ষষ্ঠ অধ্যায় – কুকিজাতির বিবরণ
বাঙ্গালার সীমান্তস্থিত পার্বত্য প্রদেশ সমূহে যে সকল অনাৰ্য্যজাতি বাস করে, তন্মধ্যে কুকিগণের ন্যায় হিংস্র মানব অতি বিরল। বঙ্গবাসীগণ ইহাদিগকে নরখাদক বলিয়া অবগত আছেন। যদিচ অধুনা ইহারা নরমাংশ ভক্ষণ করে না, কিন্তু ইহাদের নরহত্যা প্রবৃত্তি এরূপ প্রবল যে ॥৩৩৮॥ ইহাদিগের রাক্ষস আখ্যা প্রদান করিলে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হয় না।
আমাদের পার্শি ভ্রাতাগণ যেরূপ আমাদিগকে “হিন্দু” আখ্যা প্রদান করিয়াছেন, সেরূপ পূর্ববঙ্গবাসী বাঙ্গালিগণ এই রাক্ষসবৃত্তিপরায়ণ জাতিকে “কুকি” আখ্যা দ্বারা আখ্যাত করিয়াছেন। কাছাড়াবাসীগণ ইহাদিগকে “লুছাই” বলিত। ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণ কাছাড়ীদিগের নিকট “লুছাই” শব্দটি গ্রহণ করত তাহাকে “লুসাই” করিয়া ফেলিয়াছেন। প্রাচীন ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণের রিপোর্ট সমূহে “লুসাই” বা “লুছাই” শব্দ দৃষ্ট হয় না[১]।” কাছাড়ীগণ যে কুকি সম্প্রদায়কে লুছাই বলিত তাহাদের জাতীয় সাধারণ নাম “খছাক।”
পূর্বে ব্রহ্মরাজ্য পশ্চিমে ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম, উত্তরে প্রাচীন কাছাড় ও মিতাই ভূমি, দক্ষিণে আরাকান। ইহার মধ্যবর্ত্তী পার্বত্য প্রদেশই এই দুৰ্দ্দান্ত জাতির নিবাস ভূমি। ইহার পরিমাণ দশ সহস্র বর্গমাইলেরও অধিক। প্রাচীনকালে সমগ্র কুকিজাতি প্রবল বিক্রম ত্রিপুরেশ্বরদিগের অধীনতা নিগড়ে বদ্ধ ছিল। মুসলমান ও মগদিগের সহিত অবিশ্রান্ত কলহ করিয়া, বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন ত্রিপুরেশ্বরগণ দুর্বল হইয়া পড়িলেন, তখনই এই দুর্দান্ত জাতি মস্তকোত্তলনের ॥৩৩৯॥ সুযোগ প্রাপ্ত হইল। অধুনা কুকিগণমধ্যে কতকগুলি স্বাধীন, কতকগুলি ত্রিপুরা ও মণিপুরজাতির অধীন, অবশিষ্ট কুকিগণ ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের অধীনতা নিগড়ে বদ্ধ রহিয়াছে।
কুকিজাতি অনেকগুলি শ্রেণীতে বিভক্ত। শ্রেণীসমূহের সংখ্যা ও তাহার নাম অদ্যাপি বিশুদ্ধভাবে কোন লেখক সংগ্রহ করিতে পারেন নাই। আমরা শ্রেণী সমূহের নাম যাহা সংগ্রহ করিতে পারিয়াছি, তাহার তালিকা প্রকাশ করিলাম যথা : –
পইতু, পাইতে, ফুন, ফুনতেই, লেনতেই, রাংচন, রাংচিয়ে, বুরদইয়া, হালতেই, জংতেই, সওয়ালই, পওয়া, ধুন, অমড়ই, চোটলং, চন্লেল, পালই বেত্, বাতে, বলতে, বিয়েতে, খরেং, বাইফেই— ইত্যাদি। শ্রেণীসমূহের ভাষা মূলত এক। ত্রিপুরার ভুতপূর্ব মন্ত্রী ঠাকুর ধনঞ্জয় দেববর্মণ লিখিয়াছেন “মণিপুরী ভাষার সহিত কুকি ভাষায় ও শব্দের বিস্তর পার্থক্য থাকিলেও মণিপুরী ভাষার স্বর ও গঠনের কথঞ্চিৎ সৌসাদৃশ্য রহিয়াছে। কুকিদিগের উচ্চারিত ভাষাও কণ্ঠ, তালু, দন্ত্যোষ্ট ও মূর্দ্ধাভিঘাতজনিত সমস্ত বর্ণের উচ্চারণ আবশ্যক হয়, কিন্তু অধিকাংশ স্থলেই মূর্দ্ধণ্যবর্ণ উচ্চারণের ন্যায় উচ্চারিত হইয়া থাকে। কুকিদিগের ভাষার মাধুর্য্য কোমলতা এবং ওজস্বিতা প্রভৃতির পারিপাট্য আছে।” মিতাই জাতির সহিত যে কুকিদিগের নৈকট্য সম্পর্ক রহিয়াছে, তাহা পূর্বে ॥৩৪০। উল্লেখ করা হইয়াছে। সুতরাং এই দুই জাতির ভাষায় শব্দ ও উচ্চারণের সাদৃশ্য বিচিত্র নহে। কুকি ভাষা নিরক্ষর, কিন্তু ইহা বিস্তৃত এবং শ্রবণ মনোহর্ ভারতবর্ষীয় ভাষা সমূহের মধ্যে যেরূপ হিন্দী প্রধান, ইয়োরোপে যেরূপ ফরাসী ভাষার প্রাধান্য বাঙ্গালার পূর্বদিকস্থ পার্বত্য প্রদেশে তদ্রূপ ত্রিপুরা ভাষার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হইয়া থাকে। কাপ্তান লেউইন সাহেবও ইহা স্বীকার করিয়াছেন[২]।
কুকিগণ কিরাত বা লৌহিত্য বংশজ। কিন্তু অন্যান্য পার্বত্য জাতি হইতে ইহাদের আকৃতি কিয়ৎ পরিমাণে পৃথক দৃষ্ট হইতেছে। অন্যান্য পার্বত্য জাতি হইতে আহাদের বর্ণ কিঞ্চিত মলিন, কিন্তু ইহাদের নাসিকা উন্নত, ওষ্ঠ পাতল। তাতার বা মোঙ্গলীয়ান জাতি সাধারণের ন্যায় ইহাদের মুখমণ্ডল চাপা নহে। ইহার কারণ আমরা এরূপ স্থির করিয়াছি যে, বাঙ্গালি রমণীগণের সংযোগে এই জাতির আকৃতি ক্রমে পরিবর্তন হইয়া আসিতেছে[৩]। ইহাদিগের মধ্যে ঘন কৃষ্ণ শ্মশ্রু গুল্ফ বিরাজিত সুন্দর মুখ মণ্ডল দৃষ্ট হইয়া থাকে, তাহাদের প্রতিবেশী অন্য কোন জাতিতে তদ্রূপ পরিলক্ষিত হয় না। ॥৩৪১
“কুকিদিগের” একতা এবং সমাজ বন্ধন অতীব প্রশংসনীয়। কোন ব্যক্তি সামাজিক নিয়মের কোন অংশ উপেক্ষা করিলে, সমাজ তাহার উপর কঠিন শাসন প্রয়োগ করিয়া থাকে এবং সমাজের নিয়ম লঙ্ঘনকারী সেই শাসন সহ্য না করিয়া পারে না। প্রতি সম্প্রদায়ের রাজা; অথবা, প্রত্যেক বাড়ির প্রধান লোকই (সরদার) সেই সেই সমাজের অধিপতি। কিন্তু অধিপতি হইলেও সমাজের অপরাপর প্রধান প্রধান লোকের অজ্ঞাতেও অমতে কোন লোকের বা সমাজের ॥৩৪৩॥ কোন নিয়মের উপর নূতন নিয়ম প্রবর্তন বা পরিবর্তন করিতে পারে না। এজন্য কুকিদিগের সামাজিক বন্ধন নিতান্ত দৃঢ় রহিয়াছে। বস্তুত সমাজ সম্পৰ্কীয় কোন বিষয়ের পরিবর্ত্তন কি সামাজিক কোন ব্যক্তির উপর সমাজ সম্পৰ্কীয় কোন শাসন প্রয়োগ করিতে হইলেও সেই সমাজের মতামত ও অভিপ্ৰায় গ্রহণ করিবার প্রয়োজন হয়।”
সুসভ্য দেশে সমূহের প্রজাতন্ত্র রাজ্যের সভাপতির ন্যায় কুকি রাজদিগের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। কিন্তু সমর কার্য্যে তাঁহার ক্ষমতা অসীম।
“কুকিদিগের গৃহ নির্মাণ কৌশলও অবশ্য প্রশংসনীয়। বাস্তবিক ইহাদিগের গৃহ নির্মাণ প্রণালী সামান্য ব্যয়সাধ্য ও অতীব সুন্দর, কিন্তু উহা দীর্ঘকাল স্থায়ী নহে। কুকিগণ কেবল পর্বতস্থ স্বভাবজাত বাঁশ ও বাঁশেরই বেত দ্বারা এবং সেই বাঁশেরই পাতার দ্বারা তাহার ছাউনি দিয়া বাসগৃহ নির্মাণ করে। প্রায় প্রত্যেকের গৃহই সুদীর্ঘ ও বিস্তৃতরূপে প্রস্তুত হয়; কিন্তু গৃহের ভিটাগুলি মৃন্ময় নহে, এবং তাহাও সেই অরণ্যজাত বাঁশ দ্বারাই অতি উচ্চরূপে মাচা নির্মাণ হইয়া থাকে। চিত্র বিচিত্র বংশশলাকা দ্বারা ঐ সমস্ত গৃহের সৌন্দর্য্য সম্পদিত হয়। কোন কোন গৃহের অভ্যন্তরে অনেক প্রকোষ্ঠ থাকে এবং উহারই মধ্যে একটি অভ্যাগতের অবস্থান জন্য নির্দ্ধারিত হয়। গৃহগুলি দীর্ঘকাল স্থায়ী না হইলেও ॥৩৪৩ নিরন্তর বাস করিবার পক্ষে নিতান্ত অনুপযুক্ত বলিয়া বোধ হয় না, এবং এক এক গৃহে বিস্তর লোক বাস করে। কোন গৃহস্থেরই একখানার অতিরিক্ত গৃহ থাকে না এবং এক এক গৃহে ৩০/৪০ জন পর্য্যন্ত নির্বিবাদে বাস করে।
“কুকিগণ অধিকাংশ স্থলেই বহু লোক একত্র হইয়া গভীর বংশ বনাবৃত অরণ্যানী পরিষ্কার করিয়া বাস করে। বাস্তবিক উহাদের এক একটী বাড়িই গ্রাম বিশেষের ন্যায় লক্ষিত হইয়া থাকে। এতগুলি লোক যে একস্থানে একই অবস্থায় পরস্পর প্রেমপ্রণয়ে ও ২০৫ নির্বিবাদে বাস করিতেছে, ইহা বিশেষ প্রশংসার বিষয়”।
“কুকিগণ গভীর অরণ্যানী কাটিয়া কিছুকাল নিপতিতাবস্থায় রাখে, এবং উহার সমস্ত শুষ্কতা প্রাপ্ত হইলে অগ্নিতে দগ্ধ করিয়া উহাতেই নানাবিধ শস্য বীজ একত্র করত পর্যায়ক্রমে বপন করিয়া দেয়। কিছুকাল পর ঐ সমস্ত বীজের অঙ্কুর উদ্গম হইলে উহার রক্ষণাবেক্ষণ করিয়া যথাকালে শস্য সংগ্রহ করে। এরূপে উৎপন্ন শস্য মধ্যে ধান্য, তিল ও কার্পাসই প্রধান। এতদ্ভিন্ন আরও অনেক প্রকার শস্য উৎপন্ন করিয়া থাকে। ইহারা প্রকৃত পক্ষে মাংসাশী সুতরাং ইহাদের শস্যের প্রয়োজন অতি অল্প।”
“যে সমস্ত প্রাণী বা উদ্ভিজ্জাদি ভক্ষণ করিলে মৃত্যু বা শরীরের কষ্ট ও আকস্মিক কোন রোগাদি উপস্থিত হয় না, ॥৩৪৪॥ প্রায় উহার সমস্তই কুকিদিগের আহার্য্য। কেবল অগ্নিতে ঝলসাইয়া কিম্বা আবশ্যক হইলে জলযোগে সিদ্ধ করিয়া উদরাগ্নির আহুতি প্রদান করে। ইঁহাদিগের মধ্যে দধি, দুগ্ধ বা ঘৃতের ব্যবহার নাই। কদাচিত কেহ কেহ দধি দুগ্ধ ব্যবহার করিয়া থাকে, কিন্তু সমাজে উহার আদর অতি অল্প
“ইহাদিগের আহার্য্য প্রস্তুত করিতে কোন মসলার প্রয়োজন হয় না। কেবল খাদ্যোপযোগী দুগ্ধ বা সুসিদ্ধ হইলেই লবণ সংযোগ উদরাসাৎ করিয়া ফেলে। আহার্য্য মধ্যে টাটকা বা সোরা (শুষ্ক) মাংসই সমধিক আদরণীয় এবং প্রথম শ্রেণীর খাদ্য। মৎস্যাদি দ্বিতীয় শ্রেণীর মধ্যে পরিগণিত। তদ্ভিন্ন আর সমস্তই নিকৃষ্ট আহার্য্য। প্রথম শ্রেণীর আহাৰ্য্য চতুষ্পদি প্রাণীমধ্যে মৃগ, শশক, হস্তী, অশ্ব, বানর, বিড়াল এবং সরীসৃপ জাতি মধ্যে অজগর, সাপ, গোসাপ, ভেক ইত্যাদি শ্রেষ্ঠ আহাৰ্য্য মধ্যে গণ্য। এই সমস্ত মাংশ ভিন্ন ইহারা প্রায়শ অন্নাদি আহার করে না। কুকি জাতি মদিরা পানে নিতান্তই আসক্ত।”
ইহাদের গৃহপালিত পশু গবয় ও ছাগ বৃহৎ ভোজ উপলক্ষে বধ করিয়া তাহার মাংস ভোজন করে। ইহারা কুকুরকে তণ্ডুল ভোজন করাইয়া তখনই সেই কুকুর বধ করত তাহাকে অগ্নিতে বিশেষরূপে দগ্ধ করিয়া তাহার উদরস্থিত সুসিদ্ধ তণ্ডুল মিষ্টান্নের ন্যায় ভোজন করিয়া ॥৩৪৫ থাকে এবং ইহা তাহাদের মধ্যে উৎপাদেয় খাদ্য। অধুনা কুকিগণ নরমাংশ আহারী নহে, কিন্তু তাহারা প্রথম যে মনুষ্যকে বধ করে তাহার যকৃতের কিয়দংশ ভোজন করিয়া থাকে।
“কুকিজাতির স্ত্রীলোক অনেকাংশেই স্বামী অপেক্ষা স্বাধীন। পুরুষগণ প্রায় সর্বদাই স্ত্রীলোকে মুখাপেক্ষী হইয়া থাকে। কুকি রমণীগণ শরীরের সাজসজ্জা করিতে ভালবাসে। বস্তুত সর্বদাই কেশবিন্যাস, গলদেশে নানাবর্ণ বিরঞ্জিত প্রস্তর মালা দোদুল্যমান থাকে। তাহারা হস্তে গজদন্ত বা মহিষাদির শৃঙ্গ বিনির্মিত চুড়ি ব্যবহার করে; কিন্তু তাহাদের পরিধেয় বস্ত্রের আড়ম্বর নাই। স্বজাতি রমণীগণ নির্মিত নাতিদীর্ঘ ও অপ্রশস্ত বস্ত্রখণ্ড দ্বারা কটিদেশ আবৃত ও কখন কখন বক্ষ আবরণ করিয়া রাখে। কিন্তু অধিক সময়েই সেই আবরণ বস্ত্রখণ্ডের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে তাহারা বিস্মৃত হইয়া থাকে।”
“কুকি রমণীগণ অধিকাংশই গম্ভীর প্রকৃতি। যাহারা সুন্দরী তাহাদের বর্ণ সুকোমল। কিন্তু তাহাদিগেরও কর্ণলতিকা বিস্তৃত রন্ধ্র সমন্বিত হওয়ায় দেখিতে তত প্রীতিকর বোধ হয় না। ব্যাভিচার দোষ তাহাদের মধ্যে প্রায় দেখা যায় না।” কুকিজাতি যদিচ কখন কখন সামান্য আকারে বস্ত্রখণ্ড দ্বারা শরীরের কোন কোন অংশ আচ্ছাদন করে বটে কিন্তু ॥৩৪৬। প্রকৃত পক্ষে উহারা উলঙ্গ জাতি আখ্যা দ্বারা বিশেষ রূপে পরিচিত হইতে পারে।
“কুকিগণ মধ্যে অতি অল্পই ব্যাভিচার দোষ ঘটিয়া থাকে। সামাজিক নিয়মের কাঠিন্য বশতঃই কেহ ব্যাভিচার দোষে লিপ্ত হইতে সাহস পায় না। অবিবাহিত স্ত্রী পুরুষের মধ্যে ব্যাভিচার বিশেষ দোষাবহ নহে। বিবাহিত পুরুষ কিম্বা বিবাহিতা স্ত্রী, অন্যের সহিত ব্যভিচার দোষে লিপ্ত হওয়ার কথা প্রকাশ হইলে সমাজে কঠিন দণ্ডে দণ্ডিত হইয়া থাকে। তজ্জন্যই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ কোন স্ত্রী কি পুরুষ সহজে পরস্পরের পরিত্যক্ত ও উপেক্ষিত কিম্বা বিবাহ বন্ধন বিচ্ছিন্ন না হইলে ব্যাভিচার দোষে সন্নিবিষ্ট হইতে সমর্থ হয় না। অবিবাহিত পুরুষ কি অবিবাহিতা স্ত্রী এই উভয় মধ্যে প্রণয় উপস্থিত হইলে প্রায়ই তাহারা বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হয়, এবং পরে সমাজের নিয়মানুসারে বৈবাহিক আচার ব্যবহার সম্পন্ন করিয়া লয়। কিন্তু পরস্পর মধ্যে সম্বন্ধের নৈকট্য প্রতিবন্ধক থাকিলে ঐরূপ প্রণয়েও বিবাহ সম্পন্ন হইতে পারে না, এবং উহা অসিদ্ধ বিবাহ মধ্যে পরিগণিত হইয়া থাকে। বিবাহে কোনরূপ ধর্মকার্য্যের অনুষ্ঠান হয় না। বৃহৎ ভোজ ও অপরিমিত মদিরা পানই বিবাহোৎসবের প্রধান অঙ্গ। কুকিগণমধ্যে বিবাহ সম্পন্ন হইলে সহজে কেহই কাহাকে পরিত্যাগ করিতে পারে না, কিন্তু অনিবার্য্য ॥৩৪৭ কারণে একজন অন্যজনকে পরিত্যাগ করিতে কি নিজেই পরিত্যক্ত হইতে ইচ্ছা করিলে সমাজে সেই বিষয় উত্থাপিত হয় এবং সামান্য কারণ ঐ পরিত্যাগের বা পরিত্যক্ত হওয়ার মূল হইলে সমাজ তাহার প্রতিরোধ করিয়া দেয়। তাহাদের পরস্পর মধ্যে অসামঞ্জস্য হইয়া উঠিলে তন্মধ্যে যাহারই পরিত্যাগ পাইবার ইচ্ছা প্রবল, তাহাকেই সামাজিকগণকে একবার ভোজ এবং বিরুদ্ধ পক্ষের ক্ষতিপুরণ দিতে বাধ্য হইতে হয় এবং তদ্বারা তাহা সম্পন্ন হইলেই ঐ বিবাহ বন্ধন বিচ্ছেদ ও পুনরায় অন্যের সহিত হইতে সম্পন্ন হইতে পারে। অধিকাংশ স্থলেই স্ত্রী পুরুষ মধ্যে পরস্পরের প্রণয় জন্মিলে বিবাহ সম্পন্ন হয়। কখন কখন পরস্পরের অভিভাবকও সম্বন্ধ নির্ণয় করিয়া বিবাহ সম্পন্ন করিয়া দেয়।
“কুকিগণ নিরীশ্বরবাদী নহে। অথচ কোনও নির্দ্দিষ্ট দেব-দেবীর বা ঈশ্বরের উপাসনা করাও তাহাদের কুলগত রীতি নাই। কিন্তু তাহারা মানে যে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে দেব-দেবী ও জগৎস্রষ্টা একজন ঈশ্বর আছেন। তাহারা বলে যে, ঈশ্বর অনিমা, মঘিমাদি ষড়ৈশ্বর্য্য মহিমায় আবশ্যকানুসারে এই বিশ্বসংসারের সমস্ত স্থানেই বিচরণ ও প্রাণীদিগের হিতাহিত ও শুভাশুভ সাধন করিয়া থাকেন, এবং সেই ঈশ্বর বা দেব- দেবীকেই কুকিগণ “পাতিএন” বলিয়া উচ্চারণ করে ও মানিয়া থাকে।।৩৪৮।।
“নিরন্তর সুখস্বাচ্ছন্দের কামনায় সংবৎসর মধ্যে বিশেষ বিশেষ পর্বোপলক্ষ্যে এবং কোনও পীড়াদি প্রশমনার্থ সময়ে সময়ে ছাগ, কুক্কুট, বরাহ ও মহিষাদির বলিবিধান দ্বারা কোনও সুবৃহৎ বৃক্ষ বা পর্বত কিম্বা নদ-নদী অথবা, বংশবিনিৰ্ম্মিত চিত্রিত শলাকা সংযোজিত আসন নির্মাণ করিয়া স্ত্রী পুরুষ ভেদে সংজ্ঞা বিশেষে দেব- দেবীর কল্পনায় ও উদ্দেশ্যে “পাতিএনের” পূজা বিধান ও অর্চনা করিয়া থাকে এবং তদ্বারা শুভাশুভ ও হিতাহিত কল্পনা করে। সুতরাং ইহাই কুকিদিগের উপাসনা বা অর্চনার পদ্ধতি, তদ্ভিন্ন আর অন্যরূপ উপাসনার পদ্ধতি ও নিয়ম নির্দ্ধারিত নাই।”
“কুকিগণমধ্যে কেহ মৃত্যুমুখে পতিত হইলে তাহার আত্মীয় স্বজাতিগণ তাহাকে অগ্নিসাৎ করিয়া সংস্কার করে এবং তাহার স্বগার্থ তদুদ্দেশে সামাজিক সকলকে প্রচুর মাংস মদিরাদি দ্বারা ভোজ প্রদান করিয়া থাকে। কিন্তু রাজগণমধ্যে কেহ পরলোকগমন করিলে তৎক্ষণাৎ উহার অগ্নিসংস্কার না করিয়া প্রকাণ্ড অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করত মৃতদেহ শুষ্ক করিয়া যত্নের সহিত দীর্ঘকাল রক্ষা করিয়া থাকে। কিন্তু রক্ষার অযোগ্য হইয়া উঠিলে মহাসমারোহে অগ্নিসাৎ করিয়া ফেলে। অথচ পর্বে পর্বে সেই মৃতব্যক্তির উদ্দেশ্যে মাংস মদিরাদি উৎসর্গ করিয়া উদরসাৎ করিবার নিয়ম প্রচলিত আছে।”
আমরা পূর্বে বলিয়াছি যে, মুসলমান ও মগদিগের সহিত ॥৩৪৯॥ অবিরাম কলহ করিয়া যখন ত্রিপুরেশ্বরগণ দুর্বল হইয়া পড়িলেন, তৎকালে ত্রিপুররাজ বংশধরগণ আত্মকলহ দ্বারা রণ দুৰ্ম্মদ কুকিদিগকে অধীনতা শৃঙ্খল ছিন্ন করিবার পন্থা পরিষ্কার করিয়া দিয়াছিলেন। বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগে ইহার সূত্রপাত হয়। ১১৪৭ ত্রিপুরাব্দে (১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে) যৎকালে সুবা রুদ্রমণি ঠাকুর, মহারাজ মুকুন্দ মাণিক্য মুসলমান ফৌজদারকে কারারুদ্ধ করিয়া, জয়মাণিক্য নাম গ্রহণ পূর্বক সিংহাসন অধিকার করেন, তৎকালে রণদুর্ম্মদ কুকিগণ তাহার সহায় হইয়াছিল। তদবধি ইহাদের অত্যাচারের সূত্রপাত হয়। সেই সময় হইতে যখনই ইহারা কোনরূপ সুযোগ প্রাপ্ত হইয়াছে, তখনই পার্বত্যপ্রদেশ অতিক্রম করিয়া সমতল ক্ষেত্রে প্রবেশ করত তাহাদের রাক্ষসপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করিয়াছে।
মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্যের পক্ষ অবলম্বন পূর্বক কুকিগণ বারংবার সমসের গাজির সহিত আহবে লিপ্ত হইয়াছে। যদিচ সমতল ক্ষেত্রে সম্মুখে যুদ্ধে কুকিজাতি তাহাদের বিক্রম প্রকাশ করিতে পারে না; কিন্তু এই সময় হইতে ইহার পর্বতমধ্যে আপনাদের বল বিক্রম প্রকাশ করত বিশেষ প্রবল হইয়া উঠে। বৰ্ত্তমান শতাব্দীর প্রারম্ভে কুকিগণ এরূপ প্রবল রইয়াছিল, যে ব্রিটিশ গবর্ণমেন্ট সাহায্য না করিলে মহারাজ ॥৩৫০॥ রামগঙ্গা মাণিক্য সপরিবারে তাহাদের দ্বারা নিহত হইতেন। ত্রিপুর বংশের যে শাখা এক্ষণ ত্রিপুর সিংহাসনের প্রকৃত অধিকারী বলিয়া নির্ণীত হইয়াছেন, গবর্ণমেন্ট উপযুক্তরূপ সাহায্য না করিলে এই শাখার চিহ্নও বিলুপ্ত হইত, তাহা হইলে ত্রিপুর সিংহাসনের উত্তরাধিকারীত্বের অন্যরূপ মীমাংসার হইত।[৫]
১২৩৪-৩৬ ত্রিপুরাব্দের মধ্যবর্ত্তী কালে শম্ভুচন্দ্র ঠাকুরের প্ররোচনায় কুকিগণ ত্রিপুরেশ্বরের বিরুদ্ধে বারংবার অস্ত্র ধারণ করিয়াছিল।
১২৩৮ ত্রিপুরাব্দে ত্রিপুরেশ্বর উত্তরপূর্ব সীমান্তে তাঁহাদের সীমান্ত প্ৰদেশ সুদৃঢ় করিতে যত্নবান হইয়াছিলেন। আধুনিক কাছাড় জেলার অন্তর্গত হাইলাকান্দী ও মণিপুর রাজ্যের অন্তর্গত থাঙ্গম নামক কুকিগ্রাম ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত বলিয়া তিনি দাবি করিয়াছিলেন। সে সূত্রেই মণিপুরপতির সহিত ত্রিপুরেশ্বরের কলহের উপক্রম হইলে গবর্ণমেন্ট মধ্যস্থ হইয়া ইহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন। অনুসন্ধান দ্বারা নির্ণীত হইয়াছিল যে থাঙ্গম, খচাক কুকিদিগের প্রাচীন বাসভূমি, ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা হইতে সমসূত্ররেখায় ১৬০ মাইল দূরে, পূর্ব উত্তর কোণে অবস্থিত। এই গ্রাম মণিপুরের অতি নিকটবর্ত্তী হইলেও পূর্বে ইহা ত্রিপুররাজছত্রের ॥৩৫১॥ অধীন ছিল। কিন্তু ৪/৫ বৎসর যাবৎ মণিপুরপতি সেই গ্রামে একটি থানা স্থাপন করিয়াছেন। এই জন্য গবর্ণমেন্ট “দখলকারের দখল” স্থির রাখিয়া থাঙ্গম নামক স্থানে সৈন্য প্রেরণ করিতে ত্রিপুরেশ্বরকে নিষেধ করিলেন[৬]। হাইলাকান্দী পরগণা লইয়া বিগত শতাব্দীর অন্তভাগেও কাছাড়পতির সহিত ত্রিপুরেশ্বরের বিরোধ চলিতেছিল। কিন্তু ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে হাইলাকান্দীর দক্ষিণদিকস্থ সমগ্র পার্বত্য প্রদেশ ত্রিপুরারাজ্যের অন্তর্গত বলিয়া ইংরোজমালা ১৪০ রাজমালা ১৩৯ রজ কর্তৃপক্ষগণ স্বীকার করিয়াছেন[৮]। তদনুসারে আধুনিক কাছাড় জেলার অধীন বর্ণারপুর প্রভৃতি অনেকগুলি চা ক্ষেত্র ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত হইতেছে। ॥৩৫২॥
আমাদের দেশে একটি প্রচলিত কথা আছে “সাঁতার না জানিলে বাপের পুকুরে ডুবিয়া মরিতে হয়।” রাজ্য এক সময় বৃহৎ ছিল সত্য কিন্তু রক্ষা করিতে না পারিলে রাজ্য বৃহৎ থাকে না, ক্রমে সীমারেখা সঙ্কুচিত হইয়া পড়ে। যে দিবস লক্ষ লক্ষ বীরপুরুষ ধন্যমাণিক্য ও বিজয় মাণিক্যের বিজয়ী পতাকা আকাশ মার্গে উড্ডীন করিয়া রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইত, বহুকাল হইল সেই দিবস গত হইয়াছে। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে যখন খচাকদিগের বাসভূমি ॥৩৫৩॥ লইয়া মণিপুর পতির সহিত বিরোধ উপস্থিত হয় তৎকালেও চারিসহস্র সৈন্য হনুমান মূর্ত্তিলাঞ্ছিত ত্রিপুরপতাকা লইয়া অগ্রসর হইয়াছিল। মহারাজ কাশীচন্দ্র এবং মহারাজ কৃষ্ণকিশোর বিলাস সাগরে অঙ্গ ভাসাইয়া মণিপুরী “লাইছবি” দ্বারা রাজঅন্তঃপুর পরিপূর্ণ করিলেন। উপযুক্ত অর্থব্যয় করিয়া সৈন্য রক্ষা নিষ্প্রয়োজনীয় জ্ঞান হইল। চাকলে রোসনাবাদ ঋণজালে বদ্ধ করিয়া কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য বিলাস সাগরে অর্থরাশি ঢালিলেন। সুশিক্ষিত সৈন্যের অভাবে রাজ্যসীমা সঙ্কুচিত হইতে চলিল।
ত্রিপুরারাজ্যের পূর্ব ও উত্তর দিকস্থ পার্বত্য প্রদেশে পইতু কুকিগণের বাস। যে সকল লোমহর্ষণ ঘটনা স্মরণ করিলে আমাদের হৃদয়ের শোণিত অদ্যাপি শুষ্ক হইয়া উঠে, তাহার অধিকাংশই পইতু কুকি দ্বারা সম্পাদিত হইয়াছে। আমরা এস্থলে তাহাদের একটি প্রধান শাখার বংশাবলী প্রদান করিতেছি। বিগত শতাব্দীর অন্ত্যভাগে মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্যের শাসনকালে, পইতু কুকির প্রধান সরদার শিববুত পঞ্চবিংশতি সহস্ৰ কুকি পরিবার লইয়া স্বীয় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিন্তু তাহার উত্তর পুরুষগণ মধ্যে কেহ কেহ স্বাধীন রহিয়াছে। অন্যেরা ত্রিপুরেশ্বরের অধীনতা স্বীকার পূর্বক তাহাদের জাতীয় প্রথা অনুসারে কর প্রদান করিতেছে। যাহারা স্বাধীন রহিয়াছে, তাহাদের কৃত অত্যাচারে জ্বালাতন ॥৩৫৪॥ হইয়া গবর্ণমেন্ট কৌশল পূর্বক তাহাদের স্বাধীনতা রত্নহরণ মানসে নানা প্রকার উপায় উদ্ভাবন করিতেছেন।
আমরা আরও কতগুলি বিখ্যাত কুকি সরদারের বংশাবলী সংগ্রহ করিয়াছি। কিন্তু নিতান্ত সংক্ষিপ্ত এজন্য উল্লেখ করা হইল না। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে (১২৩৬ ত্রিপুরাব্দে) কুজাশিবের পুত্র রাজা বুন্তাই শ্রীহট্টবাসী কতকগুলি কাঠুরিয়াকো পর্বত মধ্যে বধ করিয়াছিলেন।
১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাজবংশজ রামকানুঠাকুর ৩/৪ শত ত্রিপুরা কুকি লইয়া খণ্ডল নিবাসী মেরকুচৌধুরীর বাড়ী আক্রমণ করেন। তিনি উক্ত চৌধুরীর বাসভবন ভস্মীভূত ও ১৫ জন লোককে বধ করিয়া পর্বত মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণ উল্লিখিত ভীষণ হত্যাকাণ্ডের নায়কদিগকে ধৃত করিবার জন্য লিখিলেন, ত্রিপুরেশ্বর তাঁহাদের চির অত্যন্ত “বাঁধাবোলে” উত্তর করিলেন যে, “ইহারা তাঁহার প্রজা নহে।”[১০]
১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের (১২৫৩ ত্রিপুরাব্দে) অন্ত্যভাগে বিখ্যাক কুকি সরদার রাজালারু কাল কবলিত হন। তাহার উপযুক্ত পুত্র লালছোকলা পিতার ঔৰ্দ্ধদৈহিক কাৰ্য্য উপযুক্ত রূপে সম্পাদন করিতে মনস্থ করিলেন। এরূপ একজন পরাক্রমশালী বীরের শ্রাদ্ধ কাৰ্য্য কখনই নরমুণ্ড ও দাস দাসী ব্যতিত সম্পন্ন হইতে পারে না। বিশেষত ব্রিটিস রাজ্যের অস্ত্রশস্ত্র ॥৩৫৬॥ বিহীন অধিবাসী না হইলে নরমুণ্ড কিম্বা দাস দাসী সংগ্রহের সুবিধা হয় না। সুতরাং বীরবর লালছোকলা পর্বত হইতে বহির্গত হইয়া ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল নিশাবসানে শ্রীহট্টের অন্তর্গত প্রতাপগড় পরগণার মধ্যবর্তী কচুবাড়ী নামক গ্রাম আক্রমণ করত ২০টী নরমুণ্ড এবং ৬টি দাস দাসী সংগ্রহ করিলেন। শ্রীহট্টের ম্যাজিষ্ট্রেট এই লোমহর্ষক ঘটনার সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া গবর্ণমেন্টে রিপোর্ট করিলেন। গবর্ণমেন্ট অত্যাচারকারীগণকে ধৃত করিবার জন্য ত্রিপুরার মহারাজাকে লিখিলেন, মহারাজ ত্রিপুরেশ্বরদিগের চির অভ্যস্থ প্রথানুসারে তদুত্তরে লিখিলেন যে, “ইহারা তাহার অধীন নহে।” কিন্তু গবর্ণমেন্ট ইহাতে অসন্তুষ্ট হইয়া অত্যাচারী কুকিগণকে ধৃত করিবার জন্য মহারাজকে লিখিলেন। অগত্যা মহারাজ বাধ্য হইয়া একজন দারগাকে ১০ জন বরকন্দাজের সহিত লালছোকলাকে ধৃত করিবার জন্য প্রেরণ করিলেন। ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণ তৎসংবাদ শ্রবণে হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না। তাঁহারা ইহাকে একটি প্রহসন বলিয়া বিবেচনা করিলেন।
গবর্ণমেন্ট ত্রিপুরেশ্বরের আচরণে বিরক্ত হইয়া তাঁহাকে লিখিলেন যে আগামী ১লা ডিসেম্বরের পূর্বে প্রকৃত অত্যাচারীকে ধৃত করিয়া গবর্ণমেন্টের হস্তে সমর্পণ না করিলে ব্রিটিশ সৈন্যদল তাঁহার রাজ্যমধ্যে প্রবেশ করিয়া অত্যাচারীকে ॥৩৫৭। ধৃত করিবে। এই ঘটনার পর ত্রিপুরেশ্বর ৪ জন কুকি অপরাধীকে ২৭ জন সাক্ষীর সহিত শ্রীহট্টের ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করিলেন। কিন্তু তাহারা ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট উপস্থিত হইয়া প্রকাশ করিল যে, তাহারা ইহার কিছুই অবগত নহে। এই ঘটনায় কিছু কাল অতিবাহিত হইল, অবশেষে নিরূপিত ১লা ডিসেম্বরে কাপ্তেন ব্লেকউড একদল পদাতিক সৈন্য লইয়া ত্রিপুরা রাজ্যে প্রবেশ করত লালছোকলার গ্রাম অবরোধ করিলেন।
ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণের রিপোর্টে প্রকাশ যে, ৪ঠা ডিসেম্বর লালছোকলা কাপ্তেন ব্লেকউডের হস্তে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু প্রবন্ধলেখক বিশ্বস্ত সূত্রে অবগত আছেন যে, ত্রিপুরেশ্বরের জনৈক সেনাপতি (কেলীফেয়িঙ্গী) লালছোকলাকে ধৃত করিয়া ব্লেকউডের হস্তে সমর্পণ করিয়াছিলেন। শ্রীহট্টে লালছোকলার বিচার হয়। সেই বিচারে লালছোকলা দ্বীপান্তর প্রেরিত হইয়াছিলেন।
১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে রাজবংশজ ভগবান চন্দ্র ঠাকুর একদল কুকি সংগ্রহ করত খণ্ডলের অন্তত একখানি গ্রাম আক্রমণ ও লুণ্ঠন এবং ভষ্মীভূত করিয়াছিলেন।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কুকিগণ শ্রীহট্ট ও ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত স্থানে ভীষণ অত্যাচার করিয়াছিল, দেড়শতের অধিক প্রজা তাহাতে বিনষ্ট হইয়াছিল। এই সংবাদ গবর্ণমেন্টের কর্ণ ॥৩৫৮॥ গোচর হইলে কর্তৃপক্ষগণ তাহার প্রতিশোধ লইবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। কিন্তু মহারাজ গবর্ণমেন্টকে জানাইলেন যে, এই ভীষণ হত্যাকাণ্ড তাহার রাজ্য মধ্যে হইয়াছে, সুতরাং ইহাতে হস্তক্ষেপ করিবার গবর্ণমেন্টের কোন অধিকার নাই। কিছুকাল এই কথা লইয়া গণ্ডগোল চলিয়াছিল। অবশেষে কাপ্তেন ফিসারের মানচিত্রদ্বারা ঘটনাস্থান ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত নির্ণীত হওয়ায় গবর্ণমেন্টের সৈন্যগণ প্রত্যাবর্তন করিতে আদিষ্ট হইয়াছিলেন। তৎপর মহারাজ এই দুর্বৃত্তদিগের দমন জন্য আর কোন উপায় অবলম্বন করেন নাই।
১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু খচাক ও লুসাই প্রভৃতি কুকিগণ, চট্টগ্রামে শ্রীহট্ট ও কাছাড় প্রদেশে প্রবেশ করিয়া অনেকগুলি লোকের প্রাণ সংহার ও কয়েকখানি গ্রাম ভষ্মীভূত করিয়াছিল। এই সময় কুকিগণ প্রায় ৫২ জন লোককে ধৃত করিয়া লইয়া যায়।
আমাদের গবর্ণমেন্ট কুকিদেগের দ্বারা এইরূপ জ্বালাতন হইয়া তাহাদিগের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করিতে মনস্থ করেন। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে যখন কর্নেল লেষ্টার সৈন্য লইয়া কাছাড় হইতে কুকিদিগের বাসস্থানাভিমুখে যুদ্ধ যাত্রার আয়োজন করিতেছিলেন, সেই সময় পূর্বদিক হইতে প্রায় ৪০০ কুকি চট্টগ্রাম পার্বত্য প্রদেশ এবং কাছাড়ের দক্ষিণদিকস্থ পার্বত্য প্রদেশ হইতে আর একদল কুকি শ্রীহট্টের ॥৩৫৯॥ অন্তর্গত লাতু থানার নিকটবর্তী স্থানে প্রবেশ করিয়া তাহাদের চিরঅভ্যস্থ নরহত্যা, গৃহদাহ প্রভৃতি কার্য্যগুলি সম্পাদন করিয়া পলায়ন করে। লাতুর নিকটবর্ত্তী স্থান ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত বলিয়া মহারাজ বিশেষ তর্ক উত্থাপন করিলেন, এবং আক্রমণকারী কুকিগণও ত্রিপুরেশ্বরের অধীনস্থ বলিয়া প্রকাশ হইয়াছিল।
কর্ণেল লেস্টারের যুদ্ধ যাত্রার ফল মোটের উপর এই হইয়াছিল যে, বিখ্যাত কুকি সরদার সুকপাইলাল গবর্ণমেন্টের আনুগত্য স্বীকার করত বন্ধুত্ব সংস্থাপন করিতে সম্মত হইয়াছিলেন। গবর্ণমেন্ট কুকিদিগের এই সকল স্বীকৃতি বাক্যের প্রতি আস্থা প্রদর্শন করিলেও আমরা এই সকল অসভ্য বর্বরদিকে কিছুমাত্র বিশ্বাস করিতে পারি না। যাহা হউক, ইহার পর প্রায় দশ বৎসরকাল কুকিদিগের দ্বারা বিশেষ উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা হয় নাই। কেবল ১৮৫০-৫১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের সীমান্ত স্থান কতকগুলি কাঠুরিয়া কুকিগণ কর্তৃক বিনষ্ট হইয়াছিল। যাহা হউক, আমাদের গবর্ণমেন্ট নিশ্চিন্ত ছিলেন না। সীমান্ত প্রদেশ রক্ষার জন্য এই সময় যে সকল উপায় অবলম্বন করা হয়, তন্মধ্যে চট্টগ্রাম পার্বত্য জেলা সৃষ্টি করিয়া তথায় একজন ইংরাজ সুপারিনটেণ্ডেন্ট সংস্থাপন করত সর্বোৎকৃষ্ট কাৰ্য্য বলিয়া গণনা করা যাইতে পারে। ॥৩৬০
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে খণ্ডলের ভীষণ হত্যাকাণ্ড সম্পাদিত হয়। আমরা বাল্যকালে এই লোমহর্ষণ হত্যাকাণ্ডের বিবরণ যাহা শ্রবণ করিয়াছি, অদ্যাপি তাহা স্মরণ করিলে দুঃখে হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যায়। পাঠকগণ, সেই দুঃখের কথা কি বলিব। কানপুরের বিদ্রোহী সিপাইগণ যে লোমহর্ষণ কাৰ্য্য সম্পন্ন করিয়াছিল, তাহা অনন্তকাল ইতিহাসপটে শোণিতাক্ষরে লিখিত থাকিবে; কিন্তু খণ্ডলের হত্যাকাণ্ডের বিবরণ কতজন পাঠক অবগত আছেন? আমাদের কর্তৃপক্ষগণের বিজ্ঞাপনীতে এই ঘটনা নিম্নলিখিত রূপ সামান্য আকারে বর্ণিত হইয়াছে।[১১]
এই ভীষণ হত্যাকাণ্ড অবলম্বন করিয়া রাধামোহন নামক জনৈক গ্রাম্য কবি একটি কবিতা রচনা করিয়াছিলেন, ॥৩৬১ আমরা বাল্যকালে ইহা শ্রবণ করিয়াছি। সেই কবিতা সম্পূর্ণ রূপে এক্ষণে আমাদের স্মরণ নাই। তাহার কিয়দংশ মাত্র স্মরণ রহিয়াছে[১২]। তৎকালে যাহারা পলায়ন পূর্বক আত্মরক্ষা করিতে সক্ষম হইয়াছিল, তাহাদের নিকট এই ঘটনা যেরূপ শ্রুত হওয়া গিয়াছে, এই স্থলে তাহাই প্রকাশ করা গেল।
খণ্ডল পরগণার অন্তর্গত (ছাগলনাইয়া থানার অধীনে ) মুনসীরখীল নামক গ্রামস্থ বাজারে ত্রিপুরেশ্বরের জনৈক সেনাপতি- কাপ্তান ধরণীধর সিং- কতিপয় সৈন্যর সহিত অবস্থান করিতেছিলেন। ১৬ই মাঘ শনিবার পঞ্চমী পূজা ছিল। কাপ্তান তাঁহার সঙ্গীয় অস্ত্রশস্ত্রাদি ॥৩৬২॥ ধৌত ও পরিষ্কার করিয়া পূজার জন্য সুসজ্জিত করিয়া রাখিলেন। এই সময় সংবাদ আসিল যে, ৪০০।৫০০ কুকি নিকটবর্ত্তী গ্রাম আক্রমণ করিয়াছে। কাপ্তান মহাশয় এই সংবাদ প্রাপ্ত মাত্র অস্ত্রাদি লইয়া পলায়ন করিলেন। কুকিগণ নির্বিবাদে গৃহে অগ্নি প্রদান পূর্বক গ্রামবাসীদিগকে খণ্ড খণ্ড করিতে লাগিল। যে সকল শিশু মাতার সহিত কুকিদিগের দ্বারা ধৃত হইল, কুকিগণ সেই সকল শিশুকে মাতার বক্ষ হইতে কাড়িয়া লইয়া শূন্যে নিক্ষেপ করত নিম্নে সুতীক্ষ্ণ শেল ধারণ পূর্বক তাহাদিগকে বিদ্ধ ॥৩৬৩। করিতে লাগিল। হতভাগী জননীগণ এইরূপ নিষ্ঠুরতার সহিত অপত্য নিধন দর্শনে নীরবে অশ্রু বিসর্জ্জন করিতে লাগিল। কুকিগণ পুরুষ মাত্রকেই নির্দয়তার সহিত হত্যা করিয়া যুবতী রমণীগণকে পশুর ন্যায় বন্ধন করত আপনাদের সঙ্গে লইয়া চলিল। তাহার এইরূপে ১৫ খানা গ্রাম লুণ্ঠন ও ভষ্মীভূত করিয়া ১৮৫ জন মনুষ্যকে বন্ধন করিয়া লইয়া যায়। বলা বাহুল্য যে, তন্মধ্যে অধিকাংশ স্ত্রীলোক, বিশেষত যুবতী। এই ১৫ খানা গ্রাম লুণ্ঠন করিয়া তাহারা যে সমস্ত স্বর্ণ, রৌপ্য ও লৌহ প্রাপ্ত হইয়াছিল, তাহাই লইয়া গিয়াছিল।
এই সময় গুণাগাজি নামক গ্রামস্থ একজন প্রধান ব্যক্তি চতুৰ্দ্দিকস্থ পল্লীসমূহ অনুসন্ধান পূর্বক প্রায় ২৫/৩০টি বন্দুক সংগ্রহ করিয়া বাউনালী নদীর তটে কুকিদিগকে আক্রমণ করেন। কুকিদিগের অধিক বন্দুক ছিল না, সুতরাং তাহারা বন্দুকের মুখে নদী পার হইতে সাহসী না হইয়া প্রত্যাবর্তন করে। বিশেষত কুকিগণ প্রায়ই সম্মুখে-যুদ্ধে অগ্রসর হয় না। গুণাগাজি এরূপ সাহস অবলম্বন না করিলে যে আরও কত গ্রাম ভষ্মীভূত এবং কত লোক কুকিদিগের দ্বারা বিনষ্ট হইত, তাহা কে বলিতে পারে? গুণাগাজির এই কীৰ্ত্তি অনন্তকাল ইতিহাস লেখক ঘোষণা করিবেন।॥৩৬৪।
জেলা ত্রিপুরা ম্যাজিষ্ট্রেটের সাহেব এই সংবাদ শ্রবণ মাত্র কতিপয় সৈন্য খণ্ডলাভিমুখে প্রেরণ করিয়াছিলেন; কিন্তু তাহারা সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া কেবল মাত্র কুকিদিগের অত্যাচারের জ্বলন্ত চিহ্ন প্রত্যক্ষ করিল। কুকিগণ ইহার পূর্বেই জঙ্গলে প্রবেশ করিয়াছিল।
এই ভীষণ হত্যাকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান করিতে যাইয়া আমাদের কর্তৃপক্ষগণ যাহা অবগত হইয়াছিলেন, তাহা নিম্নে উদ্ধৃত হইল।[১৩]
উল্লেখিত ভীষণ হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ আমরা এরূপ অবগত আছি, ত্রিপুরার পার্বত্য প্রদেশে রিয়াং নামক এক সম্প্রদায় আছে ইহারা কুকিদিগের ন্যায় তত ভীষণ প্রকৃতির না হইলেও, নিতান্ত নিরীহ জাতি নহে॥৩৬৫॥ রিয়াংগণ খণ্ডলের বাঙ্গালি মহাজনগণ হইতে সর্বদা টাকা কর্জ্জ করিত। পার্বত্য প্রদেশে অনাবৃষ্টি নিবন্ধন প্রায় দুই তিন বৎসর শস্য জন্মে নাই। সুদে অনেক টাকা দাঁড়াইল। মহাজনেরা সর্বদা রিয়াংদিগকে টাকার জন্য তাগাদা করিত। তাহারা ইহা অসহ্য বোধে দুথাঙ ও অন্যান্য কুকিদিগের সহিত সম্মিলিত হইয়া এই কাৰ্য সম্পাদনা করে। ইহাতে কৃষ্ণচন্দ্র ঠাকুর প্রভৃতি রাজবংশীয় কয়েকজন ব্যক্তি সংসৃষ্ট ছিলেন।[১৪] বিখ্যাত কুকি সরদার রতন পুইয়া ইহাদের সাহিত যোগদান করেন।
কুকিদিগের অত্যাচারে যে সকল খন্ডলবাসী সর্বস্বান্ত হইয়াছিল, গবর্ণমেন্ট তাহাদিগকে ১৩০০৭ টাকা ক্ষতিপূরণ স্বরূপ প্রদান করেন। ইহার অর্দ্ধাংশ ত্রিপুরেশ্বর হইতে গৃহীত।৩৬৬॥
গবর্ণমেন্ট উল্লিখিত ভীষণ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ লইবার মানসে তৎপর বৎসর শীতকালে একটি যুদ্ধ যাত্রার উদ্যোগ করিয়াছিলেন। ইতিমধ্যে (১৮৬১ খ্রিঃ অঃ জানুয়ারিতে) একদল কুকি ত্রিপুরেশ্বরদিগের প্রাচীন রাজধানী উদয়পুর আক্রমণ করে। উদয়পুরে ত্রিপুরেশ্বরের একটি সেনানিবাস ছিল। তাহাতে একজন হাওয়ালদার ও ২৬ জন সিপাই থাকিত ইহার কুকিদিগের নাম শ্রবণ মাত্র “মেগেজিন” ফেলিযা পলায়ন করে। কুকিগণ সেই মেগেজিনের বারুদ, গুলি ও গোলা প্রাপ্ত হইয়া প্রবল বিক্রমে উদয়পুর ও তাহার নিকটবর্ত্তী দুইখানা গ্রাম ও একটি প্রকাণ্ড বাজার ভষ্মীভূত ও কতকগুলি লোকের প্রাণবধ করিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখে যাত্রা করে। তথায় চাকমা সরদার কালিন্দী রাণীর অধিকৃত কয়েক খানা গ্রাম অগ্নি দ্বারা দগ্ধ করিয়াছিল। গবর্ণমেন্টের একদল পুলিশ সৈন্যের সহিত তাহাদের একটি ক্ষুদ্র যুদ্ধ হয়, কুকিগণ তাহাতে বিশেষরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া পর্বতে পলায়ন করিয়াছিল।
এই সকল ঘটনার পর কুকিদিগকে বিশেষরূপে নির্যাতন করিবার মানসে ত্রিপুরেশ্বরের সহিত উপযুক্ত পরামর্শ করিবার জন্য কাপ্তান গ্রেহাম সাহেব আগরতলায় প্রেরিত হন। সেই সকল বৃত্তান্ত ইতিপুর্বে বর্ণিত হইয়াছে। তৎপর বৎসর বর্ত্তমান মহারাজ রাজ্যাধিকার প্রাপ্ত হন।॥৩৬৭। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের নিকটবর্ত্তী স্থানে কিম্বা ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণাংশে কোন গণ্ডগোল হয় নাই, কিন্তু উত্তরাংশে শ্রীহট্ট জেলার সীমান্তবর্তী স্থানে আদমপুরের বিখ্যাত হত্যাকাণ্ড সম্পাদিত হয়।
লালছোকলার পুত্র মুরছুইলাই বিখ্যাত কুকি সরদার সুকপাইলালের ভগিনী ভানুইথাঙ্গীকে বিবাহ করেন[১৫]। কোন কারণবশত মরছুইলাল স্বীয় পত্নী ভানুইথাঙ্গীকে অপমানিত করেন। উপযুক্ত ভ্রাতার উপযুক্তা ভগিনী সেই অপমান সহ্য করিতে না পারিয়া স্বীয় ভ্রাতা সুকপাইলালকে তৎ সংবাদ জ্ঞাপন করিয়াছিলেন। তাহাতেই কুকিদিগের মধ্যে একটি গণ্ডগোল উপস্থিত হয়। মতান্তরে রাজা মুরছুইলালের সহিত কুমারি ভানুই থাঙ্গার বিবাহ কালে যৌতুক প্রদান করিবার জন্য আদমপুর আক্রমণ করিয়া কতকগুলি দাস-দাসী সংগ্রহ করা হইয়াছিল। প্রকৃত ঘটনা যাহাই হউক না কেন, মুরছুইলাল, সুকপাইলাল, রাংবুম ও লালহুলন নামক চারজন কুকিরাজা সম্মিলিত হইয়া ত্রিপুরারাজ্যের অন্তর্গত কতকগুলি গ্রাম ও শ্রীহট্টের অন্তর্গত ॥৩৬৮॥ আদমপুরের নিকটবর্ত্তী তিনখানা গ্রাম অগ্নিদ্বারা দগ্ধ ও কতকগুলি লোক বন্দি করিয়া লইয়া যায়। ইঁহাদের মধ্যে মুরছুইলাল ও রাংবুম ত্রিপুরেশ্বরের অধীন এবং সুকপাইলাল সম্পূর্ণ স্বাধীন। লালহুলন মুরছুইলালের পিতৃব্যপুত্র ইহা পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে।
আদমপুরের হত্যাকাণ্ডের পর ১৮৬২-৬৩ খ্রিস্টাব্দে গবর্ণমেন্ট কৌশলে কুকি সরদারদিগকে বাধ্য করিয়া পূর্বসীমান্তে শান্তি সংস্থাপন করিতে যথাসাধ্য যত্ন করিয়াছিলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তদানীন্তন সুপরিনটেন্ডেন্ট গ্রেহাম রতন পুঁইয়ার সহিত সন্ধিস্থাপন করিলেন। তৎকালে ইহা অবধারিত হয় যে সীমান্ত প্রদেশে শান্তি রক্ষার জন্য গবর্ণমেন্ট প্রতি বৎসর রতন পুঁইয়াকে ৪০০ টাকা, হাউলংদিগকে ৮০০ টাকা ও সাইলোগণকে ৮০০ টাকা প্রদান করিবেন।
উত্তরদিকে কাছাড়ের ডিপুটী কমিসনর ষ্টুয়ার্ট সাহেব সুকপাইলাল ও মোল্লা সরদার বনপুঁইলালের সহিত সামান্য প্রকারের সন্ধি সংস্থাপন করিয়াছিলেন। সুকপাইলাল গবর্ণমেন্টের আনুগত্য স্বীকার করত শান্তিরক্ষা করিলে তাহাকে বার্ষিক ৬০০ টাকা গবর্ণমেন্ট হইতে প্রদত্ত হইবে, এইরূপ প্রস্তাব হইয়াছিল।
আদমপুরের হত্যাকাণ্ডের সময় কুকিগণ যে সকল স্ত্রীলোককে ধৃত করিয়া লইয়া যায়। তন্মধ্যে কয়েকটি পলায়ন॥৩৬৯॥ পূর্বক কাছাড়ে উপস্থিত হইয়াছিল। অন্যান্য স্ত্রীলোকগুলিকে কুকিগণ বিবাহ করে।
১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের পার্বত্য প্রদেশে কুকিগণ নানা প্রকার উৎপাত আরম্ভ করে। কিন্তু সুখের বিষয় এই যে, তাহারা বাঙ্গালার সমতল ক্ষেত্রে প্রবেশ করে নাই।
১৮৬৫-৬৬ খ্রিস্টাব্দে কুকিগণ বঙ্গীয় সমতল ক্ষেত্রে কোনরূপ অত্যাচার করে নাই। কিন্তু তৎকালে যে তাহারা তাহাদের চির অভ্যস্ত কার্য্যে বিরত ছিল, এমত নহে, কারণ সেই সময় তাহারা আত্মকলহে নিযুক্ত ছিল। সৌভাগ্যবশত আমাদের কর্তৃপক্ষগণের সতর্কতায় তাহারা সমতলক্ষেত্রে প্রবেশ করিবার সুবিধা প্রাপ্ত হয় নাই।
১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসে প্রায় ৫০০ হাউলং তাহাদের রাক্ষস বৃত্তি চরিতার্থ করিবার জন্য সমবেত হইয়াছিল। কর্তৃপক্ষগণ রতন পুঁইয়ার দ্বারা এই সংবাদ শ্রবণ মাত্র চট্টগ্রামের পূর্ব সীমান্ত রক্ষার জন্য যত্নবান হইলেন। হাউলংগণ সেই দিকে সুবিধা প্রাপ্ত না হইয়া ত্রিপুরা রাজ্যাভিমুখে ধাবিত হইল। সৌভাগ্যবশত হউলংগণ এবার ত্রিপুরা রাজ্যে কোনরূপ উপদ্রব করিতে সক্ষম হয় নাই।
১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগে সুকপাইলাল এবং বনপুইলালের অধীন কুকিগণ কাছাড়, ত্রিপুরা এবং মণিপুর রাজ্যে সমভাবে অত্যাচার করিয়াছিল। এই সময় মণিপুরের ॥৩৭০। ভূতপূর্ব নরপতি মারজিতের পুত্র কানাই সিংহ পৈত্রিক সিংহাসন অধিকার করিবার মানসে একটি ক্ষুদ্র সেনাদল সংগ্রহ করিয়া কুকিদিগকে উত্তেজিত করেন। কুমার কানাই সিংহ কুকিগণের সহিত বিশেষরূপ প্রীতি স্থাপন করিয়াছিলেন। ত্রিপুরা রাজকুমার নীলকৃষ্ণ কানাই সিংহের ভগিনী পুত্র এবং এজন্যই খণ্ডলের বিখ্যাত হত্যাকাণ্ড নীলকৃষ্ণের চক্রান্তে সম্পাদিত হইয়াছিল বলিয়া ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণ তাঁহাকে প্রধানত কারাগারে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ত্রিপুরার ভূতপূর্ব ম্যাজেস্ট্রেটের গর্ডন সাহেবের রিপোর্ট অনুসারে গবর্ণমেন্ট নীলকৃষ্ণকে নির্দোষ বলিয়া মুক্তি প্রদান করেন।১৬ খণ্ডলের ভীষণ হত্যাকাণ্ড নীলকৃষ্ণের চক্রান্তে সম্পাদিত হইয়াছিল কি না, তাহা স্থিরভাবে লিপিবদ্ধ করা সুকঠিন। কিন্তু কোন কোন কুকি সরদারের সহিত যে নীলকৃষ্ণের গুপ্ত প্রণয় ছিল তাহা আমরা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতে পারি। বিশেষত কাছাড়ের ভূতপূর্ব ডিপুটী কমিশনার (পশ্চাৎ বাঙ্গালা গবর্ণমেন্টের প্রধান সেক্রেটারি) এডগার সাহেব কুকিপ্রদেশে ভ্রমণকালে তাহার বিশ্বস্ত প্রমাণ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ত্রিপুরার মহারজের ধর্মনিষ্ঠ কর্মচারীগণ কোন কোন সময় বৈরীনিৰ্য্যাতন মানসে কোন কোন নির্দোষ ভদ্রলোককে ॥৩৭১॥ কুকি অত্যাচারে সংসৃষ্ট বলিয়া কর্তৃপক্ষগণ নিকট প্রচার করিতে কিছুমাত্র লজ্জা বোধ করেন নাই। কুমার নীলকৃষ্ণের প্রিয় সুহৃদ ঢাকা নিবাসী বাবু বংশীলোচন মিত্র এবং উজির বংশধর শিবজয় ঠাকুরকে খণ্ডলের বিখ্যাত হত্যাকাণ্ডে সংলিপ্ত করিবার জন্য রাজ সরকার পক্ষে একটি ঘৃণিত চক্রান্ত হইয়াছিল। ইহা নিতান্ত দুঃখের সহিত আমরা উল্লেখ করিতেছি যে, যদিচ বারংবার ত্রিপুরার রাজপক্ষ হইতে এইরূপ ব্যবহার গবর্ণমেন্ট অবিশ্বাস করিয়া আসিতেছেন, তথাপি এইরূপ অনুষ্ঠানে মহারাজ কিছুমাত্র লজ্জা বোধ করেন না। বর্তমান মহারাজের কর্মচারিগণ এই সূত্র অবলম্বন করিয়া ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে রাজপুত্র নীলকৃষ্ণ ও চক্রধবজকে কারাগারে নিক্ষেপ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে কুমার নবদ্বীপচন্দ্রকে কারাগারে নিক্ষেপ করিবার জন্য বর্ত্তমান মহারাজের প্রিয় দেওয়ান- ক্ষুদ্রচাণক্য-রাম মাণিক্য ও কণিক-শিষ্য ঈশানচন্দ্র এই ঘৃণিত পন্থা অবলম্বন করিয়াছিলেন। কিন্তু ম্যাজেস্ট্রেটকাওয়েলী সাহেব পাপাত্মাগণের পাপ চক্রান্তে আস্থা প্রদর্শন করেন নাই।
১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের আরম্ভে গবর্ণমেন্ট কুকিদিগের বিরুদ্ধে তিনদল সৈন্য প্রেরণ করেন। এই যুদ্ধ যাত্রার ফল ॥৩৭২॥ সন্তোষজনক হয় নাই। তদনন্তর ঐ বৎসরের শেষ ভাগে বৃহৎ একদল সৈন্য কুকিদিগের প্রতিকূলে প্রেরণ করিবার জন্য সার উইলিয়ম গ্রে, গবর্ণর জেনারেল লর্ড মেও বাহাদুর নিকট প্রস্তাব করেন। লর্ড মেও সেই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিয়া সীমান্ত প্রদেশ সুরক্ষিত করিবার জন্য অন্যান্য উপায় অবলম্বন করিতে আদেশ করেন। তৎকালে পর্বত ত্রিপুরা রাজ্যে পলিটিকেল এজেন্ট নিযুক্ত করিবার প্রস্তাব বিশেষরূপে অনুমোদন করেন। প্রকৃতপক্ষে এই পার্বত্য প্রদেশের আভ্যন্তরিক অবস্থা অবগত না হইয়া বারংবার যুদ্ধ ঘোষণা দ্বারা কেবল গবর্ণমেন্টের অর্থ নাশ মাত্ৰ হইতেছিল।
প্রায় একবৎসর কাল কর্তৃপক্ষগণ সরদারদিগকে কৌশলে হস্তগত করিবার জন্য বিশেষ যত্ন করিয়াছিলেন। এই সময় কাছাড়ের ডিপুটী কমিসনর এডগার সাহেব কুকিপ্রদেশস্থিত বেপারি বাজারে গমন পূর্বক বিখ্যাত সরদার সুকপাইলালকে এক আশ্চৰ্য্য খেলাত প্রদান করিলেন[১৭]। কিন্তু আমাদের গবর্ণমেন্টের সুতীক্ষ্ণ নীতি শাস্ত্র বর্বর কুকি ॥৩৭৩॥ জাতির হস্তে ভোতা হইয়া দাঁড়াইল। কুকিগণ বিবেচনা করিল “আমরা যতই অত্যাচার করিব ততই সাহেবগণ আমাদিগকে নানাপ্রকার উপহার প্রদান পূর্বক সন্তুষ্ট করিতে যত্ন করিবেন। সুতরাং সাহেবদিগের নিকট হইতে কিছু আদায় করিতে হইলেই পার্বত্য প্রদেশ হইতে বহির্গত হইয়া নরহত্যা গৃহদাহ প্রভৃতি কাৰ্য সম্পাদন করিতে হইবে।” এডগার সাহেব সুকপাইলালকে খেলাত প্রদান পূর্বক শিলচরে প্রত্যাবর্তন করিবার পূর্বেই সংবাদ পাইলেন যে, কুকিগণ তাঁহাদের চির অভ্যস্থ কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছে। অল্পকাল মধ্যে কুকিগণ কাছাড় শ্রীহট্ট, ত্রিপুরা এবং মণিপুর রাজ্যের অন্তর্গত বিবিধ স্থান আক্রমণ করত তাহাদের চিরঅভ্যস্ত নহরত্যা গৃহদাহ লুণ্ঠন ইত্যাদি কাৰ্য্য সম্পাদন করে। এই সময় তাহারা অনেকগুলি যুবতী স্ত্রীলোক বন্দি করিয়া লইয়া যায়। স্মরণীয় কাল মধ্যে কোন ॥৩৭৪॥ এক বৎসরে এতগুলি স্থান আক্রান্ত হয় নাই[১৮]। কাছাড়ের অন্তর্গত আলেকজেন্ডারপুর নামক চাক্ষেত্র আক্রমণ করিয়া কুকিগণ কেবল যে কতকগুলি কুলি বধ করিয়াছিল এমত নহে, চা ক্ষেত্রের মেনেজার উইনচেষ্টার সাহেবকে বধ করিয়া তাহার শিশু কন্যাকে অপহরণ করিয়াছিল।
এই সকল অত্যাচার কাহিনী বাঙ্গালা গবর্ণমেন্টের কর্ণগোচর হইলে গবর্ণমেন্ট বুঝিতে পারিলেন যে কেবল ॥৩৭৫॥ বেলওয়ারি বুতামের হার দ্বারা এই বর্বর জাতিকে শান্ত করা অসম্ভব। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ১১ জুলাই এক ॥৩৭৬ বিজ্ঞাপনী প্রচার করেন। তাহাতে লিখিত হইয়াছিল যে, পূর্ব সীমান্তে স্থায়ী রূপে শান্তি স্থাপন জন্য আগামী শীত ঋতুতে একটি সামরিক অভিযান হইবে; ত্রিপুরা ও মণিপুরপতি এই অভিযানে আমাদিগকে সাহায্য করিবেন। এই অভিযানের কার্যারম্ভের পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্যে একজন পলিটিকেল এজেন্ট নিযুক্ত করিতে হইবে। এই অভিযান দুই ভাগে বিভক্ত হইবে। একদল সৈন্য চট্টগ্রাম হইতে গমন করিবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ডিপুটি কমিশনার লেউইন সাহেব সেই সেনাদলের সহিত সিবিল অফিসারস্বরূপ গমন করিবেন। হাউলং সাহেব সেই সেনাদলের সহিত সিবিল অফিসারস্বরূপ গমন করিবেন। হাউরং ও সাইলোদিগকে নির্যাতন করা ইহাদের প্রধান কার্য্য হইবে। দ্বিতীয় দল কাছাড় হইতে খছাক (লুসাই ) কুকিদিগের বিরুদ্ধে গমন করিবে। কাছাড়ের ডিপুটি কমিসনর এডগার সাহেব এই সেনাদলের সহিত সিবিল অফিসারস্বরূপ গমন করিবেন।
বিগত শীতঋতুতে কোন্ কোন্ সরদার দ্বারা উল্লেখিত ভীষণ অত্যাচার সংসাধিত হইয়াছে, তাহা স্থিরভাবে নির্ণীত হয় নাই। অভিযান সময়ে তাহা স্থির করিতে পারিলে প্রকৃত অপরাধীর উপযুক্ত দণ্ড প্রদান করিতে হইবে। বন্দিগণকে মুক্ত করিতে হইবে। যাহাদের নিকট বন্দিগণ আবদ্ধ রহিয়াছে তাহাদিগকে আত্মসমর্পণ করিবার জন্য আদেশ করা হইবে। সেই আদেশ অগ্রাহ্য করিলে তাহার গ্রাম, শস্যাগার ও শস্য ॥৩৭৭। ক্ষেত্রে অগ্নিদ্বারা দগ্ধ করিতে হইবে। এবং ভবিষ্যতে যাহাতে কুকিগণ দ্বারা কোনরূপ অত্যাচার সংসাধিত না হয়, তজ্জন্য সরদারগণ হইতে জামিন লইতে হইবে। প্রত্যেক সেনাদলের সহিত এক কিম্বা ততোধিক সারভে অফিসার গমন করিবেন। তাহাদিগকে সেই পাৰ্বত্য প্রদেশের মানচিত্র প্রস্তুত করিতে হইবে। ইহাই অভিযানের অভিপ্রায়।
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে কাছাড় ও চট্টগ্রাম দুইটি বৃহৎ সেনাদল উপস্থিত হইল। চট্টগ্রামের সেনাদলের নায়ক হইলেন জেনারন ব্রাউনলো, জেনারল বোরসিয়ার কাছাড় সেনাদলের সেনাপতি পদে নিযুক্ত হইলেন। ডিসেম্বর মাসের মধ্যভাবে অভিযান আরম্ভ হয়।
জেনারল ব্রাউনলো সাইলো ও হাউলং সরদারগণকে একপ্রকার বিনাযুদ্ধে অবনত মস্তক করিয়া মেরি উইনচেষ্টার এবং অন্যান্য বন্দিগণকে উদ্ধার করিয়াছিলেন। ৯ই ডিসেম্বর ব্রাউনলো দেমাগিরি যাত্রা করেন। ২৩১ মাইল পার্বত্য পথে জয়ডঙ্কা নিনাদিত করিয়া স্বীয় অনুচরগণ সহ ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন। বিখ্যাত কুকি সরদার রতন পুঁইয়া জেনেরল ব্রাউনলো ও তাঁহার অনুচরদলের পথ প্রদর্শক হইয়াছিলেন।
কাছাড়দলের নায়ক বোরসিয়া স্থানে স্থানে অনলক্রিয়া প্রদর্শন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। অন্যান্য কুকি সরদার ॥৩৭৮॥ গণকে নিৰ্য্যাতন করিয়া তিনি অবশেষে সর্বপ্রধান ও পরাক্রমশালী কুকি রাজা লালবোবা হইতে ১ জোড়া উৎকৃষ্ট গজদন্ত, একজোড়া ঘুং ১৯, ১ ছড়া হার, ১০টি ছাগল, ১০টি শূকর ৫০টি মোরগ ও ২০ মণ ধান্য এবং মণিয়ার খাল ও নন্দীগ্রাম চাক্ষেত্রে লুণ্ঠন করিয়া কুকিগণ যে কয়েকটি বন্দুক লইয়া গিয়াছিল তাহার দ্বিগুণ সংখ্যক বন্দুক দণ্ডস্বরূপ গ্রহণ করত ১০ মার্চ কাছাড়ে প্রত্যাবৰ্ত্তন করেন। তিনি কাছাড় হইতে ১৯৩ মাইল দূরে অবস্থিত লালবরোর সুদৃঢ় গ্রামে গমন করিয়াছিলেন। এই যুদ্ধ যাত্রায় খছাক, সাইলো ও হাউলং প্রভৃতি কুকি সরদারগণকে ব্রিটসি বৈজয়ন্তীর নিকট মস্তক অবনত করিতে হইয়াছিল।
উল্লেখিত দুইটী সেনাদলের সহিত যে সকল সারভে অফিসার গমন করিয়াছিলেন তাঁহারা এই অল্পকাল মধ্যে চট্টগ্রাম ও কাছাড়ের মধ্যবর্তী ৬৫০০ বর্গমাইল ভূমির মানচিত্র প্রস্তুত করতে সক্ষম হন। এই সময় ত্রিপুরা রাজ্যের পূর্বসীমা রেখা নির্ণয়ের প্রস্তাব উপস্থিত হইয়াছিল। কুকিগণ কর্তৃক কোনরূপ অত্যাচার কার্য্য সম্পন্ন হইলেই, ত্রিপুরেশ্বরগণ তাঁহাদের চির অভ্যস্ত “বাধা বোলে” উত্তর দিয়াছেন যে “ইহারা আমার প্রজা নহে।” পক্ষান্তরে ত্রিপুরা রাজ্যের পূর্বসীমা রেখা নির্দ্দেশ করিতে হইলে তাঁহারা ॥৩৭৯॥ ত্রিপুর কুলতিলক ধন্যমাণিক্য ও বিজয় মাণিক্যের নাম স্মরণ পূর্বক ব্রহ্মরাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিতে নিতান্ত লালায়িত হইয়া থাকেন। নিতান্ত পক্ষে টেপাই নালা ত্রিপুরা রাজ্যের পূর্বসীমা বলিয়া প্রদর্শন করিতে তাঁহারা বিশেষরূপে সক্ষম; কিন্তু ত্রিপুরার পলিটিকেল এজেন্ট পাউরার সাহেব ত্রিপুরা রাজ্যের পূর্ব প্রান্তে সারবেয়ারগণ সহিত পরিভ্রমণ করিয়া উক্ত রাজ্যের আধুনিক পূর্বসীমা বিশেষ দক্ষতার সহিত নির্দ্দেশ করিয়াছিলেন[২০]। ইহা দ্বারা সুকপাইলাল ও অন্যান্য খছাক কুকিদিগের বাসভূমি চিরকালের তরে ত্রিপুরা রাজ্য হইতে বিচ্ছিন্ন করা হইয়াছে। সারভেয়ারগণ পর্বত শ্রেণী অপেক্ষা নদী দ্বারা সীমা নির্ণয় প্রয়োজনীয় বলিয়া রিপোর্ট করেন, তদনুসারে গবর্ণমেন্ট জাম্পুই ও ॥৩৮০। হিচক পর্বত শ্রেণীর মধ্যবর্ত্তী লঙ্গাইনদী (তাহার উৎপত্তি স্থান বেতলংশিব পর্য্যন্ত তৎপর) ধলেশ্বরীর (ডলুজুরীর) জলপ্রপাত সমুৎপন্ন স্রোত রেখার অতিক্রম পূর্বক সাৰ্দ্দিং ও ফেণী নদী দ্বারা ত্রিপুরা রাজ্যের পূর্বসীমা নির্ণয় করিয়া দিয়াছেন২১। এই সীমারেখার পূর্বদিকে লুসাই ভূমি। ত্রিপুরেশ্বর সেই দেশবাসীর সহিত কোনরূপ সংশ্রব রাখিতে পারিবেন না, গবর্ণমেন্ট সেই প্রদেশে রাজনৈতিক কর্তৃত্ত্ব করিবেন।
উল্লেখিত অভিযান সম্বন্ধীয় কাৰ্য সম্পন্ন হইলে সার জর্জ কেম্পবল বলিয়াছিলেন, “কুকি অত্যাচার সম্পূর্ণরূপে নির্বারিত হইয়াছে। চা-কর এবং আমাদের প্রজাগণ শান্ত ভাবে কৃষিক্ষেত্রে বিস্তার করিতে পারিবে।”
উল্লেখিত অভিযানের পর কয়েক বৎসর কুকিগণ দ্বারা বিশেষ কোন অত্যাচার সংসাধিত হয় নাই। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে কুকি প্রদেশে দুর্ভিক্ষ হয়। তৎকালে কুকিগণ কাছাড়ের ডিপুটী কমিসনর সাহেব নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছিল। কুকি প্রদেশ মধ্যে চাংশীল (প্রাচীন বেপারি ॥৩৮১॥ বাজার) সোনাই এবং টেপাই মুখ নামক স্থানে তিনটি হাট-বাজার ছিল। কাছাড় ও শ্রীহট্টের বাঙ্গালি বণিকগণ তথায় নানা প্রকার পণ্য দ্ৰব্য লইয়া গমন করিত এবং সেই দ্রব্য কুকিগণ নিকট বিক্রয় করিয়া তাহারা কুকিগণ হইতে সুলভ মূল্যে রবার খরিদ করিয়া আনিত। ক্রমে কুকিরাজগণ অতিরিক্ত শুল্ক বণিকের নিকট দাবি করিতে লাগিলেন। তদ্বারা সেই তিনটি বাজারের অবনতি আরম্ভ হইল। অবশেষে রবারের বাণিজ্য বন্ধ হওয়াতে বাজারগুলি সম্পূর্ণরূপে ভাঙ্গিয়া গেল। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হইলে গবর্ণমেন্ট ধান্য ও তণ্ডুল প্রেরণ করত বাঙ্গালি বণিকদিগকে উৎসাহিত করিয়া ঐ সকল বাজারে তণ্ডুল প্রেরণ করিয়াছিলেন।
১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে সার রিচার্ড টেম্পল পার্বত্য চট্টগ্রামে জনৈক পলিটিকেল অফিসার নিযুক্ত পূর্বক সমগ্র কুকি প্রদেশ ও ত্রিপুরা রাজ্য তাঁহার শাসনাধীনে করিবার প্রস্তাব করেন। আসামের চিকমিশনার কর্ণেল ফিটিঞ্জ ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিয়া বলেন, “লুসাই কুকিগণ কাছাড়ের নিকটবর্ত্তী স্থানে বাস করিতেছে, চট্টগ্রাম হইতে ইহাদিগকে শাসন করা কঠিন হইবে। সুম্মা নদীর তীরস্থ প্রদেশে শান্তি রক্ষার জন্য আগরতলায় জনৈক পলিটিকেল এজেন্ট রাখাই আমি সম্পূর্ণ সঙ্গত বলিয়া বিবেচনা করি।” ॥৩৮২ কর্ণেল ফিটিঞ্জের মন্তব্য অনুসারে ইণ্ডিয়া গবর্ণমেন্ট সার রিচার্ড টেম্পলের প্রস্তাব কার্য্যে পরিণত করেন নাই।
১৮৭৬-৭৭ খ্রিস্টাব্দে কুকিগণ ভীষণ আত্মকলহে নিযুক্ত ছিল। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার পলিটিকেল এজেন্ট গবর্ণমেন্টকে জানাইলেন যে, সীমান্ত প্রদেশ রক্ষা করিবার জন্য কমলপুর, কৈলাসহর, ফারুয়াধর্ম্মনগর, একছবি, উদয়পুর, ঋষ্যমুখ, খাদলামাদলা এবং আগরতলায় মহারাজের যে আটটা সেনা নিবাস আছে, তাহার অধিকাংশ সৈন্যগণেরই বারুদগুলি প্রভৃতির নিতান্ত অভাব দেখা যাইতেছে এবং সৈন্যগণ নিয়মিতরূপে বেতন পাইতেছে না।’ ইন্ডিয়া গবর্ণমেন্ট এই সংবাদ শ্রবণমাত্র আদেশ করিলেন যে, “সীমান্ত প্রদেশের শান্তি রক্ষা করিবার জন্য মহারাজ যেরূপ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আছেন তাহাকে অবশ্যই তাহা প্রতিপালন করিতে হইবে।”
১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে একদল কুকি চাংশীল বাজার লন্ঠন করিয়াছিল। বণিকগণ এইরূপে ক্ষতিগ্রস্থ হইয়া কাছাড়ে উপনীত হন। ডিপুটী কমিসনার এই বৃত্তান্ত অবগত হইয়া রাজা সুকপাইলালকে বণিকদিগের ক্ষতিপূরণ জন্য এক সহস্র টাকা জরিমানা করেন। উক্ত টাকা প্রদান না করিলে চাংশীলে কোন বাঙ্গালি বণিক গমন করিবে না এইরূপ বলা হইয়াছিল। সুকপাইলাল ইহার অধিকাংশ পরিশোধ করিয়াছিলেন, অবশিষ্ট দণ্ড হইতে চিফ-কমিশনার তাঁহাকে ॥৩৮৩॥ মুক্তি প্রদান করেন। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে সুকপাইলালের মৃত্যু হয়। ১৮৮১-৮২ খ্রিস্টাব্দে কুকিগণ ভীষণ আত্মকলহে নিযুক্ত ছিল। গবর্ণমেন্টের কৃপায় নিরীহ বাঙ্গালি হত্যার পন্থা বন্ধ হওয়ায় তৎকালে তাহারা স্বজাতীয় নরহত্যা দ্বারা আপনাদের রাক্ষস বৃত্তি চরিতার্থ করিতেছিল। এই সময়ে কুকি প্রদেশে পুনর্বার দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হয়। গবর্ণমেন্ট তৎকালে প্রচুর পরিমাণে সাহায্য করিয়াছিলেন। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে একদল সুক্তি কুকি টেপাই মুখের বাজার আক্রমণ ও লুণ্ঠন করিয়া একটি বালককে বন্দি করিয়া লইয়া যায়।
১৮৮৪ হইতে ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দ পৰ্য্যন্ত কুকিগণ সমতলক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে পারে নাই। পর্বত মধ্যেই সময় সময় তাহাদের রাক্ষসবৃত্তি চরিতার্থ করিয়াছিল। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে লেপ্টেনেন্ট ষ্টুয়ার্ট যৎকালে পার্বত্য প্রদেশে জরিপি কার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন। সেই সময় (৩ ফেব্রুয়ারি) সিন্ধুগণ বস্ত্রাবাস মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাঁহার ও দুইজন ইংরেজ সৈন্য ও একজন দেশীয় পদাতির প্রাণ বধ করে। তখন গবর্ণমেন্ট বুঝিতে পারিলেন যে কেবল আত্মরক্ষা নীতি অবলম্বন দ্বারা এই বর্বর পাশবাচার হইতে বিরত রাখা অসম্ভব। সুতরাং তৎপরবর্ত্তী শীত ঋতুতে একটি বৃহদাকার অভিযানের প্রয়োজন হইল। ॥৩৮৪॥ ১৮৮৮-৮৯ খ্রিস্টাব্দে ‘চীন-লুসাই” অভিযান হইয়াছিল। ব্ৰহ্ম হইতে একদল ও চট্টগ্রাম হইতে একদল এবং কাছাড় হইতে একদল সৈন্য কুকি প্রদেশে প্রেরিত হইয়াছিল। এই অভিযান দ্বারা কুকিদিগকে বিশেষরূপে শাস্তি প্রদানপূর্বক অনেকগুলি বন্দিকে মুক্ত করা হইয়াছিল। তদন্তর গবর্ণমেন্ট কুকি প্রদেশ দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া “উত্তর লুসাই” ও “দক্ষিণ লুসাই” নামক দুইটী প্রকাণ্ড জেলা সৃষ্টি করিয়াছেন। এই দুই জেলার পরিমাণ বোধ হয় ৫০০০০ বর্গমাইল হইতে ন্যুন হইবে না। মরে সাহেব প্রথমত দক্ষিণ লুসাই জেলার শাসন কর্তৃত্বে নিযুক্ত হন। তদন্তর তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের এসিষ্ট্যান্ট কমিশনারের পদে নিযুক্ত হইলে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে ১ মে কাপ্তান সেক্সপিয়ার উক্ত পদে নিযুক্ত হন। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ১৮ মে কাপ্তান ব্রাউন উত্তরলুসাই জেলার পলিটিকেল অফিসার হইয়া আজিয়াল দুর্গে গমন করেন।
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ৯ সেপ্টেম্বর প্রাতে কাপ্তান ব্রাউন সৈরং হইতে চাংশীল গমন করিতেছিলেন। সঙ্গে তাঁহার ক্লার্ক বাবু কামিনীকুমার সেন, ১জন দফাদার ও ২ জন পুলিশ সৈন্য এ কতকগুলি কুলিমাত্র ছিল। পথিমধ্যে কুকিগণ তাঁহাদিগকে আক্রমণ করত নিতান্ত নিষ্ঠুরতার সহিত, ॥৩৮৫॥ কাপ্তান ব্রাউন, কামিনীকুমার সেন ও তাঁহাদের ১৬ জন অনুচরকে বধ করে। মৃত সরদার সুকপাইলালের আত্মীয়বর্গ দ্বারা এই ভীষণ সম্পাদিত হইয়াছিল। আসামের চিফ্-কমিশনার ও গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর এই সংবাদ অবগত হইয়া উপযুক্তরূপে তাহার প্রতিশোধ লইয়াছিল।
অধুনা গবর্ণমেন্ট এই বর্বর জাতিকে যেরূপ কৌশলের সহিত ব্রিটিশ শাসন যন্ত্রের মধ্যে আনয়ন করিতেছেন, বোধ হয় কিছুকাল পরে এই রক্ত পিপাসু বর্বরগণ সাওতালদিগের অপস্থাপন্ন হইবে। ইহারা শতাধিক বৎসরকাল আমাদিগের প্রতি যেরূপ পাশব অত্যাচার করিয়াছে, সমগ্র কুকি জাতির রুধির ধারা দ্বারাও তাহার সম্পূর্ণ প্রতিশোধ হইতে পারে না; কিন্তু ক্ষমাই ধর্মের একটি প্রধান অঙ্গ। আমরা ভরসা করি আমাদের গবর্ণমেন্ট ইহাদিগকে ভীষণ শাসন যন্ত্রে নিষ্পেষিত না করিয়া সভ্যতার আলোক প্রদর্শন পূর্বক কুকিদিগের উদ্ধারের জন্য একটুকু কটাক্ষপাত করিবেন। আমরা ইহাদিগকে সভ্যতা শিখরের শীর্ষদেশবাসী কোন উন্নত জাতির বিকৃত আদর্শ দর্শন করিতে অভিলাষী নহি। কুকিগণের জাতীয় জীবন ইতিহাসের পৃষ্ঠা হইতে বিলুপ্ত হউক, ইহা আমাদের অভিপ্রায় নহে। কুকিগণ তাহাদের জাতীয় ভাব ও ধর্ম রক্ষা করত শনৈঃ পদবিক্ষেপ দ্বারা উন্নতির ॥৩৮৬॥ তুঙ্গ শৃঙ্গে আপনাদের জাতীয় আসন সংস্থাপন করুক, ইহাই আমাদের অভিলাষ। কাপ্তান লেউইন পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদিগের প্রতি যেরূপ ব্যবহার করিবার জন্য লিখিয়াছেন, আমরাও এই বর্বর জাতির প্রতি তদ্রুপ ব্যবহার করিবার জন্য গবর্ণমেন্টকে বিনীতভাবে অনুরোধ করিতেছি।[২২]।৩৮৭॥
.
টীকা
১. Asiatic Researches. Vol. II-P. 187 and Vol. VII-P. 183.
২. Lewin’s Hill Tracts of Chittagong. P. 99.
৩. কাপ্তান লেউইন লিখিয়াছেন যে, They differ entirely from the other hill tribes of Burman Arracanese origin, in that their origin, faces bear no marks of Tartar or Mongolian descent. They are swarthy in complexion and their cheeks are generally smooth among the Howlong tribe. Howerer, one meets many man having long bushy beards. I should be inclined to attribute this to a mixure of Bengali blood. From the many captives they have, from time to time, carried কিন্তু উপসংহারে লেউইন ভ্রমে পতিত হইয়া লিখিয়াছেন, but I have away, seen old men, white bearded and we possess no record of any Lhossai raids so long as even thirty or forty years ago. আমরা গবেষণা দ্বারা নির্ণয় করিয়াছি যে, ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে হইতে কুকি জাতির অত্যাচারের সূত্রপাত হয়। তদাবধি বাঙ্গালি রমণীসংযোগে কুকিবংশ বৃদ্ধি হইতেছে।
৪. বঞ্জুগী ও পংখুজাতির ঈশ্বর “পতৈন”।
৫. Mackenzie’s North East Frontier- P-274
৬. Mackenzie’s North East Frontier- P-217
৭. Wilson’s Burmese War Appendix P. XXVII
৮. From the sources of the Jeeree Fiver along the western bank, to its confluence with the Borak; thence South on the Western bank of latter river to the mouth of the Chikoo (or Tipai) nullah, which marks the triple boundary of Manipur, Cachar and Tripurah. On the south the limits have never been accurately defined, and we only know that on this side the line is formed by the northern foot of lofty mountains inhabited by the Poitoo Kookies and by wild and unexplored tracts of territory subject to Tripurah. This dense- ly wooded and mountainous region appears to commence at a dis- tance of between 40 and 50 miles from the southern bank of the Soormah. (Pembertons’ Report, 1835 )
এ সম্বন্ধে সার আলেকজাণ্ডার মেকেঞ্জি লিখিয়াছেন : The southern extremity of the Suddhashur Hills was the south-east corner of Cachar. It would appear from this that the narrow hilly tract run- ning down between Hill Tipperah and Manipur, and represented in our most recent maps as part of Cachar, was in Pemberton’s time considered to be part of Hill Tipperah.
ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণ ইহাকে Gnoor-Shai-Ion, এবং Mischoey Looee প্রভৃতি আখ্যা দ্বারা পরিচিত করিয়াছেন। বোধ হয় এজন্য তাঁহারা ত্রিপুরা রাজদরবার হইতে ইহার সম্বন্ধে বিশুদ্ধ উত্তর প্রাপ্ত হন নাই। ইতিহাস লেখক স্বয়ং মুরছুইলালকে দর্শন করিয়াছেন। ইনি ত্রিপুরেশ্বরের অধীনস্থ সামন্ত নরপতি।
১০. Mackenzie’s North East Frontier – P – 280
১১. Early in January 1860, reports were received at Chittagong, of assembling of a body of 400 or 500 Kookies at the head of the River Fenny, and soon the tale of burning villages and slaughtered men gave token of the work they had on hand. On the 31st January, before any intimation of their purpose could reach us, the Kookies after sweeping down the course of the Fenny, burst into the plains of Tipperah at Chagalneyah, burnt of plundered 15 villages, butchered 185 British subjects, and carried off about 100 captives. ১২. কবি বীণাপাণির পদ বন্দনা করিয়া বলিতেছেন :-
“শুন সর্ব সাধু ইহার নির্ণয়,
যেনমতে খণ্ডলেতে কাটাকাটি হয়।
দেখ, মাঘমাসে শনিবারে শ্রীপঞ্চমী ছিল।
মুনসীর খিল বাজারে বাবু ধুরন্ধর আছিল।
যে দিন প্রভাতকালে, করেছিল পূজার আয়োজন,
চিনি শর্করা আদি যত লয় মন।
পূজা আরম্ভিল, হেনকালে প্রমাদ ঘটিল।
অকস্মাৎ তিপ্ৰাকুকি আসি দেখা দিল।
তারা দাও শেল হাতে, বন্দুক কান্দে দেখতে ভয়ঙ্কর।
দেখে প্রাণ ভয়ে কাঁপে কালা ভুসঙ্গর।
রণে প্রবেশিল, যারে পায় কাটিয়া ফেলায়,
অবনিতে কাটা পরি ধূলাতে লুটায়।
রুধির আবেসিল, আকাশেতে উড়িছে শকুন,
ঘর জিনিস লুট করি, চালে দেয় আগুন।
তারা খন্তা নিল, কুড়াল নিল, আর নিল দাঁও কাঁচি।
সিন্ধুক ভাঙ্গি কাপড় নিল ভাল ভাল বাচি
ঠিক দুপুর বেলা হল পুড়ে মুনসী বাড়ী।
সেদিন ফিরে যায়; রাত পোহা’ল ছিল রবিবার,
কাটা গ্রামে কাটি আসি দিল পুনর্বার।
চৈলেছে কোলা পাড়া
কোলা পাড়া যেতে তরা করেছে গমন।
ধাউলানীর কোলে আসি দিল দরশন।
দেখে গুণাগাজি, গুণাগাজি এল সাজি সিফাই সঙ্গে করি,
তিপ্রা কুকি ফিরাইল বন্দুক আওয়াজ করি।
১৩. It was at first supposed that this Extended movement on the part of these tribes was directed by certain near relatives of the Tipperah Raja, and was intended to involve that chief in trouble with the English government. But it was afterwards ascertained, with considerable certainty, that the main instigators of the invasion were three or four Hill Tipperah refugees. Thakurs who had lived for sometime among the Kookis, and who took advantage of the ill-felling caused by an attack made by Raja’s subjects upon some Duplung Kookies, to excite a rising, that unfortunately became diverted to British territory. Driven by the Raja from his domin- ions, these men had formed alliances among the various Kooki Tribes of the interior, and year by year villages, supposed to be friendly to Raja, had been attacked and plundered, vague rumours of which disturbances had reached our ears. Some of the Raja’s own subjects, moreover, exasperated by constant exactions, were belived to have invited the Kookis to ravage his territories.”
১৪. কুমার নীলকৃষ্ণ দেববর্মণ ইহাতে সংলিপ্ত বলিয়া অবরুদ্ধ হন। কিন্তু পশ্চাৎ তিনি নিৰ্দ্দাষ বলিয়া মুক্তি লাভ করেন।
১৫. সুকপাইলালের পিতা মংপের কুকিগণ মধ্যে একজন পরাক্রমশালী সরদার ছিলেন। শিববুতের উত্তর পুরুষ লারুর সহিত মংপেরের দীর্ঘকাল কলহ চলিয়াছিল। মৃত্যুর পর তৎপুত্র লালছোকলা মংপেরের সহিত সন্ধিস্থাপন করেন।
১৬. Government letter to the commissioner of Chittagong, 7th November 1880, No. 5845.
১৭. Suukpilal was invested with a dress of honour specially made for him, -green pyjama, with scarlet and gold flowers, a purple coat with green and gold Embroidery, an indescribable hat of green and white silk, a necklace of glass buttons and gold beads and two glass earrings (observer, 25….71.) এডগার সাহেব বিবেচনা করিলেন, কতকগুলি মূল্যহীন ঝুটা বস্তু দিয়া এই বর্বরকে গোলাম করিয়া লইলাম। আর সেই বর্বরের অনুচরগণ মণিপুরের রাজ দরবারে যাইয়া প্রকাশ করিল যে, কাছাড়ের বড় সাহেব আসিয়া আমাদের রাজাকে কর প্রদান করিয়া গিয়াছেন।
১৮. এই সময়ের কুকি অত্যাচারের বিস্তৃত ইতিহাস লিখিয়া গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধি করিতে ইচ্ছা করি না। যে যে স্থান কুকিগণ কর্তৃক আক্রান্ত হইয়াছিল, তাহার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা এস্থানে প্রদত্ত হইল।
১) ত্রিপুরা রাজ্য-
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ২১/২২ জানুয়ারি এবং ২রা মার্চ ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত বিবিধ স্থান আক্রমন করত কুকিগণ গৃহদাহ লুন্ঠন ও নরহত্যা কার্য্য সম্পাদন করে।
২) শ্রীহট্ট জেলা—
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জানুয়ারি কাছাড়িয়া পাড়া আক্রমণ করত ১০ জন মনুষ্য বধ ও কতকগুলি যুবতী স্ত্রীলোক বন্দি করিয়া লইয়া যায়। ২৪ জানুয়ারি চারগোলা থানার নিকটবর্তী একখানা গ্রাম আক্রমন করিত ২ জন মনুষ্য বধ করে। ২৭ ফেব্রুয়ারি আলী-নগরের নিকটবর্তী একখানা গ্রাম আক্রমণ করে। এডগার সাহেবের বন্ধু সুকপাইলালের অনুচরগণ দ্বারা এই কাৰ্য্য সম্পাদিত হইয়াছিল।
৩) কাছাড় জেলা—
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি আইনেরখাল গ্রাম এবং আলেকজেন্ডারপুর ও কাতলাছড়া চা ক্ষেত্র আক্রান্ত হয়। তাহারা ২৪ জানুয়ারি পুনর্বার কালাছড়া চাক্ষেত্র আক্রমণ করে ২৭ জানুয়ারি মনিয়ারখাল এবং নন্দীগ্রাম চা ক্ষেত্র ও রুকনী নদীর তীরস্থ একদল কাঠুরিয়া তাহাদের দ্বারা আক্রান্ত হইয়াছিল। ২৩শে ফেব্রুয়ারী তাহারা জালনাছড়া চাক্ষেত্র আক্রমণ করে।
৪) মণিপুর রাজ্য-
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাত্রিতে মণিপুরের দক্ষিণ দিকস্থ একখানি গ্রাম বিনষ্ট করিয়া ৪০ জন মনুষ্য বধ করে এবং ২০ জনকে বন্দি করিয়া লইয়া যায়।
সাইলো কুকি সরদার সবোঙ্গা, হাউলং কুকি সরদার লাল সোবনা ও সেইপয়া, খচাক কুকি সরদার বোনপাইলাল, তাহার মাতা ইম্পানু, বনোলাল ও তৎপুত্র লালবোরা ও জোংদঃ এবং সুকপাইলাল, তাহার দুই পুত্র ও তাহার ভগিনী ভানুইথাঙ্গির অনুচরগণ দ্বারা এই সকল ভীষণ কাৰ্য সম্পাদিত হয়।
১৯. একটি বৃহৎ কাশির ন্যায়, কুকিদিগের রণবাদ্য।
২০. পাউয়ার সাহেব ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিলের পত্রে লিখিয়াছেন :-
“The territory over which the Raja has a bonafide nominal control is bounded on the east by a range of hill running south ward from chatter choora to sorphul peak, and from thence in zigzag line to surdaing. On the east of this line, the Lushai land commences, and on the West there is much uninhabited and unexplored Jungle.”
২১. আমাদের বিবেচনায় পর্বত শ্রেণীর পরিবর্তে স্রোতস্বিনীগুলি দ্বারা সীমা নির্ণয় করিয়া গবর্ণমেন্ট ভ্রমের কার্য্য করিয়াছেন। ইহা দ্বারা ভবিষ্যতে নানারূপ তর্ক উপস্থিত হওয়া সম্ভব।
২২. This I say, then, let us not govern these hills for ourselves, but administer the country for the well being and happiness of the peo- ple dwelling therein, Civilization is the result and not the cause of civilization. What is wanted here is not measures but a man, Place over them an officer gifted with the power of rule; not a mere cog in the great wheel of Government, but one tolerant of the failings of his fellow creatures, and yet prompt to see and recognise in them the touch of nature that makes the whole world kin; -apt to enter into new trains of thought and to modify and adopt ideas, but cautious in offending national prejudice. Under a guidance like this, let the people by slow degree civilize themselves. With edu- cation open to them, and yet moving under their own laws and cus- toms, they will turnout not debased and miniature epitomes of English men, but a new and noble type of God’s creatures. Lewin’s Hill Tract of Chttagong. P 118.