাব্বানকে নিয়োগ করেন; হাব্বান সেইমত পশ্চিম এশিয়া থেকে সেন্ট টমাসকে ক্রীতদাস হিসেবে ভারতে নিয়ে আসেন। কাহিনীর ঐতিহাসিকতা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে, কিন্তু রাজা কিভাবে নিজের প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে রাজশ্রেষ্ঠীকে দায়িত্ব দিতেন, তার খানিকটা আন্দাজ এই কাহিনী থেকে পাওয়া যাবে।
ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে বণিকদের কর্মতৎপরতা অনেকাংশে সহজ হয়েছিল স্থলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নততর হওয়ার দরুন। বৌদ্ধ গ্রন্থ ব্যবহার করে অতীন্দ্রনাথ বসু দেখিয়েছিলেন সমগ্র ভারতবর্ষে অন্তত চারটি প্রধান যোগাযোগের পথ ও তাদের সংশ্লিষ্ট অনেকগুলি ক্ষুদ্রতর পথের উদ্ভব ঘটেছিল। বভেরু জাতকে দেখা যায় দক্ষিণে সাতবাহনদের রাজধানী পইট্ঠান বা প্রতিষ্ঠান থেকে একটি পথ টগর, নাসিক, সেতব্য, বনসভয়, উজ্জয়িনী হয়ে সাঁচীর মধ্য দিয়ে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় যেত; পথটি উত্তরে কোশল রাজ্যের রাজধানী শ্রাবস্তী পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। অপর একটি পথ অঙ্গের রাজধানী চম্পা (ভাগলপুর অঞ্চল) থেকে পশ্চিম বা উত্তর পশ্চিমে গন্ধার দেশের পুষ্কলাবতী পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। এই পথের কিছুটা বর্ণনা রামায়ণে রামের বনবাস যাত্রার মধ্যেও দেখা যায়। পূর্ব দিক থেকে অপর একটি পথ পাটলিপুত্র থেকে শুরু হয়ে পশ্চিম প্রান্তে সিন্ধু নদের বদ্বীপ অঞ্চলে পাটল পর্যন্ত পৌঁছেছিল। অতীন্দ্রনাথ বসুর মতে এই পথটিই জাতকে বর্ণিত পূর্বান্ত-অপরান্ত যোগাযোগের পথ। পশ্চিম উপকূলের বিখ্যাত বন্দর ভৃগুকচ্ছ এর সঙ্গে কাবুল অঞ্চলের স্থলপথে যোগাযোগের কথা পেরিপ্লাসে বর্ণিত হয়েছে। কাবুল থেকে পুষ্কলাবতী ও তক্ষশিলা হয়ে পাঞ্জাব ও গাঙ্গেয় উপত্যকার মধ্য দিয়ে মালব অতিক্রম করে পথটি ভৃগুকচ্ছে শেষ হত।
সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে আন্তর বাণিজ্যিক সম্পর্কের পাশাপাশি খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতকের শেষদিক থেকে ভারতবর্ষ নিয়মিত দূরপাল্লার বৈদেশিক তথা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লেনদেনে বিশেষ স্থান অধিকার করে। ভারত কীভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এক তাৎপর্যপূর্ণ দেশ হিসেবে দেখা দিল তার পরিপ্রেক্ষিত বুঝবার জন্য পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার পরিস্থিতি অনুধাবন করা আবশ্যক। খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতক নাগাদ ইওরোপ ও এশিয়ার মধ্যে নিয়মিত বাণিজ্য শুরু হয়। এই বাণিজ্যের দুই প্রধান তরফ ছিল পশ্চিমে রোম সাম্রাজ্য ও পূর্বপ্রান্তে চীনের হান সাম্রাজ্য। রোমের ক্ষমতা বিস্তার ও এক বৃহৎ শাসক গোষ্ঠীর উদ্ভব হওয়ায় বিলাস দ্রব্যের চাহিদা রোম সাম্রাজ্যে তথা রোম সাম্রাজ্যের অধীনস্থ পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে ক্রমশ বাড়তে থাকে। বিলাস দ্রব্যের মধ্যে পাশ্চাত্য জগতে সবচেয়ে বেশী কদর ও চাহিদা ছিল রেশমের, যে রেশম কেবলমাত্র চীনেই উৎপাদন হত। চীনের রেশম স্থলপথে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে, মধ্য এশিয়ার টাকলামাকান মরুভূমির মধ্য দিয়ে, বহু দুর্গম পথ অতিক্রম করে পামির মালভূমি ও ইরান হয়ে পশ্চিম এশিয়া পৌঁছত; সেখান থেকে রোমে ও সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে শাসক ও বিত্তবান গোষ্ঠীর হাতে তা পৌঁছত। বুলনয়ের রচনায় এই পথের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়। যেহেতু এই পথে যে সব সামগ্রীর আনা নেওয়া হত তার মধ্যে রেশমের গুরুত্ব ও দাম ছিল সবচেয়ে বেশী তাই ইতিহাসে এই দীর্ঘপথ রেশমপথ বা সিল্ক রোড নামে প্রসিদ্ধ।
কিন্তু এই বিস্তীর্ণ পথে বাণিজ্য বজায় রাখার কয়েকটি সমস্যা ক্রমেই গুরুতর আকার ধারণ করে। প্রথমত অত্যন্ত কষ্টকর, বিপদসঙ্কুল ও সমস্যাজর্জরিত ছিল এই সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া। ফলে যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে বণিকরা যখন তাদের অভিলষিত বাজারে জিনিস নিয়ে পৌঁছতেন তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের আনা পণ্যগুলি অত্যন্ত চড়া দামে বিক্রীত হত। পণ্যের অত্যধিক দাম হলে তার বাজার সঙ্কুচিত হয় ও ব্যবসা শেষ পর্যন্ত লাভজনক হতে পারে না। দ্বিতীয়ত এই দীর্ঘ স্থল পথের একটি বড় অংশ ইরাণের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। চীন ও রোমের মতই ইরাণেও অত্যন্ত শক্তিশালী এক সাম্রাজ্য এই সময় ক্ষমতাসীন ছিল। এই সাম্রাজ্য গ্রীক রচনাকারদের লেখনীতে আর্সাকীয় নামে অভিহিত ও চীনা গ্রন্থে আন-সি বলে উল্লিখিত। ইরাণের আর্সাকীয়রা কেবলমাত্র এক পরাক্রান্ত রাজশক্তি ছিলেন না। তাঁদের ভূখণ্ডের ভৌগোলিক অবস্থান এমনই ছিল যে পূর্ব-পশ্চিমের বাণিজ্যিক লেনদেন তাঁদের সাম্রাজ্যের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। অর্থাৎ আর্সাকীয়রা ভৌগোলিক ও বাণিজ্যিক দ্বিবিধ অন্তর্বত্তীর ভূমিকা নিয়েছিল, এবং এই অন্তর্বত্তীকে এড়াবার কোনও উপায় ছিল না। ফলে এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার আর্সাকীয়রা করেন এবং রেশম পথের উভয় দিকের বাণিজ্যের ওপর অত্যন্ত চড়া হারে শুল্ক চাপিয়ে ছিলেন। এই শুল্কের হার এত বেশী ছিল যে চীনের রেশম ও রেশম জাত পণ্য মূল দামের বহুগুণ বেশী মূল্যে রোমের বাজারে বিক্রী হ’তে আরম্ভ করে। এর দরুন স্থলপথে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে খানিকটা সমস্যা দেখা দেয়। চীন ও রোম দুই সাম্রাজ্যের তরফ থেকেই অপর একটি পরিবর্ত অন্তর্বর্তী শক্তির প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকে—এই অন্তর্বত্তী শক্তিকে এমনই জায়গায় অবস্থিত হতে হবে যাতে আর্সাকীয় উপর নির্ভরতা কমে যায়, ও পরিবর্ত অন্তর্বত্তী শক্তিটি যেন আর্সাকীয় শক্তির মত এক আগ্রাসী শুল্ক নীতি অনুসরণ না করে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক কারণে কাঙ্খিত অন্তর্বত্তীর ভূমিকায় ভারতীয় উপমহাদেশের আবির্ভাব ঘটে। বিষয়টির বিশদ ব্যাখ্যা ও আলোচনা দরকার। খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতকের গোড়ায় মধ্য এশিয়ার যাযাবর জনজাতির বসতিতে ব্যাপক পরিবর্ত্তন আসে। চীনা সূএ থেকে জানা যায় যে মধ্য এশীয় তিন যাযাবর জাতি হিউয়ুং নু (পরবর্ত্তীকালের হূণ), সেক (শক) ও ইউয়েচ্চি (পরবর্ত্তীকালের কুষাণ) নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ লড়াইতে লিপ্ত ছিল। এই লড়াই-এর ফলে অন্যান্য কয়েকটি উপজাতির মত ইউয়েচ্চিদের প্রধান শাখা তা-ইউয়েচ্চিরা তাদের মধ্য এশীয় আদি বাসস্থান ত্যাগ করে পশ্চিম দিকে সরে আসে। কালক্রমে আঃ ১৩০ খ্রীঃ পূঃ নাগাদ তারা তা-সিয়া বা আফগানিস্তানের পূর্বদিকে বাহলীক দেশের পূর্বাংশ দখল করে। ক্রমে ক্রমে বাহলীক দেশ (রাজধানী বালখ=মজর-ই-শরীফ) তাদের করায়ত্ত হয়। এই ইউয়েচ্চিদের পাঁচটি শাখার একটি কুএই ষুয়াং গোষ্ঠী বিশেষ ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে; এই কুএই-ষুয়াং থেকে পরবর্তীকালে কুষাণ সাম্রাজ্যের উদ্ভব। একটি মধ্য এশীয় শক্তি হিসেবে বাহলীক দেশকে কেন্দ্র করে কুষাণরা তাদের ক্ষমতা বিস্তার করতে থাকে। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর সাম্প্রতিকতম গবেষণা দ্বারা দেখিয়েছেন কিভাবে কুষাণরা একটি মধ্য এশীয় শক্তিরূপে পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার এক বিশাল ভূখণ্ডের উপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কুষাণদের এই ব্যাপক ক্ষমতা বিস্তারের জন্য কুজুল কদফিসেস, বীম কদফিসেস ও সর্বোপরি কনিষ্কের আগ্রাসী রণনীতির সাফল্য বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছিল। পশ্চিম এশিয়ায় ইরাণের বিকল্প এক অন্তর্বর্ত্তী শক্তির উদ্ভব ঘটে।
অন্যদিকে খ্রীঃ প্রথম শতকের মধ্যভাগে ভারত মহাসাগরে মৌসুমী বায়ুর গতিপ্রকৃতি বণিক ও নাবিকদের কাছে জানা হয়ে যায়। তার দরুন পশ্চিম থেকে প্রাচ্যে আসার জন্য একমাত্র স্থলপথের উপর অপরিহার্যতা অনেকাংশে হ্রাস পায়। মৌসুমী বায়ুর ব্যবহারের ফলে ভূমধ্যসাগরীয় বন্দর থেকে লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে আরব সাগর পেরিয়ে ভারতীয় উপকূলে পৌঁছন সম্ভব হয়ে ওঠে। পেরিপ্লাসের বর্ণনা অনুযায়ী এপিফি বা জুলাই মাসে এই বায়ু প্রবাহ শুরু হলে বণিকরা লোহিত সাগরে যাত্রা শুরু করতেন। লোহিত সাগর ও আরব সাগরের সংযোগস্থল এডেনের কাছাকাছি কোনও অঞ্চল থেকে ঐ বায়ু প্রবাহ অবলম্বন করলে অপেক্ষাকৃত সহজে ও অল্প সময়ে ভারতীয় উপকূলে পৌঁছন যেত। এর আগে ভারতের সঙ্গে এত দূরপ্রসারী মাঝ দরিয়া পাড়ি দিয়ে সমুদ্র বাণিজ্য পাশ্চাত্যের ঘটেনি। সিন্ধু সভ্যতার আমলে বহির্বাণিজ্যে সমুদ্র বাণিজ্যের ভূমিকা স্বীকার করেও বলা যায় যে ঐ বাণিজ্য মূলত উপকূল আশ্রয় করে চলত। কিন্তু রোম-ভারত বাণিজ্যে সরাসরি সমুদ্র পেরিয়ে জাহাজ চলাচল করত। তবে এই সুদীর্ঘ সমুদ্রপথ পাড়ি দেওয়া হঠাৎ উদ্ভূত হয়নি, কয়েকটি ধাপে ধাপে তা বিকশিত হয়। এই পর্বগুলির সবচেয়ে বিশ্বস্ত বর্ণনা প্লিনির ন্যাচারাল হিস্ট্রি গ্রন্থে আছে। তাঁর মতে ভারত থেকে পশ্চিমে সমুদ্র পাড়ি দেবার প্রাথমিক পর্বটি দেখা যায় আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণের সময়। ভারত অভিযান শেষ করে আলেকজাণ্ডারের সৈন্যবাহিনীর একটি অংশ জলপথে সিন্ধুর বদ্বীপ অঞ্চল থেকে পারস্যের রাজধানী সুসা গিয়েছিল; সময় লেগেছিল সাত মাস। এর পরবর্তী পর্বে মৌসুমী বায়ু আবিষ্কৃত হওয়ায় জাহাজগুলি অনেক কম সময়ে ও সহজে সিন্ধু নদের মোহনায় অবস্থিত বারবারিকাম বন্দরে ভিড়ত। তৃতীয় ধাপে রোমের জাহাজ এসে পৌঁছত সিগেরিয়াস নামক বন্দরে; এই বন্দরটি সাধারণত কোঙ্কন উপকূলের জয়গড় বন্দরের সঙ্গে অভিন্ন বলে ধরা হয়। চতুর্থ ও শেষ বা সবচেয়ে পরিণত পর্বে লোহিত সাগরের উপর বার্নিস বন্দর থেকে মৌসুমী বায়ুর আন্দাজমত জাহাজ ছাড়লে মাত্র চল্লিশ দিনে ভারতের মালাবার উপকূলের বিখ্যাত বন্দর মুজিরিসে পৌঁছন যেত। জলপথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারতের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্য পূর্ণ হয়ে ওঠে। স্ট্রাবো জানিয়েছেন তিনি যখন তাঁর বন্ধু মিশরের প্রশাসক ইলিয়াস গ্যাল্লাসের সঙ্গে ছিলেন তখন তিনি আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর থেকে ভারতের উদ্দেশে কমপক্ষে ১২০টি জাহাজকে পাড়ি দিতে দেখেছিলেন; অথচ মাত্র কিছুদিন আগেও ভারতে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাণিজ্য যাত্রা ছিল বিরল ঘটনা।
পেরিপ্লাসে ও টলেমীর ভূগোলে খ্রীস্টীয় প্রথম দুই শতকে ভারতীয় উপকূলের প্রধান বন্দরের তালিকা পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রেই বন্দরগুলির নাম পেরিপ্লাসে ও টলেমীর ভূগোলে প্রায় একইরকম। ভারতের বন্দরগুলির মধ্যে অন্যতম প্রসিদ্ধ ছিল বারবারিকাম, যা সিন্ধুনদের মোহনায় অবস্থিত। পেরিপ্লাস থেকে দেখা যাবে যে সিন্ধু নদের মোহানায় সাতটি মুখের মধ্যে মাত্র মাঝেরটিই নাব্য ছিল, তারই ওপর বারবারিকাম বন্দর অবস্থিত ছিল। প্লিনির বর্ণনা অনুসারে রোমের সঙ্গে জলপথে বাণিজ্য একসময়ে নিম্ন সিন্ধু উপত্যকা ও সিন্ধুর বদ্বীপ অঞ্চল থেকে চালু ছিল; সে দিক দিয়ে বিচার করলে বারবারিকাম-এর গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। চীনা গ্রন্থের (হৌ-হান-শু) সাক্ষ্য ব্যবহার করে ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে শেন-তু বা নিম্ন সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলের সঙ্গে রোমের সমুদ্র বাণিজ্যে বণিকরা প্রচুর লাভ করতেন। দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এই অঞ্চল কুষাণ অধিকারে ছিল।
নিম্ন সিন্ধু উপত্যকাও বদ্বীপ অঞ্চলের পর কচ্ছ অঞ্চল পেরিয়ে গুজরাটের উপকূলে সুরাষ্ট্ৰিনি বন্দরের উল্লেখ করেছেন টলেমী। এই বন্দর নিঃসন্দেহে আধুনিক সুরাট। তবে সুরাষ্ট্ৰিনি বন্দর তখনও পরবর্ত্তীকালের মত প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে নি।
গুজরাট উপকূলে মনোগ্লোসন (বা মানগ্রোল) বন্দরের কথাও টলেমী বলেছেন। তবে এই উপকূলের তথা সমগ্র পশ্চিম উপকূলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্দর ছিল বারুগাজা, যার বিশদ বর্ণনা পেরিপ্লাসে পাওয়া যাবে। বারুগাজার গুরুত্ব সম্বন্ধে টলেমীও সচেতন ছিলেন। বারুগাজা ভারতীয় লেখমালায় ও সাহিত্যে প্রসিদ্ধ বন্দর ভূগুকচ্ছের (প্রাকৃত ভরুগচ্ছ) সমার্থক। পেরিপ্লাসের অজ্ঞাতনামা গ্রীক লেখক সম্ভবতঃ এই বন্দরে একাধিকবার নিজে জাহাজ নিয়ে এসেছিলেন। কারণ এই বন্দর সম্বন্ধে তাঁর বর্ণনা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা জাত বলেই মনে হয়। তিনি এও সঠিকভাবে নির্দেশ করেছেন যে বারুগাজা বন্দর ছিল নর্মদার মোহনায়; এই তথ্যটি সমকালীন ভারতীয় তথ্যসূত্রেও পাওয়া যাবে। পেরিপ্লাসের বর্ণনা জানায় যে এই বন্দরে জাহাজ নিয়ে আসা দুঃসাধ্য ছিল। কারণ বন্দরের নিকটবর্ত্তী অঞ্চলের জল ছিল অগভীর; ফলে জাহাজ চালানোর পক্ষে যথেষ্ট সমস্যা দেখা দিত। পেরিপ্লাসে বলা আছে যে স্থানীয় শাসক ম্যামবানুস বা ন্যামবানুস (=শক ক্ষত্রপ নহপান) বিদেশী জাহাজের গমনাগমন সহজতর করার উদ্দেশ্যে স্থানীয় মাঝিমাল্লা ও নাবিকদের নিয়োগ করতেন; ঐ মাঝি-মাল্লারা এপ্পগ ও কোটুম্ব নামক ক্ষুদ্রতর জলযান চালিয়ে বিদেশী জাহাজগুলি বন্দরে আনার ও বন্দর থেকে বড় দরিয়ায় বার করার ব্যাপারে পথ দেখাতেন। এই তথ্যটি বারুগাজা বন্দরের গুরুত্ব, বন্দরে বিদেশী জাহাজ আসা যাওয়ার সুবিধা জনক ব্যবস্থা ও বারুগাজার মধ্য দিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শক রাজার গভীর আগ্রহের পরিচয় বহন করে। এখানে উল্লেখ করা চলে যে বিদেশী জাহাজকে পথ দেখিয়ে দেবার ব্যাপারে শকদের মত সাতবাহন রাজারাও বোধহয় সজাগ ছিলেন; সাতবাহন ভূখণ্ডের অন্তর্গত কাহ্নেরীতে একটি লেখতে যে সাগরপালোগণদের কথা বলা আছে, তাঁরা সম্ভবত স্থানীয় নাবিক হিসেবে বিদেশী জাহাজ চলাচলে সহায়তা করতেন। বারুগাজা বন্দরের উত্থানের অন্যতম কারণ ছিল এই বন্দরের সঙ্গে নিকটস্থ ও দূরবর্ত্তী পশ্চাদভূমির নিয়মিত বাণিজ্যিক সংযোগ। পেরিপ্লাস থেকে জানা যায় টগর ও প্রতিষ্ঠান (দাক্ষিণাত্যের মধ্যভাগ) থেকে গোশকটে যথাক্রমে তিরিশ ও কুড়ি দিনে বারুগাজায় আসা যেত। আবার বারুগাজা থেকে পূর্বদিকে মালবের উজ্জয়িনীর সঙ্গে যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, সে কথা পেরিপ্লাস টলেমী ও ভারতীয় সাহিত্য সূত্রের সাক্ষ্যের সাহায্যে প্রমাণিত হয়। পেরিপ্লাসের লেখক এছাড়াও জানিয়েছেন যে চীনের পণ্য বাহলীক দেশ থেকে কাবুল, পুষ্কলাবতী হয়ে স্থলপথে নিম্ন সিন্ধু অঞ্চলের মধ্য দিয়ে বারুগাজায় পৌঁছত। এত বড় পশ্চাদভূমি সমকালীন ভারতের অন্য কোনও বন্দরের ছিল না বললেই চলে।
বারুগাজার দক্ষিণে কোঙ্কন, উপকূলে তিনটি বন্দরের নাম পেরিপ্লাসের রচনাকারের জানা ছিল। এই তিনটি যথাক্রমে সুপ্পারা, ক্যালিয়েনা ও সিমুল্লা। সুপ্পারা নিঃসন্দেহে আধুনিক সোপারা, যা বম্বের কাছেই অবস্থিত। সিমুল্লা বন্দরটি বম্বের ২৩ মাইল দক্ষিণে বর্তমান চৌল-এর সঙ্গে সনাক্ত করা হয়। ক্যালিয়েনা অবশ্যই কল্যাণ। পেরিপ্লাসের বর্ণনা থেকে মনে হয় এই তিনটি বন্দর ছিল সাতবাহনদের রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত। পেরিপ্লাসের লেখক জানিয়েছেন এলডার সারাগানুস (বা সাতবাহন রাজার প্রথম সাতকর্ণি)-এর আমল পর্যন্ত ক্যালিয়েনা ছিল এক ব্যস্ত ও নিয়মিত বন্দর। কিন্তু সাণ্ডানেস (=সুন্দর সাতকর্ণি) সিংহাসনে আসার পর ম্যামবানুস (ন্যামবানুস) অর্থাৎ শক ক্ষত্রপ নহপানের সঙ্গে লড়াই লাগায় এই বন্দরের সমৃদ্ধি নষ্ট হয়। নহপান এই বন্দরের উপর নৌ অবরোধ জারী করেন; ফলে গ্রীক জাহাজ এখানে ভেড়ানো বন্ধ হয়ে যায়; কোনও গ্রীক জাহাজ অবরুদ্ধ এলাকায় ঢুকে পড়লে নহপানের নৌবহর তাকে বলপূর্বক বারুগাজায় নিয়ে যেত। এই বর্ণনা পড়লে কোনও সন্দেহ থাকে না যে শক ও সাতবাহন উভয় পক্ষই রোম-ভারত সমুদ্র বাণিজ্যে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন এবং সুবিধা আদায়ের জন্য বাণিজ্যিক ক্রিয়াকর্মের ওপর এক পক্ষের বলপ্রয়োগ অজানা ছিল না। কল্যাণ বন্দরটির সঙ্গে অভ্যন্তরস্থ ভূভাগের যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য সহ্যাদ্রি পর্বতমালার ভিতর তিনটি ঘাট বা গিরিপথ (থলঘাট, ভোরঘাট ও নানাঘাট) বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কল্যাণের উপর নৌ অবরোধ গড়ে তোলায় বন্দর ও যোগাযোগের তিনটি পথে বাণিজ্য চালানো বোধহয় বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। ১৫০ খ্রীঃ টলেমী যখন তাঁর ভূগোলে ভারতীয় বন্দরগুলির তালিকা দেন, তখন তিনি কল্যাণের নাম উল্লেখ করেননি। অনুমান করা যায় কল্যাণ তার গুরুত্ব হারিয়েছিল।
কোঙ্কন উপকূলের দক্ষিণাংশেও কয়েকটি বন্দরের কথা পেরিপ্লাস ও টলেমীর ভূগোলে পাওয়া যাবে। এগুলি হল ম্যান্ডাগোরা (সম্ভবতঃ বানকোট), প্যালিপাটমে (সম্ভবতঃ দাভোল), মেলিজিগারা (জয়গড়), বাইজান্টিয়াম (সম্ভবতঃ ভিজাদ্রোগ), টোগারাম (দেওগড়), তুরান্নাবোয়াস (বোধহয় মালভান)। তবে এই বন্দরগুলি কোনও ক্রমেই বারুগাজা বা কল্যাণের সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। হিমাংশু প্রভা রায় সাতবাহন আমলের বাণিজ্য বিষয়ে যে গবেষণা করেছেন তার ভিত্তিতে দেখানো সম্ভব যে, কোঙ্কন উপকূলের উত্তরভাগের বন্দরগুলির বাণিজ্যিক গুরুত্ব বেশী ছিল। তার কারণ উওর কোঙ্কনের কৃষি-সমৃদ্ধি দক্ষিণের তুলনায় বেশী এবং বন্দরগুলির সঙ্গে অভ্যন্তরস্থ ভূভাগের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। কিন্তু দক্ষিণ কোঙ্কনের বন্দরগুলি সমৃদ্ধ পশ্চাদভূমির অভাবে যথাযথ বিকশিত হতে পারেনি। কেবলমাত্র বাণিজ্যের উপর নির্ভর করলে এই অঞ্চলে আর্থিক নিশ্চয়তা আসা কঠিন; তাই প্লিনি ও টলেমীর রচনায় এই অঞ্চলে বোম্বেটেদের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা উপকূলের মানুষকে জলদস্যুবৃত্তিতে খানিকটা ইন্ধন জোগাত।
কোঙ্কন উপকূল ছাড়িয়ে মালাবারে অনেকগুলি সমৃদ্ধ বন্দর ও বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল, যার পরিচয় পেরিপ্লাস, টলেমীর রচনা ছাড়াও সঙ্গম সাহিত্যেও পাওয়া যাবে। এর মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য বন্দর ছিল মুজিরিস। তার অবস্থান ছিল আধুনিক ক্র্যাঙ্গানোরের কাছাকাছি। এই বন্দর তার গুরুত্ব ও সমৃদ্ধির দিক দিয়ে বারুগাজার নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। তামিল সঙ্গম সাহিত্যে এই বন্দর মুচিরিপত্তনম নামে প্রসিদ্ধ। খেয়াল রাখতে হবে যে প্লিনির বর্ণনা অনুযায়ী রোম-ভারত সমুদ্র বাণিজ্যের সবচেয়ে উন্নত পর্যায়ে বিদেশী জাহাজগুলির পক্ষে মুজিরিস বন্দরে পৌঁছতে সবচেয়ে কম সময় লাগত। সঙ্গম সাহিত্যে বলা হয়েছে এই বন্দরে যবন জাহাজগুলি স্বর্ণমুদ্রা ভরে নিয়ে আসত ও ফেরৎ যাবার সময় তারা মুদ্রার পরিবর্ত্তে গোলমরিচ দিয়ে জাহাজ ভর্তি করত। মুজিরিসে শুধু যে গ্রীক-রোমান জাহাজই আসত তা নয়, এখানে বোধ হয় বিদেশী বণিকদের স্থায়ী নিবাসও গড়ে ওঠে। তৃতীয় শতকে রচিত ট্যাবুলা পিউটিনজেরিয়ানা গ্রন্থে মুজিরিকোট্টা বা মুজিরিসে রোমান সম্রাট অগাস্টাসের স্মৃতিতে গড়া মন্দির ছিল বলে উল্লেখ আছে। মৃত সম্রাটের উপর দেবত্ব আরোপ করে তাঁকে পূজা করার রীতি রোমে ছিল; ফলে ঐ জাতীয় মন্দিরের অস্তিত্ব রোমান বণিকদের ঐ বন্দরে স্থায়ী বসতির পক্ষে জোরালো প্রমাণ। মুজিরিস ছাড়া আর দুটি বাণিজ্যকেন্দ্র হল নরা ও টুণ্ডিস (যথাক্রমে আধুনিক ক্যান্নানোর ও পোন্নানি)। মুজিরিস সহ এই বন্দরগুলি ও নেলকুণ্ডা শহরটি ছিল চেরপুত্র (=পেরিপ্লাস ও টলেমীর কেপ্ৰোবোথ্রস) বা চেরবংশীয় শাসকদের অধীন।
মালাবার উপকূলের দক্ষিণতম সীমা কন্যাকুমারী পেরিপ্লাসে কোমারী নামে উল্লিখিত। সেখানেও একটি বন্দর ছিল তবে তার বাণিজ্যিক গুরুত্ব কিছু চমকপ্রদ ছিল না। করমণ্ডল উপকূলের বন্দরগুলি ছিল পাণ্ডিয়ান (=মাদুরার পাণ্ড্য বংশ) ও তাঞ্জোরের চোলদের অধীনস্থ। পাণ্ড্যদের অধীনে কোলচি বা আধুনিক কোরকাইতে মুক্তো উৎপাদনের কথা পূর্বেই আলোচিত। করমণ্ডল উপকূলের তিনটি সমৃদ্ধ বন্দরের নাম যথাক্রমে কামারা, পোড়ুকা, ও সোপাটমা। তিনটি বন্দরই আধুনিক মাদ্রাজের প্রতিবেশী অঞ্চলে ছিল। তবে পোড়কা নিঃসন্দেহে পণ্ডিচেরীর কাছে অবস্থিত আরিকামেড়ু, যেখানে উৎখননের ফলে একটি রোমান বাণিজ্য কেন্দ্রের অস্তিত্ব জানা গিয়েছে। আরিকামেডুতে ১৫০ ফুট লম্বা যে বৃহৎ অট্টালিকা আবিষ্কৃত হয়েছে, তা, মর্টিমার হুইলারের বিচারে, একটি গুদামখানার ধবংসাবশেষ এবং তা আঃ ৫০ খ্রীঃ নির্মিত। দুটি দামী পাথরের গায়ে যে ধরণের নকশা দেখা যায়, তার চল রোমে বা গ্রীকো-রোমান কারিগরদের মধ্যেই ছিল। এ ছাড়াও উজ্জ্বল লাল রঙের মৃৎপাত্র ও আরও কিছু পানপাত্র পাওয়া গিয়েছে; এইগুলিতে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কারিগরীর ছাপ স্পষ্ট। রোমান বাতিদান ও কাঠের পাত্রও আবিষ্কৃত হয়েছে। পোড়ুকা বা আরিকামেডুর মতই অপর একটি বিখ্যাত বন্দর ছিল কাবেরীপট্টিনম। সঙ্গম সাহিত্যে যে বন্দর কাবেরীপট্টিনম বলে বর্ণিত, তারই নাম টলেমীর ভূগোলে খাবেরোস। এই বন্দর কাবেরী নদীর মুখে ও চোল রাজ্যে অবস্থিত ছিল। আধুনিক পুহার বা পুম্পুহার-এ প্রাচীন বন্দরটির ধ্বংসাবশেষ পুরাতাত্ত্বিকরা আবিষ্কার করেছেন।
করোমণ্ডল উপকূলের উত্তরদিকে অন্ধ্র উপকূলে মাসালিয়া বা মাইসোলিয়া অঞ্চলে (আধুনিক মসুলিপওন) টলেমী কণ্টাকসুল্লা (বা প্রাচীন ঘণ্টকশাল), আলোসুগনে নামক দুইটি বন্দরের উল্লেখ করেছেন। এই একই উপকূলে পেরিপ্লাসে একটি বন্দরের কথা জানা যায় যেখান থেকে খ্রাইসে খোরা বা সুবর্ণভূমির উদ্দেশে জাহাজ ছাড়ত। সুবর্ণভূমি নামটি প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে বহুশ্রুত: এই নাম সাধারণত ব্রহ্মদেশের দক্ষিণ উপকূল, শ্যামদেশ ও দঃ-পূঃ এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জকে বোঝাতে ব্যবহৃত হত। কৃষ্ণা-গোদাবরী নদীর বদ্বীপ অঞ্চলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা ও বঙ্গের নিয়মিত যোগসূত্রের ইঙ্গিত নাগার্জুনকোণ্ডায় পাওয়া ইক্ষ্বাকু লেখমালায় আছে। এই লেখমালার সাক্ষ্য অনুযায়ী কৃষ্ণা বদ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত বৌদ্ধ সংঘে বঙ্গ ও শ্রীলঙ্কার ভিক্ষুদের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ব্যতিরেকে কল্পনা করা কঠিন।
গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে পেরিপ্লাসে গ্যাঙ্গে বা গঙ্গা বন্দরের উল্লেখ আছে। এই বিবরণে বলা হয়েছে নিম্ন গাঙ্গেয় অঞ্চল গঙ্গা দেশ বলে পরিচিত ছিল; ঐ দেশের প্রধান বন্দরের নামও গ্যাঙ্গে বা গঙ্গ। এই অঞ্চলের নানা পণ্য—বিশেষতঃ মসলিন— হয় গাঙ্গেয় উপত্যকার মধ্য দিয়ে ভৃগুকচ্ছ বন্দর অথবা বন্দর অথবা উপকূল ধরে দ্রাবিড় দেশে পৌঁছত; সেখান থেকে তা রোমের বাজারে রপ্তানী হত। টলেমীর বিবরণে টামেলিটিস নামক যে বন্দরের নাম পাওয়া যায়, তা নিঃসন্দেহে প্রাচীন বাংলার বিখ্যাত তাম্রলিপ্ত বন্দর (বর্তমান মেদিনীপুর জেলার তমলুক)।
ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলির গুরুত্বের তারতম্য অবশ্যই ছিল। টলেমী সামান্য কিছু বন্দরের ক্ষেত্রে এম্পোরিয়ন অভিধাটি ব্যবহার করেছেন। এম্পোরিয়ন শব্দটি সাধারণভাবে যে কোনও বাণিজ্যকেন্দ্রকেই বোঝাতে পারে। তবে ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে টলেমী এই শব্দটি অত্যন্ত সাবধানে ও বেছে ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর মতে প্রাচ্যের উপকূলের নিকটবর্তী কোনও বন্দরে যদি রোমান বণিকদের পাকাপাকি নিবেশ থাকত, তাহলেই সেই বন্দর টলেমীর ভূগোলে এম্পোরিয়নের মর্যাদা পেত। সেই দিক দিয়ে দাক্ষিণাত্যের তুলনায় দক্ষিণভারতে মালাবার ও করমণ্ডল উপকূলে এম্পোরিয়ন বেশী ছিল। কৃষ্ণার বদ্বীপ অঞ্চলের বন্দরগুলির কয়েকটিকে টলেমী এম্পোরিয়ন বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু বাংলাদেশের গঙ্গা বন্দর বা তাম্রলিপ্তের ক্ষেত্রে এই অভিধা যুক্ত হয়নি। বাংলার এই দুই প্রাচীন বন্দরের গুরুত্ব মেনে নিয়েও বলা যায় যে বাংলার বন্দরগুলি রোম ভারত বাণিজ্যে প্রত্যক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিত না।
রোম ভারত বাণিজ্যে যে পণ্যগুলির লেনদেন হত প্লিনি, পেরিপ্লাস ও টলেমীর ভূগোলের থেকে তার খানিকটা আন্দাজ করা সম্ভব। কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে চাল ও গম কোঙ্কনের বন্দর থেকে পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে রপ্তানী হত। চাল ভৃগুকচ্ছ এবং মালাবার বন্দর থেকেও রপ্তানী হত। সুগন্ধী ও মশলার মধ্যে গোলমরিচ বিশেষভাবে রোমের বাজারে আদৃত হত। মালাবার থেকে দারুচিনিও রপ্তানী হত। চন্দন কাঠ, সেগুন কাঠ ও মেহগিনি কাঠের কদরও যথেষ্ট ছিল। শিল্প সামগ্রীর মধ্যে ভারতীয় কাপড়—সাধারণ মোটা কাপড় ও মসলিন দুইই রোমের বাজারে যেত। মসলিনের প্রতি রোমানদের প্রবল আকর্ষণের কথা সুবিদিত। অন্যদিকে চীনের রেশম ও রেশমজাত বস্ত্র ভারতের বিভিন্ন বন্দরের মধ্য দিয়েই রোমের বাজারে পৌঁছত। ফলে ভারতীয় বন্দরগুলি রেশমের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশ নিতে শুরু করে। দামী পাথর ও খনিজ সম্পদের মধ্যে পড়ত। এছাড়া অ্যাগেট ও কার্নেলিয়ান জাতীয় আধাদামী পাথরের প্রতিও রোমানদের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। রোমে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মধ্যে বিলাসব্যসনের দ্রব্যের উপস্থিতি অনস্বীকার্য। এই জাতীয় পণ্য অত্যন্ত চড়া দামে বিক্রীত হত, যার ফলে এই রপ্তানিতে নিযুক্ত ব্যবসায়ীদের বিপুল লাভের সম্ভাবনা মানতেই হয়।
অন্যদিকে রোম তথা পশ্চিম এশিয়া থেকে ভারতে আমদানীর তালিকাটি ক্ষুদ্রতর ও পণ্যের তালিকাতেও বৈচিত্র্য কম। খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে খেজুর নিয়মিত আমদানী হত বারুগাজাতে। ইটালীয়, লাওডিসীয় ও আরবী সুরার আমদানীর কথা পেরিপ্লাসে বর্ণিত হয়েছে। মালাবারেও বিদেশী সুরা আমদানী হত। সুরা আমদানীর অপর সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে প্রচুর পরিমাণ পানপাত্র ও পানীয় রাখার জারের উল্লেখ করা যায়। এইগুলি সমকালীন বহু প্রত্নক্ষেত্রেই আছে। প্লিনি ও পেরিপ্লাস একত্রে মিলিয়ে পড়লে মনে হয় ব্যাবিলন ও আলেকজান্দ্রিয়ার সূচীশিল্পশোভিত কাপড় বারবারিকাম বন্দরে আসত। কাচের পাত্র আমদানি হয়ে বারবারিকাম, বারুগাজা ও মালাবারের বন্দরে নিয়মিত আসত। কিছু ধাতুও আমদানিযোগ্য পণ্যের মধ্যে ছিল যথা: তামা, টিন ও সীসা। এছাড়া সোনা ও রূপোর আমদানির কথাও জানা যায়। রোমের স্বর্ণমুদ্রাও বুলিয়ন হিসেবে আমদানি হত পশ্চিম উপকূলের বিভিন্ন বন্দরে।
রোম ভারত বাণিজ্যে লেনদেনের তালিকা ও বহর দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বাণিজ্যে লাভ লোকসানের পাল্লা ভারতের দিকেই ঝোঁকানো ছিল। ২২ খ্রীঃ রোম সম্রাট টাইবেরিয়াস অভিযোগ করেছিলেন যে বিলাসব্যসনের চাহিদা মেটাতে রোম সাম্রাজ্যের সম্পদ অপসৃত হয়ে যাচ্ছে। প্লিনি আরও অর্ধশতাব্দী পর সখেদে মন্তব্য করেন যে, প্রতি বছর ভারতীয় পণ্য তাদের আদত দামের একশত গুণ বেশী দামে রোমের বাজারে বিক্রী হওয়ায় রোম সাম্রাজ্যকে বছরে ৫৫০,০০০,০০০ সেসটারসেস পরিমাণ অর্থ হারাতে হচ্ছে।
বাণিজ্যের বিস্তার ও সমৃদ্ধ অবস্থার সবচেয়ে নির্ভবযোগ্য চাক্ষুষ প্রমাণ এ যুগে প্রস্তুত বহুল পরিমাণ ও বহু প্রকারের মুদ্রা। ইন্দোগ্রীকরা স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা নিয়মিতভাবে চালু করেছিলেন। তবে উত্তর ভারতের মুদ্রা ব্যবস্থায় কুষাণ মুদ্রার গুরুত্ব সর্বাধিক। কুষাণরা স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র তিন ধাতুতেই মুদ্রা প্রস্তুত করেন। কুষাণ মুদ্রার উপর ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা সমকালীন মুদ্রা ব্যবস্থার চরিত্র বুঝতে অনেকটাই সাহায্য করে। কুষাণরা যে স্বর্ণমুদ্রা চালু করেন তা সম্ভবত বীম কদফিসেস দ্বারা প্রবর্তিত হয়। কুষাণ স্বর্ণমুদ্রা যে রোমক স্বর্ণমুদ্রার আদলে ও প্রভাবে তৈরী হয় সে বিষয়ে সমর্থনযোগ্য প্রমাণ রয়েছে। আগেই বলা হয়েছে কুষাণ রাজারা রোমের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তুলতে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন (ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমাণ করেছেন যে কুষাণ সম্রাটরা রোমে বাণিজ্যিক দৌত্য প্রেরণ করেছিলেন)। বীম কদফিসেস-এর এক প্রকার স্বর্ণমুদ্রার ওজন সমকালীন রোমান স্বর্ণমুদ্রার ওজনের সঙ্গে তুলনীয়; এটি নিছক কাকতালীয় নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রয়োজনে এই পদক্ষেপ বোধহয় সচেতনভাবে নেওয়া হয়েছিল। রৌপ্য মুদ্রার ক্ষেত্রে কুষাণদের নীতি ও পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন প্রকারের। হুবিষ্কের সময়কার মথুরা লেখতে (কনিষ্কাব্দ ২৮=১০৬ খ্রীঃ) পুরাণ নামক যে রৌপ্য মুদ্রার উল্লেখ আছে তা বোধহয় সরকারী উদ্যোগে তৈরী হয়নি। ঐগুলি বেসরকারী বণিকদের দ্বারা প্রস্তুত হয়েছিল বলে মুখোপাধ্যায় মনে করেন। অন্যদিকে নিম্নসিন্ধু উপত্যকাতে যে কুষাণ রৌপ্য মুদ্রা দেখা যায় তা নিশ্চিতভাবে কুষাণদের রাজকীয় টাঁকশালে উৎকীর্ণ ও নির্মিত। এই জাতীয় মুদ্রাগুলি কেবলমাত্র নিম্নসিন্ধু এলাকাতেই প্রচলিত ছিল। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় গ্রেশামের তত্ত্ব ব্যবহার করে প্রমাণ করতে প্রয়াসী হয়েছেন নিম্নসিন্ধু উপত্যকায় রৌপ্য মুদ্রার নির্মাণ ও প্রচলনে কুষাণদের হস্তক্ষেপ জরুরী ছিল। তাঁর মতে বীম কদফিসেসের রাজত্বের বেশ কিছু আগে ও পহ্লববংশীয় দ্বিতীয় অজ-র মৃত্যুর পর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ও সিন্ধু উপত্যকায় প্রচলিত রৌপ্য মুদ্রায় ঢালাও খাদ মেশানো হতে থাকে। তার ফলে রৌপ্য মুদ্রার প্রকৃত মূল্য ভয়াবহভাবে কমতে থাকে। এমতাবস্থায় অধিকতর খাঁটি রৌপ্য মুদ্রাগুলিকে গুপ্তধন হিসেবে সঞ্চিত রাখার প্রবণতা বেড়ে যায়; তার ফলে বাজারে অবিশুদ্ধ রৌপ্য মুদ্রারই প্রাধান্য চলতে থাকে। গ্রেশামের তত্ত্বে এমন অবস্থায় অধিকতর বিশুদ্ধ মুদ্রা অপেক্ষাকৃত কম বিশুদ্ধ মুদ্রার দ্বারা বাজার থেকে বিতাড়িত হয়। অথচ রোমের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য নিম্ন সিন্ধু উপত্যকার ভূমিকা ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ; মুদ্রাব্যবস্থায় এহেন নৈরাজ্যসুলভ অবস্থা কখনওই বৈদেশিক বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলে না। ফলে মুদ্রামান ঠিক রাখার উদ্দেশ্যে ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের খাতিরে কুষাণরা নিম্ন সিন্ধু উপত্যকার ক্ষেত্রে (অর্থাৎ একটি সীমিত এলাকায়) এক নির্দিষ্ট মুদ্রানীতি নেন। স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার ব্যবহার হয়তো দূরপাল্লার ও আন্তর্জাতিক লেনদেনের পক্ষে অধিকতর প্রয়োজনীয় ছিল। দৈনন্দিন ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য তাম্র মুদ্রাই ছিল প্রশস্ত। কুষাণদের তাম্র মুদ্রাও প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গিয়েছে। এগুলি পাশ্চাত্যের দ্রাখমা মুদ্রার আদলে তৈরী। কুষাণ তাম্র মুদ্রাগুলির তিন প্রকার ওজন ছিল ১৭ গ্রাম; ৮-৮.৫ গ্রাম ও ৪-৫ গ্রাম। কুষাণ মুদ্রা কেবলমাত্র কুষাণ অধিকৃত এলাকাতেই পাওয়া গিয়েছে তা নয়; কুষাণ সাম্রাজ্যের বাইরে ভরতে ও বহির্ভারতে কুষাণ মুদ্রার সন্ধান পাওয়া যায়। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ইথিওপিয়াতে কুষাণ স্বর্ণ মুদ্রা ভাণ্ডারের অস্তিত্বের কথা জানিয়েছেন। এই ঘটনা দ্বারা কুষাণ স্বর্ণমুদ্রার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গুরুত্ব বোঝা যায়। রোমক মুদ্রার সঙ্গে সাদৃশ্যের কথা ইতিপূর্বে আলোচিত। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতে নীরোর রাজত্বের সময় থেকে রোমক মুদ্রা ব্যবস্থায় পরিবর্ত্তন আসে—রোমের মুদ্রার ওজন কমানো হয়, কিন্তু ধাতব বিশুদ্ধি বজায় রাখা হয়। হুবিষ্কের সময় থেকে কুষাণ মুদ্রার ক্ষেত্রেও বদল দেখা যায়: কুষাণরা মুদ্রার ওজন অবিকৃত রাখেন কিন্তু মুদ্রায় খাদের পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। ফলে কুষাণ ও রোমক মুদ্রা ব্যবস্থায় সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও একটি প্রধান পার্থক্য ছিল। এই কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে রোমের মুদ্রার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পাল্লা দেবার ক্ষমতা কুষাণ মুদ্রার ছিল না।
রোমের সঙ্গে বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান প্রমাণ ভারতের নানা স্থানে রোমক মুদ্রার আবিষ্কার। স্যার মটির্মার হুইলার পাঁচের দশকে ভারতে আটষট্টিটি রোমক মুদ্রাভাণ্ডারের তালিকা করেছিলেন ( এই মুদ্রাগুলি মূলত খ্রীঃ প্রথম শতাব্দীর), তার মধ্যে সাতান্নটিই বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত। সাম্প্রতিক আর একটি প্রতিবেদনে ১২৯টি রোমক মুদ্রা ভাণ্ডারের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে; দ্বিতীয় তালিকাতেও দক্ষিণ ভারত থেকে বেশী রোমক মুদ্রা ভাণ্ডারের উপস্থিতি নজরে পড়ে। মৌসুমী বায়ুর উন্নততর ব্যবহারের ফলে পাশ্চাত্যের জাহাজগুলির পক্ষে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে দক্ষিণ ভারতে পাড়ি দেওয়া সহজসাধ্য হয়ে ওঠে। তাই দক্ষিণ ভারতীয় বন্দরগুলি রোমের সঙ্গে সমুদ্র বাণিজ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই দিক থেকে বিচার করলে দক্ষিণ ভারতে ও দাক্ষিণাত্যে রোমক মুদ্রাভাণ্ডারের আধিক্য থাকা স্বাভাবিক।
দাক্ষিণাত্যের সাতবাহন রাজারা ও শক ক্ষত্রপরাও নিয়মিত মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন করেন। সাতবাহনরা রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। সাতবাহন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে আঞ্চলিক প্রয়োজনে মুদ্রার প্রকার ভেদ দেখা যায়। দাক্ষিণাত্যের পূর্বাংশে সাতবাহনরা সীসা ও পোটিন মুদ্রা চালু করেছিলেন। আন্ধ্র ও করমণ্ডল উপকূলের বন্দরগুলি এই সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশ নিতে থাকায় ঐ অঞ্চলে মুদ্রাশ্রিত অর্থনীতির সম্প্রসারণ ঘটে।
আলোচ্য আমলের মুদ্রাগুলির মধ্যে স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রাগুলি হয়তো সবচেয়ে বেশী মূল্যবান ও দৃষ্টি আকর্ষক; কিন্তু তাম্র মুদ্রার ব্যাপক প্রচলন এই যুগের মুদ্রা ব্যবহার অন্যতম প্রধান লক্ষণ। তাম্রমুদ্রা সাধারণত দৈনন্দিন কেনাবেচার পক্ষে উপযোগী অতএব বোঝা যায় যে দূরপাল্লার বাণিজ্যই শুধু নয়, দৈনন্দিন বাণিজ্যেও মুদ্রাশ্রিত অর্থনীতি যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। কুষাণ ও সাতবাহন রাজারা ছাড়াও মধ্যভারতের নাগবংশীয়, কৌশাম্বী, মথুরা, অবন্তী ও অহিচ্ছত্রের মিত্রবংশীয় রাজারা বহু তাম্র মুদ্রা প্রস্তুত করিয়েছিলেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মধ্য ভারতের অনেকগুলি অরাজতান্ত্রিক কৌম সংগঠনও (যথা যৌধেয়, মালব, অর্জুনায়ন প্রভৃতি) তাম্র মুদ্রা প্রচলন করে। মুদ্রা ব্যবস্থা যে রাজতন্ত্রের সীমা ছাড়িয়ে কৌম সংগঠন দ্বারা শাসিত ভূখণ্ডেও প্রসারিত হয়, এই নিদর্শন থেকে তা অবিসংবাদিতভাবে প্রমাণিত হয়।
বাণিজ্যের ইতিহাসের দিক দিয়ে এই যুগের তাৎপর্য অনস্বীকার্য; লেনদেনের পরিমাণ যে দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে যে বহুল পরিমাণে বাড়ল তাই নয়, এই প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশের বাণিজ্যিক ক্রিয়া আন্তর্জাতিক চরিত্র লাভ করল। আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরের বাণিজ্য লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যিক লেনদেনের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত হয়ে পড়েছিল।
॥ ৬ ॥
কৃষি অর্থনীতির বিকাশের দরুন উদ্বৃত্ত উৎপাদন কারিগর ও ব্যবসায়ীকে খাদ্যোৎপাদন ব্যবস্থা থেকে বিযুক্ত করেছিল; তার ফলে কারিগর ও ব্যবসায়ী আপন আপন বৃত্তিতে সর্বক্ষণের জন্য নিযুক্ত থাকতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিতে নগরায়নের অবস্থা কি রকম ছিল, তার আলোচনা না করলে অর্থনৈতিক ইতিহাসের বর্তমান চর্চা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। নগরজীবন শেষ পর্যন্ত এমন এক জায়গাতেই বিকশিত হয় যেখানে অর্থনীতি নিছক কৃষি অর্থনীতিতে আবদ্ধ নেই। ব্যবসা বাণিজ্য, কারিগরী শিল্পের চর্চা ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র হিসেবেই নগরকে গ্রামের থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। খ্রীঃ পূঃ ২০০ থেকে খ্রীঃ ২০০ পর্যন্ত সময়সীমাতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল নগরায়নের পক্ষে বিশেষ অনুকূল। প্রকৃত পক্ষে আদি ঐতিহাসিক যুগের নগরায়নের শিখর পর্ব এই সময়েই দৃষ্টিগোচর হয়। প্রাক খ্রীঃ পূঃ ২০০ আমলে নগরায়ন মূলত আর্যাবর্ত বা উত্তর ভারতের পরিস্থিতিতেই দেখা দিয়েছিল; কিন্তু খ্রীঃ পূঃ ২০০ থেকে কালক্রমে নগরায়ন সর্বভারতীয় চেহারা নেয়। সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই আমলে সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে থাকা সব নগরগুলির প্রতি সমান মনোযোগ ও সুবিচার করা কঠিন। তাই বিশেষ উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ নগরগুলির আলোচনার মাধ্যমে নগরায়নের মূল লক্ষণগুলি বুঝবার চেষ্টা করাই শ্রেয়।
ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে তক্ষশিলা নগর হিসেবে প্রভূত প্রসিদ্ধি লাভ করে। খ্রীঃ পূঃ ২০০ থেকে ২০০ খ্রী পর্যন্ত সাংস্কৃতিক জীবনের পরিচয় সিরকাপের ঢিবি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছে। প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে নির্দ্ধিধায় বলা চলে নগরজীবনের সমৃদ্ধি আগের পর্বের ভির ঢিবির নিদর্শনের তুলনায় অনেক বেশী। ইন্দো-গ্রিক শাসকদের হাতে তক্ষশিলার নগরায়ন ত্বরান্বিত হয়, তবে ইন্দো-পার্থীয় শাসকদের রাজত্বকালে তক্ষশিলায় পাকা প্রাকার তোলা হয়েছিল। সিরকাপের প্রত্নবস্তু অবিসংবাদিতভাবে প্রমাণ করে যে তক্ষশিলায় নগরায়নে সুচিন্তিত ব্যবস্থাপনার চিহ্ন স্পষ্ট। শহরের উত্তর প্রান্ত থেকে লম্বালম্বি প্রধান সড়কটি তৈরী হয়, এই সড়কের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র সরণী ও ক্ষুদ্রতর গলিগুলি যুক্ত ছিল। বাসগৃহগুলি রাস্তার দুপাশে যেভাবে বিন্যস্ত তাতে পরিকল্পনার ছাপ অনস্বীকার্য। নগরজীবনে এই জাতীয় পরিকল্পিত রূপ ভারতীয় উপমহাদেশে বিরল, বরং তা গ্রিক ও হেলেনীয় সংস্কৃতিতে নিয়মিত ঘটনা। অমলানন্দ ঘোষ তাই যথার্থই মনে করেন সিরকাপের উৎখননে তক্ষশিলার যে রূপ উদঘাটিত তার চিন্তাধারাও বিদেশী, উৎসও অনেকাংশে বিদেশী। তাই এই পর্বে তক্ষশিলার নগরবিন্যাসকে প্রাচীন ভারতীয় শহরের প্রতিনিধি হিসেবে ভাবা দুষ্কর। অহিচ্ছত্র নগরীতে ২০০ খ্রীঃ নাগাদ নতুন একটি পাকা রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল। বিহারের উত্তর-পূর্বাংশে লিচ্ছবিদের নগর বৈশালীতে খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতক ও খ্ৰীষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যে অন্তত তিনবার প্রাকার নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ হয়। ওড়িষ্যাতে শিশুপালগড়ের প্রত্নক্ষেত্রে নগরায়নের আভাস খ্রীঃ পূঃ ৩০০ নাগাদ থেকে চোখে পড়ে। তবে খ্রীঃ পূঃ ২০০-র পর থেকে তার বিকাশ দ্রুতগতিতে ঘটতে থাকে। এখানে খ্রীঃ পূঃ ২০০ থেকে ১০০ খ্রীঃ পূঃ-এর মধ্যে এক বিশাল নগরপ্রাকার তোলা হয়েছিল, এই প্রাকার প্রথমে কাদামাটি দিয়ে তৈরী হলেও পরে তাতে পাকা ইটের গাঁথনি লাগান হয়। শিশুপালগড়ের নগরায়নের সবচেয়ে চমকপ্রদ বস্তুটি হল একটি বৃহৎ ও অলঙ্করণযুক্ত তোরণদ্বার।
উত্তর ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর হিসেবে মথুরার উদ্ভব এই আমলেরই ঘটনা। মথুরা ও মথুরার নিকটবর্ত্তী সঙ্খ-এ উৎখনন থেকে পাওয়া পুরা সম্পদ, বহু লেখমালার তথ্য ও সমকালীন সাহিত্য থেকে সাক্ষ্যপ্রমাণ যোগাড় করে মথুরানগরীর বিকাশের বিশ্বস্ত আলেখ্যটি ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে শক পহ্লব ও কুষাণ রাজাদের আমলে মথুরার উৎকর্ষ সর্বাধিক হয়েছিল। যেহেতু এই দুই বিদেশী শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের যোগ ছিল, তাই গঙ্গা যমুনা দোয়াবে অবস্থিত মথুরা নগরীও উত্তর-পশ্চিমের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। সঙ্খ-এ ২৩ ও ২৪তম স্তর থেকে যে পুরাবস্তু পাওয়া গিয়েছে তা বিচার করলে মনে হয় আগের তুলনায় বাড়ীগুলি কিছুটা যেন এলোমেলো ভাবে তোলা হয়েছে এবং রাস্তাঘাটগুলি অপরিসর হয়ে পড়েছে। এই সঙ্গে রাস্তার মোড়ের বাড়ির সামনে পাথরের একটি অংশ বার করে দেবার ব্যবস্থাটি অনুধাবন করতে হবে। এই ব্যবস্থা দ্বারা যানবাহন মোড় ঘোরার সময় যাতে বাড়ীগুলির ক্ষতি না ঘটে, তা নিশ্চিত হত। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় যথার্থই শনাক্ত করেছেন যে এই ঘটনা নগরে যান চলাচলে বৃদ্ধি তথা ব্যবসা বাণিজ্যে বৃদ্ধির ইঙ্গিতবহ। সঙ্খ-এ ১৬শ স্তরে (কুষাণ অধিকারের কাল) নগরজীবনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও পরিণত লক্ষণগুলি প্রকট। বসতবাড়ীগুলিতে যেমন কাদামাটী ব্যবহৃত হয়েছে তেমনই পাকা, পোড়ানো ইঁটও লাগানো হয়েছে। মথুরার প্রাকার সংস্কার ও বর্দ্ধনের পরিষ্কার লক্ষণগুলিও আমাদের নজর এড়ায় না। নগরের বাইরে চারপাশে প্রাকার ছাড়াও, শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি অঞ্চল প্রাচীর দিয়ে বিচ্ছিন্ন করা হয়। এই স্থানটি সম্ভবত প্রশাসক গোষ্ঠীর বসবাস ও ক্রিয়াকলাপের জন্য নির্দিষ্ট ছিল; তাই বাড়তি সুরক্ষার দরকার হয়। খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকে অঙ্গুত্তরনিকায়তে মথুরার বর্ণনায় তাচ্ছিল্যের ভাব স্পষ্ট: মথুরার রাস্তাঘাট ধুলোয় ভর্তি ছিল, যাতায়াত ব্যবস্থাও নিম্নমানের এবং আর্থিক অবস্থাও এতই সাধারণ যে ভিক্ষাও দুর্লভ। সেই মথুরা নগরীর রূপ খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতকে ললিতবিস্তরের বর্ণনায় একেবারে অন্যরকম: মথুরা নগরী আকারে বেড়েছে, সমৃদ্ধি লাভ করেছে, ক্ষেমময়ী নগরীটিতে বহুমানুষের বাস এবং ভিক্ষা সেখানে অঢেল (‘ইয়ং মথুরা নগরী, ঋদ্ধা চ স্ফীতা চ ক্ষেমাচ সুভিক্ষাচাকীর্ণাবহুজনমানুষ্য চ’)। উত্তর ভারতের অপর যে অংশে নগরায়নের বিকাশ বিশেষভাবে লক্ষ করার মত, তা হল বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ। খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতক নাগাদ থেকে উত্তর ভারতীয় নগরায়নের অভিঘাত প্রাচীন বাংলাতেও পড়ল। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় অনুসন্ধান চালিয়ে অনেকগুলি প্রত্নস্থল উদ্ধার করা হয়েছে, যার অধিকাংশই আদি ঐতিহাসিক পর্বের। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নক্ষেত্রটির নাম চন্দ্রকেতুগড়। কলকাতা থেকে ২৩ মাইল উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই এলাকায় উৎখননও করা হয়েছে। প্রত্নস্থলটির চারপাশে উঁচু মাটীর প্রাকার, যা এলাকাটিকে প্রথম দর্শনেই নগর হিসেবে চিহ্নিত করে দেয়। প্রত্নক্ষেত্রের বৃহৎ আয়তন থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে প্রাচীন শহরটি আকারে বড় ছিল। চন্দ্রকেতুগড়ের প্রাচীনতম স্তরে উত্তর ভারতের উজ্জ্বল কালো মৃৎপাত্র পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু খ্রীঃ প্রথম শতকের পর থেকেই চন্দ্রকেতুগড় নগরসুলভ আয়তন ও চরিত্র লাভ করে। যাকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা সাধারণত ‘কুষাণ আমল’ বলেন (এখানে খেয়াল রাখা দরকার, প্রাচীন বাংলায় কুষাণদের রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের কোনও প্রমাণ নেই), সেই স্তর থেকে যে পুরাবস্তু পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে আছে বহু মৃৎপাত্র ও তার ভাঙা টুকরো, পানপাত্র, পোড়ামাটীর মূর্তি, ছাঁচে ঢালাই করা তাম্রমুদ্রা প্রভৃতি। পানপাত্রগুলি নগরজীবনে বিলাসব্যসনের পরিচয় দেয়। পোড়ামাটীর ভাস্কর্যগুলিতেও শৌখিন ও সম্ভ্রান্ত গোষ্ঠীর পছন্দসই শিল্পকলার ধারণা করা সম্ভব।
দক্ষিণবঙ্গ ছাড়িয়ে নগরায়নের নিদর্শন এখন জানা গিয়েছে সদ্য আবিষ্কৃত মঙ্গলকোটের (বর্ধমান শহর থেকে ৩৫ কিমি দূরে অজয় ও কুনুর নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত) প্রত্নক্ষেত্রে, যেখানে উৎখনন এখনও চলছে। এই প্রত্নক্ষেত্রের উৎখনন সম্পূর্ণ হলে প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের বহু অজানা তথ্য উদঘাটিত হবে। এতাবৎ পাওয়া প্রত্নবস্তু থেকে বোঝা যায় যে মঙ্গলকোটের চতুর্থ স্তরে (খ্রষ্টীয় প্রথম তিন শতক) নগরায়নের লক্ষণগুলি প্রকট হচ্ছে। প্রচুর পোড়ামাটীর মূর্তি, মূল্যবান পাথরের মালা, নানা নকশায় অলঙ্কৃত লালরঙের মৃৎপাত্র (আতরদান, পানপাত্র ইত্যাদি), ঢালাই করা মুদ্রা ও নামাঙ্কিত সীলমোহর নিঃসন্দেহে নগরজীবনের ইঙ্গিত দেয়। এছাড়াও লক্ষ্যণীয় বাড়ীঘর তৈরিতে ইঁটের ব্যাপক ব্যবহার, ইঁটের তৈরি কুয়ো, বাড়ীর লাগোয়া পাতকুয়ো। অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে প্রাচীন বাংলায় এই পর্বের নগরগুলিতে উত্তর ভারতীয় নগরায়নের আদল বা প্রভাব রয়েছে।
উত্তর ভারতের মত দাক্ষিণাত্যেও অনেকগুলি সমৃদ্ধ নগর দেখা দেয়। তার মধ্যে নেভাসা, টের ও সাতানিকোটাতে উৎখননের ফলে নগরজীবনের চাক্ষুষ রূপটি বোঝা যায়। এর মধ্যে কুর্ণুল অঞ্চলে অবস্থিত সাতবাহন আমলের নগর সাতানিকোটার কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। প্রাকারবেষ্টিত নগরীটির অবস্থান ছিল তুঙ্গভদ্রা নদীর ডান তীরে। পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের দ্বারা প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে, নগরটি খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতক থেকে খ্রীঃ তৃতীয় শতক পর্যন্ত সমৃদ্ধশালী অবস্থায় ছিল। নগর পরিকল্পনায় যে বৈশিষ্ট্যটি নজরে পড়ে, তা হল সাতানিকোটায় নগর প্রাকার ছাড়াও একটি পরিখা ছিল। নগর প্রাকারে পোড়া ইঁটের ব্যবহারও হয়েছে এবং নগরের দক্ষিণ দিকে একটি জাঁকালো তোরণদ্বার ছিল। নগরে দামী পুঁতির অলঙ্কারশিল্প বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করেছিল। দাক্ষিণাত্যে নগরায়নের বিকাশের অন্যতম প্রমাণ লেখমালায় নগর, নিগম প্রভৃতি শব্দের বহুলতর প্রয়োগ। নাসিকে পাওয়া শক ও সাতবাহন লেখমালায় নগর নিগমের উল্লেখ আছে। শক মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামনের বহুবিধ কৃতিত্বের অন্যতম ঘটনা নগর নিগমগুলি তাঁর শাসনে শ্বাপদ ও দস্যুর উৎপীড়ন থেকে সুরক্ষিত হত। সাতবাহন সম্রাট গৌতমীপুত্র সাতকর্ণির আমলে সাতবাহনদের ক্ষমতা পশ্চিম ও মধ্য দাক্ষিণাত্য থেকে পূর্ব দাক্ষিণাত্যে ছড়াবার ফলে নগরায়নের প্রসার ঐ অঞ্চলেও দ্রুত ঘটতে থাকে। কৃষ্ণা বদ্বীপ অঞ্চলে অমরাবতী, ভোট্টিপ্রোলু, শালিহুণ্ডম, নাগার্জুনকোণ্ডা প্রভৃতি অঞ্চলে উৎখননের ফলে নগরজীবনের অস্তিত্ব পরিষ্কারভাবে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এই প্রত্নক্ষেত্রগুলির নগরসুলভ লক্ষণ তর্কাতীত। পেরিপ্লাসের বিবরণ, টলেমীর ভূগোল, স্থানীয় লেখমালা ও মুদ্রার সাক্ষ্য এই অঞ্চলে কৃষি ও বাণিজ্যের সমৃদ্ধির পরিচয় দেয়। এই অঞ্চলের বন্দরের উল্লেখ ও আলোচনা ইতিপূর্বেই করা হয়েছে। ধান্যকটক নগরটি কৃষ্ণা নদীর উপর অবস্থিত; প্রকৃতপক্ষে এই নগর পর্যন্ত কৃষ্ণার নাব্যতা বজায় ছিল। কৃষ্ণার নাব্য খাতটির সঙ্গে ধান্যকটকের সংযোগেরও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। বণিক ও বণিকদের সংগঠনের উপস্থিতির উল্লেখ আছে স্থানীয় লেখমালায়। নাগার্জুনকোণ্ডা নগরটির সুরক্ষার ব্যবস্থা প্রকৃতিই করেছিলেন; তার তিন দিকে ছিল পাহাড়। শহরের অভ্যন্তরে প্রাকার বেষ্টিত একটি অঞ্চলে বোধহয় রাজার নিবাস ছিল। খেয়াল রাখা দরকার, নাগার্জুনকোণ্ডা ছিল ইক্ষ্বাকু রাজধানী (২২৫-৩৫০ খ্রী)। বসতবাড়ীগুলি নগরের পূর্বাংশেই বেশী তৈরি করা হয়েছিল। নগরবিন্যাসের এক উল্লেখনীয় দিক হল এখানকার পথঘাট। প্রশস্ত রাস্তা, সরু গলি, তিন বা চার মাথার মোড়—সবই এই নগরীতে পাওয়া গিয়েছে। নগরটি বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কেন্দ্র হিসেবেও খ্যাতি লাভ করে। নগরের অন্যতম প্রধান চমকপ্রদ বিষয় ছিল খোলা আকাশের নীচে এক বিশাল প্রেক্ষাগৃহ—যা রোমান এমফিথিয়েটারের কথা মনে পড়িয়ে দেয়—যেখানে কমপক্ষে হাজার জন দর্শকের বসার ব্যবস্থা ছিল।
নগরায়নের প্রসার সুদূর দক্ষিণ ভারতেও দেখা যায়। সমকালীন সঙ্গম সাহিত্যে অনেকগুলি নগরের বর্ণনা আছে। তবে সে বর্ণনা অনেক ক্ষেত্রেই প্রথাগত; তাই তার সারবত্তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। তার উপর প্রত্নতাত্ত্বিকরা উৎখনন চালিয়ে নগর জীবনের যে চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়েছেন তাতে সাহিত্যগত বর্ণনার অনুরূপ সমৃদ্ধি দেখা যায় না। তবে মাদুরা ও কাবেরীপট্টিনম-এর মত নগরের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মাদুরা নগরীর বিশদ বর্ণনা আছে তামিল কাব্য মাদুরাইকাঞ্চীতে। আর কাবেরীপট্টিনমের বর্ণনা পাওয়া যাবে পাড্ডিনাপালাই ও তামিল মহাকাব্য শিলপ্পাদিকারম-এ। পাড্ডিনাপালাই-এর কিছু পরে শিলপ্পাদিকারম রচিত হয়। মহাকাব্যটি পরবর্তীকালের রচনা হওয়ায় কাবেরীপট্টিনম নগরটিকে আরও সমৃদ্ধরূপে দেখানো হয়েছে। বোঝা যায়, কাবেরীপট্টিনম নগরটি ক্রমশই বিকাশ লাভ করছে। শিলপ্পাদিকারমে নগরের বিভিন্ন অংশে বণিক, কারিগর, মৎস্যজীবীদের বাসস্থানের কথা বলা হয়েছে। বিদেশী যবন বণিকদের বসবাসের জন্য পৃথক অঞ্চল নির্দিষ্ট ছিল। আগেই বলা হয়েছে এই নগর বন্দর হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। সমুদ্র বাণিজ্যের দিক থেকে এই বন্দর নগরটির গুরুত্বের কথা সম্যক অনুধাবন করেই এখানে বাতিঘর বসানো হয়েছিল। উৎখননের ফলে বন্দরের নিকটস্থ গুদাম ঘরের অস্তিত্বও জানা গিয়েছে। মহাকাব্যে কাবেরীপট্টিনম নগরীতে বহু স্নানাগার ও জলাশয়ের বর্ণনা আছে। এই বর্ণনা অবাস্তব নয়। উৎখনন থেকে ইটের তৈরি অর্ধ গোলাকৃতি ইমারত পাওয়া গিয়েছে যেখানে জলাশয় ছিল; জলাশয়ে জল আসত কাবেরী নদী থেকে একটি প্রণালীর মারফৎ। নাগরিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধানের ব্যবস্থা কাবেরীপট্টিনমের নগর সুলভ লক্ষণের পরিচয় বহন করে। আদি ঐতিহাসিক পর্বে খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে নগরায়নের যে প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছিল, তার সর্বভারতীয় রূপ, ব্যাপক প্রসার ও সন্দেহাতীত সমৃদ্ধি ঘটে খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রীঃ ২০০ পর্যন্ত কালসীমায় | অর্থনৈতিক জীবনের নানা দিকের মতই নগরায়নের দৃষ্টিকোণ থেকেও আলোচ্য যুগটির গুরুত্ব অসামান্য।
॥ ৭ ॥
খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতকের প্রথম পাদ থেকে খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতক পর্যন্ত এই কাল পর্বে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নেই। কৃষি অর্থনীতি সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল; বিশেষত দাক্ষিণাত্যে ও দক্ষিণ ভারতে স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজের পত্তন কেবলমাত্র আর্থিক প্রগতি ঘটাল না, তার ফলে বিন্ধ্যের দক্ষিণভাগে রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশের পক্ষে অনুকূল পরিবেশের জন্ম হল। শিল্পক্ষেত্রে ধাতুর ক্রমবর্ধমান ব্যবহার, শিল্পোৎপাদনে বৈচিত্র্য, ‘শ্রেণী’ জাতীয় শিল্প সংগঠনগুলির উত্তরোত্তর গুরুত্ববৃদ্ধি এই যুগের অর্থনৈতিক ইতিহাসের এক বিশেষ লক্ষণ। এই পর্বেই ‘শ্রেণী’গুলি কার্যত ব্যাঙ্কের ভূমিকা প্রথম পালন করে। দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন সাম্রাজ্যে গিল্ডগুলির সঙ্গে বৌদ্ধ বিহারগুলির স্থানগত নৈকট্য যেমন দেখা যায়, তেমনই উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্কও হিমাংশুপ্রভা রায় তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণায় নির্দেশ করেছেন। বাণিজ্যের অগ্রগতি এই সাড়ে চারশ বছরে উপমহাদেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে বহির্ভারতে—বিশেষত রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে—আন্তর্জাতিক সমুদ্রবাণিজ্য দ্বারা হয়। কারিগরী ও বাণিজ্যিক উন্নয়নের ফলে নগরায়নও সর্বভারতীয় চরিত্র লাভ করে। তবে কৃষিক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের ক্ষমতা ব্যতিরেকে নগরায়ন এত দ্রুত সমগ্র উপমহাদেশে ছড়াতে পারত না। এই কারণে হরিবিষ্ণু সরকার এই পর্বের নগরগুলিকে কৃষিনির্ভর (‘অ্যাগ্রো-সিটি’) বলে মনে করেন।
নগরায়নের বিকাশ সহ অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতির ফলে এযুগে আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা জটিলতর হয়ে ওঠে। আলোচ্য যুগটিতে বহু বিদেশী ভারতে এসেছিলেন—যুদ্ধ, বাণিজ্য বা ভাগ্যপরীক্ষা যে উদ্দেশ্যই হোক না কেন। এই সব বিদেশী জাতির ক্রমশই ভারতীয় সমাজে অন্তর্ভুক্তি ঘটে, কার্যত তাঁরা ভারতীয় জনজীবনে এমনভাবে মিশে গিয়েছিলেন যে, তাঁদের বিদেশী বলে শনাক্ত করাই হয়তো কঠিন। কিন্তু এই বিদেশীরা ভারতীয় জাতিবর্ণ ব্যবস্থায় প্রথমে ব্রাত্য বা অবনমিত বলে আখ্যাত; পরে তাঁরা ‘শূদ্র’ বলে আখ্যাত। কিন্তু কালক্রমে অনেক বিদেশীই যখন রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হন ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি ভোগ করতে থাকেন তখন সম্ভবত ধর্ম-শাস্ত্রকারগণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিশ্র জাতি হিসেবে তাঁদের ভারতীয় বর্ণব্যবস্থার আওতায় নিয়ে এসেছিলেন। এই দিক দিয়ে বিচার করলে ভারতীয় জাতি-বর্ণব্যবস্থায় নমনীয়তার লক্ষণই ফুটে ওঠে, যে নমনীয়তার প্রতি শাস্ত্রকারদের অনীহা সুবিদিত। ধর্মশাস্ত্রে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার কড়াকড়ি সংক্রান্ত যে বিধিনিষেধ দেখা যায়, তার বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ আছে। এই আমলের কারিগররা প্রায় কখনওই দানপত্রগুলিতে তাঁদের জাতি বা বর্ণগত পরিচয় দেন না, প্রায় সর্বত্রই তাঁদের বৃত্তি বা পেশাগত পরিচয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর থেকে মনে হয় বৃত্তিগত পরিচয় জাতি পরিচয়ের চেয়ে কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এই আমলে যেহেতু কারিগরী বৃত্তিগুলির ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে তাই ঐ বৃত্তিগুলিতে নিযুক্ত ব্যক্তিরা তাঁদের পেশার কথা খোলাখুলি ঘোষণা করবেন, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। সমাজ ব্যবস্থায় রক্ষণশীলতা তুলনামূলকভাবে কম: তার একটি দৃষ্টান্ত মথুরার একটি লেখতে দেখা যায়। এই লেখতে মণিকার ও লোহবণিজ—এই দুই বৃত্তিধারী পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের কথা জানা যায়। এই জাতীয় বিবাহ সাধারণ ভাবে ধর্মশাস্ত্রে অনুমোদিত নয়; কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এই জাতীয় আন্তর্বিবাহ অজানা ছিল না। মথুরারই আর একটি দান লেখতে একজন মহিলা দাতা নিজেকে বারাঙ্গনা ঘোষণা করতে দ্বিধা বা সংকোচ বোধ করেননি: তাঁর মা-ও যে দেহোপজীবিনীই ছিলেন এই তথ্যও লেখটিতে বলা আছে। অর্থাৎ বারাঙ্গনা বৃত্তি নেবার জন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দান করতে বা দানজনিত পুণ্যার্জনে কোনও বাধা দেখা যায় না। নগরায়নের প্রসার সমাজে উদারতা ও নমনীয়তা নিয়ে এসেছিল। কারণ নগরে যে বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক ক্রিয়া কলাপ চলে, তার দরুন শহর এলাকায় বহু অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক ও ভাব বিনিময় ঘটা স্বাভাবিক। বৈচিত্র্যের এই পরিমণ্ডল গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতাকে হ্রাস করে, সমাজ ও অর্থনীতিকে সজীব ও প্রাণবন্ত করে তোলে।
মুদ্রাশিত অর্থনীতি সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় অর্থের মহিমা ও গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতনতাও বোধ হয় বেড়েছিল। তাই চরক সংহিতায় বলা হয়েছে জীবনলিপ্সা, ধনলিপ্সা ও ভবিষ্যৎ জীবনের সমৃদ্ধির প্রতি তীব্র অনুরাগ সমস্ত মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। চরক নির্দ্বিধায় ঘোষণা করেছেন যে অসুস্থ ব্যক্তিকে সুস্থ করে তুললে যে প্রীতি ও শুভেচ্ছা চিকিৎসকের উপর বর্ষিত হয়, তাই চিকিৎসকের একমাত্র কাম্য নয়; তিনি রাজার (ঈশ্বরাঃ) অনুগ্রহ ও বিত্তবানের (বসুমন্তাঃ) পৃষ্ঠপোষকতা পেতেও সমান আগ্রহী। অর্থের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে এত স্পষ্ট উক্তি মুদ্রাশ্রিত অর্থনীতিরই অবদান। অতএব অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে আর্থিক সমৃদ্ধি সামাজিক প্রতিপত্তি আনতে সহায়তা করত। জৈন গ্রন্থ অঙ্গবিজ্জায় (খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতক) সামাজিক বিভাগের আলোচনার উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এই গ্রন্থে একবার বলা হয়েছে সমাজ চতুর্বর্ণে বিভক্ত (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র)। তারপর বলা হয়েছে যে সামাজিক অবস্থান জন্ম ও বৃত্তি দুই-এর দ্বারাই চিহ্নিত (যেমন যিনি জন্মে ব্রাহ্মণ, তিনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের বৃত্তি নিতে পারেন)। অন্যত্র দেখা যায় যে সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত, ‘আর্য’ ও ‘ম্লেচ্ছ’। চতুর্থ সংজ্ঞা অনুযায়ী ঐ একই গ্রন্থে বলা হয়েছে সমাজে দুই প্রধান ভাগ ‘আর্য’ বা সম্পন্ন গোষ্ঠী এবং ‘প্ৰেষ্য’ বা দাস/দরিদ্র গোষ্ঠী। এই শেষতম ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারণানুযায়ী নিম্ন জাতি সম্ভূত কোনও ব্যক্তি (যেমন শূদ্র) যথেষ্ট বিত্তবান হয়ে ‘আর্য’ বা সম্পন্ন গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, অন্যপক্ষে উচ্চবর্ণ-সঞ্জাতও (যেমন ব্রাহ্মণ) দারিদ্র্যের হেতু দাস/ভৃত্য/ ‘প্ৰেষ্য’ পর্যায়ে থাকতে পারেন। এই ধারণার মধ্যে সমাজকে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার চাইতে শ্রেণী ব্যবস্থায় বিভাজিত করার প্রবণতা দেখা যায়। কেবলমাত্র জন্মের দ্বারাই সামাজিক অবস্থান নির্ণীত হবে, ধর্মশাস্ত্রকারদের রক্ষণশীল এই গোঁড়া ধারণার পাশাপাশি শ্রেণী বিভাজনের ধারণা সামাজিক গতিময়তার ইঙ্গিত দেয়। জন্মের পাশাপাশি আর্থিক সমৃদ্ধি (বা তার অভাব) সামাজিক উত্থান পতনের মাপকাঠি হিসেবে এই আমলে বোধ হয় স্বীকৃত হয়েছিল। শিল্প ও বাণিজ্যের অগ্রগতির দরুন নগরায়নের যে বিকাশ ঘটে ও যা মুদ্রাশ্রয়ী অর্থনীতিকে মজবুত করে তোলে, তার ফলে সমাজে রক্ষণশীলতার জায়গায় অপেক্ষাকৃত নমনীয়, উদার সামাজিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।