ষড়-রত্ন

ষড়-রত্ন

চড়াইডাঙার নয়-আনা তরফের মালিক গদাধর পাল চৌধুরীর সম্বন্ধে লোকে যখন একান্তে কথাবার্তা কয়, তখন তাঁহার নামটা বিকৃত করিয়া তাঁহাকে ‘পালের গোদা’ বলিয়া থাকে; কারণ একে তো পাল চৌধুরীর সব শরিকানরাই দারুণ উৎপীড়নের জন্য অপযশস্বী, তাহার উপর ইনি আবার সকলের উপর এককাঠি বেশি যান।

যথারীতি সভা বসিয়াছে, কিন্তু ওই কেবল বসিয়াছে পর্যন্তই—তেমন জমিতেছে না।

প্রথমত, অনেকদিন যাবৎ তেমন বড়-গোছের মকদ্দমা হাতে না থাকায় পাত্রমিত্রদের মধ্যে এক রকম আএমপ্লয়মেন্ট প্রব্লেম অর্থাৎ বেকার-সমস্যা পড়িয়া গিয়াছে; আর দ্বিতীয়ত, সাড়ে-তিন আনা তরফের নিকট অমন সাজানো দেওয়ানিটা হারিয়া অবধি চৌধুরী মহাশয়ের মনেও আর সুখ নাই; সংসারটা যেন গজভুক্ত কপিত্থবৎ অসার বোধ হইতেছে! সভাসদেরা জজসাহেবের ও-তরফের নিকট মোটা টাকা খাওয়া হইতে আরম্ভ করিয়া ময়নাগাছিতে ছাগলীর পেটে উটের বাচ্চা এবং ইসলামপুর কাঁঠালগাছে কলার কাঁদি পর্যন্ত অনেক ‘প্রত্যক্ষ’ ঘটনার অবতারণা করিয়াছে; কিন্তু এ পর্যন্ত কোন ফল হয় নাই। ‘মহারাজে’র সেই একই ভাব—বিষণ্ণ বদন, বেশি কথা নাই; কল্পকথার বিরহিণী রাজকন্যার মতো কোনো ঔষধই আর তাঁহার লাগিতেছে না। এদিকে বৈদ্যরাজেরাও বসিয়া প্ৰমাদ গনিতেছে।

যাদব হালদার আর ঘোষাল মহাশয় একটা খুব গুরুতর বিষয় লইয়া হাতমুখ নাড়িয়া সুস্পষ্ট চাপা গলায় জোর আলোচনা লাগাইয়াছে, আর চৌধুরী মহাশয়ের উপর এই থিয়েটারী ‘একান্তে’র প্রভাব কিরূপ হইতেছে লক্ষ্য করিবার জন্য মাঝে মাঝে তাঁহার পানে তির্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছে। চক্রবর্তী, চৌধুরী মহাশয়ের তৈলচিত্রটার দিকে ভাবগদগদ নয়নে অনেকক্ষণ হইতে চাহিয়া আছে। তর্কালঙ্কার আসিয়া অবধিই নানাবিধ ভোজ্য এবং অনেক নামজাদা ভোজন-বিলাসী ও ভোজন-বিশারদের রোমাঞ্চকর গল্প জমাইবার প্রয়াস করিয়া এ পর্যন্ত বিফল মনোরথ হইয়াছে। বুড়া আঙুলের ঠেলায় নাকে একরাশ নস্য চালান দিয়া শ্বাসের মতো একটা টান দিল, তাহার পর হাতটা সশব্দে ঝাড়িয়া সজলনেত্রে আবার কি একটা শুরু করিতে যাইবে, এমন সময় ‘ইস’ করিয়া সভার মাঝে একটা দীর্ঘ শব্দ উঠিল। সকলে এককালীন অবধূতের পানে উৎসুক নেত্রে ফিরিয়া চাহিল। চৌধুরী মহাশয়ও মৌনভঙ্গ করিয়া বলিলেন, “কি হল আবার?”

অবধূত একটা চার-হাত পাঁচ-হাত সাপ্তাহিক খবরের কাগজের উপর আগ্রহের সহিত হুমড়ি খাইয়া পড়িয়াছিল। কাগজটার একটা জায়গায় আঙুল দিয়া তর্কালঙ্কারকে বলিল,

“আমি গোটা তিনেকের অর্ডার দিচ্ছি, তোমার জন্যেও একটা লিখে দোব নাকি?”

তর্কালঙ্কার প্রথমে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছুই না বলিয়া গভীর অভিনিবেশের সহিত কয়েক সেকেন্ড লাইনটার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া রাখিল, তাহার পর বলিল, “যা বলছে, যদি তাঁই হয় তো একটা কেঁল, আঁবার জল্যেও গোটা তিলেক লিখ দিল লা।”

গোঁসাই বলিল, “ব্যাপারটা কি? মহারাজ যখন জানতে চাইছেন—”

চৌধুরী মহাশয় অভিমানে মুখটা অন্ধকার করিয়া কহিলেন, “না, থাক; গদাধর সাড়ে- তিন-আনির কাছে হেরে অবধি তার কি আর পদার্থ আছে যে লোকে সেটার কথায় আবার কান দেবে? নেহাত বেহায়া আমি, তাই—”

অবধূত বলিল, “এই দেখ দিকিন! ছেলেমানুষ তোমরা, হুট বলতে তোমাদের অভিমান হয়ে পড়ে; আর গোঁসাইয়েরও ফোড়ন দেওয়া একটু চাই-ই। না হয়, বললাম; কিন্তু তোমাদের বলে হবে কি? কবচ-টবচ তোমরা নব্যেরা কি বিশ্বাস করতে? হেসেই উড়িয়ে দিতে। কাজ কি বাপু? ও আমাদের সেকেলেদের মধ্যে থাক গে, ওল্ড ফুলের দল আমরা।”

সকলেরই চৌধুরী মহাশয়ের বয়স সম্বন্ধে এখানে ভ্রম দাঁড়াইয়া যাইতে পারে বলিয়া জানাইয়া রাখা দরকার যে, তিনি দু-তিন বৎসর পূর্বেই পঞ্চাশ উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছেন। অবধূত বরং দুই-তিন বৎসরের ছোট হইতে পারে।

এতক্ষণ পরে চৌধুরী মহাশয়ের মুখটায় একটু হাসি ফুটিল, গোঁফ কয়টা প্ৰাণবন্ত হইয়া উঠিল এবং চোখের পাশে গালে কপালে কতকগুলো পরিচিত রেখা জাগিয়া উঠিল, কহিলেন, “শুনছ চক্কোত্তি, অবধূত মশায়ের কথা শুনছ একবার? চল্লিশ কবে পেরিয়ে গেল, আর আজ বলেন কিনা ছেলেমানুষ। হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি। তোমরাও সব ওই এক দলের, আমিই মিথ্যেবাদী। কই, কি আবার এক মান্ধাতার আমলের কবচ আপনি টেনে বের করলেন? মনের বিশ্বাসের ওপর তো কারুর জোর নেই; কিন্তু না হয় শুনলামই বা একবার। কই রে, অবধূত মশায়ের জন্যে যে বড় তামাকটা আনালাম অত করে”

অবধূত চক্রবর্তীর দিকে কাগজটা ঠেলিয়া দিল, বলিল, “তবে শুনিয়ে দাও; আমার চোখ জোড়াটা আনতে ভুলে গেছি।” চৌধুরী মহাশয়ের অলক্ষিতে ঘোষালের দিকে একটা বিজয়ের কটাক্ষ হানিল, ভাবার্থটা—”দরবার এই একে বলে।”

চক্রবর্তী একটা দড়ি-বাঁধা চশমা মাথায় গলাইয়া পড়িতে লাগিল—”

“সত্বর হউন! হেলায় হারাইবেন না! মুহূর্তের বিলম্বে
জীবন-ব্যাপী অনুশোচনা!!!
মহাবিঘ্নহর কবচ
বা
ধর্মার্থকামমোক্ষের একত্র সমাবেশ!!!
মানুষ সংসারে চায় কি? চায় সুখ শান্তি বৈভব,
চায় পুত্রকন্যা-গলগ্রহ—”

সকলে সাশ্চর্যে ‘অ্যাঁ!’ করিয়া উঠিল।

চক্রবর্তী ঝুঁকিয়া পড়িয়া শুধরাইয়া লইল, “পুত্রকন্যা কল–ত্র, ছাপাটা ধেবড়ে গেছে, হ্যাঁ,–”

“মানুষ সংসারে চায় কি? চায় সুখ শান্তি বৈভব, চায় পুত্রকন্যা-কলত্র। কিন্তু কি পায়? নিরাশা। আকুল আবেগে মানুষ ঐহিক সুখের মৃগতৃষ্ণিকার পশ্চাতে ছুটিতেছে, ঘর্মাক্তকলেবর, রক্তাক্ত-চরণ; কিন্তু হায় সুখ, তুমি কোথায়? দরিদ্রের হাহাকারে, চিররুমের আর্তনাদে, লাঞ্ছিতের মর্মব্যথায়, অপুত্রকের হতাশ্বাসে এবং মামলাকারীর উষ্ণশ্বাসে সংসার শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে পর্যবসিত হইয়াছে। ধর্ম আজ হৃতমাহাত্ম্য, পাপীর বিজয়োল্লাসে ধরণী মুখরিত; অর্থ পরহস্তগত, মাড়োয়ারী আর ভাটিয়া মিলিয়া দেশকে লুণ্ঠিত করিতেছে; কাম, অনঙ্গ বিকলাঙ্গ, অকালবার্ধক্যে দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা যৌবনসুখে বঞ্চিত।”

তর্কালঙ্কার বলিল, “বাঃ, ভাষার চটক আছে!”

চক্রবর্তী বলিল, “আর মোক্ষ?”

“সে দুঃখের কথা আর নাই বা তুলিলাম। আমরা প্রতিদিন কি দেখিতেছি? দেশময় পর্ণকুটির হইতে ক্রোড়পতি পর্যন্ত প্রত্যহ যাঁহারাই মকদ্দমা করিতেছেন, তাঁহাদের ঠিক অর্ধেক লোক মকদ্দমায় হারিয়া সর্বস্বান্ত হইতেছেন। বড় বড় উকিল-ব্যারিস্টারদিগের ওজস্বিনী বক্তৃতায় কিছুই ফল হইতেছে না। বাকি অর্ধেকের জয়োল্লাসও নিতান্ত ক্ষণস্থায়ী, আপীল আছে, প্রিভি কাউন্সিল আছে। সোনার ভারত আজ গ্রহবৈগুণ্যে বিপর্যস্ত! শুধু ভারত বলি কেন, পৃথিবীর সমস্ত দেশেই এই এক কাহিনী—প্রাচ্য, প্রতীচ্য, ইউরোপ, চীন, জাপান, নিউ ইয়র্ক, ম্যাডাগ্যাস্কার যেখানেই নয়ন ফিরাই, এই এক করুণ অন্তর্দাহের প্রতিধ্বনি। পাশ্চাত্য সভ্যতা আজি জ্ঞান-বিজ্ঞানের লীলাভূমি, কিন্তু জীবনের এই মহাসমস্যার কোনো সমাধান করিতে পারিয়াছে কি? ত্রিতাপদগ্ধ মোহান্ধ মানুষের মন কিছুমাত্রও শান্তিসলিল সিঞ্চন করিতে সমর্থ হইয়াছে কি? হয় নাই। এ শক্তি ভগবান এই লাঞ্ছিতা পরপদদলিতা দারিদ্র্যপিষ্টা ভারতমাতাকেই দান করিয়াছে। আর সেই ভারতের মধ্যেও শুধু আমরাই ভগবৎ-কৃপায় মানবমণ্ডলের যাবতীয় বিঘ্ননাশকরণান্তর তাহাকে চতুর্বর্গ ফলের অধিকারী করিবার সৌভাগ্য লাভ করিয়াছি।

“আমাদের মহাবিঘ্নহর কবচ ধারণে ত্রিরাত্রি অন্তে মানুষ দৈব ও আধিভৌতিক সর্বপ্রকার বিঘ্নবিপত্তি হইতে মুক্ত হইয়া নিরুদ্বেগে কালাতিপাত করিতে পারে। ইহাতে মকদ্দমায় জয়লাভ, সাহেবের সুদৃষ্টি, শত্রুনাশ, কলেরা, বসন্ত, কালাজ্বর, প্লেগ, বেরিবেরি, মৃতবৎসা প্রভৃতি মানুষের যাবতীয় রোগ অচিরে বিনষ্ট হইয়া মানব শরীর যৌবন-শ্রীতে মণ্ডিত করে। ভূত, প্রেত, পিশাচ, অগ্নি, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, সর্পাঘাত, মোটরের টায়ার ফাটা, বজ্রাঘাত প্রভৃতি আকস্মিক বিপদ হইতে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকা যায়। ইহা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, বশীকরণ, বাজীকরণ, নষ্টসম্পত্তির পুনরুদ্ধার, দৈব অর্থলাভ, গবাদি গৃহপালিত জন্তুর নিরুদ্দেশ প্রভৃতি ব্যাপারে ব্রহ্মাস্ত্রস্বরূপ। এক কথায় ইহা ত্রিকালজ্ঞ ঋষিকল্পিত তেজোগর্ভ মন্ত্রশক্তি এবং অধুনাতন পাশ্চাত্ত্য বিজ্ঞানসম্মত রসায়নশক্তির অচিন্ত্যপূর্ব একত্র সমাবেশ। যথাবিধি পুরশ্চরণ ও ভক্তিপূর্বক দেবীচরণে মানসিক করিয়া এই পরমাশ্চর্যময় কবচ অঙ্গে ধারণ করিতে হয়। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান কাহারও ইহা ধারণে কোনোই প্রতিবন্ধক নাই।”

চৌধুরী মহাশয় গভীর মনোনিবেশের সহিত শুনিতেছিলেন। অবধূতের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “বিশ্বাস আমি একবিন্দুও করি না, তা যাই মনে করুন। তা হলেও না হয় আপনাদের পেড়াপীড়িতে একটা আনালাম। তারপর? এটা খেয়ো না, কবচ পচে যাবে, এটা করো না, অনাচার হয়ে পড়বে—এই সাতসতেরো বখেড়া করতে থাকবেন তো? তার চেয়ে যেমন আছি, তেমনই থাকি বাপু, সাড়ে-তিন-আনিই সব মকদ্দমা জিতুন, আমার অত—”

অবধূত বড়-তামাক সেবনে আরক্ত চক্ষু দুইটি বিস্ফারিত করিয়া বলিল, “সে কথা তো স্পষ্টই লিখেছে; তবে আর বলছি কি? চক্রবর্তী, বুঝি সে কটা লাইন ছেড়ে এসেছ? তা তুমি পার, ‘কলত্র’কে ‘গলগ্রহ’ বলে যেমন আরম্ভ করেছিলে! কই, দাও দিকিন, দেখি আমি।”

কাগজের উপর দ্রুত আঙুল চালাইতে চালাইতে অবধূত পড়িতে লাগিল— “মানুষের…পশ্চাতে…মারোয়াড়ি…ভাইয়া…হুঁ…উ…. উঁ……. ব্রহ্মাস্ত্র-স্বরূপ…এই—এই যে স্পষ্ট বলেছে—”

“ইহাতে আহার-বিহার প্রভৃতি মানবের ন্যায্য উপভোগ্য কোনো বিষয়েই নিয়মের কোনো অযথা বন্ধন নাই। সকলেই আনন্দের সহিত ভোগবিলাসে জীবন যাপন করিতে পারেন, কারণ ইহার দৈবশক্তিগুণে সমস্ত আচার-অনাচারই শুদ্ধ সত্ত্বগুণান্বিত হইয়া পড়ে। “হে চক্কোত্তি, সকলের আগে তোমার একটা আনতে দেওয়া দরকার—চশমাতে আর বল নেই।”

চক্রবর্তীর কোলে কাগজটা ফেলিয়া দিয়া গোপনে একটা টিপুনি দিয়া দিল।

তর্কালঙ্কার হাতে খানিকটা নস্য ঢালিয়া বলিল, “লব্যল্যায়দীপিকায় ওই রকঁব এক কবচ প্রলয়লের রীতি বর্ণিত আছে বটে, তাতে আঁবিষ আহার করলেও নিরাঁবিষের ফল হয়; এ দেখছি তা হলে-–”

গোঁসাই উৎসুকভাবে বলিল, “বটে! অথচ আমিষের স্বাদ ঠিক থাকে?”

অবধূত খিঁচাইয়া বলিল, “হ্যাঁ, ঠিক থাকে, অমনই নোলায় জল এল! আগে শোনই না সবটা! কই হে চক্কোত্তি।

গোঁসাই রাগিয়া উঠিয়া কি বলিতে যাইতেছিল; চক্রবর্তী পড়া শুরু করিয়া দেওয়ায় অবধূতের পানে কটমট করিয়া চাহিয়া থামিয়া গেল।

চক্রবর্তী পড়িয়া চলিল—

“মহাবিঘ্নহর কবচের যশ বিশ্বময় ছড়াইয়া পড়িয়াছে। সম্প্রতি দক্ষিণ চীনের সহিত উত্তর চীনের মহাযুদ্ধে স্বীয় দুর্ধর্ষ সৈন্যদিগের ব্যবহারার্থ মহাচীনাধিপতি অহিংসপরায়ণ বৌদ্ধসম্রাট হিং চাও বিশ হাজার মহাবিঘ্নহর কবচের অর্ডর দিয়াছেন। এই কারণে যাঁহারা সপ্তাহকাল মধ্যে অর্ডার না দিবেন, তাঁহাদিগকে কবচ সরবরাহ করা আমাদের সম্ভবপর হইবে না। এজন্য আমরা স্বদেশবাসীর নিকট লজ্জিত। কিন্তু যেখানে একটা জাতির জয়পরাজয়, উত্থানপতন আমাদের কবচের উপর নির্ভর করিতেছে, সেস্থলে আমরা সম্পূর্ণ নিরুপায় জানিয়া সহৃদয় দেশবাসী আমাদের এ অপরাধ মার্জনা করিবেন।”

চৌধুরী মহাশয় কহিলেন, “ওহে ঘোষাল, নায়েব মশাইকে বলে দিও, গোটা দুয়েক অর্ডার যেন তাড়াতাড়ি দিয়ে দেন, এলে ফেলে দিতেই বা কতক্ষণ! আজকের ডাকেই চিঠি যাওয়া চাই।”

অবধূত বলিল, “দেখলে ঘোষাল, কেমন কাঁচা মন, এক কথার বিশ্বাস, এক কথায় অবিশ্বাস!”

চক্রবর্তী পড়িতে লাগিল—”

“এই মহাশক্তিশালী কবচ আজকালকার বাজারে যথারীতি যজ্ঞাদির পর এক-একটি প্রস্তুত করিতে ২৫৫ টাকা ব্যয় হয়; কিন্তু একত্র পাইকারী হিসাবে বহু কবচ প্রস্তুত করায় আমরা ৩।/৫ টাকা সওয়া পাঁচ আনাতেই দিতে সমর্থ। তিনটি একত্র হইলে ৫।/ ৫ পাঁচ টাকা সওয়া পাঁচ আনা, এক ডজন ৮।/৫ আট টাকা সওয়া পাঁচ আনা।”

চৌধুরী মহাশয় কহিলেন, “তবে ঘোষাল, এক ডজনের অর্ডার দিতেই বল। শর্মা কিন্তু একটার বেশি ধারণ করবে না, তা বলে রাখছি অবধূত মশায়, হ্যাঁ। আমি অত ঢালোয়া বিশ্বাস করতে রাজী নই। নেহাত বলছেন আপনারা, প্রাচীন লোক—”

অবধূত বলিল, “হ্যাঃ—হ্যাঃ—হ্যাঃ, তোমরা যে দেবীমাহাত্ম্য মানছ, এই আমার বাপের ভাগ্যি; এখন রক্তের তেজ রয়েছে, হোক আমাদের মতো বয়েস, তখন আবার দেখব! বলে, কত নেড়ানেড়ীই কণ্ঠী ছিঁড়ে—”

গোসাঁই তেলে-বেগুনে জ্বলিয়া উঠিল। তিরিক্ষিভাবে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, “এসব কি কথা বলুন তো মহারাজ, কোথাকার একটা অর্বাচীন—”

চৌধুরী মহাশয় হাসিয়া বলিলেন, “আরে, বস বস। কেন অবধূত মশায়, এ নিরীহ বেচারীদের নিয়ে টানাটানি করেন?”

খানিকটা হাসি পড়িয়া গেল।

চক্রবর্তী পড়িতে লাগিল—

“বহু রাজা, মহারাজা, জমিদার এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারিদিগের অযাচিত প্রশংসাপত্রে আমাদের একখানি ঘর বোঝাই হইয়া গিয়াছে। আসিয়া পড়িয়া যাউন। স্থানাভাবে নিম্নে মাত্র কয়েকটি অনাড়ম্বর পত্র উদ্ধৃত হইল—”

১। গোরক্ষপুর জিলার অন্তর্গত কিষণগড় গ্রামের স্বনামধন্য জমিদার রায় বিন্ধ্যেশ্বরী সিংহ বাহাদুর লিখিতেছেন—”

“আমি আমার এক প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী জ্ঞাতির সহিত দেওয়ানি বাধাইয়া এলাহাবাদ কলিকাতা প্রভৃতি স্থান হইতে খ্যাতনামা উকিল-ব্যারিস্টার আনাইয়া সর্বস্বান্ত হইতে বসি। মকদ্দমা প্রিভি কাউন্সিলে উঠে; কিন্তু সেখানে সামান্য এক মোক্তারের হস্তে কেস দিয়া, এখানে স্বয়ং আপনার সর্ববিঘ্নহর কবচ ধারণ করি। জয়ী হইয়াছি। ব্যাটার নামে এবার ফৌজদারী চালাইব, কৃপা করিয়া আর তিনটি কবচ ভিঃ পিঃ যোগে পাঠাইয়া দিবেন।”

২। শ্রীহট্ট জিলার গৌরীপুরনিবাসী, কাশ্মীর স্টেটের ভূতপূর্ব কন্ট্রোলার সার্ অচ্যুতানন্দ সিংহ রায় লিখিতেছেন—”

“আপনার কবচের গুণ এক মুখে বর্ণনা করা যায় না। আমার কনিষ্ঠপুত্র শ্রীমান কালীকিঙ্কর দুই বৎসর যাবৎ নানা প্রকার অসুখে ভোগায় পরীক্ষায় ফেল হইয়া আসিতেছিল। এবারে চার মাস কাল শিলং পাহাড়ে থাকিয়া স্বাস্থ্যলাভ করিয়া উপযুক্ত পরিশ্রমে সমর্থ হইয়া পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষার তিন দিবস পূর্বে আপনার কবচের বিজ্ঞাপন দেখিয়া তাহাকে ধারণ করাই। বলা বাহুল্য, আশু ফল প্রাপ্ত হইয়াছি। ডাকযোগে আর একটি পাঠাইয়া তাহার স্কলারশিপ পাইবার পথ সুগম করিয়া দিবেন।”

৩। মেদিনীপুর কোটালিয়ানিবাসী শ্রীযুক্ত গঙ্গাধর ভড় পরম শ্রদ্ধাসহকারে লিখিতেছেন—”

“মহাশয়, কোটি কোটি প্রণাম গ্রহণ করিবেন। কয়েক দিবস হইল একটি বকনা হারাইয়া গিয়াছিল। দুইদিবস কোন সন্ধান পাইলাম না। পরে জানা গেল, নিরুদ্দেশ হইবার পূর্বে বকনাটি আমার কনিষ্ঠা কন্যার গলদেশবিলম্বিত সর্ববিঘ্নহর কবচ খাইয়া ফেলে। মহাশয়, ত্রিরাত্রিও অতীত হয় নাই—সকালে উঠিয়া গোয়ালে গিয়া দেখি, বুধী আসিয়া মায়ের দুধ টানিতেছে। এদিকে মেয়েটি অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছে। সত্বর আরও তিনটি কবচ পাঠাইয়া চিরবাধিত করিবেন।”

৪। মাইশোর গবর্মেন্টের ভূতপূর্ব অবসরপ্রাপ্ত চীফ মেডিক্যাল অফিসার—বর্তমানে নিখিল-ভারত থিয়সফিক্যাল ফেডারেশনের সহকারী সম্পাদক মেজর বাণলিঙ্গম্ পিলে আডায়ার হইতে লিখিতেছেন—”

“মহাশয়, ক্রমান্বয়ে কয়েকটি দৃষ্টান্তে আপনাদের সর্ববিঘ্নহর কবচের অলৌকিক আরোগ্যশক্তি দেখিয়া আমি চিকিৎসাশাস্ত্রে বীতরাগ হইয়া থিয়সফি অবলম্বন করিয়াছি। সূক্ষ্ম শক্তি বুদ্ধির জন্য এক ডজন কবচ পাঠাইয়া চিরানুগৃহীত করিবেন! ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

“বিশেষ দ্রষ্টব্য নং ১

“বিক্রয়লব্ধ যাবতীয় অর্থ আমাদের শ্রীশ্রীচণ্ডিমা আশ্রমের পরিচালন এবং উন্নতি সাধনে ব্যয়িত হইয়া থাকে।”

বিশেষ দ্রষ্টব্য নং ২—

“ইহার সহিত যাঁহারা আমাদের জগদ্বিখ্যাত স্বপ্নলব্ধ দদ্রুহুতাশন ক্রয় করিবেন, তাঁহাদের প্রত্যেককে কবচ অর্ধমূল্যে দেওয়া হইবে। মূল্য প্রতি কৌটা দশটাকা বার আনা মাত্র।

“হেড অফিস—শ্রীশ্রীচণ্ডিকা আশ্রম—ভৈরবগঞ্জ, জলপাইগুড়ি।

ব্র্যাঞ্চ

১৪ নং পাঁচু সদাগরের লেন, কলিকাতা।
১৭।১ দক্ষিণেশ্বরী গলি, ঢাকা।
১৪।৩।২ বৃত্রাসুর স্ট্রীট, বেনারস।”

চৌধুরী মহাশয় বলিলেন, “আর, হ্যাঁ, দেখ ঘোষাল, বলো, নায়েব মশাই যেন লিখে দেন, ওর মধ্যে একটা কবচ বিশেষ করে মকদ্দমা জেতার মন্ত্র দিয়ে যেন শোধন করে দেওয়া হয়। ওর সঙ্গে আর দদ্রুহুতাশন এনে কাজ নেই, কি বলেন অবধূত মশায়? মাহাত্ম্য নষ্ট করে দেবে শেষে!”

.

সাড়ে-তিন-আনির দল সান্ধ্যভ্রমণে বাহির হইয়াছিল। পিছনে দুই-একটি করিয়া জুটিতে জুটিতে নয়-আনির দল পুষ্ট হইয়া উঠিল। প্রথমে উভয় দলেই খানিকক্ষণ গুজগুজ ফুসফুস চলিল, তাহার পর সাড়ে-তিন-আনির একজন নিজের দলের অনিশ্চিত একজনকে লক্ষ্য করিয়া গলা চড়াইয়া বলিল, “ওহে, মেড়াটা লড়াইয়ে, একবার শিঙ ভেঙেছে বলে তুমি যে হাল ছেড়ে দিলে! ভাঙা শিঙে একটা কবচ বেঁধে রে―রে—রে করে ছেড়ে দাও দিকিন একবার।”

সেদিন রাত্রের মজলিসে ঘোষাল কথায় কথায় অবধূতকে বলিল, “নাতিটা বালসিছে কদিন থেকে; একবার পায়ের ধুলো দিয়ে আসতে পারবেন না?”

অবধূত অতিমাত্র সংক্ষুব্ধ চিত্তে হাতজোড় করিয়া বলিল, “মাপ কর দাদা, সাড়ে- তিন-আনির বাড়ির সামনে দিয়ে আমায় আর কোথাও যেতে বলো না। ভালো হয়ে যাবে’খন, আমি এইখান থেকেই আশীর্বাদ করছি।”

চৌধুরী মহাশয় সাগ্রহে প্রশ্ন করিলেন, “কেন অবধূত মশাই, কি হল?”

অবধূত অত্যন্ত জেদাজেদির পর বলিল, “তা হলে বল হে ঘোষাল, তুমিও তো ছিলে। আমি বলতে গেলে আবার রাগ চাপতে পারব না, কাজ কি?”

“যতদিন সাড়ে-তিন-আনি বেঁচে আছে, ততদিন আর আপনার দেবদেবী, কবচ-টবচ মেনে কাজ নেই মহারাজ।”—বলিয়া ভূমিকা করিয়া ঘোষাল সম্পূর্ণ নিজের ভাব এবং অলঙ্কার দিয়া সাড়ে-তিন-আনির দলঘটিত ক্ষুদ্র ব্যাপারটি এমন গুছাইয়া সামনে ধরিল যে, সেটা মোটেই আর ক্ষুদ্র রহিল না। এমন কি তাহার নিজের মনেও আপসোস হইতে লাগিল যে, কেন সে এতদিন যাত্রার পালা বাঁধিতে চেষ্টা করে নাই।

পরদিন গ্রামটা কি একটা ব্যাপারে প্রতীক্ষায় নীরব উৎকণ্ঠায় সমস্ত দিবসটা যাপন করিল। নয়-আনির দল প্রথমে সান্ধ্যভ্রমণে বাহির হইল, সঙ্গে লাঠি হাতে কয়েকজন ইতর- শ্রেণীর লোক।

কাল ইহারা যেমন করিয়া জুটিয়াছিল, সেরূপ ভাবে আজ সাড়ে-তিন-আনির দলটা অল্পে অল্পে পিছনে জমাট বাঁধিয়া উঠিল। লাঠিও দেখা গেল।

বড় দলই প্রথমে মুখ খুলিল। একজন, বিশেষ কাহাকেও সম্বোধন না করিয়া কহিল, “হ্যাঁ হে, একটা এঁদো পাঁদাড়ের বুনো শুয়োরে ঐরাবতকে একটা খোঁচা মেরে নাকি বরাহ অবতার হয়ে পড়েছে? লাঠির চোটে দাঁত দুটা ভেঙে দাও না।”

সাড়ে-তিন-আনির পক্ষের একজন, নিজের দলের পানে চাহিয়া অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সহিত বলিল, “হ্যাঁ হে, চারটে ঠ্যাং আর একটা শুঁড় আছে বলে এঁদো ডোবার মশাও নাকি হাতির পংক্তিতে উঠল? আবার যে-সে হাতি নয়, ঐরাবত!”

একজন বলিল, “ন-আনি ঐরাবত কেমন হয় একবার দেখতে ইচ্ছে করছে।” অপর একজন উত্তর করিল, “গর্দভবৎ হবে আর কি।”

একটা হাসির হররা উঠিল; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সেই বিকশিত দন্ত-পংক্তিরাজির একটিতে সজোরে আসিয়া একটা ইটের ঢেলা পড়িয়া সমস্ত দলের হাসির স্রোতটা একেবারে বন্ধ করিয়া দিল। তাহার পর চারিদিকে চটাপট পটাপট শব্দ হইতে লাগিল এবং লাঠি, ইট, চড়, কিলের আর লেখাজোখা রহিল না। মিনিট পাঁচেক দাঙ্গা চলিল, দশ-বারো জন জমি লইল, বাকি সব অদৃশ্য হইয়া গেল।

চৌধুরী মহাশয়ের লোক ঘোড়ায় চড়িয়া তৈয়ার ছিল, স্বপক্ষীয়দের মধ্যে যাহারা জখম হইয়াছে, তাহাদের নাম লইয়া থানায় ডায়েরি করিতে ছুটিল। ডায়েরি করার ঘটনা পূর্ব হইতে সাজানো ছিল, তাহার সহিত প্রকৃত ঘটনার বিশেষ কোনো সম্বন্ধ ছিল না। দুই দিন পূর্বে ‘কারণে’র মাত্রাধিক্যে অবধূত পড়িয়া গিয়া মাথার খানিকটা ফাটাইয়া ফেলিয়াছিল, সেটা দেখাইয়া বলিল, “আর আমার মাথার এই লাঠির ঘা-টাও লিখিয়ে দেবে, ইঞ্চি-টিঞ্চি সব আন্দাজ করে নাও।”

গোসাঁই বলিল, “আপনি তো অকুস্থানে ছিলেন না মশায়!”

অবধূত দাঁত-মুখ খিঁচাইয়া বলিল, “আর তুমি থেকেই বা কটা চোট আনতে পেরেছ? বুদ্ধি থাকলে যোগাসনে বসেও দাঙ্গা করা চলে; কলকাঠি কে চালাচ্ছিল? দু দিন ওষুধ লাগানো বন্ধ করি, কি বল হে গদাধর? সব দৈব অনুগ্রহ হে—মকদ্দমা হু-হু করে ছুটে চলবে। নিরীহ বিষয়নির্লিপ্ত সন্ন্যাসীর গায়ে হাত।”

চৌধুরী মহাশয় বলিলেন, “একটা ছটাক খানেক দেওয়ানি জিতে পাপে মেতে উঠেছে, না হলে জগদম্বার সেবকের গায়ে হাত দিতে যায়! মকদ্দমা একটু ভালো করে তদ্বির করতে হবে কিন্তু অবধূত মশায়; চক্রবর্তী, হালদার, ঘোষাল, তোমরাই সব দেখেছ। আর গোঁসাই, অবধূত মশায়ের সঙ্গে খেঁচামেচি না করে এদিকটা একটু সামলাও।”

অবধূত বলিল, “তুমি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোও গিয়ে বাপু, এ আমাদের নিজের কাজ, বলতে হবে না। কাল উঠে শুধু একবার কবচটা ধারণ করে নিও, ব্যস। হ্যাঁ, নায়েব মশায়কে ডেকে একবার আজ রাত্রে পুজোর বন্দোবস্তটা ভালো করে করে দিতে বল, সারারাত্রিটা এখানে কাটাতে হবে। আজ ধেনোয় কুলুবে না, বিলিতীর হুকুম করে দাও, সব বেটী ডাকিনীদের একটা পার্টি দোব। তোমরা কে কে সব আসছ? গোসাঁই? আরে, শ্যাম শ্যামা একই, যোগিনীগুলোকে গোপিনী ধরে নিলেই হবে।”

সকলেই আসিবে বলিল, তর্কালঙ্কার নাকে খানিকটা নস্য ঠুসিয়া দিয়া বলিল, “কাল অঁবদি গুটি বারো ব্রাভ্যল ভোজল করিয়ে দিলে হয় লা? বঁহারাজ কবচটা পরছেল, বঁকদ্দবাঁটাও দায়ের হবে—দু দুটি শুভকাজ।”

মহারাজ হাসিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, তা হবে; তর্কালঙ্কারের ক্রমাগত নাকে মুখে গুঁজতে পারলেই হল। সাড়ে-তিন-আনির শ্রাদ্ধের ভোজটার দিকেও নজর রেখো। আর আদালতে মন্তরগুলো যেন গোলমাল না হয়ে যায়!

সকলে খুব হাসিতে লাগিল। অবধূত শুধু গম্ভীরভাবে রহিল; হাসি থামিয়া গেলে বলিল, “আপসোস হয় গদাধর, যদি লেখার চর্চাটা একটু একটু রেখে যেতে;—সেই ভারতচন্দ্র,মরেছে অবধি দেশে একটা লিখিয়ে হল না। তোমার কথার যেমন ছাঁদ, যেমন বাঁধুনি—”

চৌধুরী মহাশয় বলিলেন, “ও চর্চাটা আগে কিছু কিছু করে এসেছি অবধূত মশায়; বাংলাকে আর একটা বিদ্যাসুন্দর দোব ভেবেছিলাম, তা এই সাড়ে-তিন-আনির উপদ্রবে আর হয়ে উঠল না। কবচটা কাল এসে পড়বে তো? সেই এক চিন্তা! জগদম্বার ভরসাতেই এই হাঙ্গামাটা তো বাধানো গেল!”

ঘোষাল বলিল, “সে ভাবনা ভাববেন না মহারাজ, তাঁর কাজ তিনি করে যাবেন। এত বড় জগৎ-সংসারটা চালাচ্ছে কে? চাই কি আজও এসে পড়তে পারেন। একটা লোককে তো পোস্ট আপিসে দৌড় করিয়ে দিয়েছি?”

অবধূত কপালে যুক্তকর ঠেকাইয়া বলিল, “তারা শিবসুন্দরী, দেখো মা, তুমিই একদিন বড় মুখ করে বলেছ, যদা যদাহি ধর্মস্য—কি যে ছাই ভুলে যাচ্ছি, ভারতে আজ অধম সন্তানেরা সেই ভরসাতেই এই ছোটখাটো কুরুক্ষেত্রটুকু করতে সাহসী হয়েছে। বলি, কুরুপক্ষে কজন ঘায়েল হল, হ্যাঁ ঘোষাল?”

চৌধুরী মহাশয় “অনেকগুলো। একটা নাকি আবার হাসপাতালে ধুঁকছে। আমি বলি কি, অবধূত মশায়, জোড়া কবচ ধারণ করলে হয় না?”

অবধূত বলিল, “পাকা কাজ হয়; তবে দুটো অনুষ্ঠান করতে হবে, এই যা। ডবল খরচ পড়বে।”

তর্কালঙ্কার বলিল, “আর সেই সঙ্গে ব্রাভ্যল বারোর জায়গায় চব্বিশটি করে দিতে হবে। আমি বলি, বঁহারাজ লিষ্ঠাভাল চারজল বেছে লিয়ে তাদেরই ছ দিল—কি যে বলে— সেবা করিয়ে দিল লা; চার ছয় চব্বিশ—সোজা হিসেবে পঁড়ে রয়েছে।”

বেচারাম পোদ্দার ‘কুরুক্ষেত্রে’ একটা ঢিল খাইয়াছিল, খিঁচাইয়া বলিল, “ত্যাখান থেকে সেরেফ খাই-খাই করছ ঠাকুর, কাজের সময় ছেলে কোথাকে?”

হালদার উত্তর করিল, “তবে তু ব্যাটারা আছিস কি করতে র‍্যা? আ মর্। আয়, কাজে কর্মে ব্রাহ্ম ভোজনের পাটটা তোরাই তুলে নে; আমরা লাঠি খেয়ে পড়ে থাকি। আ মর, আমাদের কাজটা যেন কাজই নয়! কলিকাল আর বলেছে কেন!”

অনেক রাত্রি পর্যন্ত সকলে মিলিয়া মকদ্দমার ফন্দি আঁটা হইল। কে কে সাক্ষ্য দিবে, কোন কোন উকিলকে নিযুক্ত করিয়া ফেলিতে হইবে, এবং ওপক্ষে যাহাদের নিযুক্ত করা হইবে, তাহাদের হাতে রাখিবার উপায় কি? নূতন জজ আসিয়াছে, টোপ ফেলিয়া দেখিলে হয় না? ও তরফের সাক্ষী কে কে হইল? তাহাদের বাড়িতে ভূতের উপদ্রব, চোরের উপদ্রব, লঙ্কাকাণ্ড, এসব হওয়া চাই—যেটা নিরস্ত হয়। তারপর ঘুষঘাষ, পথ আগলানো, এসব আছে। মকদ্দমা জিতের দিন সদর হইতে শোভাযাত্রা করিয়া আসিতে হইবে। সাড়ে- তিন-আনির দেউড়ির নিকট দিয়া আসিলে চাই কি গরম গরম একটা লাগিয়া যাইতেও পারে।

উঠিবার সময় অবধূত বলিল, “রাজসূয় যজ্ঞ ফেঁদেছ গদাধর, দেশে একটা কীর্তি রইল। কিছু ভাবনা নেই, খালি বিশ্বাসটুকু রেখে যেও, ওইটুকু হারিয়ো না। তারা শিবসুন্দরী!”

.

মোকদ্দমা সেশনে উঠিয়াছে এবং মকদ্দমার তদারকের জন্য চৌধুরী মহাশয়, ঘোষালাদি পারিষদবর্গের সহিত শহরের বাগান-বাড়িতে আসিয়া উঠিয়াছেন;

উভয় পক্ষের উকিলই উভয় পক্ষকে খুবই আশা দিয়াছে। সরকারি পক্ষের উকিল রায় বাহাদুর জয়হরি মণ্ডল অত্যন্ত আশ্চর্য হইয়া গিয়াছেন। সন্ন্যাসী-ফকিরের গায়ে হাত! মহারাণীর ঘোষণার মূল কথা—”আমরা তোমাদের ধর্মে হাত দোব না, আর তুই কোথাকার একটা কে, অত বড় একটা ধর্মের পাণ্ডার কপাল ফাটিয়ে বসলি একেবারে। এ মকদ্দমা আর যায় কোথায়! তবে তাঁর নিজের হাতে গণ্ডা দেড়েক কেস রয়েছে, তাই জামাইকে সঙ্গে না নিলে সামলে উঠতে পারবেন না। ইত্যাদি।

ও-পক্ষের উকিল ও-পক্ষকে বলিয়াছে, “ও ব্যাটা অদ্ভুত যখন এর মধ্যে রয়েছে, তখন আর ভাবনা নেই। নতুন সাহেব ধর্ম-বিটকেলগুলোর ওপর হাড়ে হাড়ে চটা; দেশে কুলপাদ্রীর সঙ্গে কি নিয়ে নাকি কবে একবার খিটিমিটি হয়েছিল, তাকে তো আর এখানে পায় না, রাগটি গিয়ে পড়েছে এই পুরুত, অবধূত, নাগাদের উপর। জেল তো কলির নৈমিষারণ্য করে তুলেছে। এদিকে মাসখানেক থেকে কোনও ব্যাটাকে না পেয়ে খিঁচিয়ে আছে; ব্যাটা অবধূতকে একবার দেখতে পেলে হয়! কাউন্টার কেসও আনতে হবে না, এমনিই মিথ্যে সাক্ষীর চার্জ দিয়ে জেলে পুরে দেবে’খন। মজাটা দেখুন না। আর অন্য জুনিয়ার নিতে হবে না, ছেলেটা নতুন জয়েন করেছে, বাপ-ব্যাটার মকদ্দমা তুড়িতে উড়িয়ে দোব। তার আবার ধর্মসংস্কার, ভারত-উদ্ধার এই সব বাই আছে, এক রকম এমনিতেই এ মকদ্দমার কাজ করে দেবে’খন। ইত্যাদি।

তাহা সত্ত্বেও ও-পক্ষের একজন ভালো ব্যারিস্টার যোগাড় করিবার জন্য কলিকাতায় লোক ছুটিয়াছে। চৌধুরী মহাশয়েরও ইচ্ছা ছিল, একজন সাহেব ব্যারিস্টার মোতায়েন করেন। অবধূত হইতে দেয় নাই, সাহেবও নয়, বাঙালীও নয়। একবার বেশি রকম বুজরুকি করার জন্য নিজের তরফের ব্যারিস্টারের কাছেই বেয়াড়া রকম ধমক খাইয়া তাহার ও- জাতটার উপরই বিতৃষ্ণা ধরিয়া গিয়াছিল। বলিল, “এইটে ছেলেমানুষি করছ গদাধর; তোমাদের নব্যদের এই তো দোষ। এর মধ্যে কেরেস্তানি ব্যাপার এনে ফেললে কি হবে, তা ভেবে দেখেছ কি? কবচের ওই ঐশিক শক্তি বিরূপ হয়ে অশেষ অনিষ্ট সাধন করতে পারে। কবচ দুটো ধারণ করলে, এখন একটু স্থির হয়ে না হয় জগদম্বার সেবকদের ব্যারিস্টারিটুকুই দেখে যাও না। তোমাদের কি মত হে?”

চক্রবর্তী, তর্কালঙ্কার, ঘোষাল, হালদার প্রভৃতি সকলেই অবধূতকে সমর্থন করিল। ঘোষাল তো আবার “কাল স্বপ্ন দেখলাম, মা যেন— বলিয়া একটা লম্বা-চওড়া ব্যারিস্টার-বিরোধী স্বপ্নকাহিনী সদ্য সদ্য আবৃত্তি করিয়া দিল।

ব্যারিস্টারের বদলে আরও একটা কবচ ধারণই সাব্যস্ত হইল। অবধূত কহিল “আর কিছু নয়, এই ত্রয়ী শক্তির যোগে ও-তরফে একটা সে রকম অঘটন না ঘটে যায়! শুধু মকদ্দমাটুকু হারিয়েই ছেড়ে দিলে বাঁচি। আমায় এই হিংসাদ্বেষের মধ্যে মা যে কেন টান দেয়! ব্যারিস্টারের একদিনকার ফী বেটীদের সব ভাগ-বাঁটরা করে দিতে হবে; সেটার একটা অর্ডার করে দিয়ো। মেলা ফাঁকি দিয়ে ওদের কাছ থেকে কাজ বাগিয়ে নেওয়াটা ঠিক নয়।” তর্কালঙ্কার বলিল, “তিল বারং ছত্রিশটা ব্রাঁভ্যল হল বঁহারাজ, বলেল তো আমি লা হয় রাজপুরীতে গিয়ে বসে বসে এই কাজটা সারি গিয়ে, ওটাও তো অলুষ্ঠালের একটা অঙ্গ।”

নিম্ন আদালতে নস্য-অপভ্রষ্ট উচ্চারণের জন্য তাহাকে ম্যাজিস্ট্রেট হইতে শপথ করাইবার মহা-পুরোহিত পিয়নটি পর্যন্ত, সকলেরই ধমকানি খাইতে হইয়াছিল। সে এই সামনের ভাবী এজাহারের কথা ভাবিয়া দারুণ মনোকষ্টে কাটাইতেছিল এবং একটু ফুরসত পাইলে ‘নেমন্তন্ন’ ‘পরমান্ন’ প্রভৃতি কয়েকটি কথা লইয়া ‘ন’কে ‘ন’ এবং ‘ম’কে ‘ম’ বলিবার চেষ্টার প্রাণপণে কসরত করিতেছিল।

এদিকে যাগ, যজ্ঞ, হোম অনুষ্ঠানের চোটে পাড়ার লোকে অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছে। বাজারে মদের দর চড়িয়া গিয়াছে। সমস্ত রাত বাড়িটার অমানুষিক ‘মা’ ‘মা’ শব্দ এবং অসংলগ্ন অট্টহাস ও কান্নার মিশ্র কলরোল সকলের একটা আতঙ্ক দাঁড় করাইয়া দিয়াছে। মাঝে মাঝে ‘লাগাও’ ‘ফৌজদারী’ ‘সাড়ে-তিন-আনি’ ‘শির লে আও’ শব্দে এই বিকৃত তান্ত্রিক আচারকে লোকের কাছে আরও ভীতিপ্রদ করিয়া তোলে।

সকালে কাহারও আর দীর্ঘপথ বাহিয়া উকিলের বাড়িতে তালিম লইতে যাইবার অবস্থা থাকে না। অবধূত বিধান দিয়াছে, “এ একটা পীঠস্থান হয়ে গেল; উকিলই এখানে এসে রোজ হাজরি দিয়ে যাক।”

সরকারি উকিলের স্বয়ং আসা অসম্ভব; প্রতিভূস্বরূপ জামাই আসিয়াছিল। সকলের খামারির ঝোঁকে তাহার যেরূপ রঙবেরঙের অভ্যর্থনা হইল, তাহাতে সে বেচারী একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া সেই যে পাড়ি মারিয়াছে, আর এমুখো হয় নাই। গাড়ি হইতে নামিতেই চক্রবর্তী টলিতে টলিতে গিয়া, তাহার চিবুক ধরিয়া মাথা দুলাইয়া বলিল, “আহা, রাই এসেছেন অভিসারে, প্রেম শেখাতে শ্যামকিশোরে! এস, বাপ এস।” অবধূত গাঁজার ছিলিম নামাইয়া প্রথমে পরিচয় এবং উদ্দেশ্য জানিয়া লইল। তাহার পর জবাফুলের মতো চক্ষু দুইটি পাকাইয়া জড়িত কণ্ঠে বলিল, “কি? আমায় তালিম দেবে মর্তের জীব! নেকালো।”

ছোকরা নেহাত ক্ষীণজীবী এবং অল্পপ্রাণ; কম্পিত পদে বাহির হইয়া যাইতেছিল। চৌধুরী মহাশয় অর্ধনগ্ন অবস্থায় তাহাকে বুকে জড়াইয়া একেবারে ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিয়া বলিলেন, “বাবাজী, অভিমান করো না। আহা, অবধূত মশায়, এই ননীর পুতুলকে কটু কথা বললেন! জয়হরিবাবুর জামাই, এ যে আমার নিজেরই, আমার ছোট ভাইয়েরও বেশি।”

এই অবস্থায় মোকদ্দমার অবস্থা যেমন হওয়া উচিত, তেমনই হইতে লাগিল। প্রথম দিনের শুনানিতে চক্রবর্তী, তর্কালঙ্কার আর কয়েকটা লোকের এজাহার হইল। ইহারা শিক্ষা- মোতাবেক অনেকটা গুছাইয়া বলিল, চক্রবর্তী কিন্তু প্রকৃত ঘটনা এবং সাজানো মকদ্দমার কিছু কিছু লইয়া একটা তালগোল পাকাইয়া ফেলিল। তর্কালঙ্কার একে স্বভাবতই বোকা গোছের, তাহার উপর ক্রমাগত ধমক খাইতে খাইতে এমন সব কথা বলিয়া নামিয়া আসিল, যাহা সাজানো মকদ্দমায় পাওয়া যায় না এবং প্রকৃত ঘটনাতেও কস্মিনকালে ঘটে নাই।

অবধূত আসিয়া রিপোর্ট দিল, “শুনছি, খাসা এজাহার হয়েছে। তর্কালঙ্কারের টিকি ছেঁড়ার কথায় আমাদের তরফের জুরি নাকি লাফিয়েই উঠেছিল। হুঁ-ব্বাবা, টিকি ছেঁড়ে নি তো, বিদ্যুতের তার ছিঁড়েছে, লঙ্কাকাণ্ড করে তবে ছাড়বে।”

“হ্যাঁ, তাকে আর এক দফা কিছু পাঠিয়ে দিয়ো, লোকটা বড় সাচ্চা লোক হে— আমাদের তরফের জুরির কথা বলছি। একটা কথা কিন্তু কেমন ঠেকছে; বাজারে গুজব, জজ সাহেব নাকি ও-তরফের ঘুষ নিয়েছে। তোমাদের কি রকম মনে হল হে তর্কালঙ্কার?” তর্কালঙ্কার চটিয়াই ছিল, বিশেষ করিয়া জজ সাহেবের উপর; ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত খানিকটা নস্য ঠুসিয়া ঝাঁঝিয়া বলিল, “ও আর বলে হওয়া-হওয়ি কি? আলবত লিয়েছে, ইতর ব্যাটা, ব্রাঁভ্যল-পণ্ডিতের সঙ্গে এই আচরল! ব্যাটা ম্লেস্য! ও-ব্যাটা ব্যালেস্টারটাও মোটা ঘঁষ—লা, ও তো ওদেরই লোক।”—বলিয়া অপ্রতিভ হইয়া চুপ করিয়া গেল।

চৌধুরী মহাশয়ের রাত্রের নেশাটা অনেকটা কাটিয়া গিয়াছিল; অবধূত আর তর্কালঙ্কারের কথায় হঠাৎ চমক লাগিয়া বাকিটুকুও ঝাঁ করিয়া মিলাইয়া গেল। মাঝ-কপালে ভূ তুলিয়া বিহ্বলভাবে বলিলেন, “সে কি? এ তো ভালো কথা নয় অবধূত মশায়; আমরা এতগুলো টাকা ঢাললাম, নিজের হাতে দিয়ে এলেন আপনারা—”  

অবধূত বলিল, “হ্যাঁ, দিয়ে এসেছি বইকি। পাছে কারুর সন্দেহ হয়, তাই গোঁসাইকে সঙ্গে নিলাম, যার সঙ্গে আমার এক তিল বনে না। ভাবলাম, না, টাকাকড়ির ব্যাপার। তা এমন কিছু চিন্তিত হবার কারণ নেই। রায় এ তরফে দিতেই হবে। ও কি দেবে? দেবেন যিনি, তিনি তোমার কবচগুলোর মধ্যে বিরাজ করছেন। শুধু বিশ্বাসটুকু রেখে যেয়ো, এটুকু গেলেই আর সামলাতে পারব না। আজ রাত্রে বশীকরণের মন্ত্রটাকে জাগিয়ে তুলতে হবে।”

চক্রবর্তী বশীকরণের কটি মানেই জানিত, জিজ্ঞাসুনেত্রে চাহিল। তাহার মনের ভাব বুঝিয়া অবধূত হাসিয়া কহিল, “ওহে, সে সব কিছু নয়, দেখ দিকিন গেরো! সাহেব, চীনেম্যান, কাবুলী, দারোগা—এদেরও বশীকরণের বিধান শাস্ত্রে আছে, যাকে হিপ্‌নটিজম্ বলে। তোমার চক্কোত্তি রসিক আছে গদাধর।”

চক্রবর্তী আত্মপ্রসাদে গদগদ হইয়া বলিল, “মহারাজের সভায় ওই করে চুল পাকালাম—”

চৌধুরী মহাশয় দক্ষিণ বাহুর কবচটা মাথায় ঠেকাইয়া একটু ভীতভাবে বলিলেন, “মা’র পাদপদ্মে বিশ্বাস বরাবরই আছে। সেদিন যা বলেছিলাম, সে কথার কথা, সেইটুকুই কি মা ধরে বসে থাকবেন? বড়ই বেইজ্জত হব তা হলে।”

অবধূত কহিল, “অত ভেবো না; কাল আমার এজাহার, একবার পরিচয়টা দিয়ে আসব’খন। ফিরিঙ্গীর পো বুঝতে পারবেন, হ্যাঁ।”

পরের দিন হালদার, গোসাঁই আর অবধূতের পালা ছিল। হালদার অবধূতের নামে অকথ্য গালি দিতে দিতে এজলাস হইতে বাহির হইল। ঘোষাল গুছাইয়া বলিবার ক্ষমতা দেখাইতে গিয়াছিল, ফলে যাহা দাঁড়াইয়াছিল তাহা স্মরণ করিয়া তাহার বাস্ফূর্তিই হইল না। গোসাঁই ভেজালের মধ্যে যায় নাই; ‘হ্যাঁ’, ‘না’, ‘মনে নাই’–এর উপর সমস্ত জেরাটা কাটাইয়া দিয়া লম্বা এক সেলাম ঠুকিয়া চলিয়া আসিয়াছে। অবধূত নিজের পরিচয় একটু বেশি রকম দিয়া ফেলিয়াছে—জজ, জুরি আর ব্যারিস্টার মিলিয়া সযত্নে পরিচয় বাহির করিয়াই লইয়াছে বলা চলে! সে মালা জপিতে জপিতে বাহিরে আসিয়া এক ছিলিম চড়াইয়া তবে ধাতস্থ হইল। তাহার পর আবার বাকি সকলকে ভুজং-ভাজং দিয়া ঠাণ্ডা করিয়া বাসায় লইয়া গেল।

প্রথমে আস্তে আস্তে পূজার ঘরে গিয়া তাহাদের চাঙ্গা করিয়া হুজুরে হাজির হইল। ঘোষালের দিকে চাহিয়া বলিল, “দেখলে ঘোষাল, এজাহার কাকে বলে? আমায় আবার সেই ঘরজামাই ব্যাটা তালিম দিতে এসেছিল, যার গলা টিপলে দুধ বেরোয়! তোমরা দুজনেও তো ভেলকি দেখিয়ে দিলে হে, অ্যাঁ! আর গোঁসাইজীর পেটেও এত ছিল! আমি জানতাম, নেহাত গোবেচারী, চড়াইডাঙার জলের গুণ আর কি!”

“কিন্তু দেখলে ব্যাটা জুরিদের কাণ্ড? আমার তো মনে হয়, মবলগ খেয়েছে সব। তোদের আবার অত জেরা করার ধুম কেন রে বাপু? কেউ মাস্টার, ছেলে ঠেঙাস; কেউ বেনে-বকাল, দাঁড়িপাল্লা নিয়ে থাকিস; কি বুঝিস তোরা মকদ্দমার?”

শেষের কথাগুলিতে চৌধুরী মহাশয় উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, “আজ আবার এ কি কথা অবধূত মশায়? একটাকে তো কবচ পর্যন্ত পরানো হল, মা কি শেষ পর্যন্ত—” অবধূত বলিল, “শেষ পর্যন্ত মা দেখবেনই,—আপীল আছে, প্রিভি কাউন্সিল আছে। আর কালকের আশাই ছাড়তে হবে নাকি? না হয় ব্যাটারা খেয়েছেই ঘুষ; মা তো আর—”

চক্রবর্তী শেষ করিল, “মা তো আর ঘুষ খাবার মেয়ে নন।”

ঘোষাল সায় দিল, “এই।”

চক্রবর্তী বলিল, “ইংরিজি ব্যান্ডের বায়না হয়ে গেছে; না, আমার মন বলছে, যেন সাড়ে তিন-আনির মুখে চুনকালি পড়বেই। নিন, সবাই এক এক পেগ ঢালুন দিকি; ওসব অলুক্ষুণে কথা ভাবতে নেই। গোঁসাইয়ের এক চুমুক চলবে নাকি?”

এই রকমে জোড়াতাড়া দিয়া পরদিন দুপুর পর্যন্ত অবসরটা সবাই মিলিয়া জমাইয়া রাখিল। যথাসময়ে হালদার, চক্রবর্তী, অবধূত প্রভৃতি সকলে ফোঁটাচন্দন কাটিয়া মকদ্দমার রায় শুনিতে গেল।

শুনিয়া ফিরিয়া আসিল শুধু তর্কালঙ্কার। কাঁপিতে কাঁপিতে গিয়া হুজুরে হাজির হইল। মকদ্দমার রায়ের খবর তাহার পূর্বেই চৌধুরী মহাশয়ের কানে পৌঁছিয়া গিয়াছে।

চৌধুরী মহাশয় হুঙ্কার করিয়া উঠিলেন, “রামবুঝাওন সিং, হান্টার আর অবধূতকো হাজির করো।”

তর্কালঙ্কার বলিল, “আজ্ঞে, তিনি হিবালয়ে গেছেল, আপীলের জন্যে যোগসাধল করতে।”

চৌধুরী মহাশয় নির্বাক বিস্ময়ে চাহিয়া রহিলেন। রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, “আচ্ছা, লে আও হারামজাদা চক্কোত্তিকো।”

তর্কালঙ্কার কহিল, “তিনি বললেন—কাঁবাক্ষ্যাতে ধল্লা দিতে চঁল্লুব, আর—আর—”

চৌধুরী হান্টারে এক টঙ্কার দিয়া বলিলেন, “হ্যাঁ, ‘আর’ কি, বল না? তোমার গুষ্টির শ্রাদ্ধ করেছে?”

তর্কালঙ্কারের হাঁটুতে হাঁটুতে ঠুকিয়া যাইতেছিল! কহিল “আর হাঁলদার বঁশাই আর ঘোঁষাল বললে—আপীলে লা জেঁতা পর্যন্ত এ বুখ আর সঁবাজে বের করব লা।”

স্থান—চড়াইডাঙার জমিদার-ভবন; কাল—উক্ত ঘটনার মাসখানেকের পর। পাত্রমিত্র-পরিবৃত হইয়া গদাধর পাল চৌধুরী সভাস্থলে আসীন।

ঘোষাল আছে, চক্রবর্তী আছে, হালদার আছে, তর্কালঙ্কার আছে; গোঁসাই নাই, আর নাই অবধূত, তাহাদের স্মৃতিটুকু পড়িয়া আছে; আর সেই স্মৃতিটুকুকে উদ্দেশ করিয়া চৌধুরী মহাশয় মাঝে মাঝে বাছা বাছা অকথ্য ঝাড়িতেছেন।

এমন সময় ডাকপিওন আসিয়া একটা বাংলা সাপ্তাহিক এবং দুইখানা হাকিমী ও কবিরাজী ঔষধের আর একখানা শরসন্ধাননিরত কামদেবের ছবিওয়ালা বটতলা- পাব্লিকেশনের ক্যাটালগ দিয়া গেল। চৌধুরী মহাশয় সাপ্তাহিকটার বহর সামলাইতে পারেন না বলিয়া নিজে কখনও খোলেন না। সভ্যসদ্ববর্গের সামনে ফেলিয়া দিয়া নিজে বটতলা- পাব্লিকেশনের ক্যাটালগটা খুলিয়া দেখিতে লাগিলেন।

কাগজের ভাঁজ খুলিতে খুলিতে চক্রবর্তী হঠাৎ এক জায়গায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া খানিকক্ষণ ধরিয়া পড়িল; তাহার পর মুখ তুলিয়া বলিল, “ওঃ, ব্যাটা কি ধড়িবাজ। তোমায় আমি সেই দিনই বলেছিলাম ঘোষাল—”

চৌধুরী মহাশয় আস্তে আস্তে মাথা ঘুরাইয়া নিরুদ্বিগ্নভাবে প্রশ্ন করিলেন, “কি হল আবার?”

“গবর্মেন্ট, অবদূত আর গোঁসাইয়ের নামে হুলিয়া করেছে, পলাতক জেল-আসামী তারা, ওসব জলপাইগুড়ির চণ্ডিকা আশ্রম, কবচ দদ্রুস্থতাশন—সব তাদেরই কাণ্ড। তার আগে নাকি দুজনে কোথা এক করাচিতে সাইকেল আর ঘড়ি মেরামতের দোকান—”

চৌধুরী মহাশয় শিহরিয়া উঠিলেন, “দুজনেই!”

ঘোষালও বিস্মিত হইয়া বলিল, “দুজনেই! এখানে তারা যে পাঁচ মাসের মধ্যে একটা দিনও আপসের মধ্যে গালাগালি না করে জল খায় নি! উঃ, ব্যাটারা…! তা আমার যেন বরাবরই কেমন-কেমন ঠেকছিল।”

হালদার বলিল, “আমি তো কদিন থেকে যেন কেমন-কেমন ভাব লক্ষ্য করছিলাম।”

তর্কালঙ্কার আরম্ভ করিল, “আঁবারও গোঁড়াগুড়িই এঁকটা সঁ দেহ—”

চৌধুরী যে রাগে ফুলিতেছিলেন, ইহারা কেহ লক্ষ্য করে নাই। তর্কালঙ্কার শেষ না করিতেই চিৎকার করিয়া উঠিলেন, “আর আমি শালা দুনিয়ার বেকুব হলাম, না? রাম- বুঝাওন সিং, ই সব সবজান্তা হারামজাদা লোগকো নিকালো, নিকালো আভি!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *