ষষ্ঠীর কথামৃত
জামাইষষ্ঠীর জামাইদের যে যাই বলুন, কেমন যেন বোকা-বোকা চেহারা হয়। কেন হয় বলা শক্ত। দেখলেই চেনা যায় মহাশয় শ্বশুরালয়ে চলেছেন? মুখে তেমন হাসি নেই। চোখের দৃষ্টি ফ্যালফেলে, উদাস। স্ত্রী চলেছেন আগে-আগে। সেজেগুজে। প্রখর রোদে মেকআপ গলে-গলে পড়ছে। যেহেতু তিনি বাপের বাড়ি চলেছেন, সেইহেতু চলনে বেশ একটা বাড়তি আবেগ। অনেকটা ‘চলরে নও জোয়ানে’র ভঙ্গি, যিনি মা হয়েছেন তিনি শাবকটিকে তুলে দিয়ে স্বামীর কোলে তোয়ালে জড়িয়ে। নিজের হাতে রেখেছেন প্ল্যাস্টিকের বালতি ব্যাগ। তার মধ্যে পাট-পাট তোয়ালে। একটা বাড়তি শাড়ি। মাঝারি মাপের সন্দেশের বাক্স। উঁকি মারছে ফিডিং বোতল। একটি রবার ক্লথের রোলও সময়-সময় দেখা যেতে পারে।
ষষ্ঠী আর আগের মতো জমে না। জীবন বড় এলোমেলো হয়ে গেছে? মানুষও আজকাল আত্মসচেতন। অনেক জামাই শ্বশুরালয়ে ত্রিসীমানা এড়িয়ে চলতে পারলে বেঁচে যান। শ্বশুরবাড়িতে পার্সোনালিটি বড় ধাক্কা খায়। সমীহ করে চলার যুগ চলে গেছে। অথচ স্ত্রীর পিত্রালয়ের গুরুজনদের সামনে ভিজে বেড়ালটি হয়ে থাকতে হয়। নিজের পিতাকে বাবা বলে পায়ে হাত দিয়ে প্রণামের অভ্যাস খসে গেলেও, স্ত্রীর পিতাকে পিতৃ সম্বোধনে যথোচিত সম্মান দেখাতেই হবে; কারণ নিজের টিকিট স্ত্রীর হাতে গচ্ছিত। পান থেকে চুন খসলে বয়কট করে দেবেন। এ যুগে আবার বেয়াইয়ে-বেয়াইয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঠান্ডা লড়াই চলে। হয় দেনা-পাওনা নিয়ে, নয়তো পুত্রবধূর ঔদ্ধত্যের অভিযোগে। দুই পরিবার জল ঘোলা করে দম্পতিকে অশান্তির আবর্তে চুবিয়ে রাখেন। সম্পর্কের খেলা চলে শ্বশুর-জামাইয়ে। ছেলের পিতা-মাতার সেই একই অভিযোগ, পরের বাড়ির মেয়ে এসে ছেলেটাকে গ্রাস করে নিল। শ্বশুরবাড়ির কথায় ওঠে আর বসে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি তেমন সুখের নয়। তবু ষষ্ঠী আসে। স্ত্রী-স্বামী ট্যাকে নেচে-নেচে ষষ্ঠীর টানে পিত্রালয়ে ছোটেন। সেখানে তাঁর অন্যরূপ। যেন বাঁধা গরু ছাড়া পেয়েছে। স্বামীর সংসারে যে মুখ তোলা হাঁড়ি, পিতার সংসারে সে মুখে হাসি আর কলকা-কলির ঝরনা ধারা। তফাতটা চোখে পড়ে। মন ধাক্কা খায়। আগেকার কালে বিবাহ ছিল জমপেস ওয়েলডিং।
জোড় মেলানো যায় না। বেকায়দায় হাত পড়লে খোঁচা খেতে হয়। দু:খের হলেও কথাটা সত্যি আজকাল অধিকাংশ ছেলেই স্ত্রীকে শ্বশুর বাড়ির পরিবেশ থেকে আগলে রাখতে চান মগজ ধোলাইয়ের ভয়ে। কে কখন কি ফুসমন্তর ঝেড়ে দেবে, পারিবারিক শান্তি চোট খাবে। বেসুরে বাতাস বইবে।
সুখের ষষ্ঠী, হুল্লোড়ের ষষ্ঠী শহরজীবন থেকে বিদায় নিয়েছে। এখন যেন মনে হয় স্বামী বেচারার গলায় দড়ি বেঁধে স্ত্রী চলেছেন টানতে-টানতে। আমার মাতামহের কাছে সে যুগের ষষ্ঠীর গল্প শুনেছি। এখন মেলাতে গেলে আর মেলে না। মাতামহের জীবনের ঘটনা। একবার ষষ্ঠীতে প্রচণ্ড ঝড় জল। কলকাতা ভেসে যাচ্ছে। মাতামহ ফিনফিনে পাঞ্জাবি পরে পঞ্চান্ন ইঞ্চি ধুতির কোঁচা ঝুলিয়ে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে পমেটম লাগিয়ে বুরুশ মারছেন। মাতামহের পিতৃদেব জিগ্যেস করলেন, ‘এই বৃষ্টিতে যাবে কি করে উত্তরপাড়ায়।’ মাতামহ বললেন, ‘সাঁতারে।’ পিতৃদেব স্ত্রীকে বললেন, ‘ব্যাটা আমার বিল্বমঙ্গল।’ মাতামহের চোখের সামনে তখন ভাসছে, শহর নয়, বড়-বড় তপসে মাছ, মসৃণ ত্বক ল্যাংড়া আম, শুঁড়অলা গলদা চিংড়ি। ভোজনবিলাসী ছিলেন। মনে এক মুখে এক ছিল না। লজ্জা-টজ্জার তেমন বালাই ছিল না।
জীবনের অস্বাভাবিকের চাপে এখন সব নষ্ট হয়ে গেছে। সপরিবারে কোথাও যেতে হলে দুর্ভাবনায় মুখ শুকিয়ে যায়। যানবাহনের শোচনীয় অবস্থা। পয়সা ফেললেও ট্যাক্সি মিলবে না। গুঁতোগুঁতি করে অফিসে যাওয়া যায়, শ্বশুরবাড়ি তো আর কোর্ট-কাছারি নয়। স্টপেজে, স্টপেজে, প্ল্যাটফর্মে তীর্থের কাকের মতো জোড়া জোড়া স্বামী-স্ত্রী ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছেন। কোন সুদূর শ্বশুরবাড়িতে অন্ন-ঘৃত-পক্ব হচ্ছে। তপসে বাঙালি জীবন থেকে অদৃশ্য। ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় স্মৃতি-সন্ধান করতে হয়। চিংড়ি সহসা চোখে পড়ে না। শাঁখা সিঁদুরের প্রতীক মৎস্য দুর্মূল্য? কার্বাইডে পাকা আম জৈষ্ঠের গরমে আর সে রস ছাড়ে না। যার আকর্ষণে জামাই আসার আগেই ডুমাডুমা নীল মাছি উড়ে আসে।
কারুর-কারুর জীবনে ষষ্ঠী বড় করুণ অভিজ্ঞতা। আমার এক বন্ধুর, পঞ্চশ্যালক। শ্বশুর মহাশয় গত হয়েছেন। শ্যালকরা সকলেই বিবাহিত। শ্বশ্রূমাতা ফ্যামিলি পেনসানে কায়ক্লেশে জীবিত। জামাই বেচারা এখন ভাগের মা। শ্যালকরা স্বার্থপর। তাঁরা বলেন, জামাই হল মায়ের, ষষ্ঠীর আপ্যায়ন করতে হলে তিনিই করুন। আমাদের দায় পড়েছে? বৃদ্ধা তাঁর পেনসানের পয়সায় ষষ্ঠীর আয়োজন করেন! সে বড় করুণ দৃশ্য। শ্যালকরা বউ বগলে সাত সকালেই বাড়ি খালি করে সরে পড়েন। সেই শূন্য বাড়িতে জামাই বেচারা রাতের বেলায় খানকতক ফুলকো লুচি নিয়ে বিরসবদনে বসেন। পরিবেশন আর রন্ধনের দায়িত্ব স্ত্রীকেই নিতে হয়। বৃদ্ধা সারাক্ষণ আঁচলে অশ্রুমোচন করেন। ছেলেদের কীর্তিকাহিনি বর্ণনা করেন। দেওয়ালে প্রলম্বিত শ্বশুর মহাশয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আহা: আজ ওই মানুষটা বেঁচে থাকলে কি আনন্দের দিনই না হত। তিনি খেতে আর খাওয়াতে ভালোবাসতেন।’ এদিকে লুচি জুড়িয়ে আসে। এক একটি পদ আসতে থাকে, আর আমার বন্ধু মনে-মনে হিসেব করতে থাকেন, বৃদ্ধার সামান্য পেনসানের কত টাকা ধ্বংস হল! বাজারটাই বা কে করেছে? এর নাম চোখের জলের জামাই-ষষ্ঠী।
ষষ্ঠীর রজনী অনেক জামাইয়ের ক্ষেত্রে আবার উপদেশ রজনী হয়ে দাঁড়ায়। সে আর এক জ্বালা! লাল লুঙ্গি আর কাঁধকাটা গেঞ্জি পরে বড় শ্যালক ডিভানে আড়কাত। পাশে নস্যির ডিবে আর নস্যির রঙে ছোপানো একটি রুমাল। নস্যিতে ফোঁ টান মেরে বললেন, ‘তা, তোমার সেই ব্যাংকিং পরীক্ষার কি হল? ওটা এবার চাড় করে দিয়ে দাও। অফিসারস গ্রেডে উঠতে হবে তো!’ সামনে চায়ের কাপ ধরে দিতে-দিতে স্ত্রীর মাতাঠাকুরানী বললেন, ‘শুনেছি, তোমার খুব খরচের হাত। বেশ মোটা টাকার একটা ইনসিওরেন্স করে ফেলো। মেয়ের বিয়ে দিতে হবে তো! শ্বশুরমশাই সিগারেট পাকাতে-পাকাতে বললেন, ‘তোমাদের কালে লাখের কমে মেয়ে পার হবে না, বাবাজি?’
বড় শ্যালক খেঁই ধরলেন, ‘একটা নিজস্ব বাড়ির চেষ্টা করো এখন থেকে। লটারিতে অন্তত একটা সরকারি ফ্ল্যাটই না হয় দ্যাখো।’
শাশুড়ি বললেন, ‘মেয়েটাকে একটা ভালো স্কুলে এখন থেকেই দেওয়ার চেষ্টা করো।’
শ্বশুর মশাই বললেন, ‘মানু (মেয়ের নাম) কে, একজন স্পেশালিস্ট দেখাও। আফটার ইসু কেমন যেন অ্যানিমিক হয়ে যাচ্ছে। জানবে, স্টিচ ইস টাইম সেভস নাইন।’
অনেক শ্বশুর মশাই আবার নিজেকে একটু জাহির করতে ভালোবাসেন। ‘চিংড়িটা খেয়ে দ্যাখো। একেবারে এক নম্বর মাল। গোটা আষ্টেক ছিল। চল্লিশের কমে নামল না, আমার আবার একটু উঁচু নজর।’
আমে হাত দিতে গিয়ে হাত টেনে নিতে হল। ‘সেরা ল্যাংড়া। গাছপাকা। দাম একটু বেশি নিলে। তা নিক। খাওয়াতে হলে সেরা জিনিসই খাওয়াতে হয়।’
সন্দেশটি মুখে পোরামাত্রই বললেন, ‘স্রেফ জিভে আর তালুতে পাগলে-পাগলে খাও। তারকের নরম পাক। ঘরে কাটানো ছানা। এ জিনিস অর্ডিনারি দোকানে পাবে না।
এইবার সেইদিন আসছে। নিজের ষষ্ঠী নিজেকেই না করতে হয়। অনেক শ্বশ্রূমাতা আবার চাকরে। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে প্রেসার কুকারে জামাই বাবাজির ফলার পাকাতে বসবেন ক্লান্ত শরীরে। রাত সাড়ে দশ। তখনও প্রেসার কুকার সিটি মারে না। শোনা গেল তাঁর রাগত কণ্ঠস্বর, ‘মুখপোড়াকে, আজ আবার কি রোগে ধরল!’
এর চেয়ে চিনে রেস্তোঁরাই ভালো। স্ত্রীর তো ষষ্ঠীর উপবাস! নিজেকেই নিজে খাওয়াও। চৌমিনের জট ছাড়াতে-ছাড়াতে ভাবো, সামনে বসে আছেন শাশুড়ি মাতা। হাতে তালপাখা নিয়ে। আর কাউন্টারে! অনেকটা তার মতোই দেখতে। একটু স্থূলকায়।